6
‘স্বপন যদি ভাঙিলে’
আগের সেই টিনের চাল আর চাটাইয়ের বেড়া নেই, থাকার কথাও নয়। প্রায় আটচল্লিশ বছর , কম কথা নয়।
পিচের রাস্তা আর তার পাশে ফুটপাথ ঘেঁষে কালো হলুদের বর্ডার। অধিকাংশ বাড়ি পাকা।
বিজনদার বাড়ি শেষ কবে এসেছিলাম? ওর ছোড়দির বিয়েতে। আমরা প্রায় পনের জন, পনের অশ্বারোহী।
তার মধ্যে দুজন মেয়ে। একজন বিবাহিত। আমার সেলের কম্যান্ডার ও তার বৌ।
আমার সেলের প্রশান্তর আলগা মুখ।
একবার সেল মিটিংয়ে কম্যান্ডারকে বলে দিল-- নিজে তো পার্টনার পটিয়ে নিলে, আমাদের খালি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখাচ্ছ? আমাদের কী হবে?
--- বিপ্লবে প্রেম করা মানা নাকি? আমরা কি আনন্দমঠের সন্ন্যাসীর দল!
-- তা কই? আমাদের পার্টনার কই?
-- রিক্রুট কর। আমার বউ তো আমার রিক্রুট।
--উঁহু, মেয়েদের রিক্রুট করা বহুত ঝামেলি। সুশান্তকে জিগাও।
সেদিন লাজুক মুখচোরা সুশান্ত মুখ খোলেনি। কিন্তু বিয়েবাড়িতে সবার পেড়াপেড়িতে একরকম নিমরাজি হল।
-- আমি কিছু বলব না। প্রশান্তই বলুক। ওই আমাকে ডুবিয়েছিল।
সে কী?
-- বলছি বলছি। সুশান্ত প্রেমে পড়ছিল, পাড়ারই মেয়ে। পাঁড় কংগ্রেসি বাড়ি।
আমার কাছে এসে কিন্তু কিন্তু করে বলে ফেলল।
ব্যস্, আমি ওকে গাইড করতে লাগলাম। বললাম-- প্রেমে পড়ে বিপ্লবকে ভোলা চলবে না।
সলিউশন? কংগ্রেসি বাড়ির মেয়েকে রিক্রুট করে কমিউনিস্ট বানাতে হবে।
মায়াকোভস্কি বলেছেন-- প্রিয়ার গোলাপি ঠোঁটে চুমু খাওয়ার সময়েও যেন রিপাব্লিকের লাল পতাকা পতপত করে উড়ছে দেখতে পাই।
প্রশান্ত আমার কথা মত কাজ করতে লাগল। বিপ্লব বোঝাল, শ্রেণীসংগ্রাম বোঝাল, কৃষিবিপ্লবও বুঝিয়ে ফেলল।
শেষে যখন ওকে দলে আসতে বলল তখন মেয়েটি বলল যে তোমরা ছেলেরা কত স্বাধীন,সন্ধ্যের পরে দেরি করে ফিরলেও বাড়িতে কিছু বলে না।
আমরা মেয়েরা কী আর করতে পারি বল?
সেদিন ওই মুখচোরা সুশান্তের জিভে দুষ্টু সরস্বতী ভর করেছিলেন। তারপর কানে আমার ফুসমন্তর!
ও অনায়াসে বলল-- বেশি না, একটা কাজ তো করতে পারিস! কিছু না হোক আমার মত গোটা কয়েক বিপ্লবী তো পয়দা করতে পারিস।
তারপর কী হইল জানে শ্যামলাল।
তখন খাসির মাংস পাতে পড়েছে।
বিজনদাকে চিনতে একটু কষ্ট হল।
ছ'ফিট লম্বা একটু মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখে এক্ধরণের একরোখা ভাবটা এখন অনেক নরম, কারণ সামান্য মেদ জমেছে।
একমাথা কোঁকড়ানো চুলের জায়গা দখল করেছে এক মরুভূমি।
সেই ছিপছিপে ছিলেটানা-ধনুক ভাব উধাও, সকাল-সন্ধে মুখবুজে টিউশন করতে করতে একটু নুয়ে পড়েছে পিঠ।
কিন্তু হাসিটা আগের মতই প্রাণখোলা। তবে ঝক্ঝকে দাঁতে আগের মত নিকোটিনের ছাপ নেই।
চারমিনার কি বাজার থেকে উধাও হয়ে গেছে? নিদেনপক্ষে পানামা?
বিজনদা কি আজকাল নিয়মিত ডেন্টিস্টের কাছে যায়?
আগে তো ডেন্টিস্টের কাছে গিয়ে দাঁত চক্চকে করা, বিউটি পার্লারে গিয়ে রূপটান-- এসব তো বুর্জোয়া অবক্ষয়ের লক্ষণ ধরা হত।
খেটে খাওয়া মানুষদের লড়াইয়ের রাস্তা থেকে সরিয়ে নিয়ে ব্যক্তিগত সৌন্দর্যের নার্সিসিজমে বেঁধে ফেলার ডেকাডেন্ট কালচারাল কনস্পিরেসি!
সবাই কেমন বিশ্বাস করত যে যারা বিউটি পার্লারে কাজ করে বা সেখানে ক্লায়েন্ট হয়ে যায় তাদের চরিত্র সন্দেহজনক।
তবে বিজনদা ছিল ওদের মধ্যে সবচেয়ে পিউরিটান।
কোন আঁশটে চুটকি বা কমেন্ট, অভিধান-বহির্ভূত শব্দের ব্যবহার একেবারে সহ্য করতে পারত না।
রেগে গেলেও কারও মা-বাপ তুলত না।মেয়েদের মাল বা গুল্লি বলা মানে প্রচন্ড ধমক খাওয়া।
আর মাগী শব্দ মুখ থেকে বেরোলে হাতাহাতি হবার সম্ভাবনা।
আঠেরো বছর বয়সের রমেন একবার পথে একজন গর্ভবতী মহিলাকে দেখে বলে উঠেছিল
-- দেখেছেন, ওর না নিচের তলায় ভাড়াটে এসেছে।
দুজন সঙ্গী হ্যা-হ্যা করে হেসে উঠতে গিয়ে দেখল বিজনদা ওর কলার মুচড়ে ধরে ঝাঁকাচ্ছে
-- শালা! তোর লজ্জা করে না? অপদার্থ! তুই ওদের থেকে আলাদা কিসে?
বিজনদা এগিয়ে এসে দুহাতে জড়িয়ে ধরেছে রমেনকে।
--- কী রে! আমাদের ভুলে গেছলি? আর আমরাও তো--।
রমেন কোন কথা বলে না, শুধু হাসতে থাকে। শংকর এগিয়ে এসে বলে --- ওঃ, আবেগের দুধ উথলে উঠেছে।
ওকে ছেড়ে দাও , অনেক কথা আছে। আগে তোমার ছাত্রছাত্রীদের ছুটি দাও।
গোটাদশেক ছেলেমেয়ে চটপট খাতাবই ঢাউস ব্যাগের মধ্যে ঢুকিয়ে ফেলে। বিজনদা রোববারের দিন এটা পুষিয়ে দেবে বলে আশ্বাস দেয়।
শংকর বিজনদার থেকে একটা সিগ্রেট চেয়ে নিয়ে ধরিয়ে ফেলে।
আমি আপত্তি জানাই; ওর বারণ আছে। ধোঁয়া গিলে কার কি উবগার হবে শুনি?
--কার বারণ, বৌয়ের? সেটা ঘরের মধ্যে। ঘরের বাইরে একটু অবাধ্য না হলে চলে?
---হ্যাঁ, হ্যাঁ; ঘরের মধ্যে অসভ্য আর ঘরের বাইরে অবাধ্য।
আমি চমকে উঠি। এই রে, বিজনদা ঝাড় দিল বলে। কিন্তু বিজনদার ঝকঝকে দাঁতে অমলিন হাসি।
শংকরের দিকে তাকাই।
ও চোখ টিপে একটা ভঙ্গী করে বলল--চাপ নিস না, বিজনদাও লাইনে এসে গেছে।
একটু অস্বস্তি নিয়ে জিজ্ঞেস করি-- তো তুমি ঘরের মধ্যেই অবাধ্য কেন?
বৌদি সিগ্রেট খাওয়া প্যাসিভ স্মোকিং নিয়ে কিছু বলে না?
বিজনদা উত্তর না দিয়ে আরও জোরে হেসে ওঠে।
আমি ভ্যাবাচাকা। পালা করে দুজনের মুখের দিকে তাকাই।
--- না রহেগা বাঁশ, ন বজেগী বাঁসুরী!
--বুঝলি না ভ্যাবাগঙ্গারাম! বিজনদা বিয়েই করে নি।
--ও!
--মানে করে নি বললে ঠিক হবে না, বলা উচিত দ্বিতীয়বার করে নি।
--আচ্ছা, প্রথমবারটা কবে?
--- সেই যে রে! বিজনদার প্রথম রিক্রুট?
---তপতীদি! উনি এখন কোথায়?
বিজনদা বাইরের দিকে তাকায়, আবার একটা সিগ্রেট ধরায়।
ঘরের ঘুলঘুলিতে দুটো চড়াই পাখি ঘর বাঁধছে। কিচিরমিচির। গোটা কয়েক খড়কুটো এসে আমার গায়ে মাথায় পড়ে।
বিজনদা পরম মমতায় সেগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দেয়। ওর হাত আমাকে ছোঁয়, খানিকক্ষণ ছুঁয়ে থাকে।
ভাবি, কোলকাতায় এখনও চড়ুইদের দেখা পাওয়া যায়!
আমি জল চাইলাম , বিজনদা উঠে ভেতরে গেল।
-- এই শালা! চটপট বলে ফ্যাল দিকি , কিসের কেলো?
--- বিজনদা তখন পুরুলিয়া থেকে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে এসেছে। পার্টির শেলটার-ফেলটার ভেঙে ছত্রখান।
যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। আগের সমর্থকরা কেউ আর আমাদের মাথা গোঁজার জায়গা দিচ্ছে না। কাউকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না।
বেলেঘাটায় পুলিশের ঢোকানো মোলগুলো মুখোস পরে অ্যাকশন স্কোয়াডের ছেলেদের ধরিয়ে দিল।
তপতীদি অন্য একটা উপদলে যোগ দিয়ে আমেরিকান লাইব্রেরিতে বোম ফাটিয়ে কাঁচ ভাঙল।
একবার ধরা পড়ে বেইল জাম্প করল।
-- বেইল পেয়ে গেছল? কী করে?
--তখন পেটে ছ'মাসের বাচ্চা।তাই কোন বুড়ো সি জে এম--!
আমি ছটফট করি, উল্টোপাল্টা বকবক করতে থাকি।
-- আচ্ছা, পেটে বাচ্চা এল কেন? একটু সতর্ক হলে--।
--তুই কি বুঝবি রে আবাল!
তুই তখন শান্ত ছত্তিশগড়ে বসে বাপের হোটেলে খাচ্ছিস দাচ্ছিস আর ইডিওলজিক্যাল কনফিউশন মারাচ্ছিস।
আমি হাসি। সে তো এখনও মারাচ্ছি। কিন্তু ওদের কি তখন "চার আনায় তিনটে" কেনারও পয়সা ছিল না?
-- এটা একেবারে বোকা-দার মত বললি। আরে তখন তো আমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ে বিশ্বাস করতাম না।
মাও নিজে লং মার্চের সময় ফ্যামিলি প্ল্যানিং করেন নি। আর ভাবতাম এসব গরীবদের মূল সমস্যার থেকে চোখ সরিয়ে দেওয়ার সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত।
তর্ক করতাম--মানুষ শুধু পেট নিয়ে জন্মায় না, হাত-পা ও মাথা নিয়ে জন্মায়।
তখন যদি কোন শালা বলত --
খোদ মাওয়ের চীনে সত্তরের দশকে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের নির্দেশে একাধিক বাচ্চা হলে প্রমোশন ইনক্রিমেন্ট আটকে দেওয়া হচ্ছে তো--।
--সে শালার গুষ্টির তুষ্টি করে ছাড়তাম। সে ঠিক আছে, তারপর কী হল?
-- তপতীদি এ বাড়ি সে বাড়ি ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে এমনকি নিজের মা-ভাইদের থেকেও রূঢ় ব্যবহার পেয়ে বদলে গেল।
বিধবা সেজে উত্তরবঙ্গে একটা মাস্টারি যোগাড় করে চলে গেল। বিজনদার সঙ্গে কোন সম্পর্ক স্বীকার করে নি।
আমি কী বলব বুঝতে পারি না।
ঠিক এইসময় বিজনদা একটা থালার ওপর তিনকাপ চা দুটো লেড়ো বিস্কুট আর একগ্লাস জল নিয়ে ঢুকল। কী টাইমিং!
আচ্ছা, আড়াল থেকে আমাদের কথাবার্তা শুনছিল নাকি!
আমি চায়ে চুমুক দিতে দিতে পুরনো দিনে ফিরে যাই।
বিজনদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় কবে যেন?
হ্যাঁ, ১৯৬৭ সালের মে দিবস। বিজয়গড়ের থেকে মিছিল বেরোবে শুনে জুটে গেছি।
তখন হায়ার সেকেন্ডারির ফল বেরোতে মাস দেড়েক বাকি। পুরোদমে টো টো করে ঘুরে বেড়ানো আর চারমিনার ফোঁকা চলছে।
দুটো পায়জামা আর দুটো পাঞ্জাবী বানিয়েছি-- একটা গেরুয়া আর একটা কচি আমপাতা রঙের।
পরে বেরোলে এখানে ওখানে আড্ডা দেওয়া উদ্বাস্তু কলোনীর দুরন্ত মেয়েরা আওয়াজ দেয়-
দেখ দেখ, একজন নতুন কমরেড যাচ্ছে। কেউ কেউ পেছন থেকে কমরেড বলে চেঁচিয়ে ভালোমানুষ মুখ করে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকত।
ভালো যে লাগত সে নিয়ে কোন কথা হবে না।
সেই মিছিল।
বিজয়গড় এর একটি সাংস্কৃতিক চক্রের ছেলেরা মোড়ে মোড়ে ভ্যানরিকশায় চড়ানো মাইক নিয়ে সলিল চৌধুরির গান গাইছে -- আয় রে পরাণ ভাই, আয় রে রহিম ভাই।'
গানটা প্রথম শুনলাম।
তাতে কালো-নদীর-বান রোখার আহ্বানে বুকের মধ্যে কেমন করে উঠল। ছোটবেলায় পার্কসার্কাস পাড়ায় দেখা দাঙ্গার পরিবেশের ছবি ভেসে উঠল যেন।
সেখানে তানুদা পরিচয় করিয়ে দিল পায়জামা ও সবুজ পাঞ্জাবী পরা অসম্ভব ফরসা বিজনদার সঙ্গে।
তারপর ঘনিষ্ঠ হয়ে দেখেছি কিরকম ঘোর সংসারী বিজনদা। তখন চাল দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য।
তখনও গলি গলিতে হাতরুটি বেলে বেলে মহিলারা বিক্কিরি করতেন না। আসলে বাঙালী তখনও রুটিকে শুধু জলখাবারের যোগ্য মনে করত।
চালের কর্ডন জেলায় জেলায়। র্যাশনের চাল মুখে তোলা কঠিন।
দাদা তখন সাইকেল করে গড়িয়া-নরেন্দ্রপুর পেরিয়ে রাজপুরের বাজার থেকে প্রতিকিলোয় কুড়ি নয়া পয়সা কম দরে চাল কিনে আনত।
সেই বিজনদা একদিন মা-বাবা-ভাই-দিদিকে ফেলে কিভাবে বিপ্লবের স্বপ্নে নিশির ডাকে সাড়া দিয়ে অনন্ত সিংয়ের ডাকাতির দলে ভিড়ে গেল সেটা এক রহস্য।
নিজে গেল তো গেল, আমাদের মত আরও কয়েকজনকে নিয়ে গেল যে!
-- অ্যাই বিজনদা, এ শালাকে একটু বোঝাও তো!
চল্লিশবছর দন্ডকারণ্যে বনবাস করে ওর ঘিলু কেমন ভসকিয়ে গেছে, সোজা কথাও বুঝতে পারছে না।
বিজনদার মুখে প্রশ্রয়ের হাসি।
--কী, হয়েছেটা কী?
-- প্রথমতঃ আমি কোন বনবাসে ছিলাম না, ছত্তিশগড়ের স্টিল সিটি ভিলাই কি বনজঙ্গল? দ্বিতীয়তঃ--
-- চোপ্ শালা! দন্ডকারণ্য কি ছত্তিশগড়ে নয়?
দ্বিতীয়তঃ আমাদের ইংরিজির মাস্টারমশায় দীনেনস্যার যে গণ-আদালত বসিয়ে চারটে ছেলেকে মৃত্যুদন্ড দিয়েছিলেন, সেই যে পদ্মপুকুর মাঠে গো,
আর আমাদের অনেকের নামে খেলার মাঠের মারপিট নিয়ে মিথ্যে এফ আই আর করেছিলেন--সেটা ও কিছুতেই বিশ্বাস করছে না।
-- কেন?
--- ব্যাপারটা মেলে না, মানে ওঁর মাইন্ডসেটের সঙ্গে খাপ খায় না।
-- ওরে আমার সাইকোলজিস্ট রে! হুঁ, মাইন্ডসেট!
সব ব্যাপারে বাতেলার অভ্যেসটা এখনো যায় নি।
--- সে তো তুই, বিজনদা সবাই।
--- কোথায় খাপ খুলছিস ? বিজনদা দশবছর আগে সাইকোলজিতে মাস্টার্স করেছে, ইগনু থেকে।
আবার ডিজার্টেশনের বিষয় নিয়েছিল-প্যাসিভ অ্যাগ্রেসন সিনড্রোম। বুঝলি?
তুমি বল বিজনদা।
--- হ্যাঁ, তোর খুব খারাপ লাগছে রমেন, কিন্তু কথাটা সত্যি। আমি তখন এদিকেই ছিলাম।
-- হল তো! আমরা সবাই ছিলাম, উনি ছিলেন না, তবু এঁড়ে তক্কো।
আমার ঠাকুমা বলতেন-- রেখে দে তোর দেখা কথা, আমি শুনে এলাম।
---কিন্তু বিজনদা, এটা কী করে হয় ?ওঁর মত শান্ত ব্যক্তিত্বের একজন নিরীহ মানুষ--।
উনি সিপিএম ক্ষমতায় আসায় কী খরগোস থেকে সিংহ হয়ে যাবেন?
-- আদ্দেকটা ধরেছিস। খরগোসের ক্ষমতায় আসা। ক্ষমতার সিপিএম-নকশাল-কংগ্রেস হয় না।
সত্তরে যখন মানুবাবুরা যুব কংগ্রেসের পতাকার নীচে মাস্তানদের জড়ো করে কোলকাতাকে দুঃস্বপ্নের নগরী করে তুলেছিলেন
তখন তোদের পাড়ার দত্তগুপ্ত বাড়ির ছ্যাবলা নিরীহ ছোটকা রাইফেল দিয়ে তোদের গাছ থেকে নারকোল টিপ করে পুকুরে ফেলে নি?
পাড়ার চক্কোত্তি বামুনের ছেলে গামছায় শ্রাদ্ধবাড়ির চালকলা বাঁধা ছেড়ে বোমা বাঁধতে শুরু করেনি?
"সিরাজদ্দৌল্লা" নাটকে দানশা ফকির চরিত্রটা দেখেছিস?
যে ছোটবেলা থেকে খোঁড়া, ব্যঙ্গবিদ্রূপ সয়ে বড় হয়েছে , সে কেমন সুযোগ পেয়ে মহা ভিলেন হয়ে উঠল।
সেই যে রে , সেই বিখ্যাত ডায়লগ--যেমন তেমন দানশা পাইছ!
অবশ্য তোরা বোধহয় এসব পড়িস নি।
--পড়েছি, কিন্তু গুলিয়ে গেছে-- কে যে লিখেছিল? গিরিশ ঘোষ, নাকি শচীন সেনগুপ্ত?
--- ডি এল রায়ও হতে পারে, কি বল বিজনদা?
--আঃ, ফালতু কথা ছেড়ে বল, কী বুঝলি?
-- রমেন যে কিস্যু বোঝেনি, সে তো মুখ দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। আমি বুঝলাম যে তোমার দুটো উপপাদ্য।
এক, ক্ষমতার সিপিএম -নকশাল হয় না। মানে যে যায় লংকায় , সেই হয় রাবণ।
দুই, ক্ষমতা পেয়ে খরগোসের সিংহ হওয়া।
অর্থাৎ, ক্ষমতা নামক বায়বীয় শক্তি বেড়ালকে পোঁদে ফুঁ দিয়ে ফুলিয়ে বাঘ বানায়।
কিন্তু মাস্টারমশায়, আমরা ছাত্র হিসেবে ব্যাকবেঞ্চার। একটু কষ্ট কইরা উদাহরণ সহকারে বুঝাইয়া দেন।
মাস্টারমশায়ের গম্ভীর মুদ্রা । নীচুগলায় বললেন--এসব কথায় অনেক সময় লাগে।
ভাতে ভাত হয়ে গিয়েছে, ডাল করাই আছে।
যখন খেতে বসব তখন তিনটে হাঁসের ডিমের বড়া ভেজে দেব।
আর আছে লংকার আচার। চলবে তো?
সেই আদি অকৃত্রিম বিজনদা, ঘোর সংসারী, পরিবারের সবার দিকে নজর, আমরা আড়ালে বলতাম-- বড়পিসিমা।
--শোন, এবার অন্য শিবিরের এইরকম অকারণ হিংস্রতার একটা গল্প বলি? মানে নকশালদের?
সেখানেও একজন মাস্টারমশায়, তবে স্কুলের না, কলেজের।
-- কে বলত? আমরা চিনি?
--খুব চিনিস, কিন্তু নাম বলব না। এখন শান্ত ভদ্র বুদ্ধিজীবি, কাগজে প্রবন্ধ-টবন্ধ বেরোয়।
অ্যাকাডেমিক লাইনে ব্রিলিয়ান্ট। তবে--।
বিজনদা আর একটা সিগ্রেট ধরিয়ে একমুখ ধোঁয়া ছাড়ে, তারপর ব্যোম মেরে যায়।
--আরে কী হল?
--দাঁড়া, ভাবছি কোত্থেকে শুরু করি।
আচ্ছা রমেন, তুই তখন স্কটিশে ইকনমিক্স পড়তি না? রঘুবীর সেন তখন তোদের দু'ব্ছরের সিনিয়র ছিল, মনে আছে?
-- খুব মনে আছে। হেব্বি আঁতেল। "অনীক" পত্রিকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। "এস আর " লাইন মারাতো।
ওর বাপবুড়ো ভাল বেহালা বাজাত।
-- "এস আর" আবার কী?
-- তুই শালা গড়িয়া কলেজের মাল, তুই কোত্থেকে জানবি? আমরা হলাম প্রেসিডেন্সি কনসোলিডেশনের, বল্লে হবে?
"এস আর" হল সোশ্যালিস্ট রেভোলুশ্যন গ্রুপ। যারা মনে করত ভারতে কৃষিতে পুঁজিবাদ এসে গেছে, সামন্ততন্ত্র পিছু হটছে।
তাই এদেশে চীনের মত পিডিআর বা পিপলস ডেমোক্র্যটিক রেভোল্যুশন হবে না, রুশের মত শহুরে অভ্যুত্থান করে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব হবে।
অর্থাৎ, চাষি-ফাষি নয়, শ্রমিকদের পোঁদে লাগো।ওদের কানে ফুসমন্তর দাও --
মাইনে বাড়ানো আর বোনাসের দাবি ছেড়ে কারখানার মালিক হওয়ার স্বপ্ন সফল করতে হাতিয়ার তুলে নাও।
তখন সিপিএম ও সরকারী নকশালদের একই মত ছিল, ভারতে বিপ্লবের স্তর হল জনগণতান্ত্রিক বা কৃষি বিপ্লব।
রঘুবীর পরে বড় ইকনমিক্সের অধ্যাপক হল, বিদেশে রিসার্চ করল। ইদানীং রিটায়র করেছে শুনছি। এবার তুমি বল, বিজনদা।
--- তখন রঘুবীর মাস্টার্স করতে সাউথ সিঁথির ইকনমিক্স বিল্ডিংয়ে গেছে। ওরা আটটা ছেলে চারটে মেয়ে; দুজন আজকের লব্জতে বেশ ঝিংকু।
ওখানে তখন নকশালদের ইউনিট, মেয়েগুলিও তাই। রঘুবীরের একটু ইন্টুমিন্টু করার ইচ্ছে হল। ওর ব্যক্তিত্বের একটা আকর্ষণ তো ছিলই।
কিন্তু ও বাবা! কোথায় কি! যেন গোখরো সাপের বিলে এসেছে। মেয়েগুলো ওকে খালি রাগী রাগী চোখে দেখে, ভাল করে জবাব দেয় না।
শেষে ওর কাছে খবর এল যে ওকে "এস আর" গ্রুপের তাত্ত্বিক প্রবক্তা হিসেবে শ্রেণীশত্রু ঘোষণা করা হয়েছে।
ওর বেঁচে থাকার অধিকার নেই। খতমের তালিকায় নাম উঠে গেছে।
মেয়েদের কাছে নির্দেশ পৌঁছে গেছে, তাই ওদের অমন সাপের মত হিস হিস্।
রঘুবীর বিশ্বাস করেনি যে ওকে মেরে ফেলা হবে। তবু সতর্ক হল।
ভীড়ের বাসে বাড়ি ফিরতে লাগল। একা কোন গলিতে ঢুকত না।
কিন্তু ওপর থেকে যে অধ্যাপক নেতাটি ওর অজান্তে বিচারসভা বসিয়ে ওকে মেরে ফেলার পক্ষে রায় দিয়েছিলেন, তিনি অধৈর্য্য হয়ে উঠলেন।
শেষে বেলেঘাটা ইউনিটকে দায়িত্ব দেওয়া হল। ওদের অ্যাকশন স্কোয়াড খুব দক্ষ।
একদিন রঘুবীর কিডন্যাপ হয়ে গেল।
ওরা ওকে মুখ বেঁধে ট্যাক্সির ডিকিতে হাত-পা শেকল দিয়ে বাঁধা অবস্থায় রাত্তিরে শেয়ালদা -ক্যানিং রেললাইনে ফেলে দিয়ে গেল।
পুরো হিন্দি ফিল্ম।
খবরটা পেয়ে ওর এক পুরনো বন্ধু, তখন সংগঠনে সিনিয়র, একজনকে বোঝাল যে এস-আর হোক, যাই হোক --নকশাল তো বটেক। ওকে বাঁচাতে হবে।
সেই পথ দেখিয়ে জায়গাটায় নিয়ে গেল। তখনও কোন মালগাড়ি আসেনি। নইলে-।
ওই অধ্যাপকটিও খুব ভদ্র, নরম স্বভাবের। কখনও কাউকে চড় মারেন নি।
এখনও এদিকে দু'একটা টালির ছাদওলা বাড়ি রয়ে গেছে। ফুটপাথ সিমেন্টের, তাতে একপাশে কালো হলুদ দিয়ে সোঁদরবনের বাঘের মত ডোরাকাটা।
আঙিনার ভেতর থেকে কখনও উঁকিঝুকি মারে দোলনচাঁপা, জবা বা টগরফুলের গাছ।
আর কোথাও ফুটপাথের গায়েই পুরনো মাস্তানের মত মাথা তুলে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে একটা নারকোল গাছ। বয়সের ভারে হেলে গেছে।
সন্ধ্যে নেমেছে অনেকক্ষণ।
কিছু জিন্স ও লেগিংস পরা কিশোরী চলে যায় কলকল করতে করতে, পিঠে ঢাউস ব্যাগ, গন্তব্য সম্ভবতঃ কোন কোচিং ক্লাস।
পাড়ার ভিতরে ত্রিফলাবাতি নেই।কিন্তু ল্যাম্পপোস্ট অগুনতি। বেশিরভাগের মাথায় আলো জ্বলছে।
আমরা ফিরছি। অনেক অনেক আড্ডা হল।
চলে আসার সময় বিজনদার বিষণ্ণ মুখ। আবার আসিস কিন্তু।
তুই তো এখন কোলকাতাবাসী হয়ে গেছিস। অসুবিধে কী?
-- হ্যাঁ, হ্যাঁ। আসবে না মানে? ওর ঘাড় আসবে।তুমি এমন রেঁধে বেড়ে খাওয়াবে আর ও আসবে না।
--ধ্যাৎ, আমি কি খেতে পাই নে? নাকি হ্যাংলা?
--দুটোই। তোর মত যেচে একা থাকার লোকেরা নিজেরা কত রেঁধে খায় আমার জানা আছে।
তোদের দর্শন হল-- ভোজনং যত্র তত্র, শয়নং হট্টমন্দিরে।
--- ভাগ শালা! তোর মত ফ্ল্যাটের মালিক নই, কিন্তু মাথার ওপর একটা ছাদ ঠিকই আছে। এজমালি তো কি?
বিজনদা হাসে। বাগানের কাঠের দরজাটা ভেজিয়ে দিয়ে বাইরে আসে। মনে হয় গলির মুখটা অবদি এগিয়ে দেবে।
--কিছু মনে করিস না রমেন, ও তোকে হিংসে করছে। মানে তোর স্বাধীনতা, সে ওর কপালে নেই।
--- ভুল বুঝছ বিজনদা! তোমরা দুজনই উমাহারা মহেশ্বর। শ্মশানে মশানে বাস।
পুরনো দিনের গাঁজার ধোয়ার মৌতাতে তোমাদের জমবে ভাল।
--- কাল আসতে পারবি?
--না, না। কাল নয়। পরে আরেকদিন।
ওর মিশন ফেরারি ফৌজ চলছে যে! খুঁজে বেড়াচ্ছে পুরনোদিনের সাত ঘোড়সওয়ারকে।
--- ক'জনকে পেল?
--- বিমলেন্দু, আমি আর তুমি। এখনও চারজন বাকি।
-- তো কালকে কার ইন্টারভিউ নিবি?
--- না, বিজনদা, ইন্টারভিউ-টিউ নয়।
আমি দেখতে চাই তোমরা কেমন আছ? কী ভাবছ? প্রায় আদ্দেক শতাব্দী পেরিয়ে গেল যে!
এই বদলে যাওয়া সময়টাকে বুঝতে চাইছি, ধরতে চাইছি।
-- বেশ তো, কাল কার বাড়ি যাবি বল?
--বুঝতে পারছি না। ভাবছি আমাদের চে গুয়েভারা সজলের খোঁজ নেব।
সেই যে ছোটবেলা থেকেই হাঁপানীতে খুব ভুগত আর নিজেই দরকার মত ডেরিফাইলিন, অ্যামিনোফাইলিন ইঞ্জেকশন ঠুঁসে নিত।
এর পরে যাব প্রিয়ব্রতর বাড়ি।
শংকর হটাৎ দাঁড়িয়ে পড়ল। বিজনদা অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমাকে দেখছে।
এদিকে আজকাল গাছে গাছে ঝোপেঝাড়ে জোনাকিরা জ্বলে- নেভে করে না।
কোথাও টিভিতে পুরনো ফিল্মি গান বাজছে-- রমাইয়া বস্তাবইয়া! রমাইয়া বস্তাবইয়া!
তেলেভাজার দোকানের সামনে কিছু লোকজনের গজল্লা।
--কী হল? অমন চুপ মেরে গেলে যে?
-- কেন তুই জানতিস না?
--কী জানব?
--- ওরা দুজনেই নেই।
--কোলকাতার বাইরে? আমার মত প্রবাসী বাঙালী?
--- না, ওরা দুজনেই মারা গেছে। সেই সত্তরের প্রথম দিকে।
--- সে কী? কী করে? কী হয়েছিল?
-- ওসব শংকরের থেকে পরে শুনে নিস। তোরা এখন যা! ভালো লাগছে না।
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।