বক্রেশ্বরের পলাশ রিসর্টের রুমে ব্যাগ পৌঁছে দিয়ে বলল,
- স্যার বক্রেশ্বর চেনেন তো? যার জন্য সবাই এককালে রক্ত দিয়েছিল
- দ্যাখো বক্রেশ্বরের জন্য কিনা বলতে পারবো না, তবে আমার এক দাদা প্রায়ই রক্ত দিত টিফিনের লোভে
- না স্যার, এর জন্য পাবলিক টিফিন ছাড়াও রক্ত দিয়েছিল
- হবে হয়ত। যাকগে বাদ দাও, এই রুমটার ভিউ কেমন বলো
পলাশ এগিয়ে গিয়ে পর্দা সরিয়ে দিল, পুরো দেওয়াল জুড়ে কাঁচের জানালা
- স্যার দেখুন, কি দারুণ ভিউ
এগিয়ে গিয়ে দেখলাম - পুরো কুয়াশা আর মেঘ। এক হাত দূরের জিনিস দেখা যাচ্ছে না। তবুও পলাশ মনে কষ্ট পাবে বলে বললাম
- দারুণ ভিউ তো! আচ্ছা পলাশ এই রুম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়?
- সেটা স্যার আপনি কতদিন থাকছেন তার উপর নির্ভর করবে
- না, মানে আমি দেখতে পাব কিনা জানতে চাইছি না। এই রুম থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায় কিনা সেটাই জিজ্ঞেস করছি
- বুঝেছি স্যার। ওই জন্যই তো বললাম কত দিন থাকছেন তার উপর নির্ভর করবে। কাল চেক আউট হলে উত্তর হ্যাঁ, আর কয়েকদিন পর হলে উত্তর না।
আমি এবার গেলাম কনফিউজ হয়ে। বেশীদিন থাকলে তো কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাবার সম্ভাবনা বাড়ার কথা, কমার তো নয়!
আমাকে কনফিউজ দেখে পলাশ এগিয়ে এল হেল্পে
- স্যার, আপনি দেশের লোক বলে ভিতরের ব্যাপারটা খুলে বলি। কাল পর্যন্ত ওয়েদার এমনি মেঘলা থাকবে। তাই কাল যারা চেক আউট করবে তাদের সবাইকে বলা হচ্ছে সব রুম থেকেই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যায়, আপনাদের লাক খারাপ। কিন্তু সেটা তো আর আপনাকে বলা যাবে না! পরশু ওয়েদার ক্লিয়ার হলে আপনি নিজেই আসল ভিউ পাবেন
- আসল ভিউ কি তাহলে?
- তোফা সিনেমা দেখেছেন জীতেন্দ্র-শ্রীদেবীর?
- না
- হিম্মতওয়ালা? নতুন ফালতুটা নয়, পুরানো আসলটা
- না
- আপনি তাহলে করেছেনটা কি! আচ্ছা রিসেন্ট টাইমের বিজয়পত সিনেমার সেই গানটা দেখেছেন তো? রাহা মে উনসে মুলাকাত হো গেয়ি
- হ্যাঁ, এটা বিলকুল দেখেছি। শানুদার গান
- এই তো লাইনে এসেছেন। তাই ওই গানে কেমন সব পতপত করে পতাকা উড়ছিল মনে আছে?
- আছেই তো? পাহাড়ের উপর দারুণ দৃশ্য। তা তেমন দেখবো নাকি জানালা দিয়ে?
- পতপত করে ওড়া দেখবেন। তবে পতাকা নয়। পাশে ছাদে ধোপার শুকুতে দেওয়া সাদা বিছানার চাদর আর রঙীন জামা প্যান্ট
দরজাটা টেনে বন্ধ করে চলে যাবার আগে পলাশ জানিয়ে গেল
- লাক ভালো থাকলে শুধু সাদা বিছানার চাদর শুকালে জীতেন্দ্র-শ্রীদেবী আপনার মনে পড়তে বাধ্য! দার্জিলিং এসে সেটাই বা কি কম পাওয়া!
--------------------------
ড্রাইভার ভাই বলল,
- আপকে পাশ যো ডি এস এল আর ক্যামেরা হ্যা না, উসমে হামারা এক ফটোশ্যুট কর দিজিয়েগা?
কেন নয়! এই ভেবে রাজী হয়ে গেলাম। তখন কি আর জানতাম যে এর ফটোতোলার নানাবিধ আব্দার রাখতে গিয়ে আমাকে যা শ্রম দিতে হবে বিয়ে বাড়ির ফটোগ্রাফার এত কষ্ট করে না!
পুরো ট্যুরে এই আমাদের গাড়ি চালাচ্ছিল - ১৮ বছর হয়েছে কিনা বা লাইসেন্স আছে কিনা এই পিক সিজিনে ওসব জিজ্ঞেস করার চল নেই শুনলাম। ছেলে এমনিতে ভালো - কিন্তু গান করার রোগ আছে।
বড়ই বেসুরো গান গায় - আমি মানিয়ে নিচ্ছিলাম তবুও। কিন্তু একসময় দেখলাম মেহুল কানে হাত দিয়ে বসে আছে। ভাবলাম গান জোড়ে বাজছে বলে কান চেপে আছে। ড্রাইভার ভাইকে গানটা বন্ধ করে দিতে বললাম। মেহুল প্রবল আপত্তি জানিয়ে বলল
- গান চলুক, তুমি ওকে গাইতে বারণ করো
- সেটা আমি পারবো না! রেগে গিয়ে এই পাহাড়ে নামিয়ে দিলে বাড়ি ফিরব কি করে?
যাই হোক তবুও আমার তরফে ছেলেটিকে ইংরাজি গান না গাইবার অনুরোধ করলাম
তো ছবি তোলার ব্যাপারটা ফিরে আসা যাক। মিরিক লেক জুড়ে ছবি তুললাম ড্রাইভার ভাইয়ের
একবার বলে ব্রীজের, একবার বনের ধারে, একবার বোটে হেলান দিয়ে। জানতে চাইলাম ঘোড়ায় চড়াটাই বা বাকি থাকে কেন!
ভাবলাম শেষ হয়েছে - ওমা কোথায় কি!
- আপকা পাশ অটো মোড হ্যায় না?
- বিলকুল হ্যা
- তো উসমে আপ তসবির খিঁচিয়ে মেরা। আমি এমন করে হেঁটে যাব সামনের দিকে, খানিক গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে তাকাবো। আপনি সেই সময়েই ক্লিক
ব্যাস এবার সিরিজে হাঁটা চলল। ছবি আর মনমত হয় না। কোন সময়ে বেশী মুখ ঘুরে যাচ্ছে, কোন সময় বেশী নীচু হয়ে যাচ্ছে, কোন সময় ব্রীজের মাঝখান ক্রস করে যাচ্ছে - কোন সময় সামনে দু গাছি চুল বেশী এলিয়ে গেছে - এই সব সামলে প্রবল সংগ্রাম শেষে ছবি মনমত হল
কিন্তু ততক্ষণে দেরী হয়ে গেছে, প্লেন ধরার তাড়া। মিরিক লেক বা আমার মেহুলের ছবি তোলার সময় আর হল না
সাথের ছবিটা আইফোনে তোলা - এটা পছন্দ হয় নি, বলল ছবিটায় সেই 'কিক' টা নেই
ক্যামেরার ছবি প্রসেসিং করে দেখি কিক আসে কিনা!
---------------------
চিড়িয়াখানা দেখে পিক আপ পয়েন্টে ওয়েট করছি ড্রাইভারের জন্য। যা জ্যাম, আসতে খুব দেরী হচ্ছে গাড়ীর। আমার মত আরো অনেকেই অপেক্ষা করছেন এখানে
সেই ফাঁকে আমি মেহুলের সাথে পরবর্তী গন্তব্য নিয়ে আলোচনা সেরে নিচ্ছি। আইটেনারী অনুযায়ী এবারে যাওয়া জাপানীজ টেম্পেল। এত ভীড় দেখে কি করে সব কিছু কাটিয়ে হোটেলে বসে ল্যাদ খাওয়া যায় সেই অজুহাত খুঁজছি। নিজেই নিজেকে বললাম,
- খোদ জাপানে গিয়ে বা সাউথ ইষ্ট এশিয়ায় জাপানী মন্দির দেখে বোর হয়ে গেছি। এখানে আর মন্দির দেখে কাজ নেই। কি বলিস মেহুল?
- খোদ জাপান কি?
- অরিজিন্যাল জাপান। তোর মনে নেই? সেই ছোট বেলায় নিয়ে গিয়েছিলাম
পাশের এক ভদ্রলোক মনে হয় আমাদের কথাবার্তা শুনছিলেন এতক্ষণ। আমার মুখে জাপান শুনেই বললেন
- আপনিও এই ভাবে ছেলে ভুলান?
- মানে?
- এই যে বললেন, "তোকে ছোটবেলায় জাপান নিয়ে গিয়েছিলাম, কিছু মনে নেই তোর"? আমিও ছেলেকে বলি ছোটবেলায় তোকে প্যারিস, সুইজারল্যান্ড, আমেরিকা সব জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম
- আরে সত্যি সত্যি গিয়েছিলাম তো!
- আরে বাবা লজ্জার কিছু নেই। ছেলে মানুষ করতে গেলে এমন সব বলতে হয়। সান্তা ক্লজ, ভূত-প্রেত। সব সত্যি হতে হলেই তো হয়েছে আর কি!
- দাঁড়ান, আপনাকে ছবি দেখাচ্ছি। ছবি তো আর মিথ্যে বলবে না!
- থাক না কি দরকার!
আমি পড়েছি বিশাল চাপে ছবি দেখিয়ে প্রুভ করার। টেনশনে ফোনের কি নাম্বার বার পাঁচেক ভুল টিপে ফোন লক করে ফেললাম!
এদিকে ততক্ষণে গাড়ি চলে এসেছে। আমি ইতস্তত করে বললাম,
- ফোন লক হয়ে গেছে!
- জানতাম তো এমনি হবে!
- মানে?
- শুনুন ফোন লক বলবেন না, ড্রাইভার চলে এল বলে এই যাত্রায় বেঁচে গেলেন বিড়ম্বনা থেকে। এর চেয়ে বলবেন ফাইল সব কোরাপ্ট হয়ে গেছে। সেফ ব্যাপার
-----------------------
পাহাড়ের দিকে গেলে মোমো না খেলে হয় নাকি! তা সেদিন বৃষ্টি পড়ছিল বিকেলের দিকে, ভাবলাম হোটেলের রেষ্টুরান্টেই মোমো খাওয়া যাক
আমাকে বলা হল প্রচুর সময় লাগবে, মিনিমাম এক ঘন্টা, একদম স্ক্র্যাচ থেকে নাকি মাল বানানো হবে। বললাম কৈ পরোয়া নেহী!
তো রেষ্টুরান্টের রাঁধুনিদের সাথে আমার চিরকালই ভাব ভালোবাসা, আজকাল আবার তাদের শেফ বলতে হয়, যেমন বাস ড্রাইভারদের পাইলট
শেফ ভাইয়ের সাথে আলাপ হয়ে গেল, তেনার হাতে প্রচুর সময়। জিজ্ঞেসিল
- কোথায় বাড়ি
- কোলকাতায়
- কলকাতার ঠিক কোথায়?
- ঠিক কলকাতা নয়, আর একটু ওদিকে গিয়ে বর্ধমান
- বর্ধমানের কোথায়?
- ঠিক বর্ধমান নয়, মেমারী
- মেমারীর কোথায়?
- মেমারী ঠিক নয়, তার পাশে নিমো
- নিমোর কোথায়?
- ভাই নিমোর কোথায় তুমি বললে চিনবে
- কেন চিনব না! আমার বাড়ি তো পালসিট
এবার আমার পালা
- পালসীটের কোথায়
- ওই পালসীটের পাশে বেগুট
- বেগুটের কোথায়?
- বললে চিনবেন?
- কেন নয়? কত খেলতে গেছি ওদিকে
যাই হোক শেফ ভাইয়ের সাথে আলাপ হল, হাটগোবিন্দপুর স্কুলে পড়েছে। বায়োলজির স্যার হরপ্রসাদবাবুর কথা মনে এল
তবুও শেফকে বললাম,
- ভাই কিছু মনে কোরো না। নিমো থেকে দার্জিলিং এসে মোমো খেতে চেয়ে বেগুটের রাঁধুনীর বানানো মোমো খাব? ফিলিংসটাই তো আসবে না আর জেনে ফেলায়।
- আরে দাদা, খেয়ে দেখুন না। গ্যারান্টি দিয়ে ভালো বানাই। খেয়ে দেখুন, তাহলে কাল দুপুরের বাচ্চাটার পাতলা মাছের ঝোলটায় এক পিস পেটি ফ্রী দেব
মাছের পেটির লোভে বেগুটের মোমো খেলাম, অনেকটা সেই লন্ডন ব্রীজের পাশে বাংলাদেশী ভাইয়ের বানানো ফাহিতা খাবার মত কেস
বলতে নেই, ফাহিতার মতন, এই মোমোও ভালো হয়েছিল
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।