মনটা আমার বড্ড নরম, হাড়ে আমার রাগটি নেই,
তোমায় আমি চিবিয়ে খাব এমন আমার সাধ্যি নেই !
মাথায় আমার শিং দেখে ভাই ভয় পেয়েছ কতই না—
জানো না মোর মাথার ব্যারাম, কাউকে আমি গুঁতোই না ?
এস এস গর্তে এস, বাস ক'রে যাও চারটি দিন,
আদর ক'রে শিকেয় তুলে রাখব তোমায় রাত্রিদিন ।
হাতে আমার মুগুর আছে তাই কি হেথায় থাকবে না ?
মুগুর আমার হাল্কা এমন মারলে তোমায় লাগবে না ।
অভয় দিচ্ছি, শুনছ না যে ? ধরব নাকি ঠ্যাং দুটা ?
আদর আহ্লাদ ভালবাসা বোঝানো - দিব্যি তো এসব দিয়েই ঠাসা ছিল। ভালো কথা কানে ঢুকলো না। তাই শুধু শেষের একটা লাইনে গিয়েই যতো সব গোলমাল, হুমকি সংস্কৃতি ..... থ্রেট কালচার? তা যদি সত্যি হয় তবে বলতে হয় রাজনীতির গোড়ার কথাই হল থ্রেট কালচার। রাষ্ট্র বিজ্ঞানী এলান বল লিখেছেন, রাষ্ট্র, রাজনীতি, প্রশাসন, তারা সবাই তার নিজস্ব মতে, পথে অন্যকে প্রভাবিত চালিত করতে চায়। এই প্রভাবিত করার সামর্থ্য দুই রকম। প্রথমত অনুনয়, বিনয়, বুঝিয়ে বলা, এটা দেব, ওটা দেবো, পাইয়ে দেবো, খেতাব দেবো, পুরস্কার দেব, এমন কত কিছু। এতে যদি কাজ না হয়, তার জন্য থাকে তিরস্কার, হুমকি, একটু ভয় দেখানো, হালুম, ফোঁসস। এই গোটাটা মিলেই একটা রাজনৈতিক সংস্কৃতি। বাবা বাছায় কাজ না হলে ফোঁসস করা। কথা হলো পুরস্কার আর তিরস্কারের অনুপাতটা কেমন থাকবে। কারণ আল্টিমেটলি সব রাষ্ট্রের শেষ অস্ত্র ফোঁসস করা। অমন যে মার্কিন গণতন্ত্র, সেখানেও শান্তিপূর্ণ অকুপাই ওয়াল স্ট্রিটে আন্দোলনে ছাত্রদের ওপর নির্মম দমন পীড়ন চলেছিল। তাই বলছি সম্প্রতি থ্রেট কালচার শব্দটা এত ব্যবহার হচ্ছে, যেন এটা উত্তরবঙ্গ লবির একটা উত্তরে সংস্কৃতি। আমরা তো আমাদের কম বয়সে চিকিৎসা জগতে একটা বর্ধমান লবির কথাও শুনতাম। নিশ্চয়ই তারাও এইরকম কালচারেই অভ্যস্ত ছিলেন। তা না হলে বর্ধমানেরই তো এক সিপিএম নেতা বলেছিলেন "লাইফ হেল" করে দেব, মনে আছে তো? সেও তো থ্রেট বই অন্য কিছু নয়।
অমন যে মহামতি সম্রাট অশোক, যার মধুর বাণী মানুষের মাঝে প্রচারিত হতো, যিনি সামরিক বিজয় ত্যাগ করে ধর্মবিজয়ে মন দিলেন। এমনকি প্রশাসনে একদল আমলা নিযুক্ত হলো ধর্ম মহামাত্র। তিনিও কিন্তু তার সাম্রাজ্যে সেনাবাহিনী ভেঙ্গে দেন নি। মুগুর তারও ছিলো। আবার মহামতি আকবর রাজপুতদের প্রতি বরাবর মুক্ত উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন। কিন্তু তিনিও মেবারের সামান্যতম বেয়াদবি মানতে চান নি । আমি আসলে বলতে চাইছি আপোষ আর দমন হলো শাসকের একই নীতির দুটি দিক। এ যেন দ্বি ধার যুক্ত তরবারি। বিচারপতি থ্রেট কালচার শুনে খুব বিস্মিত হয়েছেন "এ তো সাংঘাতিক ব্যাপার"। তা আমি বলি অন ক্যামেরা কেন্দ্রীয় মন্ত্রী বলেছেন, "গোলি মারো শালোকো" - তিনি কি শোনেননি? আদালতে একজন বিচারপতি এক বিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষককে ভয় দেখাচ্ছেন, আমি আপনার পেনশনটা বন্ধ করে দেব? যদি দেই কেমন হবে? বলুন দেবো কিনা? আর সেই বৃদ্ধ প্রধান শিক্ষক আদালতে দাঁড়িয়ে কাঁদছেন। বিচারপতি উপভোগ করছেন। এটা কি থ্রেট কালচারে পড়ে না ?
পরিবারের মধ্যে যে থ্রেট কালচার চলে, সেটাকে কি সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া যায়। এটা করো, তাহলে ওটা দেবো। এটা করলে কিন্তু বাবাকে বলে দেব। প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভয় দেখানো চলে। এমনকি এই ভয়ের পরিবেশটা খানিকটা কাটিয়ে দিতেন দাদু ঠাকুমা বা পিসি কাকা। আজকের আধুনিক পরিবারে তাদের অস্তিত্ব সংকটের মুখে। ফলে মা বাবা অথবা আয়া মাসী যার কথাই বলি, তাদের কাছ থেকে জোটে পুরস্কারের প্রলোভন অথবা তিরস্কার। এগুলো থ্রেট কালচারের আতুর ঘর। পরিবারের অভ্যন্তরে একটু চোখ-কান খোলা রাখলে বহু নারী জীবনের দুঃখ কান্নার শব্দ গল্পকথা শুনতে পাবেন। আবার একটু লক্ষ্য করে দেখেছি বিপরীতে অনেক ক্ষেত্রে শাশুড়ি শ্বশুর এমনকি বৃদ্ধ বাবা মা তাদের উপরে চলতে থাকে পীড়ন। তালা বন্ধ করে রেখে দেওয়া হয়। আমি তো এমন ঘটনায় সান্ত্বনা দিই নিজেকে, যদি স্ত্রী-নিগ্রহ চলে এটাই স্বাভাবিক। স্ত্রী নিগ্রহ না চললে স্বামী নিগ্রহ হতো। শাশুড়ি বউকে পীড়ন না করলে বউ শাশুড়িকে পীড়ন করবে । নিগ্রহ হলো এই সমাজের অনিবার্য অনুষঙ্গ । যাদবপুরে স্বপ্নদীপের ওপর র্যাগিং ও যৌন নির্যাতন তো পুরুষতন্ত্র দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না। সরকার পুলিশ প্রশাসন কাউকে দায়ী করা চলে না। এটা আসলে সমাজের মধ্যেই থেকে যাওয়া এক পীড়নের মানসিকতা। পীড়নের আনন্দ, এ নিয়ে বাংলা খুব বেশি প্রতিবাদ মুখর হয়নি তো। কারণ স্বপ্নদীপ মোটামুটি ভাবে নদীয়ার গ্রাম থেকে আসা, হাওয়াই চটি শ্রেণীর অন্তর্ভুক্ত ছিল। উচ্চ বর্গের চোখে তাই তার হয়রানি অতটা অস্বাভাবিক ছিল না ।
বিদ্যালয়ে প্রবেশের পর সেখানে কি ছাত্র সদাই ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে না? বিদ্যালয়ের যা কিছু দমনমূলক আইন, নিয়ম সবই ছাত্রের জন্য। ইউনিফর্ম ছাত্রের জন্য। প্রারম্ভিক প্রার্থনা সভায় হাজিরার কঠোরতা, ছাত্রের জন্য। একটু এদিক ওদিক হলেই আছে শাস্তি, অভিভাবক তলব, ক্লাস থেকে সাসপেন্ড, কত ব্যবস্থা। নির্দিষ্ট সময়ের আগে ছাত্র তার নিজের টিফিন টুকুও খেতে পারে না। শিক্ষক পারেন। শিক্ষক কোন ক্লাস চলাকালে টিচার্স রুমে বসে কি হাসি মশকরা করেন না? তার জন্য সব মাফ। কিন্তু ছাত্র যদি শিক্ষক হীন ক্লাসে একটু কথাবার্তা বলে, তার জন্য আছে শাস্তি তিরস্কার ভৎসনা। আবার শিক্ষক এই ছাত্রদের মধ্যেই ছড়িয়ে রাখে তার অসংখ্য এজেন্ট, যাকে শুদ্ধ কথায় বলা যায় হেঞ্চম্যান বা মনিটর । এরা কিছু কিছু শিক্ষকের বাড়তি প্রশ্রয় পেয়ে ক্লাসের অভ্যন্তরে এবং স্কুলে অন্যদের উপর নানাবিধ দৌরাত্ম্য চালায়। সাধারণ ছাত্ররা ব্যঙ্গ করে এদের অমুক স্যারের "কোলের ছেলে" বলে ডাকে। একদিন ক্লাসে লিখতে দিয়েছিলাম প্যারাগ্রাফ, "বিদ্যালয় তোমার যা সবচেয়ে অপছন্দ"। নানা অপছন্দের কথা নানাজন লিখেছে। দু একজন লিখেছিল মনিটরদের দৌরাত্ম ও শিক্ষকের প্রশ্রয় নিয়ে বিস্তারিত করুন কাহিনী। তাহলেই ভাবুন।
তবে দু একজন তো পাগলা দাশু থাকেই, যারা শিক্ষকের চেয়ারের নিচে চিনে পটকা ফাটায়। একজন ফিজিক্স শিক্ষক ছাত্রদের কার্যত ভয় দেখিয়ে নিজের বাড়ির পাঠশালায় ভিড় বাড়ায়। নবম দশম হলেই ভৌত বিজ্ঞানের পৃথক ফিজিক্স ও কেমিস্ট্রি টিউটর দেওয়া হয়। এত বেশি ছাত্রদের উত্ত্যক্ত করতো যে বহু ছাত্রই ফিজিক্সে দুজন টিউটর নিতে বাধ্য হতো। কারণ যে শিক্ষকটির কথা বলছি, ছাত্ররাও জানে তার যোগ্যতা খুবই কম। কিন্তু মাধ্যমিকের ওরাল পরীক্ষার নম্বর, উচ্চমাধ্যমিকে প্র্যাকটিক্যালের নম্বর , এসব ভেবে তাকে ঘাটাতো না। ছাত্রদের বলেছি, তোমরা যারা ভালো ছাত্র তারাও দুটো পাঁচটা নম্বরের জন্য এত ভীতু? মৌখিক পরীক্ষায় বড়জোর দু'নম্বর কম দেবে, প্র্যাকটিক্যালে ৩ - ৪ নম্বর কম পাবে। বড়জোর ৫ কম পাবে। তার জন্য এভাবে আপোষ করো? কেউ শুনতো না। এক বছর একজন ছাত্রকে পেলাম যে লিখিতভাবে জানালো যে অমুক চন্দ্র ফিজিক্সের শিক্ষক তার কাছে প্রাইভেট পড়ার জন্য আমাকে চাপ দিচ্ছে। এমনকি নিয়মিত বিরক্ত করছে আমাকে। টেলিফোনে ভয় দেখাচ্ছে। প্রাকটিক্যাল এর নাম্বার নিয়ে এই অভিযোগ পাওয়ার পর, ওই শিক্ষককে নিয়ে সভা করে সিদ্ধান্ত করা হয়। দ্বাদশ শ্রেণীর ফাইনাল পরীক্ষায় ফিজিক্স প্রাক্টিক্যাল ঐ শিক্ষক আর কোন দিন, কখনো দায়িত্ব পাবে না। গৃহীত এই সিদ্ধান্ত প্রধান শিক্ষক সমস্ত ক্লাসে গিয়ে নিজের মুখে পড়ে দেন যে প্রাইভেট পড়ার বিষয়টা ছাত্রের ইচ্ছাধীন ও মর্জি মাফিক, এটা বাধ্যতামূলক নয়। এই পাগলা দাশু টি একমাত্র শিরদাঁড়ার জোর দেখিয়েছিল। সে এমবিবিএস, এমএস, করে এখন জীবনে সু প্রতিষ্ঠিত। এমন আরেকজন ছাত্রকে পেয়েছিলাম যে গণিতের ও ফিজিক্সের শিক্ষকের অনুরূপ চাপ কে কিছুতে ই মেনে নেয় নি। সে অত্যন্ত কৃতি ছাত্র ঠিকই। মাধ্যমিক পরীক্ষায় চতুর্থ হয়েছিল। অংকের স্যার আর ফিজিক্স এর স্যার তাকে বুঝে নিয়েছিলেন উচ্চমাধ্যমিকের নাম্বারে। কিন্তু সেই ছাত্রের কিছু যায় আসেনি। সে বর্তমানে সগৌরবে কাল্টিভেশন অফ সাইন্সে গবেষণা রত।
কলেজের ক্ষেত্রে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় বা বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু অসংখ্য কলেজ নিয়ে কারবার এই ভয়ের কারবারিরা কম সক্রিয়। তথাপি রাজ কলেজ লবি , হুগলি মহসিন লবি , এরকম কিছু কিছু থ্রেট ও প্রতিহিংসার নমুনা পাই । বিশেষত যদি কোন ভাবে ইটাচুনা - বাগাটি কলেজের একজন ছাত্র তার বিভাগে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবার সম্ভাবনা দেখায়, যে কোন মূল্যে এই সমস্ত লবি সক্রিয় হয়ে হাড় মাস চামড়া সব পাল্টে দেয়। এসব আজকের কথা না। মনে আছে ১৯৯১ এ এমনই এক ছাত্রের কেমিস্ট্রি অনার্স পার্ট টু প্র্যাকটিক্যাল পড়েছিল রানীগঞ্জ টিডিবি কলেজে । সেই ছাত্রের পরিবার আর আমরা এক বাড়িতেই ভাড়া থাকতাম। ওই ছাত্রের পরীক্ষায় যিনি এক্সটারনাল ছিলেন, পরে জানলাম সেও আমার ঘনিষ্ঠ পরিচিত। তিনি ওই ছাত্রের পরীক্ষায় মুগ্ধ। তারপর ফেরার পথে ছাত্র কোথায় থাকে জেনেছেন। এরপর আমাকে ফোন করে জানিয়েছিল অসাধারণ ভালো ছাত্র। এবার ও ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হবেই। তখনই বলতে বারণ করেছিল। আমিও কিছু বলিনি। এরপর যখন ফল প্রকাশ হলো, ওই ছাত্রটি অত্যন্ত খারাপ নাম্বার সহ সেকেন্ড ক্লাস পেল। কোথাও এমএসসি পড়ার সুযোগই পেল না। উচ্ছ্বাসে আবেগে ওই এক্সটার্নাল ফোন করে জানিয়েছিলেন বটে। কিন্তু এরপর রাঘববোয়াল কলেজের মাথারা নানাবিধ চাপ সৃষ্টি করে নম্বর পাল্টাতে বাধ্য করে। আর কল্যাণী যাদবপুর এই সমস্ত কলেজে যেহেতু কলেজ আর বিশ্ববিদ্যালয় একাকার, এদের অধীনস্থ অন্য কলেজ নেই, অতএব সবটাই কলেজের হাতে। থ্রেটের পরিমাণ তাই বেশি ।
পোস্ট গ্রাজুয়েশনে নাইন্থ পেপার আর টেন্থ পেপারের গল্প না হয় নাই বললাম। আমার ধারনা আমার দেখে আসা সেই নবম ও দশম পত্র এখনো একইভাবে বহাল আছে। থাক সে কথা, বরং যাদবপুর হাই স্কুলের কথা বলছি। প্রধান শিক্ষক ছিলেন আমার এলাকার মানুষ। এখন অন্যত্র বাড়ি করে চলে গেছেন। তার স্কুলে একটি শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম মত ইন্টারভিউ, এক্সপার্ট এর দেওয়া নম্বর, প্যানেল, সব হওয়ার পর প্রধান শিক্ষক যে প্যানেলটি ডিআই অফিসে পাঠাবেন বলে ঠিক করলেন, আলিমুদ্দিনের কর্তারা জানালেন প্যানেল পাল্টাতে হবে। তখন অনিল বিশ্বাস সম্পাদক। প্রধান শিক্ষক রাজি হলেন না। দীর্ঘদিন নিয়োগ আটকে থাকলো। প্রধান শিক্ষক তথাপি আলিমুদ্দিনের লালচক্ষু উপেক্ষা করলেন। যে কেউ অনুমান করতে পারেন সেই দুর্দান্ত প্রতাপ এর যুগে একজন প্রধান শিক্ষক শিরদাঁড়া সোজা রাখতে চাইছেন। কি সাংঘাতিক ভীতি প্রদর্শন, হুমকি। কিন্তু কোন কিছুই তাকে টলাতে পারে নি । মজার কথা তিনি কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থক ছিলেন না। কোথা থেকে এত মনের জোর পেলেন ভাবতে আজও বিস্ময় লাগে।
একজন ডাক্তার তিনি ঘোষণা করে স্বাস্থ্যসাথী কার্ডে চিকিৎসা অপারেশন ইত্যাদি করে। আমার প্রতিবেশী যখন সেই নামকরা সার্জনকে দিয়ে অপারেশন করাবেন ঠিক করল, ডাক্তারবাবু বললেন অপারেশনের আগের দিন কুড়ি হাজার টাকা নিয়ে চেম্বারে দেখা করতে। আমি তার কাছে শুনে অবাক, বললাম চেক পেমেন্ট কর বা অনলাইন পেমেন্ট কর। সে বলল ডাক্তারবাবু বলেছেন নগদ টাকা দিতে হবে। "জানোই তো স্বাস্থ্যসাথীর টাকা পেতে দেরি হয়" - ডাক্তারবাবুর যুক্তি । আমি বলেছিলাম এই ডাক্তারকে বাদ দাও, অন্য ডাক্তারও তো আছে। মনে হচ্ছে এই টাকাটা পেলে তবে ওর উনুনে হাঁড়ি চাপবে। কিন্তু পেশেন্ট পার্টির অচলা ভক্তি, ওই ডাক্তারকে দিয়েই করাবো। আর যার হাতে ছুরি কাঁচি তাকে রাগিয়ে লাভ নেই। নগদ টাকা গুনে দিয়ে এলো ডাক্তার বাবুর হাতে। পরদিন অপারেশন হলো। এ গল্প নতুন না প্রায় বেশিরভাগ ডাক্তার বাবু এভাবে স্বাস্থ্য সাথীকে বুড়ো আঙ্গুল দেখায়। সাধে কি নোট বন্দির সময় যত মানুষের নামে মিথ্যা আত্মহত্যার গুজব ছড়িয়েছিল, তার ভেতরে অধিকাংশ ছিল ডাক্তার। এ থেকেই ডাক্তারবাবু দের সামাজিক অবস্থান সহজেই বোঝা যায়। অর্থের পরিমাণ যত বাড়লো, সামাজিক সম্মান ততই কমলো। আগে কোনদিন এত ডাক্তার বাবুকে মার খেতে দেখে নি কেউ পেসেন্টের হাতে।
সমাজ আজ স্পষ্ট গ্রেট কালচারের উপরে দাঁড়িয়ে আছে। একে বিনাশ করবেন কিভাবে? যে ডাক্তার বাবুর কথা বললাম নগদ কুড়ি হাজার টাকা পকেটে পুড়লেন , সেই ডাক্তারই কিছু কর্তা ব্যক্তিদের ইশারায় কোনো ফিজ ছাড়াই ছুরি কাঁচি ধরেন । কারণ এই কর্তাদের হাতে রাখতে হয়। তারাও থ্রেট করেন একটু দেখবেন। বিপদে আপদে ওরাই ডাক্তারের ভরসা। কে যে কাকে থ্রেট করছে বোঝা ভারী মুশকিল। আসলে ক্ষমতার অনুষঙ্গ হলো থ্রেট করা। এটা হল তার ফাইনাল রিসর্ট। তাহলে এই সমাজে পুকুরের একঘাটে বিষক্রিয়া হলে অন্য ঘাটে মাছ মরবে না তা তো হয় না। অতএব যে যাকে পারে হুমকি ধমকি চমকানো চলতে থাকে। এটা নিয়ে কর্মবিরতি করে লাভ নেই। তাহলে সমাজ বিপ্লবের ডাক দিতে হয়। যে সমাজে বৈষম্য থাকবে না, অতএব থ্রেট থাকবে না। সেই ১৯ শতকের রামমোহন বিদ্যাসাগরকেও সমাজপতিরা সমাজচ্যুত করার হুমকি দিয়েছিলেন। এগুলোকে উপেক্ষা করেই লড়াই আন্দোলন এগিয়ে চলে। সমাজও পাশাপাশি চলতে থাকে। জুনিয়ার ডাক্তাররা থ্রেট কালচার বন্ধ করার দাবি করতেই পারেন , কিন্তু সেটা বন্ধ না হলে আমাদের কর্ম বিরতি চলবে। কিন্তু আমরা নিয়মিত বেতন নিয়ে যাবো। এটা কোথায় যেন হাস্যকর লাগছে। আর তিলোত্তমার পৈশাচিক ঘটনায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত হিসেবে প্রতিবাদী কর্মবিরতি যথার্থ ও ন্যায় সঙ্গত। কিন্তু আমি রোগীর হাতে প্রহৃত হলাম তাই কর্ম বিরতি। এটা ডাক্তারবাবুর নিজের আত্মসম্মানেও লাগা উচিত। শিক্ষকদের বলতাম, ক্লাসে ছাত্রের কোন আচরণে বিরক্ত হয়ে, যা সমাধান ক্লাসেই করবে। ক্লাস ছেড়ে চলে এসে, হেডমাস্টার কে বিহিত করতে বললে, ছাত্র ও হেডমাস্টার দুজনের চোখেই তুমি অযোগ্য বলে প্রমাণিত হবে।
দেশি বিদেশি ডিগ্রিধারী এক ডাক্তারবাবু তিনি পিজি হাসপাতালের ডাক্তার। প্রেসক্রিপশনে একটি বিনম্র থ্রেট , "ডু নট সাবস্টিটিউট দ্য মেডিসিন" ছাপার অক্ষরে লেখা আছে। খুব বিচিত্র লেগেছে আমার এমন নির্দেশ বো থ্রেট এই প্রথম দেখলাম। ডাক্তারবাবু এই নমনীয় থ্রেট করার কারণটা পরে বুঝলাম। চেম্বার থেকে বেরোনো মাত্র এমআর দল প্রেসক্রিপশনের ছবি তুলে নিল। তখন বুঝলাম তারাও বাইরে দাঁড়িয়ে ডাক্তারবাবুকে ওয়াচ করছেন, এটাই থ্রেট কালচার। এটা দূর করবেন কিভাবে?
শেষে যে প্রসঙ্গটা বলবো সেটাকে জুনিয়র ডাক্তারবাবুরা থ্রেট কালচার বলে গণ্যই করেন না জানি। আগে বিদ্যালয়ে ভালো মেধাবী ছাত্ররা উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার পাঠ গ্রহণের পাশাপাশি আরেকটু হায়ার প্রবলেম নিয়ে পড়াশোনা, কঠিনতর সিলেবাসের আলোচনা করত। জয়েন্ট এনট্রান্সের প্রস্তুতি নিতো । সাধারণ উচ্চমাধ্যমিক সিলেবাসের চেয়ে একটু কঠিন ছিল তাদের চর্চার বিষয়। ফলে বহু বিত্তহীন, মধ্যবিত্ত ঘরের মেধাবী ছাত্রকেও জয়েন্টে ডাক্তারি ইঞ্জিনিয়ারিং এ প্রবেশ করতে দেখেছি। কিন্তু একদিন সে ভুল ভাঙলো। একজন নামকরা শল্য চিকিৎসক আমার ছাত্রের অভিভাবক তিনি সন্তানকে জয়েন্টের জন্য কোথায় কোচিং করাবেন তা নিয়ে আর এক শিক্ষকের সাথে আলোচনা করছেন। আমি বললাম, আপনি নিজে ডাক্তার মানুষ। আপনি যত ভালো কোচিং দেবেন, অন্য কে তার চেয়ে ভালো দেবে? বললাম, চেম্বার দুদিন অফ করে ছেলেকে নিয়ে বসে যান। ডাক্তার বাবু বললেন, দুদিন কেন, চেম্বারে তালা ঝুলিয়ে বসতে রাজি আছি। কিন্তু ঘটনা হলো আমাদের সেই দিন গেছে। এখন জয়েন্টের প্রশ্নগুলো এমন ভাবে করা হয় যেখানে বুদ্ধি বা মেধা নয়, বারেবারে অনুশীলন ও মুখস্ত করাই শেষ কথা। ইউজি বা পিজি এন্ট্রান্স পরীক্ষায় ঢুকে দেখবে কোচিং সেন্টারের প্রশ্নগুলোই হুবহু হাজির। ও বাছ বিচার না করে মুখস্ত বিদ্যা দিয়ে টিক মারবে। এর জন্যই জন্ম নিয়েছে আকাশ ফিটজি ইত্যাদি কোচিং সেন্টার। লক্ষ লক্ষ টাকা নিয়ে কোচিং দেয়। অতএব ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার হওয়ার স্বপ্ন এখন বিত্তের পদতলে। উচ্চমাধ্যমিকে দশম স্থান অধিকারী ছাত্রও নিজের বুদ্ধি বা মেধা দিয়ে নিট পরীক্ষায় ভালো র্যাংক করতে পারেনা। এমনকি এক বছর নষ্ট করে সার্বিকভাবে নীটের প্রস্তুতি নিয়েও ভালো র্যাঙ্ক পায়নি। এটা কি বিত্ত কৌলিন্যের থ্রেট বা চোখ রাঙানি নয়? এভাবে দেবী ভারতী লক্ষ্মী দেবীর অধীনতা স্বীকার করেছে। এটা কি মেধাকে বৃত্তের চোখ রাঙ্গানি বা থ্রেট নয়। পেশা প্রবেশের আগেই লক্ষ লক্ষ টাকার বিনিয়োগ। পরীক্ষার দুর্নীতি ও টাকার খেলা বাদই দিলাম। অতএব পাশ করার পর কতজনের মধ্যে সেবার মনোভাব থাকবে? এটা বুদ্ধি মেধা ও পরবর্তী জীবনে পেশায় বিত্তের থ্রেট কালচার ডেকে আনবেই। ডাক্তার রোগীর সম্পর্কে অবিশ্বাস ডেকে আনবেই, অতএব নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে না। এই যুগ হলো সম্পর্ক ভাঙ্গনের যুগ। অতএব নিরাপত্তা একটা দীর্ঘস্থায়ী সামাজিক প্রক্রিয়া। আদালত প্রশাসনের ফতোয়া আর নির্দেশ দিয়ে সেটা হবে না।
বস্তুত প্রভূত বিত্তের অধিকারী যে সমাজ, সেই সমাজ বিত্তের শীর্ষে আরোহন করলেও, তাকে তার ভেজাল নিম্ন গুণমানের ওষুধটি বাজারে চালানোর জন্য নির্ভর করতে হতো মেধার উপর। এটা খুব সমস্যা। একই ভাবে বিত্তের অধিকারী কে অন্যায় বেআইনি কাজ করে রেহাই পাওয়ার জন্য নির্ভর করতে হতো পুলিশ প্রশাসন আমলা বিচার বিভাগের ওপর।
আজকে এই নির্ভরতা আর চায় না। বিত্তের দাপটে সে ডাক্তার, আইএএস, আইপিএস, জুডিশিয়াল সার্ভিস সর্বত্র নিজের শ্রেণীকে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। সেটা করতে গেলে প্রবেশিকা পরীক্ষাকে মেধার প্রাধান্য মুক্ত করে বিত্তের অধীনস্থ করতে হবে। যেখানে মেধা বা বুদ্ধি প্রধান বিচার্য হবে না। তেমন একটি ব্যবস্থা। তার নিজের সন্তানটিকে ঐ সমস্ত পদে আসীন করবে। ইলেক্টোরাল বন্ডে যে ৩৫ টি ওষুধ কোম্পানি অর্থ দিয়েছে শত শত কোটি টাকা তারা এর সবটা উসুল করে নেবে অসুখের দামে এবং মানে । তাহলে সাধারণের স্বার্থ ও স্বাস্থ্য কি হবে? আপনি ভাবছেন তাহলে তো তার নিজের চিকিৎসার নিরাপত্তার কি হবে? তার চিকিৎসা তো হবে এ দেশে নয়, বিদেশে। এরা করবে আমজনতার দেখভাল। এই থ্রেট কালচার নিয়ে ডাক্তার বাবুরা সরব হবেন কবে? আমিও আমার অশক্ত শরীর নিয়ে সেদিন পথে নামবো।