বিলেতে গিয়ে সুকুমার তাঁর মা বিধুমুখীকে চিঠি লিখছেন, আমসত্ত্ব আর ভাজা মশলা না হলে তাঁর চলছে না। আকাশবাণীতে সম্প্রচারিত "আমার বাবা" অনুষ্ঠানে স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে সত্যজিৎ রায় বলেছেন, এর কিছুদিন পরের চিঠিতে আবার জানা যাচ্ছে, সেসব জিনিস লন্ডনে গিয়ে পৌঁছেছে। ফটোগ্রাফি এবং মুদ্রণশিল্প নিয়ে সুকুমার রায় বিলেতে পড়তে গিয়েছিলেন ১৯১১ সালে। সেখান থেকে সসম্মানে ডিগ্রি ও উপাধি নিয়ে দেশে ফেরেন ১৯১৩ সালে। উপেন্দ্রকিশোরকে লেখা সব চিঠিতেই ছিল কাজ এবং পড়াশুনার কথা। ভাই সুবিনয়কে লিখছেন, "প্রবাসী", "মডার্ন রিভিউ" এবং "তত্ত্বকৌমুদী" যেন ঠিক সময়ে পাঠানো হয়। সবচেয়ে ছোটবোন টুনি অর্থাৎ শান্তিলতাকে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, টাই বাঁধাটা ততদিনে সড়গড় হয়ে গেছে। তবে মা বা বোনেদেরকে লেখা চিঠিতে বিলেতের হালচাল, খাওয়াদাওয়ার নানা প্রসঙ্গ এসেছে ঘুরেফিরে। ছোটবোন খুসি অর্থাৎ পুণ্যলতাকে লিখছেন, খ্রিস্টমাসের ছুটিতে দল বেঁধে হ্যাম্পটন কোর্ট প্যালেস আর অষ্টম হেনরির বাড়ি দেখতে গিয়েছিলেন। সেখানে গিয়ে বেজায় খিদে পেল কিন্তু খ্রিস্টমাস বলে সব হোটেল বন্ধ। তখন খুঁজে খুঁজে পাড়াগাঁয়ের একটা সরাইখানায় গিয়ে বিফ রোস্ট, কপি সেদ্ধ আর আলু সেদ্ধ দিয়ে রুটি আর চা খেলেন। তবে বিলেতে গিয়ে সংস্কারমুক্ত মন নিয়ে যতই তিনি সাহেবি খানায় অভ্যস্ত হতে শুরু করুন না কেন, নিখাদ বাঙালি রান্নার প্রতি তাঁর ঝোঁক কমেনি। বাড়ি বদলে নতুন বাড়িতে যাবার পরে টুনিকে আর একটি চিঠিতে লিখছেন, "এখানে রান্নাটা এখন আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। কুক কার কাছ থেকে কতকগুলো দেশি রান্না শিখে নিয়েছে। তাই মাঝে মাঝে ডালের বড়া, জিলাপি, খিচুড়ি, এই সব খেতে দেয়। মন্দ লাগে না...” আবার বিলেতের সাহেব ভারতে গেলে তাঁকে বাংলার সুখাদ্যের সঙ্গে পরিচয় করাতেও তাঁর আগ্রহ কম নয়। ১৯১২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ম্যাঞ্চেস্টার থেকে মা-কে লেখা চিঠিতে জানাচ্ছেন, মিস্টার পিয়ার্সন খ্রিস্টমাসের সময় কলকাতা যাবেন -- "বেশ বাংলা বলতে পারেন আর মানুষ অতি চমৎকার। যদি আমাদের বাড়িতে যান, পাটিসাপ্টা কিম্বা কিছু খাইয়ে দিতে পারলে বড় ভালো হয়।"
১৩ কর্নওয়ালিস স্ট্রিটে লাহাদের যে বিরাট বাড়ির দোতলায় কয়েকটি ঘর ভাড়া নিয়ে বিবাহের পর উপেন্দ্রকিশোর সংসার পেতেছিলেন সেটি নানাদিক দিয়ে ছিল এক ঐতিহাসিক বাড়ি। একতলায় নতুন প্রতিষ্ঠিত ব্রাহ্ম বালিকা বিদ্যালয়, দোতলায়,তিনতলায় দু-তিনটি ঘর নিয়ে ব্রাহ্মধর্ম গ্রহণ করায় নিজেদের বাড়ি থেকে বিতাড়িত ছোট ছোট অনেকগুলি পরিবার। উপেন্দ্রকিশোরদের পাশেই স্ত্রী ও তিন শিশুকন্যা নিয়ে থাকতেন তাঁর ছোটভাই প্রমদারঞ্জনের শ্বশুর অর্থাৎ লীলা মজুমদারের দাদু পন্ডিত রামকুমার ভট্টাচার্য। কিছুদিন পরে তিনতলায় উপেন্দ্রকিশোরের শ্বশুর দ্বারিক গাঙ্গুলি এবং তাঁর আধুনিক শিক্ষিতা স্ত্রী ও বিলেত ফেরত দেশের প্রথম পাস করা মহিলা ডাক্তার কাদম্বিনী গাঙ্গুলি থাকতে শুরু করেন। বিধুমুখী ছিলেন অত্যন্ত সুগৃহিণী। দারুণ ভালো রান্না করতেন আর নানারকম খাবার তৈরি করতেন। নতুন ভালো রান্না দেখলেই শিখে নিতেন । একরকম পুডিং বানাতেন ‘এগস ইন স্নো’। বিখ্যাত শিল্পী শশী হেসের ইতালিয়ান স্ত্রীর কাছ থেকে এটা প্রথম শিখে নিয়েছিলেন বিধুমুখীর বড় জা অর্থাৎ সারদারঞ্জনের স্ত্রী শশীমুখী। এছাড়া কত রকম আচার, মোরব্বা, আমসত্ত্ব সারা বছর বানাতেন। কার কোনটা পছন্দ, কার অরুচির জন্যে জারকলেবু, কার হজমের গোলমালের জন্যে বেলের মোরব্বা সব খেয়াল রাখতেন। বাড়িতে লোকজন খাওয়ানোর ধুম লেগে থাকত। পুণ্যলতা লিখেছেন, "এ সংসারে কোন খিল ছিল না।" ছোট-বড় সবাই মিলে আমোদ-প্রমোদ, লেখাপড়া, ছবি আঁকা, খেলাধুলা, সৃজনশীলতা, খাওয়াদাওয়া সবেতেই এই সংসারের আনন্দের স্পর্শ পরিবারের অন্যান্য শাখাকে তো বটেই, এমনকি গোটা সমাজকেই সঞ্জীবিত করেছিল। বিধুমুখীর রান্না খেয়ে "ইন্ডিয়া ইন বন্ডেজে"র বিখ্যাত মার্কিন লেখক ডক্টর জে টি স্যান্ডারল্যান্ড এতটাই অভিভূত হয়েছিলেন যে তাঁকে আমেরিকায় গিয়ে রান্নার স্কুল খোলার প্রস্তাব দিয়েছিলেন।
ওই বাড়ির ছাদে পাড়ার যাবতীয় বিয়েবাড়ির খাওয়া প্রায় সবই ওখানে হত। ব্রাহ্ম সমাজের মাঘোৎসবের সময় তিনটে দিন ছিল ছোটদের খুব মজা। একদিন উপাসনার পর খিচুড়ি খাওয়া, একটা দিন পিকনিক আর একটা দিন বালক-বালিকা সম্মেলন। সেদিন বাড়ির উল্টোদিকে ব্রাহ্মসমাজ মন্দিরে উপাসনার পর কয়েকশ ছেলেমেয়ে রাস্তা পেরিয়ে এসে বাড়ির ছাদে সারি সারি পাত পেড়ে খেতে বসত। একবার সেখানে হাজির ছিলেন নীলচোখ, সোনালি চুল, ধুতি পরা নরওয়ে থেকে আসা এক সাহেব। তিনিও ছোটদের মধ্যে বসে হাত দিয়ে লুচি ছিঁড়ে ছিঁড়ে খাচ্ছিলেন আর ভাষা না জানায় সবার দিকে চেয়ে হাসছিলেন। পুণ্যলতার স্মৃতিকথায় এমন অনেক মজার মজার ঘটনা এবং অন্তরঙ্গ পারিবারিক ছবি পাওয়া যায়। এই বালক-বালিকা সম্মেলনের বিবরণ দিয়েছেন কল্যাণী কার্লেকারও। একবার ভোজের জন্যে ময়রা এক ড্রাম ভর্তি রসগোল্লা নিয়ে এল। পন্ডিত শিবনাথ শাস্ত্রী জিজ্ঞাসা করলেন, "এই এত রসগোল্লা কে একা খেতে পারে?" সবাই চুপচাপ। সুকুমার জোরে বলে উঠলেন, "আমি পারি।" তারপর ফিসফিস করে যোগ করলেন, "অনেকদিন ধরে।" শাস্ত্রীমশাই খুব হাসলেন, "ইতি গজ নাকি?" বিলেতে গিয়েও সুকুমারের আমসত্ত্বের প্রতি এত দুর্বলতা হবে না কেন? মা-তো বানাতেনই, তাছাড়া তাঁর মায়ের পিসিমা যাঁকে তাঁরা বড়দিদিমা বলতেন তিনি প্রতি বছর কাশী থেকে টিন ভর্তি আমসত্ত্ব তৈরি করে আনতেন। বড় বড় থালার মতো গোল আমসত্ত্ব, চাটাইয়ের মতো চৌকোনা আমসত্ত্ব, সুন্দর ছাঁচে ঢালা ফুলকাটা আমসত্ত্ব। কাজেই বিলেতে আমসত্ত্ব না পেলে তাঁর চলবে কী করে! সেই বড়দিদিমা কলকাতায় এলে স্নান করে পুজো সেরে খেতে বসতেন। পুণ্যলতা ও তাঁর খেলার সাথী চামি মাসি রোজ দরজার গোড়ায় বসে পুজো দেখতেন। বড়দিদিমা পাথরের বাটিতে ঘন দুধ ও কলা দিয়ে ভাত মাখতেন। পায়েসের মতো খেতে সেই সুগন্ধি চালের দুধ ভাতের ওপরে তাঁদের ভারি লোভ ছিল। খাবারের প্রতি ছোটবেলার লোভ নিয়েও কত গপ্পো! পুণ্যলতার বর্ণনায় জানা যায়, একদিন তাঁরা বারান্দায় বসে আছেন। এমন সময় দেখলেন দিদিমার মা যাঁকে তাঁরা বড়মা বলে ডাকতেন, তিনি এক হাঁড়ি দই নিয়ে তাঁর ঘরে ঢুকলেন। দইটা ঘরে রেখে দরজায় শিকল তুলে চলে গেলেন। মংলুমামা ছিলেন পেটুক মানুষ। কতক্ষণে খাবার সময় হবে তার আর সবুর সইছে না। একটু নিরিবিলি হতেই তাড়াতাড়ি একটা টুলে চড়ে শিকলি খুলে, চুপিচুপি খাটের তলা থেকে হাঁড়িটা টেনে নিয়ে মস্ত এক খাবলা দই মুখে পুরেই পরিত্রাহি চিৎকার! আসলে সেটা তো দই-ই ছিল না, ছিল পানে খাবার চুন। আবার নতুন চুনের ঝাঁঝ খুব বেশি হয়। কাজেই মংলুমামার যে কী দশা হল তা তো বুঝতেই পারা যাচ্ছে। দই খাওয়াও হল না, তার ওপর চুরি করে খেতে গিয়ে ধরা পড়ার লজ্জা! রায় পরিবারে সুখাদ্যের প্রতি আকর্ষণের শুরুটা হত একেবারে জন্মাবার পর থেকে। সুকুমারের ছোট ভাই নানকু অর্থাৎ সুবিমল সবে জন্মেছে। সে যখন মাত্র কয়েকদিনের, দুপুরে মা তাকে পাশে নিয়ে একটু ঘুমিয়েছেন। হঠাৎ চকাৎ চকাৎ শব্দ শুনে তাকিয়ে দেখেন, পাঁচ বছরের কন্যা টুনি পান্তুয়া খেতে খেতে ফোঁটা ফোঁটা রস টিপে টিপে ভাইয়ের মুখে দিচ্ছে আর ভাই দিব্যি চকচক করে খাচ্ছে।
কলকাতার বাড়িতে এইসব হাসি মজার পাশাপাশি প্রতি বছর ছুটির সময়ে সুকুমার এবং ভাই-বোনেরা মিলে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে যেতেন পাহাড়ে, পশ্চিমে কিংবা ময়মনসিংহে দেশের বাড়িতে। ট্রেনে, স্টিমারে, নৌকায়, অবশেষে হাতি এবং পাল্কিতে চড়ে পূর্ববাংলার গ্রামে যাওয়াটা ছিল মস্ত অ্যাডভেঞ্চার। রাতে শিয়ালদহ স্টেশনে ট্রেনে চড়ে সকালে গোয়ালন্দে স্টিমার। বিরাট বিরাট জাহাজের কত বিচিত্র নাম। অ্যালিগেটর, ক্রোকোডাইল, পরপয়েজ, ঈগল,কন্ডর, ভালচার। সেগুলির ডেকে দাঁড়িয়ে দু-ধারের দৃশ্য দেখতে দেখতে তাঁরা যেতেন। বিকেলের দিকে নারায়ণগঞ্জে পৌঁছে আবার ট্রেন, রাতদুপুরে কাওরাইদ স্টেশনে নেমে আবার এক প্রস্থ নৌকাযাত্রা। সকালে উঠে দেখতেন পদ্মা নয়, অনেক ছোট ছোট নদী দিয়ে ভেসে চলেছে তাঁদের নৌকা। কোন ঘাটে নৌকো ভিড়িয়ে তার আড়ালে স্নান সেরে মাঝিদের রান্না টাটকা মাছের ঝোল ভাত খেয়ে বাড়ি পৌঁছতে সন্ধ্যা। সেখানে শাঁখের আওয়াজের মধ্যে ঠাকুমা, পিসিমারা এগিয়ে এসে আদর করে তাঁদের ঘরে নিয়ে যেতেন। শহুরে পরিবেশ থেকে গিয়ে মসূয়া গ্রামে। কাছাড়ের নীল পাহাড়ের অনতিদূরে ব্রহ্মপুত্রের তীরভূমির এই সব আম-জাম-কাঁঠালের বনে ছাওয়া বড় বড় পুকুর, খাল, বিলে ভরা অঞ্চলের নিজস্ব একটা পরিবেশ ছিল। সেখানকার সুগন্ধি চাল, লাল গোল আলু, আর সোনালি সুমিষ্ট আনারসের খ্যাতি ছিল। দেশের ঘরবাড়ি, বাগান, পুকুর, গাছের পাকা ফল পেড়ে খাওয়ার মজা ছিল অভিনব অভিজ্ঞতা। শ্বেতপাথরের খেলনার মতো সুন্দর চিনির তৈরি হাতি-ঘোড়া রথ। ঠাকুমা, পিসিদের বানানো নানারকম ক্ষীর নারকেলের মিষ্টি। ক্ষীরের নাড়ু, মটমটে শক্ত তিলের নাড়ু, তক্তি, ছাঁচ, গোকুল পিঠে, মুগের পুলি, চন্দ্রপুলি, পাটিসাপ্টা, গঙ্গাজলি, নারকেলের চিরাজিরা কত কী! ওঁরা যখন কলকাতায় আসতেন তখনও তাঁরা সঙ্গে নিয়ে আসতেন মুখে সরা চাপা, ময়দা দিয়ে আঁটা বড় বড় মাটির হাঁড়ি। তাতে ভরা থাকত এইসব সুখাদ্য। বাড়ির গরুর দুধ-সর, পুকুর থেকে ধরা জ্যান্ত মাছ, গাছের ফল, বাগানের তরতাজা সব্জি, ঘরে তৈরি পিঠে-পুলির পাশাপাশি গ্রামের নানা টুকিটাকির আকর্ষণও কিছু কম ছিল না। তাই গাছ থেকে কাঁচা আম বা কুল পেড়ে তেল, নুন, লঙ্কা দিয়ে জারিয়ে বানানো ঝাল চাটনি হুসহাস করে খাওয়া হয়ে যেত। আর ছিল বেত ফল। তেল-নুন মেখে পাথরের বাটি ঢাকনা চাপা দিয়ে ঝাঁকাতে ঝাঁকাতে সমবেত স্বরে আওয়াজ উঠত "আম পাকে, জাম পাকে, মামা-বাড়ির বেথুন পাকে।" নাড়তে নাড়তে নরম হয়ে গেলে সেগুলি খেতে সুন্দর লাগত। কলকাতা ফেরার সময় গোয়ালন্দ থেকে বিরাট সব তরমুজ কেনা হত। উপেন্দ্রকিশোর যখন কোথাও যেতেন সেখান থেকে মজার মজার ছবি আর পদ্যে চিঠি লিখতেন। ময়মনসিংহে তো এত জমিয়ে খাওয়াদাওয়া, কিন্তু তিনি তাঁর শ্যালক সতীশকে স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষায় লিখছেন, "সৈত্যাদ্দ্বা,হাঃ হাঃ হাঃ! / কথাডা শুইন্যা যা / কৈলকাতা বৈস্যা খা / দৈ ছানা, ঘি, পাঁঠা / ময়মনসিং ঘোড়াড্ডিম / দেখবার নাই কিচ্ছু ভাই / সার্ভেন্ট ইজ ইস্টুপিড / রাইন্ধ্যা থোয় যাইচ্ছ্যাতাই।"
একবার তাঁরা গিয়েছিলেন গিরিডির উপকণ্ঠে পচম্বায়। সেখানে খাকো নদীতে, শ্লেট নদীর পাড়ে, তিলৌড়ি পাহাড়ে চড়ুইভাতি হত। পিকনিকে যাওয়ার জন্যে ছিল গরুর গাড়ি বা মানুষে টানা পুশপুশ। খিচুড়ি রান্না হত, পায়েস হত। গাছের তলায় চাদর বিছিয়ে বসে সকলে খেতেন। আর একবার মধুপুরে গিয়ে সেখান থেকে ফেরার সময় এনেছিলেন হাঁড়িভর্তি প্যাঁড়া ও ঝুড়ি ভর্তি ডিম। সেখানে খুব বড় টাটকা ডিম সস্তায় পাওয়া যেত। মেয়েরা ঝুড়ি বোঝাই করে বাড়ি থেকে ডিম নিয়ে আসত স্থানীয় হাটে। একদিন তার মধ্যে থেকে একটা অদ্ভুত দেখতে, সরু, লম্বা, বিরাট ডিম বেরোল। কেউ বলে রাজহাঁসের ডিম, কেউ বলে জংলি পাখির। সুকুমারের মা বললেন, কিসের না কিসের ডিম খেয়ে দরকার নেই। কিন্তু ওঁদের ধনকাকা সে কথা শুনলেন না। বেশ করে পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে ওমলেট ভাজিয়ে খেয়ে ফেললেন। যার ডিমই হোক না কেন, তা নাকি খুবই উপাদেয়।
ওঁদের এই বেড়াতে যাবার প্রসঙ্গে দার্জিলিংয়ের কথা না বললেই নয়। তাঁরা বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন একেবারে কার্ট রোডের ওপরে। সামনেই টয় ট্রেনের লাইন। সেই সময়টা এমনই যখন সব জায়গায় জিনিসপত্র পাওয়া যেত খাঁটি এবং টাটকা। নিচের বস্তি থেকে গোয়ালারা বাঁশের চোঙায় দুধ বেচতে আসত। সেই দুধ এমনই ছিল যে আসতে আসতে পথের ঝাঁকানিতে মাখন ভেসে উঠত। জ্বাল দিলে চমৎকার পুরু সর পড়ত। একটু ফোটালেই পরতে পরতে সর থেকে মাখন হত। দার্জিলিঙে থাকার সময় উপেন্দ্রকিশোরের স্ত্রীর হল হিল ডায়েরিয়া। বন্ধু ডাক্তারের চেষ্টায় তিনি সেরে উঠলেন বটে তবে এক মাস ধরে তাঁর পথ্য ছিল কাঁচকলা সিদ্ধ আর ভাতে ভাত। ভালো হয়ে উঠে একদিন তিনি ডাক্তারকে খাবার নিমন্ত্রণ করলেন। ভদ্রলোক এসে দেখলেন হরেক পদ রান্না হয়েছে বটে তবে সুক্তো থেকে পায়েস সব কাঁচকলা। রান্নার জাদুতে কাঁচকলাও যে এমন সুখাদ্য হতে পারে সে সম্পর্কে ডাক্তারের কোন ধারণাই ছিল না। সাধারণ উপকরণ দিয়ে সুস্বাদু রান্নায় তিনি ছিলেন অসম্ভব পটু। শুধু তাই নয়, কারও অসুখ-বিসুখ হলে সহজপাচ্য খাবার, মণ্ড, পোড়ের ভাত, দুধ-বার্লি নিজে তৈরি করে খাইয়ে আসতেন। এ হেন রায় পরিবারে খাওয়া দাওয়ার বিষয়টি যে দৈনন্দিন জীবনযাত্রায় একটা গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার ছিল সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। সুকুমারের বিলেত যাত্রার আগেই হয়েছিল ননসেন্স ক্লাবের সূচনা। আর সেখান থেকে ফিরে আসার দু'বছরের মধ্যে প্রতিষ্ঠা হল মানডে ক্লাব। ১০০ নম্বর গড়পার রোডের বাড়িতে মূলত নানা বিষয়ে হাসির তুফান ছোটানো আড্ডা বসলেও ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অন্যান্য সদস্যদের বাড়িতেও বৈঠক হত। সোমবার আসর বসত বলে মানডে ক্লাব আর আড্ডার সঙ্গে প্রচুর উপাদেয় জলযোগের ব্যবস্থা থাকত বলে সভার ডাক নাম হয়ে গেল মন্ডা ক্লাব। এই উপলক্ষে কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত "আমাদের শান্তিনিকেতন"-এর সুরে গান বেঁধেছিলেন -- "মোরা হপ্তা বাদে জুটি / সবাই হাঁপাই ছুটোছুটি / রাধাবল্লভে মন নেইকো, রাধাবল্লভি বেশ লুটি।" আহারের বাহার না থাকলে সাহিত্যবাসর যে জমে না এবং আড্ডা যে কিছুদিন বাদে লাটে ওঠে সেই চরম সত্যটি সবার জানা ছিল। তাই প্রতিটি নিমন্ত্রণলিপিতে খাওয়ার কথা ফলাও করে জানানো হত। একটি চিঠিতে রয়েছে -- "ছোটকু বলে 'রইনু চুপে / ক'মাস ধরে কাহিলরূপে' / জংলি বলে, 'রামছাগলের / মাংস খেতে চাই' / যতই বলি, 'সবুর কর' -- কেউ শোনে না কালা / জীবন বলে কোমর বেঁধে, কোথায় লুচির থালা?"
সুকুমারের মায়ের রান্নার ঘরানাটা ঠিক ধরে রেখেছিলেন তাঁর স্ত্রী সুপ্রভা। ছোটভাই সুবিনয়ের স্ত্রী পুষ্পলতাও অনেক রকম রান্নাবান্না জানতেন। তবে বাড়িতে এত রান্না ও খাবারের চল থাকলেও সত্যজিৎ কিন্তু ছেলেবেলায় বাড়ি থেকে স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতেন না। আরও কয়েকজন মিলে খেতেন এক পয়সায় একটা আলুর দম। শালপাতার ঠোঙায় বিক্রি হত এই আলু আর সঙ্গে দেওয়া কাঠি বিঁধিয়ে আলুটা মুখে পুরতেন। ইস, স্কুলের গেটের সামনে দাঁড়িয়ে সত্যজিতের আলুর দম খাওয়ার একটা ছবি যদি থাকত! কলকাতার স্ট্রিট ফুডের এর চেয়ে ভালো বিজ্ঞাপন আর কী হতে পারত! সত্যজিৎ লিখেছেন, টিফিনের এক ঘন্টার মধ্যে তাঁদের খাওয়া এবং খেলা দুটোই চলত। পুণ্যলতার লেখায় পাওয়া যায় তাঁদের স্কুলের টিফিনের ছুটির সময় বারান্দার কোণে কৈলাশ ময়রা বিরাট এক বারকোশের ওপরে ঝকঝকে কাঁসার বড় বড় জামবাটিতে ভরা নানারকম খাবার নিয়ে বসত। লুচি, ডাল বা তরকারি, সিঙাড়া বা কচুরি আর সন্দেশ এবং অন্য দু-একটি মিষ্টি থাকত। একদিন টিফিনের সময় সত্যজিৎ দেখেন যে এক নতুন জিনিসের আমদানি হয়েছে। কাগজে মোড়া মাখনের প্যাকেটের মতো দেখতে আইসক্রিম -- "হ্যাপি বয়"। বাঙালি কোম্পানি, রাস্তায় ফেরি করা আইসক্রিম সেই প্রথম। তবে সত্যজিতের প্রথম আইসক্রিম খাওয়া নিয়ে বেশ একটা মজার গল্প আছে। ধর্মতলায় হোয়াইটওয়ে লেডল-র কাছে ছিল গ্রামোফোন ও খেলার সরঞ্জামের দোকান 'কার অ্যান্ড মহলানবিশ'। দোকানে বসতেন বুলাকাকা। তাঁর সঙ্গে সত্যজিৎ একবার গিয়েছিলেন গঙ্গার ধারে ভাসমান আউট্রাম রেস্তোঁরায়। সেখানে জীবনে প্রথম আইসক্রিম খান সত্যজিৎ। প্রথম চামচ মুখে দিতেই দাঁত কনকন করে ওঠায় বলেছিলেন আইসক্রিমটা একটু গরম করে দিতে। 'হ্যাপি বয়' উঠে যাবার পরে কলকাতায় এল ম্যাগনোলিয়া এবং তারও অনেক পরে কোয়ালিটি ও ফ্যারিনি। তবে তিনি লিখেছেন, "আমাদের ছেলেবেলায় কাঠের বালতির গায়ে লাগানো লোহার হাতলের ঘড়ঘড় শব্দ শুনলে মনটা নেচে উঠত। কারণ, বাড়ির তৈরি ভ্যানিলা আইসক্রিমের স্বাদের সঙ্গে কোন ঠেলাগাড়ির আইসক্রিমের স্বাদের তুলনা চলে না।" গড়পার থেকে ভবানীপুরে চলে আসার পরে বাড়ির বারান্দা থেকে সত্যজিৎ দেখতেন রংবেরঙের জিনিস ফিরি করা 'জার্মানওয়ালা দো-আনা', 'জাপানওয়ালা দো-আনা'। সপ্তাহে দু-তিন দিন আসত মিসেস উডের বাক্সওয়ালা। মা-মাসিরা ডাক দিতেন, "এই বাক্সওয়ালা, এখানে এস"। সত্যজিতের মনটা তখন আবার নেচে উঠত, কারণ বিকেলের খাওয়াটা তাহলে জমবে ভালো। বাক্সে থাকত মেমসাহেবের তৈরি কেক, পেস্ট্রি, প্যাটি। আর সন্ধ্যার সময় শোনা যেত "ম্যায় লাহুঁ মজেদার চানাচোর গরম" আওয়াজ। সেই চানাচুরের স্বাদও সত্যজিৎ বিলক্ষণ পেয়েছেন যদিও তাঁর ছবিতে ফেলুদার প্রিয় চানাচুরের দোকান ছিল নিউ মার্কেটে।
রায়বাড়ির খাওয়াদাওয়া নিয়ে আর এক কুশীলবের কথা না বললে এই কাহিনী অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। তিনি হলেন সত্যজিতের ছোটকাকা সুবিনয় যাঁর ভাত খেতে সময় লাগত আর সকলের তুলনায় ঝাড়া একঘন্টা বেশি। কারণ, তাঁর নিয়ম ছিল প্রতিটা গ্রাস বত্রিশ বার করে চেবানো। তা না করলে নাকি খাবার হজম হয় না। তাঁর বৈশিষ্ট্য ছিল বিভিন্ন রঙের কালিতে প্রতিদিনের নানা ঘটনার বিবরণ দিয়ে ডায়েরি লেখা। কোথাও ট্রেনে করে বেড়াতে গেলে ট্রেনের স্টিম ইঞ্জিনের কী 'টাইপ' সেটাও লিখে রাখতেন। পেটুক ছিলেন না, তবে খেতেন খুব তৃপ্তি করে। রোজ এবাড়ি, ওবাড়ি গিয়ে তাঁর চা-পান ছিল একটা বিশেষ ব্যাপার। ডায়েরিতে তার উল্লেখ থাকত। তবে একেবারেই সাধারণভাবে নয়। যে চা-টা খেলেন তার একটা বিশেষণ আর ব্র্যাকেটে তার একটা ব্যাখ্যা। যেমন "নৃসিংহভোগ্য চা (ভৈরবকান্তি জনক, হুহুঙ্কার - প্রসাদক, জোরালো চা)", কিংবা "বিবেকানন্দভোগ্য চা (কর্মযোগস্পৃহাবর্ধক, বাগবিভূতিপ্রদ, তত্ত্বনিষ্ঠার অনুকূল উপাদেয় চা)" অথবা "মজলিশি চা (মশগুল - মশগুল ভাবোদ্রেককারী চা)"। এমন চমকপ্রদ নামের আরও উদাহরণ রয়েছে।
রায়বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার বহর আর তাকে ঘিরে হাজারো মজাদার ঘটনার ঘনঘটা ছিল বলেই ছোটদের মন জয় করা লীলা মজুমদারের গল্প-কাহিনী খাদ্যরসে এমন টইটুম্বুর। তাঁর রচনায় জলখাবার হিসেবে সবচেয়ে বেশি উল্লেখ রয়েছে লুচি-পরোটার যা আজও বাঙালির ঘরে ঘরে অতি প্রিয়। "নেপোর বই"য়ে পানুর মন খারাপ ভালো হয়েছিল রামকানাইয়ের আনা গরম গরম তেকোনা পরোটা আর রাতে করা মাংস আর আলুর চপ খেয়ে। "গুণুপন্ডিতে" পিসিমার বাড়িতে ভাইপো-র জন্যে জলখাবার এসেছে রুটি টোস্ট, ডিমভাজা ও চিনি দিয়ে আগের দিনের দুধের সর। ছোটবেলা থেকে পরিবারে যা দেখেছেন, যেমন খাওয়াদাওয়া হয়েছে সেই স্মৃতি সম্বল করে পরিণত বয়সে লিখে ফেলেছেন অত্যন্ত জনপ্রিয় রান্নার বই। রায়বাড়িতে খাওয়াদাওয়ার এমন বৈচিত্র্য ছিল বলেই বোধ হয় খাদ্যরসিক সুকুমার দিতে পেরেছিলেন পেটে খাওয়ার বাইরেও হরেক খাবারের বিপুল সে তালিকা -- "সবে হল খাওয়া শুরু, শোন শোন আরো খায় -- / সুদ খায় মহাজনে, ঘুষ খায় দারোগায়। / বাবু যান হাওয়া খেতে চড়ে জুড়ি -গাড়িতে, / খাসা দেখ 'খাপ খায়' চাপকানে দাড়িতে।"