এবং বাওয়ালি। অর্থাৎ, একক বা দলবদ্ধভাবে বদমাইশি। এর কোনও আলাদা ডেফিনিশন বা সীমারেখা ছিল না। রাত তিনটের সময়ে রুমের সামনে করিডরে চকলেট বোম ফাটানো হতে পারে, কিংবা রাত দেড়টায় স্টীলের থালা বাজাতে বাজাতে করিডর প্রদক্ষিণ হতে পারে, বাথরুমের দরজায় লাথি মারা, পায়খানার দরজার ওপর দিয়ে জল ঢেলে দেওয়া, আরও কী কী হতে পারে, তার পুরো লিস্টি দিতে গেলে আর কিছু লেখার জায়গা হবে না, সবচেয়ে বড় কথা, সেন্সর বোর্ডে আটকে যেতে পারে। ভোর চারটে পর্যন্ত কমন রুমে টেবিল টেনিস বা ক্যারম খেলা, বাইরে সারারাত ধরে ঝরে যাওয়া অবিশ্রান্ত বৃষ্টি। ভোর যখন হল, কোলাপসিবল গেট খুলে বাইরে বেরিয়ে টাটকা অক্সিজেন নেওয়া, চারদিক সবুজ আর ভিজে। সারাদিন আবার বৃষ্টি, বিকেল তিনটের সময়ে ক্যাম্পাসের উত্তর পশ্চিম দিকের আকাশে উঠল একটা মেগা রামধনু, অত বড় অর্ধবৃত্তাকার রামধনু, আর অত প্রমিনেট রং, আর কোথাও দেখা যায় কিনা, কে জানে! এই দিগন্ত থেকে শুরু, ঐ দিগন্ত থেকে শেষ। রামধনু খুব প্রমিনেন্ট হলে তার পাশে পাশে আরও দু তিনটে হালকা হালকা রামধনু দেখা যায়, একটু দূরত্বে দূরত্বে। সে এক অদ্ভূত সুন্দর দৃশ্য।
পাঠক হয় তো অমার সম্বন্ধে ধারণা করে নিতে পারেন যে আমি খুব ভালো গান টান গাই, লোকে শুনলেই ফিদা টিদা হয়ে যায়। আমি নিজেও সেই রকমই ভাবতাম, যতদিন না আরেক গায়ক বেরোল আমাদের হস্টেলের ব্যাক উইং থেকে, অগস্তি। অসাধারণ গানের গলা, রক্তেও তার গান আছে। মহিষাদল রাজবাড়ির একসময়কার সভাগায়ক ছিলেন তার দাদু। সঞ্জীব চাটুজ্জের বই লোটাকম্বলে উল্লেখ আছে তাঁর। অগস্তির সাথে আলাপ হবার পর বুঝলাম গানের রাস্তায় খুব বেশিদূর হাঁটা আমার হয়ে ওঠে নি। দুজনে জমে উঠল অচিরেই।
এই পর্যন্ত লিখে ফেলার পর মনে হল, কলেজের মেয়েদের সম্বন্ধে একেবারে একটা কথাও লেখা হয়ে ওঠে নি এখনও পর্যন্ত। কলেজে ভর্তি হয়েছি, চারপাশে রঙীন রঙীন প্রজাপতির মত যুবতীকূল ঘুরে বেড়াবেন না, এবং তাঁদের দৃষ্টিধন্য স্পর্শধন্য হবার আকাঙ্খায় যুবককূল থাকবেন না, তাও হয় নাকি?
কলেজ বিল্ডিংয়ের সামনে আমরা কজন : আমাকে চেনা যাচ্ছে?
তাও হয়। ছেলেদের মতই বাড়ি ছেড়ে বাইরে প্রথম একা থাকতে আসা মেয়েরাও ছিল। তবে সম্ভবত ইঞ্জিনীয়ারিং কলেজ বলেই তাদের সংখ্যা খুব খুব কম ছিল। আমাদের ব্যাচে ইতিহাস সৃষ্টি হল মেকানিকাল ডিপার্টমেন্টে প্রথম মেয়ে এসে। এর আগে মেকানিকাল ছিল মেয়েবর্জিত ক্লাস। বেশ ষন্ডাগুন্ডা চেহারার এক মেয়ে ,মেকানিকালের সবেধন নীলমণি। আমাদের ব্যাচে সবশুদ্ধু আটজন মেয়ে, দেড়শো ছেলের সঙ্গে ভর্তি হয়েছিল। ফলে কলেজ ছিল আক্ষরিক অর্থে পুরুষপ্রধান ক্যাম্পাস। মেয়েরা একেবারেই নন্-এনটিটি হয়ে থাকত, সম্ভব অসম্ভব বিভিন্ন ধরণের পুরুষালি মৌখিক সম্ভাষণ এবং অফারিং শুনে শুনে চার বছরের মাথায় তাদের কান এবং বাকি গায়ের চামড়া বেশ মোটা হয়ে যেত। ক্যাম্পাসের মধ্যেই প্রিন্সিপাল কোয়ার্টারের কাছে একটু আলাদা দিকে ছিল মেয়েদের হস্টেল। মেন গেটের ভেতরে ছেলেদের প্রবেশাধিকার ছিল না, তবে গেটে কোনও দারোয়ানও ছিল না। চাতকের মত দর্শনপ্রার্থীকে দাঁড়িয়ে থাকতে হত, যদি গেটে কোনও মেয়ের মুখ দেখা যায়, তাকে রিকোয়েস্ট করা, অমুককে ডেকে দাও তো। ফরবিডেন এলাকা বলেই ছেলেমহলে অত্যধিক আলোচিত ছিল লেডিজ হস্টেলের ভেতরের জগৎ। যে যেমন পারত পেঁয়াজ রসুন মাখিয়ে পরিবেশন করত, বাকিরাও তার আনন্দ উপভোগ করত। প্রবেশাধিকার না থাকলেও বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোনও কোনও মেয়ের সাথে থাকতই কোনও কোনও ছেলের। সেই সূত্রেই সেই সব বিশ্বাসঘাতক ছেলেদের মারফৎ জানা যেত লেডিজ হস্টেলের নানা তথ্য। সবচেয়ে বেশি আলোচনা হত লেডিজ হস্টেলে র্যাগিং নিয়ে। সম্ভব অসম্ভব অনেক রকমের বিবরণ শুনেছি, কোনওটাই বিশ্বাসযোগ্য মনে হয় নি। অনেক ডানপিটে ছেলে রাত দুপুরে লেডিজ হস্টেলে উঁকিঝুঁকি মেরে অ্যাডভেঞ্চার করার চেষ্টাও করেছিল, কিন্তু কেউই সে রকম উত্তেজক অ্যাডভেঞ্চারে কোনও উত্তেজনা সঞ্চয় করে ফিরতে পেরেছিল বলে শুনি নি। কেবল তাদের যাওয়ার ঘটনাই রূপকথা হয়ে ছড়িয়ে পড়ত জুনিয়রদের কাছে, আর সেগুলো পরে আরও বিরিয়ানি হয়ে ছড়াত বছরের পর বছর। কে গাছে উঠে সারারাত গাছেই কাটিয়েছে, কে ক্যামেরা নিয়ে গেছিল উত্তেজক ছবি তুলবে বলে, কল্পনা যতদূর পর্যন্ত যেতে পারে ততদূর পর্যন্ত যেত এই সব কাহিনিতে।
এর মূল কারণ ছিল, আমাদের সময় পর্যন্ত, মনে হয়, সংখ্যায় চূড়ান্ত বৈষম্য। দেড়শো জন ছেলের রাজত্বে সাত আটজন মেয়ে, ফলে ইন্টার্যাকশন হবার বদলে 'নিজেকে বাঁচাও' ব্যাপারটাই প্রধান হয়ে পড়ত মেয়েদের মধ্যে, আর ছেলেদের জগতে একটা কেমন যেন অলিখিত নিয়ম জারি হয়ে যেত, কলেজের মেয়েদের সঙ্গে আলাপ থাকা বা দেখা করতে যাওয়া খুব লজ্জাজনক ব্যাপার। কেউ যদি কখনও লেডিজ হস্টেলে যেত নিতান্তই নিষ্পাপ কোনও প্রয়োজনেও, তাকে যেতে হত লুকিয়ে লুকিয়ে, কোনওভাবে ব্যাপারটা প্রকাশিত হয়ে পড়লে সেই ছেলের সে দিন আওয়াজে আওয়াজে চোদ্দপুরুষ উদ্ধার হয়ে যেত।
দু তরফেই আন্তরিক ভাবে অভাব ছিল ইন্টার্যাকশন ঘটবার, কিন্তু কারণটা আসলে কী ছিল, কখনওই বুঝতে পারি নি। আমাদের পরের ইয়ার থেকে পরিস্থিতি অনেক অনেক স্বাভাবিক হয়ে আসে, কিন্তু আমাদের ইয়ার পর্যন্ত লেডিজ হস্টেলের আরেক নাম ছিল, পাকিস্তান বর্ডার।
হস্টেলের মেসে আইডি-র রাত
এই অত্যধিক দূরত্ব জন্ম দিত অনেক অশালীনতার। জাস্ট ফর নাথিং, কলেজ বিল্ডিংয়ের ভেতরেই কোনও নোংরা উক্তি ছুঁড়ে দেওয়া, ক্লাসে মেয়েদের ডেস্কে বাছা বাছা খিস্তি লিখে রাখা বা যৌনাঙ্গের অপটু ছবি এঁকে রাখা, যে রকম পাবলিক ইউরিনালের দেওয়ালে দেখা যায় আর কি, এ সব থেকে শুরু করে লেডিজ হস্টেলের ঠিকানায় বেনামী গালাগালওলা চিঠি, বা আপাত ভদ্র কথার আড়ালে খুব নোংরা কথা বলে কোনও মেয়েকে সামনাসামনি বেইজ্জত করা, এই সব বিভিন্ন কীর্তিতে খুব পারদর্শী ছিল আমাদের আগের বিভিন্ন ইয়ারের সঙ্গে আমাদের ইয়ারেরও অসংখ্য ছেলে। সম্ভবত অবদমনই বলা যায় এটাকে, বিশাল দূরত্ব ঘুচত বছরে মাত্র হাতে গোনা কয়েকটা দিন, কালচারাল, সোশ্যাল, আর হোলির দিন। এই দিনগুলোর মধ্যে কালচারাল আর সোশ্যালে ছেলে মেয়ে সকলকে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুষ্টুভাবে অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে দেখা যেত, টুকটাক অসভ্যতা যে হত না, তা নয়, কিন্তু সেগুলো যে কোনও কলেজেই হয়। নারীলোলুপ হাতগুলো সক্রিয় হয়ে উঠত মওকা বুঝে, যেমন হোলির দিন। প্রফেসর্স ক্লাবে সেদিন সকলের জন্য থাকত ওপেন ইনভিটেশন, চানাচুর মিষ্টি বিলোন হত, ছাত্ররা গিয়ে ট্র্যাডিশনাল মেথডে প্রফেসরদের পায়ে আবীর দিয়ে প্রণাম করত। ছাত্রীরাও আসত। এবং, সারা মুখে কালো রং মাখা, দলের মধ্যে এ অবস্থায় আলাদা করে চেনা অসম্ভব, সেই রকম ক্যামুফ্লাজে আমার নিজের ইয়ারের একটি ছেলেকে আমাদেরই ইয়ারের একটি মেয়েকে পেছন থেকে ধরে সেকেন্ডের মধ্যে তার বুক টিপে দিয়ে পালিয়ে যেতে দেখেছি। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারি নি অনেকক্ষণ।
কিন্তু জলু ক্যাম্পাসের ছেলেরা বা মেয়েরা কোনও হাঁড়ির ভাত নয়, যে একটিকে টিপলেই বাকি চালেদের অবস্থা সম্বন্ধে ধারণা করে নেওয়া যাবে। তাই জলপাইগুড়ির ক্যাম্পাসে ছেলেমাত্রেই এই রকমের বদ্ ছিল, বা মেয়েমাত্রেই খুব বেচারীগোত্রের ছিল, এ রকম মনে করারও কোনও কারণ নেই। অল্পস্বল্প মেলামেশাও হত, প্রেম ট্রেমও নামতো দু একটা, ধরা পড়ার মুখে তাদের ভাইবোন সাজার ঘটনাও ঘটত। কলেজের পেছন দিয়ে ভাইদা-র ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে যে রাস্তাটা পাকিস্তান বর্ডারের দিকে যেত, তার নাম ছিল ভাইবোন সরণী। ঝোপ কেসও ঘটত খুব ইরেগুলার ফ্রিকোয়েন্সিতে। এবং সেই সব ঘটনার বিরিয়ানিকরণ চলত অপূর্ব কুশলতার সঙ্গে।
ছেলেদের এবং মেয়েদের আরও কথা সময়মতো আসবে, আপাতত অন্য গল্পে ফিরে যাওয়া যাক।
প্রথম ধাক্কায় হস্টেলে ছিলাম মাত্র ২১ কিংবা ২৩ দিন, কিন্তু তাই মনে হচ্ছিল তেইশ মাসের সামিল। তারই মধ্যে প্রচুর হইহল্লা করে কেটে গেল দিনগুলো। কলেজের ভেতরটা ঘুরে দেখার আগেই চলে এল মাস ডামার দিন।
মাস ডামার গল্পটা বেশ ইন্টারেস্টিং, জলপাইগুড়ির চিরন্তন ট্র্যাডিশন এটা। বড় ধরণের কোনও ছুটি, যেমন পুজোর ছুটি বা গরমের ছুটির আগে কলেজ থেকে স্টুডেন্ট কনসেশন দেওয়া হত সবাইকে। হোমটাউন পর্যন্ত ট্রেন ভাড়ায় পঞ্চাশ পার্সেন্ট ছাড়। মানে, স্লীপার ক্লাসে দুশো টাকা যদি ভাড়া হয় জলপাইগুড়ি টু ব্যান্ডেল, তো সেটা একশো টাকায় পাওয়া যেত। এক ভদ্রলোক ছিলেন, তিনি প্রত্যেকের নামে একটা করে ফর্ম ভরে দিতেন, সেই ফর্ম স্টেশনে গিয়ে দেখালে কনসেশনের টিকিট পাওয়া যেত। তখনও ইন্টারনেট পরজন্মের কথা, কম্পিউটারে চলত কেবলমাত্র ডস অপারেটিং সিস্টেম, কম্পিউটারাইজ্ড রিজার্ভেশন কেবলমাত্র হাওড়া স্টেশন জাতীয় মহানাগরিক এলিট ক্লাসের স্টেশন ছাড়া কোথাও হত না। এক প্ল্যাটফর্মওয়ালা জলপাইগুড়ি রোডে কী করে থাকবে সে সব ফেসিলিটি? সেখানে চলত কোটা সিস্টেম। তিস্তা তোর্সা আর কামরূপে কিছু সিট জলপাইগুড়ি রোডের নামে বরাদ্দ থাকত, যে দিন ফিলআপ হয়ে যেত তো যেত, না হলে খালি সিট নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে গিয়ে আরএসি ইত্যাদিদের অ্যালট করে দেওয়া হত। তো, জনতা দল বেঁধে রোড স্টেশনে গিয়ে সেই রিজার্ভেশন করিয়ে আসত।
ভাইবোন সরণীতে দোতলা ব্যাক উইং
একটাই ফর্ম হত, যাওয়া এবং ফিরে আসার জন্য। যে ভদ্রলোক ফর্মগুলো ইস্যু করতেন, ওয়ার্কশপ ইন্সট্রাক্টর, তিনি বেশ দয়ালু প্রকৃতির ব্যক্তি ছিলেন। ছাত্রদরদী। পুরো ফর্মটা লিখতেন চেলপার্কের সবুজ রংয়ের কালিতে। নো ডটপেন। ছাত্রদের কেবল কাজ ছিল নিজেদের সুবিধের জন্য চেলপার্কের একই রংয়ের আরেকটা কালির শিশি কিনে আনা, একটা কালি-পেন, আর এক শিশি জিওলিন; এই কটা জিনিস নিজেদের পজেশনে রাখা।
ফর্ম ভর্তি হয়ে চলে এলে হস্টেলে কাজে নেমে পড়ত শিল্পীরা। আমিও এই শিল্পকর্মে নিযুক্ত থেকেছি অনেকদিন। শিল্পটা আর কিছুই না, একটা দেশলাই কাঠির ডগায় অল্প একটু তুলো লাগিয়ে, সেই তুলো জিওলিনে ভিজিয়ে সুক্ষ্ম হাতে যাওয়া এবং আসার তারিখদুটোকে মুছে দেওয়া। সবুজ কালি উঠে গিয়ে জায়গা দুটো ক্লোরিনের কল্যাণে একেবারে কোরা কাগজ হয়ে যেত। এইবার নিজেদের সবুজ কালিতে, সেই ভদ্রলোকের হাতের লেখার স্টাইলে নিজেদের পছন্দমত ডেট বসানো হত। সাধারণত পুজোর ছুটি পড়ত মহালয়ার দিন থেকে, থাকত ভাইফোঁটা পর্যন্ত। আমরা সেটাকে বাড়িয়ে নিতাম আগে পিছে এক থেকে দু সপ্তাহ মতন। মোটামুটি মহালয়ার এক সপ্তাহ আগে থেকেই হস্টেল ফাঁকা হয়ে যেত, আবার ভর্তি হত ভাইফোঁটার পরের সোমবার। অনিচ্ছুক হবার কারুর উপায়ও ছিল না, কারণ মেজরিটি চলে যাবার ফলে মেস টেসও বন্ধ হয়ে যেত। বাইরে একদিন দু দিন খাওয়া যেত, কিন্তু দীর্ঘদিন বাইরে খাওয়া ছাত্রদের পক্ষে বেশ অসুবিধাজনক ছিল। ফলে, সেই বিশেষ দিনটিতে প্রায় দেড়শো দুশো ছাত্র একসাথে ট্রেনে চড়ত।
কথায় বলে একতাই শক্তি। এতগুলো ইয়ুথ যখন একটা ট্রেনের কামরায় উঠে পড়ে, তখন টিকিট কাটার আর কী দরকার? কে কী করবে? অতএব, জলপাইগুড়ি রোড স্টেশনে খালি একটা জেনারেল কম্পার্টমেন্ট বেছে পুরো দলটা উঠে পড়ত সেখানে। সিট, ওপরের বাঙ্ক, নিচের মেঝে সর্বত্রই সেদিন জলু কলেজের ছাত্রয় ছয়লাপ। শোবার জায়গা কারুরই হত না, তবে বসার জায়গা জুটে যেত। চোদ্দ ঘন্টার জার্নিতে শোবার খুব একটা দরকার হত না, কারণ, বাড়িতেই তো যাচ্ছি, অঢেল আরাম পাবো সেখানে, একটা রাত্তির না হয় কষ্ট করলাম।
এই দল বেঁধে বিনা টিকিটে যাওয়াটাকেই বলা হত মাস ডামা। অনেক সময়ে পাঁচজনে মিলেও ডামা করেছি, কিংবা হাফ ডামা। গাঁট হত মালদায়। সেখানে প্রায় চল্লিশ মিনিটের স্টপেজ ছিল। স্পেশালি জেনারেল কম্পার্টমেন্টেই গুছিয়ে চেকিং হত। একসাথে দেড়শো দুশো বিনা টিকিটের ছাত্রের সামনে বীরত্ব দেখানোর ক্ষমতা ভারতের কোনও টিকিট চেকারের নেই। অতএব, মিউচুয়াল আন্ডারস্ট্যান্ডিং। পারহেড দু টাকা পাঁচ টাকা করে দিলে একটা বিপুল পরিমাণের পয়সা জমা হত, সেটা চেকারকে দিয়ে দেওয়া হত, চেকারও সৎভাবে আর আগে কোথাও চুকলি কাটত না। এই নিগোশিয়েশনটা করত এক্সপিরিয়েন্সড ছেলেপুলেরাই, আমরা বাকিরা ছিলম আজ্ঞাবহ দাসমাত্র। চাওয়ামাত্র দুটাকা দিয়ে দিতাম।
কাটোয়া নবদ্বীপধাম ব্যান্ডেল নৈহাটি, আলটিমেটলি হাওড়া বা শিয়ালদা পর্যন্ত এইভাবেই দল বেঁধে সবাই যেত, তারপর যে কোনও স্টেশন থেকে বেরোবার তো হাজারটা রাস্তা আছে! হাওড়া বা শিয়ালদার মত গাঁটের ক্ষেত্রে পাব্লিক লিলুয়া কিংবা বিধাননগর / দমদমে নেমে পড়ত, ট্রেন আগের স্টেশনে থামতই। কোনও অসুবিধা হত না।
আমার প্রথম ডামার অভিজ্ঞতা? নিতান্তই কুল। প্রচন্ড নার্ভাস আর টেন্স্ড লাগছিল, কারণ তার আগে জীবনে কোনওদিন বিনা টিকিটে এত লং জার্নি করি নি, কিন্তু সঙ্গে অত ছেলে বিনা টিকিটেই যাচ্ছিল, যা হয় হবে সবার হবে, আমি একা তো নই, এই ভাবনাটাই মনে সাহস যোগাচ্ছিল। আলটিমেটলি মালদা কেন, কোথাওই টিটি আসে নি। ব্যান্ডেলে পৌঁছে cool লাইন পেরিয়ে উল্টোদিক দিয়ে নেমে গেছিলাম রাস্তায়। বিনা পয়সায় বাড়ি, জলপাইগুড়ি থেকে।
অপরাধবোধ? হ্যাঁ ... না ... মনে কোথাও যে কোনও খিঁচ কখনও ধরে নি তা বলব না, কিন্তু অতগুলো পয়সা বাঁচার সওয়াল যেখানে, ঐ পয়সায় অনেকগুলো ক্যাসেট হয়ে যায় একবার সিম্ফনিতে গিয়ে পড়তে পারলে, তখন আর ঐ সব অপরাধবোধগুলোকে পাত্তা না দিলেও চলত। আমরা কেউই দিই নি। আবার কেউ কেউ দিতও। রিলিজিয়াসলি যতবার বাড়ি গেছে এসেছে, প্রত্যেকবার টিকিট কেটেই গেছে, কখনও বিনা পয়সায় ট্রেনে চাপে নি, বিবেকের কাছে তারা সত্যিই খুব পরিষ্কার ছিল, আমরা ছিলাম না। তবে তাতে বন্ধুত্ব নষ্ট হয় নি, বা এর বেসিসে কোনও লবিবাজিরও সৃষ্টি হয় নি।
(বাওয়ালবাজি জমবে আবার হপ্তা-দুয়েক পরে)