হাঁটি হাঁটি পা পা
তখনও কিছুই জানি না ক্যাম্পাস কত বড়, কোথায় কী আছে। পলিটেকনিকের ভেতর দিয়ে ধরধরি নদী পেরিয়ে কলেজ। সেখানে অ্যাডমিশন নিয়ে সোজা হস্টেল। মাঝে একবার বাবার সঙ্গে সার্কিট হাউস যাওয়া।
বিকেলে সদ্যপরিচিত রুমমেটদের সাথে যাওয়া গেল কলেজ মোড়, টিফিন সারতে। একটা সরু রাস্তা চলে গেছে কলেজের সামনে দিয়ে। এটার নাম ময়নাগুড়ি বাইপাস। কলেজ গেটের আশেপাশে ইতস্তত ছড়ানো কিছু গুমটির দোকান, চা-টিফিনের দোকান, সাইকেলের টায়ার টিউব পাংচার সারানোর দোকান, মুদিখানা, সেলুন, সিগারেটের দোকান আর গোটা দুই এসটিডি বুথ। মুখ্যত খরিদ্দাররা সকলেই এই কলেজের ছেলেপুলে। তাই কলেজ মোড় জুড়ে এদেরই আধিপত্য। ন্যাচারালি। তাদেরই একজন হয়ে আমি একটা দোকানে বসে কামড় দিলাম ব্রেড টোস্টে।
গল্পে গল্পে সন্ধ্যে হয়ে এল, বিল হল নটাকা। দশ টাকার নোট দিয়ে ফেরৎ পেলাম এক টাকার একটা নোট। তখনও এক টাকার কয়েন বহুল প্রচারিত হয় নি, দু টাকার কয়েন দুÖপ্রাপ্য। এক টাকার নোটটা দেখে কেমন যেন লাগল, ঠিক চেনা এক টাকার নোট মনে হল না। খুব নতুন নোটও নয়, কী জানি, এক টাকার নোটের অন্য কোনও ডিজাইন হবে হয় তো। ওপরে কোণায় ইংরেজিতে এক লেখা আছে দেখে আমি নিশ্চিন্তে পকেটে ঢুকিয়ে নিলাম টাকাটা।
রুমে পৌঁছে আলোর সামনে রেখে দেখি, আরে, এ তো ভারতের কারেন্সিই নয়! এই তো পরিষ্কার লেখা, রয়্যাল গভর্নমেন্ট অফ ভূটান! ইংরেজির সাথে একটা দুর্বোধ্য ভাষা লেখা নোটটা জুড়ে, সেটা ভুটানিজই হবে।
বেশ রোমাঞ্চ হল, দোকানদার নিশ্চয়ই খেয়াল না করে আমাকে একটা ভুটানি নোট দিয়ে দিয়েছে, বেশ কালেকশনে রাখার মত একটা জিনিস। আমি এমনিতে কারেন্সি কালেক্ট করি না, সে শখও নেই, কিন্তু ফোকটে একটা বিদেশি নোট পেলে কে-ই বা ছাড়ে!
রাতের দিকে দুর্লভ সম্পত্তি দেখাবার মতন করে রুমমেট অতীনকে দেখালাম টাকাটা, 'এই দ্যাখ, আজ পেয়েছি।' অতীন আদৌ ব্যাপারটা পাত্তা না দিয়ে নিজের পার্স খুলে বেশ কয়েকটা এক টাকা দুটাকা পাঁচটাকার নোট দেখালো, সবকটাতেই লেখা রয়্যাল গভর্নমেন্ট অফ ভূটান।
লে হালুয়া! হাসতে হাসতে অতীন জানালো, এটা কোনও বিশাল ব্যাপার নয়, জলপাইগুড়ি জুড়ে ইন্ডিয়ান কারেন্সির সাথে একই রেটে ভুটানি কারেন্সিও চলে। একশো পাঁচশোর নোটও লেনদেন হয়। এখানে ভূটানি নোট পাওয়া কোনও ব্যাপারই নয়!
সত্যিই ব্যাপারটা তাই। চার বছর জলপাইগুড়িতে থাকাকালীন প্রচুর ভূটানী নোট ঢুকেছে এবং বেরিয়েছে আমার মানিব্যাগ থেকে। বাড়ি ফিরে আমার অনেক বন্ধুকেই বিলিয়েছি ভূটানী দু-পাঁচ টাকার নোট। দক্ষিণবঙ্গে ব্যাপারটা যত অভিনব, জলপাইগুড়িতে সেটা একেবারে জলভাত।
প্রসঙ্গত, এটা একটা ভারত সরকারের রেভিনিউ মারার খুল্লমখুল্লা ব্যবসা। এক ভুটিয়া টাকা ইজ ইকুয়াল টু পঁচাশি ভারতীয় পয়সা। পাশপোর্টের বালাই যেহেতু নেই, এবং জলপাইগুড়ি আর ভূটান যেহেতু অনেকটা কমন বর্ডার শেয়ার করে, ফলে খুব সহজেই প্রচুর ভূটানি টাকার লেনদেন ঘটে অবৈধ ভাবে। আমি যে এক টাকা ফেরৎ পেলাম দোকানদারের কাছ থেকে, সেটা আসলে পঁচাশি পয়সা।
দ্বিতীয় দিন ক্যাম্পাস ঘুরে দেখলাম। সত্যিই বিশাল, বিশাল জায়গা নিয়ে তৈরি এই ক্যাম্পাস। শিলিগুড়ি থেকে সোজা রাস্তা চলে গেছে ময়নাগুড়ি হয়ে। এটিই একমাত্র রাস্তা বাকি পৃথিবীর জন্যে, শিলিগুড়ি হয়ে আসাম, ভূটান, বাংলাদেশ সড়কপথে যাবার জন্য। হাইওয়ে জলপাইগুড়ি শহরের ভেতর দিয়েই গেছে, কেবল এই অংশটুকু শহরের বাইরে দিয়ে বাইপাস করে দেওয়া হয়েছে, বাইপাস গিয়ে মিশেছে কুড়ি কিলোমিটার দূরে ময়নাগুড়িতে। শহরের বাইরে, সেই ময়নাগুড়ি বাইপাসের ওপর অবস্থিত জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ। কলেজের মেন গেট দিয়ে ঢুকলেই প্রথমে কলেজের মূল বিল্ডিং, এর পর বিশাল বিশাল ফাঁকা মাঠের মধ্যে সরু সরু রাস্তার কোনওটা চলে গেছে ওয়ার্কশপের দিকে, কোনওটা গার্লস হস্টেলের দিকে, কোনওটা প্রফেসর্স কোয়ার্টার্স পার করে শেষ হয়েছে করলা নদীর ধারে। মাঝে একটা মাঠ ডিম্বাকৃতিতে জাল দিয়ে ঘেরা, এখানে ক্রিকেট ম্যাচ থেকে ফুটবল ম্যাচ, অ্যানুয়াল স্পোর্টস ইত্যাদি সমস্ত আয়োজিত হয়ে থাকে, এর নাম ওভাল। ওভালের ঠিক সামনেই পর পর দাঁড়িয়ে আছে জগদীশচন্দ্র বোস হল, বা হস্টেল টু, প্রফুল্লচন্দ্র রায় হল বা হস্টেল ওয়ান, দুটোই একে অপরের ঠিক মিরর ইমেজ। এক্কেবারে এক ডিজাইন, জাস্ট ডানদিকটা বাঁ দিক, বাঁ দিকটা ডানদিক।
হস্টেলের পেছনে আরেকটা বিশাল মাঠ, তার শেষ প্রান্তে হস্টেল থ্রি, সত্যেন বোস হল। এটার অনেক অনেক গল্প আছে, সে পরে করা যাবে, শুধু ওপর ওপর জানিয়ে রাখি, এই হস্টেল নতুনদের পক্ষে আদতে একটি ভুলভুলাইয়া। তিনটি আইডেন্টিকাল ব্লক পাশাপাশি জুড়ে এই হস্টেল, এর যে কোনও একটি ব্লকে থাকলে আলাদা করে বোঝা যাবে না কোন ব্লকে আছে এবং বাইরে যাবার রাস্তা কোনদিকে। এই হস্টেলের ছাদে যাবার সিঁড়ি একটা জানলার ভেতর দিয়ে পৌঁছতে হয়। হস্টেলটা তৈরি হয়েছিল নকশাল পিরিয়ডে, এবং এই অদ্ভুত স্থাপত্যের দৌলতেই এই হস্টেলের তথা এই ক্যাম্পাসের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে আছে অনেক অনেক কাহিনি, নকশাল আমলের। এক সময়ে এই করলার জলে ভেসে গেছে অনেক ছাত্রের লাশ।
তিন নং হস্টেলের ঠিক পেছন থেকে শুরু হয়েছে চা বাগান। ডেঙ্গুয়াঝাড় টি এস্টেট। এটা লিপ্টনের চা বাগান। এবং, বলবার অপেক্ষা রাখে না যে, এই চা বাগানই ছিল কলেজ ক্যাম্পাসের সবচেয়ে মোহময় জায়গা।
চা বাগান শুনে অনেকের মনে হতে পারে আমাদের ক্যাম্পাস বোধ হয় পাহাড়ে। কিন্তু না, এই চা বাগান সমতলের বাগান। পাহাড় জলপাইগুড়ি শহরের ধারেকাছে নেই। সমতলের বলে এই চা বাগানের চা খুবই নিকৃষ্ট কোয়ালিটির। সব রকম দামের চা-ই তো বাজারে ছাড়তে হয়!
চা গাছের সম্বন্ধে আমরা ইস্কুলে পড়েছি, প্রচুর জল লাগে, কিন্তু গাছের গোড়ায় যেন জল না দাঁড়ায়। তাই চা গাছ পাহাড়ে হয়। তা এই সমতলে, তরাইতে, জলের তো অভাব নেই, পাশে করলা থেকে প্রচুর জল পাওয়া যায়, কিন্তু জল দাঁড়ানোর সমস্যা থেকে তো সহজে মুক্তি পাওয়া যায় না! খাল কেটে তাই সে জল বের করে দেওয়া হয়। সেই চা বাগানের জলে দুতো আস্ত নদীই তৈরি হয়ে গেছে, যাদের জন্ম ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের ক্যাম্পাসে। একটার নাম ধরধরি, পলিটেকনিক আর আমাদের কলেজের মধ্যে দিয়ে যে বয়ে গেছে, যার ওপর দিয়ে আমি প্রথম এসেছিলাম, আরেকটার নাম রুকরুকা।
চা বাগানের ঠিক বুক চিরে চলে গেছে রেললাইন। এই রেললাইন বাকি ভারতের সঙ্গে নর্থ ইস্টের যোগসূত্র। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে নর্দার্ন ফ্রন্টিয়ার রেলওয়ের এই লাইন গেছে নিউ কোচবিহার হয়ে গুয়াহাটি পর্যন্ত। একটাই লাইন। কোনও ডাবল লাইন নেই। দূর থেকে আমাদের ঘরোয়া তিস্তা, কামরূপ এক্সপ্রেস তো আসেই, এ ছাড়াও বাকি সমস্ত উত্তরপূর্বের ট্রেন, যেমন ব্রহ্মপুত্র, অবধ অসম, গুয়াহাটি রাজধানী, সমস্তই এই পথ দিয়ে যায়। চা বাগানের বুক চিরে দিজেল ইঞ্জিনের ধোঁয়া ওড়াতে ওড়াতে যখন ট্রেনগুলো বেরিয়ে যায়, বড় সুন্দর লাগে দেখতে, এর সৌন্দর্যের ঠিক ভাষায় বর্ণনা হয় না।
চা বাগান কোথায় গিয়ে শেষ, কেউই কখনও দেখি নি, হস্টেলের ছাদ থেকেও চা বাগানের শেষ দেখা যায় না। অন্যপ্রান্তে খালি আকাশ। খালি বটে, তবে এই খালি আকাশই জাদু দেখায় নভেম্বরের মাঝ থেকে ডিসেম্বরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। এটা ক্যাম্পাসের উত্তর দিক। ঝকঝকে হেমন্তের ওয়েদারে আকাশের গায়ে ফুটে ওঠে হিমালয়, পুরো নীল রংয়ের। আর সেই হিমালয়ান রেঞ্জের মাথায় মুকুটের মত ঝকঝক করে তিনটে বরফে ঢাকা শৃঙ্গ : কাঞ্চনজঙ্ঘা, সান্দাকফু, ফালুট। লোকে পয়সা খরচা করে এদের দেখতে আসে কত দূর দূর থেকে, আমরা হস্টেলের ছাদে বসে, নিজের বেডে বসে দিনের পর দিন দেখেছি কাঞ্চনের রূপ, কখনও টকটকে লাল, কখনও আগুনের হল্কার রং, কখনও ধবধবে সাদা, কখনও বিষণ্ন নীল। তবে বছরে ঐ একটা সময়েই দেখা যেত, এক মাসের জন্য। তার পরেই কুয়াশায় ঢেকে যেত তরাই ডুয়ার্স। সে আরেক রূপ।
সব মোহময় সৌন্দর্যেরই একটা ভয়ঙ্করতা থাকে। আমাদের ক্যাম্পাসের চা বাগানেরও ছিল। ঐ রূপের টানে প্রচুর ছেলে ভাবুক এবং কবি বনে যেত। হয় তো আজও যায়। বিকেল হলেই খাতা পেনসিল হাতে গুটি গুটি চলে যেত করলার ধারে, কিংবা চা বাগানের নিরালায়। কবিতা লিখত। এই কবিতা লেখার বাতিকে আজ পর্যন্ত যে কত ছেলে অ্যানুয়ালে ব্যাক পেয়েছে, তার হিসেব নেই। তবু, সৌন্দর্যের টান এমনই, রেজাল্ট বেরনোর পর তিনদিন মন খারাপ, চতুর্থদিনই আবার চলে যেত, সেখানেই, মন খারাপ কাটাতে।