বৌদি ছিল আমার রুমমেট। বৌদি অবশ্যই নিকনেম। আসল নাম টাম নিয়ে এতদিন বাদে আর নাড়াঘাঁটা না করাই ভালো। মধুও ছিল রুমমেট। মধু আদতে তেলুগু, কিন্তু জন্ম পড়াশোনা সমস্তই চিত্তরঞ্জনে, ফলে একেবারে যে কোনও বাঙালির মতই বাংলা বলতে পড়তে ও লিখতে পারত। বেশ ভালো ছেলে, এখনও যোগাযোগ আছে, কেবল তিরুপতিকে নিয়ে কোনও রকম ইয়ার্কি পছন্দ করতে পারত না। খুব তিরুপতির ভক্ত ছিল। ফার্স্ট ইয়ারেই পুজোর ছুটির পর মধু ন্যাড়া হয়ে এল, তাইতে আমাদের এক পাব্লিক কেবল বলেছিল, কী রে, তিরুপতির কাছে বাল দিয়ে এলি নাকি? মধু সেই পাব্লিককে কেবল মারতে বাকি রেখেছিল।
যাক গে, হচ্ছিল বৌদির কথা। কিন্তু তার আগে মধুর নামে আরও একটা কথা। মধু বেশ ভালো মাউথ অর্গ্যান বাজাত। আমরা সবাই শুনতাম। বৌদি ছিল প্রচন্ড ঘোষু ছেলে। দিনরাত হাফপ্যান্ট পরে ঘষত, আর পৈতে দিয়ে গা চুলকোত। ... প্রচন্ড পড়াশোনার যাদবপুর শিবপুরে সিনোনিম ছিল / আছে 'গাঁতানো'; আর সেটাই জলপাইগুড়িতে পরিচিত ছিল 'ঘষা' নামে। প্রচন্ড পড়াশোনা করা পাব্লিককে ঘোষু বলে ডাকা হত।
তো, ঘষাঘষির ফাঁকে ফাঁকে মধুর মাউথ অর্গ্যান শুনে বৌদির খুব ভালো লেগে গেল। এবং সে মধুকে ধরে বসল, তাকে মাউথ অর্গ্যান শেখাতে হবে। বৌদি একাই এ রকমের দাবিদার ছিল না, আরও অনেকেই এ রকম দাবিদাওয়া করেছিল, এবং দু চারবার ফুঁ দিয়ে কাটিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু বৌদি মধুকে ছাড়ল না।
একদিন বিকেলে বসে বসে মধুর কাছে মাউথ অর্গ্যান বাজানোর বেসিক ব্যাপারগুলো শিখল বৌদি। সা রে গা মা বাজানো এটসেটরা। রাতে খাওয়া দাওয়া হয়ে গেলে পরে, মধুর মাউথ অর্গ্যানটা নিয়ে বৌদি চলে গেল কমন রুমে। সেখানে সারারাত টেবিল টেনিসের লে-ঠকাঠক দে-ঠকাঠক আর ক্যারমের খটখটি সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে এক কোণে বসে সে মাউথ অর্গ্যান প্র্যাকটিস করা শুরু করল।
আমরা অ্যাজ ইউজুয়াল আড্ডা ফাড্ডা মেরে শুয়ে পড়লাম অনেক রাতে যখন, তখনও কমন রুম থেকে বৌদির রেওয়াজের প্যাঁ পোঁ ভেসে আসছিল। পরদিন সকালে উঠলাম যখন, পাশের বেডে দেখলাম বৌদি বসে আছে, চোখে মুখে রাত জাগার ছাপ স্পষ্ট, এবং মুখে মাউথ অর্গ্যানে নির্ভুল "হ্যায় অপনা দিল তো আওয়ারা'-র সেই টিউন। ... এক রাত, মাত্র এক রাতে বৌদি তুলে ফেলেছিল মাউথ অর্গ্যানের পুরো বেসিক্স। নির্ভুলভাবে। একা একা।
বৌদির সারাবছরের অত ঘষার কারণটা বোঝা গেছিল পরে। হস্টেলে থেকেই প্রিপারেশন নিয়ে আবার জয়েন্ট এ¾ট্রান্স দিল, এবং এ বারে একটা ঘ্যামা র্যাঙ্ক করে দক্ষিণবঙ্গের অন্য একটা কলেজে চলে গেল পরের বছর ইলেকট্রনিক্স অ্যান্ড টেলিকম ইঞ্জিনীয়ারিং পড়ার জন্য। একটা বছর নষ্ট হল বটে, কিন্তু মনের মত স্ট্রীম তো পেয়ে গেল! বৌদি এখন একটা খুব নামকরা বহুজাতিক সংস্থায় আছে। এদেশে না বিদেশে, জানি না। শেষ দেখা হয়েছিল আকস্মিকভাবে, নয়ডায়। আমি তখন নতুন চাকরি বদলে সদ্য দিল্লিতে এসেছি, বাড়ি খুঁজছি পাগলের মত, হঠাৎ একটা দোকানে বৌদির সাথে দেখা। সে-ও নয়ডাতেই একটা কোম্পানিতে চাকরি করত। তার কয়েক মাসের মধ্যেই বৌদির বড় চাকরিতে জয়েন করার খবর শুনলাম, বৌদি নয়ডা ছেড়ে চলে গেল ব্যাঙ্গালোরে। তারপরে আর যোগাযোগ ঘটে নি। দেখি, আবার যদি অর্কুটে কখনও দেখা হয়ে যায়!
দীপঙ্কর সাধু ছিল টোটাল মজাদার ছেলে। অর্ধেক কথা নাক দিয়ে বেরোত, বাকি অর্ধেক মুখ দিয়ে। আগেই বলেছিলাম তার বৈশিষ্ট্য ছিল প্রচন্ড ঢোলা একটা পায়জামা, গাঢ় নীল রঙের। দূর থেকে দেখলে মনে হত বুঝি একটা সায়া পরে চলাফেরা করছে। ... দু চার পীস সুনীল সমরেশ পড়ে ফেলার দৌলতে, আর জীবনমুখী গান গাইবার সুবাদে ততদিনে আমি কলেজের ম্যাগাজিন কমিটিতে নিজের জায়গা করে নিয়েছিলাম। আমার ওপর গুরুদায়িত্ব পড়েছিল ফার্স্ট ইয়ারের কাছ থেকে লেখা কালেকশন করে ফোর্থ ইয়ারকে পৌঁছে দেবার।
একদিন রোববার দুপুরে, কমনরুমে বসে টিভি দেখছি, সাধু এসে ধরল আমাকে। কী ব্যাপার? "জিনু, আমি একখানা কবিতা লিখেছি, ম্যাগাজিনের জন্য দিতে চাই। আমি তো আসলে খুব একটা লিখি টিখি না, তুই যদি একবার পড়ে বলিস, কেমন হয়েছে, তা হলে লেখাটা তোকে দিই। তুই তো ম্যাগাজিন কমিটিতে আছিস ... ইত্যাদি ইত্যাদি।'
সাধু খুব সিরিয়াস আর নাছোড়বান্দা ছিল, অতএব ওকে অ্যাপো দিতেই হল, রাত দেড়টায়, আমার রুমে।
ঠিক সময়ে সাধু হাজির হল, সায়ার পকেটে একটা ভাঁজ করা কাগজ নিয়ে, লাজুক মুখে। কাগজটা খুলে দেখেই বিষম খেলাম। কবিতার নাম, 'ঝাঁট'। পুরোটা পড়ে দেখলাম, না, অশ্লীল টশ্লীল কিছু নয়। বেশ সমাজ সচেতনতামূলক। মোদ্দা জিস্ট এই, ট্রেন দাঁড়িয়ে থাকে প্ল্যাটফর্মে, বাচ্চা ছেলেটা ছেঁড়া জামাকাপড় পরে কামরা ঝাঁট দেয়, নোংরা চেহারা, কেউ তার দিকে ছুঁড়ে দেয় পঞ্চাশ পয়সা, দশ পয়সা, কেউ বা কিছুই দেয় না অবজ্ঞা ছাড়া, কিন্তু সেই ছেলেটা ঝাঁট দিয়ে পরিষ্কার করে চলে আমাদের ময়লা। এমনি করেই একদিন ট্রেন গিয়ে পৌঁছয় আরেক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, সমাজ তাকে ঝাঁট দিয়ে ফেলে দেয় বাইরে, ... এই রকম।
দূ:খের বিষয়, সাধুর এই কবিতা ছাপানো যায় নি ম্যাগাজিনে। সেই ক্ষোভেই কিনা, কে জানে, সাধু জলপাইগুড়ি ছেড়ে চলে গেছিল পরের বছর, দুর্গাপুরে, জয়েন্টে দ্বিতীয়বার ভালো র্যাঙ্ক করে। আমরা, ভুলভাল ছেলেপুলেরা রয়ে গেলাম জলুতেই ইঞ্জিনীয়ারিং শেষ করার জন্য।
=======================
আলাপ পরিচিতির পরিধিটা আরও বাড়ল পুজোর পর যখন বাড়ি থেকে আবার হস্টেলে ফিরে এলাম। আগের বারে হস্টেলে থেকে বাড়ির জন্য মন কাঁদছিল, পুজোর ছুটিতে বাড়িতে থেকে আস্তে আস্তে বুঝলাম অর্ধেকটা মন হস্টেলেই ফেলে এসেছি, ওখানে না ফিরলে আবার সেই পরিবেশ ফেরৎ পাওয়া যাচ্ছে না।
নভেম্বরের গোড়ায় যখন ফিরে এলাম প্রথমবার উত্তরবঙ্গের শীত দেখার জন্য, তখন সত্যি বদলে গেছে প্রকৃতি। স্টেশন থেকে কলেজ ক্যাম্পাসের দিকে রিক্শা এগোচ্ছে, আর আমরা হাঁ করে চেয়ে আছি উত্তর আকাশের পানে, সেখানে তখন ঝক্ঝক করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা সান্দাকফু ফালুট সহ এক বিশাল হিমালয়ান রেঞ্জ। দ্বিতীয়বারের জন্য এই আমাদের কলেজ ক্যাম্পাসে ঢোকা, ভয়হীনভাবে প্রথমবার। এখন সবাই সমান। কোনও র্যাগিং নেই, সিনিয়র জুনিয়র নেই।
হস্টেল জীবনের সঙ্গে পরিচিতি থিয়োরিটিক্যালি হয়েই গেছিল প্রথম একুশ দিনে, এ বার তার প্র্যাকটিক্যাল ইমপ্লিমেন্টেশন। বাড়িতে লম্বা ছুটি কাটিয়ে হস্টেলে ফিরে সকলের খুব মন খারাপ, তাই মনকে সঞ্জীবনী টনিক দেবার জন্য আয়োজন হল উইংসভিত্তিক উৎসবের।
প্রথম হল, আইডি। অনেক জায়গায় একে জিএফও বলা হয়। আইডি হল ইমপ্রুভ্ড ডিনার, অথবা জি এফ: গ্র্যান্ড ফিস্ট। এক এক মাসে এক এক উইংয়ের হাতে থাকত মেসের দায়িত্ব, মাসের একটা দিন তারা কব্জি ডুবিয়ে খাওয়ার বন্দোবস্ত করত, সেদিন এলাহি মেনু। বিয়েবাড়ির খাওয়া। যে ঠাকুরের দল সারামাস দোতলা মাছের ঝোল, নিরামিষ ডিমের ঝোল কিংবা বুকের চুল মেশানো জলীয় ডাল রেঁধে খাওয়াত, তাদের হাত দিয়েই বেরোত পোলাও কালিয়া বিরিয়ানি ইলিশের ভাপা কিংবা চিতলের মুইঠ্যা বা বাটার চিকেন বা পাঁঠার দোপেঁয়াজা। রাত একটা দুটো পর্যন্ত চলত উৎসব।
মন খারাপ কাটানোর দ্বিতীয় পন্থা হল, ভিডিও দর্শন। দুই প্রকার দর্শন হত, মেস ভিডিও, উইংস ভিডিও। মেস ভিডিও মেসের পয়সায়, আবার উইংসের নিজস্ব ফান্ডিংয়ে উইংস ভিডিওও নামত। ভিডিওর কনটেন্ট মোটামুটি চার বছর ধরেই ছিল এক রকমের। সমকালীন দুই থেকে তিন খানি হিন্দি বা ইংরেজি সিনেমা, একটি টুএক্স ব্লু ফিল্ম, দুটি থ্রিএক্স, এর পর কিছু ছেলের সহ্যশক্তি বা বুকের পাটার ওপর নির্ভর করে একপিস সেভেন এক্স।
কদমতলার ভিডিওর দোকান থেকেই ভাড়া হত টিভি সেট আর যাবতীয় ভিডিও ক্যাসেট। তখনও ভিসিডির জমানা আসে নি। শো শুরু হত সন্ধ্যে সাতটা থেকে, চলত পরের দিন সকাল সাতটা পর্যন্ত। কনকনে শীত হোক বা বর্ষা, অধিকংশ ছেলেপুলেই সেই রাতে না ঘুমিয়ে এক্স রেটেড ফিল্ম টিল্ম দেখে পরদিন সকালে বেশ গরম হয়ে ঘুমতে যেত।
সব দেখেছি। তৎকালীন ব্লু ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির যাবতীয় ক্যাসেট দেখে শেষ করে ফেলেছিলাম চার বছরে। শেষদিকে কদমতলার দোকানে আর নতুন ক্যাসেট পাওয়া যেত না।
মুভি বাফ তেমন কেউ ছিল টিল না। ফলে উচ্চমার্গীয় সিনেমা হস্টেলে বসে দেখার চলও ছিল না, কলেজেও মুভি ক্লাব জাতীয় কিছু এক্সিস্ট করত না। অবশ্য করলেও ভালো সিনেমার ভালো প্রিন্ট জলপাইগুড়িতে বসে পাওয়াও যেত না, হয় তো আজও যায় না। সব পাঁউরুটি আর ঝোলাগুড়ই কলকাতাকেন্দ্রিক কিনা!
টিমোশেঙ্কো ইয়ংএর ইঞ্জিনীয়ারিং মেকানিক্সের বইয়ের দুর্বোধ্য ইংরেজি ততদিনে মোটামুটি ধাতস্থ হয়ে এসেছে, কলেজের প্রফেসরদের মোটামুটি চিনে নিয়ে প্রত্যেকের নকল করার মত কিছু হাস্যকর বৈশিষ্ট্য ততদিনে আমাদের স্বভাবজাত হয়ে গেছে। নিজেদের পাশাপাশি স্যরেদেরও নিকনেম ততদিনে সিনিয়র ইয়ারের থেকে জেনে ফেলেছি আমরা। বইয়ের সাথে মুখ্যত সম্পর্ক থাকত ক্লাসরুমেই, আর মঙ্গলবার রাতে ড্রয়িং বোর্ড নিয়ে বসতাম, কারণ বুধবার ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িংয়ের ক্লাস থাকত। ড্রয়িংটা বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিল।
তো, সেইভাবেই আস্তে আস্তে হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা এসে গেল। তখন ডিসেম্বর মাস, কন্কনে শীত আর জোলো হাওয়া, কাঞ্চনজঙ্ঘা সান্দাকফু ফালুটের রেঞ্জও ডুবে গেছে পুরো কুয়াশায়, দিনের কঠিনতম কাজটা হল সকালে লেপের তলা থেকে বেরনো, সেই প্রথম শীতের সাথে এল হাফ ইয়ার্লি পরীক্ষা। আমাদের কলেজে হালে সেমিস্টার সিস্টেম হয়েছে, তখন ছিল না। তখন পঁচিশ নম্বরের হাফ ইয়ার্লি হত ইন্টারনাল, পরে পঁচাত্তর নম্বরের অ্যানুয়াল হত, তার পঁচিশ ইন্টারন্যাল, পঞ্চাশ এক্সটার্নাল। এবং সেই এক্সটার্নালের কোশ্চেনও আমাদের কলেজের প্রফেসররাই বানাতেন। কেবল ছাপা হয়ে আসত ইউনিভার্সিটি থেকে।
পরীক্ষা শেষও হয়ে গেল। এমন কিছু কঠিন ব্যাপার লাগল না। শেষ হওয়া মাত্র হস্টেল আবার খালি। এই সময়ে আমি প্রথম হংসে যাই।
হংস্, অর্থাৎ কিনা, হংকং মার্কেট। কলেজের কাছে নিকটতম শহরাঞ্চল বলতে ছিল, শিলিগুড়ি। অবশ্য, "শহর' বলতে আমরা যা বুঝি, সেদিনের শিলিগুড়ি তাও ছিল না। কেবল হিলকার্ট রোড বরাবর দুপাশের বড় বড় দোকান পাট শোরুম, একটু পেছন দিকের বিধান রোড বরাবর বাজার দোকান জনবসতি কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়াম, কলেজপাড়ার বসতি, স্কুল কলেজ, এই ... এই টুকুই ছিল শহর। তারপর ধূ ধূ নির্জনতা, সরু রাস্তা, আধা মফস্সল অ্যামবিয়েন্স। তো, সেই বিধান রোডের এক ধারেই বিধান মার্কেট, চলতি লোকের ভাষায় হংকং মার্কেট।
ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেপুলের প্রথম হংকং মার্কেটের সাথে পরিচিতি ঘটে ক্যালকুলেটর কিনতে গিয়ে। সায়েন্টিফিক ক্যালকুলেটর, সরাসরি কাঠমান্ডু থেকে স্মাগ্ল্ড হয়ে আসা ক্যাসিও-র মাল, কলকাতার থেকে কিছু না হোক দুশো চারশো টাকা সস্তায় পাওয়া যেত। যে সে জায়গা থেকে কেনা যেত না, কারণ হংকং মার্কেট পুরোটাই ছিল দু নম্বরীর জায়গা। আজও আছে হয় তো, জানা নেই ঠিক। অধিকাংশ সো-কল্ড চাইনিজ জিনিসপত্র ম্যানুফ্যাকচার হত শিলিগুড়িতেই। তার ওপরে মেড ইন চায়না ছাপ মেরে বিক্রি হত। আসল নকল বোঝার কোনও উপায় ছিল না। এই মার্কেটের মূলত টার্গেট ছিল ফ্লাইং কাস্টমার, যারা উত্তরবঙ্গে বেড়াতে আসেন, টুরিস্ট, তারা। নকল মাল বাড়ি গিয়ে মাসখানেক ব্যবহার করার পর ধরা পড়ত, তখন আর শিলিগুড়ি ফিরে এসে সেই সব নিয়ে ঝামেলা করর ক্ষমতাও থাকে না কারুর, সে সব জেনেই নিশ্চিন্তে চলত এই বিশাল মার্কেট। কী কী পাওয়া যেত এখানে? কী পাওয়া যেত না! চাইনিজ ছাপ মেরে যা যা বিক্রি হতে পারে, সব। চার্জার এবং রিচার্জেব্ল ব্যাটারি, রেডিও ঘড়ি ক্যাসেট প্লেয়ার এমার্জেন্সি লাইট ক্যালকুলেটর স্পীকার অ্যামপ্লিফায়ার বাহারি লাইট চাইনিজ তালা স্টেপলার সেলাইকল ব্রা-প্যান্টি জুতো বেল্ট ... সমস্ত।
আমাদের ছিল চেনা দোকান। তারা জেনে নিত আমাদের রেগুলার কাস্টমার হিসেবে, কখনও ঠকায় নি। আমরাও ঐ চেনা দু একটা দোকান ছাড়া কোনও জায়গা থেকে কিনতাম না জিনিস। প্রথমবারে আসা হত কোনও সিনিয়রের সঙ্গে, সে-ই পরিচয়টা করে দিত। বাকিটা দোকানদারের স্মৃতিশক্তি। ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ছেলেকে নকল জিনিস গছাবার সাহস কারুর ছিল না। সেই অটুট বিশ্বাসেই তারাও বেচত, আমরাও কিনতাম। শো কেসে কোনও জিনিস দেখে হয় তো পছন্দ হল, দর করতে গেলাম, জিনিস যদি জেনুইন না হত, দোকানদার আগেই নিচু গলায় জানিয়ে দিত, এইটা ভালো মাল না, দু নম্বরী, আপনি যদি চায়েন তো আনায়ে রাখব, পরের শনিবার আইস্যে নিয়া যায়েন।
অনেক জিনিস কিনে নিয়ে গেছি চার বছরে, হংকং মার্কেট থেকে। সেই ক্যালকুলেটর দিয়ে শুরু। তার বেশ কিছু জিনিস এখনও চলছে, আমাদের বাড়িতে।
কলেজে পরীক্ষা হত, ঐ যেমন বললাম, বছরে দুবার মাত্র। মোটামুটি ক্লাস ফলো করলে আর পরীক্ষার আগে একমাস থেকে দেড়মাস ঘষলেই পরীক্ষার জন্য তৈরি হওয়া যেত। পরীক্ষা যে হেতু ছাত্রজীবনে এক গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার, উত্তরণের একেকটা সিঁড়ির মতন, ফলে এই পরীক্ষার আগে অনেক ছাত্রই মনে মনে বা প্রকাশ্যে অনেক রকম সংস্কার মেনে চলে। ছোটখাটো বা বড়সড়। আমাদের ইয়ারের এক ছেলে প্রতি পরীক্ষায় একটা প্রায় ছিঁড়ে আসা জামাপ্যন্টের সেট পরে পরীক্ষা দিত। একবার বাড়ি থেকে আসার সময়ে সে সেই সেত নিয়ে আসতে ভুলে গেছিল বলে তাকে বাড়ির লোক কুরিয়ার করে সেই জামাপ্যান্ট পাঠিয়েছিল। সেটাই নাকি তার লাকি জামা প্যান্ট। সেটা না পরলে নাকি পরীক্ষা ভালো হয় না।
তো, এই রকম অনেক সংস্কার আমরা দেখেছি স্কুলজীবনেও, দইয়ের ফোঁটা কালীবাড়ির ফুল থেকে শুরু করে ডাবের জল খাইয়ে দেওয়া বাবা মা পর্যন্ত, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের পরীক্ষার সঙ্গে জড়িয়ে ছিল এক অদ্ভূত গণসংস্কার। সেটা ছিল একটা গান। কেউ জানে না এর উৎপত্তি কবে, কোথা থেকে, কিন্তু ইয়ারের পর ইয়ার এই সংস্কারটা অ্যাকুয়্যার করত সিনিয়রদের থেকে, এবং দিয়ে যেত জুনিয়রদের।
গানটা ছিল, জো জিতা ওহি সিকান্দর সিনেমার, প্যহেলা নশা। এটা পরীক্ষা রিলেটেড গানও নয়, তবু, কেন যে এই বিশেষ গানটাকেই বাছা হয়েছিল জানি না। চারটে বছরে, প্রতিটা পরীক্ষার আগে, জুতোর ফিতে বাঁধা থেকে শুরু করে কলেজের দিকে এগোন পর্যন্ত শুনেছি হস্টেলে কারুর না কারুর রুম থেকে তারস্বরে ভেসে আসছে সেই গান: চাহে তুম কুছ না কহো, ম্যায়নে শুন লিয়া, কে সাথী প্যার কা ম্যায়নে চুন লিয়া, চুন লিয়া।
সংস্কারও ঠিক নয়, পাব্লিক হয় তো নিতান্ত অভ্যেসের বশেই গানটা শুনে ফেলত বা চালিয়ে দিত পরীক্ষায় বেরোবার আগে। কখনও এর অন্যথা হয় নি। জলু হস্টেলের এক রকমের সংস্কৃতিই হয়ে গেছিল এই গানটা। পরীক্ষার সমার্থক। পুজোর আগে যেমন বিশ্বাসী হোক বা অবিশ্বাসী, কান পাতবেই মহালয়ার গানে, এ-ও তেমনি। জানি না, আজও জলপাইগুড়ির ছাত্ররা পরীক্ষা দিতে বেরোবার আগে এই গান শোনে কিনা। না-শুনলেও ঘন্টা, এ শুধু আমাদের সময়ের একটা নস্ট্যালজিয়া, তাদের কী!