র্যাগিংয়ের আরও প্রকৃতি ছিল। বাংলা পর্নো বই, যাকে পুন্ডি বলা হত, সেই সব পাঠ করানো, এবং প্রতিটা শব্দের মধ্যে কিছু আদিরসাত্মক শব্দ গুঁজে গুঁজে দেওয়া। প্রচন্ড হাস্যকর লাগত শুনতে, কিন্তু হাসলেই মার। এ এক নেভারএন্ডিং লিস্ট। কাপড় কাচানো হত, জাঙ্গিয়া কাচানো হত ছানাদের দিয়ে। কিংবা, জুহি চাওলার ছবিওলা ক্যালেন্ডারকে লম্বালম্বি মাঝ বরাবর যদি ভাঁজ করা যায়, তা হলে সেই ভাঁজটা জুহি চাওলার কোন কোন অঙ্গ দিয়ে যাবে, তার ডিটেইল্স বর্ণনা। আর ছিল কিছু জামাইঠকানো প্রশ্ন, তোর কটা বোন, তোর এইচএসের নাম্বারকে এ টু দি পাওয়ার বি প্লাস বি টু দি পাওয়ার এ ফর্মে প্রকাশ কর।
আরও অলিখিত নিয়ম ছিল। সিনিয়র এসে দাঁড়ালে ছানাকে উঠে দাঁড়াতে হবে। হাসলে চলবে না, যতই ভার্চুয়াল কাতুকুতু দেওয়া হোক না কেন। জামার কলারের বোতাম, হাতার বোতাম, সমস্ত বোতাম ঠিকভাবে আটকানো থাকবে। ঘড়ি পরা চলবে না।
চার থেকে পাঁচ দিন চলত এই উৎসব। শেষ দিন হত মাস্ র্যাগিং। সেদিন মহোৎসব। সে দিন সমস্ত অ্যাক্টিভ র্যাগাররা দলবদ্ধভাবে ছানাদের নিয়ে যেত কলেজ ক্যাম্পাসের পেছনের মাঠ পেরিয়ে চা বাগানে। ডেঙ্গুয়াঝাড় চা বাগান। সাধারণত কলেজে অ্যাডমিশন হত আগস্ট মাসে, তখন তরাইতে ভরা বর্ষা। ফলে এক আর দু নম্বর হস্টেলের পেছনের মাঠ থাকত সম্পূর্ণ কাদা-পাঁকে ভরা। সেই পাঁকে ছানা পোনা সকলে মিলে সকলকে কাদা পাঁক মাখানো হত, মূলত ছানাদেরই মাখানো হত। কাদা মেখে যখন সবাই ভূত, কাউকে দেখে চেনার উপায় নেই, তখন জামাপ্যান্ট খুলে কেবল মাত্র জাঙ্গিয়া সম্বল করে, বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে চা বাগানের ভেতর দৌড়। সর্বাঙ্গে কাদা থাকায় আলাদা করে চেনার উপায় থাকত না কার পরণে জাঙ্গিয়া আছে, কার পরণে কিছুই নেই। হুল্লোড় হইচইতে ভরে যেত নিস্তব্ধ চা বাগান। চা-পাতা তোলা মদেশিয়া কামিনের দল সেদিন ধারেকাছে ঘেঁষত না।
চা বাগানের মাঝখান দিয়ে আসছে তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেস। হস্টেলের পেছনে।
দৌড় চলত রেললাইন পর্যন্ত। চা বাগানের ভেতর দিয়ে চলে গেছে রেললাইন, নিউ জলপাইগুড়ি থেকে আসামের দিকে। সেখানে গিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে হঠাৎ শেষ হয়ে যেত র্যাগিং। এতক্ষণ নির্মম ব্যবহার করে আসা সিনিয়রের দল হঠাৎ করে লাঠি টি সমস্ত ফেলে দিয়ে উদ্দাম উল্লাসে ছানাদের বুকে জড়িয়ে ধরে ওয়েলকাম জানাত, সবাই যে যার জামাপ্যান্ট ফেরৎ পেত। সমস্ত অধিকার দিয়ে দেওয়া হত ছানাদের। এখন থেকে তারাও এই ক্যাম্পাসের অংশ। হাসতে পারে, খেলতে পারে, সিনিয়রদের দেখে আর দাঁড়াবার দরকার নেই, নো ফর্মালিটিজ, হস্টেলে ফিরে পাঁচদিন বাদে সেই প্রথম ছানারা চান করত অফিসিয়ালি। সমস্ত কাদা ময়লা দূর করে পরিস্কার হয়ে সবাই জড়ো হত কমন রুমে। র্যাগিং পিরিয়ডের শেষে ছানাদের সেই প্রথম কমন রুমে প্রবেশাধিকার। রঙিন শিকলিতে ততক্ষনে কারা যেন সাজিয়ে ফেলেছে কমন রুম, বালতির পর বালতি ভর্তি রস্না। কাপ ডোবাও আর খাও। টেবিল উপছনো লজেন্স, যত খুশি খাও, চড়া ভল্যুমে বাজছে গান, সবাই নাচছে। পাঁচদিনের দমবন্ধ করা টেনশন থেকে হঠাৎ মুক্তি পেয়ে ফ্রেশারের দল তখন প্রায় পাগলের মত হয়ে যেত। সিনিয়রের কাঁধে হাত রাখতেও তখন আর কোনও মানা নেই, এক সাথে কোমর জড়িয়ে নাচ, গান, হুল্লোড় ... এর মধ্যেই এক ফাঁকে হয়ে যেত ফ্রেশারদের মিষ্টির প্যাকেট বিতরণ, সাথে একটা করে গোলাপফুলের স্টিক। সন্ধ্যের পর থেকে শুরু হত মদের ঢালাও আসর। যারা এর আগে কোনওদিন মদ্যপান করে নি, তারাও এই হঠাৎ মুক্তির আনন্দে গলা ভিজিয়ে নিত।
এই যে এতখানি বিবরণ দিলাম, পুরোটাই বন্ধুদের মুখে শুনে এবং পরবর্তী বছরে নিজের চোখে দেখে। ফ্রেশার হিসেবে, এক্সেপশনালি, আমাকে এ সবের মধ্যে দিয়ে যেতে হয় নি, আগেই লিখেছি। ঘটনাচক্রে আমি এসে পৌঁছই এই ফ্রেশার্স ওয়েলকাম হয়ে যাবার ঠিক পরের দিন। ফলে এর কিছুই আমাকে ফেস করতে হয় নি। র্যাগিংয়ের এ পর্যন্ত দেওয়া সমস্ত বিবরণই আমি দিলাম নিছক বিবরণ হিসেবে, নৈর্ব্যক্তিক ভাবে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে র্যাগিংয়ের সপক্ষে বা বিপক্ষে কিছুই বলি নি, বা বলতে চাই নি এখানে। প্রসঙ্গত, পরবর্তীকালে, সেকেন্ড আর থার্ড ইয়ারে আমি ছিলাম বি অথবা সি ক্যাটেগরিভুক্ত। জীবনে কোনওদিন কারুর গায়ে হাত তুলি নি, মারা বা মার খেতে দেখা কোনওটাই আমার পোষায় না। প্রায় সমবয়েসি কিছু ছেলেকে উলঙ্গ অবস্থায় দেখতেও আমার রুচিতে বেধেছে, সে দিক দিয়ে আমি সৌভাগ্যবান যে, আমাকে র্যাগ্ড হতে হয় নি। পরবর্তীকালেও সেই বিশেষ সময়গুলোতে আমি কলেজে বা নিজের রুমে স্বেচ্ছাবন্দী থাকতাম, এই ধরণের যৌনউল্লাস থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছি। এবং এইসব করেছি বলে আমি নিজেকে খুব গুড বয় বা ভালো ছেলে বলে তুলে ধরতেও চাইছি না, কারণ এই রকম মানসিকতার আমি একাই ছিলাম না, আমি সৌভাগ্যবান যে পরবর্তীকালে আমাদের ইয়ারের বা সিনিয়র ইয়ারের অধিকাংশ ছেলেকেই আমি এই মানসিকতার দেখেছিলাম। এই ধরণের নোংরামো করে খুবই কম সংখ্যক কিছু ছেলে। এবং ঠিক যেভাবে খুব কম সংখ্যক কিছু পলিটিশিয়ান যেভাবে একশো কোটি মানুষের দেশের সম্পদ লুটেপুটে খায়, জনতার পয়সায় বিলাসব্যসন করে, কেউ কোনও প্রতিবাদও করে না, হস্টেলেও ঠিক সেই ভাবেই এই কিছু সংখ্যক ছেলে নোংরামো করত, সংখ্যাগুরু জনতা তার প্রতিবাদও করত না।
ইহা পাকিস্তান। বাংলায় লেডিজ হস্টেল। প্রবেশ নিষেধ।
এই গায়ে হাত তোলা বা জামাপ্যান্ট খুলে উলঙ্গ করে ঘোরানো, এগুলো যেমন স্ট্যাম্প মারা অভদ্রতা, বাকিগুলো নিয়ে কিন্তু অনেকের মনেই অনেক রকমের মতামত চালু আছে। অনেকেই পছন্দ করে না, অনেকেই পছন্দ করে। এবং যারা পছন্দ বা সাপোর্ট করে, তারা নিজের মনমতো তাদের সাপোর্ট করাটা ব্যাখ্যা করে। ব্যাখ্যাগুলো সবসময়ে হয় তো লজিকবিহীন হয়ও না, কিন্তু যে হেতু আমি নিজে এই ঘটনাগুলোর ভেতর দিয়ে যাই নি, সেই জন্যেই অন্যের মুখে ঝাল খেয়েই আমাকে ব্যাখ্যাগুলো বিশ্লেষণ করতে হচ্ছে।
এই চারপাঁচদিনের র্যাগিংয়ের স্মৃতিচারণা চলত হস্টেলজীবনের শেষদিন পর্যন্ত। সময়ে, অসময়ে। নিজেদের মধ্যে, এমনকি সেই সব সিনিয়রের সাথেই, যারা এক দিন র্যাগিং করেছিল। 'মনে আছে প্রতীকদা, আমি সেই বারবার হেসে ফেলছিলাম বলে তুমি আমায় কী জোরে চাঁটিটাই না মেরেছিলে?' প্রতীকদা হয় তো তখন সামনেই পাত্তর নিয়ে বসে আছে, আধা তূরীয় অবস্থা, দিল দরাজ, সে তখন একদা র্যাগ করা ছানাকে আওয়াজ দিল, 'আব্বে শালা এখনও খার খেয়ে বসে আছিস? এই নে, প্যান্টু খুলে দিচ্ছি, তুই শালা যতবার চাস আমার পোঁদে চাঁটি মেরে নে। শালা হস্টেল ছাড়ার দিন কলেজ মোড়ে মাস্ ক্যাল দিবি না তো তোদের ইয়ারের ছেলেরা মিলে? সেদিন শালা তোদের ফুটবল টিমের হয়ে গুচ্ছ চেঁচিয়েছি, সেটা ভুলে গেলি বালটা?'
প্রায় নব্বই শতাংশ ক্ষেত্রেই পুরনো রাগগুলো এইভাবেই ডাইলিউট হয়ে যেত, হস্টেল ছাড়ার দিন পর্যন্ত আর কিছুই অবশিষ্ট থাকত না। আমি অন্তত কাউকে দেখি নি শেষদিন পর্যন্ত মার খাওয়ার জন্য কোনও সিনিয়রের ওপর এই ভাবে রাগ পুষে রাখতে। এত গভীর সম্পর্ক হয়ে যেত তাদের মধ্যে, জুনিয়রদের যে কোনও বিপদ আপদে এই সব মারকুটে ছেলের দলই সবার আগে দল বেঁধে এগিয়ে যেত , আমি বরাবর দেখেছি। ক্যাটেগরি বি আর ক্যাটেগরি সি সেখানেও ব্যাকফুটেই থাকত। টকমিষ্টি রিলেশনশিপ। যে দাদা যত মেরেছে, সেই দাদাই ক্লাস শুরু হবার আগে মার খাওয়া ছানার জন্য লাইব্রেরি থেকে আগেভাগে তুলে রাখত টিমোশেঙ্কোর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বই, অবহেলে দিয়ে দিত নিজের ড্রয়িং বোর্ড, টি। রাগ পুষে রাখা যেত না বেশিদিন। কারণে অকারণে ডাক পড়ত সেই দাদারই ঘরে, মাল খাবার আসরে। সিনিয়র জুনিয়রের পার্থক্যটা জাস্ট মুছে যেত কয়েক মাসের মধ্যেই। কেবল অমুকদা' তমুকদা' , নামের মধ্যে এই দাদা সম্বোধনটা ছাড়া আর কোনও তফাৎ থাকত না।
র্যাগিং খারাপ হোক বা ভালো, আরেকটা কাজ খুব নি:শব্দে করে দিত, সেটা হচ্ছে ইগো ধ্বংস করে দেওয়া। বিভিন্ন অঞ্চল, বিভিন্ন আর্থিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে ছেলেপুলেরা পড়তে আসত। কলকাতার নিউ আলিপুরের পশ্ লোকালিটি থেকে সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ছেলেপুলে, সকলেরই স্থান হত এই হস্টেলে, পাকেচক্রে এই রকম দুই মেরুর ছেলেদের রুমমেটও হতে হত, প্রাথমিকভাবে বনত না। ও হয় তো যখন ব্রেড স্যান্ডুইচ খেয়ে ঢুকছে, এ তখন বিছানায় বসে এক বাটি মুড়ি চিবুচ্ছে একটা কাঁচালঙ্কা দিয়ে, দুজনের চোখেই দুজনের ব্যবহার চূড়ান্ত অশ্লীল লাগত, কালচারাল কনফ্লিক্ট উপস্থিত হত। কিন্তু একই পংক্তিতে দুজনেই উলঙ্গ হয়ে দাঁড়াবার পর, দুজনকে দিয়েই সিনিয়রের গেঞ্জি জাঙ্গিয়া কাচানোর পর, দুজনকেই ইনভার্স করানোর পর, দেখা যেত আর তাদের একসাথে এক ঘরে থাকতে কোনও অসুবিধে হচ্ছে না। তখন এ হয় তো ওকে ক্যান্টিনে নিয়ে গিয়ে স্যান্ডুইচ খাওয়াচ্ছে, ও একে শেখাচ্ছে কী করে ঝাল সয়ে কাঁচালঙ্কায় কামড় লাগাতে হয়। দুটো ভীষণ আলাদা রকমের লেভেলকে এক লেভেলে নিয়ে আসার কাজটা করে দিত এই পাঁচদিনের র্যাগিং। সমস্ত রকমের ইগো, নাক উঁচু ভাব সব ধুয়েমুছে যেত। থেকেও যেত অনেক কিছু, কিন্তু অ্যাডজাস্টমেন্ট, কম্প্রোমাইজেশন, সহনশীলতা, এ সবের প্রথম পাঠ এর মাধ্যমেই হয়ে যেত, পাঁচদিনে। পদ্ধতিটা হয় তো বিজ্ঞানসম্মতভাবে এবং আইনসম্মতভাবে ঠিক নয়, কিন্তু এই পরিবর্তন ঘটে যাওয়া আমার নিজের চোখে দেখা।
এর পর, বিভিন্ন কারণে লেট অ্যাডমিশন নিয়ে আসত আরও কিছু ফ্রেশার, যেমন এসেছিলাম আমি। এদের র্যাগিং করত তারই ইয়ারের ছেলেরা। সদ্য ফ্রেশার্স ওয়েলকাম পাওয়া ছানারা, যারা সদ্য র্যাগ্ড হয়ে এসেছে। এগুলো পরে দীপঙ্কর সাধুই আমাকে শুনিয়েছিল। তার সবচেয়ে বেশি উৎসাহ ছিল র্যাগিংয়ে, কিন্তু আমি তার পূর্বপরিচিত বেরিয়ে পড়ায় সে আর আমাকে কিছুই করতে পারে নি।
সে যাই হোক, বাবা চলে যাবার পর প্রথম সন্ধ্যে। নিজের বেডে বসে রুমমেটদের সাথে অল্পস্বল্পভাবে আলাপ জমাচ্ছি, হঠাৎ একটা ছোট দল ঢুকল, সঙ্গে ফিসফাস, এই .. এই .. সিনিয়র সিনিয়র। যথারীতি বেজায় ঘাবড়ে গেছি। চা-রংয়ের নাইট স্যুট পরে গাঁট্টাগোট্টা চেহারার একজন এসে দাঁড়ালো আমার সামনে, এবং আমি আমার নবলব্ধ জ্ঞান রিকল্ করে সিনিয়রকে সম্মান দিতে উঠে দাঁড়ালাম।
সিনিয়র চোখ পাকিয়ে , মোটা গোঁফ আরও ফুলিয়ে আমাকে আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল, তারপর বেজায় বাজখাঁই গলায় প্রশ্ন করল, 'কলারের বোতাম আটকানো নেই কেন?'
আওয়াজেই প্রাণ উড়ে গেল। তড়িঘড়ি কলারের বোতাম আটকে নিতেই বাকিরা আর হাসি চেপে রাখতে পারল না। সম্মিলিত হাসির হররায় আমি জানলাম, আমার সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি কোনও সিনিয়র নয়, আমাদেরই সাথে অ্যাডমিটেড হওয়া ফ্রেশার, কৌশিক কুন্ডু, ওরফে কে-কে। এ বার আমিও হেসে ফেললাম, বন্ধুত্ব হয়ে গেল এক নিমেষে।
সেকেন্ড ইয়ার থার্ড ইয়ার, দু বছর কে-কে ছিল আমার রুমমেট।
( বাওয়াল-বাজি জমবে আবার দু' হপ্তা বাদে )