এইখানটায় অনেকদিন ধরে একজন বসত করতো। আমার ছোট্ট এক কামরার আস্তানায়। ঢ্যাঙা বাড়িখানার চিলেকোঠার ঘর। চিলেকোঠার, তাই সস্তা। তারই মধ্যে আমরা দুজনায় ঘেঁষাঘেঁষি থাকতাম। ক্রিসেনথিমাম ফুলের ছবি আঁকা ওয়ালপেপার, রং ফিকে হয়ে আসা একটা বেখাপ্পা চেয়ার, এক চিলতে রান্নাঘর, কালচে কাঠের পুরনো খাট, সবকিছুর সমান ভাগ করে নিয়ে আমরা থাকতাম। দুজনায়। ঘেঁষাঘেঁষি। অনেকদিন ধরে।
ওর নাম ছিলো ভয়েড। ভয়েড ব্রেনসন। নিরীহ, শান্ত, নির্বিবাদী প্রকৃতির মানুষ। দেখে মনে হত জগতের কোনকিছুতেই তার খুব কিছু আসে যায়না। সকালবেলায় তাড়াহুড়ো করে বেরোনোর সময়ে আমি চাবি খুঁজে পাইনা, এ খুঁজে পাইনা, সে খুঁজে পাইনা। রোজদিন সে এক বেবাক গন্ডগোল! ভয়েড শুধু মস্ত চেয়ারটায় দু'পা তুলে বসে কফির মগে চুমুক দেয়। যেন দুনিয়াতে সময় বলে জিনিসটা থেমে আছে। একএকদিন শুধু লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলে "এসব করে কি কিছু লাভ হবে? খান?"
না, হবেনা। জানি, কোনকিছু করেই কিছু লাভ হবেনা। তোমার আর কী? থাকো বসে নিশ্চিন্ত মনে। কুঁড়ের বাদশা।
রাত্রে যখন ফিরি, ওকে দেখি ক্যাঁচকোঁচে খাটে একখানা পুরনো বইয়ের সাথে আড় হয়ে শুয়ে রয়েছে। কিম্বা বেখাপ্পা চেয়ারে বসে জানালায় পা তুলে দিয়ে বাইরের দিকে দেখে। সারাদিন কোথায় থাকে, কী করে, কী খায়, কোনদিন সেসব নিয়ে কোনো কথা তোলেনা। তবে আমি বাড়ি ফিরেই দেখতে পাবো ওকে, একদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি। একটু ভুল বা হলো।ব্যতিক্রম হয়নি, যদ্দিন না ‘ওর’ সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব হয়েছিলো।‘আমি’র সঙ্গে।
ওর নাম জানিনা। বলেছিল ওই নাম আমার জিভে উচ্চারণ হবেনা। হবেনা, তার কারণ, ‘আমি’ একজন জলমানুষ। গভীরের ভাষা ধুলোমাটির শব্দ দিয়ে ধরা যায়না। ও কিন্তু পারে।উল্টোটা। জানি না কেমন করে।
‘তাহলে কী বলে ডাকবো তোমাকে? আমার নাম খান।’
‘খান? খান মানে কী?’
‘মানে নেই। প্রপার নাউন। এর মানে হয়না।’
‘মানে হয়। সবকিছুরই মানে হয়। খান মানে তো একটা। একখান। নয়? কিম্বা অনেকগুলো হয়ে যায় কখনো। খান খান?’
‘ঠিক আছে। আমি জানিনা কোনটা।’ – আমি জানিনা,আমি ভেঙে গেছি না জুড়ে আছি। কেউই কি জানে?—‘বললে না কী বলে ডাকবো?’
‘আমি’।
‘আমি?!!’
‘Ami, মানে বন্ধু। জানতেনা? ফরাসী ভাষায়।’
না, জানতাম না। আমি ফরাসী ভাষা জানিনা। আমি খুব কম জিনিসই জানি। এই দুনিয়ার। কিম্বা অন্য কোনো দুনিয়ার।
‘তুমি জানলে কী করে এতকিছু? জলমানুষ?’
‘আমি’ নীলচে-সবুজ চোখে অনেকখানি হাসি নিয়ে ডুবে গেছিলো। ও সব কথার উত্তর দেয়না। অনেক কথারই উত্তর হয়ওনা কোনো।
সেদিন অনেক রাত্রে ভয়েড আমাকে বললো – ‘বেশ, আমাকে পাত্তা দেবার দরকার নেই কোনো। আই নো ইউ গট সামওয়ান এলস অন ইওর মাইন্ড।’
‘বাজে বোকোনা। আমি ঘুমোবার চেষ্টা করছি। আমার মনের মধ্যে কিচ্ছু নেই।’… কোনোকিছু না থাকাকে কী বলে জানোনা?ভয়েড?
* * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * * *
“‘আমি, আমার একটা গাছ ছিলো, তাতে আবীর রঙের থোপা থোপা ফুল ফুটতো, জানতে?”
“হ্যাঁ,পমপম ফুল।”
“আমার একটা খুশি লেখার খাতা ছিলো। রোজ রাত্রে তাতে অন্তত তিনটে খুশি লেখা পড়তো। বেশির ভাগ দিনই সংখ্যাটা দশ ছাড়িয়ে যেতো। জানতে?”
“হ্যাঁ। সেই খাতাটা এখন তোমার খাটের নীচে পুরনো জুতোর বাক্সের মধ্যে শুয়ে থাকে। অর্ধেকের ওপর সাদা পাতা নিয়ে।”
“আমার গলার মধ্যে একটা ব্যথা… জানতে?”
“হ্যাঁ। একেক সময়ে মনে হয় আমার এই সমুদ্রের মত জল শক্ত হয়ে দলা পাকিয়ে আছে। একবার টোকা দিলেই গাল বেয়ে নেমে আসবে। না? আরেকজন ব্যাথাও আছে, জানি। ওই সাদা সাদা সরু কাঠিগুলো ওকে এনেছিলো। ওরা রাতদিন ছবি আঁকে। গোলাপী একজোড়া বেলুনের ওপরে ভুষো রঙের। চারকোল স্কেচ। না? ব্যাথা সারাক্ষণ তোমার গলা জড়িয়ে থাকে, মাথায় ইলিবিলি কাটে। ব্যাথা তোমার সাইনাস সুড়ঙ্গে সবসময় ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। না?”
"তুমি জানলে কী করে সবকিছু? জলমানুষ?”
‘আমি’র চোখের মধ্যিখানে সমুদ্র। কোমরের নীচে ওর মাছের ল্যাজ হাসিতে একটুখানি ঢেউ তোলে। আধখানা চাঁদের মত দেখতে আঁশগুলো থেকে রামধনুর মত রঙ ঝলকায়।
“তুমি অনেকগুলো প্রশ্ন করে নিয়েছো। এবার আমি করবো। তাই না? সবকিছুতেই পালাবদল থাকতে হয় খান।”
“আর যদি আমি তোমার প্রশ্নের উত্তর না জানি?”
“আবারও একটা প্রশ্ন করলে! শোনো, আমার বাড়ি যেখানে, সেই অনেক গভীরে উত্তররা সবাই একএকটা মুখবন্ধ ঝিনুকের ভেতরে ঘুমিয়ে থাকে। ফিকে গোলাপী রঙের আছে; সাদা, কালো। তুমি তাদের জানো বা না জানো। ওরা আছে। কখনো আমি তুলে এনে তোমার মুঠোর মধ্যে গুঁজে দেব। ঠিক আছে?”
ওর আঙুলগুলোর দিকে তাকাই। লম্বা,সরু,ফিকে প্রবাল রঙের। ওই আঙুল আমার হাতের মুঠোর মধ্যে গুঁজে দিচ্ছে… কোথাও একটা প্রজাপতি আস্তে আস্তে ডানা ঝাপ্টাতে থাকে। কিম্বা দুটো? পাঁচটা?
ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো। ভয়েডকে দেখতে পাইনা এসে। আজকাল মাঝেমাঝেই পাইনা। কোথায় যায় কে জানে?কখোনো জিজ্ঞেস করিনি। কোনো কোনোদিন অনেক রাত্রে আধোঘুমের মধ্যে গালের ওপর ওর নিঃশ্বাস টের পাই। ফিসফিস করে বলে “আই নো, ইউ হ্যাভ সামওয়ান এলস অন ইওর মাইন্ড”। আমি ওর কথার খেই ধরতে চাই – “আই নো…”, বাক্য শেষ হবার আগেই আধোচেতনা আমার জিভকে আচ্ছন্ন করে। আবল্লী আমাকে আস্তে আস্তে টেনে নিতে থাকে। যেন কেউ খুব নরম একটা কম্বল দিয়ে আমায় মুড়ে দিচ্ছে। বহুদিন হারিয়ে থাকা একটা কম্বল। আমি আবল্লীর মধ্যে তলিয়ে যাই। তলিয়ে যাওয়া বেশ ভালোই জিনিস। গভীরে।
**************************************************************
‘আমি’ বলেছিলো সবকিছুরই পালাবদল থাকতে হয়। এ’কথাটা আমি আগেও পড়েছি। এথায় সেথায়। পড়া কথা সব বিশ্বাস করিনা। অনেক কিছুই আমি বিশ্বাস করিনা। ওরা একে ‘ট্রাস্ট ইস্যু’ বলে। আমি বলি ‘ডিফেন্স মেকানিজম’। ভয়েড বলেছিল খুব পাকাপোক্ত ডিফেন্স মেকানিজম আসলে হীরের মত। দামী। হীরেতে কখনো আঁচড় পড়েনা। ‘আমি’ শুনে হাসে – “হীরে্তে খুব ধার হয়।তোমার বুকের ভেতরে একটা ছোট্ট গরম জিনিষ ধুকপুক করছে।ওর মধ্যে হীরে বসাতে চাও? ফালাফালা হয়ে যাবেনা?”
“তাহলে কী করবো?তুমি বলো?ওই গরম জিনিষটাকে ঠান্ডা থেকে বাঁচানোর জন্য কী করবো ‘আমি’?তুমি জানোনা কতবার কতো পিপে গাঢ় ঠান্ডা আলকাতরা চলকে পড়েছে ওটার ওপরে।আমার ব্যথা লাগে।আলকাতরায় খুব ব্যথা থাকে,ভয় থাকে।”
“ব্যথাকে ভয় পেওনা। ব্যথা জমাট হয়ে হয়ে ভারী সুন্দর স্ফটিক তৈরী হয়। গাঢ় নীল রঙের। ক্রিপ্টোনাইটের থেকে ওর শক্তি কিছু কম নয়। রঙ আলাদা, তাই লক্ষ্যও আলাদা। ভয় যে আসলে একজন সুপারম্যান সেটা জানতে?”
অচেনা অনুভুতিরা বালিয়াড়ির ছায়ায় গা ঢাকা দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। ফিসফাস করে নিজেদের মধ্যে কী সব বলাবলি করে।
নোনাজলের মধ্যে থেকে ফিকে প্রবাল রঙের একটা হাত তুলে ‘আমি’ আমার বুকের ওপরে রেখেছিলো। আমি টের পাই অনেক ভেতরে কোথায় একটা জমাট বরফের চাঙড় আস্তে আস্তে গলে যাচ্ছে।“পালাবদল”, ফিসফিস করে ও বলে “বিশ্বাসের মধ্যে অনেকখানি ওম আছে।আলকাতরাকে ভয় পেওনা। আলকাতরা কোনোদিন অমর আত্মা পায়নি।”
“অমর আত্মা? তুমি হ্যান্স অ্যান্ডারসনের গল্পের মত বলছো!সেই ছোটো জলকন্যার গল্প!”
ওর নিঃশব্দ হাসি আমি বুকের মধ্যেকার হ্রদের মধ্যে শুনতে পাই। বরফগলা হ্রদ,যেখানে ছো্টোছোটো ঢেউ মাথা নাড়াচ্ছিলো। জলের তাপমাত্রা রোদ্দুরের হাত ধরে।
আমি অনেকদিন আগেকার এক ছোট্ট জলকন্যার নিঃসীম ভালোবাসার গল্প শুনতে পাই। ভুলে গেছিলাম ‘আমি’ও একজন জলমানুষ।
সময় চলে যায়। দিনগুলো। একতলার মিসেস পামারের দরজায় লাল হরতনের ছবির জায়গায় চারটে ক্লোভারপাতা আসে। তাদের জায়গায় সাদা খরগোশ,তারা আর ডোরার পতাকা,লাল-কমলা মেপল পাতা,লোম ফোলানো কালো বিল্লী, সব একে একে আসে।দরজার ওপরকার ছবিগুলো কখনো থেমে থাকেনা। দরজার ভেতরেও।
আমার দেওয়ালে ক্রিসেনথিমাম ফুলরা আজকাল আরো একটু হাল্কা রঙের গল্প করে। বেখাপ্পা চেয়ার আয়েসি বুড়োমানুষের মত শীতের রোদ্দুরের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমার পুরনো খাতা খাটের নীচেকার জুতোর বাক্স থেকে বেরিয়ে এসে রাতটেবিলের ওপরে দাঁড়িয়ে ডানা নাড়ায়। টিংকারবেলের মত। ওর ডানা থেকে রামধনু রঙ ঝলকায়। আমার আধখানা চাঁদের মত দেখতে মাছের আঁশের কথা মনে হয়। ওই রামধনু দেখে।
আমি জলমানুষের কথা শুনেছিলাম। আমি একটা একটা করে সব হীরেগুলো ছুঁড়ে ফেলেছি, সমুদ্রের জলে। সহজ হয়নি। সময় লেগেছিলো অনেক। সব দরকারী কাজেই সময় লাগে। সময় ছাড়া ওই ক্রিপ্টোনাইট তৈরী হয়না। গাঢ় নীল। সমুদ্রের মধ্যিখানের মত।
বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হয়েছিলো, যেদিন নীল স্ফটিকটার আলো প্রথম দেখতে পেলাম। সেদিন আমার সাথে আর একজন বাড়ি এসেছিলো। ব্যতিক্রম। বা বলা যায় সেদিন একজন বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিলো। ভয়েড। ভয়েড ব্রেনসন। রাত্রি তারসপ্তকের শেষ সুরে উঠলেও সেদিন ভয়েডের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনতে পেলামনা। পরের দিনও না। তার পরের দিনও না। ভয়েড, ভয়েডও একজন সুপারম্যান ছিলো। যে নীল স্ফটিককে ভয় পায় ।পালাবদলকে।
জলমানুষকে জিজ্ঞেস করেছিলাম -“সত্যি করে বলবে? তুমি কে আসলে? মন আমি?”
‘আমি’ ওর নীলচে সবুজ চোখে অনেকখানি হাসি নিয়ে তাকিয়ে থেকেছিলো। সব কথার উত্তর দেয়না ও। সবকথার উত্তর হয়ওনা।
যেন সব প্রশ্নের উত্তর জানে এমনি ভাব করে টিংকারবেল মাথা নেড়েছিলো “ফরাসী ভাষাও আসলে বাংলাই। বুঝলে খান?”
“মানে?”
“মানে তাইই। আবার কী?”
ও ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেল। পরীদের কথার মানে বোঝা মুশকিল। বরাবরই।