ওরা দুজনেই শিক্ষিত। ভদ্রলোক খাস কলকাতায় ব্যাঙ্কের অফিসার। আঠারোর জানুয়ারিতে রিটায়ার করবেন। দুই মেয়ে ওর দুদিকে। সুন্দরী স্ত্রী একটু তফাতে আর একটি চেয়ারে। ফর্সা টুকটুকে গাল একটুও লাল হলো না যখন বললেন, স্বামী দুই মেয়ের সাহায্য নিয়ে ওর ওপর মানসিক ও শারীরিক অত্যাচার চালান। কিন্তু তাও উনি একসাথেই থাকতে চান। একা থাকতে ওর ভালো লাগে না।
কারই বা লাগে!
কিন্তু ফুঁসে উঠল দুই মেয়ে। একজন গ্রাজুয়েট, অন্য হাইয়ার সেকেন্ডারি পরীক্ষার্থী।
--মিথ্যে কথা। মা-ই বাবার ওপর অত্যাচার করে, মারে অব্দি। বড় হবার পর থেকে এইই দেখছি।
অনেক আলোচনার পর আদালত জিজ্ঞাসা করল,
---তোমরা কি চাও?
মেয়েরা সমস্বরে বলল,
- এপ্রিল মাস অব্দি মা নিজের ফ্ল্যাটে থাকুক। পরীক্ষার পর যেন আসে।
ভদ্রমহিলা তাতে বিচলিত হলেন না। ওর বেশি মাথাব্যথা স্বামীর প্রভিডেন্ট ফান্ডের নমিনি কে তাই নিয়ে। ওকে বোঝানো হল ফ্যামিলি পেনশন স্ত্রীকে বাদ দিয়ে হয় না।
এবার ভদ্রলোক কাঁদতে কাঁদতে হাত জোড় করে বললেন,
--আমার ফ্যামিলি পেনশনের জন্য যে জয়েন্ট ছবি দরকার সেটাই কি করে পাবো জানি না। আমার মায়ের টাকায় কেনা ফ্ল্যাট নিজের নামে করে নিয়েছে। তাতেও আপসোস নেই। কিন্তু অন্য পাওনাকড়ি আমার মেয়েদের। এতে আপনারা আপত্তি করবেন না।
আমাদের সে এক্তিয়ারই নেই, একথা বলার পর মহিলা বললেন,
-- ওর মা কি এমনি এমনি টাকা দিয়ে গেছে! দেখভাল করিনি তাকে?
লোক আদালত তাকে আলাদা থাকতে বললো ছোট মেয়ের পরীক্ষা না হওয়া অব্দি। মাসে খরচ হিসেবে স্বামীটি যা দেবেন তার পরিমাণও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হল।
এখনকার মহিলা কমিশনের চেয়ারপার্সন ছোট পর্দার বড় ব্যক্তিত্ব। ঠাট্টা করে বললাম,
----আপনার সিরিয়ালের বিষয়বস্তু তো আপনি এখানেই পেয়ে যাচ্ছেন।
সত্যিই টিভি সিরিয়ালের এক একটি কেস মহিলা কমিশনে দাখিল হওয়া এক একটি আবেদন। ব্যক্তি আর সমাজ জীবনের জলছবি। মেয়েরা মাথা নীচু করে আর সবকিছু মেনে নিচ্ছেন না। কিন্তু সংসারের কর্ত্রী হয়ে থাকবো এই বাসনা থেকে এখনো বেরোতে পারেননি। স্বামী নিজের বোনকে নিয়ে চলে গেছে, এগারো মাস বাদে ফিরে এসেছে, তবু স্ত্রী ছেলেকে নিয়ে আবার সংসারের পুনঃপ্রতিষ্ঠা চায়। ছেলে ডিপিএসেই পড়ুক চায়। টাকা দেবে কে, একথার উত্তরে একুশ বাইশের মেয়েটি জানায়,
----ওকে রাজারহাট নিউটাউনে সবাই চেনে। সিন্ডিকেট করে ও। এখানকার কাউন্সিলরের ঘর থেকে বেরিয়ে আমায় সেদিন বলছে, কত টাকা পেলে আমায় ছাড়বি ? কুড়ি লাখ, ত্রিশ লাখ ?
আপনারা সিসিটিভি দেখুন। বলেছে কিনা। ও ইচ্ছে করলেই আমার ছেলেকে পড়াতে পারে।
যাদের বয়স কম, তারাও স্বপ্রতিষ্ঠার কথা ভাবে না। বয়স্কারা তো একেবারেই না। বৃত্তিমূলক শিক্ষা নেই কারোরই, গ্রাজুয়েশন পর্যন্ত বেশিরভাগ। সবাই চান সংসার ফিরে পেতে, তা আমূল নষ্ট হয়ে গেছে একথা বুঝেও। লড়াকু মন বিরল। শিশুবেলা থেকে পরনির্ভরতা ছাড়া বাঙালি পরিবারে মেয়েদের আর কিইই বা শেখাই আমরা।
ফলে সবাই চাইছেন ম্যাক্সিমাম খোরপোষ আদায় করতে। পুরুষেরা দিচ্ছেন বলে শাহেনশা মেজাজে থাকেন। একলাখির রেল কর্মচারি অবলীলায় বলতে পারেন,
--কেন টাকা বাড়াবো? পরপুরুষের সাথে ঘোরার জন্য?
উত্তরে মহিলা শান্তভাবেই জাজদের জানান,
--ও কাজের মেয়েদেরও ছাড়ে না, জানেন।
সম্পর্ক যখন এই তলানিতে, তখন সেটা বয়ে নিয়ে যাওয়ার কোন মানে নেই জেনেও এরা শেষ চেষ্টা করতেই থাকেন। সংসার না থাকলে মেয়েদের ভয়াবহ আত্মপরিচয়ের সংকট। শাহেনশাদের সে সংকট নেই। তারা সবাই আত্মপরিচয়ে বলীয়ান। বাইরের জগতে স্বচ্ছন্দ চলাফেরা। বৌ না থাকলেও সমাজজলে মীনের ন্যায় স্বচ্ছন্দ সাঁতারে কোন বাধা নেই। বরং সহানুভূতি আছে। আর আছে দাতার শ্লাঘা, গ্রহীতার প্রতি তাচ্ছিল্য। ফলে তারা চকচকে। বলিয়েকইয়ে। মেয়েদের প্রত্যেকের মুখ ক্লিষ্ট। সবচেয়ে নির্দয় যাকে মনে হয়েছে, যার কথায় এ লেখা শুরু, তারও মধ্যে মনোরোগীর ছাপ স্পষ্ট। কিন্তু কি আশ্চর্যকথা, টেবিলের এপার থেকে যখন সাইকিয়াট্রিস্ট দেখাবার কথা বলা হচ্ছে, দুপক্ষই হাঁ হাঁ করে উঠছেন। শুরু হয়ে যাচ্ছে তুই পাগল না মুই পাগলের গপ্পো।
মেয়েদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার বা অভিযোগ নেবার জায়গা রাজ্য মহিলা কমিশন এইটুকু প্রায় সবাই জানি। কি তাদের এক্তিয়ার, কাজের পদ্ধতিই বা কি, লোক আদালতের সঙ্গেই বা গাঁটছড়া কোথায়, এসব খবর দায়ে না পড়লে কেউ রাখে না।
১৯৯২ সালে নারীমুক্তির জন্য লড়াকু বলে খ্যাত কিছু নামজাদা মহিলাকে নিয়ে তৈরি হয়েছিল এই কমিশন। এর এক্তিয়ারে আছে এদেশের সংবিধানে নারীর জন্য রক্ষিত সমস্ত অধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রটিকে কন্টকবর্জিত করা আর বঞ্চনাগুলির সঙ্গে লড়াই করা।
এই যুদ্ধের একটি হাতিয়ার মহিলা পারিবারিক লোক আদালত। দীর্ঘসময়ের পলি চাপা পড়া ন্যায় তো আসলে ন্যায়ের পদবাচ্য নয়, তাই দ্রুত ফয়সালার জন্য কিছুদিন অন্তর অন্তর বসে এই আদালত, মূলত গার্হস্থহিংসার বিরুদ্ধতায়, বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতায় বা অন্য কোন পারিবারিক অশান্তির সমাধান কামনায়।
মহিলা কমিশনের কথা বার বার খবরের কাগজে এলেও, লোক আদালত সম্বন্ধে আমরা খবর রাখি আরো কম। এই আদালতের ভিত্তিপ্রস্তর হচ্ছে ১৯৭৬ সালের সংবিধান সংশোধনের ফল আর্টিকেল ৩৯এ। রাষ্ট্র, হোক সে কেন্দ্র অথবা রাজ্য, ন্যায়বন্টনের ব্যবস্থাকে নিখুঁত করে তোলবার লক্ষ্যে ফ্রি আইনি পরিষেবা প্রকল্প চালু করবে যাতে সমতার ভিত্তিতে প্রত্যেক নাগরিক ন্যায়বিচার পাবার অধিকারী হতে পারে। এইজন্য আনা হলো লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটিজ এক্ট এবং প্রত্যেক রাজ্যে, জেলায় গঠন করা হলো লোক আদালত। সবচেয়ে কম সময়ে, কম ঝঞ্ঝাটে এবং নিখরচায় ন্যায়বিচার দেয় লোক আদালত। একজন অবসরপ্রাপ্ত জেলাজজ, একজন আইনজ্ঞ এবং সমাজকর্মী নিয়ে গঠিত হয় একটি বেঞ্চ। বাইরের আইনজীবির সাহায্য ছাড়াই বাদী ও বিবাদীর সহমতের ভিত্তিতে যে কোন সমস্যা সমাধান করবে লোক আদালত এবং এর রায় দেশের আর কোথাও চ্যালেঞ্জড হবে না, এমন কি সুপ্রিম কোর্টেও নয়।
তবে পারিবারিক মহিলা লোক আদালতে বৈবাহিক এবং পারিবারিক বিষয়গুলিরই ফয়সালা হয়। কমিশনের প্রশস্ত ঘরে শান্ত পরিবেশে বাদী বিবাদী দু পক্ষই মন খুলে বিচারকদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। কমিশনের চেয়ারপার্সন তো থাকেনই, অন্য সদস্যারাও উপস্থিত থাকতে পারেন। সবচেয়ে কম সময়ে বিচার পাবার সেরা জায়গা। কোন পক্ষের যদি কথা বলে মনে হয় এখানে ন্যায়বিচার পাবেন না, তাহলে তিনি কোর্টে কেস দাখিল করতে পারেন। বেশির ভাগই সে হ্যাপা পোহাতে চান না।
প্রত্যেকটি পারিবারিক মহিলা লোক আদালতের পেছনে থাকে ন্যাশনাল উইমেনস কমিশন এবং স্টেট লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটি।
পশ্চিমবঙ্গ উইমেনস কমিশনের একটি চমৎকার ইউজার-বান্ধব ওয়েবসাইট আছে। প্রি লিটিগেশন এন্ড কাউন্সেলিং সেল আছে। দক্ষ কাউন্সিলরকে বার বারই সরব হতে দেখলাম। সুয়ো মোটো তদন্ত করবার ক্ষমতা আছে। কর্মক্ষেত্রে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্টের অভিযোগও জমা পড়ে। বিশাখা গাইডলাইন মেনে চলা হচ্ছে কিনা তাও কমিশন দেখতে পারে। কোন নির্যাতিতা প্রাণ সংশয়ের আশঙ্কা প্রকাশ করলে থানাকে নজর রাখবার নির্দেশ দিতে পারে।
মহিলা কমিশন পারে অনেক কিছু। যা পারে না তা হলো ক্ষমতার সমীকরণ পাল্টাতে আর হৃদয় পরিবর্তন করতে। তিনটে কেসে দেখা গেল মায়ের বিরুদ্ধতা করলো মেয়েরা। হ্যাঁ, মেয়েরা। এই দম্পতিদের পুত্রসন্তান নেই। সে করতেই পারে, কিন্তু মায়েরাও এক কথাই আওড়ালেন, টাকা ছড়িয়ে বাবা আনুগত্য কিনেছে। কথাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়। ছোটরা ভালোমন্দের বিভিন্ন স্তরগুলো বুঝে ফেলার পরিপক্বতা নিয়ে জন্মায় না। তার জন্য দরকার শিক্ষা, মানসিক পরিণতি এবং জাগতিক অভিজ্ঞতা। শুধু একটা দামী মোবাইলের লোভে বড়দেরও সাময়িক আনুগত্য কেনা যায়।
মেয়েদেরকে ঠকানো অতটা সহজ নেই আর দিনশেষে এইরকমই মনে হল। ছোট একটি মেয়ে, নেট পেয়েছিল, বিয়ের পর দেখলো স্বামীটি ড্রাগ এডিক্ট এবং মানসিক রোগী। তাকে চাকরিও করতে দেয়নি বড়লোক শ্বশুরবাড়ি। দু বছরের ব্যর্থ চেষ্টার পর সে ফিরে এসেছে। কোন মেইন্টেন্যান্স ছাড়া সে টিউশানি করে চালাচ্ছে। দু বার নোটিশ পেয়েও ও পক্ষ থেকে কেউ কমিশনে না আসায় সহমতের ভিত্তিতে মেটানো সম্ভব নয়। তাই সে এবার আলিপুরে লিগ্যাল সার্ভিসেস অথরিটির কাছে যাবে মামলা করতে।
সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে সে জানে, হয়তো কোন কথায় মনে হয়ে থাকবে তার ভবিষ্যতের ভালো চাইছি, যাবার সময় একটা সুন্দর কৃতজ্ঞ হাসি উপহার দিয়ে গেল সে সরাসরি চোখের দিকে তাকিয়ে।
এই চোখে চোখ রাখাটা মেয়েদের আয়ত্বে এসেছে এতোদিনে, এই অনুভূতিটুকুই সেদিনের পারিবারিক লোক আদালতের সবচেয়ে বড় পাওনা।