‘গরম হাওয়া’র নির্দেশক এম এস সাথ্যু কর্ণাটকের লোক, পুরো নাম মাইসোর শ্রীনিবাস সাথ্যু। গণনাট্য মঞ্চের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বহুদিন। ভাষা নিয়ে ওঁর সিনেমায় প্রায়ই পরীক্ষা নিরীক্ষা দেখা যায়। একটা সিনেমার মধ্যেই লোকে বিভিন্ন ভাষায় কথা বলতে থাকে। বহু আগে ওঁর বক্তৃতা শোনার সৌভাগ্য হয়েছিল। সিনেমায় ভাষার বহুত্ব নিয়ে প্রশ্ন করায় জবাব দিয়েছিলেন, একটু কান পেতে শুনে দেখবেন তো আমরা রোজকার জীবনে কত ভাষা বলি আর শুনি। ভারত যে বহুভাষী দেশ তার ছাপ সিনেমাতে পড়াটাই স্বাভাবিক।
গরম হাওয়া সম্ভবত ওঁর বানানো সবথেকে বিখ্যাত সিনেমা। এতেও ভাষা নিয়ে একটা ব্যাপার আছে। নিখাদ তকল্লুফ সমন্বিত উর্দু আলফাজের ব্যবহারের কথা বলছি না। সে তো চিত্রনাট্য লেখক কাইফি আজমির কলমের জোরের জন্য আসতে পারে। বা লেখিকা, উর্দু সাহিত্যের আরেক বাঘ, ইসমত চুঘতাইয়ের দৌলতে আসতে পারে। তার বাইরেও বোধহয় সিনেমার মেজাজ বলে কিছু থাকে। এই সিনেমায় সেই মেজাজ আসছে একদা মোগল সাম্রাজ্যের কেন্দ্র আগ্রা শহরের বাসিন্দা উর্দুভাষী এক মুসলমান পরিবারের হেঁসেল ছাদ লেপ কম্বল বালিশ তোষক দস্তরখান থেকে। উত্তর ভারতীয় উর্দু আবহ ফুটিয়ে তোলার চ্যালেঞ্জ দক্ষিণী নিয়েছিলেন। প্রায় পঞ্চাশ বছর পর যে সেই সিনেমা নিয়ে লিখতে বসেছি তা বোঝায় যে সাথ্যুর হিম্মত সার্থক হয়েছিল।
সিনেমাটি অনেকেই দেখেছেন নিশ্চয়ই। খেই ধরানোর জন্যঃ সলিম মির্জা (বলরাজ শাহনি) ছোট এক জুতো কারখানার মালিক। দেশভাগের পর সলিমের দাদা লুকিয়ে পাকিস্তানে পালালেন (লিগের নেতা ছিলেন)। পৈতৃক হাবেলি সরকার ক্রোক করল (শত্রু সম্পত্তি, বাড়ি দাদার নামে ছিল)। এদিকে জুতোর কারবার লাটে উঠছে কেননা পাকিস্তানে পালাবে এই ভয়ে কেউ ধার দিতে চায় না। ক্যাপিটাল ছাড়া ছোট ব্যবসা কী করে চলে। সলিমের দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে ব্যবসায়ে বাবার সাহায্য করত। হিন্দুস্তানে নানানভাবে হেনস্তা হয়ে, বৌ-বাচ্চা নিয়ে পাকিস্তানে চলল। ছোট ছেলে সিকন্দর (ফারুক শেখ) শিক্ষিত যুবক। কলেজ পাশ দিয়ে চাকরি খুঁজছে, ঠোক্কর খাচ্ছে। মেয়ে আমিনার (গীতা সিদ্ধার্থ) সাথে জ্যাঠতুতো দাদার প্রেম ছিল, বিয়ে ঠিক ছিল। হবু বর পাকিস্তান চলে যাওয়ার ফলে বিয়ে বানচাল হল। সিনেমা এবার বাবার থেকে সরে মেয়ের ওপর কেন্দ্র করবে। আমিনার পেছনে পিসতুতো দাদা শামশাদ ঘুরঘুর করছিল। মন ভেঙে যাওয়ার পর তাকেই আমিনা আঁকড়ে ধরল। কিন্তু পিসেমশাইও নানান ফেরেববাজি করে শেষে সপরিবারে পাকিস্তানে পালালেন। অঙ্গীকার ভেঙে শামশাদ সেখানেই বিয়ে করবে এই খবর শোনার পর আমিনা আত্মহত্যা করে। শেষ দৃশ্যে সলিম মির্জা হেরে গেছেন, তার বিরাট পরিবারের অবশিষ্ট, স্ত্রী (শওকাত আজমি) আর ছেলেকে নিয়ে আগ্রা স্টেশনে ট্রেন ধরতে যাচ্ছেন। রুজি-রুটি-মকানের দাবিতে রাস্তাজুড়ে লাল ঝান্ডার মিছিল চলছে তখন। ছেলে বলে, যাব না, এখানেই থাকব। বাপ-ব্যাটা টাঙ্গা থেকে নেমে মিছিলে মিশে যাবে।
অভিনয়ে দুর্বল জায়গা নেই বললেই চলে। বলরাজ শাহনির অন্যতম শ্রেষ্ঠ কাজ। শওকাত আজমিও উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন। এডিটিং পরিমিত। পুরোনো ধাঁচের বাড়িঘরে শুটিং হয়েছে। ঘর ছোট, ক্যামেরার সামনে কম জায়গার জন্য দমচাপা একটা ভাব এসেছে। তবে তা মানিয়ে গেছে। ক্যামেরার কিছু অভিনব ব্যবহার চোখে পড়ল। আবহসংগীতের প্রয়োগ ঠিকঠাক। অপ্রাসঙ্গিক গানটান নেই। ভিলেন চরিত্রগুলো খানিক একমাত্রিক হয়েছে, এছাড়া চিত্রনাট্য নিয়ে নালিশ নেই।
বলার অপেক্ষা রাখে না সিনেমাটি মুসলমান সমাজ ও দেশভাগের ট্র্যাজেডি নিয়ে। চলে যাওয়া বা রুখসত নিয়েও। প্রথম দৃশ্যে কালো ঢাউস টিউবের মত দেখতে স্টিম ইঞ্জিন হুইসল বাজিয়ে আগ্রা স্টেশন ছেড়ে যাচ্ছে। এর পরেই এক দীর্ঘ শটে সলিম মির্জার প্রোফাইল দেখা যাবে শুধু (সে যুগের বোম্বাই ফিল্মের নিরিখে বেশ চিত্তাকর্ষক), শুধু মুখের দিকে আলো এসে পড়েছে, ব্যাকগ্রাউন্ডে ট্রেন জোরে ক্রমে আরো জোরে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে। সাদাচুল মাথার ওপর কালো টুপি, প্রবীণ মুখে বলিরেখা আলো ছায়ায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, শেরওয়ানি গায়ে, স্মিত মুখে এক হাত নাড়িয়ে বিদায় জানাচ্ছেন চলন্ত ট্রেনকে। মনে হয় সিনেমার মূল চুম্বক দৃশ্য। পরে টাঙ্গাওয়ালার সাথে কথাবার্তায় জানতে পারব মির্জা বড়দিকে পাকিস্তানের ট্রেনে উঠিয়ে এলেন। ফিল্মের শেষ দৃশ্যেও মির্জা দেশ ছেড়ে যাওয়ার জন্যই বেরিয়েছিলেন। রুখসত – প্রস্থান -- ফিরে ফিরে আসে সিনেমায়। বার বার আমরা দেখব অপস্রিয়মাণ রেলগাড়ি; তার পিছনে দৃশ্যমান হচ্ছে অতিকায় কোন বাদশাহি ইমারতের গম্বুজ, যা স্থানু। দেখব যাঁরা প্রিয়জনদের ছাড়তে এসেছেন তাঁদের। কখনও মির্জা, কখনও বা তাঁর মেয়ে -- প্রেমাস্পদকে পাকিস্তানের পানে রওনা করে দেওয়ার জন্য এসেছে, সে নিজেও যাবে একদিন, সে রকমই কথা ছিল। শেষ পর্যন্ত তাদের কারওই যাওয়া হবে না।
আশ্চর্য ব্যাপার, সলিম মির্জার মুখে কোনও বক্তৃতা শোনা গেল না। উটকো লোকে পাকিস্তানের চর বলছে, সেখানেই চলে যেতে বলছে। রুজি-রোজগার দফারফা। দাঙ্গায় মাথা ফেটে গেছে। দাদা-দিদি-ছেলে-নাতি দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। সাতপুরুষের ভিটে সরকার নিলাম করে দিয়েছে। কাঁধে তুলে বুড়ি মাকে পুরোনো ভিটেতে নিয়ে যাচ্ছেন, যাতে বাড়িতে মরতে পারার মিথ্যে মায়া রয়ে যায়। মুসলমান হওয়ার অপরাধে ছেলের চাকরি জুটছে না। বড় আদরের মেয়ের বিয়ে ভেঙে যাচ্ছে, আত্মহত্যা করছে। তাও গোঁ ধরে হিন্দুস্তানে পড়ে আছেন কেন? এইখানে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতির একখানি বক্তিমে অনায়াসে গুঁজে দেওয়া যেত। কিন্তু না। খালি, ‘ইয়ে উমর ওয়াতন ছোড়কে জানে কি নহি, ইস দুনিয়া সে উস দুনিয়া জানে কি হ্যায়।’ ব্যাস। দর্শক বুঝে নিন মির্জার ওয়াতন কোনখানা।
অনুচ্চকিত এই সিনেমার আরেক বৈশিষ্ট্য ঐতিহাসিক আবহ। মোগল সাম্রাজ্যের হৃতগৌরব অথবা গঙ্গা-জমুনি তহজিবের ওপর বক্তৃতা নেই। উত্তর ভারতের মুসলমান সমাজের হাতের থেকে ক্ষমতা চলে যাওয়ার, পদে পদে অসম্মানিত হওয়ার বিষাদ আছে, অনুচ্চারিতভাবে। আগ্রার বিরাট নির্লিপ্ত ইমারতের সমুখে খুদে মানুষদের মধ্যে ঘটনার বয়ে যাওয়ার শটগুলোয়। সলিম চিস্তির দরগার কাওয়ালির আসমান-ছোঁয়া তানে আছে। সেই তান ফিরে ফিরে আসে। প্রেমে-সান্নিধ্যে, হৃদয় ভেঙে যাওয়ার মধ্যে, মৃত্যুতে। ‘ঘুঙ্ঘট কি লাজ রাখনা, ইস সর পে তাজ রাখনা’। তাজ খসে গেছে কবে।
উনিশ শতাব্দীর শেষ দিকে আমাদের শহরে তৈরি হয়েছিল দুর্গামণ্ডপটি। ব্রিটিশ আমলে প্রবাসী বাঙালিদের মাথারা ভালই টাকাকড়ি করেছিলেন, ওকালতি, চা-ব্যবসা, সরকারি চাকরিতে। তাদের উদ্যোগে এই দুর্গামণ্ডপ গড়ে ওঠে। বাংলা মাধ্যম ইস্কুল টিস্কুল এদের সাহায্যে তৈরি হয়। দেশভাগের উদ্বাস্তুর ঢলের ফলে এই বারোয়ারি জায়গাগুলোতে লোকের অভাব হয় নি। তিরিশ-চল্লিশ বছর আগে পুজোর দিনগুলোয় পা রাখা যেত না। গতবছর অষ্টমীর সন্ধ্যায় দেখলুম, গুটিকয় মানুষ ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছেন। ঢাক বাজছে, ঝাপসা, একলা মত। ছাত্রের অভাবে বাংলা ইস্কুল বন্ধ হওয়ার মুখে। নতুন জেনারেশন কতক বেঙ্গালুরু, পুনে, গুড়গাঁও। আগের প্রজন্ম শিলিগুড়ি-কলকাতা পাড়ি দিয়েছিল। ভূমিপুত্র না হওয়ার অগৌরব কত সওয়া যায়। কলকাতা, শিলিগুড়ি বা বেঙ্গালুরুতেও কি ভূমিপুত্র হওয়া যাবে?
তবে সলিম মির্জা পাকিস্তানে চলে গেলেই পারতেন। ‘মানুষ আর কতদিন একলা বাঁচতে পারে’ বলে যে ইনকিলাব জিন্দাবাদের মিছিলে নেমে পড়লেন, তা শেষ রুখসতকে থামিয়ে দিল ঠিক। কিন্তু তাকে কি ঠেকাতে পারল যা মির্জাকে শেষমেষ হারিয়ে দিয়ে স্টেশনের পথে ঠেলে দিয়েছিল? আমরা কি ঠেকাতে পারছি? মির্জার পাকিস্তান না যাওয়া গণনাট্য মঞ্চের ভাল লাগলেও, পঞ্চাশ বছর পর মোদিরাজ্য ও যোগীরাজ্যের প্রজা সলিম মির্জার সন্ততিদের ভাল লাগছে কিনা জানতে ইচ্ছে হয়।
ছবির উৎস: মূল ছবি, উইকি