আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত,
এই রক্ত কোনোদিন
পরাভব মানে না…
০১.শাহবাগের মোড়– প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনটি একটি বারুদের স্তুপে স্ফুলিংগ সংযোগ সূচনায় গড়ে ওঠা ছাত্র-জনতার আন্দোলন । সেখান থেকে গণজাগরণ, গণ বিস্ফোরণটি ঘটে। প্রথমদিকে আন্দোলনটি শুধু কাদের মোল্লার ফাঁসির দাবিতে গড়ে ওঠে। ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট তরুণদের আহ্বানে খুব শিগগিরই এতে ব্যপক সাড়া মেলে; কারণ সচেতন নাগরিকরা কাদের মোল্লার মতো চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী, শীর্ষ জামাত নেতার শুধু যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় মেনে নিতে পারেননি। তরুণরা এই আন্দোলনটিতে পথ দেখালেও শিগগিরই ছাত্র-জনতা সকলেই এতে যোগ দেন; দেশের জেলা শহরগুলোতে তো বটেই, এমনকি উপজেলা পর্যায়েও গণদাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। জনমত তৈরি হয়, শুধু কাদের মোল্লা নয়, সব যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি –ফাঁসির দাবিতে আন্দোলনটি দানা বাঁধে। বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা বাংলাদেশী, বাঙালি ও সমমনারাও খুব শিগগিরই ১৯৭১ এর মানবতা বিরোধী অপরাধ বিরোধী আন্দোলনটির সঙ্গে একাত্নতা প্রকাশ করতে থাকেন। এই নয়া বসন্তের বজ্র নির্ঘোষ হয়ে শাহবাগের চেতনা ছড়াতে থাকে দেশে দেশে।
তথ্য সাংবাদিকতার পেশাগত কারণে একদম শুরু থেকে এখনো আন্দোলনটিকে খুব কাছ থেকে প্রত্যক্ষ করা হচ্ছে। জনে জনে কথা বলে জানা গেছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ার ক্ষোভ ৪২ বছর ধরে এদেশের মানুষ ধারণ করেছেন। তারা গত বিএনপি-জামাত জোট সরকারের আমলে শীর্ষ ঘাতক নেতা নিজামী-মুজাহিদদের মন্ত্রীত্ব দিয়ে পুরস্কৃত করার বিষয়টি বেদনাহত দৃষ্টিতে প্রত্যক্ষ করেছেন। রাজাকারের গাড়িতে স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ার অপমান মুখ বুঁজে সয়েছেন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে চলমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের বিরুদ্ধে বিএনপি-জামাতের গাঁটছড়া বন্ধুত্বের মিথস্ক্রিয়ায় ট্রাইব্যুনাল বিরোধী সীমাহীন মিথ্যাচার, এর বিরুদ্ধে আহুত জামাতি হরতালে দোসর ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাস-নৈরাজ্য-সহিংসতা ভেতরে ভেতরে তাদের ক্ষুব্ধ করেছে। সবশেষ ট্রাইব্যুনালের রায়ে কাদের মোল্লার কাঙ্খিত সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ড না হয়ে শুধু যাবজ্জীবন দেওয়া এবং রায় ঘোঘণার পর কসাই কাদের খ্যাত সাজাপ্রাপ্ত জামাত নেতার গণমাধ্যমে ‘ভিক্ট্রি সাইন’ দেখিয়ে পোজ দেওয়া ছবি তাদের ক্ষেপিয়ে তুলেছে।
০২. কোনো রাজনৈতিক দলের ব্যানারে আন্দোলনটি গড়ে না ওঠায় ‘অরাজনৈতিক’ মঞ্চটিকে সাধারণ মানুষ, চলতি কথায়– যাদের ‘আমজনতা’ বলা হয়, তারা মনে করেছেন, এটি আমার নিজের মঞ্চ, এখানে এসে আমি গণস্বাক্ষর দিতে পারি, শ্লোগানে, শ্লোগানে চিৎকার করে বলতে পারি, বিচার চাই! মোম জ্বালিয়ে ছড়াতে পারি আমার শুভ বুদ্ধির চেতনার আলো। দৃশত্:ই আন্দোলনের প্রধান সারিরা নেতা-সংগঠকরা [এমনকি চলতি লেখকও] যারা ১৯৭১ এর দ্বিতীয় প্রজন্মের, তারা কেউ-ই মুক্তিযুদ্ধটি সরাসরি প্রত্যক্ষ করেননি ঠিকই, কিন্তু তারা বড়োদের কাছ থেকে শুনেছেন, ১৯৭১ সালে কি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ এ দেশে ঘটেছে! তারা বই পড়ে, ভিডিও ফুটেজে, স্থির চিত্রে জেনেছেন, ৪২ বছর আগে ঘটে যাওয়া রক্তাক্ত বাংলার ইতিহাস।
এই প্রজন্ম ‘৭১ এর চেতনায় ১৯৯২ সালে ঘাতক বাহিনী প্রধান, সে সময়ের জামাতের আমীর [চেয়ারম্যান/সভাপতি] গোলাম আজমের বিরুদ্ধে গড়ে ওঠা শহীদ জননী জাহানারা ইমামের গণআদালত একটি বড়ো নাড়া দিয়ে গেছে। তার লেখা অবিস্মরনীয় আত্নজীবনী– ‘একাত্তরের দিনগুলি’, পপ সম্রাট আজম খান ও তার মুক্তিযুদ্ধ…১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে জর্জ হ্যারিসন-রবিশংকের ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির দলিলপত্র ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়?’, তারেক মাসুদ-লিয়ার লেভিনের ‘মুক্তির গান’ প্রামান্যচিত্র, শহীদ চলচ্চিত্রকার জহির রায়হানের ‘স্টপ জেনোসাইড’, অসংখ্য ব্লগ ও ফেসবুক নোট –ইত্যাদিও চেতনায় ছিলো জাগরুক। [১৯৭১: মুক্তিযুদ্ধের কথা]
এক-এগারোর সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক তত্বাবধায়বক সরকারের সময় মুক্তিযুদ্ধের সেনাপতিদের সংগঠন ‘সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরাম’ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জনমত তৈরিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এরই প্রতিক্রিয়ায় আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিতে এই বিচার করার অঙ্গীকারে গত নির্বাচনী বৈতরণী পাড়ি দেয়। সেখানেও মূখ্য ভূমিকা পালন করেছিলো শাহবাগের তরুণরাই, অথাৎ নতুন ভোটার, বয়স ১৮+ ।
চেতনার এই অগ্নি মশালটি এতোটাই দীপ্ত যে, টানা ২০ দিন ২০ রাতের শাহবাগের মোড়, প্রজন্ম চত্বরের গণসমাবেশ-মিছিলে [নিউ ইয়ার্ক টাইমসের মতে, প্রজন্ম চত্বরে গত ১১ ফেব্রুয়ারির মহাসমাবেশটি ছিলো দুদশকের মধ্যে সবচেয়ে বড়ো সমাবেশ] অসংখ্য নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর অংশ নিলেও এতে কোথাও কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। এতো লাখ লাখ মানুষের ভেতরেও মেয়েরা নিরাপদ বোধ করেছেন, বখাটেদের উৎপাত হয়নি তো বটেই, এমনকি একজন পকেটমারও খুঁজে পাওয়া যায়নি। সদ্য কলেজে ওঠা ছাত্রীরা ক্লাস থেকে সরাসরি সমাবেশ-মিছিলে এসে অপটু গলায় ম্লোগান দিয়েছে। তারা এই লেখককে বলেছে, এ জন্য তাদের অভিভাবকদের সম্মতি আছে। শিক্ষকরাও তাদের বলেছেন, তোমরা মিছিলে যাও। এটি হচ্ছে দেশের কাজ। শাহবাগে নতুন করে দেশের ইতিহাস লেখা হচ্ছে, এতে তোমরা অংশ নাও! এর নেপথ্য নায়ক ১৯৭১ পূর্ব প্রজন্ম — অভিভাবক সমাজ, যারা মুক্তিযুদ্ধের ধ্বংসযজ্ঞের জীবন্ত স্বাক্ষী এবং এর অপ্রাপ্তিসমূহের। তারাই বংশ পরম্পরায় অগ্নি চেতনায় শান দিয়ে রেখেছেন; প্রজন্ম চত্বরের শ্লোগানে যেমন বলা হয়েছে: রাজাকারের ক্ষমা নাই/মুক্তিযুদ্ধের শেষ নাই।
অর্থাৎ ১৯৭১ ই চলমান গণজাগরণটির প্রেরণা। এ কারণেই সেখানে লাল-সবুজ পতাকার এতো ছড়াছড়ি। শ্লোগান, গান, কবিতা, বক্তৃতা, কথামালায় ফিরে পুনর্বার উচ্চারিত হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের সময়ের শ্লোগানের টুকরো পংতি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মুক্তির গান এবং অবশ্যই যুদ্ধ জয়ের সেই মহামন্ত্র ‘জয় বাংলা’! মুক্তিযুদ্ধের ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি ১৯৭১ এ সর্ব সাধারণের মুক্তির-শ্লোগান, এমনকি স্বাধীন বাংলার সমর্থক হিসেবে প্রেরণাদায়ী হলেও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে ১৯৭১ এর ইতিহাস দখলের প্রবণতায় ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানটি এতোদিন এককভাবে আওয়ামী লীগের শ্লোগান হিসেবেই ব্যবহৃত হয়েছে। ৪২ বছর পর এই শ্লোগানটি আবার গণজাগরণ মঞ্চের অন্যতম প্রধান শ্লোগান হয়ে, ১৯৭১ এর মতোই ‘জয় বাংলা’ হয়েছে সর্বসাধারণের মুক্তির প্রেরণা, সব দল, সব মত ও সর্বসাধারণের শ্লোগান।
০৩. লক্ষ্যনীয় আন্দোলনটি যে তরুণ ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্টরা সংগঠিত করছেন, তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগ [ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন] এবং বাম দলগুলোর ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফেডারেশনের নেতা-কর্মী। বরং শুরু থেকে এখনো বাম ছাত্র সংগঠনগুলোই এতে মূখ্য ভূমিকা পালন করে আসছেন। ‘শ্লোগান কন্যা’ খ্যাত মূখ্য শ্লোগানিস্টদের একজন [লাকি আক্তার তো বটেই] সকলেই বাম ছাত্র সংগঠনের; এ কারণেই পুরোপুরি দখলের অংশ হিসেবে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের মঞ্চ থেকে বিতাড়িত হলে এর পর পরই ছাত্র ইউনিয়ন নেত্রী লাকি আক্তারকে ছাত্রলীগের গুণ্ডাদের লাঠির বাড়ি খেতে হয় । দখলবাজীর এই চেষ্টা তো চলছেই বিষয়টি আরো তলিয়ে দেখতে এই সংবাদ-বিশ্লেষণটি পাঠ করা যেতে পারে।
চলমান আন্দোলনের বিশ্লেষণে সাবেক সহকর্মী সেরীন ফেরদৌস যথার্থই বলেন, শাহবাগের তারুণ্যের আন্দোলন প্রচলিত বিচার ব্যবস্থার গালে একটি চপেটাঘাত, এমনকি প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর জন্যও। কারণ এই গণজাগরণ বুঝিয়ে দিয়েছে. এদেশের বিচার ব্যবস্থা কতোটি ফাঁপা ও জনবিচ্ছিন্ন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোও তাই। একই সঙ্গে আগামীদিনের নেতৃত্ব তরুণ প্রজন্ম যে সব রাজনৈতিক দলগুলোকে দিক নির্দশনা দিতে সক্ষম — সেটি খুব মোটা দাগেই স্পষ্ট [শাহবাগের তরুণরা যে কথা বলে দিয়ে গেল]। তবে সেরীনের বিশ্লেষণে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো একেবারেই উপেক্ষা করা হয়েছে, তা হচ্ছে, আন্দোলনটি ক্রমেই ‘আর কোনো দাবি নাই/কাদের মোল্লার ফাঁসি চাই’ — এই একদফা থেকে ছয়দফায় পরিনত হওয়া, এর আত্নঘাতি উগ্র জাতীয়তাবাদী চরিত্র এবং এর বিপরীতে ১৯৭১ সালের মতোই ধর্মীয় উস্কানিতে মৌলবাদী আস্ফালন।
বাস্তবত বাম চেতনার প্রবল উপস্থিতির কারণেই স্বতঃস্ফূর্ত গণজাগরণটি খুব দ্রুতই কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীদের ফাঁসির দাবিতে সোচ্চার হয়। ‘ধর্ম নিয়ে রাজনীতি/ চলবে না, বাতিল করো’ বামমতের দাবিটি অভ্যন্তরীন রাজনীতির দর কাষাকষিতে শেষ পর্যন্ত ‘জামাত-শিবিরের রাজনীতি/আইন করে নিষিদ্ধ করো’ দাবিতে ঠেকে এবং এসব নিয়ে মূলত বাম ও ডানের সহাবস্থানে গড়ে ওঠে দৃশ্যমান ছয় দফার যৌক্তিকতা।
প্রথম থেকে শাহবাগের গণজাগরণটি সরকারি দল আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য খুব অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ এটি তাদের সরকারের বিচার ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চরম অনাস্থার বহিঃপ্রকাশ এবং আন্দোলনটি পুরোপুরি তাদের কব্জাকৃত নয়। কিন্তু প্রাচীন দলটি ভোটের রাজনীতিতে এক কদম এগিয়ে বিএনপি-জামাত জোটের চেয়ে। তারা ঠিকই বুঝেছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনটি যুদ্ধাপরাধীদের ঘায়েল করার প্রশ্নে রাজনৈতিক বাস্তবতায় শেষ পর্যন্ত ঘায়েল করবে বিএনপি-জামাত জোটকে, যেটি এক বছর পর অনুষ্ঠেয় নির্বাচনে তাদের জন্য সফলতা বয়ে আনার জন্য খুবই কার্যকরী।
এছাড়া এই গণজাগরণে সমর্থন না দিলে বা একে উপেক্ষা করলে তরুণ ভোটারের [যাদের ভোটেই আওয়ামী লীগের গত নির্বাচনে ভোটের পাল্লা ভাড়ি হয়েছে] আস্থাহীনতা তৈরি হবে, এর নেতিবাচক ফল হবে সুদূর প্রসারী। তাই আন্দোলন পুরোপুরি দখল করতে না পারা বা একে হটিয়ে দিতে ব্যর্থ হওয়ার প্রবল অস্বস্তিসহই প্রধানমন্ত্রী সংসদ বক্তৃতায় বলেন, মন ছুটে যায় শাহবাগে।… গণজাগরণকর্মী, ব্লগার রাজীব হায়দারকে মৌলবাদীরা গলা কেটে খুন করলে তার বাসায় পরিবার-পরিজনকে শান্তনা দিতে ছুটে যান, দুঃখভারাক্রান্ত কণ্ঠে সাংবাদিকদের বলেন, এদেশে জামাত-শিবিরের রাজনীতি করার কোনো অধিকার নাই; আন্দোলনের আরেককর্মী, কার্টূনিস্ট তরিকুল ইসলাম শান্ত সমাবেশে শ্লোগান দিতে দিতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা গেলে প্রধানমন্ত্রী বিবৃতি বলেন, এটি গণজাগরণ আন্দোলনের এক অপূরণীয় ক্ষতি!
স্পষ্টতই গণজাগরণ আন্দোলনের পথ ধরেই সরকার যুদ্ধাপরাধ বিরোধী আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনটি সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছে; এরফলে এখন ট্রাইব্যুনালের রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করা যাবে তো বটেই, এমন কি যুদ্ধাপরাধী দল হিসেবে জামাত-শিবিরের বিচার করাও সম্ভব হবে। এসবই এ পর্যায়ে ছাত্র-জনতার চলমান আন্দোলনের আপাত: সাফল্য। তবে সরাসরি আদেশ/অধ্যাদেশে সন্ত্রাসী দল ও সংগঠন হিসেবে জামাত-শিবিরকে নিষিদ্ধ করতে সরকার খুবই দ্বিধাগ্রস্থ। এটি শুধু দায় এড়ানোর জন্যই নয়; এর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চাপ তো রয়েছেই। অন্যতম ওসি-ওয়ার্ল্ড ব্রিটেন তো জানিয়েই দিয়েছে, তারা মৃত্যুদণ্ডাদেশ ও রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করার বিপক্ষে।
০৪. গণজাগরণের আন্দোলনটি পুরোপুরি সাম্যবাদী চেতনার চেয়ে সংকীর্ন বাঙালি জাতীয়তাবাদী দর্শনকে ধারণ করেই এগুচ্ছে। এ কারণে আন্দোলনে ১৯৭১ এর শ্লোগান ও গান দুইই প্রাধান্য পেলেও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রশ্নে জাতীয়তাবাদী দাপটে প্রায় চাপা পড়ে যেতে বসেছে ভিন্ন জাতির কণ্ঠস্বর। চলমান আন্দোলনে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠি/ আদিবাসীর বিপরীত পাঠটিও নজরে আনা জরুরি। গণজাগরণ মঞ্চগুলোতে বার বার ধ্বনীত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের নানান শ্লোগানের সঙ্গে এই শ্লোগানটি: ‘তুমি কে? আমি কে? বাঙালি! বাঙালি!’ কিন্তু বাস্তবত এদেশ শুধু বাঙালির ও বাংলাভাষাভাষিরই দেশ নয়। ‘বাংলাদেশ’ নামক রাষ্ট্র সৃষ্টি এবং গঠনে মিশে আছে প্রায় ৭৫ টি ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠির রক্ত ও জীবন সংগ্রাম।
১৯৭১ এর ‘তোমার আমার ঠিকানা/ পদ্মা-মেঘনা-যমুনা’ — শ্লোগানটি খানিকটা বদলে এর সঙ্গে ‘মাইনি, কাচালং, সুমেশ্বরী’ নদীকে যুক্ত করার সময় অনেক আগেই এসেছে [নইলে জাতিগত প্রশ্নটি শেষ পর্যন্ত জাগরূকই থাকছে, 'তুমি কে? আমি কে?']। এই রূঢ় বাস্তবতা প্রজন্ম চত্বরের নেতৃত্ব তরুণ সমাজ যত দ্রুত বুঝবেন, ততোই মঙ্গল। নইলে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে আদিবাসী নিপীড়নের যে যাঁতাকলের ঘূর্ণন শুরু হয়, এর মারাত্নক আত্নঘাতি পরিনতিও আবশ্যিকতা মেনে চলতেই থাকবে ['তোরা সব বাঙালি হইয়া যা', শেখ মুজিব, ১৯৭২]।
এই রূঢ বাস্তবতা অস্বীকার করায় আদিবাসীরা গণজাগরণ মঞ্চগুলোতে স্বতঃস্ফূর্তভাবে মিশে যেতে পারছেন না। এ নিয়ে পাহাড় ও সমতলে আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলগুলোতে দেখা দিয়েছে চাপা ক্ষোভ। এর প্রতিবাদে আদিবাসীরা ব্লগ, ফেববুক ও টুইটারে অসংখ্য নোট লিখে ক্ষোভও প্রকাশ করেছেন।
বলা ভালো, ১৯৭১ এর জনযুদ্ধটি শুধুমাত্র বাঙলি জাতীয়তবাদে ভর করে স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিলো না, মুক্তিযুদ্ধ আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব এর নেতৃত্বে থাকলে এটি কোনো একক নেতার বা দলেরও লড়াই ছিলো না, ১৯৭১ ছিলো ছাত্র-জনতা-সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ, ডান-বাম-চরম ও দক্ষিণপন্থা, বাঙালি-আদিবাসী সকলের মুক্তির-সংগ্রাম, জনযুদ্ধটি ছিলো প্রকৃত অর্থেই ‘মুক্তিযুদ্ধ’, যদিও যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মহান মুক্তি সংগ্রামটিকে এককভাবে বাঙালি/বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে পাইকারী বিক্রেতা দল এবং কারো পিতা বা স্বামীর একক কৃতীত্ব হিসেবে জাহির করার আপ্রাণ চেষ্টা বরাবরই চলছে।১৯৭২ এ সংবিধান রচনার কালে ঐতিহাসিক মুজিবীয় উক্তিটি আবার একই সঙ্গে উগ্র জাতীয়তাবাদী দর্শনকে ধারণ করে, যার শেকড় ফ্যাসিবাদ তথা মৌলবাদে গাঁথা [যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মুজিবের দুঃশাসন এবং পরবর্তী শাসকগোষ্ঠিগুলো এখনো এই দর্শনবলেই পরিচালিত]।
মুজিবীয় ওই দর্শনটি আবার একই সঙ্গে অস্বীকার করে ১৯৭১ এর অসাম্প্রদায়ীক- বৈষম্যহীন দেশগড়ার মুক্তিযুদ্ধের চেতনা; যে চেতনায় ভাষাগত/ধর্মীয় সংখ্যালঘু – সংখ্যাগুরু, আদিবাসী ও বাঙালি স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম, বাংলা নামক ভূখন্ডের সবচেয়ে গৌরব গাঁথা মুক্তিযুদ্ধটিকেই। এ কারণে সে সময়ই কিংবদন্তী পাহাড়ি নেতা এমএ নলারমা বাংলাদেশের খসড়া সংবিধান রচনার কালে সেখান থেকে আদিবাসী/উপজাতিদের বাদ দিয়ে শুধু “বাঙালি” জাতীয়তাবাদী ঝান্ডা ওড়ানোর প্রতিবাদ করেন।
৬০ দশকে কাপ্তাই জলবিদ্যুত নির্মাণে পার্বত্য চট্টগ্রামকে পানিতে তলিয়ে দিয়ে ও প্রায় এক লাখ মানুষকে উদ্বাস্তু বানানো, ১৯৭১-৭২ সালে কতিপয় বিপথগামী মুক্তিযোদ্ধা ও বিডিআর-এর পাহাড়ে চালানো হত্যাযজ্ঞ [এখন বিজিবি] এবং মুজিব সরকারের বহু ভাষা ও বহু জাতির সাংবিধানিক স্বীকৃতির দাবি নাকচের পর এমএন লারমা বাকশালে যোগদানের ঐতিহাসিক ভুলটুকু শুধরে নিয়ে বাকশাল সরকারের চরম স্বৈর শাসনের বিরুদ্ধেই সংগঠিত করেন গেরিলা গ্রুপ শান্তি বাহিনী; এই গ্রুপের গেরিলা যুদ্ধ চলে প্রায় আড়াই দশক। [সংবিধানে "বাঙালি" জনিত প্রেক্ষাপটটি এখনো অব্যহত থাকায় ভিন্ন মাত্রায় প্রতিবাদটি চলছেই]।
["তোরা সব বাঙালি হইয়া যা"] দর্শন বলেই জে. জিয়া পাহাড়ে সেটেলার বন্যার খোয়াব দেখেন, পার্বত্য চট্টগ্রামকে বানান — আ ল্যান্ড অব দা প্যারেড গ্রাউন্ড ["মানি ইজ নো প্রবলেম"], এরশাদ এবং খালেদা-হাসিনা-খালেদা-মইন/ফখরুদ্দীন-হাসিনা একই ধারাবাহিকতায় খোয়াবের সফল বাস্তবায়ন করে চলেন। এর নীট ফলাফল অতি অবশ্যই মুক্তিযুদ্ধটিকে বাঙালি-আদিবাসীর যৌথ মুক্তি সংগ্রামকে অস্বীকার, ১৯৭২ এর সংবিধানে আদিবাসী/উপজাতিকে উপেক্ষা [দ্র. গেরিলা নেতা এমএন লারমা ] , জেনারেল জিয়া-এরশাদ-খালেদা-হাসিনা-খালেদা-মইন+ফখরুদ্দীন-হাসিনার সরকার আমলে পার্বত্য চট্টগ্রামকে সেটেলার বাঙালি-সামরিক জান্তার পাকিপনার ভূখন্ডে পরিনত করা; তারই জের টেনে শান্তিচুক্তি পূর্ব পাহাড়ি জনপদে অন্তত ১৩ টি বড় ধরণের গণহত্যা, বাস্তভিটা থেকে উচ্ছেদ করে প্রায় ৬০ হাজার পাহাড়ি শরণার্থীকে এবং শান্তিচুক্তি পরবর্তীতে গত দেড় দশকে সংগঠিত হয় অন্তত ১৪ টি সহিংস হামলা [কিছুদিন আগের রাঙামাটি সহিংসতার ঘটনাও কী তার সাক্ষ্য দেয় না?] এই প্রেক্ষাপটেই পাহাড় ও সমতলে ভাষাগত/ধর্মীয় সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে গত চার দশক ধরে রক্ত ঝরছেই, আগুন জ্বলছেই।
অন্যদিকে, ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা [এমনকি মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাইকারী বিক্রেতা আ'লীগের] সংশোধিত সংবিধান এখন পরিনত হয়েছে ধর্মনিরপেক্ষতা+বিসমিল্লাহসহ গজকচ্ছপ সুন্নাহর দলিলে। …এ পর্যায়ে বাঙালির উগ্র জাত্যাভিমান নামক বিষফোঁড়ার জরুরি অস্ত্রপচার প্রয়োজন। নইলে জাতীয়তাবাদী বেদনার উপশম নেই। এর অভাবে বিষফোঁড়ার বিষাক্ত রক্ত-পুঁজ ভাষাগত সংখ্যালঘু জনজাতি তথা আদিবাসী জীবনকে দূষিত করেই চলবে ['বাঙালিরাই এ দেশের আদিবাসীঁ/উপজাতীরা বহিরাগত, দেশে কোনো আদিবাসী নেই', দীপু মনি, পররাষ্ট্র মন্ত্রী ২০১১।]।
শেষ পর্যন্ত আদিবাসী নেতা-নেত্রীরা ঢাকায় পৃথক মিছিল করে গণজাগরণ মঞ্চে এসে বক্তব্য দিয়ে নিজেদের পৃথক অস্তিত্ব ও আন্দোলনের সঙ্গে সংহতির কথা জানান দিতে বাধ্য হয়েছেন। সাংবাদিক সহকর্মী সাথী চাকমা নিজের অস্তিত্বের পৃথক অবস্থান তুলে ধরে এটিএন নিউজ প্রধান মুন্নী সাহার বিরুদ্ধে ফেসবুকে লিখতে বাধ্য হয়েছেন এই নোট:
Well dear #MUNNI SAHA didi, you are wrong. #Santu larma or #me or #Mukta Baroi None of us are Bengali. We belong to other nations but within this beautiful country’s boundary.
You mentioned about the slogan of Liberation War but you forgot to mention honorable #MN Larma’s walk out from the Parliament in 1972 when in this very independent country the first government wanted to make us #BENGALI forgetting our distinct identity and rich culture.
I am a bit hurt after seeing your this interview after all, I grow up reading your stories and articles. Please be a little more empathetic.
Best regards.
০৫. পর্যবেক্ষক সাংবাদিকরা আগেই ধারণা করেছিলেন, অন্তিম সময়ে জামাত-শিবির ১৯৭১ এর কায়দায় আবারো মরণ কামড় দেবে। এই আশঙ্কাটিই সত্যি হয় সারাদেশে মহান একুশে ফেব্রূয়ারি পালনের পরদিনই গত ২২ ফেব্রুয়ারি, শুক্রবার। জুম্মার নামাজ আদায় করতে না করতেই জাতীয় মসজিদ বায়তুল মোকাররমসহ দেশের বিভিন্ন মসজিদ থেকে ১১ টি ইসলামী গোষ্ঠি ‘তওহীদি জনতা/হেফাজতে ইসলাম’ ইত্যাদি ব্যানারে ব্লগার, তথা প্রজন্ম চত্বরের গণজাগরণ বিরোধী জেহাদী মিছিল বের করে। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, বগুড়াসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে তাদের জেহাদী বিক্ষোভ দেখা গেছে। সিলেটে শহীদ মিনার জামাতী হামলায় একজন নিহত হয়। সেখানে অবমাননা করা হয় শহীদ মিনারে। চাঁদপুরে জাতীয় পতাকা ছিঁড়ে এতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়।
এরই মধ্যে রাজশাহী ও বগুড়াতে গণজাগরণ মঞ্চ পুড়িয়ে দেওয়ার কথা জানা গেছে। শুধু ঢাকাতেই অন্তত ১৫ জন সাংবাদিক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে সাতজনের অবস্থা গুরুতর। এতোদিন জামাতিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে জেহাদী আক্রমণ চালালেও শুক্রবার তাদের ক্ষোভের শিকার হয়েছেন মূলত সাংবাদিকরা। চট্টগ্রামে আহত হয়েছেন অন্তত তিনজন।
প্রত্যক্ষদর্শির বয়ানে ঘটনার সংক্ষিপ্ত বিবরণ, অনেকটা এরকমঃ
বেলা পৌনে একটার দিকে বায়তুল মোকাররম উত্তর গেটের দিকে মসজিদের ভেতর থেকে জেহাদীরা রাস্তায় অবস্থান নেওয়া পুলিশের দিকে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। মসজিদের কাছে জেহাদীরা মারধর করে মাছরাঙা টেলিভিশনের সিনিয়র রিপোর্টার আব্দুল্লাহ তুহিন ও এটিএন বাংলার ক্যামেরাম্যান ইমরান তুহিনকে। নামাজের শেষে জেহাদীরা শাহবাগের গণজাগরণ লক্ষ্য করে এগুতে থাকে। তোপখানা রোডে ওয়ার্কার্স পার্টির কার্যালয়ের সামনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে তৈরি তোরণ ভাংচুরও করে তারা। পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে। ইটপাকেলের জবাবে পুলিশ দফায় দফায় টিয়ার ও রাবার শেল ছোঁড়ে। মৎসভবনের কাছে জেহাদীদের ছত্রভঙ্গ করতে সক্ষম হয় পুলিশ। সংঘর্ষ চলাকালে সাবাদিক, পুলিশ, পথচারীসহ বেশ কয়েকজন আহত হন। এদের মধ্যে একাত্তর টিভির ক্যামেরাম্যান আরিফুজ্জামান পিয়াস, গাজীটিভির মাসুদুর রহমান এবং আরিফুর রহমান হীরা, আল-আমিন ও হাসান নামের পাঁচজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তি করা হয়।
চট্টগ্রাম থেকে এটিএন নিউজের বিশেষ প্রতিনিধি, সহকর্মী সমরেশ বৈদ্য টেলিফোনে জানান, চট্টগ্রামে বাছাই করে তিনজন সাংবাদিককে লাঞ্ছিত করেছে। অ্যাকশনে অংশ নেওয়া সকলেই জামাতের চিহ্নিত ক্যাডার। এই জেহাদী মিছিলে কওমী মাদ্রাসার ছাত্ররা ব্যপক মাত্রায় অংশ নেয়। জেহাদীরা চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবেও ভাঙচুর চালায়। তার ভাষ্য মতে, সাংবাদিকরা যেহেতু শুরু থেকেই গণজাগরণটিকে সক্রিয় সমর্থন দিয়ে আসছে, টিভি ও সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রচার হচ্ছে দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ-চিত্র, তাই তারা বিকৃত ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সাংবাদিকদের ওপর হামলা করে।
ঢাকার একজন সহ সংবাদিক জানান, কাওরান বাজারে জুম্মার নামাজের পরেই জেহাদী মিছিল বের হয়। সেখানে ওয়াজ বা খুতবায় কোনো উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়া না হলেও, নামাজ শেষে হতেই মুখচেনা স্থানীয় জামাতি ক্যাডাররা ‘শাহবাগে ইসলাম বিরোধী বেদাতী কাজ-কারবার চলছে। আসেন, সবাই ইসলাম রক্ষার মিছিলে আসেন’– এরকম আহ্বান জানালে সাধারণ মুসুল্লীরাও মিছিলে অংশ নেন। মিছিলের সামনের দিকে নেতৃত্ব দেয় জামাতি কাড্যাররা।
দেশের অন্যান্য স্থান থেকে পাওয়া একই রকম ভাষ্য ও পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওই অ্যাকশনে মোল্লাদের সঙ্গে মিশে মূল উস্কানিদাতা হিসেবে কাজ করে জামাত-শিবিরের ক্যাডাররাই। এরই জের ধরে গত ২৪ ফেব্রূয়ারি জেহাদী হরতালে শুধু মানিকগঞ্জেই পুলিশ-পিকেটার সংঘাতে নিহত হন চারজন।
জুমার নামাজের পর পরই হয়ে যাওয়া ‘তওহিদী জনতা’র ছদ্মবেশে জামাত তান্ডব চালানোর চেষ্টাটি প্রকাশ্যেই লিফলেট দিয়ে প্রচার করে আসছিল। জামাতের এখন ল্যাঞ্জার ঘায়ে কুত্তা পাগল দশা। যুদ্ধাপরাধ বিরোধী সারাদেশে তো বটেই বিশ্ব ব্যাপী অভুতপূর্ব গণজাগরণে তাদের অস্তিত্ব রক্ষার প্রশ্নটিই এখন তাদের জন্য ফরজে আইন। এ কারণেই তারা গণজাগরণের বিপরীত অবস্থানে ধর্মকে দাঁড় করিয়েছে। এ নিয়ে সাবেক বিএনপি-জামাত সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা, বর্তমান দৈনিক আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান একের পর এক গণজাগরণ বিরোধী ফতোয়া প্রচারের কাজ করে চলেছেন।
ফেসবুকে অসংখ্য ফেক আইডি থেকেও জেহাদী জোশ উস্কে দেওয়ার চেষ্টা করছে জামাত-শিবির চক্র। কায়দাটি ১৯৭১ এর মতোই, ‘পাক সার জমিন সাদ বাদ’ গর্ভজাত। মিথ্যাচারের কবল থেকে আন্দোলনের শহীদ ব্লগার রাজীবও রেহাই পাননি।
যুদ্ধাপরাধ বিরোধী ট্রাইব্যুনাল বন্ধ না হলে ‘দেশে গৃহযুদ্ধ বাঁধবে’ হুমকি-ধামকির পর ‘তওহিদী জনতা’ এখন শাহবাগকে ট্রার্গেট করে রাষ্ট্রপতির বাসভবন ও কার্যালয় বঙ্গভবন ঘেরাও করার হুমকি দেওয়ারও দুঃসাহস দেখাচ্ছে!
জামাতি ল্যাঞ্জাটি ফাঁদে আটকা পড়ার গোমড়টি ফাঁস করে গণজাগরণ আন্দোলনের প্রধান সংগঠক, ব্লগার ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট নেটওয়ার্কের আহ্বায়ক ডা. ইমরান এইচ. সরকার যেমন বলেন:
আমরা প্রথম থেকেই কাদের মোল্লাসহ সব যুদ্ধাপরাধীর ফাঁসি এবং ইন করে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধের দাবিতে আন্দোলন করছি। জাতীয় সংসদের স্পিকারকে আমরা যে ছয় দফা দাবিসহ স্মারকলিপি দিয়েছি, সেখানেও একই দাবি করা হয়েছে। মহাসমাবেশেও এই ছয় দফা ঘোষণা করা হয়েছে। ১৯৭১ সালে তো বটেই, এমনকি স্বাধীন দেশে জামায়াত-শিবির কি নৃশংস কায়দায় হত্যা, সন্ত্রাস, রগকাটার রাজনীতি করে আসছে, তা দেশের মানুষ দেখছে। তাই আমাদের দাবি, যুদ্ধাপরাধীদের সর্বোচ্চ শাস্তি, অর্থাৎ ফাঁসি দেওয়ার পাশাপাশি যুদ্ধাপরাধী, ঘাতকদের দল জামায়াত-শিবিরকেও নিষিদ্ধ করা। বিশ্বের যেসব দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা হয়, সেসব দেশে তাদের রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকে না। তাই স্বাধীন দেশে একাত্তরের ঘাতক ও যুদ্ধাপরাধীদের দল জামায়াত-শিবিরেরও রাজনীতি করার কোনো অধিকার থাকতে পারে না বলেই আমরা মনে করি।
০৬. বটম লাইনে: যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে রাজাকারদের যে বিষঝাড় সমূলে উৎখাত করা যায়নি, সেই অসমাপ্ত কাজটি সমাপ্ত করার দায়িত্বই এখন দ্বিতীয় প্রজন্মের মুক্তিযোদ্ধারা কাঁধে তুলে নিয়েছেন। এখান থেকে তাদের ফেরার আর কোনো পথ নেই। অন্যদিকে, সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি, পরে ছাত্রলীগ কর্তৃক বিশ্বজিৎ হত্যার বিচারে ব্যর্থতা, শেয়ার বাজার, রেলওয়ে, পদ্মা সেতু ও হলমার্ক কেলেঙ্কারী, চাল-ডাল-তেলের দাম লাগামহীনভাবে বৃদ্ধি, তেল-গ্যাস-বিদ্যুত বিলের উর্দ্ধমূখিতাসহ গত চার বছরে আরো নানান সব গুরুতর বিষয়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন সরকারের সীমাহীন ব্যর্থতা ও তাবৎ দুর্নীতি-কেলেঙ্কারি ধামাচাপা দিয়ে নির্বাচনী বৈতরণীটি আবারো পাড়ি দিতে এবারো যুদ্ধাপরাধীদের বিচারই সম্ভবত শেষ ট্রাম্প কার্ড [৪২ বছরের ইতিহাসে এই প্রথম সরকার নিয়ন্ত্রিত বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতারে প্রচার হচ্ছে গণজাগরণের, অর্থাৎ ছাত্র-জনতার আন্দোলন!]। এখন বিদেশী প্রভু, দাতা গোষ্ঠি ও জলপাই বাহিনীর পরামর্শে সরকার ট্রাম্প কার্ডটি কতোটুকু ও কি মাত্রায় ব্যবহার করবে, সেটিই দেখার বিষয়। চলমান আন্দোলনটির এক্সিট রুটও হয়তো অনেকটাই এর নিয়ন্ত্রক শক্তি হিসেবে কাজ করবে।
মুক্তমনায় প্রকাশিত