এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  রাজনীতি

  • ১৯২৪ থেকে ২০২৪---- ১০০ বছরের বিজেমূল তত্ত্ব

    Barnali Mukherji লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | রাজনীতি | ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯০২ বার পঠিত | রেটিং ৪ (১ জন)
  • ঠিক একশো বছর আগে কম্যুনিস্ট নেতা জিনোভিয়েভ বলেছিলেন, কম্যুনিস্ট দলগুলির দরজায় ‘তালা’ মারা হবে, কড়া পাহারা বসবে যাতে ভোট-জোটের নামে বেনোজল না ঢোকে!! সত্যিই আমাদের দোকানে আজ তালা। মার্ক্সবাদের দফা রফা করে 'শ্রেণীর বিরুদ্ধে শ্রেণী'-র মত এক অবাস্তব অবৈজ্ঞানিক স্লোগান কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে ধুলিস্যাত করেছে, আজও করে চলেছে। ফ্যাসিস্টদের পায়ে ইয়োরোপের কম্যুনিস্টদের বলি দেওয়া হয়েছে। যদিও ইংল্যান্ড ফ্রান্সের ন্যক্কারজনক মিউনিখ চুক্তির চক্রান্তকে ধুলিস্যাৎ করে সোভিয়েত ইউনিয়নের আত্মত্যাগ হিটলারদের পরাজিত করেছিল, কিন্তু গত ১০০ বছরের ইতিহাস দেশে দেশে ক্ষমতার কাছাকাছি যেতে যে সুযোগগুলো দিয়েছিল আমরা সেগুলোর অধিকাংশ গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছি।

    ১০০ বছর আগে 'বিজেমূল তত্ত্ব' কম্যুনিস্ট আন্দোলনে আনুষ্ঠানিকভাবে গৃহীত হয়েছিল ১৯২৪ সালে, কমিন্টার্নের পঞ্চম কংগ্রেসে ---- ফ্যাসিস্ট যা, সোশ্যাল ফ্যাসিস্টও তাই। কিন্তু এর বীজ রোপন করা হয়েছিল ১৯১৮ সালেই। ২০২১ সালের মতই সেদিনও বিজেমূল তত্ত্বের ঘোরতর বাস্তবতা ছিল। জার্মানিতে ক্ষমতায় থাকা সমাজতন্ত্রীদের হাতেই মৃত্যু হয়েছে রোজা লুক্সেম্বুর্গ, কার্ল লিবনেক্টদের। শ্রমিক আন্দোলনকে দমন করার জন্য ফ্যাসিস্টদের ভিত্তি ফ্রাই কর্পস দের ডেকে এনেছিল ইবার্ট সরকারই। ভাইমার আমলেই হু-হু করে বেকারত্ব বেড়েছে। ডয়েচমার্ক মূল্যহীন হয়েছে। আর এই বাস্তবতা শুধু জার্মানিতে নয়, প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী ইয়োরোপের প্রতিটা দেশেই ছিল। ফলে সমাজতন্ত্রীদের কম শত্রু ভাবা অত সোজা ছিল না। কিন্তু কম্যুনিস্ট আন্দোলন করতে এসে স্বতঃস্ফুর্ততার অজুহাত দেওয়া যায় না। তাই এক কথায়, সেদিনে বিজেমূল তত্ত্ব শুধু ভুল নয়, অপরাধ ছিল। কমিন্টার্ন ফতোয়া দিল, আর দেশে দেশে কম্যুনিস্ট পার্টির মধ্যে ‘লুকিয়ে থাকা’ সোশ্যাল ফ্যাসিস্টদের খুঁজে খুঁজে চিহ্নিত করে তাদের বহিষ্কার করা শুরু হল। যদিও মুখে ফ্যাসিস্ট আর সোশ্যাল ফ্যাসিস্টদের সমান শত্রু বললেও, বাস্তবে ফ্যাসিস্টরাই হয়ে উঠলো better evil।  

    ১৯২৪ সালে, কমিন্টার্ণের পঞ্চম কংগ্রেসে সভাপতি জিনোভিয়েভ ঘোষণা করলেন যে আক্রমণের মূল লক্ষ্য হোক সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা, যারাও এক ধরনের ফ্যাসিস্ট। বরং সরকারে থাকার ফলে বেশী শত্রু। ১৯২৭ সালের মধ্যেই ইয়োরোপের দেশে দেশে পার্টিগুলি টুকরো টুকরো হয়ে গেল। ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের নির্বাচনে কম্যুনিস্ট দলগুলিকে একলা চলার নির্দেশ দেওয়া হল। ১৯১৯ সালের বিচিত্র ২১ টি নিয়মাবলী দলগুলির হাত পা বেঁধে দিয়েছিল। খেয়াল রাখতে হবে এমনকি সুদূর চীনে দক্ষিণপন্থীদের সাথে যুক্তফ্রন্ট নিয়ে কেন যথেষ্ট আপত্তি তুলছে না কমিন্টার্ন, তাই নিয়ে ১৯২৭ সালে শোরগোল উঠেছিল!

    দলীয় ঐক্য মুর্দাবাদ, শ্রেণী ঐক্য জিন্দাবাদ--- এই স্লোগান আসলে বিরোধী পক্ষের গোপন জোটকে সাহায্য করলো। এক কথায় বললে ফ্যাসিস্টদের সাথে বন্ধুত্ব করার সুযোগ করে দিল। জার্মানিতে লোকের মুখে মুখে ফিরতো লাল-খয়েরী (রেড-ব্রাউন) জোটের কথা। ভাইমার সরকার, বা সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটদের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্ট আর নাজিরা একসাথে চলেছিল। গণ আন্দোলন থেকে আঞ্চলিক সরকার গঠন পর্যন্ত। কুখ্যাত রেড-ব্রাউন রেফারেন্ডাম সরকারের কথা আমরা জানি।  আবার ১৯৩২ সালে, ভোটের ঠিক আগে ইতিহাসের মোড় ঘোরানো একটি পরিবহন ধর্মঘটে, নাজি আর কম্যুনিস্টরা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তায় নামে। সেই ধর্মঘট রক্তাক্ত হয়ে ওঠে। কম্যুনিস্টরা তখন মনে করছে অভ্যুত্থানের পরিস্থিতি এসে গেছে। ফলে অভ্যুত্থানে তারা নাজিদের তলাকার জনসমর্থনকে পেতে চাইছিলেন।  তবে শুধু জার্মানি নয় এরকম উদাহরণ সেই সময় ইয়োরোপ জুড়েই দেখতে পাওয়া গেছিল। ১৯৩৪ সালে, দিমিট্রভের লাইন আসার আগে, ফরাসী সরকারের বিরুদ্ধে, ফরাসী সংসদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র ফ্যাসিস্টরা মিছিল করে যায়, আর তাদের পাশে পাশে হাঁটে কম্যুনিস্ট বাহিনি। ফরাসী কম্যুনিস্ট পত্রিকায় স্পষ্ট বলা হয় যে বুর্জোয়া সংসদের উপর যে কোনো হামলাকেই তারা সমর্থন করেন। এই হামলার উপর যদি কোনো সরকারি আক্রমণ নামে তবে প্রমাণিত হবে যে আসলে এই সরকার ফ্যাসিস্ট!!! এর চার দিনের মাথাতেই সোশ্যাল ডেমোক্র্যাটরা একটি যৌথ জমায়েত করার প্রস্তাব কম্যুনিস্ট নেতা কমরেড থোরেজকে দেন, সম্ভাব্য ফ্যাসিস্ট অভুত্থানের বিরুদ্ধে। কিন্তু কমরেড থোরেজ প্রস্তাব ফিরিয়ে দেন। তলা থেকে প্রচুর চাপ আসায় তারা রাজী হয়, কিন্তু তা আনুষ্ঠানিক করতে রাজী হয় না। যদিও কোনো যৌথ ঘোষণাপত্রে সই করতে ফরাসী পার্টি রাজী হয় না। ১৯৩৪ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয় সমাজতন্ত্রী কম্যুনিস্টদের যৌথ স্বাক্ষর পেতে। বিজেমূল তত্ত্বের চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটিয়ে সুইডিশ সমাজতন্ত্রী দল জার্মানির সাথে বোঝাপড়া করে চললো। যুদ্ধে বা ইহুদী চালানে সাহায্য করেছিল। সুইডিশ কম্যুনিস্টদের তারা বেশী শত্রু বলে মনে করেছিল। 

    প্রশ্ন হল, দিমিট্রভ লাইন কি দশ বছরের নিজেদের অপরাধকে নাকচ করেছিল? পুঁজিবাদ টিকে থাকলেই ফ্যাসিবাদ ফিরে আসবে। দিমিট্রভ লাইন কি ভবিষ্যতের বামপন্থীদের হাতে ফ্যাসিবাদকে মোকাবিলা করার অস্ত্র তুলে দিতে পেরেছিল? নির্দ্বিধায় বলা যায়, পারেনি। ইয়োরোপ জুড়ে ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর কমিন্টার্নের হুঁশ ফিরেছিল, দিমিট্রভ ফ্যাসিবিরোধী জোট করতে বললেন। কিন্তু ফ্যাসিস্টদের ক্ষমতায় আসা রুখতে ভবিষ্যতের কম্যুনিস্টদের জন্য কি শিক্ষা দিয়ে গেল ওই থিসিস? যখন ফ্যাসিস্টরা বিরোধী পক্ষ, যখন জনগণ ক্ষমতায় থাকা দলের থেকে পরিত্রাণ পেতে মরীয়া তখন সেই ক্ষমতায় থাকা পচনশীল দলের সাথে জোট করে ফ্যাসিস্টদের অভ্যুত্থানকে রোখার স্পষ্ট নির্দেশ কি দিতে পেরেছেন দিমিট্রভ? না পারেননি। ফ্যাসিস্টরা ক্ষমতায় আসার আগেই জোটের নিশ্চয়তা পাওয়া গেল না। সেই উওর দিতে হলে ১৯২২ সালের চতুর্থ কংগ্রেসকে স্বীকৃতি দিতে হতো। এবং সেই কংগ্রেসের সীমাবদ্ধতাকে টপকে যেতে হতো। 

    ১৯২২ সালের চতুর্থ কংগ্রেস কম্যুনিস্ট আন্দোলনের এগোনোর বিরাট সম্ভাবনা খুলে দিয়েছিল। লেনিনের এই শেষ বিরাট মাপের অবদানকে ভুলে গেছি আমরা। এই কংগ্রেস ছিল বিতর্কের কংগ্রেস। লেনিন সহ বলশেভিক নেতাদের মধ্যে বিতর্ক হয়েছে, অন্য দেশের নেতারাও বিতর্কে জড়িয়েছিলেন। যার মধ্যে কয়েকটি গুরত্বপূর্ণ নাম হল আর্নস্ট মায়ার, রুথ ফিশার, বোরদিগা, ক্লারা জেটকিন, বেলা কুন, সেরাতি। যে লেনিন ১৯১৯ সালে নিজের হাতে অনুশাসনের ১৯টি পয়েন্ট লিখেছিলেন এবং ইতালীয় বিজেমূলপন্থী বোরদিগার আবদারে আরও দুটো শৃংখল যুক্ত করেছিলেন,  এই কংগ্রেসে সে সব খড়কুটোর মত ভেসে গেলো। এই কংগ্রেস প্রায়শ্চিত্ত করার কংগ্রেস। কমিন্টার্নের জন্ম থেকে ইয়োরোপের বাম হঠকারী লাইনকে যেভাবে ধারাবাহিক প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, তার ভুল সংশোধন করার কংগ্রেস।
     
     ১৯১৮-১৯২২--- ‘বিজেমূল’ তত্ত্বের গোড়াপত্তনের বহিঃপ্রকাশ

    প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর ইয়োরোপ বিপ্লবের দোরগোরায় ছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও রোজা লুক্সেমবুর্গ ভোট বয়কট করে অভ্যুত্থানের ডাক দিতে চাননি। রোজা যেখানে ১৯১৮ সালে অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কথা বলছেন, রাদেক বলশেভিক দায়িত্ব প্রাপ্ত প্রতিনিধি হয়ে যদি তাঁর অবস্থানকে জোর দিয়ে সমর্থন করতেন তবে কি সেই অভ্যুত্থান হতে পারতো? প্রায় রাষ্ট্রহীন ইবার্ট সরকার যখন নির্বাচনের ডাক দিচ্ছে, যখন অন্যদিকে ফ্যাসিস্ট ফ্রাইকর্পসদের রাস্তায় নামাতে চাইছে ইবার্ট, তখন অভ্যুত্থানের ডাক দেওয়া হল! আবার ইতালিতে যখন সমাজতন্ত্রী দল ভাঙতে চাইছে না পার্টির অনেকেই, দল তিন খন্ডিত হচ্ছে এই প্রশ্নে, তখন অভ্যুত্থানের সময় হয়েছে বলে দল ভাঙার জন্য রীতিমত পীড়াপীড়ি করলো কমিন্টার্ন। ইয়োরোপের প্রতিটা দেশেই এই নির্দেশ। দল ভাঙতে হবে। সমাজতন্ত্রী ইবার্ট সরকার সহজেই ফ্রাই কর্পসদের হাতে ক্ষমতা তুলে দিল। যদিও হাঙ্গেরীতে সমাজতন্ত্রীদের সাথে জোট সরকার অতি স্বল্প সময়ের জন্য হলেও  কম্যুনিস্টরা প্রতিষ্ঠা করেছিল। সেখানে যদিও কমিন্টার্ন কোনো আপত্তি তোলেনি। ১৯২০ সালে প্রতিক্রিয়াশীল কাপ (kaap putsch) অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে সমাজতন্ত্রী ও সাম্যবাদীদের বাস্তব জোট হওয়া মাত্র কম্যুনিস্ট আন্তর্জাতিকে নাক সিঁটকানো শুরু হয়েছিল। যদিও সমস্ত আপত্তি উড়িয়ে এই কাপ অভ্যুত্থানকে পরাজিত করে এক ফ্যাসিবিরোধী আঞ্চলিক সরকার গঠিত হল। ক্ষমতায় থাকা সমাজতন্ত্রীদের কুখ্যাত ট্রেড ইউনিয়ন নেতা কার্ল লাইজেন সেদিন এই ধর্মঘটেরর নেতৃত্ব দিচ্ছেন, এবং পরে তিনিই যৌথ শ্রমিক সরকারের প্রস্তাবও দিলেন। দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হল ওই সময় তাকে গালিগালাজ করে লাইজেনের বিরুদ্ধে কম্যুনিস্টদের রুখে দাঁড়াতে উৎসাহিত করলেন এমনকি লেনিন নিজেই। কম্যুনিস্টরা কেন দ্রুত লাগাম হাতে নিতে পারছেন না তা নিয়ে ভর্ৎসনা করা হল। পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি ১৩ই মার্চ ঘোষণা করেছিল যে তারা হেরে যাওয়া সমাজতন্ত্রী সরকারের পক্ষে একটা আঙ্গুলও নাড়বেন না!! (“to lift a finger for the democratic republic”) যদিও কয়েকদিনের মধ্যেই সাধারণ শ্রমিকদের ধর্মঘটে উৎসাহ ও সক্রিয়তা দেখে কমিন্টার্ন ঢোঁক গিলতে বাধ্য হয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত lesser evil ইবার্ট সরকারকে রক্ষা করার এই প্রতিরোধকে শুভেচ্ছা জানিয়েছিলেন, the tactics adopted was beyond doubt fundamentally correct । জার্মান কম্যুনিস্ট পার্টির নেতা ব্র্যান্ডলার যেভাবে ঐ প্রতিরোধে সামিল হয়েছিলেন, সকলকে জড়ো করেছিলেন, তার জন্য এতটুকুও অভিনন্দন জানানো হল না তাঁকে। এমনকি জার্মান দলের কেন্দ্রীয় কমিটি যখন ওই ফ্যাসিস্ট কাপ ক্ষমতার বিকল্প যে সরকার প্রতিষ্ঠা পেয়েছে তার সাথে অবৈরিমুলক দ্বন্দ্বের সম্পর্ক (loyal opposition) রাখার কথা ঘোষণা করলো তখন কমিন্টার্ন রাগে ফেটে পড়লো। বেলা কুন বললেন, the democratic counter revolution in Germany found an anti democratic competitor…..। এই সিদ্ধান্ত নিতে এত দেরী হওয়ার কথা ছিল না কারণ বলশেভিকরা নিজেরা কর্নিলভের বিরুদ্ধ্বে সশস্ত্র ভাবে কেরেন্সিকে রক্ষা করেছিলেন! ইতিহাসের অনেক দুর্ভাগ্য তখনো বাকি। ১৯২২, ১৯২৩ সালে স্যাক্সনিতে সমাজতন্ত্রীরা নিজেদের দলের মধ্যে চাপের মুখে পড়ে কম্যুনিস্টদের প্রস্তাব দিল, জোট সরকার গঠন করার। ন্যূণতম কর্মসুচীর ভিত্তিতে। থালহাইমারের মত নেতারা রাজী ছিলেন। কিন্তু কমিন্টার্ন রাজী হলনা। ফলে জোট ভেঙে গেল। যা হলে ইতিহাস হয়তো অন্য খাতে বইতো। ইতালির দিকে তাকানো যাক। মুসোলিনি ক্ষমতায় যাওয়ার মাত্র কয়েক মাস আগেও দক্ষিণপন্থীদের মূল শত্রু ভাবেনি সেখানকার বিজেমূলপন্থী সমাজতন্ত্রী এবং সাম্যবাদীরা। যখন একটি বাস্তব প্রতিরোধ বাহিনি গড়ে উঠলো, ‘আরদিতি দেল পোপোলো’ নামে, তখনও সাম্যবাদীরা তার বিরোধিতা শুরু করলো আর সমাজতন্ত্রীরা দক্ষিণপন্থীদের সাথে হাত মেলালো। কমিন্টার্নও আরদিতির বিরোধিতা করলো। একমাত্র লেনিন এই গণ আন্দোলনের প্রশংসা করলেন, যদিও তিনি ভেবেছিলেন যে এটি সাম্যবাদীদের নেতৃত্বে হচ্ছে (জার্মান কম্যুনিস্টদের দেওয়া চিঠিতে ইতালি সম্পর্কে উল্লেখ করেছেন, সত্যটা জানলে কি বলতেন তা নিয়ে সংশয় থেকেই যায়)। বিজেমূলপন্থীদের অন্যতম প্রবক্তা জিনোভিয়েভ ফ্যাসিবাদের উত্থানের পরেও বলছেন যে ফ্যাসিস্টরা প্রকৃত বিপদ নয়, তারা “প্রহসন। কয়েক মাস, বড়জোর কয়েক বছর থাকবে, তার পর চলে যাবে। আর এই পরিবর্তন আমাদের খুব ক্ষতি করবে না”। ওদিকে আর এক বিজেমূলপন্থী ইতালীয় কম্যুনিস্ট নেতা বোরদিগা বলছেন, “তৎকালীন সোশ্যাল ফ্যাসিস্ট শাসনের তুলনায় মুসোলিনিরা গণতান্ত্রিক হবে”। 

    কমিন্টার্নের এই শিশুসুলভ বিশৃংখলার কারণ ছিল অবশ্যই। রুশ কম্যুনিস্টরা নিজেদের বিপ্লব বাঁচাতে মরীয়া। সাতটি সাম্রাজ্যবাদী দেশ চারিদিক থেকে তাদের ঘিরে ধরেছে। উপরন্তু রুশ সরকারের কোনো সৈন্য বাহিনি নেই। ‘রাষ্ট্র ও বিপ্লব’এর আলোচনার ধারাবাহিকতায় তারা পাকাপোক্ত সেনা রাখবেন না,  ফলে এখন বিপ্লবের দোহাই দিয়ে রণক্লান্ত সৈনিকদের ফ্রন্টে ফেরত পাঠানো সম্ভব নয়। জার্মান সরকারের অন্যয্য দাবীর কাছে হার স্বীকার করে ব্রেস্ট লিতভস্ক চুক্তি সম্পাদন করতে হয়েছিল রুশ শিশু সরকারকে। তখন তাদের একটাই আশা। ইয়োরোপে, অন্তত জার্মানিতে বিপ্লব হোক। বিপ্লব না হলেও অন্তত অভ্যুত্থান হোক। সেই আশার একটি চিত্র তুলে ধরেছেন রাশিয়ায় কয়েকমাস কাটানো এক ইংরেজ সাংবাদিক। ব্রেস্ট লিত্‌ভস্ক চুক্তিতে সই করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে একটি বৈঠকে, যেখানে এই ইংরেজও উপস্থিত। খবর এলো যে জার্মানির কোনো একটি আন্দোলন ফেটে পড়েছে। অমনি ঘরভর্তি বলশেভিকরা নাকি বিপুল উল্লাসে ফেটে পড়ল। সাত দেশের নতুন সরকার এসে সোভিয়েতের সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলুক। ইয়োরোপে অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টা কোনোভাবেই বাতিল বা স্তিমিত না হয়। ফলে সমাজতন্ত্রীদের সাথে কোনো ধরনের সম্পর্ক রাখুক ইয়োরোপের সাম্যবাদীরা, তা রুশ পার্টির নেতৃত্বে চলা কমিন্টার্ন ও তার নেতা লেনিন কিছুতেই চান নি। যার পরিণতি, বিশ্ব বিপ্লবের নামে শিশুসুলভ বিশৃংখলাকে প্রশ্রয় দেওয়া। বৃটিশ সাম্যবাদী সিল্ভিয়া প্যঙ্ঘার্স্টকে লেখা তাঁর চিঠিটি এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত উদাহরণ, I have no doubt at all that many workers who are among the best, most honest and sincerely revolutionary members of the proletariat are enemies of parliamentarism and of any participation in Parliament….I am personally convinced that to renounce participation in the parliamentary elections is a mistake on the part of the revolutionary workers of Britain, but better to make that mistake than to delay the formation of a big workers’ Communist Party in Britain out of all the trends and elements, listed by you, which sympathise with Bolshevism and sincerely support the Soviet Republic. যদিও এই চিঠিতেই তিনি এর বিপরীত কথাও লিখেছেন। ইয়োরোপ জুড়ে তখন বেলা কুন, বোরদিগাদের দাপট। যদিও ইতালি, ফরাসী ও জার্মান দলে বিরোধ ছিল। এই বিজেমূলী অবস্থান না নিলে ইতালিতে মুসোলিনি জিততে পারতো না, জার্মানিতেও হিটলার জিততে পারতো না। 

    লেনিন কিন্তু ১৯২০ সাল থেকেই নিজেদের ভুল বুঝতে শুরু করলেন। ইয়োরোপের সমস্যা বুঝতে শুরু করেছিলেন। তিনি ১৯২০ সালের জুলাই মাসে ইংল্যন্ডের কম্যুনিস্টদের বললেন “we would put up candidates in a very few but absolutely safe constituencies, namely constituencies where our candidates would not give any seats to the liberals at the expense of labour candidates’। কাপ অভ্যুত্থান বিরোধী প্রতিরোধকে সমর্থন জানালেন, একটু দেরী করে হলেও। এবং সবচেয়ে বড় কথা জার্মান ও ইতালীয় বাস্তব যুক্ত ফ্রন্টের অভিজ্ঞতা দেখে ১৯২১ সালের ডিসেম্বরেই কমিন্টার্ন এক্সিকিউটিভ কমিটি জোটের লাইন গ্রহণ করল। ১৯২২ সালের পুর্ণ সভাতে যা ফেলা হল।

    অনস্বীকার্য যে দৃঢ়তা নিয়ে এই লাইন গ্রহণ করার কথা ছিল তা করেনি কমিন্টার্ন। ১৯২০ সালে প্যাঙ্ঘার্স্টদের বিরুদ্ধে কলম ধরলেও  ‘দেখো মামনি তোমাদের আবেগকে স্যালুট জানাই, কিন্তু রাজনীতিটা বুঝতে হবে তো’ গোছের ভাষা ব্যবহৃত। লেনিনসুলভ নির্দয়তার অভাব লক্ষণীয়। ১৯২০ সালের জুন মাসেই (শিশুসুলভ বিশৃংখলা লেখার একই মাসে) লেনিন লিখলেন সাম্রাজ্যবাদ, পুঁজিবাদের উচ্চতম পর্যায়-র দ্বিতীয় ভূমিকা। সেখানেও ভোট-জোট বিরোধি, বিজেমুলীয় নেতাদের ফ্যাসিবাদপ্রেমী যুক্তিকাঠামোর প্রতি নরম তিনি। যতই বলশেভিকরা ১৯২১ সালের ডিসেম্বরে সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকুন যে ফ্যাসিবাদ বিরোধী জোট মানে শুধু তলাকার তথাকথিত শ্রেণী জোট নয়, তা ওপরতলার দলীয় জোট, নেতাদের জোট, তবু বোরদিগা, রুথ ফিশার, এর মত নেতারা বিরাট আপত্তি তুলেছেন দলীয় জোট গড়ে তোলার ক্ষেত্রে। তবু জিনোভিয়েভ তার জবাবী ভাষণে সেই প্রলাপ, অদলীয় শ্রেণী জোটের, উপরই জোর দিলেন। লেনিন যে নতুন করে  ভাবছেন তা বোঝা গেল যখন জোটের স্বার্থে তিনিই শাসক সমাজতন্ত্রীদের সম্পর্কে যে ভাষা খসরায় ব্যবহৃত হয়েছিল (বিশ্বপুঁজিবাদের ম্যানেজার) তা বাদ দিতে বললেন। সাবধান করলেন যে এই বাক্য দেখিয়েই সমাজতন্ত্রীরা জোট ভেঙ্গে দেবে বা আদৌ করবেই না। যদিও লেনিন নিজেই এর থেকেও কঠোর শব্দ ব্যবহার করেছেন সয়ামজতন্ত্রীদের সম্পর্কে আগের তিন বছরে। লেনিন বললেন যে রুশ কম্যুনিস্টরা নিজেরাও পরিস্থিতি বিচার করে কখনো জোট, কখনো ভোট, কখনো আপোষে চলেছিলেন। কাপ অভ্যুত্থানকে কর্নিলভ প্রতিক্রিয়ার সাথে তুলনা করলেন। তবে রাশিয়ায় বাস্তব পরিস্থিতির পরিবর্তন লেনিনকে দৃঢ় হতে সাহায্য করেছিল। রাশিয়াতে নয়া আর্থিক নীতি প্রচলন, বিদেশী ধনতান্ত্রিক দেশের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে সফল হওয়া, বিশেষত পোল্যান্ড যুদ্ধে তাদের পরাজয়, আর বিদেশী বিনিয়োগ আনার চেষ্টা--- সবই লেনিনকে ও কমিন্টার্নকে ১৯-২০-২১ সালের বিজেমূলীয় অবস্থান বাতিল করতে সাহায্য করেছে।

    ১৯২২ সালের কংগ্রেসে ইয়োরোপের প্রথম সারির কম্যুনিস্ট প্রতিনিধিদের তরফ থেকে উঠে আসা প্রশ্নগুলি নিয়ে চর্চা হলে ভবিষ্যত কম্যুনিস্ট আন্দোলনের উপকার হতো। প্রশ্ন গুলি কেমন ছিল? দেখা যাক, 
    •  সাম্যবাদী-সমাজতন্ত্রী জোট কি সাময়িক? একদিকে বেলা কুন বা ভারগার মত বিজেমূলপন্থী আর অন্যদিকে ক্লারা জেটকিন, রাদেক রা বা বুলগেরিয়ার কম্যুনিস্টরা। যারা বাস্তবে যুক্ত ফ্রন্ট গড়ে তুলেছিল, বলেই কমিন্টার্ন বাধ্য হয়েছিল এই নীতি গ্রহণ করতে। সমাজতন্ত্রীরা বুর্জোয়া দলের বাম অংশের সঙ্গে জোট চাইছে। আর কম্যুনিস্টরা শুধু সমাজতন্ত্রীদের সাথে, এমন একটা জটিলতা নিয়েও আলোচনা হয়েছিল। মাথায় রাখতে হবে তখন সমাজতন্ত্রীদের শুধু দক্ষিণপন্থীই নয়, একেবারে ফ্যাসিস্ট সরকার বলা হচ্ছে।  
    • জোট শুধু সমাজতন্ত্রী-সাম্যবাদী হবে নাকি বাম ও দক্ষিণপন্থীও হতে পারে? কাপ অভ্যুত্থানের প্রসঙ্গ আগেই তুলেছি। লাঞ্জিয়েনের নেতৃত্বে সমাজতন্ত্রীরা একটি সাংবিধানিক সংসদীয় মডেলের বাম-অবাম সরকার চাইছিল। কম্যুনিস্টদের মধ্যে বিভাজন দেখা দিল। অন্যদিকে ফ্রান্সে বাম-দক্ষিণপন্থী জোট হয়েছিল, ফ্রান্স নিয়ে জিনোভিয়েভ বলার চেষ্টা করেন যে ওটা ফ্রান্সেরই বৈশিষ্ট।
    • জোট সরকারকে দেরী না করে দ্রুত অভ্যুত্থানের হাতিয়ারে পরিণত করতে হবে?  ১৯২৩ সালে শেষে কম্যুনিস্টরা স্যাক্সনিতে জোট সরকারে প্রবেশ করলো। কিন্তু অভ্যুত্থানের ঘোষিত উদ্দেশ্যের ফলে সেই সরকার টিকলো না। সরকার ভেঙে গেল। শ্রমিক সরকার কি ধরনের কাজ করবে? সেই প্রশ্নের উত্তরে বলা হল যে তারা শ্রমিকদের সশস্ত্র করবে, বড়লোকদের উপর কর বসাবে, কলকারখানাগুলোতে শ্রমিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা হবে, ইত্যাদি। সশস্ত বাহিনির সুরক্ষিত পাহারায় তৈরী হবে এই সরকার। যদিও লেনিন মনে করেছেন। pro-capitalist Labour government would enable workers ‘to be convinced by their own experience’ that the Labour leadership was ‘absolutely good for nothing’ কিন্তু এই উদ্দেশ্য সম্পন করতে হলে কম্যুনিস্টদের সংস্কার কর্মসুচী দরকার। শ্রমিকদের সশস্ত্র বা নিরস্ত্র যার মুখ্য বিষয় হতে পারে না। আর্থিক-সামাজি-সাংস্কৃতিক সংস্কারের কর্মসূচির অভাব লক্ষণীয়। অন্যদিকে ট্রটস্কি ৬ মাসের মধ্যে অভ্যুত্থানের পরামর্শ দিলেন, সংস্কার বিরোধিতার চূড়ান্ত বার্তা।কমিন্টার্ন সিদ্ধান্ত নিল যে তারা বুর্জোয়া সরকার আর শ্রমিক সরকারের মধ্যে পার্থক্য টানবে। ১৬ই নভেম্বর লেনিন-ট্রটস্কি-বুখারিন-জিনোভিয়ে, সকলেই একমত ছিলেন যে সরকারে যাওয়া উচিত না। কিন্তু এক মাসের মধ্যেই তারা মত বদলালেন। তবে অনেক শর্ত সাপেক্ষে। সরকারে গেলেও দ্রুত অভ্যুত্থান করতে পারবে, এটাই হাতিয়ারে পরিণত হবে ইত্যাদি। জার্মানির উদাহরণ টেনে বলা হল যেহেতু কেন্দ্রীয় বার্লিন সরকার বুর্জোয়া আর স্যাক্সন সরকারের সীমিত ক্ষমতা। এমনকি প্রথম দুটো খসড়ায় এই শ্রমিক সরকারকে একনায়কতন্ত্র বলা হল। জিনোভিয়েভ বললেন যে এই সরকার তৈরী হবে বুর্জোয়াদের উচ্ছেদ করে। ক্রমে বিতর্ক বাড়তে লাগলো। কাপ অভ্যুত্থানের পর যে সরকার হল, সেটা ঠিক কি? বুর্জোয়া একনায়কতন্ত্র নাকি শ্রমিক শ্রেণীর একনায়কতন্ত্র? লেনিন জুন মাসে ১৯২০ সালে যেহতু জার্মান কম্যুনিস্টদের শর্তসাপেক্ষ সমর্থনকে সীলমোহর লাগিয়েছেন ফলে আপাতত আর কেউ কিছু বলল না। কিন্তু এক বছর পর মার্চ মসের অভ্যুত্থানের প্রচেষ্টার পরে আবার বিতর্ক সামনে আসে। ভাইমার সরকারের হাতে বহু হত্যার পর। যদিও কয়েক মাস পরে রাদেক আবার সেই হত্যাকারীদের সাথেই জোটের পক্ষে সওয়াল করতে শুরু করেন। জিনোভিয়েভ বললেন যে স্লোগানকে সাধারণভাবে ব্যবহার করা অনুচিত। সরকার গঠন সত্ত্বেও অভ্যুত্থান দরকার হবে, বললেন তিনি।
    • জোট সরকারকে বাইরে থেকে সমর্থন যদি বা দেওয়া যায়, সেই সরকারে অংশ কি নেওয়া সম্ভব? 
    • এই সরকার ভোটের মধ্য দিয়ে সরকার নাকি অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে সরকার? এমন নয় যে সরকার শব্দটা না জেনে ব্যবহার করা হয়েছে। বোরদিগা সতর্ক করলেন যে এই স্লোগান শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে এমন ধারণা তৈরী করবে বুঝি বা সশস্ত্র ক্ষমতা দখলের আর দরকার নেই! ট্রটস্কি বললেন যে স্যাক্সনিতে সরকারে কম্যুনিস্টদের অংশগ্রহণ করা সমীচন তখনই যদি তারা নিজেদের মন্ত্রীদের ব্যবহার করে আগামী ৬ মাসের মধ্যেই অভ্যুত্থান ঘটাতে পারেন! অর্থাৎ এই সরকার শব্দ যে ভোটের মধ্য দিয়ে হতেই পারে তা নিয়েই বিতর্ক চলেছে। তাই জিনোভিয়েভ বলার চেষ্টা করলেন যে সরকার মানে আসলে তা শ্রমিকশ্রেণীর একনায়কতন্ত্র অর্থেই (উনি pseudonym শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন) ব্যবহৃত। খুব সাবধানে এই স্লোগান ব্যবহার করতে হবে, একমাত্র সেখানেই যেখানে আমাদের পাল্লা ভারী, সশস্ত্র জনতার দ্বারা পরিবেষ্টিত আমরা। যদিও জোটপন্থী রাদেকও এই মতকেই সমর্থন করলেন। ১৯২২ সালের ঐতিহাসিক অবদান এটাই যে জোট শুধু আন্দোলনের নয়, ক্ষমতার জন্য জোট। সরকার গঠনকে কেন্দ্র করে খসড়াটিই সবচেয়ে বেশী বার পরিমার্জিত, পরিবর্দ্ধিত হয়। শুধু তাই নয় জোট সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত হওয়ার পরেও তিনটে ভিন্ন দলিল ভিন্ন দেশের দলগুলিকে বিলি করা হয়!! দেখা যায় যে ইংরেজিতে যে দলিলটি বিলি হয় সেটি যা গৃহীত হয়েছিল তার থেকে আলাদা!! (এটি বলছেন রিড্‌ল সাহেব) জার্মান কম্যুনিস্টরা সরকার গঠনের লাইন চেয়েছে্‌ কারণ তারা তা বাস্তবে করেছে। যদিও জার্মান দলেও সর্বজন গ্রাহ্য সিদ্ধান্ত হয়নি। কমিন্টার্ন পরিচালন কমিটির বৈঠকে যে খসড়া হয় সেটা নিয়ে কমিন্টার্ন মিটিঙে জিনোভিয়েভ প্রথমেই বলেন যে জার্মান দল প্রেরিত খসরা টি যথেষ্ঠ পরিষ্কার নয়। কিন্তু বাস্তবে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল সেখানে ‘প্রায় সর্বত্র’ (almost everywhere) শব্দটাই ব্যবহৃত হল। সুতরাং বহু বিতর্কের পর সরকার শব্দটা থাকলো্ শুধু তাই নয়, প্রায় সর্বত্র কথাটাও থাকলো।
    • জোট এবং জোট সরকার, কোন প্রেক্ষিতে অনুমোদন যোগ্য। যখন পুঁজিবাদ দুর্বল, যখন পুঁজিবাদ সবল নাকি সবসময়? এই প্রশ্নে খুব বিতর্ক হয়নি। মূলত ট্রটস্কি প্রতিষ্ঠা করেন যে এই জোট বা সরকার সবই এই কারণেই যে পুঁজিবাদ আপাতত দুর্বলতা কাটিয়েছে। (if we consider thst theparty is on the eve of the conquest of power and the working class will follow it then the question of united front does not arise…., 1st january, 1922) সে আগ্রাসী হয়েছে। যদিও মাত্র সাত বছরের মধ্যেই মহাপতন হয় পুঁজিবাদের!  

    বহু বিতর্কের মধ্য দিয়ে ১৯২২ সালের ওই ঐতিহাসিক কংগ্রেস ভারসাম্য রক্ষা করলো ঠিকই কিন্তু আগামী দিনের কম্যুনিস্টদের জন্য সার কথা বলে গেল।

    ১) কমুনিস্টরা প্রয়োজনে দক্ষিণপন্থী সরকারকে সমর্থন করতে পারবে।

    ২ কম্যুনিস্টরা সেই সরকারে যোগদানও করতে পারবে।

    3) সেই সরকার ভোটের মধ্য দিয়েও হতে পারে।

    4) সেই সরকারই অভ্যুত্থানের হাতিয়ার হয়ে উঠতে পারে।

    যেখানে সমাজতন্ত্রীরা শয়ে শয়ে কম্যুনিস্ট খুন করছে, যেখানে সমাজতন্ত্রীদের সরকারের আমলে লাখে লাখে বেকার তৈরী হচ্ছে, যেখানে তাদের সাথে আন্দোলনের জোটই মানা হছে না, যেখানে একটানা তিন বছর ধরে জোট-ভোট পন্থীদের দল থেকে বের করে দেওয়াই রেওয়াজ হয়ে আছে, সেখানে এই ধরনের সিদ্ধান্ত বিরাট ব্যাপার। ১৯৩৪ সালের কমিন্টার্ন চাইলে এই গুরুত্বপূর্ণ বিতর্কগুলির সারসংকলন করে আগামী কম্যুনিস্ট আন্দোলনকে পথ দেখাতে পারতো।

    ১৯২৪ সালে এসে ১৯২২ সালের এই মহামূল্যবান দলিলকে নাকচ করা হল। বোঝাই যাচ্ছে ১৯২২ সালের সিদ্ধন্ত হয়েছিল বড়ই তালেগোলে। পুঁজিবাদের ক্রম বিপর্যয় জোটপন্থীরা কোণঠাসা করেছিল।  ১৯২২ সালেই সিদ্ধান্ত হয়েছিল যে পুঁজিবাদ দুর্বল হলে আর জোট-ঘোঁট চলবে না। বাস্তবে দেখাও গেল পুঁজিবাদের বিপর্যয় এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের দৃপ্ত অগ্রগতির ফলে জোট-সরকার ছাড়াই কম্যুনিস্ট দলগুলিতে আবার সদস্য সংখ্যা বাড়তে শুরু করলো।  ফরাসী কম্যুনিস্টদের সদস্যপদ চার বছরে ৩০ হাজার থেকে তিন লক্ষ হয়ে গেল। সাংসদ সংখ্যা ১৪ থেকে ৭২ হয়ে গেল। ৮% থেকে ১৫% ভোট পেল তারা ( ১৯৩২ থেকে ১৯৩৬)। 

    কিন্তু কম্যুনিস্টদের এই বাড়তে থাকা ভোট বিপদ ডেকে আনলো। তারা আনন্দের আতিশয্যে আত্মহারা হল। জার্মানিতে কম্যুনিস্ট ভোট বাড়লো, সমাজতন্ত্রীর আগের মতোই ২০% থেকে গেল। যেহেতু জোটের সমস্ত সম্ভাবনাই খারিজ হয়েছে, সুতরাং জার্মানিতে ভাইমার সরকার আরও বেকায়দায় পড়লো। নাজিদের সুযোগ বাড়তে থাকলো। ফলে কোনো দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠরা অর্জন করার পরিস্থিতিতে থাকলো না। জার্মানিতে কম্যুনিস্টদের আর নাজিদের ভিত্তি ছিল একই, বেকার বাহিনি। ভাইমার সরকারের নীতির ফলে বেকার বাড়ছে, ফলে তাদের সাথে জোট করার কল্পনাও করতে পারছে না কমুনিস্টরা। যে বেকার বাহিনির মুখ চেয়ে তারা জোটে গেলেন না তারাই কয়েক দিনের মধ্যেই কম্যুনিস্টদের মধ্যে কোনো ভবিষ্যত দেখতে না পেয়ে দ্রুত ফ্যাসিস্টদের দিকেই ঢলে পড়লেন। এবং এই বেকার বাহিনিই হিটলারের অন্যতম ভক্তবৃন্দ হয়ে উঠলো। যুদ্ধ অর্থনীতির মধ্য দিয়ে বেকার সমস্যা সমাধানের স্বপ্ন দেখানো হল। যদিও বেকার বাহিনি বহুবার আশা করেছে যে কম্যুনিস্টরা সরকারে যাবে। ১৯৩২ সালের ভোটে, কম্যুনিস্ট আর সমাজতন্ত্রী মিলে পেয়েছিল ২২১ টা আসন, ৩৭% ভোট। যেখানে নাজিরা পেয়েছিল ১৯৬ টা আসন আর ৩৩% ভোট। কিন্তু তারা জোট করেনি, ফলে ১৯৩৩ সালের মার্চের ভোটে তাদের মোট আসন সংখ্যা নাজিদের থেকে কমে গেল। ফ্রান্সেও ১৯৩২ সালে সমাজতন্ত্রী-সাম্যবাদী ও মধ্যপন্থীরা মিলে ৩৪০টা আসন পেয়েছিল, মোট আসন ছিল ৬০৭। কিন্তু জোট হয়নি। ফরাসী কমুনিস্টদের মুর্খামির নমুনা দেখুন, (1932)…The tactic of class against class… tested in France during four years of economic or political struggles will be firmly applied by the whole of the Party during the course of this electoral campaign. The responsible organisms of the Party, from the cells up to the Political Bureau, will be on the alert so that there nowhere re-occur the defections and compromises with the Socialist, or even the Radical, Party, as occurred in certain regions in 1928…During its electoral campaign our Party must be on the alert so as not to fall into the error where right opportunism allies itself with the most narrow-minded sectarianism… It must once again be repeated that far from being a sectarian tactic, our tactic of class against class, which prohibits any electoral bloc in any form with the Socialist Party, supposes and signifies a united front at the base with Socialist workers…

    ফলে সরকার করেছিল দক্ষিণপন্থীরা। ফ্রান্স বেঁচে গেছিল কারণ ১৯৩৪ সালে পরবর্তী ভোট টা হয়েছিল, আর জার্মানিতে তা হয়েছে ১৯৩৩ সালে। ফলে জার্মানিতে দিমিট্রভের তত্ত্বের আগে আর ফ্রান্সে পপুলার ফ্রন্ট হতে পেরেছে।  ফ্রান্সের মত জার্মানিতেও বা স্পেনেও যদি এক বছর পরে ভোট হতো, তবে ইতিহাস অন্যভাবে লেখা হতো!
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৪ অক্টোবর ২০২৪ | ৯০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সুতপা দেব | 2402:3a80:4318:ac6f:778:5634:1232:***:*** | ১৫ অক্টোবর ২০২৪ ১৬:৫৬538540
  • অনেকদিন পর তোমার একটা দারুন লেখা পড়লাম। শিরোনাম একটু
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। আদরবাসামূলক মতামত দিন