গুয়াহাটী শহরের উপকণ্ঠে আমসাং অঞ্চলে ২৭ তারিখ থেকে এক বাহিনী অভিযান চালায়। প্রায় ২০০০ পুলিশ ও নির্মাণ কর্মী, ডজন খানেক হাতি ও বুলডোসার নিয়ে গঠিত এই বাহিনী। বাহিনীর কাজ আমসাং-এর গরিব লোকেদের ঘরবাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া। তিন দিনে প্রায় হাজার খানেক বাড়ি ভাঙা হয়। জনা সাতশো পরিবার উচ্ছিন্ন হন। খেপা জনতাকে সামাল দিতে পুলিশ লাঠি, কাঁদানে গ্যাস চালায় তাতে আবার কিছু লোক আহত হন। কৃষক মুক্তি সংগ্রাম সমিতির কর্মী, কার্যকর্তাদের গ্রেপতার করা হয় [১]। তাঁরা অকুস্থলে প্রতিবাদ করছিলেন।
হাতি পাঠিয়ে জমিদারি কেতায় যাঁদের বাড়ি ভাঙা হল সেই লোকগুলো কে? গৌহাটী হাইকোর্ট বলছে এরা বে-আইনি জবরদখলকারী। অভয়ারণ্যের জমি দখল করে বসে পড়েছে, এদের উচ্ছেদ করা আশু কর্তব্য। জমির প্রশ্নে পরে আসছি, আগে দেখা যাক লোকগুলো কারা। বিতর্কের অবকাশ নেই যে এঁদের সিংহভাগ পূর্ব আসামের জনজাতি গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত। বন্যা ও ব্রহ্মপুত্রের অবিরত পাড় ভাঙার ফলে ভিটেমাটিকাজকম্মোহারা হয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে জীবিকার সন্ধানে গুয়াহাটিতে এসে পড়েছেন; কম দামের বাসস্থান খুঁজে শহরের উপকণ্ঠে আমসাং-এর হদিশ পেয়েছেন।
উচ্ছিন্নরা স্থানীয় জনজাতি না হলে উচ্ছেদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এতোটা জোরালো হত কি? বলা কঠিন। অসমীয়া খবরের কাগজে উচ্ছিন্নদের আগে প্রায়শ “খিলঞ্জিয়া” বিশেষণ ব্যবহার হচ্ছে। খিলঞ্জিয়া মানে স্থানীয়, ইন্ডিজেনাস, ভূমিপুত্র। মনে রাখা ভাল, বাংলাদেশী (পড়ুন মুসলমান) অনুপ্রবেশকারীদের থেকে আসামের জাতি-মাটি-ভেটি রক্ষা করার স্লোগান দিয়ে বর্তমান রাজ্য সরকার ক্ষমতায় এসেছে (ভেটি মানে ভিত্তি, আধারশিলা)। খবরের কাগজ বা টিভিতে উচ্ছেদ অভিযানের প্রতিক্রিয়া তাই বিরূপ ও তৎক্ষণাৎ হয়েছে। আমসাং-এর ভৌগোলিক অবস্থান গুয়াহাটীর কাছে, সেটাও মিডিয়াকে সাহায্য করেছে। আপাতত, আদালত অভিযান বন্ধ করার স্থগিতাদেশ দিয়েছে বলে খবর।
এবার জমির প্রসঙ্গে আসা যাক। আদালত ও আদালতে পি আই এল আর্জিকারীদের মতে জমি আমসাং অভয়ারণ্যের। এই দাবি বিতর্কিত। সমাজকর্মী ও তাদের উকিলদের মতে জমি অরণ্য অঞ্চলে পড়ে না, পরিবেশ-স্পর্শকাতর অঞ্চলে পড়ে (ইকো-সেন্সিটিভ জোন) [২]। সেক্ষেত্রে উচ্ছেদ না করে অধিবাসীদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করার কথা। এমন দাবিও করা হয়েছে যে সরকারি দলিল অনুযায়ী জমি খাজনা গ্রামের অন্তর্ভুক্ত (রেভিনিউ ভিলেজ), সেক্ষেত্রে অধিবাসীদের হটানো যায় না।
এসব চুলচেরা আমলা-উকিল বিতর্কের বাইরে গেলে যে জিনিসটা ধীরে ধীরে স্পষ্ট হয়ে আসছে তা বর্তমান শাসনের প্রকৃতি। গত বছর কাজিরাঙ্গা অভয়ারণের কাছে তিনটে গ্রাম উচ্ছেদ করে দেওয়া হয়। সে সময়ে ভুগেছিলেন দরিদ্র চাষিরা, যাঁরা মূলত বাংলাভাষী মুসলমান, এক সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে এসেছেন। পুলিশের গুলিতে দুজনের মৃত্যু হয়। গত মাসে সিপাঝার শহরের কাছে এক গ্রামে বাঙালী মুসলমানদের উচ্ছেদ অভিযান চলে [৩]। এই দুই বারই রাজ্যের সবচেয়ে বড় নন্দ ঘোষ অবৈধ বাংলাদেশীদের নামে বিল কাটা হয়। আমসাং-এ কাঠগড়ায় দাঁড় করা হয়েছে বে-আইনি জমি দখলকারীদের। আমসাং হোক বা কাজিরাঙ্গা, বা সিপাঝাড়, উচ্ছেদের ভুক্তভোগীদের সাধারণ ধর্ম তাঁরা গরিব। আপনি খিলঞ্জিয়া জনজাতি হতে পারেন বা বাংলাভাষী মুসলমান, আপনার দারিদ্র্য, আপনার সামাজিক অপর-তা উচ্ছেদের চাঁদমারিতে ফেলে দেবে। আমসাং অভয়ারণ্যে বৃহৎ পুঁজিপতির কারখানা বহাল থাকবে। জবরদখলকারী জনজাতিদের টিন-দর্মার বাড়ি সরকারি হাতি গুঁড়িয়ে দিয়ে যাবে।
ছবিঃ দ্য এ্যাটলান্টিক[৪]>