সে আর নেই।
আজ সকালে ঘুম ভাঙতেই দেখি এনডিটিভির ব্রেকিং নিউজ মেসেজ ব্লিংক করছে আমার মোবাইলে। টানা তেরো দিন অমানুষিক লড়াই লড়বার পরে, অবশেষে হেরে যেতে হল তাকে।
টিভি খুলে জানা গেল আবার দিল্লি নামছে রাস্তায়। আর জানা গেল, তারা ভয় পেয়েছে। হাই প্রোফাইল ল্যুটিয়েন্স দিল্লির ভিআইপি বাংলোয় বাস করা সেই রাজনীতি করা লোকগুলো, যাদের বাড়ির সামনে কেউ প্রতিবাদ জানাতে এলে তারা স্বাগত জানায় জলকামান নিয়ে, টিয়ারগ্যাসের শেল নিয়ে, তারা ভয় পেয়েছে এবার। বেদম ভয়। সকাল হতে না হতেই কঠিন নিরাপত্তাবলয়ে মুড়ে ফেলা হয়েছে তাদের বাংলোগুলোর আশপাশ। কোনও প্রতিবাদী মিছিল যেন আসতে না পারে তাদের প্রাসাদের আশেপাশে, কোনও মোমবাতি যেন দেখা না যায় তাদের গজদন্তমিনারের নিচে। যারা প্রতিবাদ জানাতে আসছে এই শীতের সকালে, ঠাণ্ডা, কুয়াশা অগ্রাহ্য করে, যারা শোক জানাতে আসছে, যারা বিচার চাইতে আসছে, যারা নিজেদের নিরাপত্তা চাইতে আসছে, তারা যে আমজনতা, তাদের জন্য তাই ইন্ডিয়া গেটে প্রবেশাধিকার নেই। তাদের জন্য রাজপথ বন্ধ। তারা বসবে জন্তর মন্তরে। তারা বসবে রামলীলা ময়দানে। ক্ষমতার গজদন্তমিনারের থেকে অনেকটা দূরে।
ভারত, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র আজ লজ্জায়, অবনত। রাষ্ট্রপতি ভবন, সংসদ ভবন, নর্থ ব্লক, সাউথ ব্লক, গণতন্ত্রের প্রতীক বলে যাদের সম্মান দেওয়া হয়ে এসেছে এতদিন ধরে, তাদের সম্মান আজ প্রশ্নচিহ্নের মুখে।
এই ধরণের জনরোষ কখনও দেখে নি দিল্লি। কোনও রাজনৈতিক রঙ ছাড়াই, কোনও রাজনৈতিক নেতার উপস্থিতি ছাড়াই এত বিশাল মাপের জনসমাবেশ, কোনওদিন ঘটে নি এর আগে দিল্লিতে। আন্না হাজারের অনশনের সময়ে দিল্লি হাজির হয়েছিল অবশ্য রামলীলা ময়দানে, তবে তার বেশির ভাগটাই ছিল হুজুগের ভিড়। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতি অনাস্থা ছিলই, কিন্তু এই বিশাল মাপের স্বতঃস্ফুর্ত জনসমাবেশ, দিল্লির সমাজের প্রতিটা স্তর থেকে, স্কুলছাত্রছাত্রী, গৃহবধূ, সরকারি বেসরকারি চাকুরে, ব্যবসায়ী, এবং সবচেয়ে বড় কথা, সমস্ত রকমের ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসা মেয়েদের বেশিমাত্রায় অংশগ্রহণ, দিল্লি এর আগে কোনওদিন দেখে নি। লোকে মরিয়া হয়ে নেমে এসেছে রাস্তায়, নিতান্তই মিছিলে পা মেলানোর জন্য নয়, নিতান্তই মোমবাতি জ্বালানোর জন্য নয়।
দিল্লি কি অবশেষে বদলাচ্ছে?
দিল্লির মানুষজনকে নিয়ে ক্ষোভ, অশ্রদ্ধা দীর্ঘদিন ধরে জমা হয়ে ছিল আমার মনে। এ শহর মেয়েদের নিতান্ত একটা যৌন-উত্তেজক বস্তু হিসেবে দেখে, মেয়েদের সম্মান দিতে জানে না, সাধারণ যে কোনও পুরুষালি জমায়েতে মা-বোন তুলে গালাগাল দিতে দিতে কথা চালানো এখানকার কালচারবিশেষ। চিরদিন এমনটাই দেখে এসেছি এখানে।
বোধ হয় দিল্লিকে চেনা আমার আরও কিছু বাকি ছিল। এই দিল্লিকে আমি চিনতে পারি নি, দেখতে পাই নি এর আগে কোনওদিন। কলকাতার মতন “সুশীল সমাজ”-এর কনসেপ্ট এখানে অনুপস্থিত। মোমবাতি মিছিল হয় ঠিকই বিভিন্ন ঘটনার প্রতিক্রিয়ায়, তবে সেগুলো হয় মুখ্যত বিভিন্ন এনজিও মারফত। এই প্রথম এমন একটা প্রতিবাদের সাক্ষী হয়ে থাকলাম, যে প্রতিবাদ দিল্লি এর আগে কোনওদিন দেখে নি। ১৬ই ডিসেম্বর রাতের ঘটনা ঘটে যাবার পরে পরেই সংসদ উত্তাল হয়েছিল, লোকে টিভির চ্যানেলে, সোশাল নেটওয়ার্কিং সাইটে বা নিজেদের ব্লগে নিজেদের ক্ষোভ উগরে দিয়েছিল।
সরকার কোনও চেষ্টা করে নি আমজনতার মধ্যে এই ক্ষোভ প্রশমিত করার। নিজের নিজের নিরাপদ সিকিওরিটির ঘেরাটোপের মধ্যে তাঁরা ব্যস্ত থেকেছেন ধর্ষণ সংক্রান্ত বিল নিয়ে কবে আলোচনায় বসা যায়, তাই নিয়ে, কিংবা অন্য কোনও বিষয় নিয়ে। সরকারপক্ষের এই নীরবতাই এক বড় কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল গত বাইশ আর তেইশে ডিসেম্বরের বিশাল বিক্ষোভ সমাবেশের।
গত শনিবার সকাল থেকেই দেখেছিলাম দলে দলে ছেলেমেয়ের দল, যাদের বয়েস সতেরো থেকে পঁচিশের মধ্যে, দলে দলে চলেছে ইন্ডিয়া গেটের দিকে। কোনও নেতা ছিল না তাদের। নিজেরাই চলেছিল। হাতে ব্যানার, পোস্টার, তাতে কালো আর লাল অক্ষরে লেখা তাদের ঘৃণা আর ছিছিক্কারের ভাষা। এর আগেও দিল্লির রাস্তায় ছাত্রদের, যুবকদের, এনজিওদের মিছিল দেখেছি, সেই মিছিলের মুখগুলো আমার লাগত এক রকমের। বিষয় হয় তো কোনও ঘটনা বা নিয়মনীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, কিন্তু প্রতিবাদের আগুন থাকত না মিছিলকারীদের চোখেমুখে। সামনের লাইনের দু তিনজন শ্লোগান বা “নারা-বাজি”তে ব্যস্ত থাকতেন, বাকি পেছনের সারির লোকজন নিজেদের মধ্যে হাসি তামাশা করতে করতে পথ হাঁটতেন। কখনও সামনে মিডিয়ার ক্যামেরা দেখা গেলে সোৎসাহে হাত নেড়ে নিজের অস্তিত্ত্ব প্রকাশ। মিছিলের মুখপাত্র যখন রাগী রাগী মুখ করে নিজেদের দাবিদাওয়া পেশ করতেন বাড়ানো মাইক্রোফোনের সামনে, তখনও ব্যাকড্রপে দেখা যেত অগুনতি উৎসাহী মানুষের হাসিমুখ আর তাদের হাত নাড়া।
আমরা সবাই টিভিতে অনেক দেখেছি এই ধরণের ক্লিপিং। এই প্রথম, গত শনিবারে, একটা নয়, অন্তত তিন চারটে মিছিল দেখলাম, কমবয়েসী ছেলেমেয়ের দল, তাদের কারুর মুখে হাসি নেই, নিজেদের মধ্যে ঠাট্টাতামাশা নেই। গনগনে রাগ মুখে মেখে তারা চলেছে ইন্ডিয়া গেটের দিকে। হাতে পোস্টার।
কিছু কাজে সেদিন যেতে হয়েছিল ইন্ডিয়া গেটের কাছাকাছি কস্তুরবা গান্ধী মার্গে। ফেরার সময়ে যখন গেলাম সেখানে, ইতিমধ্যেই দেখি কয়েক হাজার মানুষ জমা হয়েছেন। রফি মার্গের কাছে ব্যারিকেড দিয়ে আটকে দেওয়া হয়েছিল যানবাহন, তার ওপারে রাইসিনা হিলসের দিকে তখন জনসমুদ্র। দূরে রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে দেখা যাচ্ছে দুতিনটে পুলিশ ভ্যান। রাজপথে তখনও আসছে কাতারে কাতারে মানুষ। এবং, যেটা লেখার মত ব্যাপার, সেটা হল, সেদিনের সেই ভিড়ের সিংহভাগ মহিলা। সতেরো বছরের কলেজছাত্রী থেকে পঞ্চাশোর্ধ্ব মহিলা।
সুযোগসন্ধানীরাও ছিল। লম্বা চুল, কানে দুল, ফুলস্পিডে মেয়েদের দলের গা ঘেঁষে মোটরসাইকেল চালিয়ে নিয়ে যাওয়া রোমিও যুবকদেরও দেখলাম। দিল্লি বলে কথা, এদের ছাড়া কি কোনও সমাবেশ সম্পূর্ণ হয়?
ফিরে এসেছিলাম আধঘণ্টার মধ্যে। অন্য কাজ সারার ছিল। পরে টিভিতে দেখে জানলাম, আমি চলে আসার খানিক বাদেই সেই জায়গা রণক্ষেত্রর চেহারা নিয়েছিল। চলেছে জলকামান, টিয়ার গ্যাস। শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভের ওপর লাঠি চালিয়েছে পুলিশ। তাদের অপরাধ, তারা গণতন্ত্রের “পবিত্র” মন্দির রাষ্ট্রপতি ভবনের দিকে পা বাড়িয়েছিল।
তার পর দুদিন ধরে, এবং তারও পরের তিন চারদিন ধরে কী কী ঘটে চলেছে, দেখে চলেছেন মানুষ, টিভির পর্দায়, কাগজের পাতায়। নিউ দিল্লিকে দূর্গে পরিণত করে, সেখানে কাজ করতে যাওয়া অসংখ্য মানুষ, মূলত মহিলাদের নিরাপত্তা আরও অনিশ্চিত করে দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে মধ্য দিল্লির মেট্রো স্টেশন, যান চলাচল। ঘটনার প্রায় এক সপ্তাহ পরে মুখ খুলেছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, কারুর একটা লিখে দেওয়া আদ্যোপান্ত প্রেডিক্টেবল ভাষণ পাঠ করে। মুখ খুলেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার, মুখ্যমন্ত্রী, রাজ্যপাল, প্রত্যেকে ব্যক্ত করেছেন নিজের নিজের বয়ান। পিটিশনের পর পিটিশন সই হয়ে চলেছে। দেশের মাথারা ঠাণ্ডাঘরে বসে এখনও ভেবে যাচ্ছেন, কঠোরতর ধর্ষণ এবং মহিলাদের প্রতি অত্যাচারের বিরুদ্ধে আইনকানুন নতুন করে ঝালিয়ে নেবার জন্য কবে নাগাদ বসা যায়।
যত সময় গেছে, জনতার ক্ষোভ আরও প্রকট হয়েছে, পুলিশ যত বেশি দমনমূলক আচরণ করেছে, লোকে তত বেশি মাত্রায় প্রতিবাদ করেছে। দিল্লি পুলিশের ব্যারিকেডের ঘেরাটোপের মধ্যে বসেও তাই দেশের কাণ্ডারীদের কালঘাম ছুটেছে। কেউ ব্যস্ত আন্দোলনকে লঘু প্রমাণিত করতে, কেউ ব্যস্ত নিজের উদ্বেগ যে আমজনতার থেকে আলাদা কিছু নয়, সেটা প্রমাণ করতে। দিল্লি সরকার আর কেন্দ্রীয় সরকারের মধ্যে বিরোধ প্রকট হয়েছে, কাণ্ডজ্ঞানহীন মন্তব্যের পর মন্তব্য করে বসেছেন ভারতের মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, বাংলার সাংসদ, মধ্যপ্রদেশের বিজ্ঞানী। আপৎকালে মুখ থেকে মুখোশ খসে পড়লে যেমনটি হয় আর কি।
এত কিছুর মধ্যে নাটকীয়ভাবে মেয়েটিকে দিল্লি থেকে সিঙ্গাপুরে স্থানান্তরিতকরণ এবং তার ঠিক দেড়দিনের মাথায় তার মৃত্যুসংবাদ ঘোষণা। আজ সকালে। ঘুম থেকে উঠেই খবরটা ঝলসে উঠল আমার মোবাইলে।
না, বেরোতে পারি নি। যে দিল্লিকে আমি চিনি না, আজ বুঝতে পারছি, তাকে কোনওদিন আমি চেনার চেষ্টাও করি নি। সেই দিল্লিও আমাকে চেনে না। ঘরে রইলাম, টিভিতে দেখলাম, জেএনইউ থেকে শোকার্ত ছেলেমেয়ের দল মিছিল করে গেল মুনিরকার সেই বাসস্ট্যান্ড অবধি। পুলিশ আজ সকাল থেকে নিউ দিল্লিকে মুড়ে ফেলেছিল ব্যারিকেডে ব্যারিকেডে, বন্ধ করে দিয়েছিল নিউ দিল্লির সমস্ত মেট্রো স্টেশন। প্রতিবাদীরা তাতেও পিছু হটে নি। ক্ষমতাসীন নেতানেত্রীদের দিকে অপরিসীম অবজ্ঞা ছুঁড়ে দিয়ে তারা দলে দলে এসেছে, বসেছে জন্তর মন্তরের সামনে। নীরবে। কালো কাপড় মুখে বেঁধে। হাতে ব্যানার পোস্টার নিয়ে। টিভি চ্যানেলের মাইক্রোফোনকেও তারা আজ গুরুত্ব দেয় নি। নীরবে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে।
হ্যাঁ, সরব হয়েছিল একবার। আজ দুপুর নাগাদ। জনতার সঙ্গে সংযোগ ঘটাতে দুপুরে এসেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী শীলা দীক্ষিত। হুটার বাজানো কনভয়ে চড়ে, ফুল সিকিওরিটি প্রটেকশন নিয়ে। তিনি এসেছিলেন আমজনতার মাঝে মোমবাতি জ্বালাতে। নিরাপত্তারক্ষীদের ঘেরাটোপের মাঝে তিনি হয় তো সে মোমবাতি জ্বালিয়ে উঠতে পেরেছিলেন, তবে সে আগুনে তাপ ছিল না। জন্তর মন্তরের সামনে বসে থাকা হাজার হাজার গলা তখন সরব হয়ে ঘিরে ধরেছিল মুখ্যমন্ত্রীকে। তারা একসঙ্গে চেঁচিয়ে বলে উঠেছিল, শীলা দীক্ষিত, গো ব্যাক। শীলা দীক্ষিত, হায় হায়। পারিষদসমেত তক্ষুনি সেখান থেকে পালিয়ে বেঁচেছেন মুখ্যমন্ত্রী।
প্রতিবাদ, এখনও চলছে। শুধু দিল্লিতে নয়, মুম্বই, কলকাতা, ভোপাল, আমেদাবাদ, পটনা, লক্ষ্ণৌ, ভুবনেশ্বর, সর্বত্র। আর তার মাঝেই একের পর এক ধর্ষণের ঘটনাও উঠে আসছে, রাজস্থান থেকে, পশ্চিমবঙ্গ থেকে, পঞ্জাব থেকে, দিল্লি থেকেও। দাবি উঠছে অনেক, তবু পুলিশ বদলাচ্ছে না, আইন বদলাচ্ছে না, বদলাচ্ছে না নেতানেত্রীদের মুখের ভাষা। স্বাধীনতার পঁয়ষট্টি বছর পরেও যে গণতন্ত্র দেশের অর্ধেক জনসংখ্যাকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে পারে নি, নিরাপত্তা দিতে পারে নি, সেই গণতন্ত্র আজ মুখ লুকিয়েছে লজ্জায়।
এ মৃত্যু যেন বৃথা না যায়। যেন ভুলে না যাই, অন্তত একবার, তার চিরন্তন ঔদাসীন্য ঝেড়ে ফেলে এই শহর আমাকে বিস্মিত করেছিল, গর্বিত করেছিল।
এই দিল্লিকে আমি চিনতে পারি নি। এই দিল্লির জন্য আমি গর্বিত।