দিন ফুরোয়, আঁধার বাড়ে। খবর, অঙ্ক, চুটকি, মিম পেরিয়ে মন চলে যায় প্রহসনের দিকে। শতাব্দীব্যাপী প্রহসন।
১)
১৯২৭-এর মার্চ মাস। কিছুকাল আগে সরকার ঘোষণা করেছে, হিন্দুদের মধ্যে জাতের নামে যতই বজ্জাতি থাকুক না কেন, সরকারি কোনো প্রতিষ্ঠান, ইমারত বা পরিষেবায়, বাকি সকলের মত, অচ্ছুৎদেরও অধিকার আছে। মহারাষ্ট্রের (তৎকালীন বম্বে প্রভিন্স) মাহাড়-এর পৌরসভা সে নীতি বলবৎ করার জন্যে স্থানীয় পানীয় জলের ট্যাঙ্কটি ব্যবহার করতে অচ্ছুৎজাতির মানুষদের উৎসাহ দেয়, কিন্তু বর্ণহিন্দুদের বিরোধিতায় তা আর বাস্তবায়িত হয় না।
এমতাবস্থায়, পানীয় জলের ওপর দলিতদের অধিকার কতটা স্বাভাবিক — তা স্থানীয় মানুষকে বোঝাতে বম্বে হাইকোর্টের আইনজীবী আম্বেদকর সত্যাগ্রহ করেন। ২০ তারিখ, রীতিমত সবাইকে জানান দিয়ে তিনি সেই ট্যাঙ্ক থেকে জল পান করেন, অসংখ্য অচ্ছুৎও তা-ই করে।
সঙ্গের বক্তৃতায় আম্বেদকর তীব্রভাবে মনুস্মৃতির বিরোধিতা করেন; বলেন, দীর্ঘদিনব্যাপী দলিত নারীদের আলাদারকমভাবে শাড়ি পরিয়ে ‘আলাদা’ করে রাখার যে প্রথা এতদিন ধরে চলে আসছে, তা বন্ধ করতে মেয়েদের ঠিক ‘উচ্চবংশের’ মেয়েদের মত করেই শাড়ি পরতে হবে। দলিত মেয়েরা এইসময় থেকেই খাটো করে শাড়ি পরা বন্ধ করেন।
ঢি-ঢি পড়ে যায় — “অচ্ছুৎরা জল খেয়ে জল নোংরা করেছে”। ব্রাহ্মণদের বিধান অনুসারে সেই ‘নোংরা’ জলকে পরিষ্কার করতে কী করা হয়? ১০৮ ঘড়া গোবর ও গোমূত্রের মিশ্রণ সেই জলে ঢালা হয়। স্বস্তির নিঃশ্বাস পড়ে — “জল এবার পবিত্র”।[1]
আম্বেদকর আবার সত্যাগ্রহ করার পরিকল্পনা করেন, এবার ২৬-২৭ ডিসেম্বর। কিন্তু বর্ণহিন্দুরা কোর্টে কেস ঠোকে – ‘ট্যাঙ্ক ব্যক্তিগত সম্পত্তি, সেখানে সত্যাগ্রহ চলতে পারে না’। কেসের নিষ্পত্তির আগে কিছু করা সম্ভব না, অতএব, সত্যাগ্রহের বদলে, ২৫ তারিখ তাঁর নেতৃত্বে ‘মনুস্মৃতি’ পোড়ানো হয়। আজও দিনটি ‘মনুস্মৃতি দহন দিন’ নামে পালিত হয় এ দেশের দলিত সম্প্রদায়ের মধ্যে।[2]
লাভ হয়েছিল কি? হ্যাঁ, হয়েছিল। দশ বছর সময় লেগেছিল, কিন্তু ১৯৩৭-এ বম্বে হাইকোর্ট অচ্ছুৎদের ট্যাঙ্ক থেকে জল খাওয়ার অধিকার মেনে নেয়।
২)
১৯৪৯ সাল। সদ্যস্বাধীন ভারতবর্ষের আইনমন্ত্রী আম্বেদকর সবে শিশু ভারতের প্রথম সংবিধানের অন্তিম খসড়াটি গণপরিষদে জমা দিয়েছেন। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের মুখপত্র, ‘The Organiser’-এর ৩০ নভেম্বর সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হল, “ভারতের নতুন সংবিধানের সবচেয়ে খারাপ দিকটি হল, এতে ‘ভারতীয়’ বলে কিছুই নেই। প্রাচীন ভারতের সাংবিধানিক আইন, প্রতিষ্ঠান, নামধাম, রীতিনীতি — এসবের চিহ্নমাত্র এতে নেই।” লেখা হল, “মনুস্মৃতি — যা কিনা স্পার্টার লাইকারগাস বা পারস্যের সোলনের থেকেও পুরোনো — আজও সারা পৃথিবীর প্রশংসা আর ভারতীয় হিন্দুদের স্বতঃস্ফূর্ত বাধ্যতা ও মান্যতার উৎসারের কারণ, অথচ, আমাদের (তথাকথিত) সাংবিধানিক পণ্ডিতদের কাছে তা তুচ্ছ!”
সঙ্ঘের তৎকালীন চালক গোলওয়ালকর তাঁর বক্তৃতায় বলেন, হতেই পারে নিচুজাতের মধ্যে ডিভোর্স-টিভোর্স হয়, কিন্তু তা বলে গোটা ভারতের লোককে তা মানানো সম্ভব নয়। বিয়েশাদির মত ব্যাপারে ভারতে কখনোই বিলেতি মডেল চলতে পারে না - ইত্যাদি। ওই অর্গানাইজারেরই একটি প্রবন্ধে হিন্দু কোড বিল-কে বলা হয়, ‘হিন্দুদের বিশ্বাস, ধর্ম ও সংস্কৃতির ওপর সরাসরি আক্রমণ’। বলা হয়, “... কিছু বিধবা, বিপত্নীক পুরুষ, সন্তানহীনা নারী আর বুড়ো-বর মিলে, আমাদের প্রাচীন নিয়মগুলিকে আলগা করে, কিছু মানুষের ফুর্তির ব্যবস্থা করতে উঠেপড়ে লেগেছে...”
নতুন বিল-এ মেয়েরা নিজেদের স্বামী পছন্দ করতে পারবে, ডিভোর্স করতে পারবে, এমনকি পৈতৃক সম্পত্তিতে অধিকারও পাবে — এমন অনাচার আরএসএস সহ্য করতে পারেনি। শুরু হয় শয়ে শয়ে ধর্না, হরতাল, মিছিল — (মনুস্মৃতি সম্মত) পিতৃতন্ত্র রক্ষার্থে আর বিলের বিরোধিতায় — গুচ্ছের সাধু আর সন্তের বদান্যতায়। মাসের পর মাস চলে এই আক্রমণ।[3]
৩)
সেই পুরোনো লোক, আম্বেদকর। সেই পুরোনো দল, আরএসএস।
নতুন সাল, ২০১৬। নতুন মতামত — ‘মেলাবেন, তিনি মেলাবেন’।
২০১৬-র এপ্রিলে সে-ই অর্গানাইজার-এরই সংখ্যায় প্রচ্ছদ হল — “Ultimate Unifier”। সঙ্গে ছবি — না, মৈত্রেয় বুদ্ধের নয় — আম্বেদকরের। স্তুতির বন্যা বয়ে গেল। ‘গোটা দেশকে জুড়ে রাখার ফেভিকল তিনি সাপ্লাই করেছেন’ থেকে শুরু করে, ‘ব্রাহ্ম-প্রার্থনা-আর্য – সমস্ত সমাজের ভাল ব্যাপারগুলোই তাঁর চিন্তাধারায় বর্তমান’ হয়ে, ‘মোটেই তিনি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে ছিলেন না, ব্রাহ্মণ্যবাদের শ্রেণীবিভাগের বিরোধী ছিলেন’ পর্যন্ত।
হবেই। এর বছরখানেক আগেই, গোলওয়ালকরের উত্তরসূরী, বর্তমান স্বয়ংসেবক-প্রধান, মোহন ভাগবত বলেছেন, যে আম্বেদকর সঙ্ঘের আদর্শেই বিশ্বাসী ছিলেন। শুধু তা-ই নয়, সঙ্ঘের গেরুয়া (ভগোয়া) রঙের পতাকাটিকেই তাঁর দেশের জাতীয় পতাকা করার ইচ্ছে ছিল, আর সংস্কৃতকে জাতীয় ভাষা। এ সমস্তই তিনি নাকি সঙ্ঘী দত্তোপন্ত বাপুরাও থেঙ্গাডি-কে বলেছিলেন।[4]
তা, হয়তো বলেছিলেন, হয়তো বলেননি। কে জানে? আমরা শুধু জানি, মনুস্মৃতি পোড়ানো আম্বেদকর, মুসলিম বাঙালি-প্রেমী (১৯৫০-এর সঙ্ঘের বক্তব্য অনুযায়ী) আম্বেদকর, এই নতুন শতাব্দীতে নতুন রূপে দেখা দিয়েছেন।
এই শতকে আম্বেদকর যে কেবল ভাগবত-মোহন হয়ে উঠেছেন তা-ই নয়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ও তাঁর দল বিজেপি-চোখের মণি হয়ে উঠেছেন। এতই, যে গোটাগুটি বই বেরিয়ে গেছে এঁদের নিয়ে।[5] ভূমিকায় দক্ষিণী সঙ্গীত পরিচালক ইলিয়ারাজা সরাসরি তুলনাই করে বসেছেন মোদির সঙ্গে আম্বেদকরের।[6]
৪)
এইখানে আমরা একটু পিছিয়ে গিয়ে দেখতে পারতাম ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গায় কী হয়েছিল, ২১ বছরের বিলকিস বানো কে ছিলেন, কীভাবে তাঁর দলধর্ষণ[7] হয়েছিল, কীভাবে এবং কোন হিন্দু ইতরেরা তাঁর পরিবারের ১৪ জনকে খুন করে তাঁর চোখের সামনে, কতদিন লাগে তাঁর বিচার পেতে, কতজন শাস্তি পায় এই নারকীয় অপরাধের, আর কতজন প্রমাণাভাবে খালাস পায়।
এসব আমরা বিস্তারিত দেখতেই পারতাম, কিন্তু সে গল্প আজকের নয়, তার জন্যে অন্য জায়গা আছে।[8]
আমরা বরং এগিয়ে আসি কয়েকবছর, এই চলতি সময়ে।
সাল ২০২২। বিলকিস বানোর ১১ জন ধর্ষককে গুজরাত সরকার স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্তিতে মুক্তি দেয়। অনেক ছিঁচকে চোরও মুক্তি-টুক্তি পায়নি কিন্তু। মুক্তির সপক্ষে গুজরাত সরকার কিছু যুক্তি-জাতীয় দেখানোর চেষ্টা করেছে - যুক্তির বদলে সেগুলির সঙ্গে বেদো-বাচ্চার ফালতু অজুহাতের মিল বেশি। তারও খতিয়ানে আমরা যাবো না।
কোন মধ্যযুগে পড়ে থাকা দেশে এই ধর্ষকদের জেল থেকে বেরোনোর পর এক রাজনৈতিক দলের তত্ত্বাবধানে ফুল-মিষ্টি দিয়ে হৈ হৈ করে বরণ করা হয় - সে উত্তেজক আলোচনাতেও আমরা যাবো না।
আসল ক্ষীর-খবর হল – এই মুক্তির সিদ্ধান্ত যে প্যানেলটি নিয়েছে, তার একজন - গোধরার বিজেপি এমএলএ সি কে রাউলজি, ক্যামেরার সামনে, নিজের ও প্যানেলের সিদ্ধান্তের সপক্ষে বলেছেন, “ওরা ব্রাহ্মণ, ভাল সংস্কার আছে ওদের। জেলে ওদের ব্যবহার খুব ভাল।”[9]
পরদিন তিনি আবার সে কথা ঘুরিয়ে বলেছেন, ধর্ষকের কোনো জাত নেই।[10]
১১ জন মুক্তিপ্রাপ্তর মধ্যে মাত্র ৩ জন ব্রাহ্মণ ছিলেন।[11] সে কথা ওঁকে কেউ বলে দেয়নি। উনি শুধুই, ‘আধুনিক আম্বেদকর’-এর পার্টির সদস্য হিসেবে, সেই প্যানেলে বসে, লোকগুলির ‘ব্রাহ্মণত্ব’ নিয়ে নিশ্চিত হয়ে তাদের মুক্তির সুপারিশ করেছিলেন। কে জানে, নারীধর্ষণ করলে, মুসলিম মারলেই তাঁর চোখে ‘জাতে ওঠা’ যায় কিনা?
আম্বেদকরের রসবোধ কেমন ছিল জানি না, তবে যারপরনাই সিরিয়াস মানুষ হলেও, এ প্রহসনে তিনিও না হেসে পারতেন না মনে হয়।
[1] উইকি লিঙ্ক
[2] উইকি লিঙ্ক
[3] ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের লিঙ্ক
[4] ইন্ডিয়া টুডে-র লিঙ্ক
[5] গুগল বুকস
[6] দ্য প্রিন্টের লিঙ্ক
[7] গুরু-র লিঙ্ক (কেন ‘গণধর্ষণ’ নয়)
[8] দ্য হিন্দু-র লিঙ্ক
[9] স্ক্রোল-ডট-ইন-এর লিঙ্ক। সেখানে ভিডিও-টিও আছে।
[10] দ্য প্রিন্ট-এর লিঙ্ক
[11] দ্য প্রিন্ট-এর লিঙ্ক