জলপাইগুড়ির প্রধান ঋতু দুটো। বর্ষা আর শীতকাল। বাকিগুলো তেমন প্রমিনেন্ট নয়। আর ওভারঅল জলবায়ু স্যাঁতসেঁতে। সব সময়েই প্রচন্ড ঘুম পায়, শীতকালে কম্বলের নিচ থেকে বেরোতে ইচ্ছে করে না। কলেজের ভাষায়, প্রচন্ড ল্যাদের ওয়েদার।
শুরুর দিকে আস্তে আস্তে এ সব আবিষ্কারের নেশা বুঁদ করে রেখেছিল অনেকদিন। পরে সব কিছুর সঙ্গেই অভ্যস্ত হয়ে গেছিলাম। সূর্যাস্তের সাথে সাথে রং বদলানো কাঞ্চনের রূপ আর তেমন দাগ কাটত না আমাদের মনে।
জলপাইগুড়ির সিনিক সৌন্দর্যের গল্প করার পরে আরও অনেক সুযোগ পাওয়া যাবে। আপাতত আমরা ফিরে আসি কলেজে।
সাতদিন কাটল। সে দিন শনিবার। কলেজ দুপুরে ছুটি। ততদিনে উইংয়ের সমস্ত বন্ধুদের সাথে পরিচয় হয়ে গেছে। বাংলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা, বিভিন্ন রকমের সব ছেলে। কত রকমের তাদের ডায়ালেক্ট, কত রকমের তাদের নিকনেম। আমারও নিকনেম দেওয়ার চেষ্টা চলছিল, নিকনেম ছাড়া কেউ হস্টেলে থাকতে পারে না, তো তার সুযোগ করে দিলাম আমিই। সন্ধ্যের আসরে গলা খুলে গেয়ে দিয়েছিলাম, পর পর দু দিন। তখন সুমন চাটুজ্জে আমার হট ফেভারিট। এ দিকে কলেজে সুমন তখনও ব্রাত্য, লোকে হিন্দি সিনেমার গান বা পুরনো দিনের বাংলা গানের বাইরে কেউই সুমন প্রতুল শুনত না। নচিকেতা তাও চলত, তাই জনতার দাবি মেটাতে নচিরও প্রচুর গান আমাকে গাইতে হয়েছিল। ফলে, আমার নামকরণ হল জীবনমুখী ছানা। শর্টে, জীমু, সেটা ক্রমশ পাল্টে হয়ে গেল জিনু। এখনও কলেজের বন্ধুরা আমাকে জিনু বলেই ডাকে।
তো, সে যাই হোক, আমার গানের প্রতিভা আমার অজান্তেই ছড়িয়ে পড়ল ক্যাম্পাসে। আমাদের হস্টেলের দুই তিনতলায় থাকত থার্ড ইয়ার। একতলায় আমরা ফার্স্ট ইয়ার। মাঝে মাঝে থার্ড ইয়ারের কারুর ঘরে বসেও গান টান চলত। এ দিকে সেই সপ্তম দিনে, শনিবার বিকেলে কে একজন এসে আমাকে খবর দিল, এই, তোর নাম জিনু? তোকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেলের ওমুকদা ডেকেছে। আজ সন্ধ্যেবেলায় একশো বারো নম্বর রুমে যাবি।
চিরকালীন ভিতু, আবার চোখে সর্ষেফুল দেখলাম। ফোর্থ ইয়ার মানে একটা দূর গ্রহের ব্যাপার, তারা নিশ্চয়ই খবর পেয়ে গেছে আমার র্যাগিং হয় নি, ফোর্থ ইয়ার আমাকে ডেকেছে মানে আমাকে নিশ্চয়ই ফেলে পেটাবে এ বার। শুনেছি র্যাগিং স্কিপ করলে ডবল র্যাগিং করা হয়।
রুমমেট অতীন, মধু, আর বৌদি মিলে যে যতরকম পারে ভয় দেখাল আমাকে, আর প্রচুর সহবৎ শেখাল, হাসবি না, কলারের বোতাম আটকে, বেল্ট আর ঘড়িটা খুলে যা, ইত্যাদি ইত্যাদি।
সেই মতো সেজেগুজে পুরো মুরগীর ছানা হয়ে সন্ধ্যেয় একা একা পৌঁছলাম ফোর্থ ইয়ারের হস্টেলে। উফ্ফ্, পুরো যেন বাঘের গুহা। সম্পূর্ণ অন্যরকম! এক আর দুই নম্বর হস্টেলের সাথে কোনওরকম মিল নেই! ভেতরে ঢুকে সব গোলকধাঁধা। কোথায় যে একশো বারো নম্বর রুম, খুঁজে বের করতে ঝাড়া কুড়ি মিনিট লাগল।
শীতের সকাল। কুয়াশার চাদরে মোড়া ফোর্থ ইয়ার হস্টেল।
সেই ঘরে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল ছ জন ফোর্থ ইয়ারের ছেলে।
আজ আর তাদের নাম মনে নেই, একজন ছিল, দাড়িওলা, বেঁটে করে, সে-ই আমাকে বলল, তোর নাম শমীক মুখার্জি?
পরের প্রশ্নগুলো এল অ্যাজ এক্সপেক্টেড, কেন র্যাগিং পিরিয়ড কাটিয়ে এসেছি ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমার প্রচন্ড আড়ষ্ট ভাব দেখে একজন এগিয়ে এসে আমার কাঁধে হাত রেখে হাসল, ভয় পাস না রে, র্যাগিং পিরিয়ড শেষ, আমরা কেউ র্যাগ করতে ডাকি নি তোকে। তুই কাল কলেজ মোড়ে জামাইদার দোকানে বসে গান গাইছিলি?
আড়ষ্টভাবেই বললাম, হ্যাঁ। কি জানি, কলেজ মোড়ে গান গাওয়া অপরাধ কিনা! পাশের আরেকজন বলল, পোঁদু বলল, তুই নাকি হ্যাভক গান গাস! তোর গান শুনতে ডেকেছি।
আর বলতে হল না। ফোর্থ ইয়ার হস্টেল থেকে বেরোলাম পরদিন সকাল সাতটায়। রাত আড়াইটে পর্যন্ত গানবাজনা হয়েছিল। সেই দাড়িওলা দাদা, ঝাড়া এক ঘন্টা মাউথ অর্গ্যানে বিভিন্ন গান বাজিয়ে শুনিয়েছিল। বাকিরাও যে যেমন পারে গলা মিলিয়েছিল। সময়ে সময়ে চা, পকোড়ার সাপ্লাই ছিল নিয়মিত। রাতে ওরাই আমার জন্য মেস থেকে খাবার তুলে আনল। একসাথে খেলাম, তারপর আবার গান। বাকি রাতটা একজনের ঘরে শোবার জায়গাও হয়ে গেল।
আজকের ক্যাম্পাস। সন্ধ্যের মুখে। একদম সামনে হস্টেল টু, এইখানেই কেটেছে আমার তিন বছর। দূরে বাঁদিকে ফোর্থ ইয়ার হস্টেল। পেছনে চা-বাগান।
এই প্রথম হস্টেল জীবনের স্বাদ পেলাম। মস্তি কা পাঠশালা। অ্যায়শ্শালা!
এ দিকে আমার রুমমেটদের হাল খারাপ। সারারাত ফিরি নি, ফোর্থ ইয়ার হস্টেলে গিয়ে খোঁজ নেবার মত সাহসও কারুর ছিল না স্বাভাবিকভাবেই। প্রায় প্রত্যেকে চিন্তা করেছে আমার জন্য।
পরদিন সকালে যখন অক্ষত ফিরলাম, তখন সক্কলে হাঁউমাউ করে একসাথে কোশ্চেন করতে শুরু করল। নিজেকে বেশ হিরো হিরো মনে হচ্ছিল। সেই সকালটা এখনও মনে আছে।
=======================
প্রথম দফায় হস্টেলে ছিলাম ঠিক একুশ দিন। ষষ্ঠীর দিন থেকেই কলেজে ছুটি পড়ে, কিন্তু যে হেতু অধিকাংশ ছাত্রেরই বাড়ি কলেজ থেকে বহু বহু দূরে, বছরে দু তিনবারের বেশি যাওয়া সম্ভব হয় না, সেই জন্য ছুটিগুলোকে ছাত্রদের তরফ থেকে এক্সটেন্ড করে দেওয়া হত, পূজোর ছুটি আনঅফিশিয়ালি শুরু হয়ে যেত মহালয়ারও তিন চারদিন আগে থেকে। তবে সে সবও অনেক পরের ঘটনা, অন্তত প্রথম বারের জন্য কলেজ থেকে বাড়ি ফেরার পেছনে মূল ড্রাইভিং ফোর্সটাই ছিল, 'বাড়ি' ফেরা। বাড়ি ছেড়ে আর থাকা যাচ্ছিল না। একুশটা দিনকে মনে হচ্ছিল একুশ মাসের সমান।
তবু এরই মধ্যে নিজেদের মতন করে হস্টেল লাইফ এনজয় করতে কেউই ছাড়ি নি। একপাল গরু প্রথম ঘরছাড়া হলে যা যা হয়, প্রায় সব হয়েছিল। ক্লাস সবে শুরু হয়েছে কি হয় নি, প্রথম পরীক্ষা ডিসেম্বরে, সকলের বইই জোগাড় হয় নি, এমতাবস্থায় পড়তে বসা বাতুলতা। অতএব, দিন রাত এর ওর তার ঘরে বিছানা চেয়ার টেবিল দখল করে শুধু আড্ডা, গ্যাঁজ।
আকাশে আজ রঙের খেলা। সূর্যাস্তের ব্যাকড্রপে ফোর্থ ইয়ার হস্টেল।
ফার্স্ট ইয়ারের জনতার প্রথম আলাপচারিতায় অবশ্যম্ভাবী টপিক মূলত দুটো, কার কেমন র্যাগিং হল, আর কে কে কেমন প্রেম করে টরে, এবং তারই ল্যাজ ধরে কে প্রেমে কতদূর পর্যন্ত এগিয়েছে।
বর্ষাকালেই প্রেম আর ভূতের গপ্পো ভালো জমে। আমাদের ইনটেক হয়েছিল আগস্ট মাসে, তখন বাংলায় শ্রাবণ মাস, তরাই ভেসে যাচ্ছে বৃষ্টিতে। প্রকৃতি এত সবুজ আর এত নীল আকাশ, আমরা প্রায় কেউই এর আগে দেখি নি। সন্ধ্যে বেলায় লোড শেডিং, ক্যাম্পাসের ব্যাকআপ জেনারেটর খারাপ, কাঁপা কাঁপা মোমবাতির আলোয় ঘিরে বসে জমতে থাকল আঠেরো ঊনিশ বছর বয়েসী একদল ছেলের আড্ডা। বিষয় প্রেম।
বেশ কিছু ছেলে বেরলো যারা অলরেডি প্রেম করে, আমরা, যারা তখনও প্রেমিকার ব্যাপারে ন্যারো ইন করে উঠতে পারি নি, কিংবা সম্ভাব্য প্রেমিকাকে প্রেম নিবেদন করে উঠতে পারি নি জলপাইগুড়ি আসার আগে, তারা এই সব সফল প্রেমিকদের প্রতি মনে মনে ঈর্ষা জন্মিয়ে ফেললাম। টিনএজের শেষ মাথা, শরীর মন তখন অনেক রকম অবাস্তব কল্পনা করে চলে বিপরীত লিঙ্গকে ঘিরে, জাগরণে, স্বপ্নে, স্বপ্নদোষে। ভদ্রতার আবরণে মুড়ে যতটা সম্ভব প্রশ্ন করা যায় সফল প্রেমিকদের, করে চলেছিলাম আমরা। তারাও ভদ্র ভদ্র ভাবে উত্তর দিয়ে চলেছিল। কেউ কেউ আবার বেয়াড়া রকমের ডেস্প্যারেট ছিল। 'তুই তোর লাভারকে (চোখ মেরে) দেখেছিস?' তার উত্তরে স্মার্ট লাভার উত্তর দিল, 'ওর পিঠের ঠিক মাঝখানে একটা তিল আছে; এ বার তোরা বুঝে নে'। এই সব কবি কবি ডায়ালগে তখন আমাদের সর্বাঙ্গ শিহরিত হয়ে উঠত, আর কল্পনা লাগাম ছাড়াত।
অনেক রকম ক্যাটেগরি বেরোল। কেউ সদ্য লাভার, আসার আগে প্রেম নিবেদন করে সফল হয়ে এসেছে, প্রেমিকার হাতটুকুও ভালো করে ধরে উঠতে পারে নি এখনও। কেউ কেউ ভেটেরান লাভার, বগলে চুল গজানোর আগে থেকে প্রেম করে আসছে, চুমু টুমু তো ছোটখাটো ব্যাপার, একে অপরের শরীর চিনে ফেলেছে অনেকদিন। কেউ কেউ ভালোবেসে প্রপোজ করে ল্যাংও খেয়ে এসেছে স্বপনচরিণীর কাছে (আমি এই দলে ছিলাম, ক্লাস ইলেভেনের শেষদিকে একটি মেয়েকে প্রপোজ করে আমি প্রত্যাখ্যাত হই)। কেউ কেউ এক তরফা ভালোবেসেছে তার ক্লাসমেট মেয়েটিকে, প্রপোজ করার সাহস করে উঠতে পারে নি। এদের নাম দেওয়া হল ফোস্লা; এফ ও এস এল এ, ফ্রাস্ট্রেটেড ওয়ান সাইডেড লাভার্স অ্যাসোশিয়েশন।
প্রেম হওয়া না-হওয়ার অনেক রকমের গল্পে ভরে উঠল আমাদের সন্ধ্যেগুলো।
(বাওয়ালবাজি জমবে আবার হপ্তা-দুয়েক পরে)