র্যাগিং
র্যাগিং নিয়ে অল্পবিস্তর চেঁচামেচি সব সময়েই হয়ে এসেছে, তবে সেই ১৯৯৫ সালে ব্যাপারটা খুব একটা উচ্চগ্রামে হত না। ফলে সিনিয়ররা, যারা মূলত র্যাগিং করত, তারা ব্যাপারটা বেশ খুল্লমখুল্লাই করত। প্রফেসররাও তাকিয়ে দেখতেন না, নাম-কা-ওয়াস্তে একটা অ্যান্টি-র্যাগিং কমিটি বানিয়ে তাঁরা দায় সারতেন। সেই অ্যান্টি র্যাগিং কমিটিতে থাকত কলেজের জি এস এবং আরও কিছু টপার গোত্রের ছেলে। বাকি আম আদমির সেই কমিটিতে কোনও এন্ট্রি ছিল না, কোনও say ও ছিল না, ফলে খুব আরামসে জিএস স্বয়ং এবং অন্যান্য অ্যান্টি র্যাগিং কমিটির ছাত্ররাও র্যাগিং করতে বসে পড়ত দল বেঁধে।
ব্যাপারটা যত সহজে বলে ফেললাম, ততটা সরলীকৃত করে ফেলাও বোধ হয় উচিত হবে না। এতে করে একটা ইমপ্রেশন তৈরি হয়ে যাচ্ছে যে জলপাইগুড়ি কলেজে ইয়ার নির্বিশেষে জিএস এবং অন্যান্য টপাররা সব সময়েই র্যাগিং করত। আর সব কলেজের খবর জানি না, জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে চার বছরে যতটা দেখেছি, র্যাগিং হত ভালো রকমই, কিন্তু সিনিয়র মাত্রেই র্যাগিং করত, এই ধারণাটা সর্বৈব ভুল, মিথ্যে। সিনিয়রদের প্রধানত কয়েক রকমের ক্যাটেগরি ছিল। প্রথমেই মাস রেটে বাদ দেওয়া যায় ফোর্থ ইয়ারকে। ফোর্থ ইয়ার থাকত আলাদা হস্টেলে, ইঞ্জিনীয়ারিংয়ের সব চেয়ে ক্রুশিয়াল ইয়ার। পড়ার চাপ বেশি, প্রজেক্ট ওয়ার্ক, তার বাইরেও চাকরির চেষ্টা, গেট বা ক্যাট বা জিআরইর জন্য আলাদা প্রিপারেশন তাদের এত বিজি রাখত যে তারা সাধারনত র্যাগিংয়ে সামিল হত না। সাধারণত বলছি এই কারনে, যে কিছু অত্যুৎসাহী অবশ্যই থাকত যারা র্যাগিং করতে ফার্স্ট ইয়ারের রুমে রুমে হানা দিত, কিন্তু তাদের সংখ্যা ফোর্থ ইয়ারে খুবই নগণ্য, ইগনোর করা যায়।
র্যাগিংয়ে মূলত ইনভল্ভড থাকত সেকেন্ড ইয়ার আর থার্ড ইয়ার। এদের মধ্যে সেকেন্ড ইয়ারের ইনভল্ভমেন্ট ছিল বেশি। প্রথম সিনিয়র হবার স্বাদ পাওয়া এই র্যাগিংয়ের মাধ্যমেই।
এবং, আবারও, বাচ্কে রহ্না সরলীকরণ সে। সেকেন্ড ইয়ার বা থার্ড ইয়ারের ছাত্র মাত্রেই র্যাগিং করত, এমন বলা নাথিং বাট অনৃতভাষণ হবে। সব ইয়ারেই এক ধরণের ছেলে থাকত যারা কাউকে মেরে আনন্দ পেত। মেরে, বা ভয় দেখিয়ে, বা যৌন উত্তেজনামূলক কার্যকলাপ করিয়ে। এই সব কাজ প্রতিবাদহীনভাবে করানোর জন্য সব থেকে সফ্ট টার্গেট ছিল মূলত ফ্রেশাররাই, ফার্স্ট ইয়ার। এরা বড় বড় জ্ঞটিঞ্চ (ইঞ্জিনীয়ারিং ড্রয়িং করার জন্য এক রকমের বড় T শেপের স্কেল) বা ডান্ডা নিয়ে ঘুরে বেড়াত, মুখে অশ্রাব্য খিস্তি, দুই হাতে বইত চড় থাপ্পড়ের বন্যা। এদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলেপুলেই ছিল পার্সোনালিটিলেস্, সারা বছর নিজের ইয়ারের মধ্যে কোনওরকম পাত্তা পেত না, অথচ পাত্তা পাবার, সম্মান পাবার একটা উদগ্র আকাঙ্খা তাদের মধ্যে কাজ করত, তারাই প্রধানত র্যাগিংয়ে সবচেয়ে বেশি অ্যাকটিভ রোল নিত। ঐ কটা দিনের জন্য তারা ফ্রেশার নামক কিছু অসহায় মুরগীদের কাছ থেকে গায়ের জোরে সম্মান আদায় করে নিত। এদের আমি নাম দিলাম ক্যাটেগরি এ।
কলেজের সেরা ফটো। হস্টেল, চা-বাগান নিয়ে আইসোমেট্রিক ভিউ। ভোর পাঁচটায় জলের ট্যাঙ্কের মাথায় চড়ে তোলা।
আরেক ধরণের ছেলে ছিল, একেবারে অ্যালুফ, সাতেও থাকত না, পাঁচেও থাকত না। র্যাগিং হল-কি-না-হল, কে তাকে পাত্তা দিল-কি-না-দিল, তাতে তাদের সিম্পলি ছেঁড়া যেত। তারা নিজেদের রুমের মধ্যে বিছনায় দিনভর বসে পশ্চাদ্দেশ উপুড় করে পড়ে যেত, পড়েই যেত। একেবারে ইন্যাক্টিভ। এদের ক্যাটেগরি বি তে ফেলা গেল।
এই দু ধরণের ছেলেদের মাঝে আরেক ধরণের সিনিয়র থাকত, যারা ছিল মঝ্ঝিমপন্থী। এদের নাম দিলাম ক্যাটেগরি সি। মারধোরের মত ব্যাপারে এরা বিশ্বাস করত না, কিন্তু জাস্ট ফার্স্ট ইয়ারের সঙ্গে পরিচিত হবার তাগিদে এরা চলে আসত ফার্স্ট ইয়ারের হস্টেলে, বোকা বোকা কোশ্চেন বা মারধোরের বদলে এরা তাদের খুঁজে বের করত যারা এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটিতে চৌখস। কে গান করে, কে ভাল এক্সটেম্পোর দেয়, কে ভালো ডিবেট করতে পারে, কার কুইজে প্রচুর প্রাইজ আছে, এই রকম ছেলেদের চুজ করে তুলে আনত নিজেদের হস্টেলে, পুরো র্যাগিং পিরিয়ড জুড়ে এই সব ফ্রেশারদের এরা শেল্টার দিত নিজেদের রুমে, বিছানা শেয়ার করত, ক্যাটেগরি এ যদি হাতের সুখ করার জন্য যদি এদের ঘরে হানা দিত ফ্রেশারের খোঁজে, এই ক্যাটেগরি সি তখন আশ্রিত ছেলেগুলোর ওপর প্রচন্ড বকাঝকা হম্বিতম্বি, এই মারব কি সেই মারব টাইপের অভিনয় করত, মানে একটা ক্যামুফ্লাজ তৈরি করত যাতে করে ক্যাটেগরি এ মনে করত এই ছানাগুলো অলরেডি প্রচন্ড ক্যাল খাচ্ছে, আর এদের আলাদা করে মারার দরকার নেই, এই ভেবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা অন্য ছানার খোঁজে সরে যেত। ইন্টেলেকচুয়াল না হলেও ক্ষতি ছিল না, এমনিই কাউকে ভাল লেগে গেলে এই ক্যাটেগরি সি ছানাদের এইভাবেই শেল্টার দিত।
ছানা। এই নামেই পরিচিত হত সমগ্র ফার্স্ট ইয়ার। ইহা জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ স্পেশাল। বিভিন্ন ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজে এর বিভিন্ন নামকরণ হয়ে থাকে। শিবপুর বিই কলেজে এদের মুরগী বলে ডাকা হত, দুর্গাপুরে বোধ হয় জুনি ... ঠিক বললাম কি? যেকোনও ফার্স্ট ইয়ারকেই ছানা বলে ডাকার অধিকার ছিল যে কোনও সিনিয়রের, মেয়ে হলে ছানি।
এর সঙ্গে যুক্ত ছিল আরেকটা শব্দ। পোনা / পুনি। বোঝাই যাচ্ছে এটা সিনিয়রদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। কিন্তু ছানার মত ব্যাপকার্থে নয়। এটা হত এলাকাতুতো দাদা / দিদির ক্ষেত্রে। যেমন আমি ব্যান্ডেল থেকে এসেছি, ব্যান্ডেলের ছেলে সঞ্জয় সরকার, সঞ্জয়দা, আমার সিনিয়র আমার এলাকাতুতো দাদা। তাই সঞ্জয়দা আমার পোনা। আমার এক পুনিও হয়েছিল, অর্পিতাদি, তাকে অবশ্য আমি অনেক পরে চিনেছি, জলপাইগুড়ি আসার আগে চিনতাম না। সাধারণভাবে পোনা তার ছানার ওপর র্যাগ করত না, বরং শেল্টার দেবারই চেষ্টা করত। যে হেতু বেশির ভাগ ছেলেপুলে কলকাতা থেকে এসে থাকে, তাই কলকাতার মত বড় জায়গার ক্ষেত্রে এই পোনা ঠিক হত ছোট এলাকা বা স্কুল ধরে, যেমন দমদম মতিঝিল কিংবা সেন্ট জেভিয়ার্স-তুতো দাদা।
র্যাগিং কী রকম হত? আমি নিজে র্যাগিং পিরিয়ডের শেষে পৌঁছেছি, র্যাগড হবার কোনও প্রত্যক্ষ অভি১৪৫;তা আমার নেই, সমস্তই বন্ধুদের মধ্যে শোনা। কিছু র্যাগিংয়ের বিষয়বস্তু সকল কলেজের ক্ষেত্রেই এক, যেমন ফুঁ-বল খেলা। একটা কাগজের গোলা পাকিয়ে ফুঁ দিয়ে খেলতে হবে, যে গোলকিপার, তাকেও ফুঁ দিয়ে সেই বল আটকাতে হবে।
ক্যালেন্ডার হতে হত, দেয়ালের থেকে বেরিয়ে আসা লকারের ছাদ ধরে ক্যালেন্ডার হয়ে ঝুলতে হবে, হাওয়া দিলে ক্যালেন্ডার যেমন করে দোলে, তেমন করে দুলতেও হবে।
কলেজ বিল্ডিং-এর সামনে।
সার্কিট করাঃ ঘরে যত ফার্নিচার আছে, চারটে খাট, তিনটে টেবিল, তিনটে চেয়ার, সবকটার নিচ দিয়ে হামাগুড়ি দিয়ে আসতে হবে, কোনও ফার্নিচার এর জন্য উল্টে গেলে, চেয়ারের ক্ষেত্রে যা হামেশাই হত, ছানার গালে পিঠে পড়ত চড়।
এর পর হত ইনভার্স। জামাকাপড় খুলে উলঙ্গ করে, উল্টো অর্ডারে পরাঃ প্রথমে জামা, তার ওপর গেঞ্জি, প্রথমে প্যান্ট, তার ওপরে শর্টপ্যান্ট / জাঙ্গিয়া। খালি পায়ে জুতো পরে তার ওপর দিয়ে মোজা পরা। হয়ে গেলে পরে সেই সাজে করিডর দিয়ে ঘুরিয়ে আনা।
এর পর ছিল সুইসাইড নোট লেখানো; তোকে এখানে এত মার দেওয়া হবে, তুই মরেও যেতে পারিস, আগে একটা চিঠি লিখে যা, আমার মৃত্যুর জন্য কেউ দায়ি নয়। মৃত্যুভয়ে ভীত ছানার হাউমাউ কান্নায় উল্লসিত হয়ে উঠত র্যাগারের দল, কারন একমাত্র তারাই জানত এখানে কাউকে মেরে ফেলা হয় না। সুইসাইড নোট লেখার পর তাকে খেতে দেওয়া হত ব্রাউন শুগার। প্রচন্ড কান্নাকাটি, হাতে পায়ে ধরা এই সময়ে করত; মূলত গ্রাম বা শহরতলি থেকে আসা ছেলেরা। তারা ম্যাক্সিমাম সিগারেট খেয়েছে, বিড়ি খেয়েছে, এখানে এসে র্যাগিং পিরিয়ডে যে ব্রাউন শুগারের মত ভয়ঙ্কর জিনিস খেতে দেওয়া হবে, এ তাদের স্বপ্নের অতীত। সে জিনিস তারা চোখেও দ্যাখে নি, শুধু জানে এ ভয়ঙ্কর নেশা। তারা কিছুতেই খাবে না, আর তাদের খাওয়ানো হবেই।
র্যাগিং পিরিয়ডে, এই ব্রাউন শুগার জিনিসটা ছিল কমপ্ল্যান আর চিনির একটা মিক্সচার। সত্যিকারের ব্রাউন শুগার যে আসলে কমপ্ল্যানের মত ব্রাউন রংয়ের আদৌ দেখতে হয় না, সেটা জানার কথা নয় সদ্য হায়ার সেকেন্ডারি পাস করে আসা ছানাদের। কেবল তাদের ভীত মুখগুলো আর রিয়্যাকশন দেখার জন্যে এই ধরণের মজা করা হত।
এই ধরণের বিভিন্ন প্রকার "ইন্টার্যক্শন"-এর মধ্যে দিয়েই ছানাদের নামকরণও করা হত, যে নাম তাদের থেকে যায় কলেজজীবন শেষ হয়ে চাকরিজীবনের শেষদিন পর্যন্ত, যতদিন কলেজের বন্ধুদের সাথে সম্পর্ক থাকে। খুব কান্নাকাটি করা ছেলের নাম হত কেঁদো, মেয়েলি স্বভাবের ছেলের নাম হত মাগি বা বৌদি বা পিসিমা। এমনি করেই গামছা, কেতু, পেড্রো, অমলেট, ম্যাক্স, পানু, দুদু ইত্যপ্রকার অসংখ্য নামে ভূষিত হত ছানার দল।
র্যাগিং হস্টেলের ভেতরে যেখানে যতখুশি হোক, দুটো জায়গা বাদ দিয়ে হত। এক, মেস, আর দুই, কমন রুম। হস্টেলের ছেলেপুলে স্বভাবতই উচ্ছৃঙ্খল হয়, কিন্তু দু একটি নিয়ম সকলে মেনে চলত, নিয়ম করে, সেটা হল; এই দুই জায়গায় প্রবেশ করতে হবে জামা পরে। খালি গায়ে বা স্যান্ডো গেঞ্জি পরে ঢোকা যাবে না। আর এই দুই জায়গায় কোনও র্যাগিং হবে না।
অবশ্য মেসে কিছুটা হত, উল্টো হাতায় ডাল তুলতে হবে, ভাত তুলতে হবে গোছের আবদার। যা একেবারেই অসম্ভব। কেউই পারত না, তখন ছানার মাথায় চাঁটি ফ্রি-তে মেরে তার পাতে এক খাবলা আলুভাজা আর ডিম তুলে দিয়ে বলা, নে, খেয়ে নে। মেসের ভেতর ছানাদের বেশ যত্ন করে খাওয়ানো হত। হস্টেলে আসার আগে শুনে এসেছি, তাড়াতাড়ি খেতে শেখ, হস্টেলে গিয়ে এই রকম আস্তে আস্তে খেলে কিন্তু বন্ধুরা সব কেড়েকুড়ে খেয়ে নেবে, নিজের পেটে কিচ্ছু যাবে না। আদতে হস্টেলে এই রকমের কোনও ঘটনা কখনও ঘটত না। খাওয়া নিয়ে কেউ কোনও রকম অমানবিকতা করত না, সে যত বড় র্যাগারই হোক না কেন। বন্ধুরা তো দূরের কথা, সিনিয়ররা পর্যন্ত কোনওদিন ছানার পাত থেকে খাবার কেড়েকুড়ে খায় নি, বরং ছানার পাতে এই ভাবেই তুলে দিয়েছে তরকারি, আলুভাজা। খাওয়া শেষ হলে ঘরে নিয়ে গিয়ে আবার র্যাগ করা যেত। চাইলে তেমন মনপসন্দ ছানা হলে তাকে একটু ভাতঘুম দিয়ে নেবার পারমিশনও দেওয়া হত।
(বাওয়াল-বাজি জমবে আবার দু' হপ্তা বাদে )