প্রথম শীত চলে এল উত্তরবঙ্গে। জানুয়ারি মাস। জীবনে কখনও এত শীত সহ্য করতে হয় নি। তাপমাত্রা প্রায় দুই তিন ডিগ্রি ছুঁয়ে ফেলল প্রথম সপ্তাহেই। হস্টেলের ঘর এমনিতেই খোলামেলা। তার ওপর পাশেই বিস্তীর্ণ চা বাগান, করলা নদী, অদূরেই পাহাড়, আর ঘরে কাচের জানলা। প্রায়শই কাচ ভাঙা থাকত আর পিডব্লুডি সেটা পাল্টানোর নামে মাসের পর মাস টালবাহানা করত, ফলে খবরের কাগজ দিয়ে ঠেকনো দিয়ে রাখা থাকত ভাঙা জানলাগুলো। তরাইয়ের জলবায়ু সবসময়েই ভিজে ভিজে, স্যাঁতসেঁতে, সব মিলিয়ে ঠান্ডা ওখানে বেশ কষ্টদায়ক হয়ে উঠত।
টিনের খাট, তার ওপরে একটা মাত্র তোষক পাতা, তার ওপরে লেপ মুড়ি দিয়ে আমরা, খুব কম ছেলের ভাগ্যেই কাঠের খাট জুটত। দিনের বেলা তাও কেটে যেত, কষ্ট হত রাতে ঘুমোবার সময়ে। সারা শরীর জমে বরফ হয়ে যেত, এপাশ থেকে ওপাশ করতে গেলে ঘুম ভেঙে যেত, মনে হত যেন সারা শরীরে অসহ্য বেদনা, পায়ে সাড় নেই, নাকের ডগায় সাড় নেই, হাতের আঙুলে সাড় নেই। মোজা পরে ঘুমোতে শুরু করলাম, পা বাঁচল খানিক, কিন্তু এপাশ ওপাশ করতে গেলেই ঘুম ভেঙে যেত। সে যে কী অসহ্য কষ্টে কেটেছে প্রতিটা শীত, বলে বোঝানো যাবে না। ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছিলাম সকলেই। সকাল এগারোটা কি বারোটা নাগাদ কষ্ট করে সূর্য উঠত, আবার বিকেল তিনটেয় হারিয়ে যেত কুয়াশার আড়ালে।
কুয়াশা। সে বড় ভয়ংকর কুয়াশা। দৈবাৎ সকালে ঘুম থেকে উঠতে হলে ঘর থেকে বেরোলেই মাথা ঘুরে যেত। লম্বা করিডর ধরে পরপর ন দশখানা ঘর, কেবল নিজের ঘর আর পাশের ঘর ছাড়া আর কোনও ঘর দেখা যাচ্ছে না। অন্যপ্রান্তে বাথরুম টয়লেট, কেবল আন্দাজে ভর করে এগনো। চারহাত দূরে কেউ দাঁড়িয়ে থাকলে তাকেও দেখা যায় না, এত ঘন কুয়াশা। রাতের দিকে কুয়াশা হত আরও ভয়ানক। একদিন রাতে এই রকম কুয়াশার ভেতর সাইকেল করে ফিরছিলাম বাইরে থেকে, হস্টেলে, কী কারণে কে জানে, রাস্তার আলোগুলোও জ্বলছিল না, জিরো ভিজিবিলিটির প্রভাবে সোজা ধাক্কা মেরেছিলাম একটা মোড়ের রাউন্ড-অ্যাবাউটে। একেবারে সামনে থেকেও দেখতে পাই নি, জাস্ট আন্দাজে রাস্তা বুঝে চলছিলাম। প্রচন্ড চোট আঘাত পেয়েছিলাম।
শিলিগুড়িতে বরং একটু কম ঠান্ডা পড়ত। শিলিগুড়ি একেবারে পাহাড়ের কোলে তো, ফলে ঠান্ডা হাওয়া পাহাড়ে অনেকটাই গার্ড হয়ে যেত। অতটা ঠান্ডা থাকত না। শীতকালে শিলিগুড়ির একটা বড় আকর্ষণ ছিল কাঞ্চনজঙ্ঘা স্টেডিয়ামের কাছে বসা ভুটিয়া মার্কেট। শীতবস্ত্রের সম্ভার। কী যে সস্তায় সোয়েটার জ্যাকেট পাওয়া যেত সেই মার্কেটে ভুটিয়াদের কাছে, তেমনটি আর কোথাও মিলত না। মার্চ নাগাদ এরা উঠে যেত। আবার বসত পরের বছর ডিসেম্বরে।
শিলাবৃষ্টি ছিল তরাইয়ের শীতকালে উপরি পাওনা। এ শিল আবার আমাদের দক্ষিণবঙ্গের মত মিহি শিল নয়, যে ছাতা মাথায় কুড়োতে বেরিয়ে পড়লাম। রীতিমতো তাগড়া তাগড়া শিল, মাথায় পড়লে আর বেঁচে ফিরতে হবে না। বরফের বড় বড় চাঙড় পুরো। সেকেন্ড ইয়ারেই বোধ হয় দেখেছিলাম শ্রেষ্ঠ শিলাবৃষ্টি। আধঘন্টার মধ্যে হস্টেলের সামনে বিশাল ফাঁকা সবুজ ক্যাম্পাস পুরো সাদা হয়ে গেল। শিলের সাইজ দেখে কেউ বেরোতে সাহস পায় নি। একজন বোধ হয় বেরিয়েছিল, প্রথম শিলের আঘাতেই তার ছাতা ছিঁড়ে ফুটো হয়ে গেল।
তেমন শিলাবৃষ্টি অবশ্য প্রতি বছর হয় না। আমরাও ঐ একবারই দেখেছিলাম চরাচর সাদা করে দেওয়া শিলাবৃষ্টি। তবে শিল পড়লে তা সবসময়েই ঐ বড় বড় চাঙড়ে পড়ে। একবার একজনের পায়ে শিল পড়েছিল, কড়ে আঙুলে, পুরো রক্তারক্তি কান্ড একেবারে!
শীতের সময়ে একটা উপরি ছুটি পাওনা হত আমাদের সকলের। ডিসেম্বরের ক্রিসমাসের সপ্তাহ থেকেই পড়াশোনায় ঢিলে পড়ে যেত, শিক্ষক ছাত্র দু তরফেরই পারস্পরিক বোঝাপড়ায় ঐ সময়টাতে কিছুদিন কলেজে পঠনপাঠন বন্ধ রাখা হত। অফিসিয়াল নয়, এমনিই। আমাদের অধিকাংশই যেহেতু ছিল দক্ষিণবঙ্গের ছেলেপুলে, তাই যাওয়া-আসা একইসাথে চলত। পুরো দল হস্টেল খালি করে চলে যেত একসাথে, আবার ফিরতও একসাথে। সমস্ত ব্যাপারটাই ঐ বোঝাপড়ার মাধ্যমে হত, যাতে করে পরে ফিরে কাউকে ক্লাসে পিছিয়ে পড়তে না হয়। মোটামুটি ডিসেম্বরের শেষ থেকে জানুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত এই শীতকালীন ছুটি পাওয়া যেত। এই সময়েই উত্তরবঙ্গের শীতটা অসহনীয় হয়ে উঠত।
অনেকেই, সমস্ত কিছু উপেক্ষা করেও থেকেই যেত হস্টেলে। তেমন শীত তো আর দক্ষিণবঙ্গে জোটে না, সেই শীতকে উপভোগ করারও একটা মজা আছে। সেই মজার বশেই আমরা অনেকেই থেকে যেতাম কলেজ ক্যাম্পাসেই, হস্টেলে। পারলে এন্তার ঘোরো, খাও দাও, কোথাও বেড়াতে যাবার থাকলে বেড়িয়ে এসো এই সময়ে। শীতকালে পাহাড়ে অফ সীজন চলে, সমস্ত হোটেল অর্ধেকেরও কম ভাড়ায় ঘর দিয়ে দেয়। পাহাড়ের বুকে দাঁড়িয়ে হিমশীতল হাওয়া বুক পেতে নেওয়ার সাহস তো কুড়ি একুশ বছরেই সবচেয়ে বেশি থাকে।
সে বার, আমরা বোধ হয় সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি, শীতের সময়ে, বছরের শেষ সপ্তাহে হস্টেল যথারীতি খালি হয়ে গেল। মেস বন্ধ, ক্যাম্পাস খালি, ভূতের মত পড়ে রইলাম আমরা জনা পনেরো-ষোল জন ছেলে।
আমাদের কলেজে একটা ট্রেকার্স ক্লাব ছিল। অনেকেই ওখান থেকে ট্রেকিং কিট নিয়ে সান্দাকফু ট্রেকিং করতে যেত। খুব নাকি এনজয়েবল জার্নি ওটা। খরচা হয় কয়েক হাজার। কিন্তু খরচাটা গায়ে লাগে না যখন কেউ সফলভাবে গৈরীবাস-টাস হয়ে সান্দাকফু ট্রেক করে ফেরে।
সেই সময়ে খরচাটা করার মত সঙ্গতি আমার ছিল না। জনা আষ্টেক ছেলেপুলে, ট্রেকার্স ক্লাব থেকে তল্পিতল্পা ভাড়া নিয়ে চলল সান্দাকফুর উদ্দেশ্যে। পড়ে রইলাম আরও কম কিছুজন।
মেস বন্ধ। খাওয়া দাওয়ার টেম্পোরারি অ্যারেঞ্জমেন্ট নবীনদার ক্যান্টিনে। হস্টেলের ক্যান্টিন। মেসের খাওয়া যতটা জঘন্য ছিল, তত ভালো ছিল নবীনদার হাতের রান্না, ফলে হস্টেলের মেস বন্ধ হয়ে গেলে আমরা কদিন নবীনদার ক্যান্টিনে খেয়ে সুখ পেতাম। বলতাম, বলিউডের হিরো গোবিন্দা, আর জলিউডের হিরো নবীনদা।
তো, সেই কম কিছুজন মিলে যখন ক্যান্টিনে বসে গুলতনি মারছি, আমরাও অল্প খরচে কোনও জায়গা থেকে ঘুরে আসতে পারি কিনা, তখন নবীনদাই উপযাচক হয়ে পরামর্শ দিল, বোদাগঞ্জ চলেন।
জলপাইগুড়ি ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজের যেদিকে জলপাইগুড়ি শহর, তার ঠিক উল্টোদিকে প্রায় ৬-৭ কিলোমিটার দূরে ছিল বনবিভাগের তত্ত্বাবধানে থাকা এই বোদাগঞ্জ ফরেস্ট। যোগাযোগ বলতে কিছু নেই, কেবল দিনে একটি উত্তরবঙ্গ পরিবহনের ভাঙাচোরা লাল-নীল রঙের বাস যেত ওদিকে, আর দিনের শেষে ফেরৎ আসত ধুঁকতে ধুঁকতে। ডেঙ্গুয়াঝাড় থেকে রংধামালি নামের একটা ছোট্ট গ্রাম পেরিয়ে যেতে হয়। অনেক দূরে, বনেরও একেবারে শেষ মাথায় বিশাল বড় তিস্তার ড্যাম, সেই ড্যামের কোলেই এই জঙ্গল।
ঠিক হল, এই বোদাগঞ্জেই যাওয়া হবে পিকনিক করতে। সাতজন রাজি হয়ে গেল। অল্ সেট।
বাস আমাদের কলেজের রাস্তা দিয়েও যায় না, আর আমরা বাসের পরোয়াও করি না। সাতজন সাতটা সাইকেল, পথপ্রদর্শক নবীনদা। জনপ্রতি একশো টাকা, আর কিছু বস্তা, চাল-ডাল বেঁধে নিয়ে যাবার জন্য।
কথা ছিল সকাল সকাল বেরোব, কিন্তু শীতের দিন, ঘুম থেকে উঠে রেডি হতে হতেই বেলা এগারোটা বেজে গেল। তখন প্ল্যান চেঞ্জ করে ঠিক করা হল, আমরা জঙ্গলে রাত্রিবাস করব, বেশ অ্যাডভেঞ্চার হবে। কে যেন খবর এনেছিল, ওখানে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো আছে, দরকার পড়লে সেখানেই থাকা যাবে। চালাও পানসি বেলঘরিয়া। দুপুর দেড়টা নাগাদ অবশেষে খেয়ে দেয়ে বেরোলাম বোদাগঞ্জের উদ্দেশ্যে। পথে রংধামালিতে কিনে নেওয়া হল চাল ডাল মুরগি ইত্যাদি। বাংলা এবং ইংরেজি তরলেরও জোগাড়যন্ত্র হয়ে গেল। শুরু হল যাত্রা।
রংধামালি কলেজ থেকে দশ কিলোমিটার মত দূরে। একটা নিতান্তই ছোট গঞ্জ। কয়েকঘর মাত্র লোকের বাস। হাটের দিন ছাড়া ভিড় হয় না। সেইখানে পৌঁছে একটু জিরিয়ে নেওয়া গেল, তারপরে আবার এগোলাম। বিকেল চারতে নাগাদ পৌঁছলাম বোদাগঞ্জ ফরেস্ট।
নামেই ফরেস্ট, বন্যজন্তু-টন্তু কিছুই নেই সেখানে, লম্বা লম্বা শাল সেগুন গাছের সারি, কাঠকুড়ুনি মেয়েবউরা সেখানে শুকনো পাতা-টাতা আর কাঠকুটো কুড়োয়, ফরেস্টেরই একপ্রান্তে একটা ছোট বসতি মতও আছে। পায়ে চলা আর সাইকেলে চলা একটা রাস্তা তৈরি হয়ে আছে আপনাআপনি, সেই পথ ধরে একটু এগোতেই চোখে পড়ল বনবিভাগের অফিস, চৌকিদারের কোয়ার্টার, আর ... হ্যাঁ, আমাদের রাত্রিবাসের উপযুক্ত একটা ফরেস্ট বাংলো। ঠিক গল্পে যেমন বিবরণ পড়েছি এতদিন, সেই রকম, বড় বড় কাঠের লগ দিয়ে মাটি থেকে উঁচু করে বানানো একটা আদ্যোপান্ত কাঠের বাড়ি, মাথায় ঢালু কাঠের ছাদ। বাইরের দিকে তিন ধার জুড়ে কাঠের করিডর বানানো, কাঠের রেলিং, আর তার ঠিক পেছন দিয়েই মাঝারি সাইজের বোল্ডারের ওপর দিয়ে কুলকুল করে নি:শব্দে বয়ে যাচ্ছে তিস্তা নদী। চারদিকে জাস্ট কোনও শব্দ নেই, আমাদের হইহল্লা ছাড়া। আর চুপ করলেই কেবল শোনা যাচ্ছে শুকনো পাতার সরসর আওয়াজ। রাশি রাশি শুকনো শালপাতা আর সেগুনপাতা।
চৌকিদার কোথায়? খুঁজেপেতে চৌকিদারকে বের করা হল। লাটসাহেবি চালে আমাদের মধ্যে কেউ একজন তাকে বলে বসল, ঘর খুলে দাও, আমরা থাকব এখানে আজ রাতে, জলপাইগুড়ি থেকে আসছি। চৌকিদার কি অত সহজে ভোলে? পরিষ্কার বলে দিল, রেঞ্জার সাহেবের কাছ থেকে পারমিশন না পেলে সে কাউকেই ঘর খুলে দেবে না। ... কেলো করেছে! রেঞ্জার কোথায় থাকে? তিনি এই ফরেস্টেই থাকেন, ঐ পাশের কাঠের বাড়িটা ওনার, কিন্তু উনি এখন গঞ্জে গেছেন, একটু বসতে হবে।
এই বার একটু ভয় করতে শুরু করল, ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসার, না জানি কি জাঁদরেল লোক হবেন টবেন। ধমকেই যদি ভির্মি খেয়ে যাই, তা হলে বার্গেইন করব কী করে? আমরাই উদ্যোগী হয়ে গঞ্জ খুঁজতে বেরিয়ে পড়লাম, পেয়েও গেলাম একটু হাঁটতেই, ছোট্ট গ্রামের মধ্যেই আরও ছোট্ট এলাকা নিয়ে গুটিকয় দোকান, তার নাম গঞ্জ। বোদাগঞ্জে এখনও বিদ্যুৎ পৌঁছয়নি, তাই বেলাবেলি এখানে লোকে দোকানবাজার সেরে ফেলে সন্ধের মধ্যে বাড়ি ঢুকে পড়ে, বন্য জন্তু না থাকলেও অন্ধকারে জঙ্গলে পথ হারয়ে ফেলা বিচিত্র নয়। তো, সে যাই হোক, সেখানে গিয়ে জিগ্যেস করতেই রেঞ্জার সাহেবকে দেখিয়ে দিল। তাঁকে দেখে আমরা সত্যিই ভির্মি খেলাম। আমি নিজে রোগা প্যাংলা ছেলে, রেঞ্জার সাহেব আমার থেকেও রোগা, ফুঁ দিলে উড়ে যাবেন এ রকম চেহারা, ওই শরীরে সাদা শার্টটাও যেন লাগছে কাকতাড়ুয়ার মতো, একটা বাঁশের তৈরি বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছেন। বুকে বল এল। গিয়ে দাবি পেশ করলাম, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছেলে, বেড়াতে এসেছি, দয়া করে আজ রাতের মতো বাংলোটা যদি দ্যান ... উনি ততোধিক মিহি গলায় বললেন, বাংলো তো ও ভাবে দেওয়ার নিয়ম নেই, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বড় বড় অফিসাররা যখন আসেন, তখন তাঁদের জন্য এই বাংলো রাখা থাকে। এমনিতে এখানে থাকতে হলে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের লিখিত অনুমতি নিয়ে আসতে হবে। আর সেই ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের অফিস হল গিয়ে শিলিগুড়তে। সুতরাং ... কিছু করার নেই, ধরে বসে পড়লাম, উনিও দেবেন না, আমরাও ছাড়ব না। প্রচুর তেল মারা, মাখন মারার (আমাদের কলেজের ভাষায়, মাল নামানো) পরে, মাল অবশেষে নামল। উনি এই শর্তে দিলেন চাবি, "দ্যাখো, ঘর আমি দিচ্ছি, কিন্তু এটা বেআইনি কাজ, যদি আজ রাতের মধ্যেই কোনও ফরেস্ট অফিসার বাই চান্স চলে আসেন এখানে, তোমাদের কিন্তু দেন অ্যান্ড দেয়ার বাংলো ছেড়ে দিতে হবে।
.তাই সই। হই হই করে ঢুকে পড়লাম বাংলোতে। বেশ অ্যাডভেঞ্চারাস লাগছল তখন। কাঠের মেঝে, পা ফেললেই মচ মচ করে একটা অদ্ভুত আওয়াজ হচ্ছিল। দু"টো বেডরুম, একটা ডাইনিং হল, একটা কিচেন, লাইট ফ্যান সমস্ত কিছুরই সুইচ আছে, কিন্তু টিপতে কিছুই জ্বলল না। গেলাম আবার রেঞ্জার সাহেবের কাছে। তিনি তখন নিজের ঘরে বসে ভাত রাঁধছিলেন, আর টিভিতে ডিডি ওয়ান চলছিল। বারান্দায় রাখা একটা বিশাল বড় সোলার সেল। ওতেই ওনার তিনটে আলো জ্বলে, আর টিভিটা চলে। কাছেই রিলে সেন্টার থাকায় ডিডি ওয়ানটা দেখতে কোনও অসুবিধে হয় না। যখনকার কথা বলছি, তখনও শহর কলকাতায় অ্যান্টেনার ছড়াছড়ি,কেবল চ্যানেল তখনও আমাদের জীবনে প্রবেশ করেনি। রেঞ্জার সাফ জানিয়ে দিলেন, ওই বাংলোর আলো জ্বলে জেনারেটরে, বড় অফিসার এলেই জেনারেটর চালানো হয়, এখন সম্ভব নয়। উনি জানালেন, এখনো গঞ্জে গেলে মোমবাতি পাওয়া যাবে, আমরা নিয়ে আসি যেন।
তথাস্তু। কয়েকজন গেল গঞ্জে মোমবাতি আর কেরোসিন কনতে, আমি থেকে গেলাম রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে গল্প করতে।
বেচারা নি:সঙ্গ মানুষ, কিছু আদিবাসী ছাড়া কথা বলার কেউ নেই। তাঁর বাড়ি কোথায়? ... শুনে চমকে গেলাম, তাঁর বাড়ি
শান্তিনিকেতন। ননা, রবি ঠাকুরের লেখা উনি পড়েছেন সবাই যেমন পড়ে টড়ে আর কি, নিজে কোনও দিন গল্প কবিতা লেখার
চেষ্টাও করেননি, সাধারণভাবে লেখাপড়া শেষ করে বনবভাগের এই চাকরিটা পেয়েছেন, তাতেই দেশে তাঁর বাড়ির লোকের
গ্রাসাচ্ছদন হয়ে যায়। অনেকটা যেন সেই ঘূণপোকা উপন্যাসের সুবোধ মিত্তির, না? ... আর তাঁর নিজের শখ আহ্লাদ? শখ মেটাবার উপায় কোথায় এই পান্ডববর্জিত জঙ্গলে? মাসে একবার জলপাইগুড়ি টাউনে যান, মাসের প্রয়োজনীয় জিনিস কেনাকাটা করে চলে আসেন, কখনও রূপশ্রী, রূপমায়া কি অন্য কোনও হলে একটা দুটো সিনেমা। উনি কথা দিলেন, এর পরে জলপাইগুড়ি টাউনে গেলে অবশ্যই আমাদের হস্টেলে বেড়াতে আসবেন।
ততক্ষণে বন্ধুরা চলে এসেছে। এসে শোনাল তাদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতা। সন্ধে সাড়ে সাতটা বাজে, চতুর্দিক ঘুটঘুটে অন্ধকার, সমস্ত দোকান বন্ধ, সব্বাই নি:সাড়ে ঘুমোচ্ছে। কোনওমতে একটা দোকান খুলিয়ে কিছু বিড়ির প্যাকেট, এক বোতল কেরোসিন আর মোমবাতি দেশলাই কিনে আনা গেছে। রেঞ্জার শুনে হাসলেন। বললেন, এখানে সন্ধের পরে জীবন এই রকমই। কোথাও আলো নেই তো, তাই এরা সন্ধে হলেই খেয়ে দেয়ে শুয়ে পড়ে, আবার ভোর থেকে উঠে দিনের কাজ শুরু করে। এখানকার বাচ্চারা পড়ে না,সন্ধেয় এমনকী কোনও অনুষ্ঠানও হয় না। সন্ধে হলেই গ্রামটা পুরো জঙ্গলের অন্ধকারে ডুবে যায়।
মহানন্দে আবার প্রবেশ করা গেল বাংলোতে। একটা জিনিস দেখলাম, মশা নেই, সেটা ঠান্ডার জন্য কিনা, কে জানে!! নবীনদা রান্না করল, গরম গরম মাংসের ঝোল আর ভাত। সঙ্গে চাটনি। ও হ্যাঁ, সমস্ত পিকনিকের যেটা অবশ্যম্ভাবী অঙ্গ, আমাদেরও তাই হয়েছিল, মাংস রাঁধার আগে জানা গেল, নুন আনা হয়নি। তখন বাজে রাত ৯টা। কোনও আশা নেই দোকানে গিয়ে নুন কিনে আনার। আবার হানা দেওয়া হল রেঞ্জারের বাড়ি। উনি বোধ হয় অল্প বিরক্ত হলেন। তবে, নুন পাওয়া গেল।
খাওয়া শেষ হতে হতে রাত এগারোটা বেজে গেল। দুই ঘরে রাজকীয় বিছানা, কিন্তু বেড়াতে এসে কি ঘুম আসে? আমরা দল বেঁধে বেরিয়ে পড়লাম তিস্তার পাড়ে। অনেক, অনেক রাত্তির অবধি গান হল। নদীর চরটা ফাঁকা থাকায় চাঁদের আলো এসে পড়েছিল নদীর জলে। বড় মায়াবী লাগছিল পরিবেশটা। নবীনদার কাছে শুনলাম, অনেক সময়ে গনেশজিরা নাক এখানে আসে জল খেতে (রাত্তিরে হাতিদের নাম নিতে নেই কিনা; আমাদের শুনলে হাস্যকর লাগতে পারে, কিন্তু ফি বছর যাদের ঘর দোর ফসল খেত তছনছ হয় হাতিদের তাণ্ডবে, তারা হাতিকে যুগপৎ ভয় ও ভক্তি করেই চলে)। অনেক রাতে এসে ঘϤময়ে পড়েছিলম, এক দল তো তরলের প্রভাবে আগেই ঘুমিয়ে নাক ডাকাচ্ছিল কাঠের ঘর কাঁপিয়ে, আমরাও অন্য প্রকোষ্ঠে জায়গা নিলাম।
পরদিন সকালে আমাদের কেউই রেঞ্জার সাহেবের সঙ্গে দেখা করে আসার সৌজন্যটুকু পর্যন্ত বোধ করিনি। চৌকদারের মেয়েকে চাবি ফিরিয়ে দিয়ে লাফ দিয়ে উঠে বসেছিলাম সাইকেলে। ঘন্টা দেড়েকের মধ্যে আবার সেই চিরাচরিত জীবনে ফেরত।
সেই রেঞ্জার আর আসেননি আমাদের হস্টেলে বেড়াতে। আমারও আর বোদাগঞ্জ যাওয়া হয়নি। দেখা হয়নি আর তাঁর সঙ্গে।
(চলবে... )