চোখজোড়া প্রায় বুঁজে এসেছিল, হঠাৎ একটা শব্দে ধড়ফড় করে উঠে বসল দীপ। কিন্তু লাইট জ্বালতে হল না, তার আগেই চোখে পড়ল ফসফরাসের মত জ্বলজ্বল করছে এক জোড়া চোখ, অবস্থান করছে খাট থেকে মাত্রই কয়েক ইঞ্চি দূরত্বে দরজার সমকোণে, আর কিছু মাত্র না ঘাবড়িয়ে একটা নির্দিষ্ট বিরতিতে বর্ষণ করে চলেছে মিউ মিউ…একই তাল-লয়-সুরে!
বিরক্তিকে নাক-মুখ-কপাল ভয়ানক কুঁচকে গেল দীপের। সাত সকালেই তাকে অফিস পানে ছুটতে হয়। একে তো নতুন চাকরী, তাও আবার পজিশনের দিক থেকে ছোট! সারাদিন কী খাটুনিটাই না যায়! তারপরেও বসের মন ভেজানো যায় না! লাথিগুঁতো না খেলেও সুপারভাইজারের মুখের যে অভিব্যক্তি আর চোখের যে রক্তাভ দৃষ্টি, তা প্রতিদিনই একটু একটু করে ক্ষয় করে ফেলে দীপের আয়ু! মাঝে মধ্যে মনে হয় লেখাপড়া না শিখে ইটভাঙা শ্রমিকদের দলে নাম লেখালে ক্ষতি কিছু ছিল না। তবে সব থেকে কষ্ট বয়ে আনে ক্ষয়াটে দিনের আগে আবির্ভূত হওয়া রাতগুলি। ঘুমপাখি যেন তখন বাক্সে বসে জিরোতে থাকে, আর তাকে বের করে আনতে কী এপাশ-ওপাশটাই না তাকে করতে হয়!
প্রাণীটা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিল দীপের দিকে। এতটুকু ভাবান্তর নেই ওর মধ্যে! ভাবভঙ্গী দেখে মনে হচ্ছে কী হচ্ছে, কেন হচ্ছে – সব কিছু স্পষ্ট করে বুঝে নিতে চায় সে! এদিকে দীপও বুঝে নিতে চাইছিল প্রাণীটার সম্ভাব্য গতিবিধি! তাছাড়া এত আকাঙ্খিত ঘুমকে হত্যার দায়ে কী শাস্তি দেয়া যেতে পারে ওকে, তা নিয়েও ভাবল কিছুক্ষণ! আগেও এমন অপকর্মের রেকর্ড আছে বজ্জাতটার! সুযোগ পেলেই তাদের দোতলা ফ্লাটটাতে ঢুকে, আর এক্সিট পয়েন্ট হিসেবে ব্যবহার করে তার জানালার কার্নিশ ও খাটটাকে।
কোন সমাধানসূত্র না মেলায়, শেষ পর্যন্ত অবশ্য শিয়রে রাখা বইটাই হাতে তুলে নেয় দীপ। কিন্তু যেই না ছুঁড়তে গিয়েছে, চোখের পলকে অদৃশ্য হয় জন্তুটা! কোথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়বে, উল্টো রাগে উন্মাদ হয়ে যায় দীপ। মুহূর্তেই পুরো ঘর পায়চারী করতে শুরু করে সে পাগলের মত - যে করেই হোক শয়তানটাকে খুঁজে বের করতে হবে! কিন্তু কোথাও পাওয়া যায় না সেই ফসফরাসকে।
এক সময় দাত কিড়মিড় করতে করতে টয়লেটে ঢোকে সে, আর কী আশ্চর্য, হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে যায় মাথাটা, নিজের উপরই রাগ হতে থাকে কেমন! নেহায়েতই একটা নিরীহ প্রাণী! তাদের রান্নাঘরের সিংকে রাখা গেরস্থালি কাটাকুটোই ওর টার্গেট। আর এ কাজ করতে ভূমি থেকে দোতলার কার্নিশে লাফিয়ে উঠতে হয় জন্তুটাকে। তাপর সবার চোখ এড়িয়ে খাবার সংগ্রহ করে একটা সেকেন্ড রাউন্ড লম্ফঝম্ফের আশ্রয় নিয়ে কেটে পড়তে হয়! চাট্রিখানি কাজ? শুধু গায়ের কসরতটাই নয়, আছে ধরপাকড়ের ভয়! হঠাৎ বেড়ালটার প্রতি মায়া পড়তে থাকে দীপের, আর প্রক্ষালন কর্ম ছেড়ে দিয়ে এ চিন্তাতেই সে মশগুল হয়ে পড়ে!
বেশ খানিকটা সময় অতিবাহিত করে অবশেষে দীপ যখন বেরোয় টয়লেট থেকে, মন বলতে থাকে, এবার খুব ভাল একটা ঘুম হবে তার! নিদ্রামাখা তাল ও লয়ে শোয়ার ঘরের দিকে এগুনোর সময় হঠাৎ একটা খটকা তাকে ডাইনিং রুমেই থামিয়ে দেয়! কী যেন একটা কিছু! কিন্তু চোখের চিত্রগ্রহণটি এত ক্ষণস্থায়ী ছিল যে, মস্তিষ্কের পক্ষে তার পুরো পাঠোদ্ধার সম্ভব হয়ে উঠে না। এক সময় ব্যাপারটা নিশ্চিত হতে পেছন ফেরে দীপ, আর সঙ্গে সঙ্গে চোখ ধাঁধিয়ে দেয় সেই এক জোড়া ফসফরাস! ডাইনিং টেবিলের উপর বেশ আয়েস করে বসে আছেন তিনি! আর তার ধবধবে সাদা পশমী কোটে মুড়ে দেয়া শরীরটা অন্ধকারের মধ্যে পূর্নিমা বিলিয়ে যাচ্ছে অকাতরে!
মুহূর্তেই কী হয়, রক্ত চড়ে যায় দীপের মাথায়! চোখে ধুলো দিয়ে লুকিয়ে থাকার বিষয়টি তার গায়ে শেলের মত বিঁধতে থাকে! ডাইনিং টেবিলের জগটা হাতের কাছেই ছিল। শরীরের সমস্ত শক্তি প্রয়োগ করে সেটিকে ছুঁড়ে মারে সে এবার, আগের মত আর থেমে যায় না ছোঁড়ার পূর্ব মুহূর্তে। কিন্তু বিধি বাম! জগটা বিপুল বেগে আর্তনাদ করতে করতে মেঝেয় লুটিয়ে পড়লেও ভোজবাজির মতই অদৃশ্য হয় প্রাণীটা!
আবারো তন্ন তন্ন করে খুঁজতে আরম্ভ করে দীপ! কিন্তু কোথাও নেই সেই পূর্ণিমা! এক সময় হাল ছেড়ে দিয়ে বিষাদ চিত্তে বিছানায় ঝাঁপ দিয়ে পড়ে দীপ জগটার মত করেই। কিন্তু আর ঘুম আসে না। মাঝে মাঝে ঘড়ির কাটাটার দিকে তাকায় সে, আর ক্রমাগত এপাশ ওপাশ করতে থাকে ঘড়ির কাঁটাটার মত করে, একই তাল ও লয়ে! কিন্তু সূর্যের চোখ খোলার সময় যতই এগিয়ে আসতে থাকে, ঘুমের গাড়ি যেন আরো দূরে সরতে থাকে, আর কপালের ভাঁজগুলি বড় হতে থাকে দীপের! আগামীকালই এমন কতগুলি গুরুত্বপূর্ণ কাজ অপেক্ষা করছে তার জন্য, স্বাভাবিক শরীরেই যার ধকল সহ্য করা কঠিন!
ভাবতে ভাবতে কখন যেন আবার চোখ বুঁজে আসে দীপের। কিন্তু আবারো একটা কী শব্দ, আর বজ্রের বেগে বোঁজা চোখ হুড়মুড় করে খুলে যায়। এক লাফে বিছানাটা থেকে উঠে পুরো ঘরটা রাউন্ড দেয় সে। কিন্তু কোথাও নেই! পরে আরেকবার শব্দটা হতেই সে রান্নাঘর পানে ছুটতে শুরু করে,আর উৎসে কান পাততে পাততে পৌঁছে যায় জানালাটার কাছে। লাইট না জ্বেলেই সে কার্নিশে উঁকি দেয়, আর সঙ্গে সঙ্গে জ্বলে উঠে ফসফরাস!
একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে দীপের স্নায়ুতে দাপদাপ শব্দ তুলে। আবার জানালাটা টপকানোর চেষ্টা করছে শয়তানটা। কিন্তু বের হয়েছিল কী করে একটু আগে? জানালাটা তো সে নিজেই মাত্র কয়েক আংগুল ফাঁক রেখে বন্ধ করে দিয়েছিল রান্নাঘরে সঞ্চিত গ্যাস নির্গমনের সুবিধার্থে। তাহলে?
জানালার ফাঁকটা ভালমত পরীক্ষা করে দীপ, কিন্তু সে যতটুকু রেখেছিল, ঠিক ততটুকুই আছে ফাঁক, কমেনি বা বাড়েনি এক ইঞ্চিও। তাহলে এই এতটুকু জায়গা দিয়েই? নিশ্চিত অসম্ভব কসরতই না করতে হয়েছে বেচারাকে বেরুতে! এখন ঐ ফাঁক গলেই আবার ঢুকতে চেষ্টা করছে! চাট্রিখানি কাজ নয়!
দীপ ফের তাকায় জীবটার দিকে। ওর শরীর থেকে অবশ্য কোন পরিশ্রমের সংকেত উদ্ধার করা সম্ভব হয় না। কে জানে, খুব শ্রমসাধ্য কিছু করার পর হয়ত ওদের অভিব্যক্তি মানুষের মত হয় না! আচ্ছা, ওদেরও কি নিঃশ্বাস দ্রুত পড়তে থাকে খুব খাটাখাটুনির পর? ওরাও কি হাঁপায় কখনো-সখনো? ওদেরও কি ঘাম হয় যেমন তার হয় অফিসে এক টানা কাজ করতে করতে?
অফিসের কথাটা মনে পড়তেই তড়াক করে লাফিয়ে উঠে দীপের মস্তিষ্ক, আর বিড়ালটার চোখের উপরেই জানালার বাকী ফাঁকটুকুও সে বন্ধ করে দেয়! এরপর বসের রক্তাভ চোখজোড়া তাকে একটু একটু করে গেঁথে ফেলতে থাকে বিছানায়। কিচ্ছু করার নেই। যে করেই হোক এখন ঘুমুতে হবে! দুনিয়ার কাজ অপেক্ষা করছে তার জন্য আগামীকাল!
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।