এক ছিল রানী। রাজার মেয়ে, আরেক রাজার ঘরণী। হাতিশালে হাতি, ঘোড়াশালে ঘোড়া- কিছুরই অভাব নেই তার। তীক্ষ্ণ বুদ্ধিশালিনীও। রাজার পাশে পাশে রাজ্যশাসনের কাজেও সাহায্য করেন। প্রজারাও তাঁর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। রাজা যখন মারা গেলেন রানীর তখন বছর তিরিশেক বয়স। রাজা হলেন ভাইপো, ন’বছরের বালক। সুযোগ বুঝলেন তাঁর প্রতিনিধিরা। নাদান বালককে কব্জা করে রাজত্ব দখল তো কয়েক সেকেন্ডের কাজ। ঝলসে উঠলেন রানী। কূটনীতির প্রয়োগে ছোট্ট রাজার শত্রুদের একে একে সরিয়ে সিংহাসন নিষ্কন্টক করলেন। ইতিমধ্যে বাইরের শত্রু হানা দিল। সেনাপতিরা দিশেহারা। কেল্লার দেওয়াল বার বার আক্রমণে ভেঙ্গে পড়ছে। রানী নিজে এলেন রণাঙ্গনে। অবিশ্রান্ত বৃষ্টি মাথায় করে, দিনরাত জেগে সেই ভাঙ্গা অংশ রক্ষা করলেন, যতক্ষণ না সে দেওয়াল মেরামতি শেষ হয়। যুদ্ধে জয় হল। বীরত্বে মুগ্ধ প্রজারা জয়ধ্বনি দিল, জয় চাঁদবিবির জয়! এরপর কেটে গেছে অনেকদিন। এবার ডাক এল বাপের বাড়ির রাজ্য থেকে। সেখানে আরেক নাবালকের অভিভাবকত্ব দরকার। আবার টালমাটাল সময়। অন্তর্দ্বন্দ্বে ভরপুর। এদিকে বার বার বন্যার মত মুঘলসেনা ঝাঁপিয়ে পড়ছে আহমদনগরের উপর। রানী বাঘিনীর মত দুর্গ রক্ষা করছেন। আকবরের ছেলে মুরাদও তাঁর বীরত্বে মুগ্ধ। মুরাদই তাঁকে সুলতানা বলে অভিহিত করেন। কিন্তু আবার যখন আকবরের বিশাল বাহিনী এল, রানী বুঝলেন আর শেষরক্ষা বুঝি হল না। সন্ধি চাইলেন। কিন্তু প্রজারা ভুল বুঝল। ভাবল রানী বিশ্বাসঘাতক। নিজের বাহিনীর হাতেই মারা গেলেন। চাঁদ সুলতানা। ইতিহাস ভোলেনি তাঁকে। আমরাও ভুলেছি কি? চলেছি তাঁর শ্বশুরাল বিজাপুরে। গোলগম্বুজের দেশ!
******
ব্যাঙ্গালুরু থেকে ট্রেন আছে জানি, একরাতের দুরত্ব, সকাল সকাল পৌঁছে দেবে বিজাপুরে। কিন্তু টিকিট কাটব কি ভাবে! টাইমটেবিলে তো বিজাপুর-ই নেই। খানিক খুঁজে-পেতে দেখা গেল তিনি আছেন, তবে একটু অন্যনামে। ২০১৪ সাল থেকে তিনি নাম বদলে হয়েছেন বিজয়পুর। সে শহর নাকি আদতে পশ্চিমা চালুক্যদের হাতে তৈরি! হবেও বা! দাক্ষিণাত্য মালভূমি তো এই সব রাজা-গজাদের জন্মানোর ঢের আগে তৈরি, তারপর রাজার পরে রাজা এসেছে, বিজিতের কীর্তির উপর জয়ী রাজার নাম চেপেছে। এটাই সর্বযুগের কমন ইতিহাস। অবশ্য বিজাপুরই হোক আর বিজয়পুরই হোক, আমার গোলগম্বুজ দেখা নিয়ে কথা! ব্যাস।
সন্ধ্যে সন্ধ্যে ব্যাঙ্গালুরু থেকে ট্রেন ছেড়েছে। পৌঁছানর কথা পরের দিন সকাল সাড়ে নটা নাগাদ। সেই মত সকালবেলা উঠে পড়ে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে বসে আছি। পরের দিন ভোরবেলা আমাদের বিজাপুর ছাড়তে হবে। কাজেই সুজ্জিমামা অস্তাচলে যাওয়ার আগের দিনটুকু শুধু সময় আমাদের হাতে। এর মধ্যেই শহরটাকে উলটে পালটে চেটে পুটে চেখে চুখে দেখে নিতে হবে। এদিকে হাতে একটা বিশাল বড় লিস্টি – কি কি দেখতে হবে! ফলে একটুকুও সময় নষ্ট করা যাবে না। ট্রেন এদিকে চলতে চলতে হঠাৎ ঘট ঘট ঘটাং করে একটা ফাঁকা মাঠের মধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ল। আর নড়েও না, চড়েও না। হাঁ করে বসেই আছি, কাউকে কিছু জিজ্ঞেস করেও উত্তর পাচ্ছি না। ঘোরতর ভাষা সমস্যা। দেখছি ঘড়ির কাঁটা হেলেদুলে এক দাগ থেকে আরেক দাগ ছুঁচ্ছে। মাঝে মাঝে এক একটা গাড়ি এসে রেললাইনের পাশে দাঁড়াচ্ছে। আমাদের ট্রেন থেকে লোকজন বাক্স প্যাঁটরা টানাটানি করে নামিয়ে নিয়ে সেই গাড়ীতে গিয়ে উঠছে। আমাদের কিচ্ছু করার নেই! শেষকালে আর উপায় না দেখে আমরা যখন হোটেলে ফোন করে গাড়ীর ব্যবস্থা করছি, তখন ট্রেন নড়ে উঠল। এইবার একটা নতুন রকমের অভিজ্ঞতা হল। সামনের লাইনে কাজ হচ্ছে বলে গাড়ী থেমে ছিল তা জানি। এইবার দেখলাম একটা ছোট অংশে লাইনের নীচে মাটি-টাটি কিচ্ছু নেই। ফাঁকা। কিছু একটা সাপোর্ট হয়ত ছিল, আমরা সেসব দেখতে পাচ্ছি না। ট্রেন শামুকের থেকেও ঢিমে গতিতে পেরোচ্ছে – আর লাইনের দুপাশে সব যন্ত্রপাতি নিয়ে কর্মীদের জটলা। তারা গভীর মনোযোগ দিয়ে আমাদের ট্রেনের চলা দেখছে। ওই জায়গাটা পেরোনর পরে সবাই যা জয়োল্লাস করে উঠল, তাতে এবার আমার মনে একটা সন্দেহ দেখা দিল। তবে কি ট্রেনের না পেরোতে পারার একটা সম্ভাবনা ছিল? ভাবতেই গা-টা একটু সিরসিরিয়ে উঠল।
******
বিজাপুর এমনিতেই ছোট শহর। পিছিয়ে পড়া এলাকা। সেটা মালুম হল স্টেশনের বাইরে এসে। অটো, গাড়ী, টাঙ্গার একসঙ্গে মোলায়েম সহাবস্থান। ঘোড়ার লেজের ফাঁক দিয়ে অটো নাক গলিয়েছে, তাদের পিছনে গাড়ী তারস্বরে হর্ণ মেরে চলেছে। অনেকটা “যদি হও সুজন, তেঁতুলপাতায় ন’জন” গোছের ভাব। টাঙ্গাসওয়ার হতে সাধ জাগল – মালপত্র কাঁখে কোমরে গুঁজে চড়ে বসলাম! কিন্তু ঠিক সুবিধা হল না - ঘোড়ার পায়ের নাল আর ভাঙ্গাচোরা হাম্পে ভরা রাস্তার এফেক্ট কোমরের উপর বিশেষ ভালো হল না। টাঙ্গায় চড়ে বাদশাহী স্টাইলে শহর দেখার প্ল্যান বাদ দিতেই হল।
অগত্যা শহর ঘুরতে অটো ভরসা। ততক্ষণে দ্রষ্টব্যের লিস্টিকে অকরুণ হাতে কেটে ছেঁটে প্রায় আধা করে আনা হয়েছে। তাও যা রয়েছে সেটুকুও এই অল্প সময়ে দেখা হলে হয়! আর্কিটেকচারপ্রেমীদের স্বর্গ বিজাপুর। আদিলশাহী সুলতানদের হাতে তিল তিল করে সেজে ওঠা পিয়ারা রাজধানী। ইউসুফ আদিল শাহের হাতে তৈরি। কেউ কেউ বলেন তিনি পারস্যের শাহের ছোট ছেলে, নিজের প্রাণ বাঁচাতে ছোট্টবেলায় রাজ্যছাড়া। আবার কেউ বলেন দাস ছিলেন। ভাগ্য তাকে পৌঁছে দিয়েছিল সিধা বিজাপুরের সিংহাসনে। বিয়ে করেছিলেন এক মারাঠি কন্যাকে। একদারনিষ্ঠ। এঁর কথা এত বিস্তারে বলছি কারণ ইনি বিশ্বাস করতেন, তোমার ধর্মবিশ্বাস তোমার কাছে, আমার ধর্মবিশ্বাস আমার কাছে। মোটামুটি এই সুরেই বাঁধা ছিল পরের দুশো বছরের বিজাপুর। এঁর নাতি প্রথম ইব্রাহিম আদিল শাহ, তার ছেলে হলেন আলি আদিল শাহ। স্থাপত্যের সমঝদার রাজা, বিজাপুর জুড়ে ছড়ানো গগনমহল, চাঁদ বাউরি, জামা মসজিদ সব এঁর আমলে তৈরি। এই রাজ্যের রাজারা মোটামুটি শিক্ষিত, বিদ্যোৎসাহী ছিলেন সবাই। আলি তাঁদের মধ্যেও সেরা। এঁর লাইব্রেরীর দেখাশোনার জন্য ষাটজন লোক ছিল। যুদ্ধেও যে যেতেন, সঙ্গে গরুর গাড়ীতে বই যেত সঙ্গে। অসমাপ্ত নুজুম-আল-উলমুন এঁরই লেখা বলে অনুমান। এ রাজাকে ভালো না লেগে উপায় কি! অবশ্য একটা ডিসক্লেইমার এখানেই দেওয়া প্রয়োজন, প্রকৃত রাজা হিসেবে কেমন ছিলেন তা জানি না। মানে তাঁদের আমলেও গরীব চাষিকে আত্মহত্যা করতে হত কিনা, দীর্ঘ খরার পরে প্রজাদের কিভাবে সাহায্য করতেন বা কাছের অমাত্যদের অনাচার চোখ বুজে মেনে নিতেন কিনা ইত্যাদি সব প্রশ্নের উত্তর আমার জানা নেই। আলির আমলেই তেলিকোটার যুদ্ধ হয়, হাম্পি-খ্যাত বিজয়নগরের সোনা-ঝলমল রাজ্যের কফিনে শেষ পেরেকটি পোঁতা হয় সেখানেই। অবশ্য সেই যুদ্ধ শুধু একা আলি আদিল শাহ করেন নি, হাত মিলিয়ে ছিলেন দাক্ষিণাত্যের অন্য সুলতানেরাও। সেই যুদ্ধে ব্যবহার করা একটি বিশাল কামান সাজিয়ে রাখা আছে বিজাপুরের মালিক-ই-ময়দানে। বিশাল বড়, আর কি সুন্দর কারুকার্য! একটা সিংহের মুখ, তার চোয়ালের মধ্যে একটি হাতি আটকে আছে। এত সুন্দর একটা শিল্পকর্ম – তাই দিয়ে নাকি মানুষ মারা হত! আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন চাঁদিফাটা রোদ – অথচ রোদ্দুরে পড়ে থাকা কামানটা একদম ঠাণ্ডা!
বেড়ানো’র একদম শুরুটা অবশ্য তেমন ভালো না। প্রথমেই গিয়েছিলাম জোড় গম্বুজ দেখতে। একেই সেখানে কোন গাইড নেই, মায় কোন বোর্ডও নেই – ফলে কি দেখছি, কেন দেখছি সবটাই বোঝা দায়। দেখতে যদিও বেশ ভালো, অনেকটা ছড়ানো জায়গার উপর একজোড়া গম্বুজ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে – বেশ রাজসিক ব্যাপার! ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল যে এ জোড়া গম্বুজে শুয়ে আছেন বাপ আর ছেলে। খান খানাম আর খাওয়াস খান। আদিলশাহী শেষ সুলতান সিকন্দারের উজির। এঁদেরই বিশ্বাসঘাতকতায় মুঘলের সঙ্গে যুদ্ধে হারেন সিকন্দর। পরে ঔরংজেবের হুকুমে এই জোড়া গম্বুজ তৈরি হয়। সেখানে আবার একটা অংশে মেয়েদের ঢোকা মানা। আব্দুল রাজ্জাক কাদরির দরগা। পুরুষদের ঢোকার অবশ্য বাধা নেই, ইচ্ছেমত ছবি তোলাও যায়। নারী কিনা এতই নরকের দ্বার! প্রথমেই বিশ্বাসঘাতকদের সঙ্গে মোলাকাত হয়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল।
পাশেই তাজ বাওরি। এমনিতে পুকুরে বিশেষ দেখার কিছু নেই। গাঢ় সবুজ জল। বাঁধানো পাড়। বিরাট মিনারে-গম্বুজে সাজানো গেট সামনে। পিছনে অলস জল। তাজ সুলতানার নামে। ঠিক এমনই আরেকটি আছে, চাঁদ বিবির নামে। চাঁদ বাওরি। ইতিহাস জড়ানো গায়ে।
আঁকা বাঁকা সরু সরু রাস্তা দিয়ে চলেছি। পুরোন শহর। ঝাঁ চকচকে নয় মোটেই। বরং একটু ধুলোভরা, অগোছালো – পথের পাশের বেআব্রু দারিদ্রে একটু যেন আবছা মত। পথের বাঁক ঘুরলে হঠাৎ হঠাৎ চোখে ভেসে ওঠে এক একটা পাথরে গড়া মায়া – কালের প্রলেপে ধুসর তাদের রং। ট্যুরিস্ট নেই মোটেই – শুধু পাড়ার দু চার জন লোকের ইতস্তত ঘোরাফেরা, নতুন লোক দেখে একবার তাকিয়ে দেখা – ব্যস ওইটুকুই। অটো নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে থামছে, ড্রাইভার শুধু জায়গার নামটা বলে দিচ্ছেন। বেশি কথাবার্তা হচ্ছে না, দুপক্ষেরই ভাষাজ্ঞানে ঘাটতি হচ্ছে। এরই মধ্যে দেখে নেওয়া গেল ইব্রাহিম রোজা। দ্বিতীয় ইব্রাহিম আদিল শাহের স্ত্রী তাজ সুলতানার সমাধি, সুলতানেরও। পাথরের দৃঢ়তার সঙ্গে অলংকরণের সূক্ষ্মতার আর আর্চের পেলবতার মিশেলে তৈরি একটা ছবি। সিধে মাথা-তোলা মিনারেটের ঔদ্ধত্যকে লাগাম পড়িয়েছে গোল শীর্ষ। দেওয়ালে মাঝে মাঝে অচেনা ভাষায় লেখা কথা। বোধহয় আরবি। এখানেও গাইড নেই। তবে জোগাড় হল একটা দশটাকার চটি গাইডবই। এই বই-ই ভরসা এখন। দেখা হল প্রথম আলি আদিল শাহের তৈরি গগনমহল, তিনি কি আর জানতেন যে একদিন এই বাড়িতেই তাঁর বংশের শেষ পুরুষটি শত্রুর হাতে আত্মসমর্পণ করবে! ছোট রাস্তার থেকে সটান মাথা তোলা মেহতার মহলের অপুর্ব কারুকার্যের দাপট চোখ ফেরাতে দেয় না। আসর মহলে যখন পৌঁছালাম বিকেল তখন মরে এসেছে। মহম্মদ আদিল শাহের বিচারসভা ছিল এখানে। ধর্মপ্রাণ হলে হয়ত আসর মহলের আলাদা কদর করতাম। হজরত মহম্মদের দাড়ির দুটি চুল আছে এখানে। অতএব পুণ্যভূমি। পাপী তাপী আমি, আমার চোখে শুধু লেগে রইল তালাওর জলে কাঁপতে থাকা খন্ডহরের ছায়া! বড় মায়াবি ছবি! একটু আগে দেখে আসা বড়া কামানের ঘোর কাটেনি তখনো। মহম্মদ আদিল শাহের পালিত পুত্র দ্বিতীয় আদিল শাহ শুরু করেছিলেন। তাঁর বেহস্ত-আবাসও বটে। ছাদহীন সারি সারি কারুকার্যময় খিলানের গায়ে অনন্তের হাতছানি। অসমাপ্ত কাব্য।
শেষের জন্য তুলে রাখা ছিল গোলগম্বুজ দর্শন। গাইড মিলল গোলগম্বুজে পৌঁছে । নেহাতই বাচ্চা ছেলে একটি – ইতিহাসে এম এ পড়ছে। দরদ দিয়ে বোঝাচ্ছিল। আলি আদিল শাহের ভাইপো দ্বিতীয় ইব্রাহিম, তাঁর ছেলে মহম্মদ আদিল শাহ। এঁরই দরবারে ছিলেন আরেক ইতিহাস বিখ্যাত বাবা – শাহজি। ছেলে শিবাজী অবশ্য বাবার থেকে মায়ের কোলে বড় হলেন বেশি। মহম্মদ আদিল শাহের শেষ শয়ান এই গোলগম্বুজে। তার চারপাশ দিয়ে তীক্ষ্ণাগ্র আর্চ ঘিরে রয়েছে, অলংকরণের বাহুল্যহীন, লাইনগুলি তাই সুস্পষ্ট। একটা অভিজাত সিমেট্রির খেলা। নীচের দেখা শেষ করে এবার যেতে হবে উপরে। এদিকে সিঁড়ির মুখে লেখা হার্টের রোগীদের সে সিঁড়িতে চড়া মানা। দেখেই বুঝলাম, ডালমে কুছ কালা হ্যায়। বললাম আমার দেখা হয়ে গেছে, তোমরা উপরে যাও।আমি এখানেই থাকি। কিন্তু আমাদের গাইড নাছোড়বান্দা। অনেকটা পিকের মত ভোকাল টনিক দিয়ে সে আমাকে সিঁড়িতে ঢুকিয়ে দিল। গোটা তিনেক তলা উঠে আমার তো জিভ বেরিয়ে গেছে। কি খাড়াই সিঁড়ি বাপরে! মহাপ্রস্থানের পথের ধর্মরাজের কুকুরের মত হা হা করে হাঁপাচ্ছি। আর বলছি, আর উঠব না, চললুম আমি নীচে। তখন ছোকরা আসল বম্বশেলটি ফাটাল – ম্যাম এটা আসলে ওয়ান ওয়ে। নামার সিঁড়ি পাবেন একদম উপরে উঠে, সাততলার উপরে। কি মনে হয় এরপরে! সব রাগ মনে চেপে রেখে উপরে উঠতেই হল। এ গম্বুজ এমন শব্দবিজ্ঞান মেনে তৈরি যে এর এক জায়গায় ফিস ফিস করে কথা বললেও অন্য জায়গা থেকে শোনা যাবে। কিন্তু শোনার জন্য একটা শান্ত পরিবেশ লাগে। তার বড় আকাল ওখানে। গোটা বিজাপুরে একমাত্র এই গোলগম্বুজেই লোকের ভিড়। বিকেলবেলা অনেকেই বাচ্চা নিয়ে বেড়াতে এসেছেন। তাই ডেসিবল লেভেল কম না। ভালো করে ফিসফিসানি শোনাতে না পেরে গাইডের ভারী দু;খ। বার বার বলছিল কাল সকালে আর একবার আসুন। তখন ফাঁকা থাকবে। ঠিক শুনতে পাবেন। আরে, আগে তো একবার উপর থেকে নামি! এই স্বর্গের সিঁড়ি বেয়ে আর উঠি কক্ষনো! নামার রাস্তা আরও খারাপ। ভাঙাচোরা, অন্ধকার। তবু একসময় নেমে এলাম।
******
অবশ্য উপরে উঠে একটা লাভ হল। গাইড ছেলেটি গল্প বলার ছুতোয় ম্যামকে একটু বিশ্রামের সুযোগ করে দিয়েছিল। তখন বিজাপুর শহরকে সাক্ষী রেখে অনেক খাসগল্প শোনা গেল। চেনা গল্প – নেই-রাজ্যের কাহিনী - জল, শিল্প, ট্যুরিজম, চাকরী কিচ্ছু নেই! অনেক তদবিরে নাকি প্লাস্টিকের কারখানা মিলেছিল, সেও জলের অভাবে ধুঁকছে! আগে নদীর জল ভরসা ছিল। সে নদীতে নাকি জল থাকলে এত ফসল হত, খেয়ে শেষ করা যেত না। এখন সে নদী মৃতপ্রায়। পড়াশোনার শেষে কি করবে জানা নেই ওর! বিজাপুরের মেহের আলিদের সব ঝুট হ্যায় আর্তনাদ শোনার লোকেরও বড় অভাব! না আছে তথাকথিত ডেভেলপমেন্টের ছোঁয়া, না আছে তেমন তরতাজা কোন বিকল্প উন্নতির মডেল। এমনকি যে গোলগম্বুজ ঘিরে এত বিজাপুরী গর্ব, তাকেও কিছুতেই ইউনেস্কোর হেরিটেজ তালিকায় তোলা যাচ্ছে না। কর্তাদের মনোযোগের বড় অভাব! আসর মহলের পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে আমাদের অটো ড্রাইভারের সঙ্গে আমার ইস্পেশাল টুটাফাটা হিন্দিতে গল্প করার চেষ্টা করছিলাম, তার গলাতেও এই একই হাহাকার! তিন কন্যার বাবার কথায় এক গভীর অসহায়তা! মেয়েরা পড়ছে, ছোট খাট কাজ পেলেও করতে পারবে না - লোকে কি বলবে! দারিদ্রের চাপ আর সমাজের চাপ দুয়ে নুয়ে পড়া এক সংসারী মানুষ!
বিকেল পাঁচটার সময় পেটে দাউ দাঊ আগুন জ্বলে উঠল – সারাদিন পেটে কিছু পড়ে নি। রাস্তায় যা পছন্দসই খাবার জায়গা চোখে পড়েছে সব নিরামিষ। সে চলবে না। বলা হল নন-ভেজ রেস্তরাঁতে নিয়ে যেতে। যেখানে হাজির করল, পছন্দ হল না। বাসরাস্তার ঠিক উপরে, ভারী নোংরা জায়গা, মাছিতে ভিন ভিন করছে! জিজ্ঞেস করা হল, এর থেকে ভালো কোন জায়গা নেই? একটু ইতস্তত করে অটোচালক বললেন, সেখানে কিন্তু বড়া গোস্তও মেলে , চলবে? চলবে, চলবে -সব চলবে , শুধু খেতে পেলেই হল! কিন্তু বিধি বাম! পৌঁছে দেখা গেল , সে এক কাঁচা নর্দমার পাশে ইটিং হাউস, এয়ার কন্ডিশন্ড লেখা আছে বটে! ঢুকে বসতে যেতেই এক রাশ আরশোলা এসে ঘিরে ধরে “আয় তবে সহচরী, হাতে হাতে ধরি ধরি” নাচতে লাগল! এরপরে আর সেখানে খাওয়া গেল না! এ জায়গাটায় কিছু গন্ডগোল আছে – মাছি, আরশোলার স্বর্গরাজ্য দেখি! একটু আগেই রাস্তায় দেখেছি সারি দিয়ে বিভিন্ন বেকারীর দোকান, কাঁচের আড়ালে সাজানো হরেক সম্ভার। অথচ কাঁচের ভিতরে বিন বিন করছে মাছির দল। প্রায় সর্বত্র। লোকের ভ্রুক্ষেপও নেই। অবশ্য তার মাঝে সিনেমাহল চলছে রমরমিয়ে। বিশাল আকাশছোঁয়া হোর্ডিং তার! আলো-জ্বলা শপিং আর্কেডও দেখলাম। কেমন খুনখুনে বুড়ির গালের কৃত্রিম লালিমার মত লাগল যেন!
ফিরে চল হোটেলে, যা মেলে তাই দিয়েই ক্ষুন্নিবৃত্তি! কোথায় কবজি ডুবিয়ে নবাবী খানা খাব, তা না! রাত্রে অবশ্য কাছের একটা দোকান থেকে বিজাপুর স্পেশাল মিল্ক কেক জুটেছিল, এটাই আনন্দ! যা দেখলাম, বাদ পড়ল তার অনেক বেশি। সব থেকে বেশি দুঃখ হল কর্ণাটকের যাযাবর জাতি লাম্বানিদের শিল্পকলার নমুনা নাকি দেখা যায় বিজাপুরে। তারও সন্ধান পেলাম না।
আর অতীত যতই মনোহারি হোক, বর্তমান কিন্তু বেশ বেদনাদায়ক লাগল। রাতে শুয়ে শুয়ে তাই ভাবছিলাম। অনেক দিন আগে এক সেমিনারে শুনেছিলাম আধুনিক ইন্ডিয়ার নতুন শ্রেনীবিভাগের কথা। যেখানে বড় মেট্রোপলিট্যান শহরের প্রথমসারির নাগরিককুল সবটুকু আলো মেখে বসে থাকে। তামাম দুনিয়ার সঙ্গে সে টক্কর দেয় নির্দ্বিধায়। দুনিয়ার সব পাওয়াও তার জন্য। শুধু তার জন্য। সে হল ইন্ডিয়া-এ। আর এই হল ইন্ডিয়া-বি। ইন্ডিয়া -এ' র হাতের মুঠোর ফাঁক দিয়ে গলে রাস্তার ধুলোয় পড়ে যাওয়া স্বদেশভূমি! ওই সব-পেয়েছির ইন্ডিয়া-এ’ র থেকে যোজন যোজন দূরে তার বাস। এই রাজা আসে , ওই রাজা যায় – দিন বদলায় না সেই ভারতে!