৩১ ডিসেম্বর মাঝরাতে আসামে এন আর সি বা নাগরিকপঞ্জীর প্রথম খসড়া বেরিয়েছে। তারপর থেকে সর্বানন্দ-মমতা, টিএমসি-ভাজপা, ব্রহ্মপুত্র-বরাক, আসাম-পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে ভারী হট্টগোল। নাগরিকপঞ্জী মানে কী? নবীকরণ কেন? কই পশ্চিমবঙ্গে তো এন আর সি হচ্ছে না! আসামের রাজনীতিতে এন আর সি নিয়ে কী রকম খেলাধুলো চলছে? এই লেখায় আমরা প্রশ্নগুলোর জবাব খোঁজার চেষ্টা করব।
এন আর সি নবীকরণ কেন?
বিদেশিদের শনাক্তকরণের অভিযান আসামে অনেকদিন ধরে চলছে। ইলিগাল মাইগ্র্যান্টস (ডিটেকশন বাই ট্রাইব্যুনাল) ও ফরেনারস ট্রাইব্যুনাল – এই দুই আইনি হাতিয়ার দিয়ে বিদেশিদের পাকড়াও করে বহিষ্কার করা হচ্ছিল। এন আর সি নবীকরণ একই উদ্দেশ্যে করা হচ্ছে, তবে এটা আগেরগুলোর তুলনায় আরও ব্যাপক আর উচ্চাকাঙ্খী প্রকল্প। এন আর সি'র অর্থ ন্যাশনাল রেজিস্টার অফ সিটিজেনস, ভারতের জাতীয় নাগরিকপঞ্জী। ১৯৫১ সালে স্বাধীন ভারতে প্রথম জনগণনা করা হয়। তখন সমস্ত ভারতীয় নাগরিকের হিসেব নেওয়া হয়েছিল, এন আর সি'তে সে তথ্য ঢোকানো হয়েছিল। আসামে এন আর সি নবীকরণ করা হচ্ছে প্রকৃত নাগরিকদের থেকে বিদেশিদের ছাঁকনি দিয়ে বের করার উদ্দেশ্যে। বিদেশি অনুপ্রবেশের বিরুদ্ধে আসামে একাধিক আন্দোলন দানা বেধেঁছে। আশির দশকের শুরুতে চলা আসাম আন্দোলনে তার সবথেকে বড় রূপ দেখা যায়। আন্দোলন শেষ হয় আসাম চুক্তিতে। ধার্য হয় ২৪ মার্চ ১৯৭১-এর পর আসামে আসা বিদেশিদের সনাক্ত করে বহিষ্কার করা হবে। বাস্তবে বহিষ্কারের কাজ বড় একটা এগোয়নি। একটা হিসেব অনুযায়ী ২০১২ পর্যন্ত ২৪৪২ জনকে বহিষ্কার করা হয়, আর প্রায় ৫৪ হাজার লোককে আদালত বিদেশি সাব্যস্ত করে। অন্য দিকে কেন্দ্র সরকারের গৃহ মন্ত্রকের বিবৃতি বলছে ২০০১ সালে আসামে নাকি ৫০ লক্ষ অবৈধ বাংলাদেশি বসবাস করতেন (সারা দেশে ১ কোটি ২০ লক্ষ)। গৃহ মন্ত্রক কোত্থেকে এই তথ্য জোগাড় করেছে জানা যায় নি।
চলমান অশরীরী বাংলাদেশি
এতো কম লোককে বিদেশি সনাক্ত করার কারণ কী? এমন কি হতে পারে, বিদেশি বড় মাত্রায় ছিল না, তাই বেশি পাওয়া যায় নি? নিশ্চিতভাবে বলা শক্ত। তার জন্য চাই অনুপ্রবেশের মত স্পর্শকাতর বিষয়ের ওপর প্রচুর পরিমাণ তৃণমূলস্তরের তথ্য। তবে আসাম ও ভারতের জনসংখ্যা গতির থেকে একটা মোটের ওপর আন্দাজ করা যায়। ধরে নেওয়া হচ্ছে যে, ব্যাপক অনুপ্রবেশ যদি না হয় তা হলে আসাম আর ভারতের জনসংখ্যা সমান হারে বাড়বে। ভারতে দশকপিছু জনগণনা হয়, সেই ভাঁড়ার থেকে আমরা তথ্যগুলো সংগ্রহ করেছি।
ছবি ১: দশকপিছু ভারত ও আসামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (শতাংশে)
এই পদ্ধতি নিয়ে এগোলে অনুমান করা যায় ১৯৭০-এর পর আসামে ব্যাপক অনুপ্রবেশ হয় নি। ১৯৭১ সালের আগে পর্যন্ত আসামের জনসংখ্যার বৃদ্ধির হার ভারতের তুলনায় অনেকটা বেশি ছিল (ছবি ১ দেখুন)। আমরা ১৯০১ সালের পর থেকে যাবতীয় তথ্য নিয়েছি। ১৯০১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত সবক'টা দশকে দেখা যাচ্ছে আসামের বৃদ্ধি ভারতের থেকে বেশি। কারণ হয়তো পূর্ব বঙ্গ (পরে পূর্ব পাকিস্তান) ও ভারতের অন্যান্য অঞ্চল থেকে ব্যাপক প্রব্রজন। ভারতের ও আসামের গতির তফাত স্বাধীনতার আগে ছিল, পরেও বজায় থাকে। ১৯৭১ সালের পর ধরনটা বদলে যাচ্ছে। ১৯৭১ পরের ৪০ বছরে ভারতের বৃদ্ধি আসামের তুলনায় বেশি। বাংলাদেশের জন্মের পরে রাজনৈতিক স্থিরতা এসেছে, ফলে আসামে প্রব্রজন কমেছে আন্দাজ করা যায়।
কেউ বলতে পারেন ১৯৮১ সালে তো আসামে গোলমালের জন্য জনগণনা হয় নি, ১৯৮১-এর জনসংখ্যা নিছক সংখ্যাতাত্বিক অনুমানে কষা। যদি ১৯৮১ সরিয়ে রেখে ১৯৯১ আর ১৯৭১-র জনসংখ্যা তুলনা করি, তাহলেও দেখা যাচ্ছে আসামের জনসংখ্যা গোটা ভারতের জনসংখ্যার থেকে সামান্য কম হারে বেড়েছে।
কেউ আপত্তি তুলতে পারেন যে আসাম আর সারা ভারতের তুলনাটা কি ঠিক হচ্ছে? আসামের সাথে ভারতের আর্থ সামাজিক অবস্থার ঢের অমিল আছে। তাই, অনুপ্রবেশ না হলে আসাম আর ভারত এক হারে বাড়বে তার কী মানে? হয়তো অনুপ্রবেশ না হলে আসাম ভারতের থেকে কম হারে বাড়ত। তাহলে এরা যে প্রায় সমান হারে বাড়ছে তাতে প্রমাণ হয় অনুপ্রবেশ হচ্ছে।
অনুপ্রবেশ এক্কেবারে বন্ধ হয়ে গেছে এমন দাবি করা মুশকিল, করছিও না। তবে ওপরের আপত্তিটাকে আমল দিয়ে আরেকটা পদ্ধতিতে এগোনো যাক। আসামের সাথে এমন একটা রাজ্যকে তুলনা করা যাক যা অনেকটা আসামের মত। আমরা ঝাড়খন্ড নিচ্ছি। ২০১০ সালে আসাম আর ঝাড়খন্ডের জনপ্রতি আয় প্রায় সমান ছিল। রাজ্যদুটোর জনসংখ্যা প্রায় সমান। দুটোই পূর্বভারতের রাজ্য। ঝাড়খন্ডে বাংলাদেশ থেকে ব্যাপক অনুপ্রবেশ হচ্ছে এমন দাবি কেউ করেনি। যদি আসামে অনুপ্রবেশ হয়ে থাকে তাহলে ঝাড়খন্ডের থেকে আসামের জনসংখ্যা বেশি হারে বাড়বে।
ছবি ২: দশকপিছু ভারত, আসাম ও ঝাড়খন্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (শতাংশে)
২ নং ছবিতে ভারত, আসাম ও ঝাড়খন্ডের জনসংখ্যা বৃদ্ধির তথ্য দেওয়া হয়েছে। দেখা যাচ্ছে ১৯৭১-র পর আসাম ও ঝাড়খন্ডের জনসংখ্যার বৃদ্ধির মধ্যে বিশেষ তফাত নেই। ঝাড়খন্ডের গতি কম হওয়ার কথা ছিল; উলটো দেখছি আসামের গতি ঝাড়খন্ডের থেকে সামান্য কম। ১৯৭১-এর পর ভারত, আসাম ও ঝাড়খন্ড মোটামুটি এক হারে বেড়েছে। আসামের জনসংখ্যার গতির সাথে ভারতের গতির একটা সমতা তৈরি হয়েছে। অস্বাভাবিক হারে বাড়া থেমেছে। আসামের সাথে ওড়িশার সাথে তুলনা করলে প্রায় এক ছবি ফুটে উঠবে।
আমরা আসামের সাথে পশ্চিমবঙ্গের তুলনাও করে দেখতে পারি। জনসংখ্যার নিরিখে বাংলা আসামের থেকে প্রায় তিনগুণ বড় রাজ্য, জনপ্রতি আয়ও বেশি। সেদিক দিয়ে অমিল আছে বটে। তবে এদুটো পড়শি রাজ্য, আর দুটোতেই দেশভাগের পরের সময়ে ব্যাপক হারে প্রব্রজন হয়েছে। তুলনা করলে প্রব্রজনসংক্রান্ত চিত্তাকর্ষক তথ্য উঠে আসতে পারে। ছবি ৩-এ তুলনাটা করা হয়েছে।
দেখছি প্রায় প্রতি দশকেই আসামের জনসংখ্যার গতি বাংলার থেকে বেশি। বাংলার থেকে "তুলনামূলকভাবে" আসামে বেশি লোক প্রব্রজন করেছে। তবে বাংলার জনসংখ্যা আসামের থেকে বেশি। এমন হতে পারে যে বেশি লোক বাংলায় গেছেন। কিন্তু আমরা প্রব্রজনের সংখ্যাকে গোটা জনসংখ্যার তুলনায় দেখছি তাই বেশি গতি আসামে দেখাচ্ছে।
১৯৫১ থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত আসাম আর বাংলায় জনসংখ্যা ভারতের তুলনায় তাড়াতাড়ি বেড়েছে। এর জন্য দায়ি বোধহয় অনুপ্রবেশ। সেই সময় পূর্ব পাকিস্তান এক অস্থির অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। ১৯৭১-এর পর আসাম, বাংলা, ভারত প্রায় সমান গতিতে বাড়ছে (চিত্র ২-এর মত)। ১৯৭১-এর পরের ৪০ বছরে আসাম আর বাংলা ভারতের থেকে সামান্য কম হারে বেড়েছে (যথাক্রমে ১১৩%, ১০৬%, ১২১%)।
ছবি ৩: দশকপিছু ভারত, আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার (শতাংশে)
সংক্ষেপে, ১৯৭১ সালের পর আসামের জনসংখ্যা আগের মত অস্বাভাবিক হারে বাড়ে নি। ১৯৭১-এর পর দেখা যাচ্ছে ভারতের গতির সাথে আসামের গতির একটা সাযুজ্য তৈরি হয়েছে। আসামের হার ভারতের থেকে সামান্য কম দেখতে পাচ্ছি। পূর্ব ভারতের পড়শী রাজ্যগুলোর সাথেও আসামের গতির মিল দেখা যাচ্ছে। উপসংহার টানা অন্যায্য হবে না যে পূর্ব পাকিস্তান/বাংলাদেশ থেকে আসামে অনুপ্রবেশ ভীষণ মাত্রায় কমে গেছে। তবে রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ, জাতীয়তাবাদী ভাবাবেগ কবে তথ্যের ললিত বাণী শুনেছে। বাংলাদেশী বিতারণের প্রশ্নকে ১৯৮৫-র পরও আসামের রাজনীতিতে জিইয়ে রাখা হল।
এন আর সি নবীকরণ
২০০৯ সালে বিদেশিদের সনাক্ত ও বহিষ্কারের দাবিতে এক এন জি ও সুপ্রীম কোর্টে মামলা করে। ২০১৪ সালে কোর্ট রায় দেয় এন আর সি নবীকরণের। ২৪ মার্চ ১৯৭১ পর্যন্ত যাঁরা রাজ্যে এসেছেন, বা তাঁদের সন্তানরা, তালিকায় থাকবেন। বাকিরা বিদেশি গণ্য হবেন। এদের নাম দেওয়া হয়েছে ডি-ভোটার, ডাউটফুল ভোটার।
৩১ ডিসেম্বরের রাতে এন আর সি'র প্রথম খসড়া বেরিয়েছে। যত লোক আবেদন করেছিলেন তাঁদের প্রায় ৫৮% প্রথম খসড়াতে আছেন। চূড়ান্ত তালিকা এখনও প্রকাশ হয় নি। যাঁরা খসড়ায় নেই তাঁদের উৎকণ্ঠার পর্ব শুরু হয়েছে।
উৎকণ্ঠার কারণ কী? প্রথমে স্থানীয়দের নেওয়া যাক। স্থানীয়দের সবার ঠিকঠাক কাগজ থাকবে তার কোনও মানে নেই। উপজাতি গোষ্ঠীর গরিবদের ক'জনের কাছে প্রামাণ্য দলিল দস্তাবেজ আছে যে তাঁরা বা তাঁদের বাপ-ঠাকুর্দারা সাতচল্লিশ বছর আগে আসামে ছিলেন? উদ্বেগকে ঠান্ডা করতে এন আর সি'র রাজ্য কো-অর্ডিনেটার প্রতীক হাজেলা বলেছেন, "কোনো প্রকৃত নাগরিক, মানে স্থানীয় কেউ, যাতে ডি-ভোটার তকমা না পান তা দেখার দায়িত্ব আমার। আমি ব্যক্তিগতভাবে চেষ্টা চালিয়েছি যাতে তালিকা বানানোর সময় সেরকম ভুলচুক না হয়।"
লক্ষ্য করুন, "প্রকৃত নাগরিক" আর "স্থানীয়"র মধ্যে চমৎকার সমীকরণ টানা হল। প্রকৃত নাগরিক মানে সে স্থানীয়। বহিরাগতরা ১৯৭১ সালের আগে আসলেও তাদের পক্ষে প্রকৃত নাগরিক হওয়া সহজ নয়। স্থানীয়দের তুলনায় বহিরাগতদের উদ্বেগ কয়েকগুণ বেশি কেন তার আন্দাজ পাওয়া যাচ্ছে। বহু পরিযায়ী মানুষকে সামান্য কারণে, অকারণে হেনস্থা করা হয়েছে। ঘটনাগুলো উদ্বেগের পারদ চড়িয়ে দিচ্ছে। আবার, বরাক উপত্যকাতে বহু স্থানীয় আছেন যাঁরা বাংলাভাষী। দেশভাগের সময় সাবেক সিলেট জেলা থেকে একটা অংশ কেটে আসামের সাথে জুড়ে দেওয়া হয়েছিল। হাজেলাসাহেবের আশ্বাস মূলনিবাসী বাঙালিদের জন্যও কি? না বাঙালি আর বহিরাগতর মধ্যে সমীকরণ আছে?
প্রব্রজনের ইতিহাস ও রাজনীতি
আসামে ভূমিপুত্র-সুরক্ষার রাজনীতি পুরোনো। এই রাজনীতিকে সমর্থন করতে পারেন, বা বিরোধিতা করতে পারেন; এর গুঁড়ি কোথায় আছে বোঝার চেষ্টা করা যেতে পারে।
১৮২৬ সালে মান(বর্মী)দের তাড়িয়ে ইংরেজরা আসাম দখল করে। তারপর দফায় দফায় প্রব্রজনের ঢেউ আসামে আছড়ে পড়েছে। ১৮৯১ সালের জনগণনা বলছে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার এক-চতুর্থাংশ লোক স্থানীয় মূলের নয়। চা বাগানের শ্রমিক যোগানের জন্য ছোটনাগপুর মালভূমি থেকে আরকাঠি লাগিয়ে দলে দলে আদিবাসীদের নিয়ে আসা হয়। বাঙালি ছোটখাটো ব্যাপারী, কেরানিরা বৃটিশ সাম্রাজ্যের পিছু পিছু চলে আসেন। মনে রাখতে হবে ১৮৭৪ থেকে সিলেট আসামের অংশ ছিল। মারওয়াড়ি ব্যবসায়ী, মজুতদারেরা ইংরেজ আমলের একেবারে প্রথম থেকে আসছেন। ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার অঢেল ঘাসভূমি, জলাভূমি নেপালি গো-পালকদের টেনে এনেছে। ১৯ শতকের শেষদিক আর ২০ শতকের প্রথম থেকে পূর্ববাংলা থেকে ব্যাপকমাত্রায় ছোট চাষি, ভূমিহীনরা আসতে থাকেন। এদের সিংহভাগ ছিলেন মুসলমান ও মৈমনসিংহ জেলার। যে কারণে আজও অনেক অসমিয়ার কাছে বাঙালি মুসলমান মানে মৈমনসিঙ্গা। চাষিদের নিয়ে এসে বসত করিয়ে রাজস্ব উপার্জনের স্পষ্ট নীতি উপনিবেশি সরকারের ছিল। ছবি ১-এ লক্ষ করুন, ২০ শতকের প্রথম দশকগুলোতে ভারত আর আসামের জনসংখ্যার গতির মধ্যে বিরাট পার্থক্য।
উপনিবেশি অর্থনীতিতে ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার হল। ব্যবসা থেকে যে পুঁজির বাড়বারন্ত হল তার আসল ভাগটা রইল বহিরাগতর হাতে। লাভের গুড় খাওয়া বহিরাগতদের মধ্যে ইউরোপিয় চা বাগিচা মালিকেরা তো ছিলেনই, ভারতের মূলভূমি থেকে আসা বণিকরাও ছিলেন। বাণিজ্য অনেক সময় শোষণের জন্ম দেয়। মূলনিবাসীরা শোষণের শিকার হচ্ছিলেন, আর অনেক সময় রাগটা বেরিয়ে আসছিল বহিরাগত বিদ্বেষের মাধ্যমে। ১৮৯২-৯৩ সালে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকায় কৃষক আন্দোলন হয়। কারণ, সরকার জমির খাজনা বাড়িয়ে দিয়েছিল। অথচ, রাগ প্রকাশ পায় মারওয়াড়ি গদি ভাঙচুর দিয়ে।
এরপর দেশভাগ, বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় উপত্যকায় উদ্বাস্তুর ঢল নামে।
ইতিমধ্যে স্থানীয় বিভিন্ন জনগোষ্ঠীতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি বেড়েছে। গোষ্ঠীগুলোর জাতীয়তাবাদী চেতনা বৃদ্ধি পেয়েছে। শিক্ষা, ব্যবসা, চাকরি, জমি মালিকানার ক্ষেত্রে বহিরাগতদের সাথে কঠিন প্রতিযোগিতা ভুমিপুত্র-সুরক্ষার দাবিকে জোরদার করেছে। ইংরেজ আমলে সরকারের প্রশাসনিক চাকরিগুলোয় শিক্ষিত হিন্দু বাঙালিদের মৌরসিপাট্টা ছিল; তা নিয়ে ক্ষোভ তো ছিলই। ভূমিপুত্রের চাকরি-বাকরি, সুযোগ-সুবিধে বহিরাগত কেন দখল করবে এমন প্রশ্ন অনেক লোকের মনে দেখা দেয়। স্বাধীনতার পর থেকে আসামের অর্থনীতির হাল বলার মত কিছু নয়। প্রতি বছর লক্ষ লক্ষ লোক অন্য রাজ্যে ছোটেন কাজের খোঁজে। অর্থনৈতিক দিকগুলো ছাড়া ভাষা সংস্কৃতি হারানোর বিপন্নতাবোধও বেড়েছে। এই প্রেক্ষাপট মনে রাখলে বোঝা যাবে কেন নবীকরণের প্রতি একাংশ মানুষের সমর্থন আছে। দুর্মর আশা, এবার একটা হেস্তনেস্ত হবে।
সাথে গোটা দেশের রাজনীতিকে জুড়ে দেখতে হবে। গত তিন দশকে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বাড়বারন্ত হয়েছে। রাজনীতির ভারসাম্যের এই বদলের দরুণ রাজ্যের প্রধান রাজনৈতিক প্রশ্নে সূক্ষ্ম এক বদল হয়ে চলেছে। স্থানীয় বনাম বহিরাগত থেকে ভারতীয় বনাম অবৈধ বাংলাদেশি থেকে হিন্দু বনাম মুসলমানে রাজনৈতিক প্রশ্ন সরে সরে যাচ্ছে। আসামের জোটসরকারের বড়পক্ষ ভাজপা। ছোটপক্ষ অসমীয়া জাতীয়তাবাদী অগপ। অগপ রাতদিন বড়দাদার হিন্দুত্ববাদী জাতীয়বাদ সহ্য করছে। এর নজির নাগরিকত্ব সংশোধনী বিল (২০১৬)। বিল অনুযায়ী পাকিস্তান, আফগানিস্তান, বাংলাদেশ থেকে আসা হিন্দুরা ভারতের নাগরিকত্বের জন্য যোগ্য, মুসলমানরা নন। ভাজপা নেতা কৈলাশ বিজয়বর্গীয় হুমকি দিয়েছেন জোটসঙ্গী অগপকে বিল সমর্থন করতেই হবে। অগপ বিলের তীব্র বিরোধিতা করছে। তবে ওইটুকুই। আদর্শগত কারণে জোটত্যাগ করছে না।
নবীকরণে কী পাওয়া যাবে?
ভবিষ্যতে কী হতে চলেছে? নবীকরণ নিয়ে অনেক লোকের মনে উদ্দীপনা থাকতে পারে, শেষে কী হবে বোঝা দায়। দুটো সম্ভাবনা আছে, কোনোটাই আশাব্যঞ্জক নয়।
প্রথম, বড্ড কম বাংলাদেশি ধরা পড়ল। কারণ, (১) দুর্নীতির দরুণ তারা এন আর সি'তে ঢুকে গেছে, অথবা (২) বেশি বাংলাদেশি ছিলই না – আমরা দেখেছি ১৯৭১-এর পর রাজ্যের জনসংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়ে নি। নোট বাতিলের পর প্রায় সব নোট ব্যাঙ্কে ফেরত চলে এসেছিল, এন আর সি কান্ডেও তেমনি বহ্বারম্ভে লঘুক্রিয়া হল। তাহলে প্রশ্ন উঠবে পাবলিকের হয়রানি করে লাভ কী হল? এর জবাব হতে পারে, "এবার নিশ্চিত বুঝতে পারলাম অবৈধ বিদেশি বেশি ছিল না। আর এনিয়ে অযথা রাজনীতি হবে না।" কিন্তু, বেশি যে ছিল না তার ইঙ্গিত তো জনগণনার তথ্য থেকে পেয়েছি। আর, কেউ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন কম লোক ধরা পড়লে বাংলাদেশী তাড়ানো নিয়ে, বহিরাগত বিদ্বেষ নিয়ে রাজনীতি বন্ধ হয়ে যাবে?
দ্বিতীয় সম্ভাবনা, অনেক বাংলাদেশি ধরা হল। প্রশ্ন, তাদের নিয়ে কী করা হবে? বাংলাদেশ অবৈধ প্রব্রজনের অস্তিত্ব স্বীকার করে না। ২০১৪-র ভোটের আগে মোদিজি আশ্বাস দিয়েছিলেন বাংলাদেশিদের বিছানাপত্তর বেঁধে বাড়ি পাঠিয়ে দেবেন। কিন্তু কূটনৈতিকস্তরে বাংলাদেশের সাথে এই বিষয়ে কথাবার্তা এগোয়নি – যদিও সুপ্রীম কোর্ট সেরকম নির্দেশ দিয়েছিল। বাংলাদেশ না নিলে লোকগুলোকে ঠেলে সীমান্তের ওইপারে পাঠিয়ে দেওয়া হবে কি? বা মিয়ানমার যেভাবে রোহিঙ্গাদের তাড়ায় তেমন সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে?
এতো অনিশ্চয়তার মধ্যে একটা ব্যাপার নিশ্চিত, ভাজপা এন আর সি নিয়ে দারুণ আগ্রহী। ভাজপা সাংসদ আর পি শর্মা বলেছেন গোটা দেশে এন আর সি নবীকরণ করা দরকার যাতে পাঁচ কোটি অবৈধ বাংলাদেশিকে তাড়ানো যায়। রাজ্যপাল জগদীশ মুখি (আর এস এস, ভাজপার প্রবীণ সংগঠক) জানিয়েছেন অন্য রাজ্যে এন আর সি নবীকরণ হবে যাতে বিদেশিদের হিসেব রাখা যায়। ভাজপার এতো উৎসাহের কারণ কী?
ভাজপার খেল
একটা লাভ মতাদর্শগত। রাতদিন নাগরিকত্বের অনুশীলন ও জেনোফোবিয়া দক্ষিণপন্থী জাতীয়তাবাদী রাজনীতির খুঁটি। আধার কার্ড, নোট বাতিল, এন আর সি – গত ক'বছরে অনুষ্ঠিত যাবতীয় মহাযজ্ঞের এক সাধারণ ধর্ম এরা আমাদের কলার ধরে ঝাঁকিয়ে রাষ্ট্রযন্ত্রের সাথে যোগাযোগের কথা মনে করায়। বৈধ আর অবৈধর মধ্যে নিত্যনতুন গন্ডি টানে। রাষ্ট্রকে আর জনতা বৈধতা দেয় না। জনতা বরং বৈধতাপ্রসাদের জন্য রাষ্ট্রের দুয়ারে লম্বা লাইন দেয়। দেশ সহজ ভালবাসার বিষয় থাকে না। তাকে ভক্তিসহকারে পরিধান করে দলবদ্ধ কুচকাওয়াজে যেতে হয়।
এ গেল আদর্শের কথা। এন আর সি'র ব্যবহারিক উপযোগিতাও দেখতে হবে বই কি। প্রথম খসড়া বেরোনোর পর হিন্দু বাঙালি কিছুটা হলেও উৎকণ্ঠিত। শিলচর শহরে নাগরিক সভা, সাংবাদিক সম্মেলন হয়েছে। বরাক উপত্যকার ৪০% মানুষও প্রথম খসড়াতে জায়গা পান নি। এটা ভাজপার লোকসানের খাতায়। অন্যদিকে লাভের খাতায় লেখা হল, ভূমিপুত্রদের আশ্বস্ত করা গেছে। বলতে পারা যাচ্ছে, "বাংলাদেশি তাড়ানোর জন্য কত্তো কাজ করছি!" নোট বাতিলে কাজের কাজ না হলেও যেমন সফল প্রচার করা গেছিল "কালোবাজারিদের শায়েস্তা করছি, আপনারাও ব্যাঙ্কে লাইন দিয়ে দেশ বাঁচান।"
কিন্তু হিন্দু ডি-ভোটারদের কী হবে? হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূলে আছে ভারতবর্ষ সকল হিন্দুর পূন্যভূমি। হিন্দুত্ববাদী দল কোন হিসেবে হিন্দুদের ঘাড়ধাক্কা দিয়ে যবনের দেশে পাঠাবে? এর জবাব হয়তো আছে নাগরিকত্ব সংশোধনী বিলে। কৈলাশ বিজয়বর্গীয় আশ্বাস দিয়েছেন ২০১৯-র ভোটের আগে বিল পাস হয়ে যাবে। বিল পাস হলে হিন্দুরা ছাড়া পেয়ে যাবেন। মুসলমান ডি-ভোটাররা পড়ে থাকবেন। এই বিভাজনটা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির জয়।