এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • টইপত্তর  স্মৃতিচারণ   নস্টালজিয়া

  • হারানো লেখা : বাংলালাইভ

    Archive
    স্মৃতিচারণ | নস্টালজিয়া | ২১ নভেম্বর ২০২৩ | ৫৯১৮ বার পঠিত | রেটিং ৫ (১ জন)
  • কালের নিয়মে বেশ কিছু ওয়েবসাইট থেকে নানান লেখাপত্র হারিয়ে গিয়েছে। তার কিছু আর্কাইভ ডট অর্গ এর ওয়েব্যাক মেসিন থেকে উদ্ধার করা সম্ভব। এরকম সাইটের সংখ্যা কম নয়। হারানো লেখাপত্তরও অসংখ্য। উদ্ধারসম্ভব লেখা সে তুলনায় নগন্য। এরকম সাইটের কথা মনে করিয়ে দিতে পারেন পাঠকেরা, এখানেই।
     গুরুচণ্ডা৯ শুরুর আগে থেকে যে সাইটে আড্ডা তক্কাতক্কি মাখা বাংলা লেখালেখি, সেটা বাংলালাইভ। সেও ইউনিকোডের আগের পৃথিবী। তার ফন্টের নাম : BanglaFontNormal.ttf যেমন গুরুর ফন্টের নাম ছিল Banglaplain.ttf
    সেখানের হারিয়ে যাওয়া লেখার যেটুকু যা পাওয়া যায় এই টইতেই তুলে রাখব ভেবেছি। এরকম অন্য সাইটের কথা মনে পড়লে সেই সাইট স্পেসিফিক অন্য টইও খোলা যাবে। 
    গুরুর হারানো লেখাপত্তর গুরুর রোবোটেরা আর্কাইভ থেকে খুঁজে নেবেন আশা করি। তার জন্য আলাদা স্পেসিফিক টই ও রয়েছে। আমি আর সে চেষ্টা করছি না।
    এই লিংক থেকে বাংলাপ্লেন ও বাংলাফন্টনর্মাল এর টেকস্ট ইউনিকোডে কনভার্ট করা যায়। সেভাবেই এই উদ্ধারকার্য চলবে। অনবধানে কিছু ইংরিজিতে লেখা শব্দ কনভার্ট হয়ে অদ্ভুত অক্ষরসমষ্টি হয়ে যেতে পারে। এই ট্রান্সলিটারেশন পাতায় আবার ইউনিকোড থেকে বাংলাপ্লেন-এ সেই অক্ষরসমষ্টি কে কনভার্ট করে নিলেই মূল ইংরাজি টেকস্টটা পাওয়া যাবে। 
    কালাতিক্রম দোষ মেনে নিয়ে ইচ্ছাকৃতভাবেই সবচেয়ে প্রিয় লেখাটিকে প্রথমে রাখব। 
     
    ===========================================================
     বিভাগ : গল্প, প্রকাশ : Jan 16 2006, আর্কাইভ লিংক
     
    নিহত অশ্বের স্বরলিপি
    ইন্দ্রনীল ঘোষদস্তিদার
      
    অশ্ব হইতে এ আখ্যানের আরম্ভ। অশ্ব স্বভাবত বেগবান, ইন্দ্রিয়জ। অশ্বময় দ্বীপরাষ্ট্র, প্লাবিত বেলাভূমি ও নারিকেলের বনমর্মর। তথায় বনবাসিনী, প্রশান্তসাগরীয় দ্বীপবালিকা, তাহার ভ্রুমধ্যে আনত উল্লাস, বঙ্কিম চপলতা ও রিনিঠিনি। পুষ্পসাজ। নৃত্যভঙ্গিমা।

    দেখিবেন, মানবী নৃত্যে উদ্যত হইলে দিবাকর তরল হয়েন, অস্তমিত হয়েন। আইল মেঘরাগ, ধাইল বর্ণচ্ছটা। দিনমণি সমুদ্রপারে, যেন বিগতস্পৃহ, সুখী, স্থবির যেহেতু প্লাবিত মনুষ্যরূপে। দেহসুখের, আনন্দভঙ্গিমার শীর্ষে মধ্যবিত্ততায় আক্রান্ত পদ্মবনের সততসতর্ক প্রহরী যেইরূপ। তাঁহার সপ্তাশ্বরথ সংবরণ করিলেন।

    অশ্বে প্রত্যাবর্তন হইল। তুরঙ্গ হইতে মুক্তি নাই। উহা ব্যতীত গতি নাই।

    অপিচ বিপন্ন অশ্ব। মন্থরগামী,যেহেতু গ্রামদেশে সন্ধ্যাযোগে আন্ধার ঘনাইল দ্রুত, বিজলি মিলিল না শত পিটিশনান্তে, শঙ্খ বাজে নাই, মুর্শিদাবাদী মুসলমানি গ্রাম, চেরাগ জ্বলিল দরগায়। কিশোর ছিন্ন পুস্তকখানি খুলিল। ইহা কুয়াশা হয়, এই বিপন্নতা, কর্তিত শস্যক্ষেত্রে অশ্ব একাকী চলিল পদব্রজে। কিঞ্চিৎ বিভ্রম, মস্তকোপরি মশকাদি পতঙ্গের ঘূর্ণমান বলয়। পাটকিলা অশ্বখানি যায়, শ্বেত অক্ষি, শ্বেত পুচ্ছ। রেললাইন পার হইতেছিল, এই লগ্নে ধাবমান যন্ত্রদানবের সহিত সংঘর্ষ রচিলে অজানা আশঙ্কা উতরোলে, গতি গতিরে গ্রাসিবে, মধ্যসাগরে নিম্নমেধা তরীদেহে সূক্ষ্ম কলরোল, উহাতে জালিকেরা শিহরিয়া সুপ্ত শিশুমুখ স্মরে, হা দরিয়ার পীর।

    কিন্তু কোথা হে যন্ত্র! আদিমতায় আক্রান্ত চরাচর, এই গ্রামরাষ্ট্র। গ্রামধরণী। সন্ধ্যাগমে খদ্যোতশাসিত  এ রজ:স্বলা রাত্রির নাগরচন্দ্রমা অথবা তাহার বিকল্পতা, শীতলতা ও গন্ধরাজের বিশীর্ণ সৌরভ, জলতন্ত্র হতে উঠিছে নিয়ত উদাসী বাষ্প, হিমে হিম , কদাচ অগ্নিতে দ্রব। নিন্দুকে আলেয়া বলে থাকে।

    এই সে বাষ্প, প্রণয়ে প্রখ্যাত, ইহারে স্মৃতি বলে-আবরিছে ভ্রম ও তাহার মহাপথ, পথিপার্শ্বস্থ চটি, তৃষ্ণা নিবারণের চায়ের বিপণী, গ্রামীণ, ভগ্ন। কুপি ও তাহার আলো, কেরোসিন শিখার শীর্ষ হইতে উত্থিত কালিমা, অশ্বটি চাহিয়া দেখে। দুইটি প্রাচীন মানব, প্রাচীন অস্থি, প্রাচীন বল্কল। এ পথে দেবানামপ্রিয়দর্শী অশোক একদা দিগ্বিজয়ে গিয়াছিলেন, নবদ্বীপমণি স্মার্ত রঘুনন্দন হাঁটিলেন, নিমাই পণ্ডিত আঁখিলোর ও প্রেমগানে ভিজাইলেন, পশ্চাদে কত শত পারিষদবর্গ, হরিবোলধ্বনি, ধৌত সফেদ ও পীত বস্ত্রাদি, পীত উত্তরীয় পিচ রাস্তায় লুটায় হে, কেশব ভারতী ঐ দেখ, দেখ নিত্যানন্দ মহাপ্রভুরে, যবন হরিদাসে আলিঙ্গনপাশে আবদ্ধ করিয়া কান্দে বিবিধমন্দ্রে। এ দুইটি মানব সাক্ষী। অক্ষয়বট সাক্ষী,অশ্ব তাহার শাখামূলে রজ্জুপাশে আবদ্ধ আছিল।

    আমি ভ্রমিয়া বেড়াই; ইহা দৈব, বিধিনির্দিষ্ট,অশ্বের পশ্চাতে মনুষ্য রাখিয়া দিগ্বিজয় সৃজন করিবেন প্রজাপতি। অশ্বমেধ যজ্ঞ। গান্ধার হইতে পৌন্ড্র, প্রাগজ্যোতিষপুর, মণিপুর, দ্রাবিড় বনাঞ্চল হইতে কাশ্মীর ব্যাপিয়া সুকেশিনী এ ফলভারানত জম্বুদ্বীপে অশ্বটির চলাচল। অব্যহত হউক, নির্বাধ হউক-রাষ্ট্র ইচ্ছিল ভারতে। সৃজিল রেশমপথ, ব্যবসায়, মধ্য এশীয় মরুবালু; তাহাতে বিকীর্ণ সূর্যতাপ, কি খর, কি যে ভানুমতী। অশ্ব, ঐ দেখ, তোমার করোটি বিদীর্ণ হয়ে আছে, মাংস নাই এক কণা, শবভোজী গৃধিনীকূলের উল্লাস দেখ, চক্রাকারে পাখসাট মারে, গিরিকন্দরে-কন্দরে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত হো-হো রব, তুরগ, হে প্রিয় প্রাণ, তুমিও কি অভিসম্পাতী আকাশে ক্ষণেক আত্মবিস্মৃত চাহিলে? বিস্মৃত বালুকা খনিয়া তুলিতে মৃত জনপদ জাগে, জাগে শুষ্ক চর্মাস্থিসার মৃত শরীর, কেহ শিশু, কেহ নারী, লম্পট ও অকৃতদার, সাধু ব্যক্তি তথা কুসীদজীবী, কাহারো মস্তক চূর্ণ, কত বা প্রাকার, বিশুষ্ক পয়:প্রণালী, নগরসভ্যতা, রত্ন আভরণ, মণিময় সিংহাসন-হা, কালের প্রহারে জীর্ণ। জাগে মৃত অশ্ব। অশ্বসভ্যতা। যাহারে ছাড়িয়া শুদ্ধোদনসুত আষাঢ়পূর্ণিমারাত্রে চলিলা, একাকী, নগরপ্রান্তে সভ্যতার গতিবাহী শ্লথ মূক পশু নীরবে ফিরিছে দেখ।

    হে গৌতম, অমৃতলোভী, হে আত্মদীপ, আমারে, এই কন্থক অশ্বটিরে কোথায় রাখিয়া গেলেন? কোন আস্তাবলে, কিবা সহিসী পীড়নে, এ পরদেশে কে রবে হায়! একদা ধান্যক্ষেত্র-জলাভূমির ই. এম বাইপাসে এ কোন মায়ারজ্জুপাশে আক্রান্ত , এ কি  হে বিভ্রম, নিয়ন আলোকিত বিলবোর্ডে যুবতী রমণীর চিক্কণ ঈশারা, বারিবিন্দু,বৃষ্টিবিন্দু, মদ্যপের কিঞ্চিদধিক আত্মার প্রগলভতায় ছয় কার্ষাপণে বিক্রিত হইলাম। নীলামবাজারে। পথে একটি  সারমেয় নাই, রাত্রিজীবী মোটরযানের হুসহাস শব্দ, হেডলাইটের বিষন্নতা, রঙ্গিলা নগরী ও ছায়াশরীরী গ্রামভারতের কাঁটাতারে উচ্চকিত বিসর্পিল সীমান্ত  বরাবর একাকী, জলহীন। নদীহীন। মধ্যরাত্রির নিরালোক নগরবাজারে গলিত আবর্জনা ও শল্কফলাদির স্তূপ,যৌনচিকিৎসার হ্যান্ডবিল উড়ে অসুখী বেতনহীন হাওয়ায়, ভ্রান্ত অশ্বত্থামা  খুঁজিয়া ফিরে শিরোমণি, লোকে পাগল বলিবে আগামী প্রভাতে। নগরীর ঘরে ঘরে কালান্তক শিশুঘাতী বাণে ভ্রূণগুলা গর্ভে শুখাইল, ভ্রূণপ্রশ্নে মনে আসে আমিও চলিব নাইটডিউটিতে, এই অশ্ব আমার বাহন, এই বি.টি রোড আমার  রাজসড়ক, রাত্রি আমার উদযাপন।

    তাই অশ্বে আরোহণ, তাই গতি, পাঁচমাথা ও নেতাজীমূর্তি ছাড়াইয়া, মানিকতলা পশ্চাতে ফেলিয়া, শিয়ালদহ রেলওয়ে স্টেশন বামে রাখিয়া আমি কর্মক্ষেত্রে , নীলরতন সরকার হাসপাতালে পৌঁছিলাম। অশ্ব হইতে অবতরণ করি, গতি নষ্ট হয়, স্থিরোভব,আমি সহজ হইলাম, হইতে থাকি, হয়েছি। লেবার রুমে ঢুকতে বমি পায়। এখনো পায়, এতদিন পরেও। আঁশটে গন্ধ। গন্ধ মানে মলিকিউল। অলফ্যাকটরি বাল্ব বেয়ে, কোটি কোটি নিউরোন বেয়ে কেমিক্যাল মেসেঞ্জার  বিদ্যুৎতরঙ্গ হয়ে চিঠিরা পৌঁছে যায় যে যার বেগুনি বাক্সে। অতিদূর সমুদ্রের মাঝখানে শ্যামলা, একহারা অরক্ষণীয়া দ্বীপে চার্চের স্ফটিক ঘন্টা বাজে পরাক্রমী হাওয়ায়,আর কি বা করবার থাকে ঘন্টা অথবা হাওয়ার! জনহীন দ্বীপ, গির্জার দেয়ালে ফ্রেস্কো, চিত্রবিচিত্র রঙ্গিন কাচে সমুদ্রের গুঁড়ো নুন। পচা মাছের গন্ধ, অনৈসর্গিক।

    ঘুম পায়, যে ঘুম আমি আশুপ্রসবিণীদের দিলাম; জন্মপদ্ধতিকে দিলাম। এই ভাঙা অ্যাম্ফিথিয়েটার, এর চারপাশে পাক খায় ঘর-গেরস্থালির কুকুর-বেড়ালেরা। প্ল্যাসেন্টা, ছিন্ন কর্ড, অ্যামনিওটিক ফ্লুইড ভেজানো ছোট ছোট সুখ মুখে নিয়ে তারিয়ে তারিয়ে জিভ চাটার স্বাধীনতা। চোখের আপত্তি হয়। ভালো কথা নয়।
    ভালো নয় এত অগণিত শিশুজন্ম। ভুলভাবে জন্মায় বাচ্চারা- গ্যারাজে, ভাঙা নৌকোয়, পরিত্যক্ত রানওয়েতে। কলতলায়, শ্যাওলা জমে পিছল। পিছল শিশুরা, গতজন্মের শিশুরা, গতজন্মের শ্যাওলা নিয়ে জন্মায়। জন্মদাগ নিয়ে। কেউ কেউ লেবার রুমেও জন্মায়। তারাও অসংখ্য , অগণন। শরীরের তুলনায় বড়সড় মাথা, হতদরিদ্র ঘিলু। ভাবে না, শোকতাপ নেই, কবচকুণ্ডলহীন শুধু জন্মে যাওয়া। বিস্ময় থাকে? যেমন বিস্ময়ে, কিঞ্চিৎ খেদে-অভিমানে, ভরা একাডেমির হিম স্টেজের মাঝখানে দাঁড়িয়ে গৌতম হালদার বলে উঠবেন-এ আমি কোথায় এলাম! জন্মাতেই থাকে ওরা। লাল, নীল, সবুজ, গোলাপি বাচ্চারা, বেলুনের মতো ফোলানো বাচ্চারা। বাচ্চাদের মতো দেখতে বেলুনেরা। এক এক সময় এত বাচ্চা জন্মে যায়, লেবার রুম থই থই করে। প্রতিটি তাকে, প্রত্যেকটা বাক্সে, আনাচে কানাচে, গলি-ঘুঁজিতে বাচ্চা। বাচ্চা ঝুলছে সিলিং ফ্যান থেকে। বাথরুমের কল খুললে ঝরে পড়ে বাচ্চারা। আমরা গ্লাভস পড়ার সময় পর্যন্ত পাই না, যন্ত্রের মতো ডেলিভারি করাই। সাবধানে পা ফেলি, মেঝের চারদিকে জমে উঠেছে বাচ্চার স্তূপ। ওরা হাসে, কুয়াশার ঝাউবনে একজন-দুজন করে মিলিয়ে যায়। শ্রেয়বোধে। মনস্তাপহীন।

    আমি শিশুময় দেখি পৃথিবী। বিগতজন্ম দেখি, সাইকেল দেখি। সন্দীপের সাইকেল। আমরা শীতের দুপুরে যাই, নীলগঞ্জ রোড খোলস ছাড়ে মন্থর বহুবল্লভা সাপিনীর মতো। দুপাশে মাইলের পর মাইল সর্ষেক্ষেত দেখি, আর নীল দিগন্ত। ফুলের আগুন বোঝাবেন রেজওয়ানা চৌধুরী। এই  বোঝা, আগলে রাখি একে, আমি আবার জন্মাই আর জন্মদ্বার দিয়ে বেরিয়ে আসার অনেক, অনেক পরে লেবার রুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকি। জন্মক্রিয়ার মধ্যে আবার, জন্ম আচারে। কেননা অগ্নিতে ঘৃত অর্পণ করিব, তৈলসিন্দূর, খই ছড়াইব। মাঝখান দিয়ে চলে গেছে অনন্ত নীলগঞ্জ রোড। দুপাশে বাচ্চাদের ক্ষেত, হলুদ ফুলে ঝকমক করছে। হা জীবন, এ আমি কোথায় এলাম!

    এইখনে নব্যেন্দুর সঙ্গে দেখা হবে। নব্যেন্দুর কেফালহেমাটোমা হয়, একটি দীর্ঘ প্রসবক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ডিসেম্বরের এক কুয়াশাময় রাত্রে নব্যেন্দুর মা ওদের দুজনকে মোচন করেন। নব্যেন্দুদের। বন্যা রাতের আহত মহানন্দার মত আপগার স্কোরের বিপদসীমা অতিক্রম করা ছাই-ছাই বর্ণ ফ্লপি হাত-পায়ের নব্যেন্দুকে বাঁচাতে  পারব ভাবিনি। পিত্তসবুজ মেকোনিয়াম শ্বাসনালীতে নিয়ে ফেলা নব্যেন্দু, শীতল নব্যেন্দুকে রিসাসিটেট করে বেবিকটে জীবনের উষ্ণতায় শোয়ানো হলে চোখ খুলে নব্যেন্দু বলে, কেমন আছেন, ইন্দ্রনীল?  
    নব্যেন্দু অর্থৎ নব্যেন্দু ১। ১, কেননা যে যার নিজস্ব সুবিধামত আমরা, ভাষাময় জীবিত প্রাণীকূল বেঁচে থাকাকে মৃত্যুর আগে স্থাপন করেছি এবং মৃত্যুকে জীবনের অপর হিসেবে দেখতে অভ্যাস করলাম। যুধিষ্ঠিরকে দ্রোণাচার্য বললেন-কি দেখছো, বাছা? যুধিষ্ঠির, সত্যবাদী ধর্মনিষ্ঠ, বললেন-সমগ্র বৃক্ষ। পক্ষীটি। উহার জননপদ্ধতি, মা-পাখির ডিমে তা দেওয়া। আমি উষ্ণতা দেখলাম, হে মহাগুরু। আমি শীতল সরীসৃপকেও  দেখলাম, ঐ যে গাছ বেয়ে উঠছে পাখির ডিমের লোভে। ঐ পক্ষীটি মহাব্যধিগ্রস্ত হইতেছে, কাল উহাকে হরণ করিবে, মহারাত্রি সকল দিনাবসানে আসিবেন ধ্রুবচরণে। তাঁহার নূপুরনিক্কণ শুনিলাম। জীবন সান্ত। ঐ রুনুঝুনু অনন্ত। এই বৃক্ষ বিনষ্ট হইবে, আপনি বিনষ্ট হইবেন, ঐ কোটরস্থিত শাবককূল, রথীবৃন্দ, পদাতিককূল, ধার্তরাষ্ট্রগণ, পান্ডবসেনানী ও যদুবংশ। মুষল প্রসব করিবেন শাম্ব। দ্রোণ বিরক্ত হলেন। অর্জুন এসে বলল, আমি পাখির চোখ দেখছি। সফলতা দেখছি। দ্রোণ খুশি হলেন। অর্জুন প্রথম হল। একনম্বর। আমরা জীবনকে প্রথম করে দিলাম। তেজী ও বেগবান বাজিরাজি তাঁহার রথে নিযুক্ত করিলাম, যদুপতি স্বয়ং সারথ্য স্বীকার করিলেন। অশ্বগণের হৃদয়ের পরিমাপ তো কেহ লইল না। তাই ১ নম্বর। দ্বিতীয়  নব্যেন্দু তো কাগজ, তামাগন্ধী, সব  লেখা মুছে যাওয়া প্যাপিরাস, ভুর্জপত্র যাহা হইতে বিধাতা তাঁহার স্বাক্ষর প্রত্যাহার করিলেন, দত্তাপহারক। ফিটাস প্যাপিরাসিয়াস। নব্যেন্দু থেকে গেলো। অনন্ত এপিসিওটমির ফাঁকে ফাঁকে, অগণিত জন্মসহায়তার ফাঁকে ফাঁকে আমরা গল্প করতাম, নব্যেন্দু আমাকে লেখালিখি করতে বলত। উস্কানি দিত সবসময়। আমি বলতাম,-গল্প বলুন, নব্যেন্দু। নব্যেন্দু খুশি হত, বলতো- ঘোড়ার গল্প শুনুন তবে।

    আদিতে ছিল ঘোড়া। ঘোড়ার  ধবধবে সাদা রং, যেন বরফের ফুল, নাকের ফুটোদুটো গোলাপি। যেখানে পাথরে পাথরে টুং টাং আওয়াজ করে ছোট্ট দস্যি মেয়ের মতো রুপোলি ঝর্না নেমে আসছে, দুধারে ঝুঁকে পড়েছে ঘন সবুজ সব গাছ, যাদের ফাঁকফোকর দিয়ে রোদ্দুর এসে পড়ে কি পড়ে না, ঘোড়া সেখনে জল খেতে যেত। শীতে গাছের পাতারা হলদে হত, লাল হত, ঝরে পড়তো রাশি রাশি, আর কিশোরী মেয়ে ঝর্না তাদের ছোট্ট ছোট্ট ঢেউয়ের মাথায় মাথায় নাচিয়ে নিয়ে ফেলত নদীতে, নদী বয়ে নিয়ে যেত সমুদ্রে। ঘোড়া সেখানে কোনদিন যায়নি। সেখানে হলুদ বালি, কালচে পাথরের খাঁজে বাসা বেঁধেছে সাদা সাদা পাখি, গোলাপি ছানারা না-ফোটা চোখ নিয়ে সোরগোল করলে মা-পাখি সমুদ্রের মাছ ধরে এনে খাওয়ায়। বসন্তে ছোট্ট, মিষ্টি, হলদে-সাদা-গোলাপি ফুলে ভরে যেত সবুজ ঘাসে ভরা পাহাড়ের ঢাল। ঘোড়া ঘাস খেতে খেতে একলা চোখে কোন দূরের দিকে যে তাকাত ! গলার কাছটাতে কি একটা সুর গুণগুণিয়ে উঠেই থেমে যেত। গাছেরা  বলত-গান গাও, ঘাসফুলেরা বলত গান গাও, পাখিরা বলত-গান গাও, ঘোড়া। হায়, ঘোড়া গান গাইতে শেখেনি!

    একদিন আর থাকতে না পেরে বিধাতার কাছে গিয়ে আর্জি জানাল সে। একলা লাগে বড়, আমাকে একজন বন্ধু দিন, সারাদিন আমায় গান শোনাবে। গান গাওয়া তো হল না আমার।
    বিধাতা তখন ঘোড়ার  বাঁ পাঁজরের হাড় থেকে সৃষ্টি করলেন মানুষ। মানুষ গান নিয়ে এল পৃথিবীতে, মেঘ-আলো-নীল পাহাড়ের গান, কাঠবেড়ালীর গান। ঘোড়া আর মানুষ দিব্যি সুখে থাকতে লাগল। কিন্তু মাটির তলার সাপ, সবুজ রং, চেরা জিভ- ও কেন প্রায়ই মানুষের সংগে দেখা করতে আসে, ফিসফিস করে কথা বলতে চায়? প্রথম প্রথম রেগেমেগে তাড়িয়ে দিত মানুষ। একদিন আর তাড়াল না। পরদিন ভোরে যখন পুবদিক লালচে, পাখিরা প্রার্থনা গাইছে, হলদে ব্যাঙ টুপ করে লাফিয়ে পড়ল জলে, মানুষ ঘুম থেকে উঠে ঘোড়াকে বলল-আমায় স্বর্গের বাগানে নিয়ে যাবে?

    নিষিদ্ধ বাগান, যাওয়া বারণ। ঘোড়া অনেকবার বোঝাল, অনুনয়-বিনয় করল; মানুষ কিন্তু একগুঁয়ে, জেদি, নাছোড়বান্দা। তাছাড়া কিছু তো আর ছুঁচ্ছি না, দেখব শুধু চেয়ে। অগত্যা দু:খী ঘোড়া, মানুষ-ভাইয়ের ভালোবাসায় কাহিল ঘোড়া মাথা নিচু করে ভাইকে নিয়ে চলল বাগান দেখতে। এই শর্তে যে বাগানের একটা পাতাতেও হাত দেওয়া চলবে না।

    রাত নামলে মেঘের ডানায় ভর করে সবুজ অন্ধকারের মতো গর্তের সাপ উড়ে গেল, বিধাতার বাগানের অমৃতফলটি, বিধাতার প্রিয় অমৃতফলটি মুখে করে ফিরে আসবে বলে। আর পরদিন ভোরবেলা বিধাতা উঠে দেখলেন অমৃতবৃক্ষ ফলহীন, বাগানময় ঘোড়ার পায়ের ছাপ।

    শাপগ্রস্ত হল সেদিন থেকে ঘোড়া। আদিগন্ত সাভানায় ঘুরে বেড়ানোর মতো পায়ে কুটিল ধাতুর নাল চেপে বসল। মানুষের মনসবদার হল ঘোড়া।

    এই সে অশ্বপুরাণ, ইন্দ্রনীল, ইহা একান্ত মানবিক হইল, অশ্বে এ দায় অর্পণ।  স্বাধীনতার এইরূপ হনন।
    আসুন, নিহত স্বাধীনতার উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালন  করি। ফুলের তোড়া জমে উঠুক, সুগন্ধী মোম জ্বলুক। অর্ধনমিত রাখি পতাকা।

    জ্বলুক তবে মোম। জ্বলুক জ্বলুক চিতার অনল। গণচিতায় শুয়ে অছে টুইন টাওয়ারের ক্যাজুয়ালটি, লন্ডন  বোমার ছিন্নহাত ছিন্নমুণ্ড লাশ। জ্বলুক তবে বাগদাদ, জ্বলুক কান্দাহার। লাফিয়ে উঠুক পতাকা, উর্ধশির আলোকশিখা। সাম্য , মৈত্রী, স্বাধীনতা। কোল্যাটারাল ড্যামেজ। দুর্দান্ত স্প্যানিশ ইস্পাত ঝিকিয়ে উঠুক দক্ষিণ মহাদেশের কোস্টলাইন বরাবর, যখন দাবানল ঘিরছে সকল ঘুমের গ্রাম। স্থিরপায়ে, অবহেলাময়। আমাদের একটা দেশ ছিল। সবুজ দেশ। তামার খনি ছিল। আমাদের ছিল বর্ণমালা, সহজ, মোটাসোটা, ঝোলা স্তন। কালো মেয়েরা যেমন হয়। নিষাদ ও নি:সংশয় পুরুষ ছিল, দেবতাত্মা বৃক্ষ ছিল। ঘুমের গ্রাম।

    ঘুমের জলে ভেসে উঠি আমরা, একটি অ্যামিবাসদৃশ প্রাণ। একোহং। বহুষ্যাম। বহু হইব বলিয়া বিভাজিত হইলাম, আমি ও নব্যেন্দু। নব্যেন্দুগণ। এক নিউক্লিয়াস বহু হইল, দুই পৃথক কোষপুঞ্জ হইলাম, দুই পরিপূরক সত্ত্বা। দুই  ভ্রাতা, সহোদর। ক্রমে জল নামিল, দেখা দিল স্থলভাগ। আমরা মৎস্য আছিলাম, স্থল ক্রমেই বাড়িতেছে বলিয়া উভচর হইলাম, সরীসৃপ, পক্ষী ও মেরুদণ্ডী হইলাম। নব্যেন্দু, সরল নব্যেন্দু, গতিপ্রত্যাশী নব্যেন্দু অশ্ব হইবার লাগিল। কেননা ছুটে বেড়াবার জন্য রয়েছে  অনন্ত প্রান্তর, অনন্ত গ্রহ। আর আমি, এ চারণভূমির গান গাহিব বলিয়া, স্বাধীনতার মোহিনী দেবীর বাতায়নতলে দীপশিখাময় প্রেমগান গাহিব বলিয়া  ত্রুবাদুর হইলাম, মনুষ্যস্বরূপ।

    ফিটাস প্যাপিরাসিয়াসের জন্মরহস্য জানেন? যমজ প্রাণযুগলের একটি যখন প্রবল হয়ে ওঠে, মাতৃগর্ভে তখনও, শুষে নেয় সকল অম্লজান, প্রত্যেক পুষ্টিকণিকা যা ঐ আমবিলিক্যাল কর্ড বেয়ে সমধারে  নেমে এসে দ্বিধাবিভক্ত হওয়ার কথা ছিল। কথা ছিল এক মিছিলে সমানতালে হাঁটবার, এক নদীতীরে সূর্যাস্ত দেখবার। হায়, সে আলোর ফলে কীটরূপী তক্ষক প্রবেশ করিলেন, আমি আত্ম-পর ভেদ শিখিলাম। দেখতে দেখতে ফুলেফেঁপে  উঠি আমি, প্লেথোরিক শিশু। আর নব্যেন্দু, প্রাণবিহনে, মেঘজলবিহনে  যেন ধানের বুকের দুগ্ধবিন্দু, শুকিয়ে কঙ্কালসার। বলিরেখাময়, জরাজীর্ণ। প্রাচীন  অশ্বের মমি, মিশরীয়। সুদূর।

    এইভাবে জন্ম নিলাম আমরা, ইন্দ্রনীল, আমি ও নব্যেন্দু-নব্যেন্দু আমাকে বলে। প্লেথোরিক  শিশু। নব্যেন্দু ১। অন্য  নব্যেন্দু  তো কাগজ, তামাগন্ধী, সব লেখা  মুছে যাওয়া প্যাপিরাস।

    রাত শেষ হয়। ডিউটি শেষ হয়, কাজ তো অনন্ত  নয়। আমি দিনের আলোয় বাড়ি ফিরি। সহজ, সাধারণ  মানুষ যেভাবে  ফেরে। ট্রেনে ওঠে, সিট পেলে বসে। তাস খেলে, গল্প করে। রুমালে ঘাম মোছে। তারপর নেমে যায় যে যার নিজস্ব স্টেশনে।

    কুয়াশার  মধ্যে অথবা দিনের আলোয় জেগে ওঠে এক অন্য চরাচর। যেন আমার এই বাড়ি ফেরা মিথ্যা, এই রিক্সার ঘন্টি মিথ্যা। রিক্সাওয়ালার জালি গেঞ্জি নেই। হ্যান্ডেলে রানি মুখার্জির ছবি নেই। চারিদিকে জল, শুধু কূলহীন উন্মাদ জলরাশির মধ্যে , প্রলয়সাগরের মধ্যে নেমে আসছে মাতঙ্গী বৃষ্টির ধারা, ভীমা, ভয়ঙ্করী। আমি ডুবে যাই আকণ্ঠ, হায়, কাকে বলি রক্ষাশব্দ, একখানি ভগ্ন মাস্তুল, একটি নিষ্পরাগ ছিন্নদল পুষ্পও যে দৃষ্টিগোচর হইল না। যাপিত জীবন স্মরণ করি বিভ্রমে, সভয়ে, স্মরিলাম সকল ঋণ। মনে পড়ে ঐ প্রতীক্ষার মুখখানি, রেলব্রিজে, একা, বত্তিচেল্লির ভেনাস। ঐ সে শকুন্তলা, ঐ মিরান্দা। অসহ্য বোকা। ধূর্ত নাবিক, আমি এক ফার্দিনান্দ, আনখশির দুষ্মন্ত, সরে গেছি অকূল সাগরে আলোকবিন্দুসম দূরতম লাইটহাউসের দিকে। প্রতিশ্রুতি থেকে নিরাপদে বহুদূর।

    দিগন্তে কড়কড় শব্দে ক্ষণপ্রভা ঝলসে কালানলসম তেজে, ছিন্ন করিয়া এ প্রলয়াকাশ। সহসা অশ্বক্ষুরধ্বনি জাগিল  সঘন, জাগিল তীব্র হ্রেষাধ্বনি ভৈরবে। আকাশে, ভূতলে, পাতালে। সপ্তনরকে।

    হৃদয়কন্দরে গ্যালপ রিদম জাগিলে, বিষনীল সুখাবেশে মূর্ছিত হইবার পূর্বমুহূর্তে জানিলাম-আমিই সে নিহত অশ্বের সহোদর।

    অশ্ব আমাতে নিহিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • পাতা :
  • রঞ্জন রায় | 23.154.***.*** | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:৪৩741439
  • https://web.archive.org/web/20100103121343/http://banglalive.com/authorworks.asp?name=ra%60Njan%20raay
     
    কাদের মশালে আকাশের ভালে (২)
    রঞ্জন রায়

    প্রায় সমতল এক বিশাল মাঠ। চারদিকে বট-অশ্বত্থ, নিম-আম, পাকুড়-বয়রা-মহুয়ার ঝাড়-জঙ্গল। মাঝখানে অনেকটা ফাঁকা জায়গা। চারপাশে গাছে গাছে বাঁধা রয়েছে অসংখ্য মশাল। গাছের নীচে ছেলে-বুড়ো-মেয়ে-মদ্দ অনেক মানুষের জটলা।

    আর মাঝখানে প্রায় এরিনার মতো জায়গায় মাদলের তালে তালে নেচে চলেছে বেশ কয়েকটি নর্তকদল।

    আমরা এগিয়ে যাই, কাছে গিয়ে গানের কথা শোনার চেষ্টা করি। একটাই লাইন বা মুখড়া বার বার ঘুরে ফিরে আসায় কিছুটা বুঝতে পারলাম। একটু একঘেয়ে সুরে গান চলছে -- "তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না, তোলা দয়া লাগে --এ-এ-এ।' মাদল বাজছে -- "ধিতাং-ধিতাং-ধিতাং-ধিন, ধিতাং-ধিতাং-ধিতাং-ধিন।'

    -- দাঁড়াবেন না, চলুন আগে দেবস্থানে গিয়ে বসি।

    একটি বিশাল বটবৃক্ষের নীচে বাঁশের চাটাই, খড়ের চাল আর বেশরমের শুকনো ডাল দিয়ে ঘেরা খানিকটা জায়গা। বেশ ভাল করে গোবর দিয়ে লেপা। গোটা পাঁচেক প্রদীপ জ্বলছে, আর একটি হ্যাজাকবাতি। এই হল দেবস্থান। আদিবাসী "বৈগা-পুরোহিত' বসে। সামনে একটি ঘটে আম্রপল্লব-ধানের শীষ-দুব্বোঘাস, সিঁদুরফোঁটায় সাজানো। আমরা বিশেষ অতিথি, কাজেই একটি চাটাই বিছিয়ে দেওয়া হল।

    কিন্তু দেবস্থানে দেব কই? সরপঞ্চ বলেন -- ওই যে, কোণের দিকে, ভাল করে তাকিয়ে দেখুন।

    খানিকপরে চোখ সয়ে গেলে দেখতে পেলাম -- এবড়ো-খেবড়ো পাথরের টুকরোয় কাপড় দিয়ে মুড়িয়ে রাখা, সিঁদুরমাখা তিনটে মূর্তির মতো। এরাই হলেন বাররাজা, বাররাণী আর ঠাকুরদেব। খানিকক্ষণ বসে থেকে উসখুস করতে থাকি। হঠাৎ খালি গায়ে ধুতির খুঁট জড়িয়ে বসে থাকা কজন ছোকরার মধ্যে একজন বিকট চিৎকার করে গোঙাতে গোঙাতে মাটিতে ধুলোর মধ্যে মুখ ঘষতে লাগল। চারদিকে একটা ফুটবল মাঠে গো-ও-ল গোছের আওয়াজ উঠল। কি ব্যাপার? না, দেবতার ভর হয়েছে। সারা দিন এরা উপোস করে মানত করে ছিল, দেবতা কখন দয়া করে ওদের ওপর চড়াও হবেন। তা এতক্ষণে তিনি সদয় হয়েছেন।

    বৈগা ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। কিন্তু ও শান্ত হচ্ছে না। তখন কেউ মাথায় ঠান্ডা জল ঢালতে লাগল, আস্তে আস্তে ওর শরীর মোচড়ানো শান্ত হতে লাগল, দেবতার জয়-জয়কারে অন্ধকার কেঁপে উঠল।

    দেবতা? কিন্তু কোন দেবতা? পুরোহিত প্রশ্ন করলে জানা গেল -- আমি বার-রাজা।

    আমি অর্জুন গুরুজির হাতের মুদ্রা দেখে উঠব উঠব করছি -- এমন সময় আমার বাঁদিকে আবার গোঙানির আওয়াজ। আরেকজনের ওপর দেবতার ভর! এবার কে? বৈগা আমাকে ইশারায় ধৈর্য ধরতে বললেন। আগে তো দেবতার প্রকোপ একাটু কম হোক। কিন্তু কম হবে কি? তার আগেই আরও দুজনের শরীর মোচড়ানো শুরু হয়ে গেল। ভিড় ছেয়ে ফেলল দেবস্থান। নাচের সামনে আর দর্শক নেই।

    -- তুমি কে?

    -- আমি, আমি?

    -- ঠিক করে বল, আমি আদেশ করছি। বৈগা তুম্‌হে হুকম্‌ দেতা হ্যায়।

    -- আমি ঠাকুরদেব। আমি ঠাকুরদেব।

    -- বেশ, বাররাজা এসেছেন, ঠাকুরদেবও এলেন, কিন্তু বাররাণী কই? উনি এলে তবে তো পুজো সম্পূর্ণ হবে। মনোকামনা পূর্ণ হবে? আর আপনি কে গো? তৃতীয় ভগবান? আপনিই কি বাররাণী?

    ভিড় উত্তেজিত, চারদিকে হঠাৎ শ্মশানঘাটের নিস্তব্ধতা।

    -- না, আমি বাররাজা।

    জনতা হৈ-হৈ করে ওঠে। না-না, বাররাজা তো আগেই হাজির হয়েছে, সব্বার আগে যার ভর হয়েছিল। নিরুপায় হয়ে নবীন ভক্তটি চেঁচায় -- ও জাল বাররাজা। আমি আসল।

    ওদিকে ঝিমিয়ে পড়া প্রথম বাররাজা গর্জন করে ওঠে -- আমিই আসল; আপনারা পরীক্ষা নিন, কে আসল, কে নকল। সব "দুধ-কা-দুধ, পানী-কা-পানী' হয়ে যাব। ভক্তদের হট্টগোলে কানপাতা দায়। অর্জুন গুরুজি আমার শালের কোঁচা ধরে টান লাগান। -- "আরে চলুন, চলুন, আপনি কি পুরো মেলা দেখতে এসেছেন না কি খালি ভর দেখতে?'

    আমরা এগিয়ে যাই, নাচের দলগুলোকে পাশ কাটাই।

    -- কই, আপনার বারনাচা কেমন যেন ঝিমিয়ে-পড়া লাগছে। যেমনটি শুনেছিলাম তেমন কিছুই তো মনে হল না।

    -- দাঁড়ান, দাঁড়ান, রাত্তির বারোটা বাজুক, মেয়েদের নাচের দল নামুক, তবে তো রক্তে দোলা লাগবে! তখন দেখবেন এই ঝিমিয়ে পড়া দলগুলো এমন চাঙ্গা হয়ে উঠবে যে --

    -- ও বাবা! আপনার কাব্যি করার ঝোঁক আছে নাকি? তা এই গানটার মানে বলে দিন না?

    -- তা নয়। কাব্যি-টাব্যি নয়। বায়োলজি পড়াই তো। ময়ূর নাচে কেন? ময়ূরীর মন ভোলাতে। সেই ময়ূরীই যদি না এল --।

    এবার ছোটে বাবুসা'ব "উদ্যমেশ্বর শরণ মণিপাল প্রতাপ সিং' মুখ খোলেন।

    -- বুঝলেন না? এ হল নিদয়া প্রকৃতি দেবীর বন্দনা। এখানে চাষ হয় বাবা আদমের জমানার পদ্ধতিতে। ধানের বীজ ভেজা ক্ষেতে ছিটিয়ে দেওয়া হয়, যাকে বলে "ছিরকাই'। তারপর ফার্টিলাইজার দেওয়ার বালাই নেই। ভরা বর্ষায় পাহাড় থেকে যে ঢল নামে তাতে যা মিনারেল এসে জমিতে মেশে -- ব্যস। ফলে বর্ষা না হলে গেল। না পাবে ক্ষেতে কোনও কাজ, না জুটবে খাবার। ঝুপড়ি ঘরে শেকল তুলে মাই-পিলা-আন্ডাবাচ্চা সব নিয়ে আড়কাঠির যোগাযোগে এরা পালাবে হরিয়ানা-জম্মু-কাশ্মীর, ইটভাটায় কাজ করতে।

    আমার গলা শুকিয়ে আসে, একটু শীত শীত করতে থাকে। বলি -- একটু চায়ের জোগাড়?

    অর্জুন গুরুজি বলেন --- আরে, মেলা বলে কথা! সব আছে। ওই হ্যাজাক জ্বলা ছোট ছোট ঠেলাগুলোর দিকে চলুন।

    কালো ন্যাকড়ায় ছাঁকা বারে বারে ফোটানো কড়ি-মিঠি চা। আমরা মুখ বেঁকিয়ে বলে থাকি, -- ল্যাংগোট চা। তা এই শীতে বড় ভাল লাগল। আর এক কাপ খেলে হয়। হঠাৎ চোখে পড়ে ব্যাঙ্কের চাপরাশি -- মেলারাম যাদব। চোখে চোখ পড়তেই অপ্রস্তুত হয়ে নমস্কার করল।

    -- কি রে! তুইও বারনাচা দেখতে এসেছিস?

    ও আমতা আমতা করে। -- না, মানে চায়ের এই দুটো ঠেলা আমার আর ছোট ভাইয়ের। মানে কদিন একটু একস্ট্রা কামাই।

    -- ঠিক আছে। ঠিক আছে।

    আমরা ওকে আশ্বস্ত করে এগিয়ে যাই। -- আরে, আমরা মাত্র তিনজন? গেঁজেল গুরুজি আর ধীরহে স্যার কোথায় গেল?

    -- চলুন, চলুন, এই মেলায় কেউ কারও জন্যে অপেক্ষা করে না। এখানে সবাই ভিড়ের মধ্যে একলা হয়ে নিজের মতো করে আনন্দ খোঁজে। আপনি চিন্তা করবেন না।

    -- মানে?

    -- মানে ধীরহে গুরুজি গেছে মেলার সীমানার বাইরে হাঁড়ি ভরে যে ঘরে-তৈরি মহুয়া বিক্রি হচ্ছে তার হিসেব-নিকেশ দেখতে।

    ওইসব হ্যান্ডলুম ইন্ডাস্ট্রিতে ওনারও অংশীদারী আছে যে!

    -- আর গেঁজেল দেবাংগনগুরুজি?

    -- ওনার কথা ছাড়ুন, উনি গিয়েছেন মনোকামনা পূর্ণ করতে। কাল সকালে ফেরার সময় আবার ঝাঁকের কই ঝাঁকে ফিরবে। তার চেয়ে চলুন ওই কোণায় ছত্তিশগড়ি লোকগীতির ভিড়ে।

    ঢোলক, মঞ্জীরা আর বক্স-হারমোনিয়ম। গাছের ওপরের মশালের আলোর কালো ধোঁয়া হাওয়ায় কেঁপে কেঁপে ওঠে। একটি ছেলে আর মেয়ে। ছেলেটি গাইছে --
    "নদিয়া কে পার মা, পরদেশি গাঁও মা, লাগে হ্যায় অব্বর এক মেলা,
    আজা টুরি, ঝুলবে তঁয় ঝুলা।'
    মেয়েটির জবাব --
    "শাস-শ্বশুর সঙ্গ হ্যায়, দাই-দদা সঙ্গ হ্যায়, কেইসে ঝুলাবে তঁয় মোলা?
    ও সঙ্গী, কেইসে ঝুলাবে তঁয় মোলা!'

    (-- নদীর পারে ভিনগাঁয়েতে বসেছে এক মেলা, আয় লো মেয়ে, দোলাবো তোর ঝোলা।
    -- শাস-শ্বশুর যে সঙ্গে যাবে, বাপ-মাও যে সঙ্গী হবে, কেমন করে দিবি আমায় দোলা?)

    ও বাবা! এ যে একেবারে পরকীয়া প্রেম, তা'বেশ। গান থামে, এরা দম নেয়। আমরা এগিয়ে যাই।

    একটা কোসম গাছের নীচে হ্যাজাকবাতি। ব্যানজো বাজছে। মাথায় রঙিন কাগজের ফুল আর গায়ে রঙিন জ্যাকেট পরে ব্যানজো বাদক গাইছে -- -- "তু বিলাসপুরকি টুরি, অউ ম্যাঁয় হুঁ রায়গড়িয়া,
    তোলা-মোলা জোড়ি, বনী হ্যায় বরবরিয়া।'

    সঙ্গিনীটি ভ্রুভঙ্গি করল। তারপর গেয়ে উঠল -- "ম্যাঁয় বিলাসপুর কি টুরি, অউ তু হ্যাঁয় রায়গড়িয়া,
    তোলা-মোলা জোড়ি, বনেগী বরবরিয়া'।

    ("তুমি বিলাসপুরের মেয়ে, আমার রায়গড়ে যে বাসা, তোমার আমার জোড়া দেখে বলবে সবাই খাসা।') তারপর নাচে ঠুমকো লাগিয়ে মাহোল জমিয়ে দিয়েছে। হাততালি আর সিটির শব্দে কানপাতা দায়।

    -- এইসব নকল লোকগীত ছত্তিশগড়ি গানের মর্যাদা নষ্ট করছে, চলুন এগিয়ে যাই।

    উদ্যমেশ্বরশরণ বলে উঠলেন। আমরাও উঠব উঠব করছি এমন সময় -- রাম রাম, সাহাব, রাম রাম গুরুজি! কেয়া বাত? আপসব ইয়ে আদিবাসীয়োঁকি বারনাচা দেখনে আয়ে? আরে দেশ কা ক্যা হোগা?'

    দেখি, গাঁয়ের নগরশেঠ রামবিলাস আগরওয়াল। আবার সঙ্গে একটি হরিণচোখি বছর বিশেকের নজরকাড়া মেয়ে।

    আমি বলি -- "আপনিও তো এসেছেন, মশাই!'

    -- "আরে, আমার কতা ছাড়ুন। আমি হলাম গে --'। আগরওয়াল চোখ টিপে অর্থপূর্ণ হাসেন। আমরা জবাব দিই না। কিন্তু অর্জুন গুরুজির মেজাজ বেশ তিরিক্ষি। -- "ভাল লক্ষণ নয়, আবার গতবারের মতো লফড়া না হয়।' -- সে আবার কি? উনি ব্যাখ্যা করেন। এ মেলায় মদ খেয়ে হুল্লোড় করা বারণ, বেলেল্লাপনা বারণ। গতবার কাঠগোড়া থেকে এক সিন্ধি ব্যবসাদারের ছেলে মাতাল হয়ে এসে একটি মেয়ের হাত ধরে টানাটানি করে। তারপর জনগণ তাকে পেঁদিয়ে বিন্দাবন দেখিয়ে দেয়। এ বছর আগেভাগেই ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। এ-কদিন কোনও ঝামেলা হয়নি। আজ শেষরাত্তির কিছু না হলেই ভাল হয়।

    -- ঝামেলা কেন হবে? আপনি কিছু মনে করবেন না -- আমি একেবারে অন্ধ নই। চায়ের দোকানের পাশে, লোকগীতের আসরের এদিক-সেদিকে বেশ কিছু জোড়ার অর্থপূর্ণ হাসি। আর চোখের ইশারা আমার চোখে পড়েছে। তাহলে সিন্ধি-মাড়োয়ারির দোষ কি? শেষে ওই আদিবাসী আর গ্যর-আদিবাসী? নিজের বেলায় আঁটিশুঁটি, পরের বেলায় দাঁতকপাটি?

    -- ধেত্তেরি! আপনার শহুরে মন! কিস্‌সু বোঝেননি। কিসের আদিবাসী আর অনাদিবাসী? শুনুন, এখানে মেয়েদের ওপর জোর-জবরদস্তি করা বারণ। আদিবাসী সমাজে রেপ হয় না। এই উৎসব আপনাদের বিলাসপুর-রায়পুরের দুগ্গোপুজোর মতো, বা রোববারের চার্চে যাওয়ার মতো। ছেলেছোকরারা একটু আস্কারা পায়, মেয়েরাও একটু আস্কারা দেয়। গাঁওবুড়ারা চোখ বুজে থাকেন। হেথায় নয়নে নয়ন মেলে। আর বারনাচের ফাঁকে বেশকটি জোড়া উধাও হয়। তাদের মধ্যে কেউ কেউ আবার বিয়েও করে। আসলে প্রতিবছর এই বারনাচা পর্বের সাফল্যের একটি মাপকাঠি হল -- এ'বার কত বেশি জোড়া পালালো? যেমন দু'বছর আগে ন'টি জোড়া পালিয়েছিল। গতবার মাত্র সাতটি। কিন্তু জোর-জবরদস্তি? নৈব নৈব চ'।

    আমরা বিনা বাক্যব্যয়ে এগিয়ে চলি। অনেকটা দূর এসে গেছি। ঘড়ি দেখি বারোটা বাজতে আর বেশি বাকি নেই। এ'বার ফিরতে হবে। দেবস্থানের দিকে যাওয়া যাক। সরপঞ্চ নিশ্চয়ই অস্থির হচ্ছেন।

    কৃষ্ণপক্ষের নিকষকালো রাত। দূরে দূরে গাছে বাঁধা মশালের আলো। আমরা তিনজন মাদলের ভেসে আসা আওয়াজ লক্ষ করে এগিয়ে চলেছি। একটা ছোট খাঁড়ি পেরিয়ে বিশাল ঝুরিনামা অশ্বত্থ বা পিপলগাছটা পেরিয়ে যাবার সময় কানে এলো একটু ফিসফিস আর গোঙানির আওয়াজ। না, কেউ যেন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমরা উৎকর্ণ হই। আমি টর্চ বের করতেই অর্জুন গুরুজি আমার হাত চেপে ধরেন।

    আস্তে আস্তে অন্ধকারে চোখ সয়ে আসে। দুটো মানব শরীর, একজন ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। কি আশ্চর্য? কান্নাভেজা স্বরটি পুরুষের।

    -- আর কত? আমাকে আর কত দুখ দিবি? অঊ কতেক দিন মোলা--'।

    নারীকণ্ঠ সান্ত্বনা দেয়, মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। --"ঝন রো'বে, ঝন রোনে তঁয়। চুপ ঝা, চুপ হো ঝা'।

    আর দেখা যায় না। এবার যে শঙ্খ লেগেছে। মানবমানবীর মধ্যেও লুকিয়ে থাকে নাগ ও নাগিন। সেই চিরন্তন নাগ ও নাগিন জেগে উঠেছে। কিন্তু শঙ্খ লাগা যে দেখতে নেই, পাপ হয়। অমঙ্গল হয়। তাই অর্জুনগুরুজির হাতের চাপে আবার এগিয়ে চলি।

    তবে মাথায় একটা যন্ত্রণা, একটা ছট্‌ফটানি। পুরুষগলার আওয়াজ যেন চেনাচেনা। অমি কিছু বলার আগেই অন্তর্যামীর মত অর্জুন বললেন - হ্যাঁ, গেঁজেল গুরুজি।

    এবার দেবস্থান দেখা যাচ্ছে, আর পঞ্চাশ পা। কিন্তু আমাদের আর পৌঁছানো হল না।

    আমাদের দিকে দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে একটা ধুলোর ঝড়, হো-হো-হোহো শব্দ করতে। আর সারা মেলার জনসমুদ্র ছুটে আসছে ওই ঝড়ের কেন্দ্রবিন্দুকে লক্ষ্য করে।

    কাছে এসে গেলে দেখতে পেলাম -- ঝড়টা আসলে উদ্দাম নাচে মেতে ওঠা মেয়েদের দল। জনাদশেক মেয়ে নিয়ে গোটা দুই দল। কোমর ধরে ধরে নাচছে খানিকটা ঝাড়খন্ডের সাঁওতাল মেয়েদের ঢং-এ। তবে পা' উঠছে অনেকটা উঁচুতে। তাতেই উঠছে ধুলোর ঝড়। যদিও গানটা সেই একঘেয়ে "তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না.....', কিন্তু মাদল বাজছে দুনি লয়ে।

    -- "ধিতাং-ধিং, ধিতাং-ধিং'।

    আর পুরুষ নাচিয়ের দল? তারা মেয়েদের দলকে প্রদক্ষিণ করে নাচছে, দ্রুতবেগে। কোথায় যেন এক অদৃশ্য প্রতিযোগিতার ভাব। অর্জুন আঙুল তুলে দেখান -- ওদিকের দলটা দররি গাঁয়ের, আর ওই নীল জ্যাকেট পরা দল -- ওরা নরইবোধ গাঁয়ের। সবুজজামা এই দলটা বলগীখার গাঁয়ের। আর গতবারের সেরা নর্তককে দেখুন। ওনার আঙুলের ইঙ্গিতে আমি দেখতে পাই এক বেঁটে বুড়ো নর্তককে যে মাদল বাজাতে বাজাতে মণিপুরি নাচের মৃদঙ্গবাদকের মত নানান কায়দায় চর্কিপাক খেয়ে নাচছে।

    -- এবার মেয়েদের দলগুলোকে দেখুন, ওই যে .....।

    আমি কিছুই দেখতে পাইনে। আমি খালি দেখি -
    "ওড়ে কুন্তল, ওড়ে অঞ্চল, ওড়ে বনমালা বায়ু চঞ্চল,
    বাজে কঙ্কণ, বাজে কিঙ্কিণী, মত্ত বোল, দে দোল, দোল।'

    কতক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি টের পাইনি। ঘূর্ণিঝড় আস্তে আস্তে স্তিমিত হয়ে আসে। আমার কাঁধে একটা হাত নেমে আসে। তাকিয়ে দেখি সরপঞ্চ - কুমার সাহেব।

    - পুজো শেষ হয়ে আসছে। হবনের সময় আপনাকে-আমাকে থাকতে হবে যে, এর পর মানতের পাঁঠা-মুরগি বলি হবে। চলুন।

    কিন্তু এত সহজে শেষ হবার নয়। গিয়ে দেখি বৈগা-পুরোহিত অপেক্ষা করছেন কখন বাররাণী ভর করবেন কোন ভক্তের ওপরে। এখন অব্দি বাররাজা এসেছেন, ঠাকুরদেব এসেছেন, কিন্তু বাররাণী আসেননি। যতবার কোন ভক্ত দাবি করেছে যে তার ওপর বাররাণীর ভর হয়েছে বৈগার পরীক্ষায় ধরা পড়েছে সব ভূয়ো।

    এবার বৈগা-পুরোহিত ধুনুচি নিয়ে নাচছেন, আহ্বান করছেন বাররাণীকে এখানে এই দেবস্থানে নেমে আসতে। উত্তেজনা বাড়ছে, সময় বেশি নেই। রাত্রির তৃতীয় প্রহরও পুইয়ে এলো।

    কখন যে আমার চোখ লেগে গেছলো টের পাইনি। হাতের ঠেলা খেয়ে ধড়মড়িয়ে উঠে দেখি -- অর্জুন গুরুজি।

    -- আরে উঠুন, হবন হয়ে গেছে। শান্তি জল নিন। তারপর আমাদের সঙ্গে নদীর ধারে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে আসুন। মুখিয়ার বাড়িতে প্রসাদীমাংস আর গরম ভাত খাওয়ার নেমন্তন্ন আছে না।

    কলের পুতুলের মতো হাত পেতে শান্তিজল নিই। বৈগার সামনের থালিতে একটি দশটাকার নোট রাখি। তারপর নদীর দিকে পা' চালাতে থাকি। রাত্তিরের গাছে - বাঁধা মশালগুলো কখন নিভে গেছে। আকাশে গোলাপি রং ধরেছে। চোখে পড়ল অনেকগুলো গাছের নীচে জমে থাকা রক্তের দাগ, চাপ-চাপ রক্ত। কোথাও বলির পর ফেলে দেয়া সামান্য নাড়িভুঁড়ি। একটু গা গুলোয়। কথা ঘোরাতে কুমারসাহেবকে বলি - শেষে কী হল? বাররাণী নেমে এসেছিলেন?

    উনি খিঁচিয়ে ওঠেন - এসেছিলেন তো, পড়ে পড়ে নাক ডাকিয়ে ঘুমুলে দেখবেন কী করে?

    অর্জুন ফিস্‌ফিসিয়ে বলেন -- এবার আট জোড়া পালিয়েছে। আর এই ভাগেড়ু অষ্টম জোড়াটি হল আমাদের গেঁজেল গুরুজি আর ধনরাস গাঁয়ের সহজরাম ক্যাওটের বউ। ওনার মনোকামনা পূর্ণ হয়েছে।

    ধীরহে গুরুজি হাসেন -- পথে সর্পদর্শন আমরা সবাই করলাম, কিন্তু কামনা পূর্ণ হলো একজনেরই।

    আমার কানে বাজে - "তোলা দয়া লাগে না, তোলা মায়া লাগে না --'।

    (শেষ)

    কয়েদ মে হ্যায় বুলবুল
    রঞ্জন রায়

    অনেকদিন পরে প্রায় দুই যুগ পেরিয়ে দক্ষিণ কলকাতার এই পাড়ায় এসেছি। পার্ক সার্কাসের ধাঙড় বাজারের সার্কাস হোটেলের সামনে ফ্ল্যাটবাড়ির দোতলায় এই তিন কামরার অ্যাপার্টমেন্ট আমার জন্মভূমি, আমার শৈশবের পাঠশালা, আমার প্রথম যৌবনের উপবন। দেশভাগের অনেক আগে থেকেই আমাদের সংযুক্ত পরিবারের একাংশ এ বাড়ির ভাড়াটে। দেশভাগের পর পূর্ব পাকিস্তান, থুড়ি বাংলাদেশের ময়মনসিংহের জেলা থেকে জানমাল নিয়ে পালিয়ে আসা আমাদের বাইশজনের গোটা পরিবার "দাদুর দস্তানা'র মতো এই তিন কামরার আর ছাদের চিলেকোঠায় সেঁধিয়ে গেল।

    আজও এ বাড়ির ভাড়া মাসিক আটচল্লিশ টাকা। বাড়িওয়ালার নাতিরা রাগে-দু:খে-অভিমানে অনেক আগেই ভাড়া নেওয়া বন্ধ করে শেষমেশ অন্য কোনও হিম্মতওয়ালা পার্টিকে বেচে দিয়েছে। আজকে এই তালাবন্ধ বাড়িতে আমাদের কেউ থাকে না। সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে গিয়েছে -- কলকাতার বিভিন্ন প্রান্তে। আমি সিঁড়ি বেয়ে ছাদে উঠে যাই, দোতলার ছাদ থেকে চোখে মেলে দেখি -- গোটা পাড়ার এক বিহঙ্গমদৃশ।

    ওপরতলায় ছটা আর নীচের তলায় দুটো ফ্ল্যাটে ভাড়ায় থাকতো আটটি পরিবার। আর বাজারের দিকটায় নব্বই ডিগ্রি কোণ করে কড়েয়া রোডের দিকে কিছু দোকানঘর।

    আজকে এত পথ হেঁটে, এত হোঁচট খেয়ে, খানা-খন্দ-নদীনালা পেরিয়ে, জীবনের এই বাঁকে এসে বুঝতে পারছি যে জীবনবিদ্যার প্রাথমিক পাঠ আসলে পেয়েছিলাম এইখানে; এই ভরদুপুরে তেতে ওঠা ফুটপাথের গন্ধে, রবারের বলে খেলা গলিক্রিকেটে, ছাতের ওপর গায়ে লাগা ফ্ল্যাটের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে মার্বেল আর লাট্টু খেলায় আর ঘুড়ি ওড়ানোয়, নীচের বাড়ির মুন্নাদা -- মোক্তারদার বাড়ির ঈদের সিন্নিতে আর ছাদের ওপর সরস্বতী পুজোয়।

    এই বাড়িতে দেখেছি যন্ত্রণার নানা রং। কলের জল নিয়ে, গলিতে আবর্জনা ফেলা নিয়ে ভাড়াটেদের মধ্যে কুৎসিত ঝগড়া। দেখেছি সামনের ফ্ল্যাটে বিধবা মায়ের পাঁচ ছেলের মেজছেলে অলকদাকে। শান্ত, গম্ভীর, চশমা পড়া সতেরো বছরের অলকদা সেই যে একদিন মায়ের মুখ নাড়া খেয়ে ঘর ছেড়ে গেল, আর ফিরে এল না।

    চোর-চোর খেলার সময় বাচ্চুদি আমাদের এভাবে গুনতে শিখিয়েচিলেন -- "অব দ্য ফোর, ডব দা ফোর, মাংকি চুজ আ ব্ল্যাক বোর। হোয়াট কালার ডু ইউ চুজ?' সেই বাচ্চুদি হঠাৎ এক মুসলিম তরুণকে বিয়ে করে কেমন যেন নিজের পরিবারের মধ্যে দুধভাত হয়ে গেলেন।

    আবার দেখতাম আমার বাবা-কাকাদের। পুববাংলার খোলামাঠ, মেঘনা -- ধনু নদীতে নৌকা বাইচ, পাট আর বোরো ধানের চাষ, জারি আর সারি গান -- এসব থেকে বহু দূরে শহর কলকাতার ইট-কাঠ-সিমেন্টের নির্বাসনে বাইশজন মিলে তিন কামরার ভাড়াবাড়িতে থাকতে থাকতে তাদের প্রাণ হাঁপিয়ে উঠত। ওদের দেখেছি স্বপ্নের মধ্যে কাঁদতে।

    "... বঁইচা মাছের মতন নীল চোখ, স্বপ্নে আমায় কুশল পুছে রোজ;
    -- ভাল কি আছ, হায়রে ভাল থাকা, নগরবাসী কে রাখে কার খোঁজ।।
    ফিরতে চাই, পাবো কি সেই পথ? তরমুজের ক্ষেতের পাশে ঘর,
    লজ্জাহীনা ফাজিল ছুঁড়ি এক, ভীষণ কালো, হাসতো থরথর।' (পূর্ব বাংলার কবিতা সংগ্রহ, ১৯৬৯)

    সামনের হলদে রঙের বাড়িতে ছিল বেশ কিছু ৭৮ আর পি এমের রেকর্ড আর হাতল ঘুরিয়ে দম দিয়ে বাজানো গ্রামোফোন। ওখান থেকে ভেসে আসত লতা মঙ্গেশকরের গলায় "প্রেম একবারই এসে ছিল নীরবে' বা সন্ধ্যা মুখার্জির গলায় "মালার শপথ লাগি ভুলো না আমারে, কাঁদাও কেন যে শুধু ভালোবাসো যারে।'

    ক্লাস ফাইভে পড়া ছেলেটি বুঝতে শিখল যে ভালোবাসায় কাঁদতে হয়, কাঁদাতে হয়। এ বাড়ির ছাদের সিঁড়িতে পাশাপাশি বসে স্বপনকুমারের বিশ্বচক্র সিরিজের গোয়েন্দা কাহিনী পড়ে নিজেকে ডিটেকটিভ দীপক চ্যাটার্জি ভাবল। আর এক ঝাঁ ঝাঁ করা বাতাসকাঁপা দুপুরে অনপেক্ষিত ভাবে। কিশোরী ঠোঁটের মাথা ঝিমঝিম করা স্বাদ-গন্ধ পেয়ে হঠাৎ বড় হয়ে উঠল।

    এ বাড়ির ছায়ায় দেখতে পেয়েছি বেশ কিছু বড় মাপের মানুষদের। বহুভাষাবিদ, সুসাহিত্যিক, সৌম্যদর্শন সৈয়দ মুজতবা আলি থাকতেন আমাদের রাস্তার শেষে পার্ল রোডের দোতলা বাড়িটিতে, সে, বাড়িতেই বাস করতেন প্রখ্যাত রবীন্দ্রসাহিত্য বিশেষজ্ঞ আবু সয়ীদ আয়ুব -- বিশিষ্ট চিন্তাবিদ অম্লান দত্ত মশায়ের ভগ্নিপতি।

    আর এপারে আসাদ মেডিকেল হলের ওপরতলায় থাকতেন সুকণ্ঠী, প্রতিভাশালী, কিন্তু প্রচারবিমুখ রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়ক কমলা বসু, আমাদের পাড়ার জনপ্রিয় বাপ্পাদার মা -- আমাদের মাসিমা। একটু রাতে যখন আড্ডা দিয়ে বাড়ি ফেরার সময় বাজারের ডাস্টবিনের কোণাটুকু নাক টিপে পার হচ্ছি, হঠাৎ ওনার ঘরের জানলা দিয়ে ভেসে এল -- "ও চাঁদ, চোখের জলের লাগল জোয়ার দুখের পারাবারে।'

    এখানেই দেখতে পেয়েছি যে মানুষ শুধু আলোকপিয়াসী নয়, সে রুধিরলোলুপও বটে।

    ১৯৬৪ সালের দাঙ্গায় যেমন বাজারের কিছু কসাই এবং গুন্ডা শ্রেণীর লোকেদের দেখেছি লুটপাট ও হননলীলায় মেতে উঠতে, তেমনই আসাদ মেডিক্যাল হলের ডাক্তার গণিসায়েবকে এবং আবদুর রেজ্জাক খানকে দেখেছি বহু হিন্দু পরিবারের জান বাঁচাতে। খানসায়েব থাকতেন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে। উনি অনুশীলন দলের সদস্য হয়ে জেল খাটতে আন্দামানে যান। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে আসেন কমুনিস্ট হয়ে। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভায় উনি একবার মন্ত্রী হয়েছিলেন। ওনার মেজ ছেলে মমতাজউদ্দিন আহমেদ ভাল অভিনেতা ছিলেন। প্রথমে গণনাট্য সংঘ, তারপরে দক্ষিণ পরিষদ বলে একটি নাটকের দলে নিয়মিত অভিনয় করতেন। বেশ ক'টি সিনেমায় ও অভিনয় করেছিলেন। তার মধ্যে "কেদার রাজা' ফিল্মে ভিলেনের রোল আমার বেশ মনে আছে।

    কাছেই নাসিরুদ্দিন স্ট্রিটে ছিল বিখ্যাত নাটকের দল "বহুরূপী'র অফিস। আর ওখানেই থাকতেন প্রবাদপ্রতিম শম্ভু মিত্র - তৃপ্তি মিত্র।

    আবার শেষ বয়সে ক্যান্সারে শেষ হয়ে যাওয়ার আগে ক্রমশ শম্ভু মিত্র এবং গোটা "বহুরূপী' দল থেকেই আলাদা হয়ে একলা হয়ে যাওয়া তৃপ্তি মিত্র ঠাঁই পেলেন আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে নাট্যপ্রেমী অশোক গুপ্তের (আলো) বাড়িতে। আলো ওনাকে জ্যেঠিমা বলে ডাকল, ছাদের চিলেকোঠায় রিহার্সালের বন্দোবস্ত করল। আমরা শুধু দূর থেকে দেখতাম হার-না-মানা এক অসাধারণ মহিলার ক্রমশ হেরে যাওয়ার পালাগান।

    রাস্তায় রাস্তায় গলি-ক্রিকেট খেলতে গিয়ে কিছু বাড়ির কাচ ভেঙে পুলিশের তাড়া খেয়ে পালানোর আর রকের আড্ডার ফাঁকে একদিন দেখলাম চিত্রেশ দাসকে। চোখে বাহারি রোদচশমা আর টি-শার্ট। এসেছিলেন দুই পাড়ার ঝগড়ায় মধ্যস্থতা করতে। সাধু উদ্দেশ্য সন্দেহ নেই। আমি অবাক হয়ে দেখছিলাম ওনার দু'হতের গুলোগুলো বাইসেপস। জানলাম উনি পাশের পাড়ার বিখ্যাত নাচের স্কুল "নৃত্যভারতী'র গুরু প্রহ্লাদ দাসের সুপুত্র, ভাল বক্সার এবং কত্থক নাচে পারঙ্গম। পরে উনি নিউ ইয়র্ক এবং ইউরোপে নৃত্যবিশারদ হিসেবে বিশেষ নাম করেন।

    চারদিকে অনেক কিছুই বদলেছে, আবার অনেক কিছুই বদলায়নি।

    সামনের বিশাল বাজারটা দোতলা হয়ে গিয়েছে। অনেকগুলো আটতলা-দশতলা বাড়ি মাথা তুলেছে, মাথার আর রেডিওর এরিয়েলের জাল নেই। তার জায়গায় বড় বড় টিভির ছাতা। অন্যমনস্কভাবে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে নামতে চোখে পড়ে বাঁকের মুখে দেওয়ালের গায়ে পেনসিলের আঁচড়ে লেখা -- "ইলি, তুমি একটা গাধা'।

    কবে লিখেছিলাম? আজ থেকে তিরিশ বছর আগে? চল্লিশ বছর আগে? ইলিকে? নীচের তলার ভাড়াটেবাড়ির মেয়েটিকে? ছাদের ওপর খেলার ফাঁকে যাকে আমি কালীয়দমন আর পুতনাবধের গল্প শুনিয়েছিলাম আর যে আমাকে শুনিয়েছিল সুদূর কারবালার প্রান্তরে এক মহাযুদ্ধের গল্প যাতে ধর্মের পরাজয় আর অধর্মের জয় হয়েছিল?

    আজ ইলি নেই? পাগলামির লক্ষণ দেখা যাওয়ায় স্বামী তাকে নেয়নি। ভাইদের গলগ্রহ হয়ে ছিল। মরে গিয়ে মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু আমার রাগের প্রকাশ রয়ে গিয়েছে, ময়লা দেয়ালের গায়ে।

    নেমে আসি নীচের গলিতে। সেখানে সবকটি ফ্ল্যাটের সম্মিলিত আস্তাকুঁড়ের পাশে পাকাপাকিভাবে ঠাঁই নিয়েছে গোটা দুই পরিবার যাদের আমরা জেনেছি নুরীর মা, নুরীর মেয়ে, নুরীর স্বামী হিসেবে। চারদিকের বাসিন্দাদের অবহেলা, তাচ্ছিল্য ও বিরক্তিতে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে ঝড়-জল অগ্রাহ্য করে টিকে আছে -- ওদের পলিথিন শীটের ছোটমতো তাঁবুর নীচে জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের ধারাপাত বিরামহীন।

    বুঝতে পারি উনিশশো উনপঞ্চাশের দেশভাগের দাঙ্গায় বাস্তুহারা রায় পরিবার আর একাত্তরের খরায় গাঁ থেকে উৎখাত হওয়া নুরীদের জোট মহাকালের বিচারে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে -- শুধু আমরা দোতলার বাসিন্দা আর ওরা ফুটপাথের।

    গলি ছাড়িয়ে হাঁটতে থাকি। পুরোনো বাজারের ফুটপাথের থেকে ওঠা ভাপের গন্ধ প্রায় একইরকম আছে। দুপুর শেষের ঝিমন্ত বাজারে দোকানদারদের খাট পেতে তাস বা লুডো খেলা ঠিক আগের মতোই। চলছে-চলবে।

    কড়েয়া রোডের দিকে ঘুরে যাই। পেছনের রাস্তায় এককোণে পরিখার সেলুন। চারদিকের ভোলপাল্টানো ঝাঁ-চকচকে অন্য দোকানগুলোর পাশে যেন লজ্জায় সিঁটিয়ে আছে।

    ভেতরে গিয়ে খালি চেয়ারে চুপচাপ বসে থাকা মাঝবয়সি লোকটিকে জিজ্ঞেস করি -- পরিখা নেই? ঘোলাটে চোখ তুলে খৈনি খেতে থাকা লোকটি মাথা নাড়ে, বলে -- ও তো বছর দশেক আগে মারা গেছে।

    বেরিয়ে আসতে গিয়ে চোখ আটকে যায় হলদে হয়ে আসা ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটার দিকে। ক্যালেন্ডারের থেকে কেটে বাঁধানো হাফটোন, ক্ষুদিরামের ফাঁসির ছবি - "একবার বিদায় দে মা, ঘুরে আসি'। চল্লিশ বছর ধরে একইভাবে টাঙানো রয়েছে।

    উল্টোদিকের ফুটপাথে "ডোমিনিয়ন টী এন্ড কোং'। গায়ে বাজারের মজুরদের জন্য সস্তা চা-ফুলুরি আর পানবিড়ির দোকান। কাউন্টারে বসা চশমা চোখে দাড়িওয়ালা মাঝবয়েসি লোকটিকে দেখে যেন চেনা চেনা লাগে! তা কী করে হবে? সে তো কবেকার কথা।

    ধীরে ধীরে চোখের সামনে থেকে যেন একটা পর্দা সরে গেল। যেন একটা আগে দেখা পুরোনো সিনেমা আবার দেখছি।

    ঠা-ঠা রোদ্দুরে ঘর থেকে চুপিসাড়ে বেরিয়ে এসে টো-টো করে ঘুরে বেড়ানো একটি বছর বারোর ছেলে এই দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সে এসেচে হারমোনিয়মের আওয়াজ শুনে। এই বাজনা ওর চোখে ভারী রহস্যময়। আর যারা এটা বাজায় তারা নিশ্চয়ই জাদুকরের থেকে কম নয়।

    এখন যে বাজাচ্ছে তার মাথা রঙিন কাগজ আর রাংতামোড়া সস্তা টুপি, গায়ে সিল্কের কুর্তা, গলায় রঙচঙে রুমাল আর পায়ে টায়ারের চপ্পল। তার পানখাওয়া ঠোঁট আর কুচকুচে কালো চেহারায় ঘাম ঝরছে আলকাতরার মতো। তার চঞ্চল আঙুল নেচে বেড়াচ্ছে হারমোনিয়মের রিডের ওপর -- জেগে উঠছে কোনও বাজারচলতি হিন্দি গানের চটুল সুর।

    চায়ের দোকান থেকে বেরিয়ে আসা কিছু পানচিবোনো ঢ্যাঙা ছোকরার দল প্রায় সিটি বাজানোর ঢঙে বলে উঠল -- শুরু হো যাও ছম্মক্‌হল্লো! দের কিস বাত কি?

    ছেলেটা সচেতন হল আরও একটি প্রাণীর অস্তিত্ব বিষয়ে। বাজনদারের পাশ ঘেঁষে এতক্ষণ প্রায় ছায়ার মতো মিশে থাকা একটি মেয়ে এবার এগিয়ে এসেছে। হারমোনিয়ম সুর তুলেছে -- দিল দেকে দেখো, দিল দেকে দেখো, দিল দেকে দেখো জী।।

    মেয়েটির পাতলা সুরেলা আওয়াজ মাঝবয়সি বাজনদারের ভাঙা ভাঙা আওয়াজের সঙ্গে মিশে যায়। মুখড়ার পর লোকটি অন্তরা ধরে। মেয়েটি গান থামিয়ে হাত ঘুরিয়ে কোমর দুলিয়ে একটু নেচে নেয়। আবার মুখড়ায় এসে নাচ থামিয়ে পুরুষকন্ঠের সঙ্গে গলা মেলায়। নাচ চলতে থাকে। ছেলেটা একমনে মেয়েটিকে দেখতে থাকে। ওর কানে গানের কথাগুলো হালকা হতে হতে মিলিয়ে যায়।

    শ্যামলা মেয়েটির বয়েস প্রায় চোদ্দ কি পনেরো। পরনে হলদে রঙের ছিটের ঘাগরা আর গোলাপি ব্লাউজ। চোখের কোণে ক্লান্তির কাজল। চারপাশের বখাটে ভিড়ের থেকে উড়ে আসা ফুটকাটা আলগা মন্তব্যকে গায়ে না মেখে ও পুতুলের মতো হাত-পা নেড়ে যাচ্ছে, যেন নাড়তে হবে বলেই। ছেলেটা লক্ষ করল যে মেয়েটি কিন্তু একবারও হাসছে না।

    মেয়েটা নতুন গান ধরেছে।
    "... কয়েদ মে হ্যায় বুলবুল, সঈয়াদ মুস্কুরায়ে, কুছ কহা ভী না জায়ে, ঔর রহা ভী না জায়ে।'

    (খাঁচায় বন্দি বুলবুল আর ব্যাধের কুটিল হাসি, না পারি বলতে, না পারি থাকতে, গলায় লেগেছে ফাঁসি।।)

    ছেলেটার ধন্দ লেগে যায়, কাকে ব্যাধ বলছে মেয়েটা? হারমোনিয়ম বাজানো লোকটাকে? এই বখাটে বেলেল্লা ভিড়কে? নাকি ছেলেটাকেই? ছেলেটার অস্বস্তি বাড়ে।

    ইতিমধ্যে নাচগান শেষ। একটি বাটি হাতে করে মেয়েটা সবার সামনে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। ঠুং-ঠাং শব্দ করে কিছু দু'আনি-চার আনি পড়ছে। ভিড় পাতলা হচ্ছে। এবার মেয়েটা বাটি ধরেছে ছেলেটার সামনে। ও বেশ অপ্রস্তুত হয়েছে। পকেটে একটাও পয়সা নেই। ওদের বাড়িতে ছোট ছেলেদের হাতখরচা দেওয়া হয় না। মেয়েটা এবার বাটির পয়সা লোকটাকে দিয়ে একসঙ্গে হাঁটা শুরু করল।

    ছেলেটা বুঝে গেছে যে ওরা বাবা আর মেয়ে। ছেলেটার ঘোর লেগেছে। যেন নিশির ডাক শুনেছে। ওদের পেছন পেছন সেও চলতে লাগল, এ-মোড় থেকে সে-মোড়। ওয়েস্ট রো থেকে ট্রাম ডিপো, সেখান থেকে ব্রাইট স্ট্রিট, চার নম্বর পুল। প্রত্যেক মোড়ে থেমে একবার করে গান আর নাচ। কিছু নতুন, কিছু পুরোনো। কিছু রিপিট হচ্ছে। কিন্তু ছেলেটা শুধু একটা গানই শুনছে -- "কয়েদ মে হ্যায় বুলবুল।'

    এবার ছেলেটা চমকে উঠল। একটা অন্য ধরনের গান যে! "ছুপ ছুপ কে খড়ে হো, জরুর কৈ বাত হ্যায়, পহলে মুলাকাত হ্যায় জী! পহলে মুলাকাত হ্যায়।' কি ব্যাপার! মেয়েটা কি খেয়াল করেছে যে ও অনেকক্ষণ ধরে ওদের পেছন পেছন আসছে? মেয়েটার চোখের পাতায় কি একটু হাসির ঝিলিক? সোজাসুজি তাকানোর সাহস হল না। এবার ওরা চার নম্বর পুলের পাশের বস্তির দিকে রওনা দিল।

    ছেলেটা ফুটপাথ ছাড়িয়ে নামতেই ওর কাঁধে পড়ল কারও থাবার মতো ভারী হাত।

    ফিরে তাকাতেই দেখে রঘুদা। ওদের পেছনের ফ্ল্যাটের নীচের তলায় থাকে। নামকরা গুন্ডা, পাড়ায় চুপচাপ থাকে, বেপাড়ায় টেরর। বন্ধুদের কানাঘুসোয় জেনেছে যে ওর বুকে আর পেটে নাকি একুশটা ছুরি দাগ আছে।

    -- "তুমি আমাদের পাড়ার তপনের ভাগ্নে না? এখানে কী করছ? স্কুলে যাওনি? চল, বাড়ি চল।' রঘুদা শক্ত মুঠোয় ওর হাত চেপে ধরে।

    একটা গাড়ি বারবার হর্ন দিচ্ছে। চটকা ভেঙে যায়। ফুটপাথে উঠে পড়ি। আস্তে আস্তে এগিয়ে যাই। জানি, সামনের মোড়ের মাথায় ওর সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। হারমোনিয়ম বেজে উঠবে আর কিশোরী কণ্ঠে শোনা যাবে -- "কয়েদ মে হ্যায় বুলবুল।'

    বাঙালকথা
    রঞ্জন রায়

    ছোটবেলা থেকেই মনের মধ্যে পা টিপে টিপে ঢুকে গেছে এক ধরনের হীনমন্যতা, সংখ্যালঘু হওয়ার ভয়। পাড়ায়-স্কুলে-ফুটবল মাঠে জানতে পেরেছি আমরা বাঙাল, আমরা উদ্বাস্তু, আমরা আসায় কলকাতা শহর কল্লোলিনী-তিলোত্তমা হতে পারেনি। আমাদের জন্য বরাদ্দ শেয়ালদার প্ল্যাটফর্ম আর আমেরিকা থেকে পাঠানো গুঁড়ো দুধ। থাকার জন্য শহর পেরিয়ে দখিনের নাবাল জমিতে জবরদখল রিফুইজি কলোনি। ভিড়ের মধ্যে নিজেকে লুকোতে পারিনে। জিভের আড় পুরোপুরি ছাড়েনি -- আমার "প্রাকৃত' ভাষা, ধরা পড়ে যাই। দুই বিনুনি করা সুন্দরীরা আমার কথা শুনে হেসে ফেলে; মনের কথা মনেই থেকে যায়। নাটক-সিনেমায় বাঙাল সবসময়েই কমিক চরিত্র। ভানু বন্দ্যোপাধ্যায়রা কখনও নায়ক হন না, "মাসিমা মালপোয়া খামু' বলাটাই আমাদের নিয়তি। ধীরে ধীরে "আমি' থেকে 'আমরা' হই; তারপর "আমরা' আর "ওরা'।

    ভয়, সংকোচ সব কখন যেন রাগের চেহারা নিতে থাকে। শিকড় হাতড়াই, -- মৈমনসিংহ সম্মিলনী' -- "বরিশাল সম্মিলনী' করি। ঘেটো বানাই। -হালতু-বাপুজিনগর-বিজয়গড়-বিদ্যাসাগর-নেতাজিনগর-আজাদগড়; তালিকা বেড়েই চলে। ঢাকুরিয়া ব্রিজের উত্তরপাড়া থেকে কোলকাতা আর দক্ষিণপার থেকে আমাদের রাজত্বি। আমরা দরমা, কাঠের ফ্রেম, টিন আর খাপরা দিয়ে ঘর বানিয়ে থাকি, হ্যারিকেনের আলোয় লেখাপড়া করি, প্রায় লাঙ্গল-চষা মাঠে ফুটবল খেলি আর অমুকের ব্যাটা হয়ে তমুকের মাইয়ার লগে "প্র্যাম' করি। এইভাবেই কেটে যায় স্বাধীনতা পরবর্তী দুটো দশক। সত্তর-আশির দশকে কিন্তু অনেক কিছু পালটে যায়। অনেক খনার বচন মিথ্যে হয়ে যায়। আজকে রাঢ়বাংলার তিলোত্তমারা অনায়াসে পূব বাংলার গলায় বরমালা পরিয়ে দেন। "আমরা' আর "তোমরা' কখন মিলেমিশে যায়। এখন আমরাই কলকাতা।

    তাহলে ওদের কী হবে? ওই আমাদের বাপঠাকুরদার সময় থেকে সঞ্চিত মিথেদের? কোথায় থাকবে ওরা?



    হাজরাদি পরগণার লোক

    একজন নামজাদা গল্প বলিয়ে অনেক উপরোধে ঢেঁকি গিলে গলাখাঁকারি দিলেন। আড্ডার সবাই নড়েচড়ে বসল।

    -- "আমার একটা শর্ত আছে; এখানে হাজরাদি পরগণার কেউ হাজির থাকলে বলে ফেলুন। তাহলে আমি আর মুখ খুলছিনে'।

    সবাই চুপচাপ। বক্তা সবার মুখে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে গল্প শুরু করলেন।

    -- "এক যে ছিল নদী, আর তার পাড়ে ছিল এক গাছ। তার পাতার এমনই গুণ যে তা জলে পড়লে হয় কুমির, আর ডাঙায় পড়লে বাঘ।'

    -- "আচ্ছা, যদি পাতা অর্ধেক জলে পড়ে আর অর্ধেক ডাঙায়! তা'হইলে কি দশা হইব? কুমির না বাঘ? খুইল্যা ক'ন মশায়!'

    সবার অবাক করা চোখ এখন নতুন বক্তার দিকে।

    -- "এই যে, সত্যি কথাটা আগেভাগে কেন স্বীকার করলেন না! বলেছিলুম না যে হাজরাদি পরগণার লোকের সামনে মুখ খুলব না!'

    এই "কিসসা'টি শুনিয়ে আমার বাবা ফোড়ন কাটলেন --"বুঝলে তো, এই হল তোমাদের হাজরাদি' পরগণার লোক। এমন কুতর্ক! ভূ-ভারতে জোড়া পাওয়া ভার। যেমন তোমাদের নীরদ চৌধুরীমশায়।'

    পিতৃদেব নীরদ চৌধুরীমশায়ের ইতিহাসবোধ ও মেঠো রসিকতা দুটোই অপছন্দ করতেন। সেদিনের প্রসঙ্গ ছিল নীরদবাবুর "দেশ' পত্রিকায় "হিন্দুর মেয়ের মুসলমানি পোশাক' নামে সদ্য প্রকাশিত প্রবন্ধটি।

    -- "কিন্তু ওনার বাড়ি তো' যদ্দুর জানি আজকের বাংলাদেশের মৈমনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ মহকুমায়।' আমি ফুট কাটি।

    -- "তোমাদের নিয়ে এই তো মুশকিল। লেখাপড়াটা ভাল করে করলে না। পড়েছ শুধু "কম্যুনিস্ট ম্যানিফেস্টো', তাও সবটা নয়, মেরেকেটে জর্মন বা অস্ট্রিয়ান সংস্করণের অষ্টম ভূমিকাটুকু। তবু তর্ক করা চাই। শোন, শের শাহ সুরি খাজনা আদায়ের সুবিধের জন্যে গোটা দেশটাকে অনেকগুলি পরগণায় ভাগ করেছিলেন। কিশোরগঞ্জ মহকুমার প্রায় সবটাই হাজরাদি পরগণার মধ্যে পড়ে।'

    কিন্তু আমাদের পৈতৃক ভিটে! মৈমনসিং জেলার মানিকখালি রেলস্টেশনে নেমে ক'মাইল হাঁটাপথ পেরিয়ে আঠারবাড়িয়া গ্রাম। হঠাৎ মাথার মধ্যে টিউবলাইট জ্বলে ওঠে। বাবাকে জিগ্যেস করে ফেলি। -- "আমরা কোন পরগণার লোক, বাবা'?

    বাবার গলার স্বর খাদে নামে -- "হাজরাদি পরগনার'।



    কপোল মানে কপাল

    এদিকে বার লাইব্রেরিতে সিনিয়র, আধা-সিনিয়র উকিলবাবুরা আরামকেদারায় আধশোয়া হয়ে চৌরিচৌরাতে উগ্র জনতার থানা জ্বালিয়ে দেওয়ায় "কুইনের রাজত্ব' কতটা বিপন্ন হল, ১৯০৮-এ সিভিল প্রসিডিওর কোড-এর পর এবার ক্রিমিনাল প্রসিডিওর কোড সংশোধন করা জরুরি কিনা, কলিযুগ তিনপোয়া পেরিয়েছে, কি সিকিকোঠা আটকে আছে -- এ নিয়ে গভীর আলোচনার পর শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কারে ব্রতী হলেন। আজকাল স্কুলে যে কিচ্ছু পড়াশুনো হচ্ছে না, মাস্টারেরা যে কিছুই পড়ায় না -- এ ব্যাপারে সবাই একমত হলেন (একুশ শতাব্দীতে কৃতী পুরুষেরা এ ব্যাপারে দ্বিমত নন)।

    সতীশচন্দ্র একসময় মাস্টারি করেছেন; কলিগদের মধ্যে "শিক্ষাগুরুদের পিন্ডদান' শুরু হলে উনিই একমাত্র ডিফেন্স কাউন্সিল। অন্যমনস্ক সতীশচন্দ্র পড়শি উমানাথবাবুর খোঁচায় জেগে উঠলেন --

    -- "শুনছেন নাকি সতীশবাবু, যতীনমাস্টারের কান্ড! "কপোল' মানে নাকি কপাল।'

    -- "কিরকম, উমানাথবাবু একটু খুইল্যা ক'ন দেহি!' আড্ডার মুখ এদিকে ফিরল।

    -- "আর কইয়েন না। ক্লাসে মাস্টরে কবিতা পড়ায় -- "কপোল ভাসিয়া গেল নয়নের জলে'। আমার পুত্র জিগায় -- কপোলের মানে কইয়া দেন; ত' মাস্টারে কয় -- কপোল মানে কপাল। ছেলেও মুখস্থ করে -- "কপোল মানে কপাল, কপোল মানে কপাল'। গুরুর কথা যে বেদবাক্য। কিন্তু নয়নের জলে কপাল ক্যামনে ভাসব' হেইডা কেডা বুঝায়? আমারই পুড়া কপাল!'

    সবার মুচকি হাসির মাঝখানে হঠাৎ সতীশচন্দ্রের গলার আওয়াজ শোনা গেল -- "হইতে পারে, কপোল মানে কপাল কবিতায় হইতে পারে।'

    -- "এইডা কি কইলাইন সতীশবাবু? গল্পের গরু গাছে চড়ে জানতাম, কিন্তু, কবিতায় এমুন হইতে পারে!'

    -- "আপনের হিন্দু সিভিল কোডে হয় না, কবিতায় বিলক্ষণ হইতে পারে'। তরজা জমে উঠেছে; দোহার উঠল, "খুইল্যা ক'ন সতীশবাবু, খুইল্যা ক'ন।'

    -- "শুনেন; কবিতা যখন, দুই লাইন মিলাইতে হইব না?' "দুই ঠ্যাং বাইন্ধা দিল কদম্বেরি ডালে, কপোল ভাসিয়া গেল নয়নেরি জলে'। এইবার দ্যাখেন নয়নের জলে "কপাল' ভাসে কিনা!' হাসির হররা এবার বার লাইব্রেরি ছাড়িয়ে বারান্দায় পৌঁছে গেল।



    ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর

    সতীশচন্দ্র পড়িয়াছেন মহাফ্যাসাদে। ইংরেজ সরকারের মতিগতি বোঝা ভার। কুইনের কি যে মর্জি! ভারত সাম্রাজ্যের রাজধানী নাকি কলিকাতা হইতে দিল্লি যাইবে। ইহা যে দিল্লাগি বই কিছু নয় তাহা জবনশাসককুলকে কে বুঝাইবে!

    কলিকাতার রিপন কলেজ হইতে আইন পাস করিবার পর সতীশচন্দ্র ভারত সরকারের সেক্রেটারিয়েটে চাকুরি করিতেছিলেন। কিন্তু বিধি বাম। রাজধানী সহিত আস্ত সেক্রেটারিয়েট দিল্লি যাইবে, সঙ্গে যাইবে করণিকুল। দিল্লিগামী সমস্ত কর্মচারী পাইবে বিশেষ রাজধানী ভাতা। যাহারা যাইবে না তাহাদের জন্য বরাদ্দ অন্তিম বেতনসহ প্রেমপত্র।

    এখন রাজধানী কলিকাতা হইতে "দিল্লি শহরে যাক, যাক না আগ্রা; মাথায় পাগড়ি দেব পায়েতে নাগরা' রবিবাবু অনায়াসে লিখিতে পারেন। কারণ, তিনি চাকুরিজীবি নন, মসিজীবি। তাঁহার শিলাইদহের জমিদারি অটুট থাকিবে। কিন্তু সতীশচন্দ্রের সামান্য তালুকদারি দেখাশোনা করে কে!

    পিতা গগন চন্দ্র সফল উকিল, কিন্তু নিষ্ঠাবান হিন্দু। "পঞ্চাশোর্ধে বনং ব্রজেৎ নীতি অনুসরণ করিয়া বৃন্দাবনবাসি হইয়াছেন। একমাত্র পুত্র সতীশচন্দ্র মায়ের দু:খের সহভাগী। তবে মায়ের প্রখর বাস্তববুদ্ধির প্রতি তাঁহার বিস্ময়মিশ্রিত শ্রদ্ধা। কোনও জটিল সমস্যার মুখোমুখি হইলে তাঁহার অন্তিম বাক্য "মা যা বলেন।' সংসারের কোনও ঝড়-ঝাপটাতেই মায়ের প্রতি এই বিশ্বাস টলে নাই। কিন্তু আজ ডাকযোগে প্রাপ্ত মায়ের একটি পত্র তাঁহাকে যারপরনাই বিচলিত করিয়াছে। বৃন্দাবন হইতে সন্ন্যাসি পিতা মাকে জানাইয়াছেন যে সতীশচন্দ্র বঙ্গদেশ ছাড়িয়া দিল্লিগামী হইলে তিনি পুত্রকে সম্পত্তি হইতে বঞ্চিত করিবেন।

    সতীশচন্দ্র কিঞ্চিৎ বিস্মিত, কিঞ্চিৎ ক্ষুব্ধ। সংসারত্যাগী পিতা হিন্দু সিভিল কোডের কোন ধারায় পুত্রকে বঞ্চিত করিবেন? আর আপন অভিমত উনি পুত্রকে সোজাসুজি জানাইলেন না কেন?

    মাতাকে সন্দেহ করা সতীশচন্দ্রের পক্ষে অকল্পনীয়। মাতা সুখময়ী দেবী তাঁহার চক্ষে আদর্শ রমণী। আজও সপ্তাহান্তে বা মাসান্তে দেশের বাড়ি গেলে তিনি মায়ের জন্য এক হাঁড়ি কলিকাতার রসগোল্লা লইয়া যান এবং নিজহস্তে একটি একটি করিয়া মায়ের হাঁ-মুখে দিয়া পরমানন্দ লাভ করেন। তবে মাঝে মাঝে বিঘ্ন ঘটে। কোথা হইতে হাজির হয় গ্রামের মঘা পাগলা। মায়ের নিকটে আসিয়া ফিসফিসাইয়া বলে, -- "ঠাকুরাইন, আমার সঙ্গে গুপ্ত-বৃন্দাবন যাইবেন?'

    গুপ্ত-বৃন্দাবন কোথায় তাহা তিনি জানেন না। কিন্তু তাঁহার হাড়পিত্তি জ্বলিয়া উঠে এবং তিনি হারামজাদা পাগলাকে জুতাইয়া দেউড়ির বাহির করিতে নির্দেশ জারি করেন।

    সতীশচন্দ্র পুরুষকারের অপেক্ষা নিয়তির উপর অধিক নির্ভরশীল। সরকারি চাকুরি এব` মায়ের আন -- এই শ্যাম রাখি না কুল রাখি দোটানায় সতীশচন্দ্র কী করিবেন তাহা নিয়তি নির্ধারিত। কাজেই তিনি ইস্তফা দিয়ে ঘরে আসিয়া মায়ের মথামতো মৈমনসিংহের মৃত্যুঞ্জয় স্কুলে ইংরেজি শিক্ষকের পদের জন্য উমেদারি করিতে লাগিলেন।

    স্কুল কমিটিতে সৈয়দ রহিমুল্লা খান তাঁহার পিতার শাঁসাল মক্কেল ছিলেন। তিনি সতীশচন্দ্রকে আগামী রবিবার স্কুলের বার্ষিক পুরস্কার বিতরণী সভায় ইংরেজিতে লেকচার দিতে আমন্ত্রণ করিলেন। ইংরেজি ভাষার সহিত খান সাহেবের সম্বন্ধ নিষিদ্ধ মাংসের প্রতি ভয়মিশ্রিত আকর্ষনের সঙ্গে তুলনীয়। পাটের কারবারি খানসাহেবের পাটোয়ারি বুদ্ধি বেশ পাকা। সতীশচন্দ্রের লেকচার শুনিয়া উপস্থিত ভদ্রজন চমকৃত হইলে ইংরেজি-টিচার পদে নিযুক্তি সহজ হয়।

    বার্ষিক উৎসবে অন্যদের তুলনায় সতীশচন্দ্রের লেকচার অতি উপাদেয় হইল। সবশেষে "ভোট অফ থ্যাংকস' দিতে খানসাহেবকে অনুরোধ করা হইলে তিনি যাহা বলিলেন তাহাও কিছু কম উপাদেয় নয়। --"এতক্ষণ আপনারা যাহা শুনিলেন তাহা অত্যন্ত হৃদয়সংগম ও চিন্তাশীলতা। এইরকম বচ্ছর-বচ্ছর পেরাইজ দিলেই ছাত্রবাবুরা বইল্যা পড়ব আর ইশকুলেরও নামকাম হইব।'

    কিন্তু সতীশচন্দ্রের চাকুরি হয় নাই; কারণ, ইংরেজি টিচারের পদ খালি ছিল না। বাংলা শিক্ষকের পদে সেকেন্ড পণ্ডিতমশায় কাজ চালাইতেছিলেন। কিন্তু বাংলা মাস্টারের বেতন কম, সতীশচন্দ্র প্রথমে রাজি হইলেন না। পরন্তু চাকুরি বড় বালাই। কিন্তু বৃদ্ধ সেকেন্ড পণ্ডিতমশায় সকলের শ্রদ্ধেয় তায় ব্রাহ্মণ। হেডমাস্টারের বিবেকে বাধিল। খানসাহেব কমিটিকে জানাইলেন যে উনি ব্যাকরণে দড় কিন্তু বাংলা সাহিত্য পড়াইতে অপারগ। কমিটি হেডমাস্টারকে পরখ করিয়া রিপোর্ট দিতে বলিল। কাজেই তিনি সিক্সথ ক্লাসের বাংলা পিরিয়ডের সময় বারান্দায় আড়ি পাতিলেন।

    ক্লাসের ফার্স্টবয় বই খুলিয়া পড়িতেছিল, "ফুটিয়াছে সরোবর কমলনিকর; ধরিয়াছে কি আশ্চর্য শোভা মনোহর।'

    ছত্রদের অনুরোধে পণ্ডিতমশায় টিকা করিলেন -- "সরোবর মানে পুস্কুনি, রাত্রে ঠান্ডায় পুকুরের জলে সর পড়ছে -- কাজেই নাম হইল সরোবর। কমলনিকর ফুটিয়াছে -- মানে মুখ ভ্যাটকাইয়া রইছে। পরের লাইন -- মনোহর, মানে আমাগো উকিলবাবুর ছ্যামড়া মনোহইরা, ডাকতরবাবুর মাইয়া শোভারে ধরছে। হেইয়া দেইখা পন্ডিতে কয় কি আশ্চর্য!'

    পরের দিন সতীশচন্দ্র বাংলা টিচার নিযুক্ত হইলেন।

    ছত্তিশগড়ের সাড়ে বত্রিশভাজা (২)
    রঞ্জন রায়

    পঞ্চপরমেশ্বর

    প্রায় সিকি শতাব্দী আগে যদি আপনি সন্ধ্যেবেলা হাওড়া-মুম্বই মেল ট্রেনে চেপে টাটানগর স্টেশন আসতে আসতে ঘুমিয়ে পড়েন তাহলে সক্কালবেলা চা-ওলার ডাকে ঘুম ভাঙবে জে ছোট জংশন স্টেশনে তার নাম চাঁপা। কিন্তু আপনি হুড়মুড়িয়ে নেমে পড়বেন কারণ স্টপেজ মাত্র দু'মিনিট। ব্যস্‌, এবার চা খেয়ে নিন। ও হ্যাঁ, যদি বেশি সাহেব না হন, তবে তার আগে আর বাকি পাঁচজনের মত প্ল্যাটফর্মে বিক্রি হওয়া নিমের দাঁতন কিনে মুখারি বা দাঁতমাজা-মুখধোয়ার কাজটা সেরে নিন। চা খাওয়া হল? আর গরম গরম সামোসা বা সিঙারা? বেশ, এবার দু'পা হেঁটে পাশের প্ল্যাটফর্মে গিয়ে চাঁপা-কোরবা-গেবরা লোকালে চেপে বসুন। ছোট লোকাল ট্রেন। যাত্রীদের মধ্য কিছু স্থানীয় গোঁড় আদিবাসী, কিছু কোরবা শহরের ব্যবসাদার। কিছু কোরবা থার্মাল পাওয়ার প্ল্যান্ট বা ওয়েস্টার্ন কোলফিল্ডের কর্মচারি। এদের মধ্যে কিছু বাঙালি থাকলেও থাকতে পারে। এবার একটু অস্বস্তি; সকালে চা-দাস্তা করে সিগ্রেট ধরিয়েছেন আর তলপেটে চাপ ধরবে না তাকি হয়? তা আপনি ভ্যাবাগঙ্গারাম ঠেলেঠুলে লোকাল ট্রেনের বাথরুমে এন্টার করলেন এবং ভারতীয় প্রথার মলপাত্রে হালকা হয়ে সবস্তির নি:শ্বাস ছাড়লেন। তারপর যেই না উঠে দাঁড়িয়েছেন কানে এল হাসির হর্‌রা। আপনার ট্রেনের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে আর একটি লোকাল ট্রেন, ইঞ্জিন বিপরীতমুখী। আর উল্টোদিকের কামরা থেকে দাঁড়িয়ে-থাকা, কাঠের সিটে বসা এবং পা-দানিতে বসা ছেলেবুড়ো-মেয়েমদ্দ যাত্রীর দল আপনাকে দেখে অনাবিল হাসির খোরাক পেয়েছে। কেননা আপনি শহুরে ভ্যাবা গঙ্গারাম দাঁড়িয়ে আছেন জন্মদিনের পোশাকে আর আপনার বাথরুমের জানলার কাঁচটা নেই!

    যাহোক, আপনি ঘন্টাখানেক রেলযাত্রার পর যেখানে পৌঁছুবেন সেটি এই গাড়িটির শেষ স্টেশন, নাম গেবরা রোড। ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গিয়েছি যে আপনি ভ্যাবাগঙ্গারামবাবু এখানে এসেছেন ব্যাংকের চাকরি পেয়ে সদ্য জয়েন করতে। যদিও কোলকাতায় স্কুলের পালা চোকানো আপনার এই চাকরি পাওয়ার কথা নয়, কিন্তু আপনার পিতৃদেব ছত্তিশগড়ের ভিলাই স্টিল প্ল্যান্টে গত পনের বছরের বেশি সময় ধরে চাকরি করছেন। কাজেই ডোমিসাইল আইনের ক, খ, ই, বা ঘ ধারায় আপনি যোগ্য বলে বিবেচিত না হলেও, চ, ছ বা জ ধারায় আপনি ডোমিসাইল, অত: চাকরি পেতে কোন ঝামেলা নেই।

    গেবরা রেলস্টেশনে পৌঁছে আপনি আবক। অ্যাসবেস্টসের শিটের চাল টিনের শেড--- এই নাকি স্টেশন ঘর? না, আপনাকে নিতে আপনার ব্যাংক থেকে কেউ আসেনি। আর গেবরা রোড স্টেশন থেকে গেবরা গ্রাম তিন কিলোমিটার দূর। স্টেশনমাস্টারের দূরদর্শিতায় একজন কুলি দইওয়ালার কায়দায় আপনার সামান্য মালপত্তর কাঁধের বাঁকে, স্থানীয় ভাষায় কাঁওরে, ঝুলিয়ে নিল। তারপর "শুরু হোক পথচলা, শুরু হোক কথাবলা'। ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পথ চলছেন আপনি আর অনর্গল কথা বলে চলেছে মালবাহক।

    -- ব্যাংকবাবু বুঝি নতুন এসেছেন? তা' ব্যাংক খুলেছে মাত্তর আট মাস। গেবরা গাঁয়ে মালগুজার দাদুসায়েবের বাড়িতে একটি কোণার ঘরে। দাদুসায়েবরা ঠাকুর, পুরনো রাজবংশ। কোরবা রাজপরিবারের দামাদ, মানে জামাই। আজ ওদের অবস্থা পড়ে এসেছে, নামে তালপুকুর, কিন্তু ঘটি ডোবে না। পুরো মহলটা দেওয়ালির সময় রং করানোর পয়সা জোগাড় হয় না। নইলে কেউ ভাড়া দেয়? আচ্ছা, আপনার এই ব্যাংকটা কি'র্ম ব্যাংক? কর্জা (লোন) দয় না? একজন সক্কাল থেকে লোকের দোরে দোরে ঘুরে বেড়ায়, বলে ব্যাংকে খাতা খোল। ফোটো নেয়, সই নেয়, টিপ্‌ ছাপ নেয়। মেয়েদের হাত ধরে ধরে টিপ্‌ চাপ লাগায়। আরে, পাঁচ টাকা দশটাকা নিয়ে পাসবই দেয়। এ'কি রকম ব্যাংক? ভিখিরির মত? আপনাদের তিজোরিতে (সিন্দুকে) টাকা পয়সা নেই নাকি? আপনারা সত্যি সত্যি ব্যাংক তো? সরকারি? না কি চিট ফান্ড? লোকজনের পয়সা নিয়ে একদিন হাওয়া হয়ে যাবেন? তা যান, কিন্তু যাওয়ার সময় এই অধমকে ভুলবেন না। সেকিনও আপনার মালপত্তর কাঁধে করে বয়ে দেব। আমার নাম? মহেত্তররাম। আমার আগের দু'ভাই জন্মের দু'মাসেত মধ্যে পটল তুলেছিল। তাই মা' নাম রাখলো -- মহেত্তর, মানে মেথর। যাতে যমরাজের নজর না লাগে। আমি হলাম যমের অরুচি।

    আপনি এতক্ষণে আপনার শ্রবণযন্ত্রে তুলো গুঁজে দিয়ে দু'চোখ ভরে জঙ্গলের রূপ দেখছিলেন। এ জঙ্গল বনবিভাগের সাজানোগোছানো বন নয়। এর শাল-শিমূল-মহুয়া-আমলকি-বয়রা-পিপলের জড়াজড়ি। ঘন বুনোট যেন কোন মেয়ের তেল-চিরুনি-না-দেওয়া, জট-না-ছাড়ানো ঘন চুলের রাশি। ফাগুনের শেষ, শীত যাবো যাবো করেও যাচ্ছে না। পায়ের কাছে উইয়ের ঢিবি, সাপের খোলস, ঝরা পাতা, টুপ টুপ করে ঝরে পরা মহুয়ার মাদক গন্ধ; -- আপনার শহুরে চোখ জীবনে প্রথম মদ খাওয়ার দিনের মত করে সবটা শুষে নিতে চায়। কিন্তু মহেত্তররামের বক্‌বকানির চোটে মাথা ধরে যায়।

    -- হমন গয়ে রহেন আপেকে ব্যাংক মা। গিয়েছিলাম গো আপনাদের ব্যাংকে একদিন। আমি, বরাতু আর রামসায় গুরুজি। গাঁওকে রামলীলা পার্টি বর কর্জা মাংগে বর।

    ব্যাঞ্জো-ঢোলক খরিদনা থা। পর নহি মিলা।

    আমাদের রামলীলা পার্টির জন্যে ব্যাঞ্জো-ঢোলক কেনার জন্যে ঋণ চাইলাম দিলে না।

    আপনার একটু কৌতূহল হল। -- তা কি বল্লো?

    -- বল্লে, আমাদের ম্যানেজার আসবেন, তখন লোন দেয়া শুরু হবে। এখন রোজ দশ টাকা জমা কর। আরে, আটমাসে পোয়াতির বাচ্ছা বিয়োয়, আপনাদের ম্যানেজারের দর্শন দেয়ার নাম নেই। যাকগে, মরুকগে! আমার বাপের কি আসে যায়? সরকারি ব্যাংক, সরকার বুঝুক গে'।

    ওই এসে গেল আপনার ব্যাংক। এবার আপনার মালপত্র কোথায় নামাতে হবে বলুন, আর আমাকে পাঁচ রুপিয়া গুণে দিন। আমি বাকির কারোবার করি না।

    আপনি ভ্যাবাগঙ্গারাম ফ্যাল্‌ফ্যাল্‌ করে দেখলেন..... হঠাৎ জঙ্গল শেষ হয়ে খানিকটে ফাঁকা জায়গা। দু-তিনটে টালির ছাওয়া মাটির বাড়ি। আর উত্তরদিকের বাড়িটা পাকা, দোতলা। তার এক পাশে একটি বারান্দাওলা ঘরের সামনের দেয়ালে পেরেক ঠুকে টাঙানো বোর্ডে লেখা গ্রামীণ ব্যাংক। পূবদিকে ধানের মাড়াইয়ের জন্যে গোবর দিয়ে নিকোনো পরিষ্কার জায়গা। একজন মুনিষ দুই বলদের ল্যাজ মুচড়ে ধান মাড়াই করাচ্ছে। একজন কাজের মেয়ে মাথার পিতলের বিশাল ঘড়া বা কুন্ডায় করে কাছের কোন কুয়ো থেকে খাবার বা রান্নার জল নিয়ে আসছে। আপনি কাছে গিয়ে মন দিয়ে দেখতে লাগলেন বাড়িটির ছাদের কার্নিসে ইঁরেজিতে কিছু লেখা, জোড়াসিংহের কোট্‌ অফ আর্মস্‌, ইয়ার ১৯১২। তাহলে এটি সত্যিই এককালের রাজবাড়ি।

    এমন সময় পেছন থেকে আওয়াজ এলো -- নমস্কার! আসুন ম্যানেজার সাহেব, আমরা কবে থেকে আপনার জন্যে অপেক্ষা করছি। তা' দেবতাদের দর্শন পাওয়া কি সহজ কথা!

    বারান্দার পাশের পেতলের কাজ করা বন্ধ দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছেন এক মাঝবয়সী ভদ্রপুরুষ, পরনে সাদা লুঙ্গি, গায়ে একটি টেরিকটের কুর্তা।

    -- আমি আপনার মকানমালিক, উদ্যমেশ্বরশরণমণিপালপ্রতাপ সিংহ; এ গাঁয়ের জমিদার। আমার এক কিলোমিটার লম্বা নাম মনে রাখা কঠিন, তা' আপনি আর সবার মতন দাদুসা'ব বলেই ডাকবেন। অ্যাই মহেত্তর, শালে! মুঁহ ফাড়কে ক্যা দেখতা হ্যায়? জলদি ম্যানেজার সাহাবকা সামান উঠা অউর বাজুওয়ালে কামরে মেঁ রাখ দে।

    আজ ইতওয়ার, (রবিবার)। আপনার ব্যাংক বন্ধ, আপনার ক্লার্ক গেছে কোর্বাঅ শহরে, সিনেমা দেখতে। আজকের দুবেলার ভোজন আমার ওখানেই হবে। কাল থেকে আপনার স্বতন্ত্র ব্যবস্থা। একি! মহেত্তর কোথায়? বুঝেছি, পালিয়েছে।

    -- কেন? পালালো কেন? ওকে যে মোত বওয়ার দশটাকা দেয়া বাকি।

    ডাদুসাহেবের অট্টহাসিতে বাড়ির ধানের গোলার পাশ থেকে দুটো মোরগ কোঁ-কোং করে পালালো।

    -- বুঝিয়ে বলছি। ব্যাংক থেকে লোন না পেয়ে ও রোজ কাল্পনিক ম্যানেজারকে গাল দিয়ে বেড়ায়। আপনিই যে নতুন ম্যানেজার সেটা বোধ হয় বলেননি। ফলে ম্যানেজারের সম্বন্ধে ওর কি ধারণা সেটা ও আপনাকে বিন্দাস শুনিয়েছে। এখন আমার মুখ থেকে যেই জানতে পারলো যে আপনিই সেই ম্যানেজার তারপর আর ও এখানে দাঁড়ায়? যাকগে, আপনি চিন্তা করবেন না। ওর দশটাকা ও পেয়ে যাবে। এই বুধরাম! এদিকে আয়।

    একটি বছর ষোলোর কালোকোলো হাফপ্যান্ট পরা ছেলে এসে নমস্কার করে দাঁড়ালো।

    -- শুনুন সায়েব! এই হোলো আপনার ব্যাংকের নতুন চাপরাশি। জাতে যাদব, মানে রাউত। এর হাতের রান্না আপনি-অমি খেতে পারি। এরা খুব ভাল সেবক হয়। বিদ্যে বালবাড়ি পর্যন্ত। আপনার ব্যাংক, শোয়ার ঘর -- সব দুবেলা ঝাড়বে, পোঁছবে। বাঁকে করে বালতি-বালতি জল এনে দেবে। রান্না করে দেবে। আপনার কাছে যা বাড়তি হবে, খেয়ে নেবে। হপ্তা চারটাকা নগদ মজুরি নেবে। খুব বিশ্বাসী।

    বুধরাম! ইনি তোর নতুন মালিক। যা! ভালো করে সেবা কর। কোঈ শিকায়েত নহী আনা চাহিয়ে!

    ক'টা দিন ভালোয় ভালোত্য কাটলো। রোজ সকালে দাদুসায়েবের সঙ্গে চা খাওয়া, দু'দিনের বাসি খবরের কাগজ পড়া, বুধরামের হাতের ডাল-ভাত-শাক আর আচার দিয়ে দু'বেলা খাওয়া আর সকাল দশটা থেকে সন্ধে সাতটা অবদি ব্যাংকে বসা। তারপর নিজের কামরায় ঢুকে হ্যাজাকবাতির আলোয় বই পড়া, ট্রানজিস্টরে বিবিধ ভারতী আর ®ঋডিও সিলোন শোনা। তারপর রাতের খাওয়া খেয়ে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়া। এই হল গঙ্গারাম ওরফে ম্যানেজার সায়েবের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা। গন্ডগোল বাঁধলো সপ্তাখানেক পরে এক হাটবারের দিন। ম্যানেজারের নিযুক্তি হওয়ার লোকের মনে লোন পাওয়ার আশা জেগেছে, ব্যাংকে ভিড় বাড়ছে, ভাউচারের সংখ্যা বাড়ছে।

    দুপুরবেলা, ভিড়ের চাপে মাথা তোলার সময় নেই। গঙ্গারামের কানে এল বারান্দায় একটা চাপা ঝগড়ার মত শোরগোল। নারীকন্ঠের খ্যারখেরে চেরা আওয়াজ। চাপরাশি বুধরামকে বলতেই মাথা নেড়ে জানালো -- কিছু না সায়েব, ও হল উম্মেদ কুঁয়ের দিদি। ও ওইরকমই।

    -- কিছু না কিরে? ওকে ডেকে আন্‌।

    বুধরাম অনিচ্ছায় ডেকে আনলো এক মেয়েকে। তেলকালো পানপাতা মুখে টানা টানা চোখ। লম্বাটে গড়ন। আঁচল কোমরে জড়ানো। কিন্তু এখন ওর চোখ দিয়ে আগুন ঝরে পড়ছে।

    গঙ্গারামের সাধারণ প্রশ্নের উত্তরে মেয়েটি ফেটে পড়লো।

    -- হবে আর কি? আমার মা সাতদিনের জ্বরে শয্যাশায়ী, উঠতে পারছে না। ওর একল জমা খাতা আছে আপনার ব্যাংকে। চিকিচ্ছে করাচ্ছি। ওষুধের জন্যে পয়সা তুলতে এসেছি। আপনার ক্যাশিয়ার বাবুটি বলে কি -- হবে না। মাকে নিয়ে এস। যত বোঝাই -- মা বিছানায়, আসতে পারবে না। ওর জন্যেই তো পয়সা তুলছি। কে কার কথা শোনে। এমন মোটা মাথা লোককে কেন যে সরকার মাইনে দিয়ে পুষছে!

    -- দ্যাখ, নিয়ম তো তাই। তোমার মা'র অংগুঠার (বুড়ো আঙুলের) ছাপ না নিয়ে ওর খাতা থেকে কি করে টাকা দেয়া যাবে?

    হে ভগবান! আপনিও? ভাবলাম আপনি পড়ে-লিখে বড়া সাহাব। অনেক বিদ্বান, জ্ঞানী। তা জ্ঞান বেরুলো এই -- ষোড়মাসীঢম্‌! ক্যাশিয়ার ঠিক বলেছে, মাকে আসতে হবে। আরে, কিসে চড়ে আসবে? হাওয়াই জাহাজে? জ্বর নিয়ে হেঁটে আসতে গিয়ে যদি অমার আশি বছরের মা মারা যায় তবে আপনি দায়িত্ব নেবেন?

    গঙ্গারামের মাথায় হঠাৎ রাই চড়ে যাত্য।

    -- বেশি চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বোলো না তো! তোমার মা কি করে আসবে তা আমি কি করে জানবো? উকিলের মত তর্ক না নিয়ে মাকে আনার ব্যবস্থা কর। নইলে টাকা পাবে না, ব্যস্‌।

    -- এই আপনার আখরী ফয়সালা?

    গঙ্গারামের কোথায় কিছু একটা বেজে ওঠে। কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসা মেয়েটির চোখের ভাষায় কিছু একটা আছে। বিহ্বল গঙ্গারাম নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারে না। ম্যানেজার বলছে -- ওকে ১০০ টাকা মায়ের অ্যাকাউন্ট থেকে দাও। আর বুধারাম ভাউচার নিয়ে মেয়েটির বাড়ি যাক। ভাউচারে শয্যাশায়ী মাকে দিয়ে টিপছাপ লাগিয়ে তবে টাকাটা দিক। ফেরত এসে আমাকে দ্যাখাক।

    চমকে ওঠা মেয়েটির কালোহরিণ চোখে কি যেন ভাসে! গঙ্গারাম মুখ ফিরিয়ে নেয়।

    মাসের প্রথম রোববার। আজ পূর্ণিমা। আদিবাসীদের কি একটা স্থানীয় পরব। দাদুসাহেব বিকেলে প্রসাদ নিতে ডেকেছেন। কথায় কথায় বললেন -- আজ রাত্তিরে একতু জেগে থাকুন। একটা জিনিস দেখাব। শহুরে জীবনে কখনও দেখেননি।

    -- কি বলুন তো?

    -- পঞ্চপরমেশ্বরের বিচার। একটি বদচলন মেয়ের বিচালন মেয়ের বিচার হবে। এই এখানেই, ব্যাংকের সামনের আঙিনায় যে ইঁট দিয়ে বাধানো চাতাল মত আছে, ওখানেই হবে। ঘরে থাকুন, সময় হলে বুধরাম আপনাকে খবর দেবে।

    সারা দুপুর গঙ্গারাম ছট্‌ফট করে কাতাল। পাঁচমাথার বিচার, মানে আগেকার জুরির বিচারের মতন। ছেলেবেলার স্মৃতি থেকে একটা ভুলে যাওয়া বেয়াড়া লাইন মাথার মধ্যে বোলতার মত ভোঁ ভোঁ করতে লাগলো -- কাজীর কাছে হয় বিচার, একুশ টাকা দন্ড তার।

    গাঁয়ের ব্যাপার, ওদের সমাজের নিজস্ব। আমার কি? আমি কেন ঘুড়ির মত লাত খেয়ে মরছি! বিকেল নাগাদ গঙ্গারামের কাছে নিজের লাট খাওয়া মুডের কারণটা স্পষ্ট হল। আসলে বিচারের কেন্দ্রস্থলে আছে এক নারী। তায় আবার বদচলন। না না, তথাকথিত বদচলন। মামলা এখনও সাব জুডিস্‌। কেমন হবে সেই নারী?

    আবার মাথার মধ্যে বোলতার মত ভোঁ-ভোঁ করে এক বেয়াড়া লাইন -- যে নষ্ট তাকে পাওয়া এতই সহজ!

    এসব কি যা-তা ভাবছে সে!

    সন্ধের দিকে আকাশে লালচে চাঁদ, চাতাল ঘিরে অন্ধকার। অন্ধকারে দু'তিনটি মাথা ছোট ছোট দলে গুজ্‌গুজ্‌ ফুস্‌ফুস্‌ করছে। এখানে ওখানে হাতে হাতে ঘুরছে বিড়ির আগুন। চাতালের ওপর পাঁচজন বয়স্ক লোক নিচু স্বরে কথা বলছে। এদের মধ্যে কেবল দাদুসাহেবকেই গঙ্গারাম চেনে। গায়ে চাদর হাতে ছোট লাঠি আর লন্ঠন নিয়ে আরও ক'জন ছোট ছোট দলে হাঁটু মুড়ে বসেছে। চাতালের আরেক দিকে জনা ছয়-সাত মেয়ের দল। অন্ধকারে কারও চেহারা চোখে পড়ে না।

    ছোট ছোট মাটির ভাঁড়ে আর কাঁচের গেলাসে করে সবাইকে চা দিচ্ছে বুধরাম। এবার সবাই নড়ে চড়ে বসল।

    পঞ্চদের একজন একতু গলাখাঁকারি দিয়ে বললেন -- আজকের সভা খুব মহত্বপূর্ণ। এতে সমাজের মানমর্যাদা জড়িত। গাঁয়ের এক মেয়ের চরিত্র নিয়ে কথা উঠেছে। অভিযোগকারী কিরানাব্যবসায়ী বচকামল শেঠের বেটা ছোটু শেঠ। ও আপনাদের সামনে বলবে আঁখো দেখা হাল। তার পর মেয়েটির কথাও শোনা হবে। শেষে পঞ্চপরমেশ্বর রায় দেবেন।

    উঠে দাঁড়ায় ছোটু শেঠ, বয়স কুড়ি-বাইশ।

    -- পঞ্চপরমেশ্বরের জয় হোক। আমি গত রোববার সন্ধের সময় সাইকেল চালিয়ে কোরবা যাচ্ছিলাম, দোকানের জন্য মাল আনতে। গাঁয়ের সরহদের কাছে কোসম গাছের নিচে দেখি কিছু ছিনা-ছপটি হচ্ছে। সাবধানে এগিয়ে দেখি -- এ তো অন্য ব্যাপার। আমাদের গাঁয়ের উম্মেদ কুঁয়ের আর দুইজন গুরুজি, তাদের নাম জানিনে। ও হ্যাঁ, একজন মিশ্র গুরুজি আর একজন ওর বন্ধু। এই তিন জন রসলীলায় মত্ত। আমি কাছে এসেছি - কোন হুঁস নেই। আমি সাহস করে যেই হাঁক পেড়েছি -- অ্যাই! কি হচ্ছে কি? দুই গুরুজি হুড়মুড়িয়ে সাইকেল নিয়ে হাওয়া। আর উম্মেদ কুঁয়ের হাতে-পায়ে ধরতে লাগলো -- আমি যেন কাউকে না বলি। ও এমনকি আমাকে খুশি করতেও রাজি। কিন্তু আমি সে বান্দা নই। নিয়মিত পুজোপাঠ করি। বজরংবলির উপোস করি।

    আমার নিবেদন -- এইসব বদচলন মেয়ে, যাকে স্বামী ছেড়ে দিয়েছে, যে এদিক-ওদিক অন্যের ওপর ডোরে ডালে -- এরা সমাজের কলঙ্ক। একে গাঁ ছেড়ে চলে যেতে বলা হোক। এখন পরমেশ্বর জা বলেন।

    সভা জুড়ে এক গুঞ্জন। কিন্তু হঠাৎ সবাই চুপ। মেয়েদের ছোট দল থেকে দাঁড়িয়ে উঠেছে একটি মেয়ে, অন্ধকারে বোঝা যায় লম্বাটে গড়ন। গঙ্গারাম চিনতে পারে--

    এ তো সেদিন ব্যাঙ্কে চোপা করা মেয়েটা! উম্মেদ কুঁয়ের।

    -- পঞ্চপরমেশ্বরের জয় হোক্‌। ইয়ে শেঠ কা বেটা সরাসর ঝুঠ বোল রহা হ্যা। আমি ওর হাতে-পায়ে ধরিনি। উল্টে ও বলছিল ওর কথায় রাজি হলে কেউ জানতে পারবে না। রাজি হইনি তাই সাধু সেজে নালিশ করেছে।

    অন্ধকারে ঢেউ উঠেছে, সভা খলবলিয়ে উঠলো।

    বণিকপুত্র মিন্‌মিনিয়ে প্রতিবাদ জানায়। -- ওর কথায় বিশ্বাস করবেন না। ওর কোন চরিত্র নেই বদচলন মেয়েমানুষ। ওর কথার কি দাম?

    গর্জে উঠলো মেয়েটি।

    -- আমি ঝুট বলছি? তোর নান্‌হী লেইকা কে মাথায় হার রেখে কসম খা শেঠ, তুই আমাকে সেদিন পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সরহদপার কোসম গাছের নিচে আসতে বলিস নি? গুরুজিরা আগে এল, সেই তোর রাগ।

    এবার ধমক দিলেন দাদুসাহেব। -- চুপ! কার এত সাহস পঞ্চপরমেশ্বরের সামনে উঁচু গলায় চেঁচায়? বড়দের কোন মানসম্মান নেই? উম্মেদ! এবার বল, কি হয়েছিল?

    -- মাফি দেও হুজুর। হামন গরিব বেসহারা মাইজাত। ওই শেঠোয়া বদমাস। আমরা যারা ওর দোকানে ধান-চাল-গেঁহু সাফ করতে যাই, তাদের হাত ধরে টানে। দশটাকার নোট দেখায়। আমার টাকার দরকার ছিল। মরদ ছেড়ে গেছে। বর্ষার আগে চাল মেরামত করতে হবে। শেঠের কাছে উধার চাইলাম, রাজি হল। কিন্তু বলল -- সন্ধেবেলা, কোসম গাছের নিচে। আমি গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। জহেঠ আসতে দেরি করল। মিশ্র গুরুজি আর পটোয়া গুরুজি সাইকেলে করে ফিরছিল। আমাকে দেখে ফিরে এসে হাসতে লাগল। কার জন্যে এখেনে? তারপর আমার হত ধরল। মিশ্র গুরুজিকে নিয়ে আমার কোন অভিযোগ নেই। উনি ব্রাহ্মণদেবতা। উনি নিজে চাইলেন, তো ওনাকে দান দিয়েছি। দান দিলে পুণ্য হয়। কিন্তু পটোয়া গুরুজিকো জরুর সাজা মিলেঁ। আমি না-না করলাম। শুনলো না, জোরজবরদস্তি করলো। দেখিয়ে মোর কামিজ ফাড় দিস। নখুন সে পিঠ মা চিরা লাগাইস্‌। এমন সময় শেঠ এলো তো ওরা পালালো। আমি থক গয়ী থী। ইতনী জোর, উঠাপটক! কিন্তু শেঠ মানবে না। ও যে আগাম দিয়েছি। আমি বললাম -- না, আরেকদিন। কিন্তু ও রাগ করছে, আমাকে রন্ডী বলে গাল দিচ্ছে, তো আমি বললাম -- যা, শিকায়ত করগে যা!

    এবার সভাকে বাগ মানানো গেল না। পুরুষ-মহিলা সবার জটলা থেকে শোনা যেতে লাগলো -- কি কান্ড! গাঁয়ের আর ইজ্জত রইলো না। ইস্কুলের গুরুজিদের এই ব্যভার? আমাদের বাচ্চারা কি শিখবে? না! মেয়েটাকে কোরবার বাজারে চালে থাকতে বলো। শেঠ ও তো মহা হারামি!

    আবার দাদুসাহেবের জলদ স্বর। -- সবাই চুপ কর। পঞ্চপরমেশ্বর এবার রায় দেবে।

    উম্মেদ কুঁয়ের! তুমি নষ্টের গোড়া। গাঁয়ে থাকতে হলে ঠিক ভাবে থাকতে হবে। আর একবার এমন ঘটনা ঘটলে এই গাঁ ছেড়ে চলে যেতে হবে। সামলে থাক। আর আগামী দশদিন মন্দিরের গায়ে লাগা দেবোত্তর ক্ষেতে দশ দিন বেগার দেবে।

    দুই গুরুজি শিক্ষক নামের কলঙ্ক। গাঁ ছেড়ে পালিয়েছে, আসবে সব শান্ত হয়ে গেলে। কিন্তু এদের তাড়ালে এই অচিন গাঁয়ে সরকার সহজে কাউকে পাঠাবে না। পড়াশুনো বন্ধ হয়ে যাবে। কাজেই সাবধান করে ছেড়ে দিলাম। বদলে এরা মেয়েটাকে এক একটি লাল লুগরা (মোটা সুতোর পাঁচহাতি শাড়ি) দেবে আর গ্রামসভাকে বোগরাভাত(খাসির মাংস আর ভাত) খাওয়াবে।

    আর শেঠোয়া! তুমি তো দেখছি ছুপা রুস্তম! বেচাল দেখলে দোকান তুলে আহিরন নদীর জলে ফেলে দেয়া হবে। বাড়িতে জোয়ান শেঠানি, তবু কাজের মেয়েদের কিকে নজর? মন্দিরের তিজৌরিতে একশ টাকা দেবে আর মেয়েটাকে লাল লুগরা।

    সভা ভঙ্গ। গাছের ডালে একটা পেঁচা ডাকছে। রাত অনেক, সবাইকে বাড়ি ফিরতে হবে।
  • 22 | 45.14.***.*** | ২১ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:৫০741440
  • https://web.archive.org/web/20100115193621/http://banglalive.com/ipatrikaa/sanglap/SanglapDetail31_1_2006.asp

    সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় -- একজন না-লেখকের নাম
    সৈকত বন্দ্যোপাধ্যায়

    ১।

    লেখক দুই জাতের।

    এক। যাঁরা সমস্কিতি করেন। দেশ ও দশের স্বার্থে সভাসমিতিতে চোঙা ফুঁকে ভালো ভালো কথা বলেন। তাঁদের নায়করা গোরার মতো ভাল ভাল কথায় ভরিয়ে দেয় পাতার পর পাতা। তাঁদের বই হু হু বিক্রি হয়। এডিশনের পর এডিশন হয়। পুরস্কার পেয়ে তাঁরা দেশ-দশ-জাতি ও পূর্বপুরুষের মুখোজ্জ্বল করেন। তাঁরা বিদেশি সাহিত্য-কারখানার নিমন্ত্রণ পান এবং ফিরে এসে অবনত শ্রদ্ধায় বিদেশবাসের ধারাবিবরণী লেখেন।

    আর দুই। যাঁরা সমস্কিতি করেন না। শুধু লেখেন। লেখেন, কারণ না লিখে উপায় নেই। তাঁরা রঙচটা লাল বাসে যাতায়াত করেন। খুচরো নিয়ে কন্ডাকটারের সঙ্গে ঝামেলা করেন। ক্ষিধে পেলে গোগ্রাসে গেলেন, মদ খেয়ে নেশা করেন, কামে রমন করেন। এবং তাঁদের মাথার পিছনে কোনও জ্যোতির্বলয় নেই। এঁদের না-লেখক বলা হয়।

    পৃথিবীর লেখালিখির ইতিহাস মূলত এই না-লেখকদের ইতিহাস। এবং বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এই না-লেখকদের কোনও জায়গা নেই।

    অতএব, এ কোনও আপতিক ঘটনা নয়, যে, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় মারা যাবেন যে অনিবার্য ব্যাধিতে, তার নাম অনাহার। ট্রাম নামক একটি অতি নিরীহ যান অনায়াসে চাপা দিয়ে যাবে বঙ্গের শ্রেষ্ঠ কবিকে, এবং মৃত্যুর বহু বহু বছর পর পর্যন্ত তাঁর ঘরের ট্রাঙ্কে পচতে থাকবে সেসব অবিস্মরণীয় গদ্যসম্ভার, যার সামনে গোটা দুনিয়ার নতজানু হবার কথা ছিল। কাফকার ধূসর পাণ্ডুলিপ উদ্ধার করে চিরস্মরণীয় হবেন ম্যাক্স ব্রড, কিন্তু মাল্যবান বা কারুবাসনা কোনওদিন বেস্ট সেলার হবে না। এবং এও কোনও আপতিক ঘটনা নয়, যে, সেই পাঁচের দশক থেকে অন্তত যে দুজনের কাঁধে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল/আছে বাংলা গদ্য ভাষা, ইতিহাসে তাঁরা আজও নাম তুলতে পারেননি। সেই দুজন, যথাক্রমে দেবেশ রায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়। "তিস্তাপারের বৃত্তান্ত'র মতো দ্বিতীয় একটু উপন্যাস বাংলা সাহিত্যে দ্বিতীয়বার রচিত হবে না, যেমন কোনও মরমানুষ দ্বিতীয়বার রচনা করতে পারবে না "ক্রীতদাস ক্রীতদাসী'র মতো আরেকটি গ্রন্থ। সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী এই দুটি গ্রন্থ, যাদের উপর শ্রাবণধারার মতো উপচে পড়া উচিত ছিল পৃথিবীর তাবৎ পুরস্কার, তারা দ্বিতীয় সংস্করণের অপেক্ষায় অনির্দিষ্টকাল কাটিয়ে দেবে শীতঘুমে। এবং এইভাবে, না-লেখকরা শেষাবধি না-লেখকই থেকে যাবেন, সে যতই তাঁরা পুজো সংখ্যায় খেপ খেলুন আর পকেটে জমা হোক একটি দুটি খুচরো পুরস্কার।

    ২।

    তো, কি সেই লক্ষ্মণরেখা, যে অনতিক্রম্যতাকে টপকাতে না পেরে একজন না-লেখক চিরকালই না-লেখক থেকে যান? একটু খুঁটিয়ে দেখা যাক সন্দীপনকেই। তাঁর রচনার দু-একখানি বৈশিষ্ট্যের দিকে চোখ তুলে তাকানো যাক, যদি কোনও ক্লু পাওয়া যায়।

    সন্দীপনের প্রায় প্রতিটি রচনাই শুরু হয় "আজ' অথবা "আমি' দিয়ে। অবশ্যই আক্ষরিক অর্থে নয়। বিজনের রক্তমাংসের প্রথম লাইনেই বিজন দেখে "আজ' তার প্রস্রাবের রং লাল। "কলেরার দিনগুলিতে প্রেম'-এ কথক প্রথম প্যারাগ্রাফেই জানান মমতার সঙ্গে শেষ দেখা হয়েছিল অমুক দিন। আরে দেখা হয়নি। অর্থাৎ "আজ' "আমি' একা। এই "আজ' আর "আমি' এই ক্যাটাগরি দুটিই সন্দীপনের যাবতীয় লেখার প্রাথমিক এϾট্রপয়েন্ট। সূচনাবিন্দু। যা আমাদের কামুর কথা মনে করায়। কামুর "আউটসাইডার'-এর প্রথম প্যারাগ্রাফও ঠিক এভাবেই শুরু হয় -- "মা আজ মারা গিয়েছে। কালও হতে পারে। ঠিক জানি না।' (অনুবাদ বর্তমান লেখকের)। সেই "আজ' এবং "আমি'। কামুর লেখার এই ফরম্যাটকে দ্বিধাহীন চিত্তে বহু জায়গায় আপন করে নিলেও, কামু ও সন্দীপনের অ্যাজেন্ডা এক নয়। বরং প্রায় বিপরীতবিন্দুতে। অস্তিত্ব এবং একাকিত্বের মিথ অফ সিসিফাস নয়, সন্দীপনের বেছে নেওয়া এই সূচনাবিন্দু শুধু এইটুকুকেই হাইলাইট করে, যে, জনতা, লক্ষ কর, আমি বানিয়ে একটি গপ্পো লিখতে বসিনি। মানবাত্মার মুক্তিসাধনাতেও বসিনি, যার শেষ ধাপে হাতে পায়সান্ন নিয়ে উপস্থিত হবে স্লিভলেস সুজাতা সান্যাল। বরং আমি নিজের কথা লিখছি। অর্থাৎ আজ এরকম। বা আমি এরকম। সমস্ত ক্লেদ রক্ত পুঁজ ও পাপাচার সহ। লেখালিখি নয়, এ আসলে এক ব্যক্তিগত স্ট্রিপটিজ। জনসমক্ষে নিজেকে উন্মুক্ত করা। আঁকশি থেকে ঝুলে আছে জীবন, কেটে কেটে দেওয়া হচ্ছে খদ্দেরদের -- অ্যাপ্রোচের দিক থেকে লেক মার্কেটের কাশেম মিয়ার সঙ্গে বিশেষ তফাত নেই -- নিজের লেখালিখি নিয়ে এরকমই লিখেছিলেন সন্দীপন।

    এবং অবশ্যই শুধু এইটুকুই সন্দীপন নয়। শুধু নিজের জীবনকে কেটে কেটে দেখলে একজন সৎ আত্মজীবনীকার হওয়া যায় মাত্র এবং সকল সৎ আত্মজীবনীকারই সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় নন। অতএব শুধু বিষয়বস্তু নয়, ফর্ম বা কনটেন্টও নয়, অ্যাপ্রোচটিই শত সন্তান প্রসবিনী যদু-মধু নামক জনৈক বা-লের (বাঙালি লেখকের) লেখা ও সন্দীপনের রচনার মধ্যে বিভাজিকা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। এ এক জার্নি, যেখানে নিজেই নিজেকে লক্ষ করে চলা হয় আড়াল থেকে, খুঁটিয়ে দেখা হয় আড়ালহীন নিজের প্রতিটি নড়াচড়া। বাথরুমের নিরাপদ প্রাইভেসিতে আমি-আপনি যখন সকলের অলক্ষ্যে টুক করে সেরে নিচ্ছি প্রসাধন, নিজের ব্রনবিঘ্নিত মুখখানাকে পাউডারে পমেটমে প্রেজেন্টেবল করে নিচ্ছি, সন্দীপন তখন সেই প্রাইভেসিটুকুকেও সাড়ম্বরে প্রত্যাখ্যান করছেন, আড়াল থেকে খুঁটিয়ে দেখছেন আয়নার সামনে নিজের জোকার-সুলভ হাবভাব। এবং এই দেখে চলা থেকে জীবনের কোনও অংশের মুক্তি নেই। প্রত্যেকটি ব্যক্তিগত মুহূর্ত, এমনকি লেখার টেবিলে যখন বসছেন তখনও পিছনে সদাজাগ্রত এই পিপিং টম। "লেখার টেবিলে' এখানে বোল্ড এবং আন্ডারলাইন। কারণ লেখকের "নিজের কথা' মানে লেখা বাদ দিয়ে শুধু বাকি জীবনটুকুর ধারাবিবরণী নয়। এ নয়, যে, জীবন নামক ফুটবল মাঠে খেলে চলেছেন একজন ব্যক্তিমানুষ, এবং বাড়ি এসে তার ধারাবিবরণী দিচ্ছেন লেখার টেবিলে বসে। বরং লেখাও লেখকের জীবনেরই অংশ। বা লেখকের জীবনের সবচেয়ে বড় অংশ। অতএব জীবন নিয়ে লেখা মানে লেখা নিয়েও লেখা। লিখতে লিখতে সেই লেখা নিয়েও লেখা। একটি উপন্যাসের ভিতরে সেই উপন্যাসটিকে নিয়ে লেখা। আখ্যানের ভিতরে সেই আখ্যানটিকে নিয়েও লেখা। এইভাবে লেখার মধ্যে শুধু কাহিনী নয়, বিষয়বস্তু হিসাবে ঢুকে পড়ে গোটা লেখাটাই। কাহিনীকে ছাপিয়ে ওঠে লেখালিখি সংক্রান্ত ডিসকোর্স। এবং সন্দীপন প্রবেশ করেন সেই চক্রব্যূহে, যার নাম নন-ন্যারেটিভ।

    অতএব সন্দীপন কাহিনীকে প্রত্যাখ্যান করেন। গৃহিণীর দ্বিপ্রাহরিক সুখী ভাতঘুমের সঙ্গী হয়ে ওঠার অনিবার্যতা থেকে থেকে গদ্যকে মুক্ত করার যুদ্ধে লিপ্ত হন। সরলরৈখিক উপাখ্যানের ছেলেভুলানো গপ্পো আর নয়, আখ্যান গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটির মধ্যেই নিয়ে আসা হয় পাঠককে। আখ্যান নামক রঙ্গমঞ্চে নাট্যাভিনয়ের সামনে পাঠক আর নিষ্ক্রিয় ভোক্তা হয়ে থাকে না, বরং নাটকের গড়ে ওঠার প্রক্রিয়াটিতেই সক্রিয় অংশীদার হয়ে ওঠে। "রুবি কখন আসবে'র মাঝপথে দুম করে থেমে গিয়ে লেখক যখন জানান, যে, দেখতে দেখতে অনেকটাই লেখা হয়ে গেল, আর ক-পাতা লিখলেই এবারের মতো উপন্যাস রচনার ভবযন্ত্রণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে, তখন লেখক শুধু "নিজের কথা' বলছেন তা নয়, উপন্যাস রচনার কূট প্রক্রিয়ার মাঝ-মধ্যিখানে টেনে আনছেন সক্রিয় পাঠককে। এরপরও আখ্যান চলতে থাকে, চলতে থাকে রুবির সঙ্গে প্রেম ও পাপাচারের বর্ণনা, এবং মাঝে মাঝেই কাহিনীর মাঝখানে থেমে গিয়ে, অনেকটাই স্বগতোক্তির ভঙ্গিতে, লেখক বারবার জানতে চান, এরপর কী লেখা যেতে পারে। এই উপন্যাস রচনা, স্রেফ একটি কাহিনী বর্ণনা নয়, বরং একটি সমস্যা, যার সমাধানের দায়িত্ব একা লেখকের নয়, বারবার স্মরণ করিয়ে দেন লেখক। এই প্রসঙ্গে, মনে আসতেই পারে দেবেশ রায়ের আরেকটি বৃহদাকার উপন্যাসের কথা, যেখানে কয়েকশো পাতা লিখে ফেলার পর, লেখক আচমকা পাঠকের দিকে প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, এই যে লেখা হচ্ছে, সেটা কী? আদৌ কি উপন্যাস? নাকি অন্য কিছু? এবং এই প্রশ্নের উত্তরের দায়িত্বও নাকি পাঠকের। যেহেতু পাঠক ও লেখক যৌথভাবে পাঠ করেছে এই শতাধিক পাতা, অতএব এই আখ্যানের রহস্য ভেদে পাঠকের দায়িত্ব কিছুমাত্র কম নয়। অতএব এইখানে দেবেশ রায় ও সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় তাঁদের যাবতীয় পার্থক্য সত্ত্বেও যে যৌথ অ্যাজেন্ডায় স্বাক্ষর করেন তার মূল পয়েন্ট দুটি। এক। নন-ন্যারেটিভ। দুই। আখ্যান লেখকের একার দায়িত্ব নয়।

    এই দুই নম্বর পয়েন্টটি আমাদের তৃতীয় আরেকটি বিষয়ের দিকে এগিয়ে দেয়। যা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। যে, আখ্যান লেখকের একার সম্পত্তি নয়। পাঠকও নয় কোনও নিষ্ক্রিয় ভোক্তা। বরং এটি একটি যৌথ প্রজেক্ট, যার কোনও কেন্দ্র নেই। কেন্দ্র নেই, কারণ লেখক আর "আমার মা সবই জানে' জাতীয় কোনও প্রফেট নন, যিনি দক্ষিণহস্তে টিয়াপাখি নিয়ে নির্ধারণ করছেন আখ্যানের ভূত ও ভবিষ্যৎ। আলোকিত মঞ্চ থেকে লেখক নেমে এসে বসেছেন পাঠকের পাশে, নোংরা সতরঞ্চিতে এবং মঞ্চে আর কোনও বক্তা নেই, যিনি গোরার মতো সমবেত পাঠককূলের ইতিকর্তব্যের কথা মাইক ফুঁকে স্থির করে দেবেন। এটি একটি প্যারাডাইম শিফট, যা সঙ্গে নিয়ে আসে আখ্যান রচনার আনুষঙ্গিক পরিবর্তনগুলিকেও। খুব ছোট করে পয়েন্টের আকারে লিখলে প্যারাডাইম পরিবর্তনের এই চিহ্নগুলি এইরকম :

    এক। গপ্পো নয়, আখ্যানের বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় গপ্পো রচনার পদ্ধতি।

    দুই। সামগ্রিকভাবে একটি বিষয়কে গোটা জেনে ফেলার অপচেষ্টা নেই। লেখকও ততটুকুই জানেন যতটুকু জানে পাঠক। লেখক নতমস্তকে মেনে নেন সেই অক্ষমতা। পাঠকের সঙ্গে একই তলে এসে দাঁড়ান।

    তিন। যেহেতু লেখক সর্বজ্ঞ প্রফেট নন, অতএব আখ্যান থেকে পরিহার করা হয় সবজান্তা গুমোট ভাব। পরিবর্তে আসে লেখকের জানার সীমা এবং অবস্থান নিয়ে ঠাট্টা ইয়ার্কি।

    চার। চরিত্র বিশ্লেষণের "আধুনিক' সাবেকিপনাকে ছেড়ে আসা হয়। কারণ লেখক কোনও চরিত্র সম্পর্কেই "পরম' কোনও স্থানের অধিকারী নন। অতএব, বিশ্লেষণ নয় বিবরণ, রহস্যমোচনের স্মার্টনেস নয়, মানবাচরণের আচম্বিত মোড়ের সামনে হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকেন ভ্যাবাচাকা লেখক।

    এই কটি পয়েন্টকে (যাকে মোটেই একটি সম্পূর্ণ তালিকা বলে দাবি করা হচ্ছে না) চিন্তনের একটি বিশেষ প্যারাডাইমের সঙ্গে মিলিয়ে নেওয়া যায়, যার নাম উত্তর আধুনিকতা। যদিও সন্দীপনের রচনার এই চিহ্নগুলি বেড়ে উঠেছে অনেকটাই স্বাধীনভাবে। সন্দীপন যখন মিনিবইয়ে দাবি করছেন "লেখকের মাথার পিছনে আর কোনও আলোকিত চাকতি নেই' নি:সন্দেহে তার আগেই রলাঁ বার্ত লেখকের মৃত্যু সংক্রান্ত ঘোষণাটি করে ফেলেছেন। কিন্তু নি:সন্দেহে সেই ডিসকোর্সের সঙ্গে সন্দীপনের সম্যক পরিচিতি ছিল না, কারণ নব্বইয়ের দশকেও ইন্টারভিউতে তিনি জানাচ্ছেন যে, লেখকের কাজ হল সত্যে পৌঁছনো। এর বহু বহু আগে ফুকো ঘোষণা করেছেন, যে, সত্য কোনও চরম বস্তু না। সত্যও একটি নির্মাণ। এই ডিসকোর্সের অংশ হিসাবে সন্দীপন দাবি করতে পারেন না, যে সত্যে পৌঁছনোই লেখকের উদ্দেশ্য।

    অতএব সন্দীপনের রচনা "অফিসিয়াল' উত্তরাধুনিক ডিসকোর্সের অংশ নয়। বরং এক অশিক্ষিত পটুত্ব, যা তৃতীয় বিশ্বের ভূমিতেই উৎপন্ন এবং লালিত। বইমেলা, খালাসিটোলা, কফি হাউসজাত লিটল ম্যাগাজিনের আজন্ম প্রিন্স সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যখন লেখেন "লেখকের মাথার পিছনে আর কোনও আলোকিত চাকতি নেই', তখন যে লেখককে তিনি টেনে পথে বসান, তিনি একজন বা-লে বা বাঙালি লেখক। আলোকিত মঞ্চ থেকে যে লেখককে টেনে হিঁচড়ে নামিয়ে এনে, অশিক্ষিত নিচুজাতের শ্রোতৃকুলের সমান আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়, তিনিও একজন দেশীয় লেখক। এবং, এই ম্যানিফেস্টোর রচয়িতা সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, স্বেচ্ছায় খুলে ফেলেন লেখকের রাজার পোশাক। প্রফেটপনা ত্যাগ করে আর পাঁচটা ক্ষুধা তৃষ্ণা ও পরশ্রীকাতর লোকের মতো সামনে আসেন তিনি, সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, যাঁর মাথার পিছনে আর কোনও জ্যোতির্বলয় নেই।

    ৩।

    প্রশ্ন ছিল এই, যে একজন না-লেখক কেন একজন না-লেখকই থেকে যাবেন, শেষ পর্যন্ত। প্রশ্নটির উত্তর, মনে হয় পাওয়া গেছে। স্টারভ্যালু বিনা কোনও ফিল্মি নায়ক হয় না। জিমে বানানো পেশি, ওয়াক্স করা দেহ, এবং লার্জার দ্যান লাইফ ইমেজ, এভাবেই তৈরি হয় নায়ক। একইভাবে তৈরি হন লেখকও। তিনিই লেখক, যিনি সিংহাসনে আসীন, যাঁর হাতে শিল্পসৃজনের যাদুদণ্ড, মাথার চারিদিকে প্রতিভার মায়াকুয়াশা, এবং সদা ঘিরে ধরে আছে অটোগ্রাফ শিকারির দল। লেখা নয়, লেখককে ঘিরে সযত্নে নির্মিত হয় মিথ, যা তাঁকে লেখক করে তোলে। অন্য দিকে না-লেখক এই মিথকে প্রত্যাখ্যান করেন। তাঁর মাথার পিছনে কোনও দিব্যজ্যোতির উপস্থিতির কথা তিনি অস্বীকার করেন। তিনি মঞ্চের সিংহাসন ছেড়ে নেমে আসেন নীচে। তিনি রংচটা লাল বাসে যাতায়াত করেন। খুচরো নিয়ে কন্ডাকটরের সঙ্গে ঝামেলা করেন। ক্ষিধে পেলে গোগ্রাসে গেলেন, মদ খেয়ে নেশা করেন, কামে রমন করেন।

    এতএব না-লেখক চিরকালই হ্যাভ-নটসের দলে থেকে যাবেন। পৃথিবীর লেখালিখির ইতিহাস মূলত না-লেখকদের ইতিহাস, তবুও না-লেখক থেকে যাবেন আলোকিত পৃথিবীর বাইরে। অটোগ্রাফশিকারীরা জাটিংগার পাখির মতো আলোর দিকে ছুটবে, আর অসুখী আত্মার মতো না-লেখক সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়ও থেকে যাবেন অন্তহীন প্রব্রজ্যায়, সে যতই প্রতিষ্ঠান তাঁকে গ্রাস করতে চাক না কেন।
  • দীপ্তেন | 185.22.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ০০:০৮741441
  • https://web.archive.org/web/20100103142748/http://banglalive.com/authorworks.asp?name=deepten

    ব্যাটেলশিপের শেষ প্রহর
    দীপ্তেন
    জুলাই ১৪ ২০০৬

    ব্যাটেলশিপ কথাটা চালু হয়েছিল সেই সপ্তদশ শতকে। নৌ যুদ্ধে তখন প্রায় শ খানেক জাহাজের ফ্লিট যেত এক সঙ্গে। তার মধ্যে গোটা পঁচিশেক থাকত মুখ্য ব্যাটেলশিপ, যাতে থাকত চারটি ডেকে সাজানো একশো থেকে দেড়শো কামান, সংখ্যায় সবথেকে বেশি জাহাজ থাকত আশি থেকে নব্বই কামানের ক্রুজারের, আর কিছু ছিল এক ডেকের খুব বেশি হলে পঞ্চাশটি কামানের ছোট জাহাজ, যাদের কাজ ছিল প্রধানত স্কাউটিং-এর। লড়াই হত জাহাজে জাহাজে, কামান দাগিয়ে। যে পক্ষের জাহাজে কামান যত বেশি এবং দুর পাল্লার, জিতবার সুযোগও তাঁদেরি বেশি। গায়ের চামড়াতেও চাই পুরু ইস্পাতের চাদর। যত শক্ত হবে এই ইস্পাতের রক্ষা কবচ, প্রতিরক্ষাও তত জোরদার হবে।

    কিন্তু এই দুই কারণেই জাহাজের ওজন বেড়ে যায়। যত ওজন বাড়বে, জাহাজের গতিও হবে তত স্লথ। তেল খাবে প্রচুর। এই বিশাল যুদ্ধ জাহাজেরা একে তো চলত থপথপিয়ে তায় উপকুল থেকে বেশি একটা দূরে যেতেও পারত না, তেল ফুরিয়ে যেত। তাই গভীর সমুদ্রে অভিযান হলে এরা তেলের জাহাজ সঙ্গে নিয়ে পাড়ি দিত। কিন্তু এই ভাসমান পেট্রল পাম্প নিয়ে সমুদ্র অভিযান - যেমন খরচা তেমনই ঝক্কির ব্যাপার।

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্যন্ত ছিল এই ব্যাটেলশিপদের রমরমা। এক একটা বিশাল যুদ্ধ জাহাজ তৈরি হত, একেকটা যেন ভাসমান রণদূর্গ আর তাদের সঙ্গে মোকাবিলা করবার কেউ থাকত না। ওই সব দৈত্যরা আশে পাশে রয়েছে জানলেই বিরোধী পক্ষেরা পালিয়ে যেত। প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পর্য্যন্ত ইউরোপের সব দেশেই এই যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে প্রায় একটা পাগলামির ঝড় চলছিল। নতুন নতুন আবিষ্কার। কে কত বেশি আর কত বড় জাহাজ তৈরি করতে পারে -- রোজ খবরের কাগজে সেই নিয়ে নানান আলোচনা, প্রায় একটা হিস্টিরিয়ায় পৌছে গেছিল। যেন যুদ্ধ জাহাজের সংখ্যা আর সাইজ দিয়েই যুদ্ধ জিতে যাওয়া যাবে।

    নতুন টেকনলজিও হল প্রচুর। কালো গান পাউডারের বদলে বাদামি পাউডার যার ফলে কামানের নলের দৈর্ঘ্য বাড়ল। তার সঙ্গে বাড়ল ফায়ারিং রেঞ্জ। নতুন বিস্ফোরক এখন আর কামানের গোলা আর শুধু লোহার বল নয়, স্থল যুদ্ধে যেমন ব্যবহার হয়, সেরকম বিস্ফরণী গোলা। নৌ কামানের ফ্ল্যাট ট্র্যাজেকটরিও চালু হল। আর ডেকের নীচে রাখা কামানের সারি নয় জাহাজের ডেকের উপর ঘুর্ণায়মান টারেটে রাখা কামান, যখন যেদিকে খুশি কামানের মুখ ঘোড়ানো যাচ্ছে, জাহাজকে আর কষ্ট করে পাশ ফিরতে হচ্চে না ব্রডসাইড আক্রমণের জন্য। যাহাজের গতিও বাড়ল। উন্নত ইঞ্জিনিয়ারিংএর ফলে জাহাজের কাঁপুনি কমল, কুড়ি বা তিরিশ মাইল দূরের চলমান জাহাজেও বেশ টিপ করে গোলা ফেলা যেত। নতুন ইঞ্জিনের কারিগরী কৌশলে অব্যাহত ছিল তার উন্নতি। এমন একটা সময় দাঁড়াল যে যুদ্ধজাহাজ তৈরি হয়ে জলে নামবার সঙ্গে সঙ্গেই নতুন টেকনলজি এসে সেটাকে রাতারাতি পুরোনো করে দিত।

    একটা সময় এল যখন এই আর্মড রেসে ক্লান্ত সব পক্ষ ব্যাটেলশিপের টনেজের উচ্চসীমা বেঁধে দিয়ে একটা চুক্তি করলেন। সেটা ১৯২২ সাল। মোটামুটি সকলেই মেনে চলেছিলেন সেই চুক্তি। সেইসঙ্গে অবশ্য ফাঁক খুঁজে সবাই চেষ্টা করছিলেন কী করে ওই চুক্তির মধ্যে থেকেও সবথেকে বড় ব্যাটেলশিপ বানানো যায়।

    চুক্তিও শেষ হল আর সারা দুনিয়া জুড়ে আরেকটি বিশ্ব যুদ্ধের দামামা বাজতে শুরু করল। শুরু হল আবার আরেক দৌড়। বিরাট ভাসমান জলদৈত্য তৈরির। দৌড়ে এগিয়ে রইল জাপান। তাদের তৈরি ইয়ামাটো আর মুশাশি দুনিয়ার সব থেকে বড় ব্যাটেলশিপ।

    জার্মানি বানালো বিসমার্ক আর টিরপিত্‌জ। আমেরিকানরা তৈরি করল ইউ এস এস নর্থ ক্যারোলাইনা, ব্রিটিশদের এইচ এম এস প্রিন্স ওফ ওয়েলস, হুড, আর্ক রয়াল।

    তবে জাপানি ব্যাটেলশিপ ইয়ামতো আর মুশাশি ছিল খুবই অতিকায়। এই সব আমেরিকান, ব্রিটিশ, জার্মান জাহাজের তুলনায় দেড় বা দুই গুন বেশি বড়। পুরু লোহার বর্মে আবৃত, শজারুর কাঁটার মতন প্রচুর কামান। আক্রমণে ও প্রতিরক্ষায় অদ্বিতীয়। সে সময়কার আর কোনও ব্যাটেলশিপ এদের পাশে দাঁড়াতেই পারত না।

    এই জাপানি জলদানবের ছিল সব থেকে বড় আঠারো ইঞ্চি ব্যাসের কামান, সেই জাহাজ লঞ্চ করেই কিন্তু জাপান থেমে থাকেনি। তখনই পরিকল্পনা করছে খুব তাড়াতাড়ি ২০ ইঞ্চি ব্যাসের কামানে সজ্জিত আরো বড় যুদ্ধজাহাজ নামাবে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস অমন বিশাল ব্যাটেলশিপ থাকলে যুদ্ধ করবার প্রয়োজনই হবে না। ভয় দেখিয়েই যুদ্ধ জয় -- একটা জনপ্রিয় জাপানি শ্লোগান ছিল।

    মুশাশি আর ইয়ামাতোতে ছিল নয়টা আঠারো ইঞ্চির কামান। প্রায় পঁচিশ মাইল দূরে ছোঁড়া যেত রাক্ষুশে সব গোলা। প্রায় দেড় টন ওজন এক একটার। দু মিনিটে তিনবার গোলা ছোঁড়া যেত এক একটা কামান থেকে। একই সঙ্গে নয়টা অমন অগ্নিবর্ষী কামানের সামনে দাঁড়াবে কে? আর এইসব নিয়েও মুশাশি চলত বেশ দ্রুত গতিতেই, ঘন্টায় প্রায় ৫০ কিলোমিটার।

    জাপান, ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, জার্মানি, আমেরিকা -- সকলে, সকলেই যখন এই সব ব্যাটেলশিপ গড়তে ব্যাস্ত তখন এদের অজান্তেই ব্যাটেলশিপের মৃত্যু ঘন্টা বাজতে শুরু করেছে। সেটা বোঝেনি কেউ।

    সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় বুঝল না জাপানিরাও। ১৯৪১ সালে পার্ল হারবারে হানা দিয়ে প্রশান্ত মহাসাগরের ব্যালান্স ওফ পাওয়ার ঘুরিয়ে দিল জাপানিরা। সেই লড়াইতে জিতল তারাই কিন্তু শিক্ষা নিল আমেরিকানেরা। পার্ল হারবারে আমেরিকান ব্যাটেলশিপ প্রায় সবকটাই ধ্বংশ হয়েছিল; কিন্তু পরবর্তী চার বছরে মুখোমুখী নৌ যুদ্ধে কোনও বারই জাপান আমেরিকাকে হারাতে পারেনি। জাপান তখনও বোঝেনি যে যুদ্ধের সমস্ত ইকুয়েশন বদলে যাচ্ছে-- জাহাজে জাহাজে লড়াই আর হবে না কখনও। যুদ্ধ হবে এক জাহাজের এরোপ্লেনের সঙ্গে আরেক জাহাজের এরোপ্লেনের।

    ব্যাটেলশিপ বনাম ব্যাটেলশিপ, মুখোমুখি দ্বৈরথ যুদ্ধে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সবথেকে বিখ্যাত ছিল জুটল্যান্ডের লড়াই। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে তিন চার বার এই ডুয়েল লড়াই হল। একটি তো জার্মান জাহাজ বিসমার্কের সঙ্গে ব্রিটিশ জাহাজ প্রিন্স ওফ ওয়েল আর হুডের লড়াই। বিসমার্কের দূর পাল্লার কামানের সঙ্গে হুডের ছিল অসমান লড়াই। তাই হুড ছুটে চলেছিল বিসমার্কের দিকে, যদি একটু বেশি কাছাকাছি এসে যাওয়া যায় তাহলে বিসমার্কের প্লাঞ্জিং ফায়ারের হাত থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। কিন্তু ওই ইমিউনিউটি জোনে পৌছাবার আগেই বিসমার্কের গোলা হুডকে দ্বিখণ্ডিত করে ডুবিয়ে দিল, চোদ্দোশো ব্রিটিশ নৌসেনার মধ্যে মাত্র তিনজন প্রাণে বেঁচে ছিলেন। মাত্র দশ মিনিট যুদ্ধ করেছিল এইচ এম এস হুড। প্রচণ্ড ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে প্রিন্স ওফ ওয়েলস ও পালিয়ে গেল। (অবশ্য এ যাত্রায় বেঁচে গেলেও কয়েক মাস পরেই সিঙ্গাপুরের কাছে জাপানি বোমায় ডুবে যায় এই জাহাজটিও)

    ব্রিটিশ নৌ ইতিহাসে এমন কান্ড কখনও ঘটেনি। একই সঙ্গে তাদের গর্ব, দু দুটি ব্যাটেলশিপ হেরে গেল জার্মান জাহাজের কাছে! কমবেশি একশো ব্রিটিশ জাহাজ বিসমার্ককে তাড়া করে বেড়াতে লাগল। কিন্তু আর সম্মুখ সমরের প্রয়োজন হয়নি।

    ছোট্ট, খুব ছোট্ট বাই প্লেন সোর্ডফিশ। চেহারা দেখলে প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের প্লেনেদের কথা মনে হয়। কোনও রকমে একটা টরপেডো নিয়ে উড়তে পারে। ২৬ মেঞ্চর সন্ধ্যাবেলা অমন একটি ছোট প্লেনের একটি টর্পেডো আঘাত করল বিসমার্ককে। লোহার ডায়নসর ওতেই ঘায়েল। বিসমার্কের রাডার জ্যাম হয়ে গেল। তার গতিও হয়ে গেল খুব ধীর। যেন এক খোঁড়া হাতি। এবার তাকে ধীরে সুস্থে শিকার করা জাবে।

    এতই ধীর গতিতে উড়ত ওই সোর্ডফিশ প্লেন যে নিশানা ঠিক রাখতে পারেনি বিসমার্কের বিমান বিদ্ধ্বংসী গোলন্দাজেরা! তাই খতমও করা যায়নি তাকে। সারা রাত ধরে প্রায় অচল বিসমার্ককে লক্ষ করে চার চারটে ব্রিটিশ ডেস্ট্রয়ার টরপেডো চালিয়ে গেল, কিন্তু একটিও লক্ষ্যভেদ করতে পারল না। পরের দিন সকালবেলাই, দুই ব্রিটিশ ব্যাটেলশিপ পৌঁছে গেল বিসমার্কের কাছে। বিসমার্ক তখন একটু হেলে আছে -- তার কামানেরা আর লক্ষ্যভেদে সমর্থ নয়। প্রতিরক্ষাহীন বিসমার্ককে প্রচণ্ড গোলা মেরে ডুবিয়ে দিল দুই ব্রিটিশ রনতরী। গল্প শেষ? মোটেও না। ২০০২ সালে সাগরের গভীরে বিসমার্কের ধ্বংশস্তুপে এক সমীক্ষা চালিয়ে দেখা গেল যে বিসমার্কের বিশেষ কোনও ক্ষতি করতে পারেনি ব্রিটিশ রণতরীর ১৪ ইঞ্চি কামানের গোলা। তার ইস্পাতের বর্ম মোটামুটি অক্ষতই ছিল। অচল, আত্মরক্ষায় অসমর্থ বিসমার্ককে নিজের থেকেই ডুবিয়ে দেয় তার ক্যাপ্টেন, ব্রিটিশেরা পাছে বন্দী করে বিসমার্ককে এই ভয়ে। বিসমার্কের জলকবরের কারণ নিয়ে এখনও তর্ক চলে!

    বিসমার্কের সহযোগী টিরপিট্‌জ এবারে মিত্র পক্ষের লক্ষ্য। আর জাহাজের ডুয়েল নয় প্রথম থেকেই বিমান আক্রমণ। সে সময়কার সবথেকে বড় ও বিধ্বংশী বোমা, যার আদূরে নাম টলবয়। এক একেকটার ওজন প্রায় পাঁচ টন। কুড়ি হাজার ফুট ওপর থেকে এই বোমা ফেলতে হয়। সেই বোমায় বিক্ষত টিরপিট্‌জকে আর মেরামতির যোগ্য নয় বলে নরওয়ের উপকুলে দাড় করিয়ে রাখা হল। যদি মিত্রপক্ষ নরওয়েতে ল্যান্ড করতে চায় তো টিরপিত এক ভাসমান দুর্গ হয়ে সেটা আটকাবে। ১৯৪৪ সালের নভেম্বর মাসে আরেকবার আক্রমণ চালাল মিত্রপক্ষ। এবারে দুটি টলবয় পরপর আঘাত করল টিরপিট্‌জকে। কয়েক মিনিটের মধ্যে সলিল সমাধি হল টিরপিতজের, তার সঙ্গে প্রায় এক হাজার নৌ সেনানীর।

    জার্মান ফিল্ড মার্শাল রোমেলের মতন জাপানি নৌসেনাধ্যক্ষ ইয়ামামতো ছিলেন শত্রু মিত্র নির্বিশেষে সবাইকার শ্রদ্ধার পাত্র। ইয়ামামতো বুঝতে পেরেছিলেন ব্যাটেলশিপের উপর এই নিরর্থক নির্ভরতা। বিশ্বযুদ্ধের আগে, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী কোনে জিজ্ঞাসা করেছিলেন ইয়ামামোতোকে আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধের সম্ভাব্য ফলাফল নিয়ে। প্রচণ্ড মিলিটারিস্ট জাপানে, ইয়ামামতোর উত্তর ছিল অবিশ্বাস্য রকমের সাহসী। তিনি বলেছিলেন, ছয় মাস কি টেনে টুনে বড় জোর একবছর আমরা দাপিয়ে বেড়াতে পারব, কিন্তু তারপর আমেরিকাই জিতবে। ইয়ামতো পরামর্শ দিয়েছিলেন আমেরিকার সঙ্গে যুদ্ধ না করতে। কিন্তু পরবর্তী কালে যুদ্ধবাজ প্রধানমন্ত্রী তোজো সেই কথা শোনেননি।

    ব্যাটেল ওফ মিডওয়েতে তার আশঙ্কা সত্যি প্রমাণিত হল। দুনিয়া কাঁপানো পাঁচ মিনিটে বিদ্ধস্ত হলো জাপানি নৌবল। এর আগে, কোরাল সির যুদ্ধে প্রথম জাপানি ও আমেরিকান নৌ বহর মুখোমুখি হয়েছিল। কিন্তু সে লড়াই ছিল দু পক্ষের বিমান বাহিনির মধ্যে। কোনও জাহাজের কামান থেকেই গোলা ছোঁড়া হয়নি। যদিও সেই যুদ্ধের ফলাফল ছিল প্রায় সমান সমান কিন্তু একট জিনিস পরিষ্কার হয়ে গেছিল যে কামান দাগিয়ে দুই ব্যাটেলশিপের লড়াই এর দিন শেষ হয়ে গিয়েছে।

    পার্ল হারবারে মুখ থুবড়ে পরে এত তাড়াতাড়ি আমেরিকান নৌ বহর আবার মাথা তুলে দাঁড়াবে এটা কেউ চিন্তা করতে পারেনি। একটা নিশ্চিত জয় খুব প্রয়োজন ছিল ইয়ামামতোর। ঞ্ছডিসিসিভ ভিকট্রিঞ্জ। পার্ল হারবারের চমক ধুয়ে আর কতদিন চলবে? মিডওয়ে দ্বীপ তখন আমেরিকানদের হাতে, ১৯৪২ সালে ইয়ামামতো চল্লেন একশো সাতাশ টি যুদ্ধ জাহাজ নিয়ে মিডওয়ে দখল করতে। সেই বিশাল ফ্লিটের মধ্যে নয়টি ব্যাটেলশিপ। অপর পক্ষে আমেরিকানদের হাতে মাত্র সাতাশটি জাহাজ। তার মধ্যে তিনটি খুব বড় বিমানবাহী রণপোত। আর মিডওয়েতে মজবুত আরো যুদ্ধ বিমান।

    লড়াই কিন্তু হল সেই বিমানের সঙ্গে জাহাজের। জাপানিরা মানসিক ভাবে তখনো ব্যাটেলশিপ নির্ভর, তাদের পরিচালনায় অনেক ত্রুটি ছিল। সেই সুযোগে অমেরিকান যুদ্ধ বিমান মাত্র পাঁচ মিনিটের মধ্যে চার চারটি জাপানি এয়ারক্রাফট কেরিয়ারকে ঘায়েল করে দিল। সারা আকাশ তখন আমেরিকান বিমান বাহিনীর দখলে। অসহায় জাপানি যুদ্ধ জাহাজেরা পিছু হঠল। পার্ল হারবারে খুব ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল আমেরিকান বিমানবাহীর জাহাজ ইউর্কটাউন। কোনও রকমে তাপ্পি তাপ্পা মেরে তাকে সাগরে নামানো হয়েছিল মিডওয়েতে জাপানিদের মোকাবেলায়। শুধু সেই ইয়র্কটাউন রণতরীটি আমেরিকানরা হারাল। ওই পাঁচমিনিটেই জাপানের ভাগ্য নির্ধারণ হয়ে গেল। আর কখনই প্রশান্ত মহাসাগরে তারা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারবে না।

    দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ বড় সাগর যুদ্ধ হয়েছিল লেয়েট গাল্ফে। দুনিয়ার সবথেকে বড় নৌ যুদ্ধ। চারদিনের ওই লড়াইতে বিস্তীর্ন এলাকা জুড়ে ২৮২টি রণতরীর এক সামুদ্রিক কুরুক্ষেত্র। সেখানে শেষ বারের মতন জাহাজে জাহাজে লড়াই হয়েছিল। আর বিমান হানা তো ছিলই। মহাসাগরে লড়াই হয় অনেকটা জায়গা জুড়ে। লেয়েট গাল্ফের যুদ্ধও সেই রকম ভাবে তিন চারটি যায়গায় ভিন্ন ভিন্ন সময়ে হয়েছিল। সেই যুদ্ধে রণতরীর ডুয়েলের একটি বিবরণ।

    আমেরিকান ডেস্ট্রয়ার জনস্টন নেহাতি এক ক্ষুদে জাহাজ। তার ক্যাপ্টেন ইভানস চিরোকি গোষ্ঠীর ইন্ডিয়ান। প্রথম জলে ভাসবার সময়েই জাহাজের সব নাবিক ও নৌসেনাকে ডেকে ইভানস বলেছিলেন, এটি একটি যুদ্ধজাহাজ। ... এই যুদ্ধের পথে যারা যেতে চান না তারা এখনই বলুন এবং এই জাহাজ ছেড়ে এখনই চলে যান।

    ইভানসের রণতরী অবশেষে মুখোমুখি হল জাপানি নৌ বাহীনির। সব ক্যাপটেনেরই ভয়াবহ দু:স্বপ্ন, তার লড়াই যেসব জাপানি জাহাজের সঙ্গে, সেগুলির কামানের পাল্লা ইভানসের কামানের থেকে বেশি। প্রায় নিশ্চিত মৃত্যু। কিন্তু ইভানস পিছু হটলেন না। যেমন একদিন কসাক বাহিনীর বিরুদ্ধে ছশো ব্রিটিশ অশ্বারোহী ছুটেছিল মৃত্যুর পরোয়া না করে, তেমনই ইভান্স শুরু করলেন তার মরণপন লড়াই। কখনও আস্তে, কখনও দ্রুতগতিতে, সব সময়ই এঁকে বেঁকে শত্রুপক্ষের গোলাকে এড়িয়ে তিনি চাইছিলেন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় জাপানি বাহিনীর খুব কাছাকাছি আসা যায়, তার ছোট কামানের পাল্লায় নিয়ে আসা যায় জাপানি জাহাজদের। এ ভাবেই প্রথম কুড়ি মিনিট তিনি টিঁকে রইলেন অবিরল গোলা বর্ষণের মধ্য দিয়ে আর তার মধ্যেই টরপেডো দিয়ে ডুবিয়ে দিলেন অনেক বড় জাপানি ক্রুজার কুমানোকে। এর পর পরই গোলার আঘাতে বিদ্ধ্বস্ত হল জনস্টন। তাও হাল ছাড়েননি ইভানস ও তার নৌসেনারা। প্রায় ডুবে যাওয়া অবদি কামান দাগিয়ে গেছিল জনস্টন। অন্তত দেড়শো জন নৌসেনার মৃত্যু হয়, যার মধ্যে ইভানসও ছিলেন। গল্প চালু আছে যে জাপানি নৌসেনারা তাদের জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে ডুবন্ত জনস্টনকে অন্তিম স্যালুট জানিয়েছিলেন।

    ওই যুদ্ধেই বিশাল জাপানি নৌবহরের সঙ্গে আমেরিকান নৌবহরের বেশ বড় মাপের লড়াই হয়। প্রচণ্ড ভুল পরিচালনায় সম্পুর্ণ জিতে যাবার মুখ থেকে জাপানিরা পিছু হটে আসে। জাপানি নৌসেনাপতি কুরিতার পিছু হটে যাওয়া দেখে অবাক হয়েছিলেন আমেরিকানরাও। তারা যখন নিশ্চিত পরাজয়ের মুখে, তখনই -- আমরাই আসলে হেরে গেছি -- এই ভেবে জাপানিরা পিছন ফেরে।
    সেই সময়ের নৌ যুদ্ধের ইতিহাসে এরকম অদ্ভুত সিদ্ধান্ত ছিল প্রচুর। কেননা কমিউনিকেশন বলতে আলো বা ফ্ল্যাগের সিগন্যালের উপর নির্ভর করতে হত। জাহজ কোনও কারণে ধোঁয়ায় ভরতি থাকলে সেটা সম্ভব হত না। একসঙ্গে একটির বেশি জাহাজকে সিগন্যাল করা যেত না। দ্বিতীয় জাহাজ প্রথম জাহাজের নির্দেশ বুঝে কনফারমেশন পেলে তৃতীয় জাহাজকে জানাবে। এই ভাবে খবর যেত ক্লান্তিকর দীর্ঘ সময় নিয়ে। নৌ যুদ্ধের তখনকার ইতিহাস তাই ভুল বোঝাবুঝিরও এক ইতিহাস।
    ওই যুদ্ধেই ক্রমাগত বিমানহানায় ডুবে গেছিল বৃহত্তম ব্যাটেলশিপ মুশাশি। এ যেন গন্ডার আর ভীমরুলের ঝাঁকের লড়াই। আমেরিকান বিমানবাহী জাহাজ থেকে একে একে চার ঝা`ক হেলডাইভার আর অ্যাভেঞ্জার বোমারু বিমান মুশাশিকে টারগেট করে অবিশ্রান্ত বোমা আর টরপেডো আঘাত করে গেল। ১৭ টি বোমা আর ১৯টি টরপেডোর আঘাতে অবশেষে মুশাশি ডুবে গেল। তার ক্যাপটেন জাহাজ ছেড়ে গেলেন না। ডুবন্ত জাহাজের ডেকে দাঁড়িয়ে স্বেচ্ছা মৃত্যু বরণ করে নিলেন ইনোগুচি।

    ব্যাটেলশিপের ভুমিকা নিয়ে আমেরিকা কিন্তু তার আগেই চিন্তা ভাবনা শুরু করে দিয়েছে। আর যুদ্ধ জাহাজ নয়। আমেরিকান ব্যাটেলশিপেরা এখন শুধু প্রতিরক্ষায় ব্যস্ত। শত্রু বিমানের হাত থেকে এয়ারক্র্যাফট কেরিয়ারকে বাঁচাতে ব্যাটেলশিপই এখন মুখ্য বডি গার্ড। তারা আর প্রধান যোদ্ধা নয়। এ ছাড়া রয়েছে উপকূল থেকে জমির উপর গোলা বর্ষণ, বিশেষত যখন আমেরিকানেরা দ্বীপ দখলের লড়াইতে নেমেছে।

    এয়ারক্রাফট কেরিয়ার এন্টারপ্রাইজকে জাপানি বোমারুর হাত থেকে বাঁচাতে, অমেরিকান ব্যাটেলশিপ আইওয়া একবার এমনই বিমান বিধ্বংশী গোলার দাপট দেখিয়েছিল যে, এন্টারপ্রাইজ শঙ্কিত হয়ে সিগন্যাল পাঠিয়েছিল -- শিগ্গির জানাও, তোমার ডেকে আগুন লেগেছে কি না।

    দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হল, ততদিনে নতুন ব্যাটেলশিপ গড়া বন্ধ হয়ে গেছে। জাহাজে জাহাজে যুদ্ধ আর হবে না কখনও। মিসাইল, টরপেডো, বোমাবাহী বিমানই আক্রমণের প্রধান হাতিয়ার। জাহাজেও মজবুত মিসাইল। আর তিরিশ মাইল দূরে দেড় টনের গোলা ছুঁড়ে শত্রু জাহাজের সঙ্গে লড়াই নয়। মুশাশির আঠারো ইঞ্চি কামানের পর আর বড় কামান ও কামানবাহী ব্যাটেলশিপ তৈরি হয়নি।

    বিশ্ব যুদ্ধ শেষ হবার মুখে বিশাল রণতরীদের মাত্র একটিই অবশিষ্ট ছিল, জাপানি ইয়ামতো। বিসমার্ক, টিরপিট্‌জ , প্রিন্স ওফ ওয়েলস, হুড, মুশাশি একের পর এক কিংবদন্তীর মহারথীরা সাগরের নীচে, তাদের নি:স্তব্ধ কামানের ভিতরে রঙিন মাছেদের আনাগোনা। - বেশির ভাগই ডুবে গেছে যুদ্ধ শুরু হবার প্রথম দু বছরে।
    ওকিনাওয়া দ্বীপে তখন মার্কিন সেনানীরা পৌছে গেছে। সেখান থেকে প্রতিদিনই জাপানের শহরগুলিতে অবরিল বোমা বর্ষণ চলছে। জাপানিরা সব সময়েই সন্ত্রস্ত থাকত তাদের সম্রাটের জীবন নিয়ে। দুনিয়ার সব থেকে বড় সুইসাইড স্কোয়াড বা কামিকাজে হিসাবে পাঠানো হলো ইয়ামতোকে। জাপান থেকে ওকিনাওয়া যাবার জন্য শুধু এক দফা তেল নিয়ে যাত্রা শুরু করেছিল ইয়ামতো। ফিরে আসবার তেল তাদের কাছে ছিল না। ওয়ান ওয়ে টিকেট টু ওকিনাওয়া। আড়াই হাজার নৌ সেনা নিয়ে সেই অসম্ভব যুদ্ধ যাত্রা ইয়ামতোর। আর যেমন হবার কথা ছিল তেমনই হল। ওকিনাওয়া পৌঁছাবার অনেক আগেই আমেরিকান বোমারু আর টরপেডো বিমান ডুবিয়ে দিল ইয়ামামতোকে, তার সঙ্গে সলিল সমাধি আড়াই হাজার নৌ সেনার।

    দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর শেষ বড় রকমের যুদ্ধ জাহাজ ডুবি হয়েছিল ফকল্যন্ডের লড়াইতে। আন্ডারডগ আর্জেন্টিনা তাদের বোমারু বিমান থেকে ফ্রেঞ্চ এক্সোসেট মিসাইল ছুঁড়ে চূর্ণ করেছিল ব্রিটিশ জাহাজ শেফিল্ড।

    যুদ্ধের চরিত্র বদলে গেছে। সাত সাগর কাঁপিয়ে অতিকায় কামান নিয়ে আর দরকার নেই ব্যাটেলশিপের। যারা টিঁকে ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে সেই সব ব্যাটেলশিপেরা, দু একজন মিউজিয়ামের প্রদর্শনী হয়ে রয়ে গেছে। বাকিরা স্ক্র্যাপ ইয়ার্ডে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে, স্টিল মিলে গলে ঢালাই হয়ে আবার ফিরে এসেছে - হয়তো আমার আপনার বাড়ির সৌখিন কোনও সরঞ্জাম হয়ে।

    আর যারা জলের তলায়, রঙিন মাছেদের ক্রীড়াভুমি হয়ে রইল? শ্যাওলা, গুল্মে ভরে উঠেছে মরচে ধরা ইস্পাতের বর্ম। গোলা, বোমা আর টর্পেডোর আঘাতে বিক্ষত, গভীর সাগরের অন্ধকারে শুয়ে এখন নোনা জলে ক্ষয়ে যাচ্ছে সেদিনের দানবেরা।

    অসিকথা
    দীপ্তেন
    মার্চ ৩১ ২০০৬

    জন্মবৃত্তান্ত

    ভীষ্ম তখন শরশয্যায়, দিন গুনছেন কখন সূর্যদেব উত্তরায়ণে যাবেন আর সেই শুভ সময়ে ইচ্ছামৃত্যু বরণ করে নেবেন। তার কাছে এলেন নকুল। পঞ্চপাণ্ডবের মধ্যে সহদেবের সঙ্গে তার নাম উল্লেখ হয়েছে নেহাতই "এক্সট্রা' হিসেবে। দ্রোণাচার্য্যের কাছে অস্ত্রবিদ্যা শিখে তিনি ছিলেন অসিবিসারদ। ভীষ্মের কাছে তাই তার প্রশ্ন তরোয়ালের উৎপত্তি নিয়ে।

    ভীষ্ম এক গল্প ফাঁদলেন। কবে কোন পুরাকালে অসুর নিধনে রুদ্রদেব এক যজ্ঞের আয়োজন করেছিলেন, সেই যজ্ঞবেদী থেকে কালান্তক ঘোর এক পুরুষ প্রকাশিত হল। সেই দানব দলন পুরুষই অসি -- রুদ্রের প্রিয় অস্ত্র। এর পর অসির খুব গুণকীর্তন করলেন ভীষ্ম অস্ত্রের মধ্যে অসিই অগ্রগন্য বললেন, কিন্তু তার পরেই যেন একটু এপলোজিটিকালি বললেন ঞ্ছকিন্তু ধনুর্বেদও উপেক্ষনীয় নয়।'

    আসলে শান্তিপর্বে ভীষ্মের মুখে যতই অসিপ্রশস্তি করা হোক না কেন, অসিবিদ্যা ভারতে কখনই সম্মান পায়নি।

    ধনুর্বেদে অস্ত্রের শ্রেণীবিন্যাসে বলা হয়েছে অস্ত্র তিন প্রকার। মুক্ত, অমুক্ত ও মুক্তামুক্ত। মুক্ত অর্থাৎ (প্রধানত) তীর, যা কিনা দূরে লক্ষ্যভেদ করে। মুক্তামুক্ত হচ্ছে ক্ষেপনীয় অস্ত্র, যেমন বল্লম। হাতে করে নিয়ে ছোঁড়া হয় আর অমুক্ত হছে গদা, কুঠার, বিশেষত তরোয়াল। বিশেষত লিখলাম কেননা হাতে করে লড়াই করা হলেও প্রায়শই উদাহরণ পাওয়া যায় কেউ গদা বা কুঠার ছুঁড়ে মেরেছেন। মুক্ত অস্ত্রই শ্রেষ্ঠ, মুক্তামুক্ত তাও চলে যায় কিন্তু অমুক্ত অস্ত্র নিকৃষ্ট। এ বিষয়ে শস্ত্রাচার্য্যদের মধ্যে দ্বিমত নেই। তখনকার দিনে মহারথীরাও কদাচিৎ তরোয়াল ব্যবহার করেছেন। তরোয়ালের আঘাতে মৃত্যু, যেন খানিকটা অবমাননাকর ছিল। যেমন প্রায়োপবেশনে নিশ্চল দ্রোনাচার্য্যকে হত্যা করেন ধৃষ্ট্যদুম্ন। যেমন অনধিকারী শম্বুক মুনিকে রামচন্দ্র তরবারীর আঘাতে শিরশ্ছেদ করেন। ঠিক যেন যুদ্ধের হাতিয়ার নয়, শাস্তির জন্য জহ্লাদের খাঁড়া। অশ্বত্থামা যখন কুরুক্ষেত্র যুদ্ধ শেষে পাণ্ডব শিবিরে প্রবেশ করে অবশিষ্ট পাণ্ডবদের হত্যা য`জ্ঞে মাতলেন, তখন তিনি খালি হাতেই হত্যা করেন ধৃষ্ট্যদুম্নকে। নিপীড়িত ধৃষ্ট্যদুম্ন সকাতরে অনুরোধ করেন অশ্বত্থামা যেন তাকে অস্ত্রাঘাতে বধ করেন তাকে, তাহলে তিনি স্বর্গলোকে যাবার অধিকারী হবেন। কিন্তু প্রতিহিংসায় উন্মত্ত অশ্বত্থামা সেই সম্মানটুকুও দেননি তার পিতৃঘাতককে।

    মহাভারতে, রামায়নে বা অন্য কোনো পুরাণে তাই তরোয়ালের কোনো সন্মানজনক উল্লেখ নেই যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে। দেবতারাও বিশেষ কেউ তরোয়াল হাতে ছিলেন না । রুদ্রের শূল। ঈন্দ্রের বজ্র, নারায়নের চক্র, বরুনের পাশ, যমের দন্ড। কিন্তু অসি -- তুমি কার?

    তরোয়ালের ছেলেবেলা

    তরোয়ালের জনক হিসেবে মেনে নেওয়া হয় গ্রিক ব্রোঞ্জের কারিগর হেফাস্টাসকে। খ্রিস্টপূর্ব ২৮০০ সালে চর্মকারদের পশুর ছাল ছাড়ানোর ছুরিকে উনি আরেকটু লম্বা করে তৈরি করেন। পরে দেশের রাজা ওই লম্বা ছুরিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেন, সেই অস্ত্রের নাম ছিল মাচাইরা। ঐতিহাসিকেরা মনে করেন এক থেকে দুই ফিট দৈর্ঘ্য ছিল সেই তরোয়ালের। এক দিকে ধারালো, এবং সামনেটা ছুঁচালো। পরে ওই তরোয়ালে হাতল লাগানো হয়। গ্রিকেরা সম্মান দেখিয়ে হেফাস্থাসকে জ্ঞকামারদের ভগবানঞ্চ (আমাদের বিশ্বকর্মা যেমন) বলে গন্য করতেন। সেটা জাপানে বা ইউরোপে, দুই জায়গাতেই সত্য। তবে ব্রোঞ্জ যুগ শেষ হয়ে আরো দেড় হাজার বছর পরে ১৩০০ খ্রিস্টপূর্বে লোহার তরোয়াল তৈরি শুরু হলো। হিট্টাইট ও মায়সেনিয়ান সভ্যতায় এইরকম লোহার তরোয়াল ব্যবহৃত হতো।

    আরও কয়েকশো বছর পর ইস্পাতের প্রযুক্তি চালু হলে বিশাল পাত্রে গলিত লোহা কাঠকয়লার সঙ্গে মিশিয়ে লোহাকে কার্বনযুক্ত করে ইস্পাত করা হতো। খুব ধীরে ধীরে ঠান্ডা করা হোতো গলিত লোহাকে যাতে কার্বনের মাত্রা বাড়ানো যায় । এই রকম ইস্পাতের প্রকৌশল হাতে আসলে একসঙ্গে অনেক তরোয়াল গড়া সম্ভব হতো এবং সেই সময় থেকেই পুরো সেনাবাহিনী সমরাস্ত্রে সজ্জিত হয়ে যুদ্ধ করতো। নামকরনেও বৈচিত্র ছিল, গ্রিকেরা বলতো ক্সাইফস, রোমানরা বলতো গ্ল্যাডিয়াস। প্রায় দুই ফিট লম্বা হতো এইসব তরোয়াল, পরে রোমানরা আরো বড় তরোয়াল, যার নাম ছিল স্পাথা, ব্যবহার করতেন। ব্রোঞ্জের বদলে লোহা এবং তার পরে ইস্পাত -- কমবেশি ১০০০ বি সি নাগাদ তরোয়াল তার শৈশবের সময় পেড়িয়ে এল।

    ভালকানের অন্দরমহল

    বিভিন্ন দেশের অসির তুলনামূলক আলোচনাও রয়েছে অগ্নিপুরানে। "খট্টরদেশজাত খড়গ অতি সুদৃশ্য, আর্ষিক দেশজ খড়গ সকল বিলক্ষন কায়চ্ছিদ্র এবং সুর্পারকদেশোদ্ভব খড়গ সমধিক দৃঢ় হয়। অংগদেশজাত খড়গ অতিশয় তীক্ষ্ম হয়, কিন্তু বংগদেশজাত খরগ তীক্ষ্ম এবং চ্ছেদসহ উভয় ধর্মাত্মক।ঞ্জ পঞ্চাশ অঙ্গুলি (এক আঙুল মানে ৩/৪ ইঞ্চি, পঞ্চাশ আঙুল হল প্রায় তিন ফিট) দীর্ঘ অসি শ্রেষ্ঠ। আরও বলা আছে তিরিশ অঙ্গুলি বা দুই ফিট দীর্ঘ অসি মধ্যম মানের, কুড়ি আঙুলের থেকে ছোট তরোয়াল যুদ্ধের জন্য প্রশস্ত নয়। ঞ্ছপদ্মপলাশাগ্র, মন্ডলাগ্র, করবীরদলাগ্র এবং ঘৃতগন্ধ ও আকাশপ্রভ খড়গই সুপ্রশস্ত।'
    কিছু রিচুয়াল মানতে বলা হয়েছে । যেমন উচ্ছিষ্ট মুখে অসি স্পর্শ করা বারণ। কত দাম দিয়ে কেনা হয়েছে সে তথ্যও প্রকাশ করাও নিষেধ। "কোন জাতীয়' অসি - সেটাও বলা বারণ।

    ১৫৭০ সালে বিজাপুরে লিখিত নুজুম এল উলুম মুলত অ্যাস্ট্রোনমির উপর লেখা বই। কিন্তু অসিবিদ্যা নিয়েও কিছু কথা আছে তাতে যার অনেকটাই অগ্নিপুরাণের পুনরাবৃত্তি মাত্র। অসি-দৈর্ঘ্য নিয়ে একই কথা বলেছেন লেখক। তবে দেড় ফিটের থেকে ছোট তরোয়ালের নাম বলেছেন - বলা হতো নিমচা। তরোয়ালে ছাতা বা শিবলিঙ্গ খোদাই থাকলে সেটি শুভলক্ষণ বলে গন্য হতো। এ ছাড়াও পিপলপত্র বা পদ্মের ছবি ও খোদাই থাকতো তরোয়ালে। অসির সুলক্ষণের মধ্যে সামনেটা হওয়া চাই বাঁশ পাতার মতন। তরোয়ালে পদ্মগন্ধ হলে খুব ভাল, না হলে মদমত্ত হাতীর গন্ধও শুভ। যদি থাকে গোমুত্র বা পাঁক বা কচ্ছপের রক্তের গন্ধ - তবে সেই তরবারি অশুভ।

    সেই সময়কার কিছু কিতাবে ও কবিতায় উল্লেখ আছে প্রায় কিংবদন্তীর মতন খ্যাত জ্ঞভারতীয় অসিঞ্চর। প্রত্নতাত্ত্বিক বি কে সরকার মনে করতেন প্রাচীন ভারতে থেকেই অসিবিদ্যা আরবে যায়। যদিও ঐ কিছু কবিতায় উল্লেখ ছাড়া আর কোন প্রমান নেই সেই ধারনার সমর্থনে।

    ডামাস্কাসের অসির ছিল ভুবনজোড়া নামডাক। কর্ণাটক ও অন্ধ্রপ্রদেশে তৈরি উক্কু ইস্পাত (এক বিশেষ প্রক্রিয়াতে তৈরি হাই কার্বন স্টিল) রপ্তানি হত আরব দেশে, সেখানে ওই ইস্পাত দিয়ে তৈরি হত পৃথিবী বিখ্যাত দামস্কাস অসি। আরব দেশে ওই ইস্পাতের নাম ছিল ংষষঢ়। ইস্পাত। প্রথম ক্রুসেডে ওই দামাস্কাস অসি এমন দাপট দেখিয়েছিল যে খ্রিস্টানেরা ভয়ে থাকতো। তাদের শিরস্ত্রান ভেদ করে যেতো ঐ উক্কু ইস্পাতের তরোয়াল। দ্বন্দযুদ্ধে দামাস্কাসের অসি স্বছন্দে দু'টুকরো করে ভেঙ্গে দিতো ইউরোপের অসিকে। এত ধারালো,তীক্ষ আর দৃঢ় হওয়া স্বত্তেও দামাস্কাসের অসি এতো নমনীয় ছিল যে সেটিকে বাঁকিয়ে পুরো বৃত্তের মতন করা যেত -- আবার ছেড়ে দিলেই আগের চেহারায় ফিরে যেত। এই টেকনলজি আয়ত্ব করতে ইউরোপের আরো অনেকদিন লাগবে। এবং স্পেইনের টলেডো হয়ে উঠবে সেরা অসি নির্মানের কেন্দ্র।

    আর জাপানে অসি নির্মাণ একটি মহান শিল্পের পর্যায়ে পৌছেছিল। খুব ভাল মানের আকরিক লোহার যোগান জাপানে সব সময়েই অপ্রতুল ছিল। তাই অসির অধিকারী হবার যোগ্যতা ছিল শুধুমাত্র অভিজাত শ্রেণীর মধ্যেই। লোহার পাত ঢালাই করে পিটিয়ে ভাঁজ করে আবার পিটিয়ে - এইরকম ভাবে বারো তেরো বার প্রক্রিয়াটি চালানো হতো। যাতে লোহার ভিতর কার্বনের ভাগ সুষম ভাবে ছড়িয়ে পরে আর অশুদ্ধ পদার্থ বেড়িয়ে যায়। তবে এই বার বার ভাঁজ করে পিটানোর একটা অপটিমাম সংখ্যা ছিল, তার বেশি হলে সেই লোহার অসি ভঙ্গুর হয়ে পড়ত। একটি মিথ চালু আছে যে জাপানে এই ভাঁজ করে পিটিয়ে প্রক্রিয়া কয়েক হাজার বার করা হত। সেই ধারণা ভুল।

    এই ভাবে হাই কার্বন স্টিলের তরোয়াল তৈরি হলে শুরু হত পালিশের পালা। খুব দক্ষ পালিশওয়ালারা তিন রকমের পাথর দিয়ে কয়েক সপ্তাহ ধরে ঘষে তরোয়ালকে চকচকে ও ধারালো করে তুলতেন। মুরামাসা, মাসামুনে - এরা ছিলেন বিখ্যাত অসি-শিল্পী। এখনও এদের নাম স্মরণ করা হয়।

    একটি উপকথায় রয়েছে এক কারিগরের তৈরি অসি ঞ্ছযথেষ্ট ধারাল নয়' বলে রাজসভায় বর্জিত হয়। ওই কারিগর ক্ষুব্ধ হয়ে রাজসভা থেকে বেরিয়ে এসে তার তরোয়ালের আঘাতে তিন-তিনটি বিরাট গাছকে দ্বিখণ্ডিত করে চলে যান। খুব বিখ্যাত জাপানি পটচিত্র রচনা এই ঘটনা নিয়ে।

    আমাদের দেশে কারিগরের সম্মান কোনও দিনই ছিল না। কিন্তু তরোয়ালের ক্ষেত্রে এক কারিগর আসাদুল্লহ ও তার পুত্র কুইল আলির নাম ষোড়শ শতাব্দীতে অনেক রাজা-রাজরার তরোয়ালে খোদাই করা ছিল। পরে ওটা একটা ব্র্যান্ড নামে পরিণত হয়। প্রায় পাঁচশো বছর পরের তৈরি তরোয়ালেও শিল্পীরা আসাদুল্লা নাম ব্যবহার করতেন।

    অসিলক্ষণ

    মহিষাসুরমর্দিনীকে অসি দান করেছিলেন মহাকাল। পরে সেটা খড়গয়ে পরিণত হয়। মহিষের গলা কাটতে তরোয়াল বোধ হয় উপযুক্ত ছিল না। পুরাণকারেরা খড়গ আর তরোয়ালে প্রভেদ করতেন না মনে হয়। সমার্থক শব্দ হিসেবে দুটোই ব্যবহার করতেন। কিন্তু মহিষাসুরমর্দিনীর প্রথম দিকের প্রস্তর মুর্তিতে বা পুরাতনী পটচিত্রে অসি অর্থাৎ সরু প্রস্থের ধারালো তরওয়াল থাকত। ক্বচ্চিৎ কখনও বাঁকানো তরোয়ালও থাকত -- কিন্তু বারোয়ারি পুজায় চকচকে খাঁড়া আজকাল যেটা দেখা যায় সেটা নব অবিষ্কার। তবে মার্কেন্ডেয় পুরাণে দেখি দেবী তরোয়াল (কখনো অসি কখন খড়গ বলা হয়েছে) দিয়ে মহিষাসুরের সেনাপতি বিড়ালাসুরকে বধ করেন। মহিষাসুরকেও, দেবীর শেষ আঘাত ওই খড়গ দিয়েই।

    জাপানে তরোয়াল কিন্তু সামুরাই যোদ্ধার আত্মা বলেই গন্য হত। ইউরোপের অনেক দেশে বহুদিন পর্যন্ত কোনো বীর মারা গেলে কবরে দেওয়া হতো তার তরোয়ালকে। ডেনমার্কে এমন প্রচুর তরোয়ালের কবর পাওয়া গিয়েছে। তবে এই অসিপ্রেম কিন্তু রোমান বা গ্রিকেদের মধ্যে অনুপস্থিত ছিল, এটা উত্তর ক্লাসিকাল যুগের ঘটনা।

    তরোয়ালের নামকরণ হত। যেমন রাজা আর্থারের ক্যালিবার্ন (পরে যেটা হয়েছিল এক্সক্যালিবার)। জাপানে তরোয়াল কুসানাগী নিয়ে অনেক রুপকথা রয়েছে। আর আমাদের পুরানে শুধু পাই মহাদেবের চন্দ্রহাস নামের অসি -- যেটা উনি রাবণকে উপহার দিয়েছিলেন। ভারতীয় পুরাণে পাই মহাদেবের অসি, নাম তার চন্দ্রহস, যেটি তিনি রাবণকে উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু রাম-রাবণের যুদ্ধে এর ব্যবহারের উল্লেখ পাইনি।

    ওই তরোয়াল নিয়ে রোমান্স - ভারতবর্ষে কোনদিন গড়ে ওঠেনি। মহাভারতেও একবারই দেখি সুতসোম (দ্রোণপর্বে) অলৌকিক অসিক্রীড়াঞ্চ করেছিলেন এবং তরোয়াল দিয়েই দু'হাজার কৌরব সেনার প্রাণনাশ করেন। সমবেত সেনানী ও আকাশস্থিত সিদ্ধগণ সুতসোমকে পদাতি হইয়া ... যুদ্ধ করিতে দেখিয়া পরম পরিতুষ্ট ও চমৎকৃত হইলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সুবলনন্দন শকুনির শরাঘাতে তার অসি ছিন্ন হয়, অবশেষে তিনি ভীমের রথে চড়ে যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে চলে যান। ভীমও দু একবার অসি চর্ম নিয়ে লড়াই করেছিলেন , যখন শরাঘাতে তার শরাসন ছিন্ন হয়েছিল। নকুল ছিলেন অসি বিশারদ -- তাই তাকেও তরোয়াল নিয়ে যুদ্ধ করতে হয়েছে কিন্তু প্রধানত লড়াই সব সময়েই ধনুর্বাণ নিয়ে। অসিযুদ্ধের বিবরণ মহাভারতে ঐ একবারি হয়েছে। অথচ সারা বিশ্বে বীরত্বের সঙ্গে তরোয়ালের সম্পর্ক ছিল ঘনিষ্ঠ। অসি যুদ্ধ তখনো মোটামুটি ভাবে আঘাত ও বিদ্ধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। এক কোপে গলা কেটে ফেলবার মতন ক্ষুরধার তরোয়াল তৈরি হতে আরও সময় লাগবে। প্রাচীন ইউরোপে তাই বাঁকা (দয়ক্ষৎনধ) তরোয়াল একটা বিরল ঘটনা। তুলনায় এশিয়াতে প্রথম থেকেই কিন্তু সামান্য থেকে শুরু করে অনেকটা বাঁকা তরোয়ালই বেশি প্রচলিত ছিল।

    তরোয়াল নির্মাণশৈলী যেমন উন্নত হতে লাগল তেমনি বর্মের সহন ক্ষমতাও বৃদ্ধি পেতে লাগল। এই চতুর্দশ শতকের ইউরোপে বর্মের কারিগরী কৌশল এমনি উন্নত হয়ে দাঁড়াল যে কোনো তরোয়ালই আর সেই বর্ম ভেদ করতে পারত না। আরও আরও ভারি তরোয়াল তৈরি হতে লাগল। এক হাতে নয়, দুই হাতে ধরা খুব ভারি তরোয়াল সে সময়ে ইউরোপে প্রচলিত হল। শেষ পর্যন্ত জার্মান অসিবিদ গুস্তাভ হাইনশেখ একটি বারো ফিট লম্বা তরোয়াল বানালেন। দু'জনে মিলে সেই তরোয়াল ধরে প্রায় দুরমুশের মতন পিটিয়ে বর্মধারীকে ঘায়েল করতে হত। বলাই বাহুল্য, এই অস্ত্র খুব কাজ লাগে নি। বরং একেবারে উল্টোপথে গিয়ে সরু লিকলিকে তরোয়াল তৈরি হল যেটি বর্মের ফাঁকফোকর দিয়ে ঢুকে বর্মধারীকে আঘাত করতে পারবে। সেই সময়কার তরোয়াল নাম ছিল এসোটেক একটা ইস্পাতের ছুঁচালো লাঠি - ধারের বালাই ছিল না। ডুমার নায়কেরা লড়াই করতেন র‌্যাপিয়ার নিয়ে। সরু এবং তীক্ষ্ম। খুব ধারালো নয়। তাই ইউরোপের অসি যুদ্ধে ভেদন (ঢ়বয়ক্ষড়ঢ়) চলত , ছেদন (ড়রতড়ব,দয়ঢ়) নয়। এই রেপিয়ার , ষোড়োশ ও সপ্তদশ শতকে ক্রমে একটি ফ্যাশন অ্যাকসেসরী হয়ে দাঁড়াল। সান্ধ্যভ্রমণে সুসজ্জিত নায়ক অভিসারে বার হলে কোমড়ে খাপে ঢাকা রেপিয়ারটি চাই। (পরে অবশ্য তরোয়ালের বদলে বেতের লাঠি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেছিল)।

    চতুর্দশ শতাব্দীতে বন্দুকের আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গেই তরোয়ালের দিন ফুরাল। ব্যতিক্রম জাপান। সামুরাইরা ছিল পেশাদার অসিবিশারদ। দুই প্রতিদ্বন্দী সামুরাই মুখোমুখী হলে কিছুক্ষণ তারা বক্তৃতা করতেন তারপর লড়াই শুরু হত। আর এই পেশাদার অসিবিদদের দিয়েই জমিদার গোষ্ঠী কৃষকদের দমিয়ে রাখতেন। বন্দুক হাতে পেয়ে সেই চাষারা রাতারাতি সামুরাইদের সমান যোদ্ধা হয়ে উঠল। জাপানের পুরো সামাজিক কাঠামই বিপন্ন হয়ে উঠল। জাপান সরকার তখন বন্দুকের উপর সরকারী নিয়ন্ত্রণ জারি করে প্রায় সেটাকে নিষিদ্ধ করে ফেললেন । তাই তরোয়াল , তাই সামুরাই, তাই অসিবিদ্যা -- জাপানে আরো শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল।

    জাপানি তরোয়াল কাটানার রমরমা তাই চলেছিল অনেকদিন। অসিবিদ্যা হিসেবে জাপানে কেন্দো ও কেনিজিৎসু জনপ্রিয় ছিল -- এখনও স্পোর্ট হিসেবে জাপানে তা বজায় আছে। সামুরাইরা কালক্রমে সবাই রিটায়ার করলে তারা প্রায় সকলেই অসিবিদ্যার আখড়া খুলেছিলেন । সমগ্র পশ্চিম দুনিয়ায় ফেনসিং, এই বিদ্যা নিয়েও বহু তত্ত্ব, তথ্য ও বই লেখা হয়েছিল। চারশো, সাড়ে চারশো বছর আগের অসিবিদ্যার ল্যাটিন, ইংরেজি,স্প্যানিশ, ইতালিয়ান বইও প্রচুর। তুলনীয় গুরুমুখী বিদ্যায় অভ্যস্ত ভারতবর্ষে অসিবিদ্যা নিয়ে প্রায় কিছুই লেখা নেই। মহাভারতে দ্রোণপর্বে অসি যুদ্ধের চৌদ্দ রকমের ক্রীড়ার বর্ননা রয়েছে। অগ্নিপুরাণে রয়েছে বত্রিশ রকমের অসি সঞ্চালনের বিবরন। যেমন ভ্রান্ত, উদভ্রান্ত, আপ্লুত, বিপ্লুত, সৃত, ইত্যাদি। কিন্তু অষ্টাদশ শতাব্দীতে লিখিত ফরাসী ক্লাসিক ঞ্ছফেনসিংএর পাঠশালা"র মতন অসিযুদ্ধ নিয়ে কোনো পুঁথি নেই। বশিষ্ঠ ধনুর্বেদ শুধুই তীর ধনুকের উপর। অসিযুদ্ধ নিয়ে কোনও কথা নেই।

    তরোয়ালের হরেক কিসিম

    তরোয়ালের কর্মটা কী? এই নিয়ে ব্যাখ্যা রয়েছে অগ্নিপুরাণে। ছেদন, ঘাত, বলোদ্ধারন, হরণ, আয়ত, পাতন, স্ফোতন - এই সাতটি হচ্ছে অসিক্রিয়া । যদি ঢ়বক্ষয়ড়ঢ় হয় গুরুত্বপুর্ণ তাহলে তরোয়াল হওয়া উচিত ছুঁচালো এবং সোজা। যদি ছেদন বা ড়রতড়ব দরকার তো তরোয়ালের চেহারা হওয়া উছিত বাঁকা। এক কোপে গর্দান নিতে হলে তরোয়ালের ব্লেডকে হতে হবে ভারী ও চওড়া - যেমন আমাদের খাঁড়া। বর্মের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গেলে অন্তত একদিক ভোঁতা হওয়া প্রয়োজন । আফগান, তুর্ক ও সর্বশেষে মুঘলেরা ভারতবর্ষে জাঁকিয়ে বসলে তারা নিয়ে আসে আরব দেশের "শামশিরঞ্চ তরোয়াল -। যার ব্লেড ক্রমশ সরু ও অনেকটা বাঁকা (দয়ক্ষৎনধ)। শামশিরের আক্ষরিক অর্থ ব্যাঘের ল্যাজ।

    যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে - প্রাচীন প্রস্তর মুর্তি বা ছবি দেখলে বোঝা যায় ভারতীয় অসি ছিল সোজা ও ছু`চালো। লক্ষ্য করুন মহাবল্লীপুরমের দেবী মুর্তির হাতের তরোয়াল। দক্ষিণের বিরুপাক্ষ মন্দিরের দেবী মুর্তি বা দ্বাদশ শতাব্দীর পালযুগের পোড়া মাটীর ভাস্কর্যে, সব জায়গাতেই সোজা তরোয়াল দেখানো হয়েছে । সাঁচির প্রস্তর শিল্পে বা কুষাণ রাজার প্রতিকৃতিতে লক্ষ্য করবেন তরোয়াল ছিল সোজা । কিছু তরোয়ালের নমুনা পাওয়া গেছে যাতে দেখা যায় তরোয়ালের সম্মুখ ভাগ অনেকটা অঞ্জলির মতন -- কিছুটা চওড়া। পুরাণকথায় অসি ও খড়গ ছাড়ও ত্রিংস্ত্র নামটি পাই। তিরিশ অঙ্গুলি দীড় বলে এর এই নাম । এটি একটি ছোট তরোয়াল। জাপানিরা যেমন অসি যুদ্ধে দুটি তরোয়াল ব্যবহার করত, একটি প্রায় তিন ফিট দীর্ঘ, নাম কাটানা আর দ্বিতীয়টি ছোট, দেড় ফিট দীর্ঘ, নাম ওয়াকিজাশি। এ ছাড়া তরোয়ালের অন্য নাম বা বিবরণ পাইনি। সমার্থক শব্দ -- যেমন কৃপান, এই সব বলছি না। ইংরেজিতে যেমন র‌্যাপিয়ার, স্যেবার, কাটলাস, ফয়েল ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের অসি , সেই রকম শ্রেণী বিভাগ, অন্তত নামকরণের ক্ষেত্রে ভারতবর্ষে তেমন প্রচলিত ছিল না। সোজা তরোয়ালের একটা দিশী নাম ছিল -- সোসুন, কিন্তু সেটা কোন ভাষায় আর কোন যুগে, সেই রেফারেন্স খুঁজে পাইনি।

    ভারতবর্ষে মুসলিম আগমন থেকেই বোধহয় সেই রকম কার্ভড তরোয়ালের প্রতিপত্তি। ঘোড়ায় চেপে লড়াই করার পক্ষে ঐ ধরনের বাঁকানো তরোয়াল আদর্শ ছিল । আরও কারণ ছিল যে যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তরোয়ালের ব্যবহার ভারতে অনেকদিন বজায় ছিল -- তৃতীয় পানিপথের যুদ্ধেও মারাঠা ক্যাভালরী আফগানদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে মুলত: অসিনির্ভর হয়ে। মোঙ্গল বা হুনেদের মতন অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনী ভারতে খুব একটা জোরদার কখনও ছিল না, বল্লমধারী পদাতিক আর অশ্বারোহী অসিবিদ -- এরাই ছিল আক্রমণের মূল স্তম্ভ।

    তবে কেরলের নমনীয় তরোয়াল, উরুলি বা চুট্টুভ্যাল একেবারেই অনন্য। ঠিক তরোয়াল নয়, এক ধারালো স্টিলের চাবুক। বিখ্যাত তরোয়ালের মধ্যে সালাদিনের তরোয়ালের সম্মুখ ভাগ ছিল সাপের জিভের মতন চেরা। হয়তো এই আকৃতির কোনো মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে (দেখলেই ভয় লাগে) কিন্তু আর কোনো সামরিক প্রয়োজন ছিল বলে মনে হয় না।

    বাংলার সামরিক ইতিহাস খুব সমৃদ্ধ নয়। যেটুকু বিবরণ পাওয়া যায় তাতে লাঠি আর সরকির দাপটই বেশি ছিল, আর তরোয়ালের ভুমিকা ছিল আভিজাত্যের নিশান হিসেবে।

    অসির শেষ জীবন

    মুঘল আমলেও যুদ্ধাস্ত্র হিসেবে তরোয়াল বেশ দাপটেই ছিল। বড় কামান দাগিয়ে যুদ্ধ শুরু হত , প্রতিরক্ষায় থাকতো মাস্কেটধারীরা কিন্তু যুদ্ধের ফয়সালা হতো ঘোড়সওয়ার বাহিনীর সংঘর্ষেই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে পুলিশ বাহিনী একবার আর ইতিহাসে শেষবারের মতন ক্যাভালরি চার্জ করেছিল নাৎসি সেনার বিরুদ্ধে ,বলাই বাহুল্য সেই লড়াই ছিল নিতান্ত একপেশে। আস্তে আস্তে বন্দুকের ক্ষমতা বাড়তে শুরু হলো। সেই চতুর্দশ শতকে যাত্রা শুরু করে উনবিংশ শতাব্দীর শেষ হবার আগেই ব্রিচ লোডিং রাইফেল এসে গেছে। ছুটন্ত ঘোড়ার পিঠে মুক্ত কৃপান হাতে বীর, সুর্য্যের আলো ঠিকরে পরছে - এমন রোম্যান্টিক দৃশ্য শুধু ইতিহাসের পাতাতেই রয়ে গেল। সামরিক বাহিনীতে সেরেমোনিয়াল সোর্ড ছাড়া তার আর কোনো ভুমিকা রইল না।

    প্রায় সাড়ে চার হাজার বছর ধরে নানা রুপকথায় আর ইতিহাসে, নানান বীরগাথার সঙ্গে জড়িয়ে , মাকে নিয়ে যাচ্ছে অনেকদুর, সেই ছোট্টো রাজকুমার থেকে পিশাচী নিধনী বেঔল্ফ - দেশ বিদেশের হাজার রূপকথায় জড়িয়ে এই অসি। আর আজ কফি টেবিল বুকের মনোরম পাতায় আর মিউজিয়ামের দেওয়ালে তার শেষ ঠাঁই হল। তরোয়াল বৃদ্ধ হলেন।

    শেষ বিচার!
    দীপ্তেন
    জানুয়ারী ১৬ ২০০৬

    ঔরঙ্গজেবকে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিকেরা খুব স্পষ্ট দুটো শিবিরে বিভক্ত। খারাপ এবং ভালো। সাদা এবং কালো। আসলে একটা স্ট্যান্স, অন্যটার প্রতিক্রিয়া।

    তাহলে সত্যিটা কী? কোথাও একটা। যে জন আছে মাঝখানে। কিছুটা সাদা, অনেকটা কালো, আর কিছু ধূসর। জীবন যেরকম হয় আর কি। আমার, আপনার, মেজোমামা, বা আপিসের বস - আদ্যন্ত খারাপ বা ভালো কেউ নয়। পাঁচমিশেলি।

    সেই সময়কার রাজা রাজরাদের মতন খুব অল্প বয়স থেকেই লড়ে যেতে হয়েছিল ঔরঙ্গজেবকে । বাবা শাজাহান তার বাবা জাহাঙ্গিরের বিরুদ্ধে অসফল বিদ্রোহ করেছিলেন। তৈমুর বংশে এ ঘটনা নতুন কিছু নয়। তো বাবার "অপরাধে', ঔরঙ্গজেবকে তার ঠাকুর্দা জাহাঙ্গিরের কাছে অনেকটা যেন "হস্টেজ' হিসাবেই বড় হতে হয়েছিল। পিতৃস্নেহ বঞ্চিত ঔরঙ্গজেবকে এই বঞ্চনা তাড়া করে বেড়াবে অনেক দিন।

    হিন্দুদের ক্ষেত্রে আইনটা খুব সোজা সাপটা। বড় ছেলে পাবে সিংহাসন। ধৃতরাষ্ট্রের ভুবন কেঁপে গেছিল যখন তিনি জানতে পারলেন দুই ভাইয়ের সন্তানদের মধ্যে যুধিষ্ঠিরই জ্যেষ্ঠতম। রামের দাবি নিয়ে কোনও সংশয় ছিল না - কখনও। কিন্তু তৈমুর বংশে এমন কোনও আইন ছিল না । সবাই জানত বাবা মারা গেলে যোগ্যতম সন্তান (পড়ুন সবথেকে শক্তিশালী) হবে সিংহাসনের দাবিদার।

    সেই মতন তৈরি হচ্ছিল চার ভাই। দারা, সুজা, ঔরঙ্গজেব আর মুরাদ। দেশের চার ভাগ চার ভাইকে বাঁটোয়ারা করে দিয়েছিলেন শাজাহান। জ্যেষ্ঠ সন্তান দারার প্রতি তার দুর্বলতাও কারুর অজানা ছিল না।

    মাত্র সতেরো বছর বয়সেই বাবা শাজাহান তাকে দক্ষিণদেশের গভর্নর করে দিলেন। সে সময় দাক্ষিণাত্য বেশ শান্ত যায়গা। নিরুপদ্রবেই ছিলেন ঔরঙ্গজেব। কুড়ি বছর বয়সে বিয়ে ও হল। কিন্তু একটা অভিমানের আগুন ছিল তার বুকে, বাবা যে অনেক বেশি ভালোবাসেন দারাকে।

    তার পঁচিশ বছর বয়সে বোন জাহানারা অগ্নিদগ্ধ হন। বেশ কিছুদিন খুব যমে মানুষে টানাটানি গেল। সব ভাই ই আগ্রায় ছুটে এলেন - বাদ শুধু ঔরঙ্গজেব। তিনি এলেন ঘটনার এগারো দিন পরে। রেগে আগুন শাজাহান তাকে দাক্ষিণাত্যের গভরনরশিপ থেকে দূর করে দিলেন। পরে ঔরঙ্গজেব বলেছিলেন "দুর, দুর, বাবা আমায় কি বহিষ্কার করবেন? দারার প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে আমি নিজেই ছেড়ে দিয়েছি'। তার ক্ষোভ ও অভিমানের সূত্রপাত সেখান থেকেই ।

    কিন্তু শাজাহান ঔরঙ্গজেবের সম্পর্ক বা ভাই বোনের মধ্যে স্নেহ ভালোবাসর অভাব - এটা কিন্তু অনেক আগের থেকেই খুব পরিষ্কার ছিল। বাবার সঙ্গে সম্পর্ক আরও খারাপ হতে থাকে। পরের বছর শাজাহান সাত মাসের জন্য "বহিষ্কার' করে দিলেন তার তৃতীয় পুত্রকে। রাজ সভায় আসবার অনুমতি ছিল না ঔরঙ্গজেবের।

    যা হোক, এর পরের বছর গুজরাতের শাসনকর্তার পদ পান ঔরঙ্গজেব আর তার পর অকর্মণ্য মদ্যপ কনিষ্ঠ পুত্র মুরাদকে সরিয়ে আফগানিস্তান অঞ্চলের দায়িত্বও তাকে দেন শাজাহান। অশান্ত অঞ্চলকে বশে আনেন যুদ্ধবিদ ঔরঙ্গজেব, এই সময়েই লড়াই চলাকালীন যুদ্ধক্ষেত্রে অকম্পিত হৃদয়ে নামাজ পড়বার পর তার ধ্রমবীর হিসাবে খ্যাতি ও খুব হয়।

    ১৬৫৭তে শাজাহান গুরুতর অসুস্থ হলে দারা সুকো আগে ভাগেই নিজেকে সম্রাট ঘোষণা করে ফেললেন। চার ভাইতে যুদ্ধ শুরু হল। সুজা পালাল বর্মা দেশে - সেখানেই তার মৃত্যু হল। যে মুরাদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ঔরঙ্গজেব লড়াই করছেলেন তাকে এক অসতর্ক মুহূর্তে বন্দী ও পরে হত্যা করেন ঔরঙ্গজেব। দারা বন্দী হলেন। প্রকাশ্য লাঞ্ছনার পর তার মুণ্ডচ্ছেদ করা হল - এত সবাই জানেন। বৃদ্ধ শাজাহান হলেন অন্তরীন। তার পাশে তখন শুধু জাহানারা।

    পথের কাঁটা সবাই দুর হল। এবারে সাম্রাজ্য শুধু তার। ঐতিহাসিক লেনপুল লিখেছিলেন সেকালের ওইটাই রীতি। হয় সিংহাসনে বসো নয়তো নিহত হও। মাঝামাঝি একটা শান্তিপুর্ন সহাবস্তান সম্ভব ছিল না। সুচ্যগ্র মেদিনী কেউ ছাড়েনি। ইয়া তখত ইয়া তাবুত - অর্থাৎ হয় সিংহাসন নয় তো মৃত্যু – এই আওয়াজ তুলে চার ভাই ময়দানে নেমেছিলেন - সবাই জানতেন বেঁচে থাকবে একজন।

    একটু মধ্য বয়সে এসে- ঔরঙ্গজেব ক্রমশ আরও বেশি করে ধর্মের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। তার দ্বিতীয় বারের দাক্ষিণাত্যের গভরনরশিপের সময় থেকেই তিনি ঞ্ছরাজার চোখে সবাই সমানঞ্জ নীতি থেকে সরে আসলেন। হিন্দুদের উপর বাড়তি কর বসানো – এইসবের শুরু তখন থেকেই। দেবদাসীদের নাচ বন্ধ করলেন ও প্রথম হিন্দু মন্দির ধ্বংশ এখানেই শুরু –যদিও একটা এজেন্ডা হিসাবে মন্দির ভাংতে আরও একটু দেরি আছে।

    তবে মন্দির ভাঙা, বিগ্রহের অবমাননা সব ক্ষেত্রেই, আবার লিখছি সব ক্ষেত্রেই নিছক পরধর্ম বিদ্বেষ নয়। এটা একটা রাজনৈতিক দাদাগিরি। ঔরঙ্গজেবের ক্ষেত্রেও এটা ব্যতিক্রম নয়।

    দাক্ষিণাত্যে সুদীর্ঘ ২৬ বছর লড়াই করেছেন কিন্তু সেখানকার দেবালয়গুলিকে মোটামুটি অক্ষতই রেখেছিলেন আলমগির, তুলনায় উত্তর ভারতে দেবালয় ধ্বংসের সংখ্যা অনেক বেশি। কেননা দাক্ষিণাত্যের বিরোধী পক্ষ ছিল সহধর্মী মুসলমান - তাই সেখানে মন্দির গুঁড়িয়ে দিয়ে কোনও প্রতিহিংসা চরিতার্থ হত না, আর আলমগীর সেটা করেনননি।

    দুটো প্রতীকি ঘটনা উল্লেখ করি , ১৫৭৯ সালে গোলকোন্ডার সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব ছিল মুরহরি রাওয়ের হাতে। তিনি ছিলেন মারাঠি ব্রাহ্মণ - কিন্তু যুদ্ধ জয়ের পর পরাজিত রাজা কৃষ্ণদেবরায়ের অহোবিলম মন্দিরের বিগ্রহ ভেঙে দেন।

    অথবা যে কাহিনী আমরা বাঙালিরা গর্বের সঙ্গে স্মরণ করি, কাশ্মীরের রাজা ললিতাদিত্য পরিহাস কেশব বিগ্রহকে সাক্ষী রেখে গৌড়াধীশকে গুপ্তহত্যা করলে, "প্রভুহত্যার প্রতিশোধকল্পে' কিছু গৌড়বাসী কাশ্মীর যান। সেখানে পরিহাস কেশবের মন্দির ঠিকঠাক চিনতে না পেরে রজতময় রামস্বামীর "বিগ্রহ উৎপাটিত করিয়া, রেনুরূপে পরিণত করিল ও তিল তিল করিয়া চতুর্দিকে নিক্ষেপ করিল'। ঐতিহাসিক কলহন পর্যন্ত লিখেছিলেন "রামস্বামীর মন্দির অদ্যাপি বিগ্রহ শূন্য , কিন্তু গৌরীয়গণের যশোরাজিতে জগৎ পুর্ণ রহিয়াছে'।

    একে তো মন্দির ইত্যাদি সব সময়েই মণি মুক্তায় ভর্তি থাকত, লুট করার এ তো একটা বড় কারণ, আরেক কারণ একশো ভাগ রাজনৈতিক, সেখানে ধর্মের সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই মন্দির বা বিগ্রহ ধ্বংসের। তুর্কী সৈন্যরা ধেয়ে আসছে শুনে খাজুরাহোর মন্দির পরিত্যক্ত করে চান্ডোলা বংশের রাজারা চলে গেলেন, কোনও রাজনৈতিক ফায়দা নেই বলে তুর্কী সেনরাও খাজুরাহোর মন্দির অক্ষত রেখে দিয়েছিল।

    রিচার্ড ইটন সাহেব দেখিয়েছেন গোটা দাক্ষিণাত্য জুড়েই রাজ, রাজেন্দ্র, চোলা, পল্লবী বংশের রাজারা একে অন্যের মন্দির ভেঙেছেন আর বিগ্রহ লুট করেছেন ।

    ঔরঙ্গজেব একাধিক হিন্দু মন্দিরকে জমি ও অর্থ দান করেছেন এমন দলিল ও পাওয়া যায়। তবু শেষ কথা এই যে, সব ক্ষেত্রেই ঔরঙ্গজেবের আচরণ শুধু রাজনীতি দিয়ে সমাধান করা যায় না। কাশী ও মথুরার মন্দির অবমাননা নেহাতই পরধর্মসহিষ্ণুতার অভাব। সেটা মানতে কোনো বাধা নেই।

    যেহেতু ঔরঙ্গজেবের পরধর্মবিদ্বেষ বর্তমান রাজনীতির সঙ্গেও জড়িয়ে, তাই স্মরণ করা যায় রমেশচন্দ্র মজুমদারের কথা। "ভারতের ইতিহাস রচনা প্রণালী' বইতে উনি লিখেছিলেন ঔরঙ্গজেবকে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক কারণে উদার ও সহিষ্ণু বলে আঁকবার যে মিথ্যাচার চলছে সেটা বর্জনীয় । যদুনাথ সরকারের "দ্য হিস্টরি ওব ঔরঙ্গজেব' মেনে রমেশ চন্দ্র কোনওমতেই ঔরঙ্গজেবকে নিছক হিন্দুবিদ্বেষী ছাড়া কিছু ভাবতে চাননি। অন্য পক্ষে ইরফান হাবিব, রমিলা থাপার, এস গোপাল প্রমূখ বামপন্থী শিবির ঔরঙ্গজেবকে কিছুটা ঞ্ছবেনেফিট ওপ ডাউটঞ্চ দিয়েছেন। বিশ্বম্ভর পান্ধে, আদৌ বামপন্থী ছিলেন না – কিন্তু খুঁজে খুঁজে বার করেছিলেন প্রামান্য দলিল - হিন্দু মন্দিরকে ঔরঙ্গজেবের দানের প্রমাণ।

    আরও মনে রাখুন ব্রিটিশ রাষ্ট্রমন্ত্রী জর্জ হ্যামিলটন যা উপদেশ দিয়েছিলেন তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড কার্জনকে -- পাঠ্য বইগুলি এমন ভাবে রচনা করা উচিত যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদ আরও বেড়ে যায়। লর্দ ডাফরিনকেও বলা হয়েছিল - পাঠ্য পুস্তকের উপর যেন নজর রাখে – যাতে দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদের আগুন জ্বালিয়ে রাখা যায়। প্রায় তিনশো বছরের পুরোনো ইতিহাস তাই খুব পরিকল্পিত ভাবেই অস্পষ্ট। ঘোষিত নীতি অনুযায়ী সাম্প্রদায়িক।

    আসলে হিন্দু মুসলিম সম্পর্কের সমীকরণ খুব সরল ছিল না। জ্যামিতির সহজ ডেফিনিশন দিয়ে সেটা বোঝা সম্ভব নয়। শতকরা হিসাবে শাজাহানের মন্ত্রী সভায় যত হিন্দু ছিলেন, তার থেকে বেশি ছিলেন ঔরঙ্গজেবের সভায়। একসময় তার বারোজন প্রধান মন্ত্রীর মধ্যে এগারো জনই ছিলেন হিন্দু। এমন কি আফঘানিস্তানের মতন মুসলিম প্রধান প্রদেশেও।

    সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন রাজপুত মান সিং। (তুলনীয় শিবাজীর সেনাবাহিনীতে নিয়োজিত মুসলিম আফগান মার্সেনারীর দল)।

    প্রতি বছরেই রাজ্যাভিষেকের দিন প্রোমোশনের লিস্ট বার হত। তাতে প্রতি বছরই থাকত হিন্দুদের নাম। শিবাজীর ছেলে শম্ভুজী, শিবাজীর কাকা ও তার ছেলেরা, ঠাঁই পেয়েছিলেন এই তালিকায়। শম্ভুজী বিদ্রোহ শুরু করলে তার সাথী হন বিজাপুরের মুসলিম নবাব। আসলে এটাই সত্য। তখনকার সমাজে এটাই প্রচলিত – দুই ধর্মের মানুষ একই সঙ্গে সংঘাত ও সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে চলত। একমাত্রিক পরিচয় কারওরই ছিল না।

    হিন্দু থেকে মুসলিম হলে রাজসভায় আখেরে লাভ হত। কিন্তু সেটাই একমার শর্ত ছিল না। ধর্মান্তরিত হলে শাল, দোশালা ও নানান উপহার মিলত, কিন্তু ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে গায়ের জোরে ধর্মান্ত্রিত করার অভিযোগ খুব জোর গলায় কেউ তোলেনি কখনও। সর্বান্তকরণে চাইতেন এক অখণ্ড মুসলিম দেশের সম্রাট হবেন – কিন্তু তরোয়াল দেখিয়ে কাউকে মুসলিম করেননি। জিজিয়া কর বসিয়েছেন, হিন্দু ব্যবসায়ীদের উপর ট্যাক্স বসিয়েছেন, লাল কেল্লার সামনে সেই নিয়ে বিক্ষোভ উঠলে হাতি দিয়ে সেই আন্দোলন ভেঙে দিয়েছেন – এ সবই তর্কাতীত সত্য। তার সাথে সাথে আমলা, সেনাপতি, মন্ত্রী ইত্যাদি পদে হিন্দুদের রমরমাও কম ছিল না। হিন্দুধর্ম বিদ্বেষী ঔরঙ্গজেব তাই কখনই হিটলার হয়ে ওঠেননি।

    অতএব আসল ঔরঙ্গজেবকে বুঝতে হলে চিনতে হবে তার দাদা, তার পরমশত্রু দারা শুকোকে।

    কেমন মানুষ ছিলেন দারা সুকো? আকবরের পরে সব থেকে বড় ব্যক্তিত্ব যিনি শুধু ইসলামিক নয়, বরং সব ধর্মের দেশ হিন্দুস্তানের সম্রাট হবার চেষ্টা করেছিলেন। দুজনেই বুঝতেন আর ভাবতেন কীভাবে হিন্দু ও ইসলাম ধর্মকে এক খাতে বইয়ে দেওয়া যায়। তিনি বই লিখলেন "মজমা উল বাহরিন' অর্থাৎ মহাসাগরদের মিলন। তুলনা করুন তার সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের ৩৩ খণ্ডে "সম্পাদনা' করা "ফতোয়া এ আলমগিরি' - শরিয়তী আইনের উপর টিকা। ছবি আঁকা, ক্যালিগ্রাফি, দর্শন - এ সব কিছুতেই উৎসাহী দারা, পার্সি ভাষায় অনুবাদ করছেন উপনিষদের – আর অন্য মেরুতে ঔরঙ্গজেব, যিনি সব চারুকলা ও সংগীতের বিরোধী ছিলেন। এ যেন শুধু সিংহাসন নিয়ে দুই ভাইয়ের লড়াইই নয় - অসুখ যেন আরো গভীরে। দুটি পথের লড়াই।

    ঐতিহাসিক অ্যাব্রাহাম এরালি বলেছিলেন -- আকবর ছিলেন এক সম্রাট, আর ঘটনাচক্রে তিনি ছিলেন সর্ব ধর্ম সমন্বয়ে গাঢ় অনুরাগী, তুলনায় দারা সুকো ছিলেন এক সর্ব ধর্ম সমন্বয়ী, যুবরাজ হয়ে জন্মগ্রহণ নেহাতই ঘটনাচক্র। দারা উপনিষদের অনুবাদ করছেন, অন্য ধর্ম নিয়ে আলোচোনা করছেন। এই নেশাতেই বুঁদ হয়ে থাকতেন তিনি। বাবার প্রিয় সন্তান। তাকে ভালোবাসতেন নগরের লোকেরাও।

    সেই শৈশব থেকেই ঔরঙ্গজেব ছিলেন একা, বড় একা। বাবা তাকে পছন্দ করতেন না। বারবার তকে অপমান করেছেন, তিরস্কার করেছেন। অনুযোগ করেছেন শুধু রাজস্বের ব্যাপারেই কারচুপি নয়, আমের বাগানের সেরা আমের ফসল নিজের জন্য রেখে বাবা তাকে দিয়েছেন বাজে ফলগুলি! দ্বিতীয়বার দাক্ষিণাত্যের গভর্নর হিসাবে ঔরঙ্গজেব গোলকোন্ডা আর বিজাপুর – এই দুই শিয়া রাজ্যকে প্রায় হারিয়ে দিয়েছিলেন – কিন্তু ঠিক জিতে নেবার মুহূর্তেই শাজাহানের নির্দেশ আসে যুদ্ধ বন্ধ করবার। সবাই জানত যে এই নির্দেশ এসেছিল দারাশুকোর পরামর্শেই। যখন দুই ভাই সমরাঙ্গনে মুখোমুখী তখন শাজাহান একশো ভাগই দারার সমর্থক। এ সেই যুদ্ধ যেখানে মাত্র একজনই বেঁচে থাকবে। এ কথা জানিতে তুমি ভারত ঈশ্বর শাজাহান। কিন্তু তুমি ছিলে দারার পাশে।

    কি ভয়ানক ছিল এ লড়াই সেটা বোঝা যায় যখন দারার জ্যেষ্ঠ পুত্র সুলেইমান লড়াইতে হেরে গিয়ে পালালেন গাড়োয়ালে। এক বছর পর তাকে বন্দী করে আনা হল। কাকা ঔরঙ্গজেবের হাতে তার মৃত্যু অনিবার্য, সুলেইমান সেটা জানতেন। ওই তরুণ। বারবার অনুনয় করেছিলেন, তাকে যেন সরাসরি মেরে ফেলা হয়। সবথেকে অসম্মানের মৃত্যু, জোর করে "পৌস্ত' খাইয়ে (আফিমের এক সরবত, কিছুদিন খেলেই মানুষে সম্পুর্ন জড়বুদ্ধি পিন্ডে পরিণত হয়। বড় অপমানের, বড় দু:খের সেই মৃত্যু)। ঔরঙ্গজেব আশ্বাস দিয়েছিলেন তার তরুণ ভাইপোকে, কিন্তু তিনি কথা রাখেননি। বন্দী করবার পর ঐ ভাবেই জোর করে পৌস্ত খাইয়ে এক বোধবুদ্ধিহীন জড় পদার্থে পরিণত করে তাকে হত্যা করেছিলেন ঔরঙ্গজেব। নৃশংস? নিশ্চয়ই। কিন্তু এই কি ক্ষত্রধর্ম নয়?

    ভীম এক এক করে তার একশো ভাইকেই মেরেছিলেন, দু:শাসনের রক্তপান করে উল্লাসে বলেছিলেন "পৃথিবীর সব থেকে স্বাদু পানীয় আজ পান করলাম আমি।' দুর্যোধনের এক ভাই, ধার্মিক বিকর্ণ, যিনি বরাবর পাণ্ডবদের সমর্থন করেছিলেন, তিনিও রেহাই পাননি। তাকে হত্যা করে ভীম বিলাপ করেছিলেন, অনুতাপ করেছিলেন - কিন্তু বিকর্ণও বেঁচে ফেরেননি। এটাই ক্ষত্রধর্ম। তাই বন্দী করে দারা শুকোকে পায়ে বেড়ি পরিয়ে হাতির পিঠে চড়িয়ে ঘুড়িয়ে ছিলেন দিল্লী নগরীর রাজপথে। নগরীর লোকে যত হায় হায় করেছিলেন সেটা ঔরঙ্গজেবকে আরো ক্রুদ্ধ করেছিল সন্দেহ নেই।

    বিজিত শাজাহানকে প্রাণে মারেননি ঔরঙ্গজেব। কিন্তু আগ্রা দুর্গে যতদিন বন্দী হয়ে বেঁচে ছিলেন, দীর্ঘ আট বছর, ঔরঙ্গজেব আর তার বাবার মুখদর্শন করেননি। এমনকি আগ্রা শহরেও পদার্পন করেননি। শাজাহান মারা যাবার পরেও তার কোনো চিত্ত বৈকল্য ঘটেনি। ধর্ম মেনে কোনও শেষকৃত্যে অংঅশগ্রহণ করেননি ঔরঙ্গজেব।

    বোনেদের মধ্যে রুপসী, বিদুষী জাহানারা প্রথম থেকেই ঔরঙ্গজেবের বিরোধী ছিলেন, আর অসুন্দরী সাদামাটা রোশোনারা কোনও পক্ষেই ছিলেন না। পরে অবশ্য রোশোনারা খুবই ঔরঙ্গজেবের কাছের মানুষ হবার চেষ্টা করেছিলেন। তবু তিনিও বাঁচতে পারেননি, মানুচ্চি লিখেছিলেন পরে ঔরঙ্গজেব বিষ খাইয়ে রোশেনারাকে মেরে ফেলেন – তবে সেটার প্রামান্যতা নিয়ে সংশয় আছে। তবে সারা জীবনের সব থেকে বড় শত্রু ছিল দারা শুকো। মৃত্যুর পরেও যার জনপ্রিয়তা ঔরঙ্গজেবকে তাড়া করে বেড়াত।

    অন্যান্য মুঘল সম্রাট, বিশেষত শাজাহান যে স্থাপত্যের নমুনা রেখে গেছিলেন, সেই তুলনায় সমান্য কয়েকটি মসজিদ গড়েছেন। যার কোনওটই তেমন উল্লেখযোগ্য নয়।

    বাদশাহী প্রতিকৃতিতে দেখি বৃদ্ধ আউরঙ্গজেব, মাটির উপর আসনে লুটিয়ে প্রার্থনা করছেন। শুষ্ক চোখ, ভাঙা গাল। শেষ বয়সে স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন দরিদ্রের জীবন। শেষ জীবনে অবসর সময়ে কোরানের প্রতিলিপি লিখেছেন, হজ যাত্রীদের জন্য নামাজের টুপি সেলাই করে বিক্রি করেছেন। চেষ্টা করেছেন শুধু সেই অর্থে নিজের সামান্য খরচা চালাতেন।

    কাউকে ভালোবাসেননি। নিজের ছেলেমেয়েদেরও না। জেষ্ঠ্য পুত্র সুলতানকে মাত্র একুশ বছর বয়সেই জেলে পাঠান। ষোলো বছর বন্দী থেকে ৩৭ বছর বয়সে মারা যান সুলতান, ঔরঙ্গজেবের প্রথম সন্তান। দ্বিতীয় পুত্র মুয়াজ্জাম তৈরি ছেলে। জালিয়াতির অভিযোগে তকে আট বছর বন্দী রাখেন আলমগের। যা হোক , এই ছেলেই পরে, বাবার মৃত্যু হলে সিংহাসনে বসেন – বাহাদুর শহ নাম নিয়ে। তার চতুর্থ পুত্র আকবর ছিল ঔরঙ্গজেবের প্রিয় সন্তান। কিছুটা ভালোবাসা ঔরঙ্গজেব তার জন্যই তুলে রেখেছিলেন। কিন্তু শিবাজীর ছেলে শম্ভুজীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে বাবার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন এই আকবর। যুদ্ধে হেরে পালিয়ে যান পারস্যে। সেখানেই মৃত্যু। বিদূষী কন্যা জেবউন্নিসা, পিতৃদ্রোহী ভাই আকবরের প্রতি সহানুভুতিশীল থাকার অপরাধে জীবনের শেষ একুশ বছর এক দ্বীপে বন্দী হয়ে থাকেন।

    এই স্নেহ ভালোবাসাহীন মৃত্যুপুরীতে কাকে শাসন করতে তুমি আলমগির?
    তার মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য আর টেঁকেনি। নব্বই বছর ধরে তেরো চোদ্দোবার রাজা বদল করে অবশেষে ব্রিটিশ রাজের কাছে আত্মসমর্পন।

    চরিদিকেই বিদ্রোহের আগুন – শিখ, মারাঠা, দক্ষিণের শিয়া নবাবেরা। এলাহি যুদ্ধের আয়োজন। প্রায় তিরিশ বর্গমাইলের অস্থায়ী তাঁবুর একটা পুরো শহর চলত তার সঙ্গে। পঞ্চাশ হাজার উট, তিরিশ হাজার হাতি, পাঁচ লক্ষ লোক। তার কঠোর ধর্মনীতি, সারা ভারতবর্ষকে বিদ্রোহী করে তুলেছিল। বিরামহীন যুদ্ধে তামাম হিন্দুস্থান বিক্ষত, রাজ ভাণ্ডার নি:স্ব।

    প্রয় পঞ্চাশ বছরের রাজত্বে শুধুই শত্রু বেড়ে চলেছে। শেষ পঁচিশ ছাব্বিশ বছর শুধুই যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধ যত না রক্তক্ষয়ী, তার চেয়েও বেশি এলাহি। অশিতীপর বৃদ্ধ বড় ক্লান্ত। তার চারিদিকে জীবনের সফেন সমুদ্রে তিনি এক হাল ভাঙা নাবিক। প্রিয় উত্তরাধিকারী কেউ নেই। অলস, ইন্দ্রিয়াসক্ত বাহাদুর শাহ বেলা বরোটার আগে নাকি ঘুম থেকে উঠতেই পারতেন না। আর কেউ নেই তার পাশে।

    সারাজীবন, দীর্ঘ জীবন শুধু লড়াই করে যেতে হয়েছে তাকে দারা শুকোর সঙ্গে। সেই দীর্ঘদেহী দার, লোহার জিঞ্জির পরে হাতির পিঠে বসে, গায়ে পরিয়ে দেওয়া হয়েছে শতছিন্ন ভিখারির পোশাক, হাতির হাওদায় নেই রাজছত্র। পিছনে বসে খোলা কৃপান হাতে জহ্লাদ।

    রাজপ্রাসাদে অন্ত:পুরে, নগরীর পথে সবাই দেখছে পরাজিত অবমানিত বন্দীকে। ঐতিহাসিক মানুচ্চি দিয়েছেন সেই মর্মস্পর্শী বিবরণ। দিল্লীবাসীদের হাহাকারে যত না সম্মানিত হয়েছেন দারা, তারও চেয়ে বেশি অপমানিত হয়েছেন আলমগির। বোধহয় সারা জীবন জ্বললেন সেই আগুনে, আর বার বার দুনিয়াকে দেখাতে চাইলেন আমি দারা সুকোর মতন নই। আমি অনন্য, স্বেচ্ছায় বেছে নিয়েছি সেই পথ যেটি দারার হেঁটে চলা পথের থেকে সবথেকে দূরে। শাজাহানকে লেখা চিঠিতে উল্লেখ করেছেন "দারা শুধু আমার শত্রু নয়, সে ছিল ইসলামের শত্রু'। এই দারা যিনি বলেছিলেন "স্বর্গ হচ্ছে সেই স্থান যেখানে কোনো মোল্লা নেই'। গুঁড়িয়ে দেওয়া মন্দিরের মাঝে কি তাই আলমগির খুঁজে পেয়েছেলেন দারার উপর তার অন্তিম প্রতিশোধ?

    আত্মীয় স্বজনহীন, নিরবান্ধব পুরীতে তার ভালোবাসা পাওয়ার বা দেবার কেউ নেই। প্রায় নব্বই বছর বয়সে মার যাবার আগে লিখলেন তার শেষ ইস্তাহার।

    "একাকী এসেছি এই দুনিয়ায় আমি এক অচেনা আগুন্তুক, একাকীই চলে যাবো অপরিচিত আগুন্তুক হয়েই।...জানি না আমি কে? কি রয়েছে লেখা আমার কপালে?... বড় পাপ করেছি। কি শাস্তি রয়েছে আমার জন্য তা আমার জানা নেই। ... আমার নাতির জন্য রইল আমার শেষ প্রার্থনা। আমি পারিনি আমার সাম্রাজ্যকে রক্ষা করতে।'

    হঠাৎ যেন উঁকি দিল এক স্নেহের ভিখারি। তিনি কি অনুভব করেছিলেন দারা শুকোর প্রতিশোধ? ছিন্ন মস্তকের শেষ হাসি?

    আরেক হিরোশিমা
    দীপ্তেন
    ডিসেম্বর ১৬ ২০০৫

    ১৯৪৫ সাল। ফেব্রুয়ারি মাস।

    ইউরোপ জুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন ক্রমে নিভে এসেছে। ইয়ালটায় স্তালিন, রুজভেল্ট, চার্চিল চিন্তা করছেন বার্লিনের পতন - খুব তাড়াতাড়ি হলে জুলাই - আর খুব দেরি হলে ডিসেম্বর। পশ্চিম দিকে মন্টেগোমারি এগুচ্ছেন ধীরে সুস্থে- বার্লিন দখলের রেস নিয়ে তার কোনও মাথাব্যাথা নেই। মন্টেগোমারি আসলে রাইন নদী পার হবার জোগার যন্তর করছেন। সবাই জানেন ওটাই হবে ইউরোপে পশ্চিমা মিত্র পক্ষের শেষ লড়াই। মন্টেগোমারি গুছিয়ে লড়াই করতে ভালোবাসেন - তিনি তখনও প্ল্যান কষতেই ব্যাস্ত। খুব তাড়াহুড়ো কিছু নেই। বৃথা সৈন্যক্ষয় যাতে না হয়, পশ্চিমি মিত্রপক্ষের সেটাও একটা বিবেচ্য বিষয়। এই যুদ্ধ শেষ হবার ঠিক মুখে সেনানীদের মধ্যেও একটা গা ঢিলে দেওয়া ভাব এসে গেছে।

    আর পুব দিকে বাঁধ ভাঙা বন্যার মতন লাল ফৌজ ছুটে আসছে। সেই বাইলোরাশিয়া থেকে শুরু - সেই ক্যাম্পেন শেষ হবে মে মাসের আট তারিখে, নাৎসি জার্মানির শর্তহীন আত্মসমর্পনের পর। বার্লিন দখলের দৌড় রাশিয়ান সেনা বাহিনির দুই মার্শালের মধ্যে - শেষ পর্যন্ত জুখবই জিতবেন, কোনেভকে ফটো ফিনিশে হারিয়ে।

    বারংবার বোমায় বিধ্বস্ত বার্লিন নগরীর এনসার্কেলমেন্ট তখন সম্পূর্ণ। হিটলার বার্লিন শহরেই আমৃত্যু লড়াই করবেন - সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে শেষ মুহূর্তে কোনও মির‌্যাকল তাকে জিতিয়ে দেবে এরকম খোয়াব দেখাও বন্ধ করেননি। দুনিয়ায় আর কেউ ওই ছেলেমানুষি স্বপ্নে বিশ্বাসী নয়। দ্বৈপায়ন হ্রদের ধারে ভগ্নউরু সম্রাটের মতন বড় একাকী তিনি। যারা পালাবার পরিকল্পনা করছিলেন তারা আঁট ঘাঁট বাঁধা শুরু করেছেন। বেশির ভাগেরই একটাই উদ্দেশ্য - রাশিয়ানদের হাতে যেন না পড়ি, যুদ্ধবন্দী হতে হলে আমেরিকানদের হাতে পড়াই ভালো। কবে যুদ্ধ শেষ হবে - লোকে সেটাই ভাবছে- ফলাফল তো সবাই জানে।

    উরথন নদীর ধারে ড্রেসডেন এক ছিমছাম শহর। এতদিনের যুদ্ধ খুব দাগ কাটেনি ড্রেসডেনের আকাশে। আর আছেই বা কি ওই শহরে? ষোড়োশ আর সপ্তদশ শতাব্দের বারোক আর তার পরবর্তী রোকোকো স্টাইলের কিছু স্থাপত্য, বেশ কিছু অপেরা হাউস। মিলিটারি টার্গেট বলতে যা বোঝায় কিছুই নেই। ছোট শহর। মাত্র সাড়ে ছয় লক্ষ লোক বাস করে ওই শহরে। ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রেসডেন এক হাসপাতাল নগরী,আর লাল ফৌজের হাত থেকে বাঁচতে পালিয়ে আসা প্রায় আরও ছয় লক্ষ রিফিউজির আশ্রয়স্থল।

    গুজবও ছিল প্রচুর। একটি গুজব - যে মিত্রপক্ষ ঘোষণা করেছে ড্রেসডেনের কোনও ক্ষতি করা হবে না, কেননা বিজয়ী মিত্রপক্ষ ড্রেসডেনকেই করবে তাদের রাজধানী।

    শহরে ডিফেন্স বলতে কিছুই ছিল না। নাগরিকরা মোটামুটি নিশ্চিন্ত। ড্রেসডেনে বোমা পরেছে মাত্র দুবার, ১৯৪৪ সলে ৭ অক্টোবরে প্রথম বার আর শেষ বার মাস খানেক আগে, ১৬ জানুয়ারি, ১৯৪৫। বলা জন্য নেহাতই ছোটখাটো হামলা। মুল টার্গেট ছিল রেলওয়ে মার্শাল ইয়ার্ড। মাঝে দু এক বার সাইরেন বেজেছিল - কিন্তু সে সব ছিল "ফলস অ্যালার্ম'। কই, অক্সফোর্ড শহরেও তো বোমা বা রকেট পড়েনি, তবে ড্রেসডেনেই বা পড়বে কেন? বিশেষ যখন যুদ্ধ শেষ হয়েই এসেছে। অ্যান্টি এয়ারক্রাফট কামান নেই শহরে, নেহাতই ভয় দেখাবার জন্য কিছু কাগজের মণ্ড দিয়ে তৈরি যুদ্ধ বন্দুকের মডেল সাজানো ছিল শহরে। ডামি। আর ওরকম কিছু ডামি বাড়ি ঘর - এরোপ্লেন থেকে দেখলে মনে হবে কোনও সরকারি দপ্তর। এই রকম সামান্য ভাঁওতার আয়োজন ছিল। ড্রেসডেনের উত্তরে যরষঢ়।ড়দবন বিমান বন্দরে কিছু ফাইটার যুদ্ধবিমান অবশ্য মজুত ছিল। এই ঘুমন্ত শহরের প্রতিরক্ষা বলতে এইই। ড্রেসডেন - আদর করে শহরের লোকেরা বলত জার্মানির ফ্লোরেন্স নগরী।

    যেন এক ওয়েসিস। সমস্ত সরকারি ভবনেই রিফুজিরা, রেলওয়ে স্টেশনের ওয়েটিং রুম এমন কি শহরের মধ্যে যে ময়দান - গ্রসার গার্টেন - সেখানেও উন্মুক্ত আকাশের নীচে হাজার হাজার তাবু। রিফিউজিদের নগরী। আর প্রায় কয়েক হাজার ব্রিটিশ আর আমেরিকান যুদ্ধবন্দী, যার মধ্যে রয়েছেন কুট ফোনেগুট। যার স্লটারহাউস ফাইভ প্রায় পঁচিশ বছর পরে খুব আলোড়ন তুলবে সারা দুনিয়াতে - বেশি করে আমেরিকায়।

    তবে ড্রেসডেনে বোম ফেলা নিয়ে পরিকল্পনা একটা চলছিল কিছুদিন ধরেই। স্ট্র্যাটেজিক বম্বিং তখন জার্মানির সিনথেটিক অয়েলের কারখানাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিচ্ছিল। ফলত জার্মানের যুদ্ধযান প্রায় স্তব্ধ হয়ে এসেছিল। স্পিয়ারের তত্ত্বাবধানে ট্যাংক, যুদ্ধবিমান - এ সবের উৎপাদন চলছিল জোর কদমে, মিত্রপক্ষের বোমায় খুব একটা থেমে থাকেনি, কিন্তু পেট্রল ডিজেলের অভাবে সেগুলো একেবারেই অচল ছিল।

    ১৯৪৪ সালের শুরু থেকেই ক্রমাগত বোমা বর্ষণে জার্মানির বড় ও মাঝারি ৬০ টি শহরের মধ্যে ৪৫ শহরই বিদ্ধ্বস্ত। মাসে আড়াইখানা শহর, গড়ে, আক্রমণ করা চাই- এটা ছিল ব্রিটেইন আমেরিকার টার্গেট।

    চার্চিল নিজেও আগ্রহী ছিলেন - সে ব্যাপারে পরে লিখছি। মোট কথা কারখানা, বিমান বন্দর, রেলওয়ে,বন্দর, সেতু- এ সবের সঙ্গে নিছক শহর ধ্বংস করে রিফিউজির সংখ্যা বাড়ানো, আতঙ্ক ছড়ানো, একটা বড় গন্ডগোল সৃষ্টি করা - এটা সরকারি অ্যাজেন্ডার মধ্যেই ছিল। জুন মাসের নরম্যান্ডিতে মিত্রপক্ষের ল্যান্ডিঙের দু মাস পর থেকেই "অপারেশন থান্ডারক্ল্যাপ'-এর কথা চিন্তা করা হচ্ছিল। জার্মানি পরাজয়ের মুখোমুখী হলে পুব জামানির সমস্ত শহরেই জোরালো বোমা বর্ষণ করা হবে যাতে জার্মান "মরাল' ভেঙে পরে আর নাৎসির জার্মানির মরনপণ শেষ লড়াই আর করবার ক্ষমতা থাকবে না। অপারেশন থান্ডারক্ল্যাপের যুক্তি ছিল এটাই। কিন্তু মষভশঢ় ভশঢ়নররভফনশদন দষললভঢ়নন এটা মানতে চায়নি। বরং আমেরিকান প্রিসিশন বম্বিং-এর উপরই তারা বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। শহর নয়, কল কারখানাই মূল লক্ষ্যবস্তু হওয়া উচিত - তারা মনে করতেন।

    জানুয়ারি মাসে রাশিয়ান সেনা বাহিনির অগ্রগতি দেখে এই অপারেশন থান্ডারক্ল্যাপ আবার মাথা চড়া দিয়ে ওঠে। এবারে ওঐই অভিমত দেয় যে চার দিন চার রাত ধরে পুব জার্মানির শহরগুলিতে ভারী বোমা বর্ষণ করা হলে যে রিফিউজির জনস্রোত পশ্চিম মুখী হবে তাতে সেনা চলাচল ব্যাহত হবে। আখেরে লাভ হবে রাশিয়ান সেনাদেরই।
    ড্রেসডেনে বোমারু আক্রমণ ছিল সর্ব সম্মতিক্রমেই। তবে সেটা যে এত সর্বাত্মক হবে সেটা সবাই জানতেন না।

    ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২৪৪টি ল্যানাস্টার আর ৯ ই মসকুইটো বিমান নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনি প্রহম হানা দিল। রাত দশটা চোদ্দো মিনিটে প্রথম বোমা পড়ল আর পুরো অপারেশন শেষ হল আট মিনিটে। প্রায় ৮০০ টন বোমা।

    প্রথম দফায় ছিল ব্লকবাস্টার বা হাই এক্সপ্লোসিভ বোমা। যাতে বাড়ি ঘরের ছাত ভেঙে পরে, তার পর আগুনে বোমা। জ্বলুক জ্বলুক চিতা, দ্বিগুণ দ্বিগুণ।

    হতচকিত, স্তম্ভিত আগুনে পোড়া নগরবাসীরা যখন ত্রাণ কাজে বেরিয়েছে তখন আবার সাইরেন বেজে উঠল। বিশ্বাসই করতে পারছিল না ড্রেসডেনবাসীরা, আবার? আবার। তিন ঘন্টা পরেই দ্বিতীয় দফা ব্রিটিশ বোমারুর ঝাঁক। এবারে বিমানের সংখ্যা প্রায় দুগুণ - ৫২৯ টি ল্যানকাসটার। আর বোমার পরিমান প্রায় আড়াই গুন বেশি প্রথম বারের থেকে- প্রায় ১৮০০টন। আর তার এগারো ঘন্টা পরে ১৪ ফেব্রুয়ারি, বেলা বারোটায় অমেরিকান বিমান বাহিনি, ৩১১ টি বি ১৭ বিমান - বর্ষণ করল ৭৭১ টন বোমা।

    সর্বমোট প্রায় ২৪০০ টন, প্রায় - প্রথম চোদ্দো ঘন্টায়।

    তাতেও রেহাই ছিল না, পরের দিন আরেক দফা। বোমার টনেজ হল ৩৬ ঘন্টায় ৩৯০০ টন।

    যেন আরও কিছু বাকি ছিল। ২ মার্চ আর ১৭ এপ্রিল আরও আড়াই হাজার টন। বোমার সংখ্যা হিসেবে যদি ধরেন তাহলে প্রতি দুই জন লোক পিছু একটি করে বোমা। যথেষ্ট?

    এ তো পরিসংখ্যান। কী হয়েছিল প্রথম চোদ্দো ঘন্টায়?

    আবহাওয়া ছিল ভাল। রাত সাড়ে নটা নাগাদ যখন সাইরেন বাজল, ড্রেসডেনের অধিবাসীরা খুব আতঙ্কিত নয়, ধীরে সুস্থে সবাই সেলার ও বেসমেন্টে বম্ব শেলটারে ঢুকল। সাইরেন বাজার চল্লিশ মিনিট পরে সচরাচর বিমান হানা হয়। সেও যদি হয়। এর অগে বেশ কয়েকবার সাইরেন বেজেছিল কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই বিপদমুক্তির আওয়াজও শোনা গেছিল। ড্রেসডেনে বোমা পরেনি।

    রাত দশটা দশে ব্রিটিশ বিমান বাহিনির প্রথম ঝাঁক ড্রেসডেনের পৌছে গেল। মাস্টার বমবার অর্থাৎ পথ প্রদর্শক খেয়াল করলেন ঝকঝকে আকাশ, নীচে নেই বিমান বিধ্বংসী কামানের ঝলকানি বা কোনও সার্চ লাইটের আকাশ কাটা আলো, তিনি আশ্বস্ত করলেন তার সঙ্গীদের। "শহরে কোনও প্রতিরক্ষা নেই, আরও নীচে নেমে এসো' - যুদ্ধবিমানেরা ৩০০০ ফিট উচ্চতায় নেমে আসল, একের পর এক বিমান উগড়ে দিল তাদের বোমা। প্রথমে হাই এক্সপ্লোসিভ, পরে আগুনেবোমা - যাতে আগুন ছড়িয়ে পরে দ্রুত। "দ্যাটস গুড বমবিং' বল্লেন মাস্টর বমবার স্মিথ।

    দশটা একুশে মাস্টার বমবার ইংলন্ডে খবর পাঠালেন রেডিও মেসেজ "টারগেট অ্যাটাকড সাকসেসফুলি'। প্রিসিশন স্যাচুরেশন বমবিং। কর্তাব্যাক্তিরা সগর্বে এই নামকরণ করেছিলেন।

    দ্বিতীয় ঝাঁকের প্রায় সাড়ে পাঁচশো বিমান যখন ড্রেসডেনে পৌছাল - রাত দেড়টা নাগাদ - তখন তাদের টারগেট চিনতে কোনও অসুবিধ হয়নি। অন্ধকার নিশুতি রাত্রে ড্রেসডেন নগর তখন জ্বলছে দাউ দাউ করে। দ্বিতীয় ঝাঁকের মাস্টার বমবার দেখলেন নীচে শুধু আগুনের দাপাদপি। প্রিসিশন বমবিং? সুযোগ নেই, দরকার ও নেই। তার নির্দেশ মতন বোমারুরা ওই আগুনের পাশাপাশি অথবা ওই আগুনের উপরেই আবার বোমা ফেললেন। এবারের ব্লকবাস্টর বোমার আঘাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ল আর বিস্তির্ণ ভাবে। চার পাউন্ড ওজনের থারমাইট বোমা - যেন শ্রাবণের বৃষ্টির মতন ঝরে পড়ল। মোট সাড়ে ছয় লক্ষ -বোমার সংখ্যা।

    ফায়ার স্টর্ম। ফায়ার স্টর্ম। শুরু হয়ে গেছে ফায়ার স্টর্ম। আগুন ঝড়।

    সভ্যতার নব আবিষ্কার। একসঙ্গে ছোট বা মাঝারি অনেকগুলি আগুন একসঙ্গে জ্বলে উঠলে সেগুলি ক্রমশ মিলে মিশে এক হয়ে যায়। কুট ফোনেগুট যাকে বলেছিলেন "এ সিঙ্গল শিট ওফ ফ্লেম'। সেই একক লেলিহান শিখা জ্বলতে থাকে দাউ দাউ করে। বাতাস থেকে শুষে নেয় অক্সিজেন। সেই আগুন দানবের ক্ষুধা মিটাতে চারিদিক থেকে বাতাস উড়ে আসে- শুরু হয় ঝঞ্ঝা। গর্জন করে সেই আগুনের স্তম্ভ নিমেষে গিলে নেয় পুরো একটা রাস্তা। তার ধারে কাছে গেলে হাওয়ার ঘূর্ণীতে টেনে নেয় তার পেটের ভিতরে - মুহূর্তে খাক হয়ে সব কিছু ।

    দ্বিতীয় ঝাঁকের বোমারুরা যখন এসেছিল তখন সাইরেন বাজাবারও কেউ ছিল না শহরের সব জায়গায়। অসহায় মানুষেরা শুধু পালানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু যাবে কোথায়? কোথায়? যারা ছিল বেসমেন্টে বা মাটির নীচের সেলারে, সেখানে মুহূর্তে নি:শেষ হয়ে গেছিল অক্সিজেন। খোলা রাস্তায় আগুন দানব দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। কোথায় পালানোর পথ?

    এ আগুন ঝঞ্ঝায় উত্তাপ ওঠে প্রায় ১৮০০ ডিগ্রি ফারেনহাইট। কেমন করে মারে মানুষকে? প্রত্যক্ষদর্শীরা বললেন মৃতদেহগুলি নিশুত রাতে উজ্জ্বল কমলা বা নীল রঙের একটা শিখায় পরিনত হয়ে যাচ্ছিল। সেই দেখে যারা বেঁচে ছিলেন তারা টের পাচ্ছিলেন আরেকটি প্রাণ, আরেকটি দেহ পুড়ে ছাই হয়ে যাচ্ছে। কখনও এক একটি দেহ নিমেশে খাক হয়ে যাচ্ছিল, পুড়ে গুঁড়ো হয়ে ছাই হয়ে উড়ে যাচ্ছিল বাতাসে। বা আরও বিভৎস - পুরো দেহটাই চোখের সামনে গলে গেল। হাড়, মাস, মজ্জা - প্রচন্ড উত্তাপে গলে তরল হয়ে যাচ্ছিল। ড্রেসডেনের দহনের আড়াই বছর আগে হামবুর্গ শহরে এই খাণ্ডবলীলার ড্রেস রিহ্যারস্যাল হয়েছিল। তার পোষাকি নাম ছিল অপারেশন গোমোরাহ। সেই একই টেকনিক। প্রথনে ব্লকবাস্টার বম মেরে বাড়ির ছাদ উড়িয়ে দিয়ে তারপর আগুনে বোমা- সারা শহর জুড়ে হাজারে হাজারে ছোট ছোট আগুনের সৃষ্টি। দ্রুত ঐ আগুনের শিখারা এক সর্বগ্রাসী মিলনে একাকার হয়ে তৈরি হবে লেলিহান এক দানবে। "এক ঝড় শুরু হল, হাওয়ার তীক্ষ্ম চিৎকার। ক্রমে সেটা হয়ে গেল যেন এক হ্যারিকেন। চারিদিকে শুধু উত্তাল এক আগুনের সমুদ্র।' বেয়াল্লিশ হাজার অসামরিক মানুষ মারা গেছিলেন সেই ফায়ার স্টর্মে। ফায়ার স্টর্ম নামটা চালু হয়েছিল সেদিন থেকেই।

    দাবানলের প্রচণ্ড উত্তাপে গরম হাওয়া উর্দ্ধগামী হয়, সৃষ্টি হয় শূন্যতা। চারিদিক থেকে আরও আরও বাতাস ছুটে আসে। আগুন যত জোরে ফুলে ফেঁপে ওঠে, দুরন্ত গর্জনে হাওয়া আরও ছুটে আসে তত জোরে। আরও খেপিয়ে তোলে সেই আগুনে দৈত্যকে।

    সেই নিদারুণ ঘূর্ণাবর্ত্ত টেনে নেয় আশে আশের সব কিছু। হাতে হাত ধরে এক মানব শৃংখল এগিয়ে যাচ্ছিল ড্রেসডেনের এগারো স্কোয়ার মাইল জুড়ে জ্বলতে থাকা ইনফার্নোর দিকে - যদি কোনও প্রাণ বাঁচানো যায়। কিন্তু সেই দাবানলের কাছাকাছি যেতেই সামনের কয়েকজনকে টেনে নিল সেই পিশাচী ইনফার্নো। পিছনের লোকেরা জাপটে ধরে টেনে ধরে রাখত পারল না - উদ্দাম ঝড়ের এমনই জোর।

    শহরের মধ্যে ময়দান, গ্রসার গার্টেনের ছিল এক বড় জলাশয়। লোকে পাগলের মতন ছুটল সেদিকে, অনেকে বাঁচল আগুনের হাত থেকে, আবার অনেকে প্রাণ হারাল সেই লেকের গভীর জলে ডুবে।

    প্রথম ঝাঁকের বিমান আক্রমণ রেল স্টেশনের খুব ক্ষতি করতে পারেনি। তাই ট্রেন ভর্তি করে আহত ও বিশেষত শিশুদের অগ্রাধিকারের দিয়ে দুরে নিরাপদ স্থানে পাঠানোর বন্দোবস্ত করছিলেন কত্তৃপক্ষ । কিন্তু সেই ব্যবস্থা শেষ করবার আগেই দ্বিতীয় দফার রেইড শুরু হয়ে যায় । পরে দেখা গেছিল স্টেশনে দাঁড়িয়ে থাকা ট্রেন ভরতি শিশুদের আর স্টেশনের দেওয়ালে ঠেস দেওয়া হাজারে হাজারে মানুষের মৃতদেহ। তাদের নিশ্বাসের অক্সিজেন শুষে নিয়েছিল আগুন রাক্ষস। কেউ পালাতে পারেনি।

    ভোর চারটে চল্লিশে, তৃতীয় দফার বিমান বাহিনি। আর কতটুকু অবশিষ্ট আছে ড্রেসডেনের? এবারে আমেরিকানদের পালা। প্রথম দু বার ছিল ব্রিটিশ বাহিনির মারণলীলা। আমেরিকানরা বোমারুর সঙ্গে এনেছিল প্রায় শ তিনেক ফাইটার প্লেন। নাম তাদের মুসটাংগ। বুনো ঘোড়া। যথেচ্চ বোমার আঘাত ছাড়াও এবারে নতুন কিছু। ভীত নাগরিক ও রিফিউজির দল যখন ছুটছে এলো মেলো- নদীর দিকে, আগুনের হাত থেকে বাঁচতে তখনই মুসটাং বিমানেরা খুব নীচ দিয়ে উড়ে গেল। শুরু হলো স্ট্রেফিং। ডানার নীচে রাখা ছয়টি মেশিন গান থেকে ঝলকে ঝলকে গুলি। একসঙ্গে ট্রিগার টিপলে সেকেন্ডে শাটটা বুলেট । নিমেষে সীসার জাল - নিস্তার নেই তার হাত থেকে। নিরস্ত্র সন্ত্রস্ত জনতা লুটিয়ে পড়ল - কাতারে কাতারে।

    শহরময় তখনও আগুনের দাপাদাপি। আকাশ ছোঁয়া লকলকে শিখার উপরে বাদামি হলুদ ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন আকাশ। শহরময় পোড়া গন্ধ। আরো সাত দিন সাত রাত জ্বলবে আগুন। থিতিয়ে নিভে আসবে তারপর। পরের দিন সকালে হান্স, তখন এক পনেরো বছরের কিশোর, দেখে রাস্তায় স্তুপীকৃত উলঙ্গ মৃতদেহ, আগুনে ও প্রবল ঝড় মৃতদের শেষ সন্মানটুকুও কেড়ে নিয়েছে। গ্রসার গার্টেনে প্রাণভয়ে পালিয়েছিল শুধু মানুষ নয়, ড্রেসডেনে ছোট চিড়িয়াখানার যাবতীয় পশু পাখি। ময়দানের এক গাছের ডালে দুই নগ্নিকার নিথর দেহের উপর ঝুলে রয়েছে একটি লেপার্ডের মৃতদেহ। পারতেন সালভাদর দালি তার পরাবাস্তবের চশমা পরে এমন ইম্যাজারি কল্পনা করতে? কুট ফোনেগুট, ধ্বংসস্তূপ সরিয়ে উদ্ধার কাজে ব্যস্ত ছিলেন। দেখলেন একের পর এক সেলারে, শয়ে শয়ে মানুষের প্রাণহীন দেহ। "যেন একই মুহূর্তে সকলের হার্ট অ্যাটাক হয়েছে'। আসলে তাই হয়েছিল। নিমেষে অক্সিজেন শেষ হয়ে গেছিল আর তার প্রচন্ড উত্তাপ। "এত লোকের মৃত্যুতেও এই বিশ্ব যুদ্ধের আয়ু এক সেকেন্ডও কমেনি' কুট বলেছিলেন পরে।

    এবারে দি কিছু শুকনো পরিসংখ্যান। শহরের প্রায় ১৫ স্কোয়ার কিলো মিটার বসতি সম্পূর্ণ দগ্ধ। নগরীর কেন্দ্রে আঠাশ হাজার বাড়ির মধ্যে পঁচিশ হাজার বাড়ি সম্পূর্ণ চুর্ণ। আরো বিচুর্ন ৭২ টি স্কুল, ২২ টি হাসপাতাল, ১৯ টি চার্চ। মূল রেলওয়ে স্টেশন বিদ্ধ্বস্ত। তবে ব্রিটিশ শেল কোম্পানির সাদা রঙের বিশাল বিশাল তেলের ডিপো গুলি সম্পূর্ণ অক্ষত ছিল।

    প্রাণ হারালো কজন মানুষ? কেউ জানে না। সঠিক তথ্য জানা তখনও অসম্ভব ছিল, এখনো জানা যাবে না। কত জন রিফিউজি ছিল সে সময়ে ঐ শহরে? কেউ বলেন দু লাখ - কেউ বলেন ছয় লাখ। নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছিল কত মানুষ - তাদের আর হিসাব নেই। উড়ে পুড়ে ছাই হয়ে মিলিয়ে গেছিল পঞ্চভুতে, বা গলে মিশে গেছিল মাটিতে - কোন বিজ্ঞানে আর প্রমাণ পাওয়া যাবে তার? বেড়ার কোন দিকে বসে হিসেব লিখছেন সেই মতে পয়তিরিশ হাজার থেকে আড়াই লাখ। এই বিমান হানার পর পরই জার্মান অফিসিয়াল রিপোর্টে লক্ষাধিক নিহত বলা হয়েছিল। সেসময়ে যুদ্ধবন্দী কুট ফোনেগুট এই বিমান হানার পর মৃতদেহ উদ্ধারের কাজে লেগে গেছিলেন, তার হিসাব আড়াই লক্ষ। ঐতিহাসিক ডেভিড আর্ভিং, যিনি "ডেস্ট্রাকশন ওফ ড্রেসডেন' নামে বই লিখেছেন,যেটির প্রামাণ্যতা নিয়ে সংশয় থাকলেও ,সততা নিয়ে দ্বিমত নেই, তার মতে এক লক্ষ পয়তিরিশ হাজার। ষাট হাজার বলেন মার্টিন গিলবার্ট। ব্রিটিশ বিমান বাহিনির অফিসিয়াল সাইট জানায় পঞ্চাশ হাজারের কম হবে না। এত মত থাকলেও বোধহয় আর্ভিং সাহেবের হিসাব মতন দেড় লক্ষ বডি কাউন্ট সত্যের সব থেকে কাছাকাছি গণ্য হবে। বিষেশত যখন হামবুর্গের অনেক ছোট ফায়ার স্টর্মে নিহতের সংখ্যা বেয়ল্লিশ হাজার এক তর্কাতীত বেঞ্চমার্ক।

    এই ভয়াবহ হতাহতের খবর ছড়িয়ে পরতেই শুরু হল দোষারোপের পালা। ব্রিটিশেরা অনেক বেশি এপোলিজিটিক ছিল, যেহেতু প্রথম দুটি ঝাঁকের আক্রমণেই ড্রেসডেনের মৃত্যু ঘন্টা বেজে গেছিল, তৃতীয় দফার অল আমেরিকান হানা নেহাতই মরার উপর খাঁড়ার ঘা, আর এই হানার পরিকল্পনা ছিল আদ্যন্ত ব্রিটিশ।

    যথেষ্ট প্রমাণ মজুত আছে যে চার্চিল জানতেন ও সমর্থন করেছিলেন এই হানাদারী। তবে এতটা বাড়াবাড়ি হবে সেটা বোধহয় তার জানা ছিল না। যেমন জানতেন না সোভিয়েত রাশিয়া, যদিও ইয়ালটাতেই তাদের প্রতিনিধি আলেস্কি এন্টোনভকে ড্রেসডেনের বিমান হানার পরিকল্পনা জানানো হয়েছিল।

    চার্চিল বেশ কড়া মেমো লিখলেন পরবর্তী কালে "এই টেরর বমবিংএর বিরুদ্ধে', কিন্তু ওয়ার মিনিস্ট্রির চাপে পরে চার্চিল সেই মেমো উইথড্র করে নেন।

    তুলনীয় আমেরিকান জেনেরাল ইরা একারের বক্তব্য "এটা জার্মানদের বোঝা উচিত তারা আমাদের যে রকম বর্বর ভাবে আমরা সত্যি সেরকমই বর্বর'।

    রাশিয়ানেরা যুদ্ধ পরবর্তী কালে ড্রেসডেন বমবিংকে এক পশ্চিম বিরোধী প্রচার মঞ্চ হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন। এই সেদিনও, ২০০৫ সালে পাঁচই মে, প্রেসিডেন্ট পুটিন বললেন "কেন যে ড্রেসডেনকে ধ্বংস করা হয়েছিল সেটা এখনও আমি বুঝতে পারি না। এই আক্রমণের কোনও সামরিক যুক্তি ছিল না।"

    বলির পাঁঠা হলেন আর্থার (বম্বার) হ্যারিস, ব্রিটিশ বিমান বাহিনির বমবার কম্যান্ডের কম্যান্ডার ইন চিফ। রাতারাতি তিনি হয়ে গেলেন ভিলেন নাম্বার ওয়ান। তার নাম হয়ে গেল বুচার হ্যারিস। ড্রেসডেনের ওই হানায় কোনও পদক বিলি হয়নি। যুদ্ধের শেষে, মিত্রপক্ষের হোমরা চোমরারা, সবাই অল্প বিস্তর পুরষ্কৃত হয়েছিলেন। হ্যারিসের ভাগ্যে কিছুই জোটেনি। তার সমপদাধিকারীরা প্রত্যেকেই হাউস অফ লর্ডসে প্রবেশ করেছিলেন, কিন্তু হ্যারিস সেই সম্মান পাননি।

    কত জন মারা গেছিলেন হিরোসিমায়? কতজন নাগাসাকিতে? এই নিয়েও বাগ বিতন্ডার শেষ নেই। যত ঐতিহাসিক তত পরিসংখ্যান। আমি শুধু এ জি পি টেলরের মতামতটাই নিলাম : হিরোসিমায় অ্যাটম বোমায় তাৎক্ষনিক মৃত্যু হয়েছিল একাত্তর হাজার মানুষের, আর নাগাসাকিতে চল্লিশ হাজার। এক প্রজন্ম ধরে লিউকোমিয়ায় আরও কত জন প্রাণ হারিয়েছিলেন সেটা বলা সম্ভব নয়। এই পারমাণবিক বিস্ফোরনের ঠিক পাঁচ মাস আগেই টোকিয়োতে ঐ আগুনে বোমার মহা আক্রমণ চালানো হয়। অ্যাটম বোমের মতন একটি নয় - কিন্তু ড্রেসডেন বা হামবুর্গের ফায়ার স্টর্মের হুবহু নকল। বি ২৯ সুপার ফরট্রেস বিমান থেকে হাজারে হাজারে থার্মাইট বোমা অঝোরে পরেছিল টোকিয়োর বুকে। মধ্যরাতে প্রায় সাড়ে তিনশো বোমারু বিমান আড়াই ঘন্টা ধরে অবিরল বোমা ফেলে গেছিল - প্রায় দশ লক্ষ বোমা!! এক রাতেই সেই অগ্নি ঝঞ্ঝায় মারা গেছিলেন তিরাশি হাজার জাপানি অসামরিক নাগরিক। কিন্তু এই মৃত্যু খুব বিচলিত করেনি শান্তিবাদীদের। ড্রেসডেনের মতন রাজনৈতিক বিতন্ডাও হয়নি।

    নিউরেমবার্গ শহরে যখন ওয়ার ক্রাইমের বিচার সভা বসেছিল, তখন থেকেই দাবি উঠেছিল ড্রেসডেন ধ্বংসও যুদ্ধাপরাধ বলে গণ্য করা হোক। বিচার হোক ঐ বিমান হানার খলনায়কদের। না:, সেরকম কিছু ঘটেনি। ড্রেসডেন নিয়ে তাও এখনো বাগবিতন্ডা চলে, কিন্তু টোকিয়োর ফায়ার স্টর্ম - (বোধহয়) এমন কি আজকের জাপানেও খুব স্পর্শকাতর দু:স্মৃতি নয়।

    ষাঠ বছর পূর্তি উপলক্ষে ড্রেসডেন উত্তাল হয়েছিল। নিউ নাৎসি থেকে বামপন্থী লিবেরাল, হরেক কিসিমের মানুষ মিছিলে সামিল হয়েছিলেন। পত্র পত্রিকায় মৃতের সঠিক সংখ্যা এবং ওই বিমান হানার যৌক্তিকতা - দুই বিতর্কই চলেছিল গমগমিয়ে।

    তুলনায় টোকিয়োতে ওই বর্ষ পূর্তি খুব নিরুত্তাপ হয়েছিল। শহরে একটি ছোট মিউজিয়াম রয়েছে আর দুটি ভুলে যাওয়া শহীদ বেদি। যে সব বক্তারা স্মরণ করেছিলেন টোকিয়োর ফায়ার স্টর্মের তারাও বক্তব্যে ছিলেন সংযত। কাউকে দোষারোপ করা নেই। শুধু প্রয়াতদের স্মরণ করা। ন্যায় অন্যায়ের তর্ক নয়। ভবিতব্য।

    কেন? কেন? যুদ্ধ শেষ হবার মুখে প্রতিরক্ষাহীন এক নগরী যার পৃথিবেজোড়া খ্যাতি তার ভাস্কর্যের জন্য, এবং সম্পূর্ণ ভাবে সামরিক লক্ষ্যবস্তুর অভাবে যে শহরে এর আগে তেমন কোনও বিমান হানাই কখনো হয়নি সেখানে কেন এই আগুন ঝঞ্ঝার আয়োজন? শুধুমাত্র রাশিয়ানদের সাহায্য করতে?

    অনেক অনেক বিতর্ক হয়েছে। কয়েকজন আমেরিকান সেনাধিপতি খুব আস্ফালন করে গেছেন - কেননা হিরোসিমা আর নাগাসকির প্রেতাত্মাদের কাঁধে নিয়ে ঘুরতে হলে ড্রেসডেনকে সমর্থন না করে উপায় ছিল না। তাও তাদের যুক্তি ছিল "করেছি, বেশ করেছি"।

    "ড্রেসডেনে সেদিন বোমা ফেলার জন্য আমি তেমন লজ্জিত নই,..... এটা সত্যি যে ব্রিটিশ বিমান পরিকল্পনা মাফিকই আগুন ঝঞ্ঝার সি্‌ষ্‌ট করেছিল এবং এতে অনেক প্রাণহানি হয়েছিল, তবে এই রনকৌশল তো প্রায়ই ব্যবহার করা হয়েছিল। ওরা,এবং আমরা, অন্য শহরেও অনেক লোককে মেরেছি,অন্য দিনে। রাশিয়ানরাও মেরেছে, জাপানিরাও। জার্মানেরাও। ড্রেসডেন কিছু ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়।' লেফটেনান্ট জন মরিস - ড্রেসডেনের এক আমেরিকান বোমারু বিমানের চালক বলেছিলেন।

    আসলে আর্থার হ্যারিস মনে প্রাণে বিশ্বাস করতেন শুধু বোমা মেরেই যে কোনও দেশকে হারিয়ে দেওয়া যায়। এর দু বছর আগেই উনি চার্চিলকে বলেছিলেন যদি ল্যানকাস্টার বোমারু বিমান দিয়ে আরও ১৫০০০ সর্টি (বিমান হানা) করা যায় তবে,আর একবছর মানে ১৯৪৪ সালের পয়লা এপ্রিলের আগেই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবে'। সেই মতন আরো পনেরো হাজার ল্যানকাস্টার বিমান হানার আয়োজন করা হয়েছিল - কিন্তু ১৯৪৪ সালের পয়লা এপ্রিল নাৎসি জার্মানের আত্মসমর্পনের কোনও আশু সম্ভাবনাই ছিল না।

    তাই যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার মুখে, যখন আকাশে জর্মান যুদ্ধবিমান প্রায় আর নেই বললেই চলে, আর ড্রেসডেনে এমনকি বিমান বিধ্বংসী কামানও নেই, হ্যারিস এহেন মারণযজ্ঞের বিপুল আয়োজন করেছিলেন।

    ৪৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ড্রেসডেন আক্রমণ করার পিছনে আর কি যুক্তি থাকতে পারে? ঐতিহাসিক ম্যাক্স হেস্টিংস বলেন, "উই র‌্যান আউট ওফ টারগেট'। সত্যিই তাই। বোমা মারার মতন ভালো, বড়,অন্তত মোটামুটিও অক্ষত কিন্তু খুব জোরদার প্রতিরক্ষাও নেই - এইরকম শহর আর ছিল না। একটিও না। তাই ড্রেসডেন।

    এর সাত সপ্তাহ পরেই রাশিয়ান সেনানী শহর দখল করে নেন, সেটা সাতই মে আর পরের দিনই, আট ই মে নাৎসি জার্মানি আত্মসমর্পন করে।
    ষাঠ বছর - দেখতে দেখতে ষাঠ বছর পার হয়ে গেল। যে ছোট্ট মেয়েটি প্রাণভয়ে ছুটেছিল আমেরিকান প্লেনের স্ট্রেফিঙের হাত থেকে বাঁচতে আজ সে উত্তর সত্তর এক বৃদ্ধা। সেদিনের বিস্ফারিত নেত্র পনেরো বছরে কিশোর আজ পচাত্তর। তার দু:স্মৃতির ভাণ্ডারে এখনও রয়ে গেছে শহরময় পোড়া মাংসের গন্ধ। ঐতিহাসিকেরা সেমিনার করেন আর তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে বর্তমানের রাজনীতি। খুঁচিয়ে তুলছে ঘৃনার ইতিহাস।

    যুদ্ধে নৃসংশতা অনিবার্য। এক গ্রিক দার্শনিক বলেছিলেন রীতিনীতি বন্দীদের প্রতি সুবিচার ইত্যাদি যতদিন মেনে চলা হবে, মানুষের জীবনে যুদ্ধও ততদিন চলবে। শুধু নির্বিকার ক্রুরতাই মানুষকে যুদ্ধ থেকে দুরে সরিয়ে রাখতে পারে।

    ড্রেসডেনের আগুন ঝড় সেই প্রতিশ্রুতি কি রাখতে পেরেছে?

    (জার্মান নদী, শহরের নাম কিভাবে উচ্চারিত হয় জানা নেই , তাই বাংলা হরফে যা লিখেছি সেগুলি যথাযথ নাও হতে পারে।)
  • 23 | 80.67.***.*** | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ০০:২৭741443
  • ছত্তিশগড়ের সাড়ে বত্রিশভাজা (৩)
    রঞ্জন রায়

    সুদে-আসলে

    সেই যে গঙ্গারামবাবু একরাত্তিরে পঞ্চায়েতের দরবারে এক "বদচলন' নারীর প্রকাশ্য বিচার দেখেছিলেন (আগের কিস্তিটি দেখুন), সেটা ওঁর মনের পলিমাটিতে বেশ ভাল রকম আঁচড় কেটেছিল। অন্ধকারে হ্যাজাকবাতির আলোয় মেয়েটির আবছা চেহারা কিন্তু চড়া গলার স্বর, আবার জমিদার দাদুসায়েবের ধমক খেয়ে নেতিয়ে পড়া; এইসব ব্যাচেলর ভ্যাবাগঙ্গারামের বুকের নিস্তরঙ্গ পুকুরে হঠাৎ এমন ঢেউ তুলল যে উনি আরও ভ্যাবাচাকা খেয়ে গেলেন।

    আসল কথা -- ওই মেয়েটা, ওই উম্মেদকুঁয়র। ওই তো নষ্টের গোড়া। আর কি বুকের পাটা। প্রকাশ্য সভায় বলল -- মিশ্র গুরুজিকে নিয়ে আমার কোনও শিকায়ত নেই। উনি ব্রাহ্মণ, দেবতা। উনি চেয়েছেন, আমি দান দিয়েছি।

    নিজের শরীর ও দান করেছে, সেটা আবার বলছে!

    কলকাতায় পড়াশোনা করা ভ্যাবাগঙ্গারামের মাথায় ঘোরে একটি কবিতার লাইন --

    "এই পৃথিবীর ভালো পরিচিত রোদের মতন, তোমার শরীর,
    তুমি দান করনিতো?
    সময় তোমাকে সব দান করে চলে গেছে বলে
    সুদর্শনা, তুমি আজ মৃত।'

    -- ধ্যেৎ, কিসব ভাবছি। একজন নারী তার নিজের শরীর, যাকে ইচ্ছে দান করবে, বা করবে না, তাতে কার বাবার কি? আমিই বা কেন ফালতু মাথা খারাপ করছি?

    ধীরে ধীরে আসল সমস্যাটা নিজের কাছে ধরা পড়ে। চেতনায় ঘুরে বেড়াচ্ছে আর এন টি স্যারের লেখা একটি গান --
    "বিধি ডাগর আঁখি যদি দিয়েছিলো
    সে কি আমার পানে কভু পড়িবে না?'

    গঙ্গারাম লজ্জা পেলেন। আজ রোববার। ব্যাঙ্ক বন্ধ। গায়ে লাগা স্টাফ কোয়ার্টার। ভাবলেন, সময় কাটাতে অফিস খুলে কিছু পেন্ডিং কাজ সেরে নিলে কেমন হয়? রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বি এস আর এখনও যায়নি, ক®¾ট্রালিং অফিস থেকে রিমাইন্ডার এসে গিয়েছে। চাপরাশি বুধরামকে ডেকে অফিস খুলে দিতে বলেছিলেন। বুধরাম তালা খুলে ঝাঁট দিয়ে টেবিল ঝেড়েমুছে একগ্লাস জল আর তাজা খবরের কাগজ রেখে গিয়েছে। কাজ শুরু করলেন কিন্তু আজ মন লাগছে না। খেয়াল হল আজকের স্থানীয় দৈনিক পত্রিকাটি পড়া হয়নি। -- অস্ট্রেলিয়ায় শিবরামকৃষ্ণাণের লেগস্পিন ও গুগলি ভাল খাচ্ছে। কিন্তু অ্যালান বর্ডারের ক্যাপ্টেনশিপ? আজহার বলে নতুন ছেলেটা ব্যাকলিফ্‌ট কম করলে ক্যাঙারুদের দেশে বেশি রান পাবে। -- ছত্তিশগড়ের কোনও অজ পাড়াগাঁয়ে একটা তে-মুণ্ডে বাছুরের জন্ম হয়েছে। আর এক জায়গায় একটি মেয়ের কান দিয়ে সুগন্ধী চাল বেরোচ্ছে। ধ্যাৎ, কাগজটা বন্ধ করলে হয়।

    এইসব নানারকম "ধ্যাৎ, ধ্যাৎত্তেরি, ধুত্তোর'-এর পালার মাঝে বুধরাম এসে বলল যে দাদুসায়েব নাস্তা করতে ডাকছেন। অফিসে পড়ল তালা, গঙ্গারাম চলল বারান্দা পেরিয়ে দাদুসায়েবের অন্দরমহলের বৈঠকখানায় যা কিনা একটু অন্তরঙ্গদের জন্যে খোলা হয়। গঙ্গারাম যখন ঢুকতে গেল তখন খালি ঘরে একজন সাদা থান পরা মহিলা বাবা আদমের জমানার সোফা, টেবিলগুলোকে একটা পালকের ঝাড়ন দিয়ে ঝাড়ছিলেন। হঠাৎ গঙ্গারামকে ঢুকতে দেখে চমকে উঠে জিভ কেটে ঘোমটা টেনে পালিয়ে গেলেন। যাওয়ার আগে একবার ফিরে তাকানোয় ও বুঝতে পারল মহিলার বয়স চল্লিশ ছোঁয়নি এখনও।

    -- উনি বড়ি বহুরানি। দাদুসায়েবের রিস্তে মেঁ ভাবীজি। ঠাকুর সাব গুজর গয়ে দশ সাল হোয়থে।

    ইতিমধ্যে দাদুসাব হাজির হয়েছেন। লুঙ্গির ওপর চিকনের কাজ করা পাঞ্জাবি। কলপ লাগানো চুলের কালো বড্ড বেশি চকচকে, কোথাও কোথাও জুলপি ছাড়িয়ে কপাল আর গালের চামড়ায় জুতোর পালিশের মতো ছাপ রেখেছে।

    -- আইয়ে ম্যানেজার সাব! ছুট্টি কী দিন ভি কাম্‌? আরে থোড়া আরাম কীজিয়ে। থোড়িবহুত গপ্‌শপ্‌ হো জায়ে।

    কখন যেন বুধরাম ভেতরে গিয়ে নিয়ে এসেছে একথালা ফুলুরি, স্থানীয় ভাষায় ভাজিয়া। সঙ্গে প্লেটে করে লাল লঙ্কা-আদা-টম্যাটো পেষা চাটনি। এরপর এল ফুলকাটা কাচের গ্লাসে ঠান্ডা জল আর অতিথিদের জন্যে বের করা বিশেষ চীনেমাটির কাপে দুধ-চা, কড়ি-মিঠি।

    একপ্লেট শেষ হতেই বুধরাম আর প্লেট গরম ভাজিয়া নিয়ে এল। গঙ্গারাম হাঁ-হাঁ করে উঠতেই দাদুসাব ধমকে ওঠেন।

    -- আরে খান, খান। এই তো খাবার বয়স। আর ছত্তিশগড়ে চাকরি করবেন অথচ ভাজিয়ার প্রেমে পড়বেন না সে কি হয়।

    নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে উঠে বললেন -- "গ্রামীণ ব্যাঙ্কে চাকরি করলে কোথায় অজ-পাড়াগাঁয়ে আদাড়ে-পাদাড়ে ঘুরে বেড়াবেন। সময়-অসময়ে খাবেন কি? আজ্ঞে, এই ভাজিয়া। যে কোনও জায়গায় পাবেন এর দোকান। বেসনের মধ্যে কুচো পেঁয়াজ আর কাঁচলঙ্কা চটকে গরম তেলের কড়াইয়ে ছাড়ুন আর ছেঁকে তুলুন।

    এই নিয়ে তো ছত্তিশগড়ি দদরিয়া লোকগীত আছে, শোনেননি? "চানা কে দার রাজা, চানা কে দার রানি, চানাকে দার গোঁদলি মা কড়কয়থে।
    আরে, টুরা পর-বুধিয়া,
    হোটেল মা ভাজিয়া, ঝড়কয়থে।'
    (ছোলার ডাল গো রাজা,, ছোলার ডাল যে রানি, ছোলার ডাল আর পেঁয়াজের কথা কিই বা বলা যায়?
    ছেলেটার কি আছে, বন্ধুর কথায় নাচে, হোটেলেতে ভাজিয়া সাঁটায়।।)
    যি রে বুধরাম? তুই জানিস না?'

    বুধরাম হেসে মাথা নাড়ে। তারপর নানান কথা আশকথা-পাশকথার পর দাদুসায়েব জিজ্ঞেস করলেন -- আজকের খবরটা দেখেছেন?

    -- কোনটা? আজহারুদ্দিনের ব্যাটিং?

    -- ধ্যৎ, রাখুন তো আপনার ওই ব্যাটবল! আসল খবর হল একজন ঠাকুরসাব রাজকাপুরের বিরুদ্ধে মামলা করেছেন।

    -- কেন?

    -- কেন আবার কি? প্রেমরোগী বলে একটা সিনেমা বানিয়েছেন। ওতে একজন ঠাকুরাইনকে বিধবা হওয়ার পর আবার বিয়ে করতে দেখানো হয়েছে। এতে দেশের সমস্ত ঠাকুরসমাজ অপমানিত বোধ করছেন।

    এমনকি আমিও। এগুলো ফিলিমওয়ালাদের অবাস্তব কল্পনা। কোন ঠাকুরপরিবারের বিধবা দু'বার বিয়ে করতে পারে না। ওসব নীচুজাতে হয়।

    ছত্তিশগড়ে সতনামী ও অন্যান্য অছুৎদের মধ্যে শুধু বিধবা নয়, অন্যরাও কয়েকবার বিয়ে করতে পারে। একে বলে "চুড়িপরানো'। মন লাগল তো আগের স্বামীর ঘর ছেড়ে আরেকজনের সঙ্গে পালালো। সে ব্যাটা ওকে চুড়ি পরিয়ে নিয়ে এসে ঘরে তুলল। একে বলে "চুড়িহাই পত্নী'। এরকম ঠাকুর পরিবারে জন্মানো কোনও মহিলা করতে পারে?

    -- আরে দাদুসায়েব, আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন। মানুষ তো, তা সে ঠাকুরপরিবারেরই হোক, বা সতনামী সমাজের।

    দাদুসায়েব হাঁফাতে লাগলেন।

    -- আপনারা বুঝবেন না, দু'পাতা আংরেজি পড়া ছেলেছোকরার দল। আমাদের সংস্কার জানেন না। আমাদের ঘরের বিধবা জানে যে বিয়ে একবারই হয়, আর তা ঠিক হয় ভগবানের দরবারে। আমাদেরই সমাজের পদ্মিনী জৌহরব্রত করেছিলেন, জানেন তো? বিধবা মেয়েছেলে মন্দিরের পুজো-আচ্চা, ঘর-গেরস্থালি এসব নিয়ে এমন ব্যস্ত থাকে যে মনে কোনও কুচিন্তা আসতেই পারে না।

    আমাদের বাড়িতেই দেখুন আমার পিসতুতো বৌদিকে। বিধবা মানুষ, কিন্তু আমার ঠাকুরাইনের স্বর্গবাসের পর উনিই এ বাড়ির মালকিন। ভাঁড়ারের চাবি ওনারই আঁচলে বাঁধা। নিষ্ঠাবতী মহিলা, আপনার কি মনে হয় এত সম্মান পেয়েও উনি সুখে নেই?

    মাসখানেক পরে একদিন ব্যাঙ্ক বন্ধ হওয়ার মুখে বুধরাম এগিয়ে দেয় একটা পাসবুক আর উইথড্রয়াল ফর্ম।

    -- কি ব্যাপার রে?

    -- নারাজ মৎ হোনা সাহাব! দিদি আজ খুদ আ নহী সকতি। দস্তখত্‌ করকে মুঝে দিয়ে। খাতে সে পৈসা ম্যাঁয় লে জাউংগা।

    -- কে তোর দিদি?

    -- উম্মেদ কুঁয়ের। তবিয়ত ঠিক নহী হ্যায়।

    -- কিন্তু ও তো নাম লিখতে পারে না। অংগুঠা-ছাপ। এতে তো বিয়ারার পেমেন্ট করা যায় না।

    বুধরাম গরুর মতো ড্যাবডেবে চোখে তাকিয়ে থাকে। কিন্তু নড়ে না।

    -- আচ্ছা, ঠিক আছে। সত্তর টাকা। আমার মোটরসাইকেলের পেছনে বোস। দুজনেই যাব তোর দিদির বাড়ি। আমার সামনে ওর টিপছাপ নিয়ে পেমেন্ট করব। তোর দিদি বলে কথা।

    রাত্তিরে ফিরে এসে গঙ্গারাম নিজে হাতে ডিমের ঝোল, আলুসেদ্ধ-ভাত রাঁধেন। বুধরামকে বলেন ট্রানজিস্টর চালিয়ে দিতে, রায়পুর স্টেশন। লোকসঙ্গীত ভেসে আসে। মনকেমন করা উদাস সুর।

    "তঁয় আকেলা যাবে হংসা মোর, আকেলা যাবে।
    যায়েকে বেলা রে, আকেলা যাবে।'
    (যে পথে যেতে হবে, সে পথে তুমি একা। ও আমার হংসরূপী আত্মা!)

    খাওয়ার পর বুধরাম বাসন ধুচ্ছে, গঙ্গারাম ওকে ডাকেন।

    -- শোন, সারাজীবন অংগুঠাছাপ হয়ে থাকা বড় অভিশাপ রে। কাল থেকে লেগে যা। আমি তোকে লিখতে-পড়তে শেখাব। খালি সময় অনেক পাস। খামোকা বিড়ি খেয়ে আর দাদুসায়েবের মুনিষজনের সঙ্গে গুলতানি করে নষ্ট করিস নে।'

    রাত্তিরের মনখারাপ করা বিষন্নতা আর ব্রাত্যজনকে অক্ষর পরিচয় করানোর জিদ সকালের রোদ্দুর কড়া হতেই কেমন যেন উপে গেল। তবু সন্ধেবেলা গঙ্গারামের সামনে বুধরাম আসনপিঁড়ি হয়ে বসল, হাতে সদ্যকেনা স্লেট-পেন্সিল।

    আধঘন্টাও কাটল না, গঙ্গারাম হাফিয়ে উঠলেন। ভারী বালতি-বওয়া, কুড়ুল দিয়ে কাঠ কাটা, কড়া পরা হাতে পেন্সিল ধরতে শেখানো যে এত কঠিন হবে গঙ্গারাম ভাবতে পারেননি। আঙূল বেঁকছে না। কি ঝকমারি রে বাবা! -- হবে, হবে, সময় লাগবে। ঘাবড়াস নে।'

    গঙ্গারাম কাকে বললেন? বুধরামকে? কি নিজেকে?

    সেদিন কোনও স্থানীয় পরব ছিল। ব্যাঙ্কে লোকজনের ভিড় নেই বললেই চলে। চা খেয়ে, মাছি তাড়িয়ে সময় কাটছে না। ভাতঘুম চোখের পাতায় জেঁকে বসছে। এমন সময় ক্লার্ক খানিকটা "অমানুষ' ফিল্মের উৎপল দত্তের কায়দায় মাঠের দিক দিয়ে হেঁটে যাওয়া কাউকে দেখিয়ে বলল -- ও যা রহে হ্যায়, সরকার, আপকা কামকা আদমী!

    ওর তর্জনী অনুসরণ করে তাকিয়ে গঙ্গারাম দেখলেন একজন বছর তিরিশের লোক ঝুঁকে পড়ে হাঁটছে, কিন্তু পা পড়ছে ঢিমে-তেতালায়। ঠিকমতো সমে আসছে না। রাগে ব্রহ্মতালু জ্বলে উঠল। মাত্র গত সপ্তাহে লোকটাকে শাক-সব্জি বিক্কিরির ব্যবসা করতে আই আর ডি পি সরকারি যোজনায় পাঁচ হাজার টাকা লোন দিয়েছেন।

    গলা চড়ল। -- এ, এ সোহন! ইধর আ! ইধর আ নিপোড়। (এদিকে আয়, আয় বলছি ক্যালানে কোথাকার।) যা বুধরাম, লে আ উস্‌ বেওকুফ্‌কো।

    খানিকক্ষণ পরে ব্যাঙ্কে বুধরামের সঙ্গে ঢুকল এক মূর্তি। পরনে চেককাটা লুঙু আর সস্তা সিল্কের পাঞ্জাবি, গলায় লাল রুমাল, মুখের কষ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানের পিক। আর কামরার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে মহুয়ার মদের গন্ধ।

    -- নমস্তে সরকার! মাফি দেও মালিক, বুরা ন মানো।

    -- কি রে হতভাগা? ব্যাঙ্কলোনের পয়সা সব দারুভাট্টিতে দিয়ে এলি?

    -- নহী সরকার! ইয়ে গলত বাত্‌ হ্যায়। লোনকা এক ভী পৈসা দারুভাট্টিমে নহী গয়া। মদ তো আমি নিজের পয়সায় খাই।

    -- ইয়ার্কি মারার জায়গা পাসনি? ব্যাঙ্কের পয়সায় কেনা শাকসব্জি কোথায়?

    -- হুজুর, সচ্‌ কহতা হুঁ, মেরে উস্তাদ কী কসম। সব্জি বেচার ধান্ধা? ও তো আমার বাঈ করে। আজও দুই ঝুড়ি শাকসব্জি নিয়ে কাঠঘোরার হাটে গিয়েছে, রাত্তিরে ফিরবে। কাল সকাল সাতটায় যদি দয়া করে এই গরিবের ঘরে পায়ের ধুলো দেন, তাহলে সব হিসেবনিকেশ করে দেব। আমি কলাকার, বেইমান নই।

    হাঁ, হুজুর, আমি কলাকার। বাড়ি থেকে পালিয়ে সেই কলকাতায় গিয়ে মেটিয়াবুরুজের উস্তাদ হাফিজ নগীনার কাছে পাঁচ বছর সাগরেদি করে গজল আর কাওয়ালি শিখেছি। গণেশপুজোতে এই গাঁয়েই আমার প্রোগ্রাম হওয়ার কথা, কিন্তু শেষ সময়ে সরপঞ্চ ধোঁকা দিল।

    গঙ্গারামবাবু হতভম্ব, এর বৌ শাকসব্জি বেচে, এ করে কি?

    -- খুলে বলি সরকার। মেটিয়াবুরুজ থেকে ফিরে গাঁয়ে গাঁয়ে গান গেয়ে বেড়াই, কিছু দক্ষিণা পাই। এমনসময় "নজর লড় গয়ি হ্যায়, তো মনমে খটকওয়া হইবে করি'।

    দো আঁখে চার হলো যার সঙ্গে সে জাতে চামার। বাড়ি থেকে আমাকে দিল বের করে। তাতে কি? বৌ রোজগার করে, আমি ঘর সামলাই, রান্না করি, বাচ্চা সামলাই।

    আর কখনও সখনও প্রোগ্রাম পেলে একশ'-দুশ' কামিয়ে নিই।

    ইতিমধ্যে ক্লার্ক বলার চেষ্টা করলো -- ব্যাটা পাঁড় মাতাল, সব কথা বিশ্বাস করবেন না।

    ধমকে উঠল সোহনলাল। -- তুম চুপ রহো জী। হম দেবতাসে, হমারে মালিকসে বাত কর রহেঁ, নৌকরোঁসে নহী। আপনি চিন্তা করবেন না সরকার। লোনের কিস্তি ঠিক তারিখে জমা হবে। বাঈ করবে। কখনও কখনও আমি আসব, আপ দেবতাকে দর্শন কে লিয়েঁ।

    এইবার সোহন সামনে হাত মেলে গেয়ে উঠল -- "দর্শন দো ঘনশ্যাম নাথ মোরি আঁখিয়া প্যাসী রে।' তারপর হাত নেড়ে নেড়ে অদৃশ্য ব্যাঞ্জো বাজাতে লাগলো; -- "টিংরিং -- রিংরিংরিংরিং--- রিং,, টিংরি--- রিংরিংরিংরি---।'

    সোহনলালের গান শোনা গেল একমাস পরেই, হোলির দিনে।

    বিশাল মিছিল, প্রায় জনা তিরিশ লোক। নাচতে গাইতে আসছে রাজবাড়ির অর্থাৎ, দাদুসায়েবের কোঠির দিকে। মাদল বাজছে, আর কর্তাল, এরা বলে মঞ্জীরা। অনেকেই ভাঙ খেয়েছে। কেউ আলু কেটে তাতে যৌনক্রিয়ার সবচেয়ে পরিচিত হিন্দিশব্দটি ব্লেড দিয়ে খুদে এনেছে। আর তাতে রং লাগিয়ে সবার বুকে চাপ লাগাচ্ছে।

    গঙ্গারামকে দেখা মাত্র আওয়াজ উঠলো -- লাগা, লাগা -- ব্যাংকওয়ালে কো লাগা।

    আর কিছু বোঝার আগে গঙ্গারামের বুকপকেটের কাছে ছাপ লেগে গেল। ওর ভ্যাবাগঙ্গারাম ভাব দেখে আরেক প্রস্থ হাসির হররা। একজন "নিন, প্রসাদ নিন্‌' বলে গঙ্গারামের দিকে বাড়িয়ে দেয় একটি ছোট ভাং-এর গুলি। খানিকক্ষণ পরে ব্যাংকসাহাব ও সবার সঙ্গে মিলে সোহনের গানের সঙ্গে নাচতে লাগল।

    -- "রং পিচকারি, সম্মুখ মারি। ভিগি আঙ্গিয়া, অউর ভিগি শাড়ি। আরে হোলিমে ঝুম গয়ে শ্যাম, আরে হোলি মেঁ'।

    দুপুরে কোনরকমে চান করে ভাত খেয়ে বিছানায় ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে বুধরামকে হোলির মিষ্টি, নমকীন, গুজিয়া এসব একপ্লেট দাদুসাহেবের বাড়িতে পৌঁছে দেয়ার নির্দেশ দেয়া গেল।

    সপ্তাহ দুই গেছে। গরম। বাতাসে হঠাৎ হঠাৎ ধুলোর ঘূর্ণি ওড়ে। ঝেঁটিয়ে দেয় যত ঝরাপাতা। বাতাসে ম' ম' করে মহুয়ার গন্ধ। গঙ্গারাম বেলা একটা নাগাদ মোটরসাইকিলে করে একটা রিকভারি ট্যুর করে ফিরছিল, ব্যাংকের কাছে আসতেই দেখে বিরাট ভিড়। ওকে নামতে দেখেই ভিড়ের মধ্যে আওয়াজ উঠলো -- আ গয়ে, আ গয়ে। আর নামামাত্র একজন আধবয়সী মহিলা এসে জড়িয়ে ধরলো ওর হাঁটু, -- হুজুর, আমার ছেলেকে বাঁচান।

    বারান্দার থামের গায়ে পিছমোড়া করে বাঁধা রয়েছে বুধরাম। কষের কাছ দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। পরনে একটা হাফপ্যান্ট, গায়ে জামা নেই। ফলে গায়ে দাগড়া দাগড়া কালসিটে ঠিক দেখা যাচ্ছে। একটা মোষবাঁধার মোটা দড়ি পাকিয়ে ওটা দিয়ে ওকে চাবকাচ্ছেন দাদুসায়েব। অনেকক্ষণ ধরে চলায় হাঁফিয়ে পড়েছেন। এখন খালি গালাগালি আর চিৎকার। বুধরাম নেতিয়ে পড়েছে, কোন প্রতিরোধ নেই।

    গঙ্গারাম প্রথমেই দাদুসায়েবের হাত থেকে মোটা দড়িটা ছিনিয়ে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল।

    -- কি করছেন, কি? ছেলেটা মরে যাবে যে!

    -- মরে যাওয়াই ওর ভালো ছিল। দুধ-কলা দিয়ে ঘরে নাগ পুষেছি। আমাকে না বলে ওকে জিজ্ঞেস করুন -- জানেন, ও কি করেছে? চুরি করেছে।

    -- চুরি? বুধরাম চুরি করেছে? আমার বিশ্বাস হয় না।

    -- আমি কি মিথ্যে বলছি? চারদিন ধরে টেবিলের নীচে ধান বেচার চারশ' টাকা রাখা ছিল। ওর সামনেই রেখেছিলাম। বিশ্বাস করতাম। কাল থেকে পাচ্ছি না। আজ ওর তোরঙ্গ থেকে বেরিয়েছে। পান দোকানে বিড়ির বদলে সিগ্রেটের প্যাকেট কিনেছিল। সবাই জানে আপনি সিগ্রেট্‌ খান না। তবে?

    গঙ্গারাম চুপচাপ ওর বাঁধন খুলে দেন। বুধরামের মা ও আরও ক'জন যাদব এসে ওকে নিয়ে যায়। গঙ্গারাম বলেন -- আগে মিশ্র ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাও। আমার নাম কোরো, পয়সা লাগবে না।

    এবার দাদুসায়েব বললেন -- ম্যানেজারবাবু, আপনাকে অন্য লোক দেখতে হবে। চোরকে তো আর ব্যাঙ্কে রাখা যায় না। ছোটবেলা থেকে দেখছি, পুলিশে দেব না। কিন্তু কাল সকালে এই গ্রাম ছেড়ে চলে যেতে হবে।

    গঙ্গারাম আস্তে আস্তে মাথা নাড়েন।

    ভোরের দিকে বিজলী চলে গেছে। মশারিরি ভেতরে গুমোট, গঙ্গারাম জেগে উঠলেন। একটা মোমবাতি কে যেন টেবিলের ওপর রেখে গেছে। আস্তে আস্তে একটি ছায়ামূর্তি বারান্দা থেকে ঘরে ঢুকছে। বুধরাম। হাতে চায়ের কাপ।

    -- কি রে, তুই? এত ভোরে?

    -- হ্যাঁ, চা খেয়ে নিন। আমি এখন যাবো। জামাকাপড় গুছিয়ে নিয়েছি।

    -- কোথায় যাবি?

    -- দিদির গাঁয়ে, অমরতাল।

    -- দিদি?

    -- হ্যাঁ, উম্মেদ কুঁয়ের। ওর কাছে থাকব, নিতে এসেছে।

    গঙ্গারাম কিছু ভাবেন। তারপর বালিশের তলা থেকে পার্স বের করে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট বুধরামের দিকে বাড়িয়ে দেন। -- নে, এটা রাখ।

    বুধরাম যেন ভুত দেখেছে। মাথা নাড়ে, পিছিয়ে যায়।

    গঙ্গারাম বিছানা ছেড়ে উঠে পড়েন, এগিয়ে যান। -- কি হল? এটা রাখ, আমি দিচ্ছি।

    বুধরামের হাত থেকে চায়ের পেয়ালা পিরিচ মাটিতে পড়ে খান্‌খান্‌ হয়ে যায়। অস্ফুট স্বরে বলে -- রূপিয়া তো ওহু দিহিস্‌।

    গঙ্গারাম অবাক হন। -- কৌন দিহিস্‌?

    -- বড়ে মালি। দাদুসাহেব।

    তারপর ফোঁপানোর মাঝে একটু একটু করে বুধরাম শোনায় এক আজব গল্প। সেই হোলির দিন দুপুরে বুধরাম ব্যাঙ্কের কোয়ার্টার থেকে প্রসাদ নিয়ে দাদুসাহেবের কোঠিতে থালা পৌঁছাতে যাচ্ছিল। চারদিক শুনশান। সিদ্ধির নেশায় ঠাকুর-চাকর ঢুলছে। বুধরাম পেরিয়ে যায় বারান্দা, খালিঘর, করিডর। বৈঠকখানার দরোজা ভেজানো। ও ভাবে টেবিলে ঢাকা থালা রেখে চলে আসবে। দরজা একটু ঠেলে ভেতরে যেতে গিয়ে ও পাথর হয়ে যায়। তক্তপোষে শায়িত দুই মানবশরীর। খেলায় মেতেছে। দেবালের দিকে মুখ করা বয়স্ক পুরুষ তো ঠাকুরসায়েবের। কিন্তু ওদিকের নারীশরীর। ওপাশ থেকে গড়িয়ে আসার সময় নারীমূর্তি দেখতে পায় বুধরামকে, চমকে উঠে গায়ে কাপড় টানে। বুধরামের যেন অঙ্গদের পা', মেজেতে সেঁটে গিয়েছে। তারপর পিছন ফিরে প্রাণপণে দৌড় লাগায়। ক'দিন ও আর ওমুখো হয় না। ব্যাঙ্কেই এঁটুলির মতো লেগে থাকে।

    গতকাল দাদুসায়েব ওকে ধরে ফেলেন। ভয়ে সিঁটিয়ে যাওয়া বুধরামকে চারটে বড়পাত্তি দিয়ে বলেন -- হোলির বকশিস। কাউকে বলার দরকার নেই। ম্যানেজারসায়েবকেও না।

    খানিকক্ষণ পরে গঙ্গারাম বলেন -- তোকে কোথাও যেতে হবে না। তুই এখানেই থাকবি। আমি দাদুসায়েবের সঙ্গে কথা বলব।

    -- থাক না সায়েব। কোন লাভ নেই। খামোকা আপনার সঙ্গে অশান্তি হবে। বড়ে মালিকের সম্বন্ধে আমার কেবল মুখের কথা কে বিশ্বাস করবে? আর আমি কাল পান্ঠেলা থেকে সিগ্রেটের প্যাকেট কিনেছি -- সেটা তো সত্যি। তার চেয়ে এই ভাল।
  • যোষিতা | ২২ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:২৩741447
  • এই টইটা অনেক পুরোনো স্মৃতি ফিরিয়ে দিল। যিনি এই কাজটি করলেন তাঁকে অজস্র ধন্যবাদ।
    মজলিশের কিছু লেখাও রয়েছে এখানে। চঞ্চলকুমারের লেখাগুলো ফিরে পাওয়া যাবে কি? ওগুলো পাওয়া গেলে আবার পড়ে দেখতাম সেই ছেলেমানুষী।
  • Bratin Das | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০২:৫৬741448
  • অনেক আশা নিয়ে যো দির "কঠোর ভাবে প্রাপ্ত বয়স্কদের" পড়লাম। সব "ছোটদের" জন্যে লেখা sadsad
  • ইন্দ্রাণী | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৭:৩৯741449
  • আর্কাইভকে অশেষ ধন্যবাদ। আরো অনেক লেখা আসবে আশা করছি।
    ব‍্যক্তিগতভাবে, মজলিশে করা বহু পোস্ট হারিয়ে ফেললেও, প্রবাসীর পত্রের সফ্ট কপি আমার কাছে ছিল; গুরুতে হরিদাস বিভাগ চালু হ‌ওয়ার পরে, সেখানে তুলেছিলাম কিছু। পরে কিছু লেখা গল্পে, উপন্যাসে ব‍্যবহার করেছি, ঐটিই তাদের যথাস্থান, মনে হয়েছিল।
    বাংলালাইভের মজলিশের কাছে সমস্ত জীবন ঋণী থাকব। লেখক যে দূরের দেবতাপ্রতিম নন, তিনি আমাদের মধ্যেই কেউ হতেই পারেন - এই বোধ প্রথম আসে বাংলালাইভেই; শ্রেয়াদি, যোষিতা, দময়ন্তী, অঙ্গনা, ইন্দ্রনীল, রঙ্গন, ঈশান ও আরো অনেকের লেখা পড়ে। প্রত‍্যেকের লেখার নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। অনেক শিখেছিও।
    নিজের টুকিটাকি লেখা শুরু এই সাহসের ওপর ভিত্তি করেই।
    সেসব কথা আবার‌ও মনে করলাম।
    নমস্কার জানবেন।
  • Archive | 42.105.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ০৮:৩৬741450
  • মজলিশ আর মতামত পুনরুদ্ধার খুব কঠিন ও প্রায় অসম্ভব কাজ। মজলিশে ২০০৫ এর ২ জুনে দেখা যাচ্ছে ১৫৪৬ পাতা হয়ে গেছিল। তারপরে মূল মজলিশে ৫০ পাতা রেখে বাকিটা আর্কাইভে সরানো হয়। তারপর কিছুদিন মূল মজলিশে ৫০ থেকে বেড়ে ১০০ পাতাও থাকে। এই মূল মজলিশের মাত্র ২১০টা ক্যাপচার আছে। তার কিছু লগিন পাতা। ওখান থেকে ২০০ পাতার বেশি উদ্ধার হয়ত হবে না। আর আর্কাইভের মজলিশ ২০০৯ এর ২৮ আগস্ট পর্যন্ত ৪১১২ পাতা। কিন্তু ক্যাপচার মোটে ১৫ টা। এর মধ্যে এক পাতা থেকে অন্য পাতায় যাওয়ার লিংক কিছু ক্যাপচার হয়ে থাকবে। সব মিলিয়েও ২৫০ পাতার বেশি উদ্ধার হবে বলে মনে হয় না। সুতরাং ও নিয়ে আশা দেওয়া যাচ্ছে না বিশেষ। এমনিতে ল্যাপটপে (ফোনেও) ফন্টটা ইন্সটল করা থাকলে পড়তে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কপি করে ওয়ার্ডে জমানোতেও অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। ইউনিকোড কনভার্টারও দেওয়া আছে। ইংরিজি টেকস্ট কিছু থাকলে সেটা মূল লেখার ওয়ার্ড থেকে কপি করে কনভার্টেড ইউনিকোডের ওয়ার্ডে রিপ্লেস করাও সহজ। মজলিশ থেকে প্রত্যেকে দরকারের যেটুকু পাবেন নিজের কাছে রাখতেই পারেন। একলপ্তে অনেক এইচ টি এম এল নামিয়ে সব অ্যাভেইলেবল পাতার প্রপার সংরক্ষণের কাজ করতে পাইথন জানা লোকেদের দরকার।  এখানেও যেটুকু উদ্ধার হচ্ছে তার আবার ইনডেক্স করে তালিকা রাখা দরকার, নইলে অচিরেই রিপিট শুরু হবে।
  • Archive | 43.25.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৫:২২741452
  • https://web.archive.org/web/*/http://www.banglalive.com/feedback/*
    এখানে নানা জায়গায় মজলিশ আছে। যেমন ৬৭ পাতার মাঝামাঝি, ৮৮, ৯৮, ৯৯ ইত্যাদি নানান পাতায়। প্রতি মজলিশ লিংকের আবার অনেকগুলো করে ক্যাপচার আছে। এক এক দিনের ক্যাপচার মানেই এক একটা আলাদা মজলিশের পাতা।
    banglalive.com/feedback/archiveMajlish.asp? এবং banglalive.com/feedback/majlish.asp?
    এই দুরকমেরই পাতাগুলো লিংক ধরে এক একটা করে খুলে সেগুলোর সবকটা ক্যাপচার দেখতে হবে। সিস্টেমেটিকালি দেখলে ২৫০-র অনেক বেশি পাতাই পাওয়া যাবে মনে হচ্ছে। প্রথম পোস্টের মাথায় দেওয়া তারিখ অনুযায়ী এক একটা পাতা yyyy-mm-dd নাম দিয়ে একটাই ফোল্ডারে সেভ করতে থাকলেই মোট কতগুলো পাতা উদ্ধার হল বোঝা যাবে। সব পাতা উদ্ধার হলে তবেই সিকোয়েন্স অনুযায়ী সেসব সাজানো যাবে - তা সেটা কোনো গল্প যেমন শঙ্কুই হোক বা চঞ্চলের ফিলিম বা কোনো বিষয় ধরে তর্ক বা অন্য লেখা। সাজানোর পরে ট্রান্সলিটারেট করে ইউনিকোডে আনা।
     
  • যোষিতা | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:০৯741453
  • আর্খি, আমার চঞ্চলকে এনে দেনারে। সে ছিল আমার ইন্সপিরেশন, আদর্শলিপি, অল্টারইগো, আনন্দআশ্রম, সপ্নোকে সওদাগর...
  • Bratin Das | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৭:১১741454
  • আর  যো দির প্রফেসর  শঙ্কুর গল্প  গুলো? ওগুলো তো টই এ লিখেছিলে না? 
     
  • স্বপক্ষে বুলবুলিবাক্য : বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত | 43.25.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৪৩741455
  • সংলাপ, ৪-৪-২০০৭
     
    স্বপক্ষে বুলবুলিবাক্য
    বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত

    (সম্প্রতি সিঙ্গুর বিতর্ক ও বিশেষত: নন্দীগ্রাম হত্যাকান্ডের কৃষি-শিল্প-পুলিশ বিতর্কে হত্যা-ভিটেত্যাগ-সন্ত্রাস-সংবাদ-গুজব-হুমকি-সন্দেহ-অভিযোগ-তদন্ত ও সর্বোপরি সংখ্যাতত্ত্বের আদানপ্রদান যখন চলছিল তখন থেকেই এক পুরোনো কমরেড বন্ধুর সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার একটা রাজনৈতিক মতবিরোধ হয়। বাক্যালাপেও আপাতত বিরতি। তো মানুষ বেড়ে ওঠা নামক পাড়ার চেনা পানাডোবাটিতে বিপদে আপদে ডুবু চান করেই থাকে। আমি করলাম। স্বীকার করে নিচ্ছি সরকারি বেসরকারি সর্বজনীন আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও আমার গ্রীষ্মে হাঁটুজল চেনা ডোবাটি এখনও সর্বজনপ্রিয় কোনও একমুখী স্রোতসাগর খুঁজে পেতে ব্যর্থ।)

    পক্ষপাতিত্বের যুগের লোক আমি, বন্ধু আর শত্রুর মধ্যে বিভক্ত এক বিক্ষুব্ধ ও নিশ্চিন্ত পৃথিবীতে জন্মানো ও বড় হওয়া, ট্যাঁ থেকে মুষ্টিবদ্ধ চিল্লানি সবই কারও না কারও বিপক্ষে করেছি, বিরোধিতায় ছেলেবেলায়। মাঝের টুকটাক খিলখিল বা নাক ঘসাঘসিগুলো ধর্তব্য নয়। গ্রাম্যতা ও হর্মোন যথাক্রমে। শত্রু চিহ্নিত করতে দেরি করতাম না আমরা, সময়ের দায়ে মানুষ দ্রুত শেখে।

    আমার প্রথম শত্রু ননীকাকু। কারণ এর আগে ভিড় বাসে কন্ডাক্টর রামকাকুর মাথায় নাকের সিকনি ঝেড়েও আমি মার তো দূরের কথা বকুনিও খাইনি, বাবুদের বাচ্চাদের শখ আহ্লাদের কথা রামকাকু জানতেন। অভিজ্ঞ মানুষ ও বাস কন্ডাক্টর। অতএব ননীকাকু। ইনি আমায় রানিদিদির টিপিন খেতে দেখে ফেলেন এবং অপরের খাবার না বলিয়া খাওয়ার অপরাধে একটি প্রাতিষ্ঠানিক চড় মেরে আমার শৈশবের অবসান ঘটান। এই অপরাধে তাঁকে আমি বহুদিন মনে মনে উইকেট দিয়ে মেরেছি। মনে মনে, কারণ, বেম্মো ইশকুলে ও তদ-প্রভাবিত ভিক্টোরিও পরিবারে এবং প্রাইমর্ডিয়াল ছায়া সুনিবিড় গ্রাম্য পাড়া সর্বত্রই কী আশ্চর্য অহিংসা কেবলই উর্ধ্বগামী।

    আমার দ্বিতীয় শত্রু আমার বাবা। ইনি নিজে সারাদিন সিগারেট খেতেন ও ছাত্রদের ভাল করে পড়ানোর সাধনা করতেন, পক্ষ-বিপক্ষ বিলক্ষণ চিনতেন ও চেনেন, কিন্তু এত কিছুর মধ্যে তিনি আমায় দুপুর একটা থেকে তিনটে ভুলে গিয়েও খেলতে দিতেন না, হ্যালেঞ্চা শাক খেতে বাধ্য করতেন এবং অবসরে, সারল্যের অত্যাচারে ব্যতিব্যস্ত পাড়া-প্রতিবেশী, নেকু হিংসুটে বন্ধুগণের নালিশসাপেক্ষে দু-চার ঘা কষাতেন, এনাকেও বহু দিন মনে মনে গাল দিয়েছি, যথোচিত বয়সে চিল্লিয়েছি, কারণ বাম রাজনৈতিক গোলার্ধে পারিবারিক খেঁকুটেপনাকে লিবেরেল বিতর্ক বলা হয়ে থাকে।

    আমার তৃতীয় শত্রু বিভূতিভূষণপ্রেমী পিতামহী। আমাকে শোকসাগরে ভাসিয়ে এবং ক্ল্যানসত্ত্বার পোমোশ্রুতি বর্জন করে ইনি বকফুল ভাজা তথা নারকেল নাড়ু পাড়ায় বিলোতেন, দেবদেবীর ট্যাক্সোনোমির প্রতিটি স্তরকে ঊষাকালে পূজা নিবেদন করার অব্যাহতি পরেই পঞ্চভূতকে উদ্দেশ্য করে দিনারম্ভে অন্তত এক প্রহরকাল প্যাঁচাল পাড়তেন। তবে পঞ্চভূতে অন্যতম ও ষষ্ঠ উপাদান ছিলেন জনৈকা বধূমাতা অর্থাৎ আমার মা, যাঁকে সুখেন দাসের তথা আপামর বাংলার প্রণম্য মা হয়ে উঠতে গিয়ে যৌবন ও প্রথম মধ্য বয়সের পঁয়ত্রিশের কিছু বেশি বছর বিসর্জন দিতে হয়েছিল। তবে ওই কটা বছরই মা সম্ভবত একটু আইজকাইলকার মাইয়া হতে পেরেছিলেন, তারপরেই ওনাকে সেকেল হয়ে যেতে হয়, মাঝে বিশ্রাম পেয়েছিলেন কিনা কখনও জিজ্ঞাসা করা হয়নি।

    আমার চতুর্থ শত্রু ছিলেন আমার মা, কারণ ইনি আমার হাসিখুশি আবোলতাবোল রাশান চিড়িয়াখানার গল্প ও ছবির ঠিক পরবর্তী সন্দেহজনক কৈশোরের পদ্য ও কাব্য, নব উন্মেষিত ও স্বপ্নবলে অনিয়ন্ত্রিত কোলবালিশাশ্রয়ী ঔরস, বান্ধবীকুল, সর্বোপরি বিলিতি হেডনকুলজাত দুষ্টগণরচিত গ্রন্থবর্গকে সন্দেহের চোখে দেখতেন। ১৯৬৮-র মে মাসে কোনও আশ্চর্য কারণে ইনি প্যারিসে না থেকে সুরুল-শ্রীনিকেতনে ছিলেন, তাই তাঁর শিক্ষা অসম্পূর্ণ রয়ে যায়।

    এঁদের সকলকে ব্যক্তিগত মহানুভবতার কারণে আমি ক্ষমা করেছি বিগত যৌবনেই, পক্ষ বিপক্ষ না ভুলেই। এঁরাও আমার স্পর্ধা ক্ষমা করায় দীর্ঘদিন ধরেই অভ্যস্ত। পোলাপানের সমাজ চিন্তায়, পিতামহীর পারলৌকিক পরামর্শেই সম্ভবত এঁদের সাধারণ আগ্রহ কম।

    এরপরে সেই সব শত্রুদের কথা, যাদের ক্ষমা করিনি। মুশকিল হল এঁরাও আমায় তেমন সময় দিতে পারেননি। পারবেন বলে মনেও হয় না। শুধু গত দশ পনেরো বছরে ভারতীয় শিক্ষিত মধ্যবিত্তের সাফল্যের ব্র্যান্ডসূর্য যখন আন্তর্জাতিক মধ্যগগনে তখন বিলাপি মুৎসুদ্দি ও নব্যপ্রযুক্তি তথা তত্ত্বকর্মীবাবুদের স্মৃতিবিহ্বল সৌখিন পরাজয় সম্ভব কাব্য পাঠে শিক্ষিত বাংলাভাষীদের ক্রমবর্ধমান অনাসক্তি ও অনীহা, ব্যঙ্গবিদ্রুপের থেকেও শক্তিশালী অস্ত্র। তবু লিখে রাখি, মনে যাতে রাখতে না হয়।

    এহেন প্রথম শত্রু পুঁজিবাদ ও তার বিভিন্ন মুখ ও মুখোস। যে বিশ্বব্যবস্থার সাফল্যে অসংখ্য মানুষের ন্যূনতম খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও স্বাস্থ্যের অধিকারহরণের উপরে নির্ভরশীল তাকে শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করতে সংশয়ের অবকাশ কম। স্বপ্নপ্রেমী কৈশোর ও সামাজিক ন্যায়পন্থী যৌবন এখনও বার্ধক্যের ভবিতব্য হুপিং কাশির ন্যায় আলাইভ ও কিকিং, পেনসন থাকুক না থাকুক।

    দ্বিতীয় শত্রু নির্ণয় আরেকটু জটিল। আমরা চিন যুদ্ধ কিংবা খাদ্য আন্দোলনের পরের আধা শহুরে প্রজন্ম, তাই মজুতদারির থেকেও বিভিন্ন জমিদার জোতদার খচিত কৃষিব্যবস্থা আমার মহান ও নির্বিকার দ্বিতীয় শত্রু হওয়ার সম্মান পাচ্ছেন। এতে তার কিছুই এসে যায় না যদিও। এদের কাছে মাইনে যোগাড় করতে আমার সাঁওতাল বন্ধুদের বাপ মায়েদের দম বেরিয়ে যেত। দিনমজুর, ক্ষেতমজুরের, ভাগচাষীর লড়াই কিছু শিক্ষা দিয়েছিল।

    তৃতীয় শত্রু ধর্ম ও সম্প্রদায়কেন্দ্রিক রাজনৈতিক রেটোরিক। মাদুগ্গার কৃপায় অসংখ্য মাকালীবাদী মার্কসিস্ট জ্যাঠা মামা দ্বারা পরিবৃত হওয়া সত্ত্বেও দশরথ পুত্র স্মরণে উৎপাদিত ইট ও অযোধ্যা কান্ডের পরে ক্রোধের দিক নির্ণয়ে আমার অসুবিধা হয়নি, বাড়িতে রবীন্দ্র রচনাবলী ছিল, লালন ছিলেন বাউল মূর্তির নীচে পাথরের অক্ষরে, মান্তো ছিলেন, আরও গরম থেকে ঠান্ডা হয়ে যাওয়া মৃত মাংসের মিছিলের ইতিহাস ছিল কেতাবের বাইরের ৪৬ এ, ঘর পালানো আত্মীয় বন্ধুরা ছিলেন, আর একটা স্বপ্ন ছিল, একদিন হিংসার কিংবা অস্ত্রের প্রয়োজন ফুরোবে। শান্তিপ্রিয় কম মাইনের ঝুনুদিদি ধর্মনিরপেক্ষ দেশে মা শীতলার পুজোর পরের দিন কেন দরগাতলায় যান, জানতে চেয়েছি একটু দেরিতে হলেও। আর সম্বল বলতে প্রায় অজান্তে শিকড়বাকড় গড়ে ফেলা একটা বিশ্বাস, বটুকদার ইন্টারন্যাশনাল একটু সুরে গাইতে পারলেই বিপ্লব ত্বরান্বিত হবে, মানুষে মানুষের হাত ধরবে। জেনে রাখবেন সাহসে শুধু নয় ন্যাকামিতেও আপনেরা এই গোব্দা কিশোরটির তুলনায় পিছায়ে ছিলেন।

    শেষ শত্রুটিই আজকের প্রতিপাদ্য। কার বিরোধিতা করব আমি, কাকে কাছে টানব, কার পতাকা হাতে নিয়ে বলব এই পতাকা আমার, আমাদের। পক্ষ নেওয়ার পুরোনো অভ্যেস আমার আটকপালিয়া দায়। কৃষকপ্রেমে যাঁরা গদগদ, যারা আমার মদ্য, পুস্তক ও সস্তার জ্যাকেট ও মুসলমানদেরকে কটাক্ষ করে দিনযাপন করেন, যাঁদের জাতিগর্বী শয়নে স্বপনে পাউন্ড-ইয়েন-ইউরো-ডলার নৃত্য করে, তাদের আমি দেশপ্রেমী বলব? ভূগোলের দায়? ভূগোল কার বাপ?

    খেতমজুর ও দিনমজুরকে যারা কোনওদিন মজুরি দিতে চায়নি, ভাগচাষীকে ভাগের ফসল নিতে গিয়ে যাদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত তীব্র লড়াই করতে হয়, নামী-বেনামী জমির মালিক যারা, শহরের মধ্যে, আশেপাশে কারখানার জমি প্রতিদিন বিক্রি করে দেয় যারা ফ্ল্যাট বাড়ি আর শপিং মল করবে বলে, আদর্শ অর্থনৈতিক পরিবেশ তৈরি করতে গিয়ে যাদের প্রথম দাওয়াই রেশন ব্যবস্থাটি তুলে দেওয়ার, এখনও যারা মানুষের সম্বৎসর কাজের অধিকারের সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেয়নি, তাদের সঙ্গে নিয়ে শিল্পের জন্য কৃষি জমি নেওয়ার বিরোধিতা করব? নাকি বিশ্বায়নের যাদুবলে ক্রমপ্রসারমান বিশ্বশান্তির খোয়াবনামা লিখব। কৃষিজীবীদের বিরুদ্ধে কৃষিজীবীদের লড়াইতে কার লাভ? দিনের পর দিন যে কারখানার মালিকেরা পেনশন, প্রভিডেন্ট ফান্ড, বোনাস না দিয়ে এবং হরির লুটের ন্যায় ছাঁটাই বিলি করে কারখানা কোম্পানি চালান আর প্রতিবাদ হলে বলেন শ্রমিকরা শিল্পস্বার্থবিরোধী, যারা বছরের পর বছর পরিকল্পিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থার নামে আসলে বৃহৎ পুঁজিকেই উৎসাহিত করেছেন, আর এখন লাভজনক পাবলিক সেক্টরগুলি, প্রাইভেট কোম্পানির কাছে সর্বাগ্রে বিক্রি না করতে পারলে যাদের রাতে ঘুম হয় না, তাঁরা কৃষকবন্ধু? বিদর্ভে অন্ধ্রপ্রদেশে, কর্ণাটকে ঋণে জর্জরিত কৃষকেরা যখন আত্মত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন তখন কৃষি বিতর্ক তথা নানাবিধ পদত্যাগ কোথায় ছিল? আর যেখানেই থাকুক বঙ্গ মিডিয়ায় তখন ধরে নিতে পারি কৃষিস্বার্থ নয় শিল্পের অভাব ঘুম কাড়ছিল। ১৪ মার্চ ২০০৭-এর পরেও এই বিতর্ক ফিরে আসতে এক দেড় সপ্তাহ লাগল মাত্র। অঙ্গরাজ্যগুলির অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড দীর্ঘদিন ধরে সম্পূর্ণ কেন্দ্রীয় সরকারের নীতির উপরে নির্ভরশীল থাকার পরে আজ তারা হঠাৎই শিল্পবন্ধু হয়ে ওঠার প্রতিযোগিতায় নামতে বাধ্য হচ্ছেন কেন, কী তার ইতিহাস, কোথায় তার দীর্ঘকালীন সমাধান এই সব প্রশ্ন স্বভাবতই করার লোক কম। কারণ এরা শিরোনামের ঝলকানি পায় না। সংবাদ পরিবেশনার প্রয়োজনে সরকার পরিচালনা কিংবা নবসংগঠিত কৃষকপ্রেমী বামপন্থার নতুন জনপ্রিয় অর্থ আপাতত দুটি। সংবাদমাধ্যম, বিশেষত ইলেকট্রনিক মাধ্যম ও প্রাক্তন ছাত্রবামপন্থা! এই সুযোগে বিরোধিতার সুরে সুর মেলাতে পিছপা নন একদিকে সেই জাতীয়তাবাদী নেতৃত্ব যাঁদের লৌহকঠিন দৃঢ়তা তথা সাংবিধানিক দায়িত্বজ্ঞান সুবিদিত ও গুজরাটে প্রদর্শিত, অন্যদিকে, মধ্যবিত্তের সুবিখ্যাত সম্মিলিত অমৃত ভান্ডার থেকে সমবেদনা তুলে দিতে দিতে অবসন্ন কিছু বাম বুদ্ধিজীবি। "আরো কেন ভালবেসে যেতে পারে না হৃদয়'? এঁরা অনেকেই সম্ভবত সংগঠিত রাজনীতির বিরোধী। ছ-মাসের আন্দোলনে এঁদের পাশে পাননি দুর্ভাগা চটকল শ্রমিকেরা। পরিবেশ ভারসাম্য নিয়ে যাঁরা বিব্রত, শহুরে বেকারিত্ব কিংবা কর্মসংস্থান নিয়ে তাঁদের অবস্থান আমার কাছে পরিষ্কার নয়, যাঁরা গ্রাসরুট আন্দোলনের নেতৃত্বে, জাতীয় রাষ্ট্রর চেহারা বদলে তাঁদের নীতি কী? যাঁরা স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দ্বারা রাষ্ট্র পরিচালনার স্বপ্ন দেখেন তাঁরা যে মূলত অনুদানপ্রাপ্ত অর্থে তৃতীয় বিশ্বের রাজনৈতিক পদ্ধতি ও প্রতিষ্ঠানগুলিকে শক্তিহীন করতে সাহায্য করছেন এ কথাটি বোঝেন না, বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে, শোকের দিনেও। উদাহরণের তো অভাব নাই। সংবাদমাধ্যম আজ জনহিতার্থে সংবাদ শিরোনাম প্রচারের প্রতিযোগিতায় সংবাদের আড়ালে শীর্ষ সংব্দেনশীল ব্যক্তিত্বদের রাজনৈতিক মতামত প্রচারে ব্যস্ত। আমরা ব্যস্ত গ্রহণে। শ্রেণী রাজনীতি ঠিক আব্রু দেয় না। তবে প্রচারের আলো অনেক অন্ধকারকেই ঢাকতে ব্যস্ত থাকে সেটা আর নতুন কোনও বিষয় নয়। জীবিকা কার, কৃষি কার, কৃষির মূল সমস্যা গুলি কোথায় কেন, শিল্প কার, কর্মসংস্থান কার, গ্রোথ কারে কয়, উন্নয়নের রাজনীতি কোথায়, ভূমি সংস্কার যেন কী, এই প্রশ্নগুলি স্বাভাবিকভাবেই শিরোনাম হতে ব্যর্থ। কৃষক ও কৃষিজীবিরা তাঁদের রাজনীতিতে ভবিষ্যতে কাকে কোথায় কতটা স্থান দেবেন তাঁরাই ঠিক করবেন, তাঁদের নতুন বন্ধুদের এই পুরোনো চেনা ডোবাস্নাত প্রশ্নগুলি তাঁরাই করবেন কোনও না কোনও দিনে।

    আমার "আমাদের'-এ পালাবদল ঘটেছে সিগারেট আর পুস্তকবিক্রেতার চোখ রাঙানিকে পয়সার ঝনঝনাতিতে চমকে দেওয়ার উচ্চাশায় যেদিন প্রথম নগদ বারোশোর নিয়োগপত্রটি গলায় বেঁধেছিলাম সেইদিন। রেন মার্টিন থেকে শেখা ইংরেজি কাজে লাগাতে শিখেছি সেই একই দিন থেকে, মাইনের কাজে, অর্থনীতির কাজে, নব্য ডলারমার্কা দেশপ্রেমের কাজে। বিপক্ষ স্বপক্ষ হয়েছেন। হয়েছি বলাই ভাল। তবে প্রথম বা একাকী পুরুষ নই এই লাইনে এটুকুই সান্ত্বনা। দ্বান্দ্বিক নৈর্ব্যক্তিক বংশানুক্রমিক শিক্ষা থাকায় সমাহিত নির্বিকার থাকতে আমার "আমাদের' পরিশ্রম হয় না। রাজনৈতিক প্রয়োজন যাঁদের চিন্তাকে নির্ভুল বিস্মৃতির ঘেরাটোপ দেয় তাঁদের কাছ থেকে পাঁচিলের ওপরে বসে থাকার অভিযোগ শুনলে আমার প্রতিক্রিয়া হয় না তা নয় তবে কম হয়। এই বিপুল তারকাখচিত সংবেদনশীলতার বিজ্ঞাপনপর্বে পথে নেমে পথ হারানোর তাড়া আমার নাই। কল্লোলপথে নেমে পথ চেনা যারে কয় "চলছে চলবে।'

    আজ নয় মননের মৃত্যুঘন্টা নিজেই বাজিয়েছি বহুদিন হল, বলি দিয়েছি চিন্তাকে, আমিই কাপালিক রঘুপতি। না মরিনি এখনও, বাঁইচাই আসি, হাত ধরো তোতলা কলমচি, না পারলে তফাত যাও। আমি আছি, গিন্নি আছেন। কিছু বইপত্র আছে। ইতিহাস কলম এরাও মরেন নাই, অশৌখিন মানুষ আছে কিছু, সময়ই আমাদের স্বপক্ষের জাল ছিঁড়ে দেবে কোন দিন। তদ্দিন আমি সদাহাস্য প্রিয়ভাষী বিনীত বাদী, আত্মপক্ষে।
  • বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত : আমরা হয়তো পারি, কিন্তু আপনি কি পারবেন মি: প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট? | 43.25.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৮:৫৪741456
  • সংলাপ, ২১-১১-২০০৮
     
    আমরা হয়তো পারি, কিন্তু আপনি কি পারবেন মি: প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট?
    বোধিসত্ত্ব দাশগুপ্ত

    বদলা

    ১৯৮৬-তে মারাদোনার বিশ্বকাপের সময় পাড়ার জেঠুর বাড়িতে টিভি দেখে ক্রাউড বিহেভিয়রের প্রথম আন্তর্জাতিক পাঠ। পাঠের নাম মেক্সিকান ওয়েভ। ডান দিকে নজর রাখুন। দেখুন আপনার পাশের ব্লকের মানুষেরা কখন বসতে আরম্ভ করেন, ঠিক সেইটাই আপনার উঠে দাঁড়ানো সময়। উঠে দাঁড়িয়ে দুই হাত তুলে মুখে হর্ষধ্বনি করুন, মনে মনে এক দুই তিন গুণে আবার বসে পড়ুন। এইবার উঠবেন আপনার বাঁদিকের ব্লকের মানুষেরা। ঐতিহাসিক ঢেউ তুলুন বন্ধু। এই মর্মে রাজ্য ক্রীড়া কল্যাণ দপ্তর সেদিন সম্ভবত একটা ছোট রঙিন লিফলেটও বিলি করেছিলেন বিনা পয়সায়। সেই লিফলেট পুরোনো প্রেমিকাদেরকে লেখা অথচ না দিতে পারা চিঠিগুলোর সঙ্গে হয়তো রয়েও গেছে কোনও প্রাচীন বুক কেসের পেছন দিকে। সেদিন মানে ১৯৯০-এর ১৭ সেপ্টেম্বর। দু'দিন পরেই পড়ে যাবে ভি পি সিংহের সরকার। কারণ ম্যাসেঞ্জারে লালুর পুলিশের হাতে গৃহবন্দী হয়েছেন লালকৃষ্ণ আদবানি। কিন্তু আমরা সেদিন, অন্তত সেদিনটুকু ঢেউ তুলেছিলাম তৃতীয় বিশ্বের আন্তর্জাতিক সলিডারিটিকে মরণোত্তর শ্রদ্ধা জানিয়ে। কারণ সেদিন কলকাতায় এসেছিলেন নেলসন ম্যান্ডেলা।

    এবং কোনও কথা হবে না, সেইদিন, হ্যাঁ সেইদিনই প্রথম আমরা দুই বন্ধু মনে মনে বাবা-কাকাদের হিংসে দেওয়ার মতো একটা কাজ করেছিলাম। নইলে কলেজ আর কৃষক ব্রাঞ্চের পুঁচকে পুঁচকে অসংখ্য মিছিলে আর মান-ইজ্জত কিসু থাকছিল না খাবার টেবিলে। একথা সকলেই জানে যে সমস্ত রিটায়ার্ড সরকারি বা অধুনা আবগারি জ্যাঠা-বাবা-কাকারা একটু গুল মারেন। আর কোনও ইস্যুতে পিছপা সামান্য হতে হলেই বলেন "আ: ক: বা:' ("আর কটা দিনই বা বাঁচবো')। বলি কিসিঙ্গারের কুশপুত্তলিকা যতবার পোড়ানো হয়েছে ধর্মতলায়, সেই ধোঁয়ার একটুও যদি আমেরিকা মায় পুবপানে ইন্দোনেশিয়ায় গিয়ে পৌঁছত, তাহলে হয় কিসিঙ্গার নয় সুকর্ণ অন্তত একবার হাঁচতেন, বাংলার আন্তর্জাতিক সলিডারিটির আন্দোলন আরেকটু গুরুত্ব পেত। সেই কবে এসেছিলেন ক্রুশচেভ আর বুলগানিন। সেদিন লক্ষ মানুষের ভিড়ে নাকি মাউন্টেড পুলিশের ঘোড়ার শুধু লেজের-ই ঝাপটায় ল্যাজেগোবরে হতে হতে হঠাৎ মুখ তুলে কাকু দেখেছিলেন, ক্রুশচেভ তাঁরই দিকে, হ্যাঁ সেই রানাঘাটের বসু বাড়ির মেজ ছেলেটির দিকে তাকিয়েই হাসছেন, সোভিয়েত সৌভ্রাতৃত্বের হাসি। এ হাসি জওহরলাল ছাড়া তেমন করে দেখেছিলেন শুধু ইনি। এই কাকুই নাকি আরও অনেক আগে, এক রিকশওয়ালাদের ইউনিয়নের কোনও কাজ নিয়ে পার্টি অফিসে গিয়ে দেখেছিলেন, এক রুগ্ন মঙ্গোলীয় চেহারার যুবক নাকি একটা চেয়ারে বসে আছেন। সামনে একটা অ্যাটাচি। পরে জানতে পারেন উনিই হো চি। উনি নাকি ট্যাক্সিওয়ালাকে শুধু বলেছিলেন, "পার্টি অফিস', তাতেই নাকি ট্যাক্সিওয়ালা সেই অফিসে তাঁকে নিয়ে আসেন। বলা বাহুল্য, সেই ট্যাক্সি ড্রাইভারের নাম ছিল কর্তার সিং অথবা জার্নাল সিং বা ইন্দর সিং বা হরজিন্দর সিং, ডিপেন্ডিং অন টাইম অফ ডেলিভারি। এবং তিনি হরকিষেণের গ্রামের লোক ছিলেন এবং খুব স্বাভাবিকভাবেই কাকুর বিশেষ পরিচিত ছিলেন। তাঁর মা ভাল ছোলা বাটোরা বানাতেন এবং ভগত সিংয়ের গ্রামের লোক ছিলেন এবং সে আমলে পাঞ্জাবেই ইংরেজিতে গ্রাহাম গ্রিনের বই পড়েছিলেন। অবান্তর প্রশ্ন করে গল্পটার বারোটা বাজানো বিশেষভাবে নিষিদ্ধ। তো এই সব প্রজন্মান্তরের অতুলনীয় বামপন্থী স্ট্রিট ক্রেডকে ওই সেইদিনই যাই বলুন বাপু আমরা একটু-আধটু কলার তুলে দেখিয়েছিলাম। হতে পারে আমাদের সেদিনের ওয়েভটা ছিল শত্রু রাজীব গান্ধির জমানায় তৈরি নতুন টেলিভিশন ব্রডকাস্টিংয়ের করুণায় চোখের সামনে এসে পড়া বুয়েনাস এয়ারসের একদা বস্তিবাসী, স্বয়ং ভগবানের নিজস্ব বাঁ হাতের মালিক, কাস্ত্রোর বন্ধু, বোকা জুনিয়র্স ও নাপোলির আপামরের হৃদয়ের একচ্ছত্র সম্রাট তথা রূপকথার রাজপুত্তুরের সম্মানে তৈরি একটা হর্ষ প্রকাশের পদ্ধতি থেকে টুকে মেরে দেওয়া আর ক্রীড়া দপ্তরের রংচংয়ে প্রম্পট-সহ ঐচ্ছিক ওঠবোস। সুভাষ চক্রবর্তী লিটেরালি জুবিন মেহতার কায়দায় ইডেনের সবুজ গালিচার উপর থেকে আমাদের ওঠাবসা নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করেছিলেন। তবু তো লোকটা ম্যান্ডেলা রে বাবা। উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে শোনা বক্তৃতাটা এখন আর মনে পড়ে না। শুধু মনে হয় এক ইতিহাসকে সাক্ষী রেখে আরেকটা ইতিহাস গড়ার সাহস আর না থাকলেও অন্তত বুকটা তখনও কাঁপার মতো সৎ ছিল। ম্যান্ডেলার মুক্তি দক্ষিণ আফ্রিকার তথা বিশ্বের কোটি কোটি সাধারণ মানুষের কাছে যা, সেনেটর ওবামার প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট হয়ে ওঠার গুরুত্ব হয়তো তুলনীয় নয়। বিতর্ক থাকত যদি কেসটা রিয়েলিটি শো হত, বিতর্ক থাকলেও কোনওটারই গুরুত্ব কমে না। ঈশ্বরের অসীম কৃপা এই মর্মে কোনও এসএমএস পোলে আমাকে অন্তত এখনও অংশ নিতে হয়নি। কিন্তু রোমাঞ্চে? এই মিডিয়ার জমানায় শয়ে শয়ে ভিডিও কোলাজের মধ্যে একটা কোলাজ তো আমরা কোনওদিন আর ভুলতে পারবই না। আই হ্যাভ আ ড্রিম বলতে বলতে ড: কিং-এর মাথা ন্যাড়া, পাশে দাঁড়িয়ে জেসি জ্যাকসন। তারপরের শটেই ওবামার শিকাগো বক্তৃতা। ইয়েস উই ক্যান। সামনের বুলেট প্রুফ কাচটা ক্যামেরায় আসে না। চিরজীবন আমাদের আমলকে প্যাঁক দেওয়া কাকু এটা দেখে কি বলতেন সত্যি জানতে ইচ্ছে করে। উপায় নেই, তিনি তাচ্ছিল্যের হাসি-সহ সময়ের কাছে বিদায় গ্রহণ করেছেন।

    ট্রিভিয়া

    বলুন সেদিন আপনার গায়ে কাঁটা দেয়নি একটু-আধটু? ভারতীয় নব্য লিবেরেলিজম-এর ঝকঝকেতম প্রতীক প্রণয় রায় পর্যন্ত স্বীকার করেছেন জাতীয় টেলিভিশনে। শিকাগোর বক্তৃতা তাঁর চোখেও নাকি জল এনেছিল। বলেই অবশ্য শাইনিং ইনভেস্টরদের সম্ভাব্য দুশ্চিন্তার দিকে তাকিয়েই হয়তো তাঁকে একটা ছোট ব্যক্তিগত ট্রিভিয়া জুড়ে দিতে হয়েছে। তিনি নাকি যে কোনও হিন্দি সিনেমা দেখেও কান্নাকাটি করে থাকেন। ইত্যাদি।

    বর্ণ ও ভোট

    আমরা এতদিনে নানা ভোটবিদের চুলচেরা বিশ্লেষণে জেনে গিয়েছি যে কৃষ্ণাঙ্গদের ৯৬ শতাংশ, শ্বেতাঙ্গদের ৪৬ শতাংশ, অল্পবয়সী শ্বেতাঙ্গদের ৫০ শতাংশের উপরে, স্প্যানিশ ভাষাভাষীদের ৬৪ শতাংশ, ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের একটা বড় অংশ মানুষের ভোট নিয়ে নির্বাচনের বৈতরণী পার হয়েছেন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামা। আমরা জানি সেনেটর ম্যাককেন এবং সেনেটর ওবামার মধ্যে শতাংশর হিসেবে পার্থক্য মাত্র ৬ শতাংশ পপুলার ভোটের। আমরা জানি ইন্ডিয়ানা, পেনসিলভানিয়া আর ওহিও ইত্যাদি রাজ্যে অভাবনীয় ফল করেছেন তিনি। আমরা কতগুলি প্রেস ক্লিপিং থেকে এও জেনে গিয়েছি যে এমনকি যাঁরা ওবামাকে ইসলাম ধর্মাবলম্বী বলে মনে করেন, তাঁরাও অনেকে ভোট দিয়েছেন তাঁকে, কারণ তাঁরা আশা করেন যে ইনি এসে অর্থনীতির হাল ধরবেন। এই অপূর্ব ভোট বিশ্লেষণের বাজারে আমরা অবশ্যই জানি না যে শ্রমিক ও কর্মচারীদের, বেকারদের, নিম্নবিত্তদের কত শতাংশ ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ওবামাকে ভোট দিয়েছেন, যদিও আন্দাজ করছি অনেকেই দিয়েছেন নইলে ওহিও, পেনসিলভানিয়াতে এই ফল হয় না। আমরা জানি না তার মধ্যে অন্তত এক-দু'জন এটা জেনেই দিয়েছেন কিনা যে, তাঁর বা তাঁদের জীবনের মৌলিক আর্থসামাজিক কোনও সমস্যার সুরাহা হয়তো এবারেও হচ্ছে না। আমরা এটাও জানি না যে ছোট শহর বড় শহরে ভোটের ভাগ কিরকম এবং আমরা একদমই জানি না বেকারিত্বের শতাংশের সঙ্গে অন্যান্য নির্বাচকদের অন্যান্য পছন্দের কোনও সম্পর্ক আছে কিনা।

    আমরা এইটুকুতেই খুশি যে মেয়েদের জন্য কুকুরছানা খোঁজার কথা বলতে গিয়ে তিনি খুব সহজ রসিকতায় দো আঁশলাদের সঙ্গে নিজের তুলনা করে ফেলেছেন। আমরা খুশি হতে শিখেছি এই ভেবে যে হ্যাঁ, অন্তত এতদিনে বলা যাবে, আমেরিকায় দাঁড়িয়ে বলা যাবে, নিকুচি করেছে বর্ণের। সেটা নানা দেশের কৃষ্ণাঙ্গরা শিখেছেন কিনা বা শিখলেও কি মূল্য শিখেছেন সেটা আমরা ভুলতে শিখেছি। টিভিতে। প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামা অত্যন্ত সচেতনভাবে বর্ণের ঊর্দ্ধে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর রেটোরিককে। এমনই উচ্চতায় নিয়ে গেছেন এই বিশেষ বিষয়টিকে যে হয়তো একদিন বিশেষজ্ঞদের বলতে হবে যে কর্মস্থলে বা সামাজিক দৈনন্দিনে বর্ণবিদ্বেষী ব্যবহারের বিচার পাওয়া কঠিন হয়ে উঠেছে। পজিটিভ ডিসক্রিমিনেশনের প্রয়োজন বা গুরুত্বের কথা হয়তো আর বলাই যাবে না। আমরা কিছুই জানি না কি হতে চলেছে, তবু একটা রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে একটা দেশ থেকে সমস্ত ধরনের বর্ণবিদ্বেষ উবে যাবে এটা একটু কষ্ট কল্পনা বলেই মনে হচ্ছে আপাতত। এই প্রসঙ্গে দুটি মাত্র কথা বলার আছে, প্রথমত -- আফ্রিকান আমেরিকান সংগঠনগুলির মধ্যেও ওবামার নির্বাচন, প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামার বর্ণ সংক্রান্ত রেটোরিক ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক চলছে। ওবামার বক্তৃতায় কোথায় কোথায় কৃষ্ণাঙ্গদের সম্পর্কে প্রচলিত সাধারণীকরণের ছায়া পাওয়া গিয়েছে সেই সব নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে। আমরা বাইরের লোকেরা, বিশেষত, আমি যে কিনা ভারতেরই বসবাসকারী, যে কিনা উচ্চবর্ণ ভারতীয় হিন্দু পুরুষ, তারা তো বর্ণবিদ্বেষের সঙ্গে ঠিক পরিচিত নই, শুধু স্বাধীন ভারতের লিবেরেল শিক্ষার সুযোগকে অবলম্বন করে এইটুকুই বলতে পারি, এই বিতর্ক জীবিত থাকাই মঙ্গল, সব ঐতিহাসিক শিক্ষাই তো আর বিজ্ঞাপনের ভাষা হয়ে উঠতে পারে না। তবে দ্য রুট পত্রিকা থেকে একটি অসাধারণ রসিকতা উদ্ধৃত না করে পারছি না। এঁরা যথাক্রমে শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গ মানুষদের জন্য কয়েকটি উপদেশাবলী প্রকাশ করেছেন গত চৌঠা নভেম্বর। তার মধ্যে একটি-দু'টি খুব মজার এবং কালচারাল রেফারেন্সগুলো না জানলেও বোঝা যাবে।

    কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য উপদেশে, নো উই কান্ট --
    1. Don't go up to every "redneck-y" looking person and gloat. "It hurts don't it? It burrrrnnss!'
    2. Don't corner your white coworkers to give them a tutorial on black culture just because "the president is black and it's 'bout time y'all learn!"

    শ্বেতাঙ্গদের জন্য উপদেশ, নো উই কান্ট --
    1. Don't personally congratulate all your black friends. Black people are not a sports team, and Obama did not win the Super Bowl.
    2. Don't start crossing the street in order to walk next to a black person. President Obama is glad you support racial reconciliation, but he takes a hard line against jay walking.
    3. Don't name drop "Dr. King." If you absolutely must make some comment about how this is a victory for civil rights, pick a marginally less obvious figurehead.

    আমার সূত্র, দ্য রুট ডট কম।

    অর্থনীতি ও সামাজিক সুরক্ষা

    সত্যি কথা বলতে কি হয়তো এই বিষয়টিতে প্রেসিডেন্ট ওবামাকে তাঁর সমর্থকদের কাছ থেকে সবচেয়ে বেশি সমালোচনা শুনতে হবে। এবং ২০০৯-এর বিশে জানুয়ারির পর থেকে যতদিন না পর্যন্ত আর্থিক ব্যবস্থা তথা বৃহত্তর অর্থনীতির দুরবস্থার অন্তত কিছুটা নিরসন না হচ্ছে ততদিন। তারপরেও আমেরিকায় বেকারিত্ব থাকবে, সামাজিক সুরক্ষায় বিশেষত স্বাস্থ্য পরিষেবা মানুষের ধরাছোঁয়ার মধ্যে আদৌ ফিরে আসবে কিনা খুবই সন্দেহ আছে। মোটর কোম্পানিগুলিকে নতুন করে আর্থিক সাহায্য করা হবে কিনা সেই নিয়ে জল্পনা চলছে। এর আগে আর্থিক ব্যবস্থাকে চাঙ্গা করতে ৭০০ বিলিয়ন ডলারের ফান্ড গড়ে তোলার প্রচেষ্টাকে প্রায় বিনা প্রশ্নে, অন্তত সর্বসমক্ষে প্রায় সম্পূর্ণ বিনা প্রশ্নে সম্মতি জানানোয় বামপন্থীদের কাছ থেকে প্রচুর সমালোচনা এসেছে। যদিও ট্র্যাডিশনাল বামপন্থীরা খুব বেশি আমল পান না আমেরিকায় তবুও জনগণের টাকা এইভাবে ব্যবহার করা আদৌ যায় কিনা তাই নিয়ে আলোচনা চলতেই থাকবে। পন্থা নির্বিশেষে লোকজন তাতে চিন্তিত থাকবেন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে একটি তদন্ত চলছে। কিন্তু এই সমালোচনা ততদিন বন্ধ হবে না যতদিন না আর্থিক ও ব্যাঙ্কিং অবস্থার হাল ফেরে। আর্থিক সাহায্যের বিনিময়ে কর্পোরেটগুলির কাছ থেকে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য সামাজিক সুরক্ষা আদায় করার জায়গায় রয়েছেন প্রশাসন, হয়তো ২০ জানুয়ারির পরেও থাকবেন, তবে তার সদ্ব্যবহার আদৌ হবে কি না খুবই সন্দেহ আছে। সর্বোপরি যার থেকে এই সঙ্কটের শুরু, সেই বাড়ির মর্টগেজের জন্য দেওয়া সাব প্রাইম লোন এবং তার বিনিময়ে করা অন্যান্য বিনিয়োগ সেই বিষয়গুলির আইনকানুনে কোনও নতুন বিধিনিষেধের প্রবর্তন হবে কিনা এখনই বলা যাচ্ছে না। কর্পোরেটকে দায়িত্বশীল করে তোলার প্রচেষ্টা এখন বা বিশে জানুয়ারির পরে নেওয়া হবে বলে মনে হয় না।

    অনেক চাকরিকে আমেরিকায় ফেরাবেন কথা দিয়েছেন ওবামা। প্রতি মাসে নতুন করে বেকারিত্ব বাড়ছে আমেরিকায় এবং বিশ্বের অন্য অনেক দেশে। এই অবস্থায়, ফ্রি মার্কেট আদর্শ বজায় রেখে ঠিক কি ম্যাজিক করবেন প্রেসিডেন্ট ওবামা সেটা ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। জনগণের টাকায় "ফ্রি' ধনতন্ত্র চালানো তো একটা উপায়। আর কোনও মৌলিক অর্থনীতির পরিবর্তন প্রেসিডেন্ট ওবামার কাছে আশা করাটা খুব একটা স্থিরমস্তিষ্কের কাজ হবে বলে মনে হয় না। অধিকাংশ আমেরিকার নাগরিকদেরও জীবন ধারণ আগামী চার বছরে খুব সহজ হয়ে উঠবে না। এতদিন পর্যন্ত ট্যাক্স নীতির সম্ভাব্য বড় সড় পরিবর্তনকেই ওবামা তাঁর অর্থনৈতিক বিষয়ে চিন্তার মূল কাঠামো হিসেবে পেশ করে এসেছেন। কিন্তু এখনকার আর্থিক বাজারে মন্দা যতদিন চলবে ততদিন ট্যাক্সের কাঠামোয় খুব কিছু পরিবর্তন আশা করা যায় না। উল্টে সামাজিক সুরক্ষার ফান্ডগুলিতে সাহায্য করার বাজেট কমে যেতে পারে। আউটসোর্সিং বিশেষত তথ্য-প্রযুক্তির বাজারের আউটসোর্সিং কমে আসবে কি না, এই নিয়ে আমাদের ভারতীয় উচ্চবিত্ত পেশাদারদের প্রচুর দুশ্চিন্তা রয়েছে। কিন্তু আমার ধারণা, গলা ঝাঁকিয়ে, অন্য অনেক ধরনের আউটসোর্সিংয়ের মধ্যে এই বিশেষ ধরনের আউটসোর্সিংটির একেবারে কমে আসা একটু কঠিন। ভিসা আইনের পরিবর্তন হতেই পারে, সেই অনুযায়ী ভারতীয় কোম্পানিগুলির লাভে অঙ্ক কমতেই পারে, তবে সরাসরি তথ্য-প্রযুক্তিতে কোম্পানিগুলির খরচ কমানোর উপায় হিসেবে আউটসোর্সিংয়ের ওপর নতুন প্রশাসনের কাছ থেকে নিষেধাজ্ঞা আসবে কিনা সন্দেহ আছে। যদিও ওবামা বরাবরই আমেরিকার "মধ্যবিত্ত'দের অর্থনৈতিক প্রয়োজনের কাছে তাঁর নীতির দায়ের কথা উল্লেখ করেছেন। তাই হয়তো বা তথ্য-প্রযুক্তিতে তুলনামূলকভাবে চাকরির সুযোগ কমবে, আর্থিক মন্দা কেটে যাওয়ার পরেও, কিন্তু সেই একই সময়ে আমেরিকার প্রযুক্তিবিদরা সহজেই একেবারে চাকরি বাজারে জোয়ার দেখবেন বলে মনে হয় না।

    প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামার প্রতীকি গুরুত্ব, সম্ভাব্য বিদেশনীতি ও আন্তর্জাতিক সংঘাতসমূহ

    গুয়ানতানামোর কয়েদখানা যদি সত্যি বন্ধ করার উদ্যোগ নেন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট তাহলে অনেক খুঁতখুঁতে স্বাধীনতাপ্রিয় মানুষই হয়তো খুশি হবেন। কিন্তু আইনি জটিলতায় সেই কাজ কি আদৌ সম্ভব? ইরাক থেকে সৈন্য কমানোর কথা তো বলেইছেন প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট, কিন্তু আফগানিস্তানে যুদ্ধোদ্যোগে নতুন করে বিনিয়োগ করার কথাও বলছেন। কাশ্মীরে রাজনৈতিক সমাধানে সাহায্য করতে চান শুনেই ভারতীয় মিডিয়া সচকিত, তবে আফগানিস্তানে নতুন যুদ্ধোদ্যোগের নীতি আর কাশ্মীর সমাধানে সদিচ্ছার নীতি আদৌ একসঙ্গে চলা সম্ভব কি না আমাদের জানা নেই। রাহম ইমানুয়েলকে হোয়াইট হাউসের চিফ অফ স্টাফের দায়িত্ব দেওয়ার পর থেকে ওবামার সম্ভাব্য মধ্য প্রাচ্য নীতি অনেকেই কটাক্ষ প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এই অঞ্চলে আমেরিকার বিদেশনীতির কোনও আশু পরিবর্তন আদৌ সম্ভব কিনা সেটাই প্রশ্ন। কাজেই তার সঙ্গে আমার মনে হয় না ইমানুয়েলের দায়িত্ব গ্রহণের কোনও সম্পর্ক আছে। ইরান ও রাশিয়ার সঙ্গে আমেরিকা তথা ইউরোপের যদি সম্পর্কের আরও অবনতি হয় তার দায়িত্ব প্রেসিডেন্ট ওবামার উপরে কিছুটা বর্তাবেই। বাকিটার জন্য আছেন এই দেশগুলির নেতৃত্ব। আমরা শান্তিপ্রিয় মানুষ হিসেবেই কিই বা চাইতে পারি। শুধু চাই নতুন কোনও যুদ্ধ বা প্রক্সি ওয়ার যেন শুরু না হয়। আলোচনা, মতবিরোধ, কূটনৈতিক শঠে শাঠ্যং যত খুশি চলুক, যুদ্ধ যেন না হয়। যুদ্ধবিরোধ দিয়ে যাঁর রাজনৈতিক উত্থানের শুরু, সেই ওবামা নতুন যেন অদূর ভবিষ্যতে যুদ্ধোদ্যোগের অংশীদার না হয়ে পড়েন। যদি নেহাতই হয়ে পড়েন আশ্চর্যের কিছু নেই। উনি তো তখন হাজার হাজার মানুষের মিছিলে হাঁটা যুদ্ধবিরোধী রাজনৈতিক নেতা আর থাকবেন না, তখন হয়ে যাবেন, রাষ্ট্রপতি ও সর্বোচ্চ সেনাধিনায়ক। "সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ' এই নামে যে সব কাজকর্ম হয়ে চলেছে, তার একটা সর্বোচ্চ স্তরে পর্যালোচনাও যদি না হয়, তাহলে সত্যি কিছু বলার থাকবে না।

    ভারতীয় মিডিয়া সদ্য সম্পাদিত পারমাণবিক সহযোগিতার চুক্তিটির ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তিত। মনে হয় না, এটাকে সরাসরি বদলাবেন প্রেসিডেন ওবামা। হয়তো বিবেচনা সাপেক্ষে এটা কূটনীতির একটা অস্ত্র হয়ে উঠতে পারে, তাও হবে কিনা সন্দেহ।

    প্রেসিডেন্ট ওবামা শুধুমাত্র কৃষ্ণাঙ্গ হওয়ার কারণেই আন্তর্জাতিক সম্পর্কে মৃত বহুপাক্ষিকতা ফিরিয়ে আনবেন এমনটা আশা করা বোধহয় সত্যিই অন্যায়। তবু আমরা আশা করব, ফোরাম হিসেবে রাষ্ট্রসঙ্ঘের গুরুত্ব সামান্য হলেও বাড়বে। আদৌ আশা অবশ্য করছি না একটা বিষয়ে। ধরেই নিচ্ছি, এমনকী দ্বিতীয়বার নির্বাচনে জিতলেও প্রেসিডেন্ট ওবামা আন্তর্জাতিক আইন বিচারের চুক্তিতে সই করবেন না।

    পরিবেশ ও গবেষণা

    ওবামা বলেছেন তিনি নতুন পরিবেশের দিক থেকে সংবেদনশীল প্রযুক্তি নির্মাণে উৎসাহ দেবেন, তাতে অনেক পরিবেশবাদীই উৎসাহ পেয়েছেন। আমার সমস্ত নস্তর্থক ভাবনা সত্ত্বেও আমারও ধারণা এই বিষয়ে হয়তো প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট ওবামা সত্যিই কিছু করবেন। কিন্তু কিয়োটো প্রোটোকলে আমেরিকা কি কোনওদিনই সই করবে?

    গোঁফ ও এজেন্ডা চুরি

    শোনা যাচ্ছে, ক্যাম্পেন শুরু হওয়ার সময়তেই নাকি গোঁফ কেটে ফেলেছিলেন ওবামা। এখন বামপন্থী সাংবাদিক প্রাবন্ধিক ব্লগাররা অনেকেই ভয় পাচ্ছেন, তাঁদের তৃণমূল স্তরের ভূমিকাকে উপেক্ষা করে, তাঁদের রাজনৈতিক দাবি-দাওয়াকে পেছনে ফেলে রেখে এগিয়ে যাবেন রাষ্ট্রপতি ওবামা। আর্থিক বিষয়ে ওবামাকে পরামর্শ দেওয়ার জন্য যে কমিটি তৈরি হয়েছে তাতে যে সব মানুষ রয়েছেন তাতে মনে হয় এই আশঙ্কা অমূলক হয় তো নয়। তাই সজাগ সচেষ্ট থাকার আহ্বান আসছে বামপন্থী লিখিয়েদের কাছ থেকে। কিন্তু শুধুমাত্র সজাগ থেকে কিছু করা যাবে না। আইন প্রণয়নের যা ব্যবস্থা তাতে ওবামা নিজে উদ্যোগী না হলে, যে কোনও বিষয়ে পলিটিক্যাল কনসেনসাস তৈরি করতে ওয়াশিংটনের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানটির সময় লাগবে না। এই যে এখন জেনারেল পাওয়েল ওবামাকে এত সমর্থন জানাচ্ছেন, ইনি তো রাষ্ট্রসঙ্ঘে টেস্টটিউব দেখিয়ে সেই বক্তৃতাটি দিয়েছিলেন, যাতে গণহত্যায় সক্ষম অস্ত্রের ব্যাপক সম্ভার প্রস্তুত করার অপরাধে ইরাক রাষ্ট্রটিকে আক্রমণের সুপারিশ করা হয়েছিল। অতএব সরাসরি প্রেসিডেন্ট ওবামার উপরেই নির্ভর করছে তিনি কোনও বিষয়ে কি বিচার করে কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন, কোন নতুন আইনটি বানাবেন আর কোন সঙ্কটের মোকাবিলায় তাঁর মৌলিক দৃষ্টিভঙ্গি কি হবে। যদি মৌলিকতা আদৌ না থাকে তাহলে আর কি বলব, দু:খের দুপুরে, রেটোরিকে মিথ্যার অসামান্য শক্তি সম্পর্কে আকাদেমিক তথা দার্শনিকদের লেখা প্রবন্ধ পড়া ছাড়া আর কোনও গতি থাকবে না।

    জাদা কা ইরাদা

    অসম্ভব কঠিন সময়ে প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন ওবামা। একদিকে নিজের দেশের সাধারণ মানুষের প্রচুর আশা-ভরসার চাপ আর ধসে বিধ্বস্ত আর্থিক ব্যবস্থা আর ব্যাপকতর মন্দা। অন্যদিকে ইউরোপের অতি দক্ষিণপন্থার রমরমা (সিলভিও বার্লুকুনি তথা পোলিশ বিদেশমন্ত্রীর সিক্রোস্কির সম্ভাব্য মন্তব্য স্মরণ করুন।) আর সারা বিশ্বে নানা জায়গায় স্থানীয় সংঘাত, যার মধ্যে অনেকগুলোতেই আমেরিকার পূর্বাপর প্রশাসনগুলির ভূমিকা আদৌ প্রশ্নের ঊর্দ্ধে নয়। তবু এরই মধ্যে এই আমি, জগৎ পারাবারের তীরে যথাক্রমে ই এম আই, ভুঁড়ি, বগল ও চাকরি সর্বস্ব ছাপোষা কলকেতে সাম্প্রতিক উচ্চবিত্ত, স্রেফ ন্যায়পন্থী যৌবনের স্মৃতিতে ভারাক্রান্ত হয়ে কয়েকটি একটু হাল্কা করে জাদা কা ইরাদা প্রকাশ করে রাখি। আর যুদ্ধ চাই না। কোথাও নয়, কখনও নয়। কর্পোরেটদের জন্য চাই বাড়তি নিয়ন্ত্রণ আর দায়বদ্ধতা। সামাজিক সুরক্ষায় চাই সরকারি সদিচ্ছা এবং ব্যাপক অর্থ সাহায্য। বর্ণবিদ্বেষের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যেন কোনও আপস না হয়। মানুষের দায়িত্বজ্ঞানহীনতায় পৃথিবী যেন বাসের অযোগ্য না হয়ে যায়, অন্তত একটা মহাশক্তিধর রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব যেন এই বিষয়ে কিছু সদর্থক পদক্ষেপ নেন।

    জানি নিরাশ হব। কারণ উপায়ান্তর কম। তবু কোথাও একটা মনের মধ্যে গোপনতম কোণে এখনও হয়তো একটা মানবিক আশা টিকে গিয়েছে। টেলি ও ইন্টারনেট মিডিয়ার এই এক জোর। সব কিছুতেই মিথ্যা অংশগ্রহণের মরীচিকা তৈরি করে। অসংখ্য ভিডিও কোলাজের মধ্যে থেকে। হয়তো প্রেসিডেন্ট ওবামা পুরোপুরি নিরাশ করবেন না। অন্তত কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমেরিকা তথা পৃথিবীর নামগোত্রহীন সাধারণ মানুষের কথা ভেবে কিছু কাজ হয়তো করবেন। আশার উৎস, স্বীকার করেইনি, টিভির পর্দায় জেসি জ্যাকসনের চোখের জল। যে লোকটা সারাটা জীবন চল্লিশ-পঞ্চাশ বছর ধরে কড়া লড়াই লড়ে গেলেন এবং এখনও যাচ্ছেন, তিনি কি এমনি এমনি কাঁদবেন? ঠকার সম্ভাবনা থাকলে তিনি কি আবার চোয়াল শক্ত করতেন না? সেইদিন সেই মুহূর্তে? তাঁর চোখের জলের মতো এনডোর্সমেন্ট আর কোথায় কীভাবে পাবেন ওবামা! পারবেন জেসিকে উপেক্ষা করতে? ক্যান ইউ স্যর, মিস্টার প্রেসিডেন্ট ইলেক্ট?

    আ: ক: বা:।
  • Archive | 43.25.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ১৯:৫৮741457
  • ৬৩২ টা কবিতা আছে এখানে। যাঁরা কবিতা ভালোবাসেন হাতে সময় আছে, আস্তে আস্তে ইউনিকোডে কনভার্ট করে তুলে রাখতে পারেন। তবে সূচিপত্র রাখবেন সাথে সাথেই। সবচেয়ে ভালো হয় ব্লগ করে তার বিভিন্ন পাতায় কবিতাগুলো রাখলে। আর এই ৬৩২ টা কবিতার পাতার ওয়েবপেজগুলো তারিখ অনুযায়ী yyyy-mm-dd নাম দিয়ে একটা ফোল্ডারে আগে সেভ করে নিলে, পরে কালানুক্রমে পোস্ট করতে পারবেন। তারিখটা ইউ.আর.এল.-এই রয়েছে। কবিতার শিরোনামের ইনডেক্স যে ব্লগপাতায় বানাবেন, সেই পাতাটায় কমেন্ট অফ করে এডিট চালিয়ে যেতে পারেন শেষ কবিতা পোস্ট করা অবধি।
     
    অনুরূপে,
    ২৩২ টা গল্প আছে এখানে
    একইভাবে একটা সূচিপত্র বানিয়ে ইউনিকোডে কনভার্ট করে পোস্ট করে যেতে পারেন।
     
    ৬৬ টি প্রবাসীর পত্র
     
    ৩২০ টা কলাম - নবনীতা দেবসেনের "নবনীতার নোটবই", শমীকের "বালি-ডাইনির দেশে" ইত্যাদি প্রভৃতি
     
    ১১ টা নাটকের রিভিউ
    ২০ টা উবাচ
     
     
    ইত্যাদি, বাংলালাইভের আর্কাইভ পাতায় আরও নানা বিষয় রয়েছে। সুবিধেমতো কপি করে জমিয়ে রাখুন বা ইউনিকোডে কনভার্ট করে পোস্ট করুন। আরেকটা প্রশ্ন, প্রথম দিকের বাংলালাইভ বিশেষ সংখ্যা যেগুলো কিছূ টাকা দিয়ে কিনতে হত, অনলাইনে ছিল না, সেগুলো কেউ কিনেছিলেন / পেয়েছিলেন? সেগুলোর সূচি দেখা যাচ্ছে কিন্তু লেখাগুলো পড়ার উপায় নাই।
  • যোষিতা | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২০:৫৯741458
  • অসাধারণ কাজ।
  • মজলিশ Archive -- সঙ্গীতা : পুজো পুজো | 43.25.***.*** | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২২:২৯741459
  • মজলিশ 
     
    যেমন বলেছিলাম, মজলিশের আর্কাইভ খুঁজতে সম্ভবত দুটো ইউআরএল খুঁজতে হবে। বিভিন্না তারিখের ক্যাপচার-এ। এখন দেখছি * ওয়াইল্ড ক্যারেকটার হিসেবে সার্চে নিচ্ছে আর্কাইভের ওয়েব্যাক মেশিন। সুতরাই, এই হল দুটো লিংক, মজলিশের জন্য।
    এবং
    মোট ৭৬২ টা ক্যাপচার। রিপিট বা লগিন পাতা যদি কিছু থাকেও, তা বাদ দিলে অন্তত ৭৫০ টা পাতা অর্থাৎ সাড়ে সাত হাজার মন্তব্য ফিরে পাওয়া যাবে। যে যার মত করে চেষ্টা করুন, বা লসাগু বা আর কেউ পাইথন ব্যবহার করে স্ক্রিপ্ট লিখে যদি সব পাতা একলপ্তে নামিয়ে, (ট্রান্সলিটারেট করে বা না-করে) কোনো ক্লাউডে রাখেন, তাহলে তো মিটেই যায়।
     
    চোখে পড়া তিনটে আর্কাইভ-মজলিশের পাতা থেকে নিয়ে জোড়া দেওয়া একটা লেখা রইল -
     
    ======================================================
     

    পূজো পুজো  [সেপ্টেম্বর ২৯, ২০০৬]     

    সাদা শাড়ি পড়ে হাঁটছিল তিতির।  একা, সজাগ অথচ  উদাসী।  সজাগ, কারন সেটাই থাকা উচিত। উদাসী, কারন সেটাই নিয়তি।   ফুটপাথ জুড়ে রঙিন কাপড়ের ডাঁই  প্যান্ডেলের জন্য উৎসর্গীকৃত। পা  বাঁচিয়ে চলতে হয়। পাছে রং লেগে যায় পায়ে, পা বেয়ে উঠে আসে শরীর, মনে।

    চারদিকে পুজোর রোশনাই। তিতির চোখ মেলে শুষে নেয় সেই আলো। ছোট্টো একটা মেয়ে  দৌড়ে আসে ধূপের প্যাকেট হাতে নিয়ে "দিদি ধূপ নেবে"?
    দশটাকা, বারোটাকা প্যাকেট।  আগের অভিজ্ঞতায়  তিতির জানে, কোনো গন্ধ নেই  তেমন ধূপগুলোয়, কেবল ধোঁয়া হয়  খুব। মশা তাড়ানোর কাজে লাগে কিনা কে জানে!  তবে  মেয়েটার হাতে যেটা জ্বলছে সেটার গন্ধ খুব সুন্দর। মিঠে, মনকাড়া। মেয়েটার ময়লা নখের আগায় হলুদ দাগ।
    নাও না দিদি, এই দ্যকো এটা  চন্দনের গন্ধ, এটা গোলাপের....
    তিতির দেখে ফ্রকটা, চিরুনি হীন লাল চুল, রোগা হাত আর কালো শরীর বেয়ে নেমে আসা ততোধিক কালো খালি  ফাটা পা। সারাদিনে ক"বার রাস্তা পারাপার করে মেয়েটা?
    ভাল গন্ধ হবে? তিতিরের  সাদা শাড়ীতে সাদা বিশ্বাসের ফুল তোলা। মেয়েটা হাসিমুখে তাকায়।
    খুব হবে গো , দ্যাকো না বাড়ি যেয়ে জ্বালিয়ে। ঠাকুরের সামনে জ্বালিয়ে দেকো
    তিতির টাকা বার করে -  দুটো প্যাকেট দাও
    কোনটা কোনটা দেবো?
    তোমার পছন্দ মত দুটো দাও।
    মেয়েটা অবাক হয়ে তাকায়, যেন জীবনে প্রথম শুনল ওরও পছন্দ থাকতে পারে।
    বড় ভীড় রাস্তায়। তিতির অন্যমনস্ক জরীপ করে। কত খুশি খুশি লোকজন, মনটা ভাল হয়ে যায়। ষষ্টির সকাল।  কলকাতার ফুটপাথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে পৌঁছে যায় ছোট্টোবেলার মামাবাড়ির ওখানে।  মাত্র দুটো পূজো হত  গোটা গ্রামে। ভোররাত থাকতে উঠে পড়ত তিন বোন। হাতে ফুলের সাজি আর একটা ব্লেড নিয়ে দৌড়ে শিউলিতলায়। সাজি ফুলের জন্য, আর ব্লেড শুঁয়োপোকার দাওয়াই। শিউলির ডাল ধরে নাড়া দিলে অনেক সময় শুঁয়োপোকা পড়তে গায়ে এসে। ব্লেড দিয়ে চেঁছে শুঁয়ো তুলতে ওস্তাদ ছিল তিনজনেই।   উঠোনের দুপাশে  দুটো বড় বড় স্থলপদ্ম গাছ নিয়ে পড়ত খুশিতে। এত ফুল তাদের ডালে সারাবছর আসে না তো! ইচ্ছা করত না ফুলগুলোকে  তুলতে। বেলা বাড়ার সাথে সাথে সাদা ফুলে গোলাপী রং ধরত। ঠিক যেন   কিশোরী বেলার  থেকে  তরুনীবেলায় পা। গোলাপী আভা মেখে  কার পথ পানে চেয়ে থাকা। দুপুর বেলায় ঢাকীদের বিশ্রামের সময় চন্ডীমন্ডপের  ধারে গিয়ে ওদের ঢাকের পালক গালে চট করে বুলিয়ে নেওয়া।  কি থাকে ঐ বাজনায়?  পা দুটো যেন অজান্তেই  নেচে উঠতে চায়। তিনবোনে  আলোচনা চলত, বড় হয়ে ঢাকী হবে। কেমন সুন্দর এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় কেবল বাজনা বাজিয়ে বেড়াও। ছুটকির মনে হত কাঁসি বাজানোটা বেশি আমোদ। মাথা বেশি নাড়ানো  যায়।
    গ্রামের শেষে বড়ডাঙার মাঠ। গাজনের মেলা বসত ওখানে। আর ভাদ্র মাসে ভাদুর উৎসব। মাঠ পেরিয়ে লাইব্রেরী। খুব ফাঁকা ছিল ওদিকটা। একটু বড় হওয়ার পর তিতির একা একা পূজোর দিনগুলোতে লাইব্রেরীর বারান্দায় চলে যেত। ধারে কাছে বাড়ি নেই কোনো। । মাঠের ডান দিকে কোন বরাবর বড় ঝিল। দিদু বলতেন পদ্মঝিল। কি ভীষন পদ্ম ফুটত! আর সারা দুপুর হাঁসেদের  জলে নামা আর ওঠা। নতুন জামা পড়া তিতির লাইব্রেরীর বারান্দায় বসে থাকত হাতে একটা গল্পের বই নিয়ে। দুপুরের গন্ধ, নতুন জামার গন্ধ, নতুন বইয়ের গন্ধ মাখা তিতির দু চোখে পূজো মাখত নিজের মত করে।
    ক্লাস টেন । স্কুলের শেষ বছর। বাবা বললেন পূজো শেষে টেস্ট, এবছর আর ওখানে যেতে হবে না। পড়াশুনার ক্ষতি হবে । মন মানে নি একদম। কেঁদে কেটে দাদু দিদাকে দিয়ে বলিয়ে রাজী করেছিল বাবাকে। ডাইনে পদ্মঝিল, বাঁয়ে লাইব্রেরী আর সামনে যেদিকে দু চোখ যায় ঘন কাশের বন হাওয়ায় মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে ডাক দেয় তিতিরকে।
    তিতির পায়ে পায়ে  এগোতে থাকে।

    দিদি, কি নেবেন?
    এক পথ শিউলি মাড়িয়ে বাস্তবে ফিরে আসে তিতির।  
    ওমা ! কাশবন কখন দোকান হয়ে গেছে!
    তিতির কাউন্টারের সামনে দাঁড়ায়। টুকি টাকি কেনার আছে কিছু।
    সেল ফোনে চেনা শব্দ। তিতিরের মনে জল ছলকে ওঠে, কিন্তু ফোনের দিকে তাকিয়ে মনের জল চোখে আসে। না: সে নয়, সে নয়। কত কাজের মানুষ অকাজে ফোন করে , মেসেজ পাঠায়, কিন্তু তার শব্দ আর শোনে না, শোনেনি কতকাল। কি অসীম আগ্রহে প্রথম প্রথম  ফোন হাতে নিয়ে জাগত, ফোন হাতে ঘুমোতো। যদি আসে তার ডাক,  একবার যদি  ফুটে ওঠে সেই নাম!
    এক সুগন্ধী সম্পর্ক বুকে নিয়ে বাঁচতে বাঁচতে মরতে থাকে তিতির।
    ডাক আসে না তার, কিন্তু ডাক দেয় নিত্যপ্রয়োজন। হাতের টাকা গুনে দিতে গিয়ে খেয়াল হয়, মেয়েটা দুটো একই রকমের ধূপের প্যাকেট দিয়েছে। হয়ত এই একটাই ওর পছন্দের। মেয়েটাকে কিছু দিলে হত হয়ত। ফেরার  রাস্তায় খুঁজবে , যদি দেখতে পায়।

    আবার  অনেক রং , অনেক আলোর বাল্বের  সারি সারি নিÖপ্রভ  চোখের চাউনির মধ্যে দিয়ে তিতির হাঁটে। আবার বাড়ি ফেরা । বাইরের  রোশনাই, আলো, হাসি সবাইকে পাপোষে ঘষে মুছে বাড়ি ঢোকা।
    ছোটোবেলার দেখা স্থলপদ্মগুলোকে  গোলাপী হতে দেখে মনে প্রশ্ন জাগত। কোন খুশিতে ওরা বেলা বাড়লে অমন রঙিন হাসি হাসে! এখন মনে হয় ঐ সাদা ফুলগুলো ই  আসলে সুখী। এখন বোঝে, আনন্দের শুভ্রতায় বিষাদের রক্তক্ষরণ মিশে ফুল হয় গোলাপী।
    তিতির আয়নায় দাঁড়িয়ে দেখে নিজেকে গোলাপী হতে, তিতির ঠোঁটে দাঁত  বিঁধিয়ে ইচ্ছা শক্তি প্রয়োগ করে দুধ সাদা হতে চায়।
    বিকেলে  বাড়িতে বন্ধুরা  আসবে । তিতির নিজেকে গোছায়। সবার রঙে রঙ মেলাতে হবে। আপ্যায়নের হাসির জারকে লিপস্টিক চুবিয়ে ঠোঁটে মেখে নিতে হবে সযত্নে। খুশি থাকতেই হয়, উৎসবের দাবী। দাবী মেটায় তিতির, যেমন মিটিয়েছিল আগেও। যেমন দাবী মিটিয়েছিল  শুধু তার জন্য গান গাওয়ার , তাকে ভালবাসার, তার জন্য দিনের পরে রাত আর রাতের পরে দিনের অলো মাখার।

    দূরে কোথায় ঢাক বাজে। তিতির আলমারীর পাল্লায় হাত রাখে। কি রঙ  জড়াতে হবে আজ? যখন সে ছিল, তার আবদার, অধিকার, দাবী, সব ছিল উজ্জ্বল লাল, হলুদ, কমলা, সোনালী হয়ে । সব রঙের ওপরে ছিল ভালবাসার  নীল পালকের হালকা ছোঁয়া। কিন্তু এখন কি আছে? কোন রঙ ?
    সে নেই। কোন  অজানা কারনে সে এসেছিল এ প্রশ্নের উত্তর পাওয়ার আগেই সে সরে গেছে পাশ থেকে, তিতিরকে মুঠিতে ধরে উড়িয়ে দিয়েছে সব রঙটুকু কেড়ে নিয়ে।  কখনও খোঁজ নেয় নি আর। চেনা পরিবেশে মুখো মুখি হলে অবহেলায় পরিচিত থেকেছে দিনের পর দিন। ভারি ভাল ছবি আঁকত মানুষটা। কি সুন্দর জলছবি স্বপ্ন। বিশ্বাসের তরল ঢেলে মিঠে রঙ গুলে তাতে আঙুল ডুবিয়ে এক টানে ছবি আঁকত সে। নেহাতই কেজো ছবি। তবু বড় সত্যি, বড় সুখ মনে হত বোকা পাখীর। কথা আর স্বপ্নের খড়কুটো মুখে নিয়ে ডানা মেলেছিল তিতির, কিন্তু বেশিদূর উড়তে পারার আগেই ছবি ছিঁড়ে শতখান।

    জল বুকের গভীরে জমতে থাকে, জমতেই থাকে। তিতির সব আবরণ খুলতে থাকে একে একে। ধূপের প্যাকেট দুটো খোলে। মেয়েটার বুদ্ধি আছে। মন খারাপের কি আর দুরকম গন্ধ হয়? সব ধূপগুলো জ্বেলে দেয় ঘরে। ধোঁয়া মাখা নরমগন্ধী  মনখারাপ গায়ে মেখে নয় নগ্ন কাঙাল তিতির। টেনে নেয় পছন্দের শাড়িটা । সাদা বিশ্বাসের ওপর অপমান আর অবহেলার   ঘন কালো লতাপাতার নক্সা  পরতে পরতে গায়ে জড়াতে থাকে, তারপরে বুকের  নোনা পদ্মদীঘিতে ডুব দেয়।  কোথাও এতটুকু ঢেউ ওঠে না। কাশের  দল হাতছানি দেওয়া ভুলে অবাক চোখে তাকায়।   দীঘির নিস্তরঙ্গ জলে ছড়িয়ে  যায় অগুন্তি  নীল  পালক ।
    লাল লাইব্রেরীর বারান্দায়  দাঁড়িয়ে  ভেসে থাকা চুলের গোছা দেখতে থাকে তিতিরের ভালবাসা, তিতিরের সব রঙ, তিতিরের সোমদেব।

    ঢাকটা বাজতে থাকে , বাজতেই থাকে ...

    --------------------------------------
    সুখ দুখ মেশানো  এই পূজোয়  সকলকে ভালবাসা আর শুভেচ্ছা  জানিয়ে

    সঙ্গীতা

    --------------------------------------------

    পূজো পূজো - ২ [অক্টোবর ১, ২০০৬]

    খুব সুন্দর সাজবে এখন  তিতির। আজ , যখন নীল পালকের মধ্যে চুল ভাসিয়েছিল বুকের পদ্মদীঘিতে, তখন পেয়েছে তার সাড়া। উদাসী  সেই মনুষটি  তিতিরের দিকে একবার চোখ ফিরিয়েছে মাত্র, একবার শুধু জানিয়েছে "আমি আছি"।  তাতেই  মন ময়ূরী পেখম মেলেছে আজ। গালে কৃষ্ণচূড়ার রঙ  লেগেছে।
    গাঢ় নীলের অহঙ্কার গায়ে জড়ায়  তিতির। কুসুমে রতনে নিজেকে সাজাতে ইচ্ছা করে খুব। ভিজে চুলের জলের কুচিতে মেখে নিতে ইচ্ছা করে  ধুনোর গন্ধ ।  অষ্টমীর অঞ্জলীর ঘোষণা ভেসে আসে মাইকে।

    খুব ভোরে ওঠে  সুবল।  ছেলেকে ডেকে দেয়  ঠেলা মেরে মেরে। আকাশে তাকায় একবার।  আজও বৃষ্টি হবে। মনটা তেতো হয়ে যায়। স্যাঁতস্যাঁতে ঢাকে আওয়াজ তেমন ওঠে কৈ?  কিন্তু আওয়াজ তুলতেই হবে। এই কাঠি দুটো বড় প্রিয়।  পূজোর গন্ধ মাখানো ঢাকের কাঠি।
    ছেলেটা সবে বারোয় পা দিয়েছে। পড়াশুনোয় মন আছে কিন্তু সুযোগ নেই তেমন। মাঝে মাঝে কাগজে পড়ে বাবাকে এসে বলে কোথায় কোন গরীবের ছেলে মেয়ে ঠোঙা বানিয়ে, চা বিক্রি করেও পড়ার খরচ তুলছে। সুবল বোঝে না ঠিক। ছেলেটাকে এখনই কোনো দোকানে লাগিয়ে দিতে পারলেই তো ভালো হত। সম্বচ্ছর  ট্রেনে ফিরি করে  পেট ভরে। বৌ এক বাড়িতে বাচ্চা সামলানোর কাজ করে, তাই একটা বাঁধা পয়সা আসে সংসারে। মা  বুড়ি যদ্দিন  বেঁচে ছিল  এবাড়ি ওবাড়ি রান্নার কাজ ধরে  দুটো পয়সা আনত ঘরে। সেও গেছে বছর পাঁচেক।  বৌ তখন পোয়াতি। সুবলের মাথায় বাজ পড়েছিল। সেবছর ঢাকের চামড়া ভিজে গিয়েছিল  ঘরের চাল ফুটো হয়ে জল পড়ে। ছেলেটা তখন বছর সাতেকের। সুবল অন্ধকার দাওয়ায় বসেছিল  চুপ করে। ঘরে আলো জ্বলে নি।  ঘোর কালো রাত, পাশের  ঘরের পারুল আর ওর বর ওদের ভ্যান রিক্সায় করে ফুলিকে  হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিল বিকেলে। ছেলেকে নিয়ে সুবল ঘরে ছিল একা। ভোর রাতে দাওয়ায় একটা টিয়া এসে বসেছিল। সুবলকে দেখেও একটুও ভয় পায় নি, উড়েও যায় নি। বেলা দশটার সময় ফুলি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। সুবলের দিকে তাকিয়ে হেসে বলেছিল "মেয়ে হল এবার"। মা এসেছে, সুবল মনে মনে বলেছিল। ভোর রাতে তাই বোধহয় দাওয়ায় বসে জানান দিয়ে গেল।
    এখন টিয়া পাঁচ বছরের। মেয়েটার কথা ভেবে বুকটা টনটনায় সুবলের। ছেলের থেকে মেয়ে বেশি প্রিয়। সারাদিনের শেষে  বাড়ি ফিরে দাওয়ায় বসলেই মেয়েটা গলা ধরে ঝুলে পড়ে এসে, পকেটে হাত ঢোকায়।  কোনো কোনো দিন সুবল ইচ্ছা করে একটা দুটো লেবু লজেন্স কি বাদামের প্যাকেট রেখে দেয়। মেয়ের সেদিন কি আনন্দ। রোগা কালো মুখে কি যে আলো, সুবল প্রাণ ভরে মেয়ের সাথে আহ্লাদ করে।
    পূজোর কদিন আগে থেকেই ঢাকের বায়না পাওয়ার জন্যে ইস্টিশনে  এসে দাঁড়ায় বাপ ব্যাটায়। বড্ড কম্পিটিশন । হাতের শিরা বের করে বাবা ছেলেতে মিলে ঢাক পেটাতে থাকে। নীচু , ঝুঁকে পড়া অবয়ব কঞ্চির মত বেঁকে চুরে বোল তোলে । সুবল ঢাকীর নাম আছে বাজারে।  অফিস মুখো বাবুরা, দিদিরাও হাতে সময় থাকলে একদন্ড দাঁড়িয়ে  শুনে যায়। গামছাটা কোমরে টাইট করে পেঁচিয়ে সুবল ঢাকী ঢাকের কাঠিটাকে হাতিয়ার বানিয়ে নেয়।
    এই প্যান্ডেলটা সুবলের চেনা। ফ্ল্যাট বাড়ির  পূজো। গত বছর এখানের এক বাবু শিয়ালদা স্টেশনে ওর বাজনা শুনে ডেকে এনেছিলেন।

    সুবল ছেলেকে নিয়ে বেরোচ্ছিল, টিয়ার মা অনেকটা চিঁড়ে আর বাতাসা বেঁধে দিয়েছেল। বরাত না পাওয়া পর্য্যন্ত ইস্টিশনেই থাকতে হয়। ঐ কদিন এক বেলা পাউঁরুটি আলুরদম আর একবেলা চিঁড়ে বাতাসা জলে ভিজিয়ে খেয়ে নিলে পেটটা শান্ত থাকে দুজনেরই। বেরোনোর মুখে টিয়া দৌড়ে এসে সুবলের হাতে একটা লম্বা পালক ধরিয়ে দিল, হলদেটে পালক, ধারে সাদার ছিট ছিট।  পেছনের ছাতিম গাছে হরেক কিসিমের পাখী  এসে বসে। গাছতলা থেকেই কুড়িয়ে এনেছে মেয়েটা। সুবল বেরোনোর আগে মেয়েকে কোলে নেয়, আদর করে একটু তারপরে পালকটা ওর ঢাকের গায়ে গুঁজে নিয়ে যাত্রা করে।
    ওর বিশ্বাস ঐ পালক খুব শুভ। ওটা ঢাকে লাগানোর পরে যেন সুবলের হাত আরো খুলে গেছে। পালকটা যেন দুলে দুলে বলে "বাবা, আরো জোরে, আরো মিঠে হাতে বাজাও।"
    মেয়েটা কি বোঝে, এই বাজনাই ওর উঠোনে পূজোর গন্ধ আনবে?
    বাবুরা বলে "সুবলের হাত ঢাকের সাথে কথা বলে"
    অষ্টমীর সকাল হয়ে গেল, সব মেয়ে বউরা চান সেরে নতুন কাপড়ে মন্ডপে আসছে। ফুলির পরনে আজও একটা পুরোনো শাড়িই থাকবে জানে সুবল। কাজের বাড়ির বাবুরা ওকে শাড়ি দিতে চেয়েছিল, ও নিজেই টাকা চেয়ে নিয়েছে।  নিজের অল্প জমানো টাকা আর কাজের বাড়ির  বোনাস মিলিয়ে ছেলে মেয়ের জন্য দুটো জামা আর সুবলের একটা  গেঞ্জী আর পাজামা কিনেছে ফুলি।  গত বছর কোন এক প্রাইজওয়ালারা ওদের  সকলকে একটা করে সাদা টিশার্ট আর একটা টুপি দিয়েছিল। সেগুলোকে কেচে কুচে  পরিস্কার করে পড়েছে এবছরেও।
    এই যে সব বাবুরা কেমন ছাপ তোলা পাঞ্জাবী পড়ে চাদর গলায়  ঝুলিয়ে এসে হাত বাড়িয়ে ফুল নিচ্ছে, গঙ্গাজল নিচ্ছে, ওদের দেখে সুবলের কেমন অদ্ভুত লাগে। মনে হয় সব রাজপুত্তুর এক একজন। আর ওদের বৌ রা, কেমন নরম নরম হাত পা, কেমন চিকন গায়ের চামড়া। কি সাবান মাখে এরা?
    সুবল  ঠাকুরের  দিকে তাকায় "মাগো, একটু বেশি বকশিশ পেলে ফুলির জন্য একখান সাবান আর এক শিশি ক্রীম কিনে নিয়ে যাব"। সাতসকালে  সুবলের চোখে ঘোর লেগে যায়। প্যান্ডেল ম ম করে ধুপ, ধূনো, ফুল বেলপাতা আর সাজগোজ করা  পরীদের গায়ের গন্ধে। রাতের বেলায় ফুলি  ঠেলে সরিয়ে দেয় অনেক সময়,  বলে "বিড়ির গন্ধে টেকা যায়নে বাপু"  
    সুবলের ইচ্ছা করে ফুলিকেও অমন সাবানে চান করিয়ে ক্রীম মাখিয়ে পাশে নিয়ে শোয় মুখে এলাচ নিয়ে। ব্যান্ডেল স্টেশনের এলাচ দেওয়া পান খেয়েছিল একবার। ফুলির সেদিনের সোহাগ এখোনো মনে আছে  সুবলের।
    আরতির  প্রদীপ জ্বালেন ঠাকুরমশাই। চওড়া পেড়ে শাড়ি পরা তিন চারজন গিন্নী গুছিয়ে দেন হাতে হাতে সব উপকরণ। কুমারী পূজা শুরু হবে এবার। দুটো ছোট্টো মেয়ে বাবার কোলে  চড়ে আসে। লাল বেনারসী, লাল চেলি, কপালে লাল টিপ, চন্দন , মাথায় মুকুট। টিয়ার বয়সী-ই হবে বাচ্ছা দুটো। একজন মনে হয় একটু ভয়  পেয়েছে, শক্ত করে বাবার গলা জড়িয়ে আছে। সুবল নিজের গলায় হাত বোলায়, টিয়াটাও ঠিক অমনি করেই ......
    মেয়েদুটোকে বসিয়ে দেওয়া হয় ঠাকুরমশাইয়ের সামনে, গলায় ফুলের মালায় চন্দন মাখা বেলপাতা ছোঁয়ান বড় ঠাকুর। বাঁ হাতে ঘন্টা বেজে ওঠে  । সুবল পিঠ ঝাঁকিয়ে তুলে নেয় হলদে পালক গোঁজা ঢাক। প্রাণপণে কাঠিতে বোল তোলে। ভুলুটা ছোটো, ঢাক মাটিতে রেখে বাজায় মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে। ধুনুচিতে ছোবড়ার গায়ে ধুনো গলতে থাকে, শুকনো ছোবড়ার আগুনে ফ্যানের হাওয়া লেগে ফুলকি ওড়ে।  কুমারী দের মায়েরা ব্যস্ত হাতে  মেয়ের চেলি সরিয়ে দেয় ধুনুচির কাছ থেকে। ঠাসাঠাসি প্যান্ডেলে পূজোর গন্ধ পাক খায়, সুবল ঢাকীর চোখের সামনে  কুমারী শিশুদুটি টিয়া হয়ে খিলখিলিয়ে হাসে।
    সুবল নাচের ছন্দে ঢাক পেটায়। বকশিশ পেতেই হবে ভাল। অনেক গুলো টাকা দরকার।
    বড় ঠাকুর মন্ত্র  পড়ছেন।  ছোটো ঠাকুরমশাই যোগাড়ে ব্যস্ত। কত বছর ধরে শুনছে এই মন্ত্র সুবল, মুখস্ত হয়ে গেছে একরকম। মানে জানে না এই সব কথার, তাই নিজের মত মানে করে নিজের মনে  সুর করে বিড়বিড় করে সুবল - মাগো, আমার টিয়া আর ভুলুকে দেখো মা। মা গো , ওরা যেন ভাল থাকে মা ..

    "বড্ড ভাল বাজাও তুমি "  
    নীল শাড়ি পড়া এক দিদিমণি সামনে এসে দাঁড়ায়
    এদের সকলেরই মুখ এত চিকন কেমন করে হয়? সুবল মাথা নামিয়ে কোমরের গামছা খুলে ঘাম মুছে নেয় মুখের।
    নীল শাড়ি নড়ে না সামনে থেকে । কি অস্বোয়াস্তি । সুবল ঠাকুরের   দিকে তাকায়। কুমারী মেয়েদুটো ঘেমে নেয়ে একশা। চোখের কাজল ধ্যাবড়ানো, মাথার চুলে ফুলের  কুচি এদিক ওদিক । ছোট্টো ছোট্টো আলতা পড়া পা দুটোর দিকে চেয়ে থাকে সুবল। টিয়াকে আলতা পড়লে কেমন দ্যাখাবে কে জানে? মায়ের পায়ের কাছে পূজোর আলতা ডাঁই  করা। ঠাকুরমশাইয়ের কাছে চাইলে হয় এক শিশি, কিন্তু লজ্জা করে সুবলের। তার চেয়ে এক শিশি আলতাও না হয় কিনবে ফুলির জন্যেই।
    "আর একটু বাজাবেন? আমার জন্য?"
    সুবল ঘাড় ঘোরায়। ভুলুটা এক দৃষ্টিতে  দেখছে কয়েকটা ছেলের ক্যাপ ফাটানোর খেলা। নীল শাড়ি আবার কথা বলে। কথা? না জল গড়িয়ে দেয়? কি মায়া গলার আওয়াজে। বাবুদের মেয়েরা  কি এরকম  মায়া মাখা কথা বলে?
    বলে না, জানে সুবল। অহোরাত্রই তো দেখছে। কিন্তু নীল দিদিমণি অন্যরকম।
    আপনার জন্য বাজাব ?
    হ্যাঁ। আমার জন্য,  বাজাবে আর একবার? আমি শুনব?
    সুবল অবাক চোখে তাকিয়েই থাকে  
    বাজাও না ভাই, আমি ছোট্টোবেলায় খুব ভালবাসতাম ঢাকের বাজনা শুনতে।  আমাদের গ্রামের বাড়িতে ....
    চুপ করে যায় নীল শাড়ি। সুবল  বোঝে না কি হত গ্রামের বাড়িতে, কেবল বোঝে দিদিমণি  ছেলেবেলা খুঁজছে। হাতে কাঠি তুলে নেয় সুবল ঢাকী। নিজের খুশিতে বাজাতে থাকে, বাজাতেই থাকে। নীল শাড়ী দিদি সামনে দাঁড়িয়ে থাকে চোখে মায়ার আলো জ্বেলে। লোক জড়ো হতে থাকে এক এক করে । চোখ বন্ধ করে সুবল বাজিয়ে চলে, নাচের ছন্দে দোলে হলুদ পালক।

    "অ্যাই তিতির, এখানে কি করছিস?  চল , বেরোবি না? অঞ্জলী দিয়েছিস? " বন্ধুরা পাশে এসে দাঁড়ায়। সুবলের নীল শাড়ি দিদিমণি তখন চোখ বন্ধ করে ভাসছে। শাড়ী ছেড়ে ফ্রকের ঘেরাটোপ,  শিউলির বোঁটায় রঙিন হাতের আঙুল, কোলে নতুন বই, চোখে পদ্মদীঘি।

    "কি ভাল বাজাও তুমি! " দিদি হাত বাড়ায় "এ জিনিস আমি টাকা দিয়ে কিনতে পারি না, কিন্তু তবু তুমি এটুকু রাখ।  তোমার ছেলেমেয়ের জন্য মিষ্টি কিনে নিয়ে যেও " নীল চুড়ি পরা  হাতের মুঠির দিকে তাকায় সুবল।
    নীল দিদি সরে যায় সামনে থেকে। যাওয়ার সময় মেঘলা মায়া মাখা  গলায়  বলে যায় "কাল আবার শুনিও, কেমন!"

    সুবল হাতের টাকা গুনতে থাকে।  আরো বাজাতে হবে। লম্বা ফর্দ মনে লেখা। সাবান, ক্রীম, ছেলে মেয়ের জামা, এক শিশি আলতা, আর হ্যাঁ, এলাচ। ফুলির একটা শাড়ি হলে মন্দ হত না তবে সেটা বাবুদের মজুরী থেকে করতে হবে। নীল শাড়ি অনেক দুরে চলে গেছে। ভুল হলে গেল বড্ড। জিজ্ঞাসা করে নিলে হত ওঁরা কি সাবান মাখেন!

    সঙ্গীতা
    ------------------------------------------

    পুজো পুজো - ৩ [অক্টোবর ১৬, ২০০৬]

    সকালের এক ঝলক রোদের মত এক চিলতে হাসি হাসে দ্যুতি,  আয়নায় ঘুরিয়ে দেখে  নিজেকে,  আবার হাসে, অল্প, এমনি-ই। নিজেকে তৈরী করতে এমন করে হাসাটা জরুরী খুব।  জানতে হবে ঠিক কোন অ্যাঙ্গেল থেকে ছবি তুললে  প্রোফাইল ভাল দেখায়। অনেক দিনের অধ্যাবসায় লাগে, অনেক  ধৈর্য্য। বন্ধুরা সবাই বলে ওর ফিগার একদম মডেলদের মত,   ওর হাসি ভীষন ঝকঝকে।  কলেজের  ছেলেগুলো তো একদম ফিদা। দ্যুতি ক্লাসে  থাকলে  অতি অগা ছেলেও ক্লাস কাটেনা  অনেক সময়  ।
    চুলগুলো চূড়া করে বাঁধে দ্যুতি, নরম রেশম চুলের পনিটেল ঘাড় ছুঁয়ে থাকে, গলার ডানদিকে একটা ছোট্টো তিল  ভীষন  অহংকারে   স্পষ্ট।    ড্রেসিং টেবল থেকে  মাসাজ ক্রীম তুলে নেয়। অনেক কাজ এখন। মুখে ক্রীম মাসাজ করে প্যাক লাগিয়ে বসতে হবে খানিক্ষন। তারপরে স্নান সেরে  সাজগোজ শুরু, আজ নবমী। মাকে বলে রেখেছে,  একটা শাড়ী পরবে মায়ের ।  বন্ধুরা আসবে সাড়ে এগারোটায়। তার আগেই নিজেকে ঝাঁ চকচকে করে ফেলতে হবে।  
    দরজায় টোকা শুনে ঘাড় ঘোরায় দ্যুতি। মা নিশ্চই, টুকাই-এর তো টোকা দেওয়ার অভ্যেস নেই, আর বাবা তো এখন মাইথনে।
    একটু সামনের দোকান থেকে চিনি এনে দিবি ? তাপসী ঘরে এসে ঢোকে
    এখন? না আমি পারব না, তুমি টুকাইকে পাঠাও
    টুকাই বেরিয়েছে, তুইই একটু এনে দে
    না আমি যাব না। এই ভাবে, তৈরী না হয়ে বেরোব না আমি
    আরে:!  তৈরী হওয়ার কি আছে, এই তো সামনেই যাবি, যা, নিয়ে আয়
    উ:। খুব বিরক্ত লাগে। আর কদিন বাদে র‌্যাম্পে হাঁটার স্বপ্ন দেখছে  যে মেয়ে, তার  এখন পাড়ার মুদীর দোকান থেকে চিনি আনা শোভা পায় নাকি?
    দ্যুতি কথা না বারিয়ে তোয়ালে টেনে বাথরুমে ঢুকে যায়
    পুজোর দিনে   সক্কাল সক্কাল মাথা  গরম হয়ে যায় তাপসীর। দিন দিন মেয়েটা কি যে হচ্ছে। আজকাল  ঘরের ড্রয়ারেও চাবি দিয়ে রাখে। একদিন তাপসী ড্রয়ার ঘেঁটে দেখতে গেছিল, মেয়েটা ঠিক পথে চলছে কিনা যদি আন্দাজ পাওয়া যায়। টুকাইকে নিয়ে এখোনো অতটা চিন্তা শুরু হয় নি, কিন্তু মেয়ে দিন দিন যেমন ষোলো কলায় বাড়ছে!
    তাপসী আয়নার সামনে চুপ করে দাঁড়িতে থাকে একটু। নিজেকে দেখে।  চুলে একটু রূপোলী আভা, চোখের পাশ দিয়ে বয়স হাঁটছে। কি তাড়াতাড়ি  এতটা  পথ পেরিয়ে গেল!  এই তো কিছুদিন আগেও দ্যুতির মতই নবমী হত। সকালের শাড়ী বিকেলে সালোয়র  কামিজে। এত রকম পোষাক অবিশ্যি পেত না তখন, তাপসী নিজের মনেই হাসে। দ্যুতি যখন ওর মত হবে, তখন বাজারে কেমন পোষাক আসবে? এখনই তো কমতে কমতে নেই তে গিয়ে ঠেকেছে। নিজের দিকে আর একবার তাকায় তাপসী। পার্লারে গেলে হত হয়ত, এখন আর লাভ নেই, ভীড়ও  হবে খুব।
    মা, লেবু আছে? দ্যুতির গলা একদম স্বাভাবিক
    আছে , দিচ্ছি , দাঁড়া
    রান্নাঘরে গিয়ে দুটো লেবু কেটে, রস করে বীজ ছেঁকে  মেয়ের হাতে দেয় তাপসী। স্নানের পরে জলে গুলে চুলে ঢালবে মেয়ে। অনেক রকম রূপটান ব্যবহার করে দ্যুতি। তাপসীও ঠিক ঠাক যোগান দিয়ে যায়। মাও তো তাই দিতেন।
    এক ঢাল পিঠ ছাপানো চুল ছিল তাপসীর। এখোনো যা আছে তাই অনেকের কাছে  ঈর্ষনীয়। মা খুব যত্ন করতেন ওর চুলের। রিঠা, শিকাকাই আর  আমলা  ভিজিয়ে রাখতেন রাতে। পরের দিন দুপুরে মাথায় ঘষতেন সেই ফেনা ওঠা জল। চোখ জ্বালা করত, লাল হয়ে যেত একফোঁটা জল ঢুকে গেলে।  কিন্তু চুল সত্যি ভাল ছিল  ঐ সময়। দ্যুতির মধ্যে তাপসীর আদল খুব স্পষ্ট। তবে স্বভাব  একদম অন্যরকম হয়েছে। মা, বাবা কারুর স্বভাব পায়নি মেয়েটা। নাকি এটা বয়সের দোষ!
    ঐ বয়সে তাপসী নিজে কেমন ছিল? খুব শান্তই ছিল, মনে আছে। লাজুক, শান্ত, একটু হয়ত ভীতুও।  
    ক্লাস  টুয়েলভে উঠে আলাপ হয়েছিল অভিকের সাথে। সকলের অভিদা, স্টুডেন্ট ফেডারেশনের  বেশ চেনা  নাম। টিপ্যিকাল ইউনিয়ন লিডারদের মত না । কাঁধে ঝোলা নেই,  বড় পাঞ্জাবী পরে না। দিনের মধ্যে বত্রিশবার  দেখতে পেত ওকে ক্যান্টিনে, ইউনিয়ন রুমে, আর নয়ত মাঠের ধারে বড় কদম গাছটার তলায়।  খুব ছটফটে  মনে হত দেখে অথচ লাইব্রেরীতে গেলেই কি শান্ত মানুষ। এক মনে পড়ত, নোটস লিখত ঘাড় গুঁজে। ঐ লাইব্রেরীতেই আলাপ হয়েছিল দুজনের।
    তারপরে প্রথম পুজো। উ: কি উত্তেজনা!  বাড়িতে কি বলে বেরোবে, মাকে কোন বন্ধুর বাড়ির কথা বলবে, যার বাড়িতে ফোন নেই, যদি ধরা পড়ে তো কি হবে?  হাজার সমস্যা, সমাধান আর সম্ভাবনার পারম্যুটেশন কম্বিনেশন করে  ঠিক করেছিল বেরোনো হবে নবমীর সকালে।
    একটা চওড়া মেরুন পাড়, ছাই রঙা শাড়ী পড়েছিল তাপসী। খোলা চুল, চোখের  কাজলে লুকোনো বিদ্যুৎ, কপালে টিপের আলো , ঠোঁটে ভিজে মিষ্টতা, তাপসী একেবারে  বধ্যভূমিতে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল অভিকে। তারপরে কতবার যে অভির চোখের মুগ্ধতা গায়ে মেখেছে তাপসী, কিন্তু সেদিনের সেই চোখ আজও  উঁকি দেয় মনে। অভির চোখের পাতা খুব বড় বড় আর ঘন। মনে হত কাজল পরেছে। তাপসী নিজেও ঐ মুগ্ধ চোখে  হারিয়ে গিয়েছিল  একেবারে।
    খুব ঘুরেছিল দুজনে। শেষে কলেজস্কোয়্যারে  গিয়ে মেজমণি আর মেসোর  মুখোমুখি।  তাপসী আপ্রাণ চেষ্টা করছিল বোঝাতে যে অভিক শুধু বন্ধু , আর কিচ্ছু নয়। মেজমনি হাসছিল মুখ টিপে। শেষে তাপসী বলেই ফেলল "মা কে বলে দিও না যেন মেজমণি"
    খুব হেসেছিল ওরা। গালের টোলে দুষ্টুমী মাখিয়ে মেজমণি বলল "ওরে আমিও তুই ছিলাম একদিন। আমি কি জন্মেই  এমন বুড়ি হয়েছি ভাবিস?"
    তারপর থেকে বাড়িতে ঢুকেই আগে মেজমণি তাপসীর ঘরে হানা দিত "কি রে? হিরো কেমন আছে?"  
    কয়েক বছর পড়ে আবার আর  এক পুজো। অভি  চাকরীর খোঁজে ইন্টারভিউ দিয়ে বেড়াচ্ছে  শুকনো মুখে অষ্টমীতে দেখা করেছিল।
    কি হয়েছে?
    কিছু না - অভি মাথা নাড়ে
    আমি এখন খুব পুরোনো হয়ে গেছি তোমার কাছে, তাপসী অভিমান মাখিয়ে বলেছিল
    মানে? সে আবার কি কথা? কি করে জানলে এত বড় তথ্যটা?
    নয়ত কি? এত সুন্দর করে সেজেগুজে এলাম, সবাই বলল ভাল দেখাচ্ছে, অথচ তুমি আমার দিকে দেখছও না -
    অভিক হেসে ফেলে - যে সারাদিন চোখের মধ্যে আছে তাকে আর নতুন করে কি দেখব শুনি?
    সেই তো, ঐজন্যেই বল্লুম, পুরোনো হয়ে গেছি আমি - তাপসী মুখ ঘোরায়
    দুজনে বসেছিল গঙ্গার ধারে, বেলুড়ে। খুব ভাল লাগছিল, চারিদিকে ধুনোর গন্ধ, মঠে পূজারীদের গমগমে গলায় মন্ত্রোচ্চারন, কি অদ্ভুত সুন্দর অনুভূতি!   অনেক্ষন চুপ  করে বসে থেকে  অভি পকেট থেকে বার করেছিল জিনিসটা, তাপসীর হাতটা টেনে নিয়েছিল  নিজের হাতে। তাপরে যেন অনেক দ্বিধায় প্রায় অস্ফুটে বলেছিল
    "আমার তো এখন কিছুই দেওয়ার ক্ষমতা নেই তোমাকে , তাই এটা  দিলাম"
    তাপসী মুঠো খুলে  মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিল। একটা বেশ বড় সাইজের মার্বেল, দুধ সাদা, শাঁখের মত, কোনো দাগ নেই, কোনো ভেইন নেই। নিটোল  গোল একটা মার্বেল।
    অভি  তাপসীর   হাতটা মুঠিতে ধরেছিল
    "এটা আমি কুড়িয়ে পেয়েছিলম রাজগীরে, বাবার সাথে বেড়াতে গিয়ে,  খুব ছোটোবেলায়। আমার খুব প্রিয় জিনিস এটা, কাউকে হাত দিতে দিইনি কখোনো। ছোটোবেলায় রোজ একবার করে বার করে মুছে তুলে রাখতাম , জানো?  আমার বহুদিনের সঙ্গী এই মার্বেলটা "
    "তাহলে আমায় দিচ্ছ কেন?"
    "কারন আমার কাছে টাকা নেই এখন একদম, তাই আমার সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটা সবথেকে প্রিয়জনকে দিলাম"
    ভাললাগায় অবশ হয়ে গিয়েছিল তাপসী। মার্বেলটা বুলিয়েছিল গালে, ঠোঁটে,  যেন ছোট্টো অভির নরম হাতের স্পর্শ মেখে নিয়েছিল তখনই।    আলতো গলায়  বলেছিল "আমিও যত্ন করেই রাখব, দেখো।"  আর অভিকে জানতে না দিয়ে   মনে মনে বলেছিল "ভালবাসি, ভালবাসি"

    অভি  এখন একদম কেজো স্বামী । চাকরীর উন্নতি, ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ,  আফটার রিটায়ারমেন্ট সিকিওরিটির দিকে চোখ রাখতে রাখতে সেই মুগ্ধ চোখ  হারিয়ে গেছে কোথাও। বাড়ির কাজ, দ্যুতি, টুকাই , জিনিসের দাম  আর মাঝে মধ্যে আত্মীয় স্বজন সম্বন্ধে  নোটস এক্সচেঞ্জ  ছাড়া কথাই বা কোথায় হয়  দুজনের মধ্যে?  একসাথে  জীবন কাটানোর সেই স্বপ্নটা কি এতই কেজো স্বপ্ন ছিল আসলে?  কানের পাশের প্রায় না দেখতে পাওয়া রূপোলী গৌরবে   ছোঁয়ায় তাপসী।  ভীষন ইচ্ছা করছে একবার  কথা বলতে।  আবোল তাবোল কিছু।  আজ বিকেলে ফিরবে অভি ট্যুর থেকে, কিন্তু অতক্ষন অপেক্ষা করতে ইচ্ছা করছে না।  তাপসী ফোন তুলে নেয় হাতে ।  কথা সেরেই  স্নানে যাবে, অঞ্জলী হবে সাড়ে দশটায়। তারপর একটু  বেরোবে , কত আর ভীড় থাকবে পার্লারে!

    মা, আমি এই শাড়িটা পড়ছি আজ
    হ্যঁ পর। যেটা খুশি পর, সবই তো নতুন
    শখ করে এবার বেশ কয়েকটা শাড়ী কিনেছে তাপসী।  দ্যুতি  গায় ফেলে দেখছে চোদ্দবার, কোনটা মানাবে ওকে।
    তাপসী মনে মনে মেয়ের  কপালের ডানদিকে কাজলের টিপ এঁকে দেয়। ও যা পরবে তাতেই তো মানাবে।
    তুমি কোনটা পড়ছ?
    তাপসী গাঢ় বেগুনী শাড়িটা বার করে আলমারী থেকে। সোনালী কুসুম হলুদ  পাড়ে জরির কাজ।
    ম্যাচিং ব্লাউজ আছে?
    তাপসী হেসে ফেলে। এই মেয়ের ওপর রাগ করেই বা কতক্ষন থাকবে?
    হ্য`ঁ, আছে, পাড় বসিয়ে করিয়ে নিয়েছি
    ও: গুড, কার মা দেখতে হবে তো? দ্যুতি শাড়ি ঘাঁটতে ঘাঁটতে কাঁধ ঝাঁকানোর ভঙ্গী করে, তারপরে  সব ফেলে মাকে এসে জড়িয়ে ধরে - মা, তুমি যখন আমার মত ছিলে, তুমিও এরকম ছিলে? আমার মত?
    তাপসীর গলায় মেজমণি ভর করে - না:, আমি কোনোদিন তোর মত ছোটো ছিলাম না। একেবারেই এমন বুড়ি হয়ে জন্মেছি
    - ইশ্‌শ্‌শ, কে বলে তুমি বুড়ি? জান, আমার বন্ধু কৌশিক বলে আমি সুযোগ পেলে মাসীমাকে নিয়ে  একদিন কফি খেতে যাব ঠিক, লোকে টেরিয়ে যাবে"
    তাপসী অবাক চোখে তাকায় - সেকিরে? তোরা মা মাসিদেরও  নিয়েও আলোচনা করিস?
    করি, cool mom দের নিয়ে করি and I am very proud to be your daughter
    দ্যুতি মাকে ছেড়ে  আবার নিজের দিকে মন দেয়।

    নবমীর সকালে প্যান্ডেলে খুব ভীড়। সুবল ঢাকি এদিক ওদিক তাকায়।  নীল দিদিমণি কি আজ আসবে? কাল মুঠি খুলে দেখেছে, অনেকগুলো ট্যাকা  দিয়েচে দিদি। আজ শুধু ও দিদির জন্যেই বাজাবে  আর একবার।
    সবাইকেই এক রকম দেখতে লাগে।  তেমন লক্ষ্য করে দেখে নি কাল, আজ কি চিনতে পারবে?  এই দিদিমণিরা তো ওদের ঘরের মেয়ে বৌদের মত নয় যে এক  শাড়ী পড়েই গোটা পুজো কাটাবে । আজ যদি নীল না পড়ে? রাগ হয়ে যায় নিজের ওপর, ইস, একটু খেয়াল করে  দেখে নিলে কি হত?
    আরতি শুরু হয়েছে, সুবল শরীরটাকে ঝাঁকিয়ে  কাঁধে ঢাক  বসিয়ে নেয় ঠিকঠাক।  কাঠি দুটোর মধ্যে  ভর করে সুবল মেয়ের কাছে পৌঁছে যায় । বড় ঠাকুরের মন্ত্র সুবলের কম বেশী মুখস্ত, তাই আজও নিজের মত মানে তৈরী করে সুবল বিড়বিড় করে " ফুলিরে আর টিয়ারে দেখো মাগো। আমি সব নে যাব, সব কিনে নে যাব ইস্টিশন বাজার থেকে। ওদের ভাল রেখো মাগো"
    ধুনোর ধোঁয়ায় চোখ জ্বালা করে। সুবল চোখ বুঁজে বাজাতেই থাকে, আরতির ঘন্টাধ্বনি শেষ হয় একসময়, ভীড় হালকা হয়ে আসে। সুবল সেই গন্ধটা অনুভব করে  আশে পাশে, কালকের সেই গন্ধ, নীল দিদিমণি এসে দাঁড়িয়েছে সামনে। চোখ খোলে না ঢাকী । দ্বিগুন উৎসাহে কাঠি নাচে ঢাকের ওপর, নাম জিগানোর দরকার নেই আর। সুবল দোকানে গিয়ে গন্ধ শুঁকে বুঝে নেবে কোন সাবান"

    বাহ, কি অপূর্ব হাত তোমার। কি অদ্ভুত সুন্দর বাজাও!
    সুবল চোখ খোলে, নীল দিদিমণি  দাঁড়িয়ে হাসছে মিটি মিটি, আর তারপাশে আর একজন বৌদিদি। বেগুনী শাড়ী, হলুদ পাড়। সদ্য চান করেছে মনে হয়, চুলের ঘেরে জলের কুচিতে রোদ পড়েছে।  এরা সব কোন  দেশ থেকে আসে?  খুব সুখী মুখ এদের। কিসের সুখ? টাকার?  সুবল মাথা নিচু করে।
    ঢাকী বিদায়ের দিন আমার কাছে এসো, কেমন? আমি ঐ ফ্ল্যাটটায় থাকি
    বৌদিদি দূরে আঙুল তুলে দেখায়। খয়েরী পর্দা ওড়া একটা জানলা দেখে নেয় সুবল
    নীল দিদিমণি  চুপ করেছিল এতক্ষন, এবার অল্প হেসে বৌদিদির দিকে তাকায় "আমি যাই তাপসী দি, বাড়িতে বন্ধুরা আসবে, বিকেলে দেখা হবে"
    চল, আমিও যাব, বেরোবো একটু
    ওদের হেঁটে যাওয়া ছবির দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে সুবলের মনে একটা প্রশ্ন আসে - আচ্ছা, ফুলি কি কখোনো এমন করে দাঁড়িয়ে ওর বাজনা শুনেছে? কখোনো বলেছে, আহা, কি মিঠে হাত তোমার! মনে করতে পারে না সুবল, হয়তো শোনেই নি, বরং পুজোর শেষে বাড়ি ফিরলে কড়া পড়া হাতে , কাঁধে গরম তেল মালিশ করে দিয়েছে  সবসময়।
    সব কিছু কিনে নিয়ে যাবে সুবল, তারপরে মেয়ে বৌকে সাজিয়ে  দাওয়ায় বসিয়ে চাঁদের আলোয় ঢাক বাজিয়ে শোনাবে। মূর্তি ছাড়াই নিজের  আঙনায়  মায়ের পুজো করবে সুবল ঢাকী।

    (ক্রমশ:)

    সঙ্গীতা
    --------------------

    পুজো পুজো- ৪ [অক্টোবর ১৬, ২০০৬]

    জানলার পর্দা ওড়ে  শব্দ করে। ঝড় উঠছে । কলেজে এক বন্ধু ছিল রফিক, গ্রামের ছেলে। আশ্বিনের  ঝড়কে ও বলত আশনাই।   দশমীর সকালের ঝোড়ো হাওয়ায়  মুখে হাত বুলিয়ে ঘুম ভাঙানোর পরে এই কথাটাই প্রথমে  মনে এলো অভির ।  তাপসী এখোনো  অঘোরে ঘুমোচ্ছে।  একদম বাচ্চাদের মত ঘুমোয় তাপসী ।  শাড়ীর প্রান্ত  তুলে উঁকি মারছে পায়ের গোছ। অবিন্যস্ত  আঁচল, হাতখোঁপা ভেঙে চুল ছড়িয়েছে বালিশে। ভোরের না ফোটো আলোয় কি মায়া মাখিয়েছে  মুখে। অভিক অনেক দিন পরে  এত মনোযোগ দিয়ে  এতক্ষন ধরে  দেখছে  তাপসীকে।  
    আচমকা মাইথনে বসে ফোন পেয়ে  অবাক লেগেছিল । তাপসী কিচ্ছু বলেনি, হাসছিল শুধু। শেষে হালকা গলায় বলে "তাড়াতাড়ি চলে এসো। ভাল লাগছে না পুজোর দিনে তোমায় ছাড়া"।
    অভিক আলতো হাত রাখে  তাপসীর  কপালে ।  
    ঘুমের মধ্যে  খুব খুশি লাগছিল তাপসীর। একটা বড় ঘর, ঘরের মধ্যে  অনেক অনেক অচেনা আসবাব , জানলা দিয়ে খুব অষ্পষ্ট  আলোর আভাস। একটা ইজিচেয়ার, এটি চেনা। ওদের বাড়ির  দোতলার বারান্দায় পাতা থাকে,  আর সেই চেয়ারের ওপরে আধশোয়া হয়ে আছেন বাবা। ভীষন , ভীষন ভাল লাগে  দেখে। তাপসী দৌড়ে  কাছে যায়, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে  "তুমি এসেছ বাবা? দেখ, আমি নতুন শাড়ি পড়েছি। ভাল না? দেখ ... " বাবা খুব সুন্দর করে হাসেন ।  খুব ভাল লাগে তাপসীর । কত্ত গল্প জমে আছে,  অনেক অনেক কথা বলার আছে বাবাকে। কিন্তু   পায়ের কাছে আসন পিঁড়ি হয়ে বসতে বসতে  আচমকাই ঘুমটা ভে`ঙে যায়। মন খারাপ হয়ে যায় সক্কাল বেলা, আরো একটু বেশিক্ষন  ঘুমটা থাকল না! আরো একটু  বেশি সময়  কাছে বসতে পারত  মানুষটার....

    তিতিরের ঘুম ভেঙেছে মাঝরাতে।  বন্ধুদের সাথে প্যান্ডেলে বসে আড্ডা দিয়েছে  অনেক রাত অবধি। ওরা সবাই মিলে  গাড়ি নিয়ে ঘুরতে গেল। ডেকেছিল অনেক করে, কিন্তু যেতে ইচ্ছা করল না  একদম । বোধহয় মনের মধ্যে একটা আশা ছিল আজ একবার ফোন আসবে, আসবেই।  হাতের মুঠিতে ফোনটা  নিয়েই শুয়েছিল, যদি ঘুমিয়ে পড়ে!  মাঝরাতে  একটা অদ্ভুত আওয়াজে ঘুম ভাঙল। অনেক দূর থেকে কেউ যেন ডাকছে তিতি ই ই ই ই। খুব মিহি আওয়াজ গলার, ঠিক যেন কোনো বাচ্ছার গলা, নরম চিকন বালির মত  অল্প দানা মেশানো  আওয়াজ । তিতির প্রাণপনে  মনে করার চেষ্টা করছিল কোথায় এই আওয়াজ শুনেছে। ঘুমচোখে অন্ধকার ঘরে চোখ সইয়ে নিতে নিতেই  মনে পড়ে যায়  নামটা। রুনার গলার আওয়াজ। ঠিক এমনি করেই ডাকত রুনা, তিতি ই ই ই ই- সুরেলা  নরম ভাসিয়ে দেওয়া গলায় ডাক দিত। ক্লাস সেভেনে  উঠে  রুনারা এসেছিল ওদের স্কুলে। বম্বে থেকে ট্রান্সফার হয়ে এসেছিলেন ওর বাবা।  স্কুলের  তৃতীয় দিনে ওর সাথে ভাব পাতিয়েছিল নিজেই।  দেখতে দেখতে বন্ধুত্ব। স্কুলের শেষের দিকে তো মনে হত এর পরে এক জন আর একজনকে ছেড়ে থাকবে কি করে।  কিন্তু  সে দিনও এল টুয়েলভের পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল  দুজনের।  কাকু ট্রান্সফার হলেন  কানপুরে। ওখানে গিয়েও মাঝে মধ্যে চিঠি চাপাটি চলেছে কিন্তু আস্তে আস্তে তাতেও ভাঁটা পড়ে গেল।  কত বছর হয়ে গেছে রুনার সাথে কোনো যোগাযোগ নেই। আজ নবমীর শেষ প্রহরে কেন যে রুনার ডাক কানে এলো কে জানে!
    একবার ঘুম ভাঙলে ঘুম আসে না সহজে, তিতির উঠে বসে , রাইটিং প্যাড টেনে নেয়। এবছর আবার অনেক দিন পরে বিজয়ায় চিঠি লিখবে । ফোনে, ই-মেল-এ শুভেচ্ছা আর  প্রণাম পাঠানো রেওয়াজ হয়ে গেছে আজকাল। কম্পিউটার খুললেই দেখবে গোছা গোছা ই-কর্ড  শুভেচ্ছা মুড়ে পৌঁছে গেছে বাক্সে।  কিন্তু তিতিরের এখন   খুব লেখা পাচ্ছে,   কিছু লিখতে হবে এখন । চোখ বন্ধ করে একটু ভাবে  তিতির , তারপরে একটা সাদা পাতা টেনে লিখতে বসে তাকে, যার ফোনের অপেক্ষায় দিন রাত কাটে তিতিরের।

    সুবল আজ মহা খুশী। এই বাবুরা  নিয়ম মেনে দশমীর দিনেই  মায়ের বিসর্জন করবে, তার মানে আজই  সব গুছিয়ে গাছিয়ে ছেলেকে নিয়ে  লাস্ট ট্রেন ধরে নিজের ঘরের দুগ্গার কাছে পৌঁছবে সুবল। অত রাতে মেয়েটা ঘুমিয়ে পড়বে জানে, কিন্তু তবু কি খুশি যে লাগে মনটায়। ছেলেকে তাড়া দেয় বার বার । চটপট কাজ সার।   সকালেই বড় ঠাকুর  বিসর্জনের মন্ত্র  পড়বেন।  বিকেলে সিঁদুর খেলা সেরে  মাকে  রওনা করানো হবে । এই কদিন খাওয়া বেশ ভাল হয়েছে। এদের এখানে খাওয়ার ব্যবস্থা ছিল সপ্তমী থেকে নবমী,দুবেলা। বাবুরা বলে দেছলেন খাবার সময় ঐ দালানে গিয়ে খেয়ে নিতে, টিকিট লাগবে না।   বাপ ব্যাটায় মিলে পেট পুরে খেয়েছে এই কদিন। ভুলুটা বারবার বলছিল "মা আর টিয়া  কি খেলো কে জানে!"
    খুব ভালো কোরে বাজার করবে কাল, বৃষ্টি বাদলায় পেছনের ডোবাটায়  জল বাড়ে। আজ ভোররাতে এখানে তো এক পশলা ঢালল, ওখানে কি হয়েছে কে জানে ।  ছাতিমগাছের গোড়া থেকে পিঁপড়ের ডিম তুলে ছিপ ফেলে বসলে হয় একবার কাল। নিজের মনেই হাসে  ঢাকী। ঐ ডোবায় ছিপ দিলেই ফুলি হাসে "যাও, বড় দেখে হাঁড়ি নিয়ে যেও, বড় বড় ইলিশ উঠবে দেখো"। ইলিশ কতদিন খায়নি, স্বাদ ভুলে গেছে । এক এক করে প্যান্ডেলে  লোক জড়ো হচ্ছে। এরা নিশ্চয়ই প্রায়ই ইলিশ খেতে পায়! সুবলের হঠাৎ ইচ্ছা করে বাবু হতে। মায়ের দিকে মুখ ফিরিয়ে হাতজোড় করে সুবল বিড়বিড় করে "আমাকে একদিনের জন্যি বাবু করে দ্যাও মাগো, বৌ বাচ্চাদের দুটি ভাল মন্দ খাওয়াই"

    মোড়ের মিষ্টির দোকানে খুব ভীড়। শোকেস ভর্তি মিষ্টি, ওপরেও হলুদ প্লাস্টিক ঢাকা মিহিদানা উঁচু করে ঢালা। কড়াইয়ে গরম জিলিপী আর সিঙাড়ার ভাপ উঠছে। অভিক অনেকগুলো জিলিপি সিঙাড়া কিনে ফেলে। ছোট্টোবেলায় বাবার হাত ধরে এমনই কচুরী, জিলিপি, সিঙাড়া কিনতে যেত মহালয়ায় আর বিজয়া দশমীতে। বাড়িতে মা মুচমুচে নিমকি ভাজতেন কালো জিরে দিয়ে। তাপসীও ভাজে নিমকি, খুব খাস্তা করে, কিন্তু তবু মায়ের নিমকির মত লাগে না জিভে। কেন কেন জানে? নিমকি ভাজার মানুষটা অন্য হয়ে গেছে বলে, নাকি জিভটাই পাল্টে গেছে এখন? কাল সকলে মিলে যাবে মা বাবাকে প্রণাম করতে, মাকে বলবে একটু নিমকি বানিয়ে দিতে। তাপসী কি রাগ করবে? মনে হয় না, তাপসী সব বোঝে, সব। এটাও বুঝবে নিশ্চই।
    স্নান সেরে নেয় তাপসী। সাদা চওড়া পাড় শাড়ি পরে একটা। ফ্ল্যাটবাড়ির এক চিলতে কোনে ঠাকুরের আসনের সামনে গিয়ে বসে,বাবার ছবিটা হাতে তুলে নেয়। নতুন শাড়ির আঁচল দিয়ে যত্ন করে মোছে ছবিটা, যেন নিজের আঁচল দিয়ে পা মুছিয়ে দিচ্ছে।  ঠাকুরের আসনের ফুলের গন্ধ , ধূপের গন্ধ ছাপিয়ে তাপসী বাবার সিগারেটের গন্ধটা খোঁজে। এক বছর সাত মাস হল বাবা চলে গেছেন।  দশমীর সকালে বাবার ছবি বুকে নিয়ে তাপসীর গাল ছাপিয়ে জল নামতে থাকে ।
    "মা, চলো, খেতে দেবে, বাবা কত্ত জিলিপি এনেছে" দ্যুতি সামনে এসে দাঁড়ায়।  বাসি জামায় বাসি চুলে মেয়েটাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। কদিন পুজোর তালে হুল্লোড়ও হয়েছে খুব। তাপসী রান্নাঘরের দিকে এগোয়।

    রোদ চড়ে গেছে মাথার ওপর । ছোটো ঠাকুরমশাই বড় পিতলের  পাত্রে দই, চিঁড়ে, মুড়কি, কলা, বাতাসায় দধিকর্মার  যোগাড়ে  ব্যস্ত। বড় ঠাকুরমশাই কোশাকুশির জলে রাখার বেলপাতা খুঁজছেন। মায়ের যাবার  আয়োজন প্রায় সারা।  ইচ্ছে করছিল না আসতে, তবু নেমে এসেছে তিতির। সারারাত ধরে লেখা চিঠিটা সকালে কুচি কুচি করে ফেলে দিয়েছে কাগজের  ঝুড়িতে। মাঝরাতে লেখা চিঠিতে অনেক নগ্ন সত্যি থাকে, নিজের ভালবাসা, রাগ, অভিমান সবই বড় তীব্র সুরে বাজে। ভোরের আলোয় সে চিঠি  নিজেকেই লজ্জা দেয়। অমন আকুতি, অমন ডাক কি তিতিরের বুক থেকে বেরিয়েছে? পড়ে নিজেই লজ্জা পায় তিতির। একবার মনে হয়েছিল লেখা যখন হয়েই গেছে, পাঠালেই বা ক্ষতি কি? কিন্তু মন সায় দেয় না পুরোপুরি। সারারাত ধরে লেখা চিঠিখানা   একরাশ সাদা শিউলি হয়ে যায়। স্নান সেরে তিতির নেমে আসে প্যান্ডেলে, আজ ঐ ঢাকীকে বলতে হবে আরো একবার অমন করে ঢাকটা বাজাতে। গ্রামের সিংহবাহিনীর নাট
    অমন্দিরে দাঁড়িয়ে প্রণাম সারতে গেলে ঐ ঢাকের আওয়াজের পথটুকুই ভরসা।

    সন্ধ্যের মুখেই বাবুদের  দুটো লরি এলো। একটাতে মা আর অন্যটাতে ছেলেমেয়েকে ওঠানো হবে। তাপসীর গালে কপালে লাল টুকটুকে সিঁদুর মাখা। অভিক ক্যামেরা চার্জ করিয়ে রেখেছিল। অনেক ফটো তুলবে আজ। লালপেড়ে সাদা শাড়িতে  মাকে  দেখে খুব ভাল লাগে দ্যুতির। সকলেই বলে ও মায়ের থেকেও বেশি সুন্দর হবে, কিন্তু আজ ঐ সিঁদুর মাখা খুশি মুখটা দেখে মনে হচ্ছে দুজনে পাশাপাশি র‌্যাম্পে হাঁটলে এখোনো লোকে আগে মাকে দেখেই মুগ্ধ হবে। বড্ড ভাল লাগে হঠাৎ। ঠাকুর ভাসান যায়নি এখোনো কিন্তু দ্যুতি হঠাৎ দৌড়ে গিয়ে তাপসীর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে ফেলে।
    তিতিরও সেজেছে লাল পেড়ে শাড়িতে, ভেতরে চাঁপা রঙের ওপর লাল ফুল তোলা প্রিন্টেড তাঁত। সবাই কি উচ্ছাসে সিঁদুর খেলছে। তিতিরের বন্ধুরা যারা বিবাহিত,  তারা হোলি খেলার মত করে সিঁদুর মেখেছে। তিতিরেরও ইচ্ছা করে ঐ অহঙ্কার মেখে নিতে মুখে, গলায়। খুব খুব ইচ্ছা করে। মনের মধ্যে ফিসফিসিয়ে  ডাক দেয় তাকে। শুনতে কি পায় সে?

    সুবলের বাঁধাছাঁদা সারা। বাবুদের পাওনাগন্ডা , ঢাকী বিদায়ের বকশিশ মিলে বেশ কিছু টাকা এসেছে হাতে। তাড়া তাড়ি  এগোতে পারলে শেয়ালদা ইস্টিশন থেকেই সব কিনে নেবে। যা যা ভেবে রেখেছে।
    নীল দিদিমনিকে আজ একদম অন্যরকম দেখাচ্ছে। কেমন বৌ বৌ।  সামনে এসে দাঁড়ায় দিদিমনি  "ঢাক বাজাবে না এখন?" সুবল  আর একবার  নিশ্বাসে মেখে নেয় গন্ধটা তারপরে মাথা নেড়ে ঢাকে কাঠি ছোঁয়ায়। বাজাবে বৈ কি, প্রাণ খুলে বাজাবে। আজই তো বাজাবে, এর পরেই তো সুবল ঢাকী থেকে হয়ে যাবে সুবল ফিরিওয়ালা। তার আগে একবার কলজে নিংড়ে না বাজলে কি চলে?
    সুবল কাঁধে ঝাঁকুনি দিয়ে ঢাক সোজা করে।
    তাপসির বুকের মধ্যে একা এক মেয়ে পাগলের মত তার বাবাকে খোঁজে। অভিকের ক্যামেরায় অনেক অনেক খুশি মুখের ভীড়। দ্যুতি বন্ধুদের সাথে সন্ধ্যেবেলায় আইসক্রীম খেটে যাওয়ার প্ল্যান করে।  সুবলের বন্ধ চোখের ওপারে পুজো মন্ডপটা ওর বাড়ির উঠোন হয়ে যায়, আলতা পরা পা দুলিয়ে টিয়া মাথা দোলায় বাজনার তালে তালে।  বাজনার তালে ।   তিতির  জোড় হাতে  চোখ বন্ধ করে  একবার দাঁড়ায় চন্ডীমন্ডপের চাতালে, তারপর ফ্রকের ঘের উড়িয়ে দৌড়োতে থাকে কাশবনের গা ঘেঁষে পদ্মদীঘির পাড় বরাবর।  

    -------------------

    সমস্ত মজলিশিদের জন্য রইল শুভ বিজয়ার অনেক অনেক শ্রদ্ধা, শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।  
    ভাল থাকুন সকলে, ভাল রাখুন সকলকে

    সঙ্গীতা
    sangita | - | -
     
  • Bratin Das | ২৩ নভেম্বর ২০২৩ ২৩:০৩741460
  • সঙ্গীতা মানে 
     কি আমাদের  রাত্তির  দিদিমণি?  
  • বাংলালাইভ বিশেষ সংখ্যা - রঙ্গন / বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী | 43.25.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ০০:৪০741461
  •  
    বাংলালাইভের বিশেষ সংখ্যা ছিল শারদীয় i-পত্রিকা, বৈশাখী, রবীন্দ্রজয়ন্তী (২৫শে বৈশাখ) আর শ্রাবণী। এদের লেখাগুলো আগের পোস্টে দেওয়া গল্প / কবিতা আর্কাইভে নেই, উপরের লিংক থেকে প্রতিটা খুলেই কেবল দেখা সম্ভব। প্রথম তিন বছরের বৈশাখী আর শারদীয় i-পত্রিকা ছিল ক্রয়লভ্য। সেগুলো আর দেখার উপায় নেই, যাঁরা কিনেছিলেন তাঁরা শেয়ার না করলে। তা বাদে বাকিগুলো থেকে একজনের লেখাগুলো একত্র করা  থাকল। উপরের লিংক থেকে পত্রিকাগুলো একে একে খুলে সূচিপত্র দেখে আপনারাও সেভ করে নিতে পারেন পছন্দের লেখাগুলো। কম্পিউটারের ফন্ট ফোল্ডারে লাগবে বাংলাফন্টনর্মাল নামের ফন্ট ফাইলটি আর প্রথম পোস্টে দেওয়া ট্রান্সলিটারেশনের পাতাটা, হিজিবিজি অক্ষর যাইই দেখবেন, সেসবই ওই ফন্টের লেখা। ট্রান্সলিটারেশনে ফেললেই ইউনিকোডে কনভার্ট হয়ে যাবে।
     

    বর্ষা-পদ্য
       বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    ছায়াতলে রাখ মেঘ, মায়াভালে থাক-
    অতল পাতালঘোরে অন্ধস্রোতে ছায়াভারে
    সুখরাতে দুখাবেশে শিরে হাত রাখ-

    টেম্‌সের ইস্পাতজলে
    অবিরত ব্রিটিশ শ্রাবণ।
    গহন কাফেতে দোঁহে যুবকযুবতী
    হিয়ে হিয়া ঠোঁটে ঠোঁট-
    ভায়োলিনে সেল্টিকস্তব।
    প্রাচীন সুখের সব শব্দ লুকিয়ে
    সাঁঝে ওড়ে বিষনীল অনন্ত বেলুন।

    সাধ ধুল, গতি ধুল, ধুল সূর্য ম্লান
    করুণাগরিম মেঘ যুবতী সাম্পান;
    ভাসে সুখে, দুঃখে ভাসে জোছনা ডাগর
    ভাসানে প্রদীপ জ্বলে অন্ধ সদাগর।

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১১)
    -------------------------------------------------------
    জন্ম
       রঙ্গন

    অনন্ত শবের মুখে জন্মনাম জপ হে জনম বরষা জলে ভাসে যে জন্ম তার রক্ত জল লালা দিয়া হবে বা সংসার
    অচেতন ভ্রুণ যেই ধুক্‌ধুক্‌ জঠরের গভীর শ্মশানে রচ যে সংসার সেথা কোথা মাতা কোথা পিতা শুধুই জীবন
    শীর্ষে গিয়া দেখ ফিরে ছড়ানো মেঘের দলে অন্ধকারে আলো জ্বলে রক্তে তাপ তাপিত মলিন নাড়ী ছেড়ে আসে প্রাণ
    স্বেদজন্ম রক্তজন্ম মাংসজন্ম শেষে নিরাবেগ শবে মেঘের পসরা তুলে ঘরে যেতে যেতে একবার ফিরে দেখে প্রথম সন্তান।

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১২)
    -------------------------------------------------------
    শ্লোক
          রঙ্গন

    শ্রীকৃষ্ণকীর্তন

    কালকেউটের রাখাল তোমার চক্ষুকোণে বিষ,
    কোলাপ্‌সিব্‌ল হাওয়ায় দোলে মোবাইলের শিষ।
    আষাঢ়গ্রামের কদমতলায় ঘি মৌ মৌ ঠেক,
    সর্ব অঙ্গে টাপুরটুপুর দাও না একটা ব্রেক।
    হাতের পাঁচন মরণবাঁচন বাক্সো আপিস হিট,
    ময়ূরপুচ্ছে লুকিয়ে রাখ মাঝবয়সের গিঁট।
    দিন চলে যায় গুনগুনিয়ে আগুন শরীরময়,
    এসো আমার ঘরে এসো শেষের বারান্দায়।

    দুর্গাস্তোত্র

    এই রাত্রের সিঁদুরখেলা তমসাসৈকতে,
    আন্ধার নদ গর্ভছেঁড়া রক্তক্লেদে ভাসে।
    বাতাস জুড়ে উলুধ্বনি, আকাশ জুড়ে মদ,
    জন্মদ্বারে বিষ ছুঁইয়ে নিহত শৈশব।
    ভাসান শেষে মাংস বিলি, কণ্যার ভ্রূণ তাজা,
    নীলকণ্ঠের গলায় শেকল, পাখায় ভীষণ কাদা।

    শ্যামাসঙ্গীত

    সেই
    বনের মধ্যে পা ছড়িয়ে চরম নারী বসে,
    তার শ্যাওলা বুকের উদাস গন্ধে অরণ্য কি স্থির!
    মাটির কপাট খুলছে যোনির গভীর সর্বনাশে,
    ঘুমিয়ে আছেন স্বয়ম্ভূ রাত অনন্ত গম্ভীর।

    দ্যাখ্‌
    ছয় হিজড়ের ঢোলক বাজে দিনের আগুন খেলায়,
    আগুন বাজে ঘরবসতে, আগুন জলে বাজে;
    বাচ্চাগুলো মাংস বিক্রি করছে আগুনমেলায়,
    ল্যাংটো হয়ে জ্যান্ত পুরুষ শুকনো খানকি সাজে।

    তাই
    খুঁজেই ফিরি, খুঁজেই মরি অকূল শবরী,
    কোমর ঢাকে আদিবৃক্ষ, আদিম পিদিম রাত;
    তার গর্ভরসে দুনিয়াদারি, গর্ভেতে ঈশ্বরী,
    তার জলের কাঁথায় শান্ত ঘুমায় ভুবনডাঙার মাঠ!

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১৩)
    -------------------------------------------------------
    গল্প :

    পশুখামার
    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    সে বেশি দিন আগের কথা নহে। এক চাষির এক মস্ত বড় পশুখামার ছিল। সেই খামারের একপাশে থাকিত রংচঙে ঝুঁটিফোলানো কোঁকোরকোঁ মুরগি মোরগ। অন্যপাশে থাকিত সাদাকালো হাম্বাট জাবরকাটা গরুদের দল। চাষির কড়া নিয়ম গরু আর মুরগিদের খাওয়াদাওয়া সব একইসাথে একইপাতে। শুধু শুইবার জায়গা আলাদা। তবে সম্পূর্ণতার খাতিরে বলিয়া রাখা প্রয়োজন যে ইতিপূর্বে চাষি একবার গরু আর মুরগি একসাথে শোয়াইয়া "মোরু' তৈয়ারের প্রয়াস করিয়াছিল বটে। কিন্তু তাহাতে কিঞ্চিৎ প্রাণক্ষয় হইবার কারণে চাষি এখন সে আশা ছাড়িয়াছে। গরুমুরগিদের এহেন খাওয়াপরা ওঠাবসা দেখিয়া পাড়াপড়শীদের তাক লাগিয়া যায়। সবাই বলে- দেখেছো! কত্তার দাপটে গরুমুরগি একপাত্তরে খুদ খায়! গরু দুধ দেন, এবং মুরগিরা ডিম দেন। সেই দুধ আর ডিম বিক্রয় করিয়া চাষির সংসার সুখেশান্তিতে চলিয়া যায়। শুধু মোরগমুরগিগণ বৃদ্ধ হইলে বৃদ্ধাবস্থার কষ্টলাঘবের স্বার্থে চাষি তাহাদের কাটিয়া খাইয়া ফেলে। তাহাতে বিশেষ কাহারো আপত্তি নাই। এই কৃত্রিম জন্মনিয়ন্ত্রণের ফলে খাদ্যের একজন ভাগীদার কমিয়া গণস্বার্থ রক্ষিত হয়। এহেন সাম্যবাদী সুশীল সমাজের ভাগ্যাকাশে একদিন দুর্যোগের কালো মেঘ ঘনাইয়া আসিল। সেই দুর্যোগ শিল্পায়ন হইতেও ভয়াবহ, মর্মান্তিক। পাঠকপাঠিকা, আইস, আমাদের এক্সক্লুসিভ ক্যামেরায় আমরা দেখিয়া লই সেইসব রক্তস্নাত দিনগুলিতে সত্য সত্য কি হইয়াছিল।

    মুরগিরা ভোরে দল বাঁধিয়া প্রাতঃকৃত্য করিবার সময় দেখে মিস কলহপ্রিয়াকে আর পাওয়া যাইতেছে না। দুর্ধর্ষ দস্যু কাগামাছির বিশ্বস্ত অনুচর কদম্ব পাকড়াশীর চকোলেটের মোড়কের মতো শুধু কয়েকটি উজ্জ্বল পালক অকুস্থলে পড়িয়া রহিয়াছে। মুরগিরা নিজেদের ঘর, গরুদের গোয়াল তন্নতন্ন করিয়া খুঁজিয়াও মিস কলহপ্রিয়াকে পাইল না। এইরূপ পরিশীলিতা, মননঋদ্ধা, উত্তরাধুনিকা মুরগিকে হারাইয়া মুরগিমহলে এক নিদারুণ শোকের ছায়া নামিয়া আসিল। কিছু জোয়ান মোরগ সন্দেহপ্রকাশ করিল চাষি নিশ্চয় রাত্রের অন্ধকারে কলহপ্রিয়াকে কাটিয়া খাইয়া ফেলিয়াছে। বৃদ্ধ মোরগেরা বলিল চাষির পক্ষে এইরূপ বিশ্বাসভঙ্গ নিতান্তই অসম্ভব। এই দুর্যোগকালে যে কোনো মূল্যে পশুখামারের সংহতি ও ঐক্যরক্ষাই কুক্কুটসমাজের পবিত্র শ্রেণীকর্তব্য। কিন্তু পরের দিন পুনরায় সেই একই কান্ড। এইবার মিসেস ঝ্যাঁটামারি উধাও হইলেন। মিসেস ঝ্যাঁটামারি একটি বিষেষ লেগহর্ন জাতির মুরগি হইবার ফলে এই ঘটনার সুদূরপ্রসারী খামারনৈতিক অভিঘাতের কথা ভাবিয়া সকলেই যারপরনাই চিন্তিত হইয়া উঠিলেন। চাষিরও মাথাতে হাত। তাহার সুসজ্জিত বাগান চোখের সম্মুখে শুকাইয়া যাইতে বসিয়াছে। চাষি ভাবিতেছে হয় ইহা প্রতিবেশী খামারের হিংসুটে, চক্রান্তকারী মালিকের কারসাজি। নয় তো ইহা দূরের জঙ্গলের হিংস্র বাঘের সাম্রাজ্যবাদী হানা। এই সব সাতপাঁচ ভাবিয়া চাষি খামারের সম্মুখে পাহারা বসাইল। কিন্তু পরের দিন সেই একই ঘটনা পুনরাবৃত্ত হইল। এবার উধাও হইলেন মোরগকুলরত্ন পণ্ডিত খিস্তিরাজ তীক্ষ্ণচঞ্চু। পাহারা বাড়াইলেও কিছুতেই কিছু হয় না। এইভাবে একে একে মিসেস জ্বালামুখী, জনাব কাজিয়া মিঞা এবং সেনর পায়েপালাগানি নিরুদ্দেশ হইলেন। শেষে যখন একদিন সকালে অভিজাতবংশের রানা কোঁদলবাহাদুরকে খুঁজিয়া পাওয়া গেল না তখন মোরগ মুরগিরা সত্য সত্যই চাষির উপর বিশ্বাস হারাইল। ঝরা পালক ডাঁই করিয়া নির্মিত শহীদবেদীর সম্মুখে সংগ্রামী কুক্কুটসমাজ এক পা তুলিয়া প্রতিজ্ঞা করিল, জান কবুল আর মান কবুল, যে কোনো মূল্যে এই গুপ্তঘাতককে ধরিতেই হইবে। আজ হইতে কুক্কুটসমাজ নিজেরাই পাহারার ব্যবস্থা করিবে। তাহাতে যদি দু চার ডজন ডিম কম পাড়া হয়, বৃহত্তর আন্দোলনের স্বার্থে তাহাও সহ্য করিতে হইবে।

    সেই রাত্রে গ্রামের জমিদারের পেটা ঘড়িতে তৃতীয় প্রহরের সংকেত বাজিল ঢং ঢং ঢং। রংচঙে ঢং ছেড়ে মোরগবাহিনী এখন গেরিলা প্রতিরোধবাহিনীর ন্যায় সশস্ত্র সজাগ। তাহাদের ঝুঁটিতে ব্যারিকেডের সাতরঙা নিশান উড়িতেছে। ঠিক এইসময় খামারের মধ্যে ঝট্‌পট্‌ ঝট্‌পট্‌ শব্দ শ্রুতিগোচর হইল। প্রতিরোধবাহিনী অর্ধেক উড়িয়া এবং অর্ধেক দৌড়িয়া গিয়া দেখিল অতিবৃদ্ধ মোরগ শ্রী ভীমরতি তর্কবাগীশ মহাশয় গুরুতর আহত অবস্থায় মাটির উপর পড়িয়া আছেন। তাঁহার মুখে গঙ্গাজল দিবার পূর্বেই তিনি শশী কুমোরের ন্যায় "শিং, শিং' করিয়া কেলাইয়া পড়িলেন। ক্যাপ্টেন স্পার্ক বা প্রখর রুদ্র অকুস্থলে উপস্থিত না থাকিলেও কুক্কুটদের সংগ্রামী প্রজ্ঞা অতিশীঘ্র তাহাদের রহস্য সমাধানের পথে চালিত করিল। তদুপরি পূর্বরাত্রে একপশলা বৃষ্টি হইবার কারণে কুসুমে কুসুমে চরণচিহ্নের ন্যায় অপরাধীর ফুটপ্রিন্ট খামারের দিকে দিকে বিছাইয়া পড়িয়াছিল। মৃত্যুপথযাত্রী বৃদ্ধের অন্তিম উচ্চারণ এবং অপরাধীর পদচিহ্ন একটি সম্ভবনার দিকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করে কিন্তু ইহাও কি সম্ভব! যাহাই হউক, ক্রমাগত প্রাণহানির তাড়নায় অতীব ব্যথিত এবং সাম্যবাদী সমাজে আসন্ন শ্রেণীদ্বন্দ্বের আশঙ্কায় নিদারুণ চিন্তিত কুক্কুটসমাজ সেই রাতটি যে কিভাবে কাটাইয়াছিল তা তাহারা এবং তাহাদের ডিমেরাই জানে।

    পরদিন উষালগ্নে দেখিলাম শত শত কুক্কুট ব্যানার পোস্টার লইয়া গোহালের দিকে মিছিল করিয়া চলিয়াছে। সেই সব ব্যানারে "দড়ির বাঁধন কাটবে তুমি এমন শক্তিমান!', বা "বলদা নয়, বদলা চাই' ইত্যাদি লেখা ছিল। বয়োঃবৃদ্ধ গুটিকতক ষণ্ড পরমগম্ভীর মুখে আগাইয়া আসিলেন যেন ওডেসা স্টেপ বাহিয়া জারের কমিশারগণ আসিতেছেন। তাহার পর সমবেত হাম্বা এবং কোঁকোর কোঁ আমরা পাঠকদের সুবিধার্থে সাব-টাইটেলরূপে তুলিয়া দিলাম।

    - কি হল কমরেড? আপনারা এত উত্তেজিত?
    - আপনারা প্রতিদিন রাতের অন্ধকারে আমাদের উপর হামলা চালাচ্ছেন। আমাদের খুন করছেন।
    - আমরা গিয়ে আপনাদের খুন করছি? আপনাদের সবাই কি বার্ড ফ্লুতে ভুগছেন?
    - আমরা কোনো রোগে ভুগছি না। আপনারা ক্ষমতার দম্ভে প্রতিদিন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছেন।
    - মুরগির আবার কীসের মানবাধিকার?
    - আপনাদের ঘৃণ্য অপরাধ ঢাকতে কথা ঘোরাবেন না।
    - গল্পের গরু না হয় গাছে ওঠে। তাই বলে আপনারা খামারের গরুকে গুপ্তঘাতক বানিয়ে দিলেন?
    - কিছু বানাইনি, আপনারা যা তাই বলছি।
    - আপনারা তো দেখি পুরো মুরগি হয়েছেন।
    - আমরা তো মুরগিই, নতুন করে মুরগি হব কেন?
    - অভিযোগ যে তুলছেন, প্রমাণ এনেছেন?

    এইবার মুরগিদের মাথা চুলকাইবার পালা আসিলেও আসিতে পারিত, কিন্তু তাহাদের সবিশেষ সুবিধা করিয়া দিল ন্যাদোশ পাল। এই তরুণ তুর্কী গোশাবকটি বৃদ্ধদের পশ্চাতে দাঁড়াইয়া গোগ্রাসে এই তর্জা গিলিবার সময় ভুলিয়া গিয়াছিল তাহার মুখে গতরাত্রের হামলাজনিত রক্ত ও পালক লাগিয়া রহিয়াছে। এহেন রূপ লইয়া কুক্কুটসমক্ষে আসিয়া সে নিজের গুরুত্বÄ পুনরায় প্রমাণ করিল। মুরগি এবং মোরগেরা সমস্বরে চীৎকার করিয়া উঠিল।

    - ঐ তো ব্যাটা নরখাদক!
    - একবার বলছেন আপনাদের খেয়েছে আবার বলছেন নরখাদক! ঠিক করে বলুন।
    - ঐ তো ন্যাদোশবাবুর মুখে রক্ত আর পালক লেগে রয়েছে।
    - ওর ওইরকম সাজবার শখ।
    - গরু মুখে লিপিস্টিক মাখছে? বাঁদরামো হচ্ছে?
    - এ হে হে হে! তোমাদের মাথা তো একেবারেই গেছে! গরুতে করবে বাঁদরামো?
    - কথা না ঘুরিয়ে উত্তর দাও।
    - গরু যদি মুরগি শিকার করতে পারে, তাহলে সে লিপস্টিক মেখে ক্রস-ড্রেসিংও করতে পারে।
    - বাজে কথা রাখুন। ন্যাদোশবাবুকে গ্রেপ্তার করে ওনার ডি এন এ টেস্ট করা হোক।

    পশুখামারের চত্বর যখন কুক্কুট ও গাভীদের সমস্বরে নিনাদিত হইয়া উঠিয়াছে, এমন সময় কৃষকমহাশয় মঞ্চে প্রবেশ করিলেন। তাঁহার সবল যষ্ঠির সাহায্যে বিবদমান পশুদের পশ্চাতে লাগাইলেন ঠাঁই ঠাঁই ঠাঁই। কৃষকের যষ্ঠি দেখিলেই পশুদের আপনাপন শৃঙ্গ ও চঞ্চুর সদ্ব্যবহার ভুলিয়া বেকুব বনিয়া যায়। এই ক্ষেত্রেও তাহার ব্যত্যয় হইল না। পশু ও পক্ষীরা আপনাপন পুচ্ছ গুটাইয়া গোমড়ামুখে নিজ নিজ আস্তানায় প্রত্যাবর্তন করিল। কৃষক হরগিজ এইরূপ উত্তেজিত পশুদল দেখে নাই, তাও আবার তাহার নিজ খামারে। সবিশেষ উচ্চরক্তচাপ খাইয়া কৃষক সরজমিন তদন্তে বাহির হইল। প্রথমে সে গেল মুরগিদের কোঠাবাড়িতে। মুরগিরা মৃদুস্বরে, এবং বলাবাহুল্য অত্যন্ত গণতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে বলিবার চেষ্টা করিয়াছিল যে তদন্ত কমিটিতে তাহাদেরও সামিল করা হউক। তাহাদের সমস্বর সাব-অল্টার্ন কোঁকোঁ ধ্বনি অনুধাবনে অসমর্থ অত্যাচারী কৃষাক লাগাইল দুই ঘা। ইহার পর গোহালে পঁহুছিয়া দেখে কমরেড ন্যাদোশ রক্তরঞ্জিত ওষ্ঠগুলির মূহূর্মুহূ তাড়নায় চক্ষু বুজিয়া জাবর কাটিতেছে এবং বাকিরা কিঞ্চিৎ দূরে দাঁড়াইয়া সসম্ভ্রমে তাহার জাবর কাটা দেখিতেছে। ভাবটা "আমাদের দেশে হবে সেই ছেলে কবে' আশা পূর্ণ হইবার ভাব। এই অত্যাশ্চর্য পোষ্যটিকে দেখিয়া কৃষকেরও বিস্ময়ের সীমা নাই। দূর হইতে দেখিয়া কিন্তু মুগ্ধ চক্ষুতে চক্ষু না রাখিয়া কৃষক ঈষৎ চিন্তিত বদনে গৃহে প্রত্যাগমন করিল।

    এমতবস্থায় যাহা যাহা হওয়ার ছিল তাহার কিছুই হইল না। এইরূপ হইলে সাধারণত পাঁচ হাজার বৎসরের কৃষিসভ্যতার সরলমতিত্বের স্টিরিওটাইপ কৃষক আমিষাশী বাছুরটিকে গ্রাম্য সার্কাসদলে ভাড়া দিয়া দুই পয়সা আয় করিবার চেষ্টা করে। গ্রামের মেলায় ত্রিপলতলে নীল ভিডিওছবির পার্শ্ববর্তী তাম্বুতে সর্বশ্রেষ্ঠ আকর্ষণ চিকেনখেকো বাছুরটিকে একপলক দেখিবার জন্য মারকাটারি লাইন পড়িয়া যায়। তাহা হইল না। কেহ জানিল না যশোদানন্দন ব্রজদুলালের গোবৎসে কোন শুভক্ষণে করালবদনা মৃত্যুরূপা কালীমায়ের আবির্ভাব হইল। কৃষকের দালানে কৃষ্ণ ও কালীর জয়েন্ট ভেঞ্চার রম্‌রম্‌ করিয়া চলিতে পারিত। তাহাও হইল না। তারকানন্দ, তারকা নিউজ যাহাদের টি আর পি না বাড়িলে সমাজ পিছাইয়া পড়ে তাহারা চারঘন্টার এক্সক্লিউসিভ প্রোগ্রাম করিতে পারিত। কিছু সময়ের জন্য দর্শক পরমাণু চুক্তি অথবা কন্ডাক্টরের বদমাইশির ন্যায় সমাজসচেতন এবং বোরিং সংবাদ হইতে রক্ষা পাইতেন। তাহাও হইল না। নিদেনপক্ষে জিলার স্থানীয় বাংলা সংবাদপত্রে এক কলাম সংবাদ বাহির হইতে পারিত। তাহাও ঘটিল না। বাংলার সুশীলসমাজকে আলোকিত করিবার কোনোরূপ সদিচ্ছাই কৃষকটির মধ্যে দেখা গেল না। তাহার পরিবর্তে পরের দিন প্রভাতে সে শুধু নিজের স্ত্রীকে সব কিছু খুলিয়া বলিল এবং তাহার স্ত্রীর কিছু গহনা গ্রামের মহাজনের সিন্দুকে বাঁধা পড়িল। মহাজনমহাশয় সম্পন্ন কৃষকের এইরূপ ব্যবহারে কিঞ্চিৎ অবাক হইয়া দুই একটি প্রশ্ন করিলেও কৃষক হাটের মধ্যে কিছুই ভাঙিল না।

    ইহার ঠিক এক সপ্তাহ পরে কৃষকের পশুখামারে একদল বিলাতী ডিগ্রিধারী গোবৈদ্যের আবির্ভাব ঘটিল। এই এক সপ্তাহে কৃষক গরু ও মুরগির দলকে পরস্পরের নিকটে ঘেঁষিতে দেয় নাই। কেবল চিকেনাতুর ন্যাদোশকে প্রতিদিন ছাগমাংস কিনিয়া আনিয়া খাওয়াইয়াছে। দেখা গিয়াছে ন্যাদোশের কোনোপ্রকার মাংসেই বিশেষ অরুচি নাই। উপরন্তু তারুণ্যবশতঃ কোলেস্টেরল এবং ট্রাইগ্লিসারাইডাদি বাড়িবার সম্ভাবনাও কম। যখন গোবৈদ্যের দল কৃষকের গোহালে আসিয়া উপস্থিত হইলেন, ন্যাদোশ তখন তাহার ইস্পেশাল কুঠুরিতে জাবর কাটিবার ন্যায় মুদিত চক্ষে গতকল্যের নির্ভেজাল পাঁঠাটির ঠ্যাং চাটিতেছে। গোবৈদ্যের দল আশ্চর্য হইলেও প্রোফেশনাল গাম্ভীর্য বজায় রাখিলেন। কিন্তু ইহার পরে যাহা শুনিলেন তাহাতে তাহাদের যাবতীয় নির্বেদ মুহূর্তেই ভাগলবা হইল। স্বাভাবিকভাবেই তাহারা ভাবিয়া আসিয়াছিলেন কৃষক বেপথু হইয়া এই অস্বাভাবিক রোগ সারাইবার জন্য তাহাদের দুয়ারে ধর্না দিয়াছে। কিন্তু কৃষক উলটা কথা কহে। সে চায় একটি ন্যাদোশ নয়, গোবৈদ্যগণ শত শত ন্যাদোশ প্রস্তুত করুন। যে গরু শিকার করিয়া খায়, আবার দুধও দেয়, তাহার অসীম বাণিজ্যিক সম্ভাবনার কথা সে বাঘা বাঘা গোবৈদ্যকে সংক্ষেপে বুঝাইয়া দিল। তাহার শুধু একটিমাত্র দাবী। গবেষণা সফল হইলে লভ্যাংশের একটি মোটা ভাগ যেন তাহার পকেটে আসে। হায় রে উজালা সফেদ কৃষিসভ্যতা আমার! অপাপবিদ্ধ সরল খেটে খাওয়া কৃষকের দিন গিয়াছে।

    ইহার পর একমাস কাটিয়া গিয়াছে। গোবৈদ্যদের মধ্যস্থতায় একটি বহুজাতিকের সহিত কৃষকদম্পতি মৌ স্বাক্ষর করিয়াছেন। শীতাতপনিয়ন্ত্রিত একটি ইস্পেশাল কেবিনে চড়িয়া ইস্পেশাল মুরগির হাড় চিবাইতে চিবাইতে ন্যাদোশবাবু বিলাতযাত্রা করিয়াছেন। কিন্তু মুরগিদের সুশীল আন্দোলন আর বেশিদূর আউগায় নাই। গোবৈদ্যগণের নিদান মানিয়া কৃষক গরু ও মুরগিদের থাকিবার যাবতীয় আড়াল দূর করিয়া দিয়াছে। চব্বিশ গুণিতক সাত তাহারা একত্রে থাকে। ইহাদের পারস্পরিক হর্মোনশোঁকাশুঁকির এফেক্ট গোবৈদ্যগণ হাতেকলমে পরীক্ষা করিয়া দেখিতে চান। মুরগিগণ এখন ষাণ্মাসিক "মুর্গ কি আওয়াজ' পত্রিকায় জ্বালাময়ী প্রবন্ধ ছাপাইয়া নিজেদের অস্তিত্বের জানান দেন। ন্যাদোশবাবুর এহেন প্রস্থানে কমরেড গরুদের মনোবলও কিঞ্চিৎ ধ্বস্ত। কৃষকের কড়া নজরদারিতে বিশেষ ট্যাঁ ফোঁ, আরও সঠিকভাবে বলিতে গেলে হাম্বা রাম্বা করিবার উপায় নাই। কুক্কুটমাংসে কাহারও বিশেষ রুচি না আসায় কৃষকের হাতে প্রায়ই প্যাঁদানি খাইতে হইতেছে। শুধু ক্কচিৎ কদাচিৎ তাহারা গুলগুলগুল্লা গুলগুলগুল্লা জাতীয় ফাঁকা আওয়াজ করিয়া মুরগিদের ভীতিপ্রদর্শনের চেষ্টা করেন। কৃষকদম্পতি আশায় আশায় বসিয়া আছেন। আমরাও অপেক্ষায় আছি তাহারা নিশ্চয় তাহাদের শ্রেণীসম্পর্কিত অমর প্রবাদবাক্যটি মিথ্যা প্রমাণ করিবেন।

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১৪)
    -------------------------------------------------------
    তাকে
       রঙ্গন

    কে তুমি পদ্মপত্রে মুখ?
    কে তুমি আবাল্য অসুখ?
    আমার কিছুই মনে পড়ে না আজ।

    কিন্তু ক্কচিৎ প্রখরতার
    সঙ্গে মেশা প্রথম আলাপ --
    এইরকম কি ছিল?
    হেলাফেলা সারাবেলা
    প্যামফ্লেট আর পোস্টার মেলা
    অঢেল পোর্টিকোতে
    পুরনো সিঁড়িটা, বহু শোধবোধ,
    ভাঙা টিটিবোর্ড, বইয়ের গন্ধ,
    ট্রামরাস্তাটা বৃষ্টিতে দেখো নুইয়ে পড়ল --

    কে তুমি স্মৃতির মধ্যে জরা?
    কে তুমি অকাল স্বয়ম্বরা?
    আমার কিছুই মনে পড়ে না আজ।

    এখানে অনেক দেওয়াল,
    এবং আলগা আবছায়া,
    ধুলোয় ভরা রোদ, অনেক মানুষ --
    একা;
    ওদের মাথায় ভর
    দিয়েছেন বাদশাহী ঈশ্বর,
    সেই পবিত্র হারেমে
    এক বালিকা দেন দেখা।

    কে তুমি উন্মাদিনী রাই?
    কে তোমার নির্বাসনের সাঁই?
    আমার কিছুই মনে পড়ে না আজ।

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১৫)
    -------------------------------------------------------
     
    হিসেব
       রঙ্গন
         
    যতটা থাকে ততটাই যায়,
    তার বেশি তো যায় না;
    তবুও সারা সকালসন্ধে
    মুখের সামনে আয়না।

    আয়না যেন ঘরের আড়াল
    আটকে রাখে হাওয়া,
    আয়না বড় লক্ষ্মীমন্ত
    যখন যেমন চাওয়া।

    যেভাবে হবার সেভাবেই হয়,
    অন্যভাবে হয় না;
    যতই লুকাও শমীবৃক্ষে
    অস্ত্র এবং গয়না।

    (শারদ i-পত্রিকা ১৪১৬)
    -------------------------------------------------------
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে
          রঙ্গন

     
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে-
    দুধের সায়র নে চিনে।

    জঠর আগুন, যোনির আগুন,
    আকাশ লুটোয় সেই আগুনে;
    সময় অসীম, খেলছি খেলা,
    দেহের জমিন নে চিনে-
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে।

    স্তনের কোলে উড়ন্ত চাঁদ,
    বাঁধন ছেঁড়ে বৃন্ত কুসুম,
    ভীষণ ব্যথায় শরীর জুড়োয়,
    গহন ফুলের পাপড়ি খুলে
    জন্মসায়র নে চিনে-
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে।

    মরছে ছবি, শব্দ জাগে,
    গোপন কানে ফুলের বাগান,
    কি মোলায়েম শয্যা মা গো-
    এইখানে আজ জীয়ন আসর,
    আনন্দগান নে চিনে-
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে।

    মেঘ জ্বলছে জ্বলার আশায়
    বুকের শিকড় উপড়ে নিল,
    খেলার পরেও রাত্রি জাগর,
    শেষের পহর জাগছে লখাই,
    জন্মবৃক্ষ নে চিনে-
    বাঘ জেগেছে দক্ষিণে।
     
    (বৈশাখী,১৪১২)
    -------------------------------------------------------
     
    কী যন্ত্রণায় মরেছে পাথরে
        রঙ্গন
    অন্ধ বালক দু হাত ছড়িয়ে
    হাওয়ার পেছনে দিক ভুল করে ছুটছে;
    ঘরের উঠোনে দাঁড়িয়ে আছেন মা-
    মাটির তলায় ঘোর মৃদঙ্গ,
    তালে তালে দিন হিংসার আল্‌পনা।
    ঘর পুড়ে ছাই আর্ত দুপুরে
    মরা বাচ্চারা গাছে গাছে দোলা খাচ্ছে;
    দরোজার কোণে দাঁড়িয়ে রয়েছে মা-
    আঁতুড়ে ছড়ানো শুকনো রক্ত,
    সন্তান আর পেছনে ফিরছে না।

    সিঁদুর মাথায় শত বিধবার
    উদোম কোমরে আগুনের মালা দুলছে;
    ঠাকুরঘরের দেয়াল আঁকড়ে মা-
    জঙ্গলে খাকি ডালপালা জুড়ে
    মরা ভোরে বসে থার্ড ডিগ্রির থানা।

    ছেলের সামনে বাপের মাংস
    পাড়াপ্রতিবেশী দুহাত ডুবিয়ে খাচ্ছে;
    পেছনের ঝোপে রক্তে ভিজছে মা-
    লিঙ্গ উঁচিয়ে দোনলা বন্ধু,
    বদলার আগে কবরের প্রার্থনা।

    আজ থেকে আরও তিন চার মাসে
    শালজঙ্গলে পুরোনো বৃষ্টি নামছে;
    মায়ের শাড়িটা খুঁজেই পাচ্ছি না-
    আপাততঃ আয় নতুন বছর,
    শুরু করা যাক সেমিনার আলোচনা।
     
    (বৈশাখী, ১৪১৩)
    -------------------------------------------------------
    রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে টুক্‌রোটাক্‌রা
         বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    এখন কেবলমাত্র বাথরুমে নির্জনতা পাই , তাও মোবাইল ফোন না নিয়ে ঢুকলে। গিগাবাইট টেট্রাবাইটে কথা-সম্পর্ক-গিঁট-কূটকচালি-মনিটর, সার্ভার-সিরিয়াল-উৎসব-মেলা-টাকাপয়সার ভিড়। এর মধ্যেও কিবোর্ড চাপড়ে চাপড়ে কত লোক কত বন্ধু খুঁজছে! বন্ধুত্বের পোর্টফোলিও ডাইভার্সিফিকেশন- চল্লিশটা গেলেও আরও চল্লিশটা তো পড়ে থাকবে! এর মধ্যেও রাস্তাঘাটে, অটোতে, গাড়ি চালাতে চালাতে যখন সময়ের নির্জন স্বাক্ষরের আবছায়া দেখি, তখন স্নায়ুতন্ত্র এই নির্জনতা নিয়ে কী করবে ভেবে না পেয়ে থ মেরে বসে থাকে। অভ্যেস নেই কিনা! মগজের এই ভিড়ভাট্টা গাশোঁকাশুকির সময়ে আপনি ঠিক কোথায় দাঁড়িয়ে, শ্রীল শ্রীযুত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর? মিউজিক সিস্টেমে বাজতে থাকা গানের ওপারে?
    গান তো শুনি প্রায় প্রতিদিন। কিন্তু আপনার গানের অনুভূতিতেও হৃদয় ও কান খুব অভ্যস্ত এখন। "প্রথম আলোর চরণধ্বনি" শুনলে ঠিক কত শতাংশ উজ্জীবন আর কত শতাংশ দিওয়ানাপন হৃদয়ে মিশ খাওয়াতে হবে, বা "গোধূলি গগনে মেঘে" শুনলে কোন সময়ে দেখা কোন বর্ষার সন্ধ্যার কথা মনে করতে হবে, আর তার উপর সুপারইম্পোজ করতে হবে কোন না-পাওয়া সুন্দরীর মুখ, তাও ফাইল সিস্টেমের খাপেখোপে সযত্নে সঞ্চিত। আপনার গান ওষুধ তো বটেই- একটা অ্যান্টাসিড, বা ব্লাডপ্রেশারের গুলির সঙ্গে টুক করে গিলে নিই। সারাদিনের খাটুনির পর রিভাইটাল খাওয়া পল্টুদা মনে হয় নিজেকে। দোষ আমাদের। আপনি কী করে জানবেন কারফিউ কাকে বলে, কাকে বলে সিস্টেম, কাকে বলে এফিশিয়েন্সি! কিন্তু এই সিস্টেমের কোনখানে আপনি এϾট্র নেবেন, ভেবে দেখেছেন কি বিশ্বকবি গুরুদেব রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর?

    তাহলে আপনার বাঁচা কি এইভাবেই হবে? সিস্টেমের প্রতি মাইক্রোচিপে গেঁড়ে বসে থাকার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত- চাইলেই রিট্রিভ করে আনা যায়! নতুন করে পাবো কীভাবে - যদি কখনও নাই হারিয়ে যান? যদিও এই সিস্টেমিক বেঁচে থাকার মধ্যে আপনার নতুন নতুন ভার্শন বেরোবে-রকে বা রোয়াকে, ব্যান্ডে, নতুন ছন্দে, তন্ত্রে ও মন্ত্রে। পুরোনো ভার্শনও তো বেশ জোরালো যাচ্ছে- শ্যামা শাপমোচনের অশ্রুমোচন বা লাল শালুতে "আমি তোমাদেরি লোক"- মার্ক্সীয় রবীন্দ্রপ্রজ্ঞার সরকারি অবদান। কিন্তু বঙ্গসংস্কৃতির সার্ভারের মগডালে চড়ে এই স্বয়ংক্রিয় চন্নামেত্তোসেবন আপনার কেমন লাগে, বলবেন কি মিস্টার রবীন্দ্রনাথ টেগোর?

    কিন্তু কেলোটা ধরেছেন নিশ্চয় এতক্ষণে। আপনি একমাত্র মরা মানুষ যার সঙ্গে ডাইরেক্টলি কথা বলার চেষ্টা করি, এত বেয়াদব প্রশ্ন করি। কেন জানেন? ভুল করেও ভাববেন না আপনার লেখা আর গান খুব ভালো লাগে বলে। কোনোদিন বিভূতিভূষণ, সমরেশ বসু, অতুলপ্রসাদ কি সলিল চৌধুরী, এমনকি সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে কথা বলার কোনো চেষ্টা করিনি। কিন্তু আপনার ইউ এস পি কি জানেন মশাই? আসলে চারদিকে খুব ছোটো ছোটো ছাদের বেশি কিছু দেখতে পাই না। উপরে তাকালে ঐ বাস্তবিক আকাশটাকেও ছাদ মনে হয়। আর ছাদ মানে ওখানেই শেষ, একটা নিরেট গন্ডি। জমে থাকা ধুলো বালি ময়লা আকাশে উড়িয়ে দিতে চাইলে আকাশ কোথায় পাই বলুন তো? আপনাকে তখন ঐ আকাশের ডামি, নাকি আকাশ হিসেবেই ধরে নিই। কেন জিজ্ঞাসা করবেন না। আমিও জানি না। কিন্তু আকাশ সাপ্লাই দেওয়াতে আপনার এই অদ্ভুত মোনোপলি। কাজেই আপনার তারা সূর্য চাঁদ ঘুড়ি স্যাটেলাইট দেখতে দেখতে আমার ক্যাথারসিস হয়। আকাশে নিজের পনেরো শতাংশ দেখতে পাই। কিন্তু আমার এক শতাংশ দেখার আগেই আপনি পুড়ে গেলেন। সম্পর্কটা একটা মিউচুয়াল চেনাচেনির মধ্যে দিয়ে এগোলে কি আরও ভালো হত না, মহাশয় রবি ঠাকুর?
     
    (২৫শে বৈশাখ, ১৪১২)
    -------------------------------------------------------
    রবিবার্ষিকী
           বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    রবিমামা দেয় হামা গায়ে রাঙা জামা ঐ
    দারোয়ান গায় গান শোনো ঐ রামা হৈ।

    একদল শিশু লালপেড়ে শাড়ি পরে সক্কাল সক্কাল "ধোনিলো আওভানো মোধুরো গোম্ভিরো প্রোভাতো অম্বরোমাঝে" গাইতে গাইতে প্রভাতফেরি করবে। পঙ্কজ সাহার দলবল রবীন্দ্রসদন এবং জোড়াসাঁকোতে ভোর থাকতেই পৌঁছে যাবেন। তিনশো পয়ঁষট্টি দিনের একদিন তিন ঘন্টার জন্য দূরদর্শনের টি আর পি রেটিং শূন্য থেকে কিছুটা বাড়বে। গোড়ের মালার সেলও বাড়বে। মিডিয়া বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতির প্রপিতামহদের দুই হাজার ছয় সালে রবীন্দ্রনাথের প্রাসঙ্গিকতা নিয়ে প্রশ্ন করবে। এবং দুই হাজার ছয় বার সেই একই উত্তর দিতে প্রপিতামহরা ভিতরে ভিতরে উদ্দাম বোর হবেন। রবীন্দ্রসদনে সুন্দরী প্রায়প্রৌঢ়া বৌদি নস্টালজিক হয়ে কচি ছেলেটার গরমে ভেজা ঠোঁট দুটো দেখে এক্সট্রা দু কপি লিট্‌ল ম্যাগাজিন কিনবেন। বৃদ্ধ জরাগ্রস্ত গায়কের ধুর গান শুনে মেসোমশাইয়ের স্মৃতিমেদুর চোখের পাতা জলে ভিজে যাবে। কিছু উৎপটাং বুদ্ধিজীবী এইসব কান্ড দেখে বাবুইপাখির বাসার মতো চোখ তুলে অতিবিনম্র স্বরে শুধাবেন "রবীন্দ্রনাথ কি শুধুই নাচগান?' আর একদল আমোদগেঁড়ে ডিস্কে স্পেশাল রবীন্দ্রনাথ নাইট সেলিব্রেট করতে যাবে। রিমিক্সে বাজবে "প্রাণ চায় চক্ষু না চায়'। পাঁচতারা হোটেলে রবীন্দ্রখাদ্য সার্ভ করা হবে যেমন ফোর কোর্স ডিনারের নাম হবে "চতুরঙ্গ' বা ডেসার্টের নাম হবে "শেষের কবিতা"। অতিপক্ব তার্কিক খগেশ রবীন্দ্রনাথের নাম শুনে নাক মুখ কুঁচকে হাংরি কবিতা পড়তে বসে যাবে। পাড়ার ফাংশনে সুন্দরী মেয়ে টুসকি উত্তীয় সাজবে। রবীন্দ্রজয়ন্তীর সুবাসিত জমানায় পাড়ার ছেলেরা কম্পিটিশন দেবে টুসকিকে কে তুলতে পারে। সখীদের নাচে পিছনের সারিতে দাঁড় করাবার জন্য অনিন্দিতাবৌদি তার মেয়ের নাম উইথড্র করে নেবেন। "ডিম পাঁউরুটি/ ডিম পাঁউরুটি' বাজানো তবলচি ঠেকা দিতে গিয়ে ভিড়িয়ে দেবে। ফাংশন শুরুর ঠিক আগে কোটালের পাজামার থেকে সেফটিপিন খুলে পড়ে যাবে। এবং পাশের মাঠে লালটুদার সাথে ঝারি করতে যাওয়ার জন্য টুসকিকে খুঁজে পাওয়া যাবে না। পাড়ার রাজনীতির ডাইনামিক্স পালটাবে। দাদাবৌদিদের ঝগড়া বাড়বে, ছেলেমেয়েদের ভাবভালোবাসা বাড়বে, পরের বারের পুজো কমিটির সেক্রেটারির জন্য নতুন মুখ উঠে আসবে, তিন বছরের টুম্পা "ধর ধর ঐ চোর ঐ চোর' করে সারা বাড়ি নেচে বেড়াবে। এবং বাংলালাইভে এইরকম অতি হতচ্ছাড়া লেখা দিয়ে রবীন্দ্রসংখ্যা ছাপানো হবে।

    চিরনূতনেরে দিল ডাক, পঁচিশে বৈশাখ।
     
    (২৫শে বৈশাখ, ১৪১৩)
    -------------------------------------------------------
    সরীসৃপ
       রঙ্গন

    চক্ষু
    বসন্তের উদ্ধত রোদ্দুরে গৃহস্থের ব্যালকনিগুলো ঝলসাচ্ছে যখন তোমার তক্‌তকে ঠান্ডা মেঝেতে উদাস ময়াল সাপের দেহ। এসির খোপ দিয়ে চোঁয়ানো আলোতে ওদের পিঠগুলোতে সোনারঙের ফালি। ঠান্ডা হাওয়ায় ওড়ে সারি সারি বিছানার কান্নাসাদা থান। দেওয়ালে কেঁপে কেঁপে ওঠে স্নিগ্ধ পরিতৃপ্ত শরীরের স্মৃতি।

    স্মৃতি
    কতযুগ ধরে বাথরুমের বন্ধ কল থেকে টিপ্‌টিপে জল
    কতযুগ ধরে ফ্রিজের পিছনে বুনে যাওয়া মাকড়শার জাল
    কতযুগ ধরে তোমার সুটকেসে রাখা নীল বালুচরি
    কতযুগ ধরে আলমারির লকারে বাচ্চাটার ফটো,
    এই ঘরে

    গন্ধ
    একটু শস্তার চার্লি সেন্ট, সকালের চন্দনধূপ, ছেড়ে রাখা অন্তর্বাস, হঠাৎ পাওয়া শিভাস রিগাল, খদ্দেরের ছোঁড়া পাঁচশ টাকার বান্ডিল, ফেমিনার ছেঁড়া পাতায় পকোড়ার ঠান্ডা তেল, শুকিয়ে আসা গ্ল্যাডিওলার ঝাড়, কাল সন্ধেতে দেওয়া ঠাকুরের দু টুকরো পাকা পেয়ারা, জানলায় ভারী ভারী পর্দার ধুলো, রুটিন সমাপ্ত হলে আমাদের সম্মিলিত ঘাম,
    সেই সব গন্ধগুলো।

    জীবন
    আমাদের পিচ্ছিল সময়ে
    পাশের ফ্ল্যাটের ব্যালকনিতে মা তাঁর বাচ্চাকে তেল মাখাচ্ছিলেন;
    আমাদের উত্থানপতনের মুহূর্তে
    উপরের ফ্ল্যাটের একাকী বৃদ্ধ তাঁর প্রবাসী পুত্রের চিঠি পেলেন;
    আমাদের বিস্ফোরণক্ষণে
    মড়ার খাটিয়া কাঁধে একদল লোক গলন্ত পিচ পাড়িয়ে চলে গেলেন।

    ভিতর
    এই ঘরে বসন্ত বললেই তোমার মায়ের বসন্তমালতীর গন্ধ
    এই ঘরে বসন্ত বললেই আমাদের চামড়ার অযত্নের ভাবনা
    এই ঘরে বসন্ত বললেই ইউজ এন্ড থ্রো সাদা থান বেডশিট
    এই ঘরে বসন্ত বললেই বসন্তসেনার ইমিটেশন জুয়েলারি সেট
    এই ঘরে

    সঙ্গীত
    আন্ধার বাতাস হেথা কুসুম কুসুম।
    উঁচুনীচু মাংস লয়ে কুসুম কুসুম।
    মন নাই সেই ভালো কুসুম কুসুম।
    ফুল ফোটো নাই ফোটো কুসুম কুসুম।
     
    (বৈশাখী, ১৪১৪)
    -------------------------------------------------------
    আজ রাতে
       রঙ্গন

    পাগলা হাইওয়েতে গাড়িগুলো তারাদের মত জ্বলছে-
    উপরে চাঁদ সাক্ষী, হাওয়াতে বরফ সাক্ষী,
    আজ রাতে অনন্ত ম্যাজিকপার্টি হবে।
    আজ রাতে গাছেরা তাদের শিকড় দেখাবে।
    নিরন্ন ভিখিরি অসুখী গৃহস্থকে আশীর্বাদ দেবে।
    বরফের খোলা উঠোনে আজ অনন্ত ম্যাজিকপার্টি হবে।

    ছায়াপথ জুড়ে এসে দাঁড়িয়েছে মধ্যরাতের ট্রেন;
    বিপুল আলোর জোয়ারে কাঁপছে অশরীরী বুনোফুল;
    আধখাওয়া বুড়ো ভিখিরি ধরেছে প্রাথমিক মালকোষ;
    দু মূহুর্ত বাদে মুছে যাবে এই অলিখিত জংশন;

    শীতের জঙ্গলে একা অন্ধ যাজক ম্যাজিক দেখবেন-
    উপরে চাঁদ সাক্ষী, হাওয়াতে বরফ সাক্ষী,
    পুড়ে যাওয়া বেসমেন্ট থেকে আজ পরীরা বেরোবে।
    উড়ন্ত ডাইনীর দল মেঘে মেঘে মশাল জ্বেলে দেবে।
    নগ্ন দেবদূতের স্কেটের গতিতে বরফে স্ফুলিঙ্গ ছুটবে।
    বরফের জঙ্গলে আজ অনন্ত আহ্লাদের রাত।

    হে বিনিদ্র চন্দ্রমা, তুমি থাকো।
    হে উন্মাদ হাইওয়ে, তুমি থাকো।
    হে আবিষ্ট অরণ্য, তুমি থাকো।
    হে উদাসীন ভিক্ষুক, তুমি থাকো।
    হে চঞ্চল দেবদূত, তুমি থাকো।
    হে অসহায় গৃহস্থ, তুমি থাকো।
    হে নিষ্পাপ শূন্যতা, তুমি থাকো।
    হে অদৃশ্য অসময়, তুমি থাকো।

    আজ রাতে অনন্ত ম্যাজিকপার্টি হবে।
     
    (বৈশাখী, ১৪১৫)
    -------------------------------------------------------
    ভালোবাসা বিষয়ক
       রঙ্গন
     
    Could Not Recover
    (বৈশাখী, ১৪১৬)
    -------------------------------------------------------
     
  • b | 14.139.***.*** | ২৪ নভেম্বর ২০২৩ ১০:২৯741463
  • যিনি এইসব পুরনো লেখাগুলো তুলে আনছেন, তাঁর শ্রীচরণে শত শত নমন ও লাল সেলাম। 
  • &/ | 151.14.***.*** | ২৫ নভেম্বর ২০২৩ ০০:১০741467
  • খুবই চমৎকার, খুবই চমৎকার। কী সব দিনকাল ছিল! ইন্টার-অ্যাক্টিভ সব লেখকগণ, তাঁদের ঋদ্ধ পাঠকেরা, ক্রমাগত তৈরী হয়ে চলা কাহিনিমালা---সে এক অন্য জগৎ। মাধবীলতার বারান্দা, শূন্যলোকের কমল-সরোবর।
  • বাংলালাইভ নাটক সমালোচনা - বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী | 43.25.***.*** | ২৯ নভেম্বর ২০২৩ ২১:১৩741492
  • পরের দিকের আরো ৩৭টা গল্প আছে এখানে 
     
    ১৬টা কবিতা
     
    ধারাবাহিক
     
    সব মিলিয়ে মোটমাট ১৪০ টা নতুন ম্যাগাজিন আইটেম ইতিমধ্যে i-পত্রিকা পাল্টে হয়েছে ম্যাগনেট নব-i-পত্রিকা। অনিন্দ্য লিখছেন সম্পাদকীয় সহজপাঠ। এসব জানতামই না, এই দেখছি সবে।
     
    পরের দিকের মজলিশ
     
    যাই হোক, প্রবৈচ-র বাকি সব লেখা যখন ইউনিকোডে জমানোই রইল তখন নাটকের সমালোচনা তিনটেও থাক। 
     
    Jan 24 2008
     
    আদতে এটি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটির হুবহু মঞ্চরূপ
    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী
     

    দশম লোককৃষ্টি নাট্যোৎসবের উদ্বোধনী দিনে মঞ্চস্থ হল নাট্য আননের প্রযোজনা হীরক রাজার দেশে। উনিশশো আশিতে সত্যজিৎ রায় যখন সিনেমাটি বানিয়েছিলেন, তখন বাঙালি সমাজে শ্রেণীদ্বন্দ্ব, স্বৈরতন্ত্র, মায় রাষ্ট্রবিপ্লব নিয়ে ঘনঘোর আলোচনা নিত্য অভ্যাসের মধ্যে ছিল। তার সাতাশ বছর পরে কিছু দুর্ভাগ্যজনক ঘটনার ফলে মধ্যবিত্ত বাঙালির ব্রেকফাস্টের টেবিলে পুনরায় এই শব্দবন্ধগুলো ফিরে এসেছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে হীরক রাজার দেশের নাট্যাভিনয়ের সংবাদ উৎসুক করেছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে প্রযোজনাটি পুরোপুরি হতাশ করল। যে কোনো জনপ্রিয় অতিচেনা প্রযোজনাকে অন্য মাধ্যমে পুনরাভিনয়ের মধ্যেই একটা ঝুঁকি থাকে, বিশেষত তা যদি হয় সত্যজিৎ রায় পরিচালিত সর্বজনপ্রিয় একটি চিত্রনাট্যের পুনরাভিনয়। এই ঝুঁকি এড়াতে সাধারণত প্রয়োগকারেরা মূল স্ক্রিপ্টে কিছু মৌলিক অদলবদল করতে বাধ্য হন। এই অদলবদলের মধ্য দিয়েই আমাদের অতিচেনা গল্পের নবতর ভাষ্যের খোঁজ পাই।

    নাট্য আননের এই প্রযোজনার প্রথমেই যখন ম্যাকবেথ অনুকরণে তিন ডাইনি আসে, তারপর তিন ডাইনির ডাকে ভূতের রাজা ও রাণীর কমিক আবির্ভাব ঘটে, মনে হয় নাট্য আনন এই চেনা গল্পের কোনো অচেনা আদল খুঁজে পেয়েছে। প্রথম তাল কাটে যখন গুপি আর বাঘাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য এক নপুংসক ভূত মঞ্চে আসে। এইধরনের অসহনীয় এবং অপ্রয়োজনীয় রসিকতা বাংলা নাটকে ইদানীং দেখা যায় না। এর পর হীরকরাজার দরবার থেকে দড়ি ধরে মারো টান অবধি চিত্রনাট্যের ট্রু কপি। এইযুগের ছোঁয়া নিয়ে আসতে কিছু কিছু জায়গায় এটা ওটা গুঁজে দেওয়া হয়েছে, কিন্তু আদতে এটি সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাটির হুবহু মঞ্চরূপ, এবং এই অনুকরণ শুধু গল্পের ক্ষেত্রেই নয়, মেক আপ থেকে শুরু করে সংলাপকথনের স্টাইল পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জাগে, যে দর্শকেরা হীরক রাজার দেশে দেখেছেন, দেখছেন ও দেখবেন, তাদের সেই একই জিনিস স্টেজের মধ্যে পরিবেশনার কি যৌক্তিকতা?

    এসব সত্ত্বেও নাট্য আননের কাছে কেল্লা ফতে করার সুযোগ ছিল। এইচ এম ভি তাদের সিনেমার মূল গানগুলি ব্যবহারের অনুমতি দেননি। কাজেই খরাজ মুখোপাধ্যায় নিজেই গান বেঁধে গানে সুর দিয়েছেন, যা শাপে বর হতে পারত। সত্যজিৎ রায়ের সুরারোপিত গান আমাদের প্রত্যহের অঙ্গ হয়ে যাওয়ায় কাজটা খুব কঠিন ছিল, কিন্তু মঞ্চে খরাজের লেখা ও সুর করা গানগুলি শুনতে খারাপ লাগে না। এই গানগুলি দিয়ে বাজিমাত করা যেত যদি অভিনেতা অভিনেত্রীদের সমস্বরে সুরে তালে মঞ্চটা ঝম্‌ঝম্‌ করে বেজে উঠত। সেটাই এইধরনের মিউজিকাল ঘরানার প্রযোজনার থেকে স্বাভাবিক প্রত্যাশা থাকে। অথচ সে সব কিছুই হল না। সব গানবাজনাই হল ব্যাকগ্রাউন্ডে এবং স্টেজের অভিনেতা অভিনেত্রীরা স্রেফ মুখ নেড়ে গেলেন। বাংলা মঞ্চে গান জানা মানুষের কি অভাব পড়িয়াছে? অসংখ্য চরিত্র এলো গেল, যা হবার ছিল সবই হল, রাজার নাক কাটা গেল, গবেষকে হীরে পেল, উদয়ন পন্ডিত বিদ্রোহ করল, শুধু একটা জিনিসই হল না। দর্শকেরা একবারও স্বত:স্ফূর্তভাবে হাততালি দিয়ে উঠলেন না, যা এইধরনের জম্‌জমাট নাটকের স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। পাক্কা দুটো ঘন্টা এত চেষ্টা সত্ত্বেও নাট্য অভিজ্ঞতা হিসেবে "হীরক রাজার দেশে" একেবারেই ম্যাড়মেড়ে হয়ে রইল, একটিও নাট্যমুহূর্ত তৈরি হল না যা মনে রাখার মতো।

    তার উপর আলোকসম্পাতের তুঘলকি চাল যন্ত্রণা বাড়িয়ে দিয়েছিল। জানি না দোষ কার, কিন্তু বারে বারে আলো অভিনেতা অভিনেত্রীদের ঠিক জায়গায় ধরতে ব্যর্থ হচ্ছিল। এই প্রযুক্তিগত সমস্যা শুধু এই প্রযোজনার সমস্যা নয়, বাংলা নাটকের আরও নামী দামী প্রযোজনায় লক্ষ করেছি। জানি না কে বা কারা বেড়ালের ঘলায় ঘন্টা বাঁধবেন বা বাঁধছেন? অভিনয়ের ক্ষেত্রে প্রত্যেকেই যথাযথ, কারণ প্রায় প্রত্যেকেই সত্যজিৎ রায়ের পরিচালিত পথ অনুসরণ করেছেন মাত্র, নতুন কিছু রূপায়ণের বিড়ম্বনায় পড়তে হয়নি। চন্দন সেন হীরকরাজার ভূমিকায় আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, কিন্তু তাঁর ছোটোখাটো চেহারা হীরকরাজার ক্ষমতার প্রাবল্যকে রূপ দিতে পারে না, মজার দিকটাই প্রাধান্য পেয়ে যায়- উৎপল দত্তের স্মৃতির সামনে দাঁড়িয়ে চন্দন বড়ই অসহায়। গুপীর ভূমিকায় রাজেশ কর্মকার ও বাঘার ভূমিকায় বাসুদেব সাহাকে খারাপ লাগে না। উদয়ন পন্ডিতের চরিত্রে শান্তিলাল মুখোপাধ্যায়ের অভিনয়ই সব থেকে পরিণত ও হৃদয়গ্রাহী।

    নাট্যোৎসবের সূচনা খুব একটা উৎসাহব্যঞ্জক না হলেও, আশা রাখি পরের প্রযোজনাগুলিতে এই হতাশা কাটিয়ে ওঠা যাবে।

    নাটক: হীরক রাজার দেশে
    প্রযোজনা: নাট্য আনন
     
    Jan 25 2008
     
    থিয়েটার জগতের নিরিখে সর্বার্থে মাল্টিস্টারার নাটক "আরোহণ'
    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    লোককৃষ্টি নাট্যোৎসবের দ্বিতীয় দিনের নাটক ছিল থিয়েটার জগতের নিরিখে সর্বার্থে মাল্টিস্টারার। মুখোমুখি প্রযোজিত "আরোহণ' নাটকটির রচনা, নির্দেশনা ও অভিনয় করেছেন সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়, তার সঙ্গে অভিনয়ে সঙ্গত করার জন্য ছিলেন দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায়, খেয়ালি দস্তিদার, বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, জগন্নাথ গুহ, পৌলমী বসুর মতো পোড়খাওয়া অভিনেতা অভিনেত্রী, অঞ্জনা বসুর মতো বাংলা সিরিয়ালের খুব চেনা নায়িকা। মূল নাটকটির অনুপ্রেরণা তিরিশের দশকের শেষের দিকে লেখা লিলিয়ান হেলম্যানের "দ্য লিট্‌ল ফক্সেস'- সেই সময়ের ব্রডওয়ের মারকাটারি হিট। ১৯৪১ সালে উইলিয়াম ওয়াইলার এই নাটকটিকে সিনেমার পর্দায় নিয়ে আসেন যে সিনেমাটির মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেন বেটি ডেভিস। পরবর্তীকালে ব্রডওয়েতে বহুবার এই নাটকটি পুনরাভিনীত হয়, যেমন ১৯৮১ সালের পুনরাভিনয়ে মূল অভিনেত্রী ছিলেন এলিজাবেথ টেলর। মার্ক ব্লিৎজস্টাইন এই নাটক অবলম্বনে "রেজিনা' নামে একটি অপেরাও লিখেছিলেন। যে কোনো ব্রডওয়ে ও হলিউড ক্লাসিকের মতো এই নাটকেরও মূল উপজীব্য তার কাহিনী এবং সেই কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে চলা জম্‌জমাট অভিনয়।

    গপ্পোটি মূলত নব্যধনী পরিবারের তিন ভাই বোনকে ঘিরে যারা এক প্রবাসী ভারতীয় ভদ্রলোকের সঙ্গে জয়েন্ট ভেঞ্চারে ফুড প্রোসেসিং প্ল্যান্ট খুলতে যাচ্ছেন। এই ব্যবসার সম্ভাবনাকে কেন্দ্র করে তিন ভাই বোনের উদগ্র লোভ ও ল্যাং মারামারির খেলায় বাদ সাধে পরিবারের জামাই। তার এই কাজে নৈতিক সমর্থন যোগায় তার পালিতা কন্যা ও ছোটো ভাইয়ের স্ত্রী। কিন্তু তার ভগ্নস্বাস্থ্যের জন্য সে তার লড়াই খুব বেশিদূর নিয়ে যেতে পারে না। এই দাবাখেলায় আপাতত কিস্তিমাত করে পরিবারের মেয়েটি, যে একদিকে পথের কাঁটা তার স্বামীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়, অন্যদিকে ভাইদের ব্ল্যাকমেলের মুখে দাঁড় করিয়ে তার সমস্ত দাবী মেনে নিতে বাধ্য করে। মুখোমুখির নিজস্ব ভাষায়: "আরোহণ লোভের কাহিনী, চক্রান্তের কাহিনী; এক অন্ধকার পারিবারিক নাটক, যেখানে স্বার্থ এবং উচ্চাশা বিলীন করে দিয়েছে মায়া-মমতাকে।.........আরোহণের পৃথিবী আপনার-আমার এত পরিচিত দুনিয়া, যে আপনি ভয় পেয়ে যাবেন।" আমাদের এই দুনিয়ায় অবশ্যই এই গল্পের কিছু বৃহত্তর সামাজিক তাৎপর্য রয়েছে, তবুও এই নাটকটিকে ব্যক্তিগত মনস্তাত্ত্বিক ঘাতপ্রতিঘাতের জম্‌জমাটি নাটক হিসেবে দেখাই শ্রেয়।

    সৌমিত্রবাবু নাটকটির মঞ্চায়নেও ধ্রুপদী বাণিজ্যিক থিয়েটারের ধারা গ্রহণ করেছেন। বাস্তববাদী মঞ্চসজ্জা, পরিমিত আবহ ও আলোকসম্পাতের যথাযথ প্রয়োগে নাটকটির মূল সূত্র থাকে অভিনেতা অভিনেত্রীদের হাতে। বিদেশে যতবার নাটকটির অভিনয় হয়েছে, ততবার নাটকটির কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিল পরিবারের লোভী এবং বিবেকহীনা স্বার্থপর বোনটি। এখানে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ের উপস্থিতিতে একটা ঝুঁকি ছিল ফোকাস অন্য চরিত্রগুলির থেকে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় অভিনীত বোনের স্বামী চরিত্রটির দিকে সরে যাবে। কিন্তু সৌমিত্রবাবু তাঁর অভিনয়ে অদ্ভুত কুশলতায় সেই পরিমিতি রক্ষা করেছেন, যার দৌলতে চরিত্রটির যতটুকু প্রাপ্য ঠিক ততটুকুই পেয়েছে। যদিও নাটকটি বিবর্তিত হয় খেয়ালী দস্তিদার অভিনীত ছোটো বোনের চরিত্র ঘিরে, এই প্রযোজনায় তাকে ছাপিয়ে গেছেন বড় ভাইয়ের চরিত্রে দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় ও ছোটো ভাইয়ের চরিত্রে বিশ্বজিৎ চক্রবর্তী, যারা নাটকটির দুটি স্তম্ভ। অবিবাহিত কূটবুদ্ধি সাবেকী ঘরানার বড়ো ভাই এবং স্থূলরুচি নিষ্ঠুর স্বল্পবুদ্ধি ছোটো ভাই- দুটি চরিত্রই বেশ ছাঁচে ফেলা চরিত্র যাতে একটা ক্লিশে হয়ে যাওয়া ছক অনুসরণের ঝুঁকি থাকে। কিন্তু এই দুই অভিনেতা সেই ক্লিশে সযত্নে এড়িয়ে গিয়ে দুটি চরিত্রকে সম্পূর্ণ বিশ্বাসযোগ্য রক্তমাংসের চরিত্র করে তুলেছেন। বরং খেয়ালী দস্তিদারের অভিনয়ে মনে হয়েছে উৎরাই চড়াই বড়ো কম, বিশেষত তীক্ষ্মকণ্ঠের উচ্চকিত ব্যবহারে কখনই চরিত্রটি আরও একটু বেশি আলোআঁধারি দেখাবার স্পেস পায় না। এই নাটকের যে দুটি তুঙ্গ মুহূর্ত- এক, বোন যখন নিজের স্বামীকে প্রায়-হত্যা করে, এবং দুই, বোন যখন ভাইদের তার ব্ল্যাকমেলের পরিকল্পনা জানায়, সেই মুহূর্তগুলোয় মনে হয় নাটকীয় অভিঘাতের মাত্রা একটু কম পড়ে গেল, টেম্পোটা পুরোপুরি তৈরি হল না। তবে সেটা সার্বিক প্রয়োগ-পরিকল্পনার ত্রুটিও বটে। অন্যান্য চরিত্রে জগন্নাথ গুহ, পৌলমী বসু, সুমিতা বন্দ্যোপাধ্যায়, নবকুমার ব্যানার্জী, মৃণাল ব্যানার্জী এবং অঞ্জনা বসু যথাযথ।

    ইদানীং গ্রুপ থিয়েটারের কর্ণধারদের খেদোক্তি শুনতে পাই- কলকাতার বাণিজ্যিক থিয়েটার ধ্বংস হয়ে গিয়ে যত না বাণিজ্যিক থিয়েটারের ক্ষতি হল, তার থেকে অনেক বেশি ক্ষতি হল গ্রুপ থিয়েটারের। থিয়েটারের দিকে দর্শক টেনে আনার জন্য গ্রুপ থিয়েটারের সঙ্গে এখন আর কোনো সক্ষম সহযোদ্ধা নেই, একা লড়াই করতে হচ্ছে টিভি সিরিয়ালের মতো প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বীর বিরুদ্ধে। অন্যদিকে প্রযোজনার গুণগত মানবৃদ্ধির তাগিদটাকে উস্কে দেওয়ার জন্য সামনে কোনো বলশালী প্রতিযোগীও নেই। এখন থিয়েটার মানেই গ্রুপ থিয়েটার। এই সব খেদ ও দু:খ আরও দেড় যুগ আগে ঘটলে উত্তর কলকাতায় থিয়েটার হলের সংখ্যা কমে বিয়েবাড়ির সংখ্যা বেড়ে যেত না। এই ধ্বংসাবশেষের মধ্যে সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রায় একাই এই অবলুপ্ত থিয়েটারের ধারা পুনরুজ্জীবনের লড়াই চালিয়েছেন ও চালাচ্ছেন। "আরোহণ' সেই ধারারই অন্যতম দর্শকমনোগ্রাহী প্রযোজনা হয়ে রইল।
     
     
    Jan 29 2008
     
    স্টেজে এত বড় ক্যানভাস নিয়ে "পুতুলনাচের ইতিকথার' চ্যালেঞ্জ কঠিনতর
    বৈজয়ন্ত চক্রবর্তী

    লোককৃষ্টি নাট্যোৎসবের তৃতীয় দিন ছিল দুর্যোগপূর্ণ, অবিশ্রাম টিপ্‌টিপ্‌ বৃষ্টির সঙ্গে হাড়কাঁপানো জোলো হাওয়া। এই অকালবর্ষণ উপেক্ষা করেও বেশ ভালো সংখ্যক দর্শক এসেছিলেন, যদিও তা অন্যদিনের থেকে অনেক কম। সেদিন ই জেড সি সির পূর্বশ্রী প্রেক্ষাগৃহে মঞ্চস্থ হল চেতনা প্রযোজিত অরুণ মুখোপাধ্যায় নির্দেশিত মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের "পুতুলনাচের ইতিকথা'। অরুণ মুখোপাধ্যায়  নির্দেশনার জগতে বেশ কিছুদিন একটু চুপ করেছিলেন, এবং সেই আড় ভাঙলেন এমন একটি নাট্যপ্রয়াসের মধ্যে দিয়ে, যা কোনো নাট্যপরিচালকের কাছে এক অভ্রংলিহ চ্যালেঞ্জ। অরুণবাবুর এই স্পর্ধিত প্রয়াসকে সেলাম জানাবার জন্য প্রেক্ষাগৃহে আরও বেশি দর্শক না থাকাটা দুর্ভাগ্যজনক। এই দুর্যোগের মধ্যে আরও গোল বাঁধিয়েছিল প্রেক্ষাগৃহের শব্দক্ষেপণ ব্যবস্থা। এই প্রতিবেদক প্রথম সারিতে বসার সুবাদে পুরো নাটকটি তারিয়ে তারিয়ে উপভোগ করলেও, পেছনের দিকে অনেকেই নাকি প্রথমার্ধের বেশির ভাগ সংলাপ শুনতে পাননি। হয়তো সেই কারণেই সাধুবাদ জ্ঞাপনে দর্শকদের একটু কুন্ঠিত মনে হল, এমন কি নাটক শেষ হবার পরে অরুণ মুখোপাধ্যায় ছাড়া মঞ্চে আর কেউ দর্শকের অভিনন্দন নিতে এলেন না। অথচ এতরকম বিঘ্ন এই প্রযোজনাটির প্রাপ্য ছিল না।

    যে কোনো এপিক ধাঁচের উপন্যাসকে মঞ্চ বা চলচ্চিত্রের পরিসরে ধরতে পারা খুব কঠিন কাজ। সাম্প্রতিককালে কলকাতার স্টেজে এত বড় ক্যানভাস নিয়ে "তিস্তাপারের বৃত্তান্ত', "সোজনবাদিয়ার ঘাট' বা "পদ্মানদীর মাঝি'র মতো কিছু কাজ হয়েছে। কিন্তু "পুতুলনাচের ইতিকথার' চ্যালেঞ্জ কঠিনতর। এক নম্বর চ্যালেঞ্জ হল এই জাতীয় উপন্যাসে স্বাভাবিক নিয়মেই অসংখ্য কাহিনী ও উপকাহিনী একে অন্যের সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে কখনও সমান্তরালভাবে আবার কখনও একমুখী হয়ে চলতে থাকে। নাটকের প্রয়োজনে এই মহীরুহসমান কাহিনীকে কেটেছেঁটে সুসংহত ও গতিবান করে তুলতে হয়, অথচ এইটুকু খেয়াল রেখে যাতে মূল কাহিনীর যাবতীয় স্বাদবর্ণগন্ধ অক্ষুণ্ন থাকে। দ্বিতীয়ত, "পুতুলনাচের ইতিকথার' কাহিনীর সঙ্গে জড়িয়ে থাকে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভাবনাচিন্তার অসংখ্য সূত্র যেগুলোকে যদিও বা চলচ্চিত্রে ভাষান্তর করা যায়, নাট্যভাষায় তার রূপান্তর এক দুরূহতর সমস্যা। এই সমস্যা সমাধানের একটি উপায় অরুণবাবু বেছে নিয়েছেন। অরুণবাবুর কথাতে- "এ নাটকে ভাষ্যকে প্রায়-অনিবার্য বলেই মনে হয়েছে। যদিও ভাষ্য সম্পূর্ণ বাদ দিয়েও কেউ এই উপন্যাসের সার্থক নাট্যরূপ দিতে পারেন বলেই আমার বিশ্বাস।' অর্থাৎ নেপথ্যে সুব্রতনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্ঠভাষ্য দিয়ে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হয়, অথবা লেখকের ভাষাতেই টীকাটীপ্পনী যোগ করে দিতে হয়। এই উপায় "তোমার মন নাই কুসুম?'-এর মতো প্রবাদপ্রায় সংলাপকে খেলো উচ্চারণের হাত থেকে যেমন রক্ষা করে, অন্যদিকে যাদব পণ্ডিতের মৃত্যুর অভিঘাতকে বেশ লঘু করে দেয়। এই ব্যাপারটা মাঝে মাঝেই ঘটেছে। দর্শকের চোখ কান উভয়ই যখন মঞ্চস্থ দৃশ্য শ্রাব্যে মজে গেছে, তখন হঠাৎ হঠাৎ নেপথ্যভাষ্য সেই অভিনিবেশকে নষ্ট করে। অথচ অন্য কোনো উপায়ের সন্ধান না থাকায় আপাতত পরিচালক নিরুপায়ও বটে।

    এইরকম কিছু কাঠামোগত সমস্যাকে বাদ দিলে এই প্রযোজনার মূল স্পিরিট নিয়ে অনুযোগ করার কিছু থাকে না। বিশাল মঞ্চকে মূলত তিন জোনে ভাগ করা হয়েছে- একদিকে কুসুমের ঘরগেরস্থালি, অন্যদিকে শশী ডাক্তারের ঘর আর মাঝের বহুতলবিশিষ্ট প্ল্যাটফর্মে বাকি সব চলমান দৃশ্যের অভিনয়। মঞ্চের  প্রায় প্রতিটি কোণ ব্যবহার  করে এই জোনভিত্তিক অভিনয় নাটকটির এপিক সুরটি তৈরি করতে সাহায্য করে। সাহায্য করে মুরারী রায়চৌধুরীর সঙ্গীত পরিচালনায় পুরানো রেকর্ডের গান, পুরানো যাত্রা ও থিয়েটারের সুর। এই সঙ্গীত ও মঞ্চপরিকল্পনার সঙ্গে যথাযোগ্য সঙ্গত করে আলোকসম্পাত, পোশাক ও রূপসজ্জা। বিদেশের চলচ্চিত্রে ও মঞ্চে কাস্টিং পেশাটির যত কদর, আমাদের থিয়েটারের স্টেজে সেইভাবে কাস্টিং করার চল নেই। মোটামুটি হাতের কাছে যা পাওয়া যায় তা দিয়েই কাজ চালিয়ে নেওয়া হয়। এই উদাসীনতার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযোজনাটি একটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হয়ে রইল। প্রত্যেকটি মূল চরিত্রের কাস্টিং দেখে মনে হয়েছে- মানিকবাবু হয় তো ঠিক এইরকমই ভেবেছিলেন! শশী ডাক্তারের চরিত্রে বিপ্লব বন্দ্যোপাধ্যায় পুরো নাটকটিকে বেঁধে রাখেন। কুমুদ চরিত্রে অনিন্দ্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের সপ্রতিভ বোহেমিয়ান ভাব চরিত্রের পক্ষে যথাযথ। অরুণ মুখোপাধ্যায় নিজে অল্প সময়ের জন্য যাদব পন্ডিতের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন, মাপজোক করা সঠিকমাত্রার অভিনয় হলেও মনভরানো কিছু নয়। অসাধারণ অভিনয় করেছেন কুসুমের চরিত্রে মনীষা আদক। এর পরে "পুতুলনাচের ইতিকথা' পড়তে গেলে কুসুমের আদলে মনীষাকে না মনে পড়ার কোনো উপায় নেই। একদিকে শশী ডাক্তার-কুসুম এবং অন্যদিকে কুমুদ-মতির রোমান্সের রসায়ন খুব বিশ্বস্তভাবে রূপায়িত হয়েছে। বাংলা নাটকে অতিরিক্ত নাটুকেপনা ছাড়া রোমান্সের এই মঞ্চরূপ বেশ বিরল। বাকিরাও অন্যান্য চরিত্রে দক্ষতার সঙ্গে তাদের ভূমিকা পালন করেছেন।

    নাটকটি দেখতে দেখতে কিছু কথা মনে হচ্ছিল যা হয় তো এই প্রতিবেদনে একটু বিক্ষিপ্ত চিন্তা। ইদানীং বিভিন্ন সাম্প্রতিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে বৌদ্ধিক মহলে গ্রামবাংলা ও কৃষিসভ্যতা নিয়ে একধরনের শহুরে ফ্যান্টাসি ও আদেখলাপনা দেখা যাচ্ছে। অথচ বাংলা সাহিত্যকে যদি ইতিহাসের দর্পণ মেনে নিয়ে থাকি, তাহলে পাঁচ হাজার বছরের কৃষিসভ্যতা নিয়ে এই ধরনের আদেখলাপনা ইতিহাসে অদৃষ্টপূর্ব। যে "আরণ্যক'কে বাঙালী প্রকৃতিপ্রেমের পরাকাষ্ঠা ভেবে এসেছে, সেই উপন্যাসের শেষ অংশ আমরা সহজে ভুলে যাই যেখানে লবটুলিয়াতে জঙ্গল সাফ করে মানুষ চাষবাস শুরু করেছে- "শীতকালের মাঝামাঝি যখন সর্ষেক্ষেত হলুদ ফুলে আলো করিয়াছে, তখন যে দৃশ্য চোখের সামনে উন্মুক্ত হইল, তাহার তুলনা নাই। দেড় হাজার বিঘা ব্যাপী একটা বিরাট প্রান্তর দূর দিগ্বলয়সীমা পর্যন্ত হলুদরঙের গালিচায় ঢাকা, এর মধ্যে ছেদ নাই, বিরাম নাই- উপরে নীল আকাশ, ইন্দ্রনীলমণির মত নীল- তার তলায় হলুদ-হলুদ রঙের ধরণী, যতদূর দৃষ্টি যায়। ভাবিলাম এও একরকম মন্দ নয়।" এইভাবেই তৈরি হয় মানুষের চিরাচরিত আখ্যান- পুতুলনাচের নতুন নতুন ইতিকথা। নব্য নারোদনিকরা যদি মানিক-তারাশঙ্কর-বিভূতিকে আরও একটু মনোযোগ দিয়ে পড়তেন!
     
  • পাতা :
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। যা মনে চায় মতামত দিন