
গৌরচন্দ্রিকা
“সেন্টার ফর দ্য স্টাডি অফ ডেভেলাপিং সোসাইটি” এবছর লোকসভা ভোটের পর সমীক্ষা চালায় বিভিন্ন রাজ্যে কত শতাংশ হিন্দু বিজেপিকে ভোট দিয়েছেন [১]। আসাম প্রথম হয়েছে, রাজ্যে ৭০% হিন্দু পদ্মফুলে ছাপ দিয়েছেন। গুজরাটের মত পাঁড়-বিজেপি রাজ্যেও ৬৭% হিন্দু বিজেপির পক্ষে ছিলেন (পশ্চিমবঙ্গে ২১% থেকে ৫৭% হয়েছে, সে অন্য প্রসঙ্গ)। আসামে মেরুকরণের এই অভাবনীয় সাফল্যের কারণ কী?
এবারের ভোট চিত্তাকর্ষক কিছু প্রশ্নেরও জবাব দিয়েছে। প্রশ্নগুলো এরকম। এক, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল, ২০১৬ বিজেপির ক্ষতি করবে কিনা। বিলটি ২০১৬ সালে সংসদে পেশ করা হয়, বিজেপি ছিল মূল সমর্থক। বিল আইনে পরিণত হলে পড়শী দেশের অ-মুসলমান অনুপ্রবেশকারীরা সহজে ভারতের নাগরিকত্ব পাবেন। আসামে বিজেপি অসম গণ পরিষদ (অগপ) ও বোড়ো পিপলস ফ্রন্ট (বিপিএফ)-এর সাথে সরকার চালাচ্ছে। অগপ ও বিপিএফ বিলের বিরোধী। তাদের আশঙ্কা বিল পাশ হলে হিন্দু বাংলাদেশিরা আসাম অধিকার করে নেবে। গোটা উত্তরপূর্ব অঞ্চল জুড়ে বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়েছে।
দুই, এবছর বদরুদ্দিল আজমলের দল এ আই ইউ ডি এফ মাত্র তিনটি আসনে লড়েছে। আজমলের দল বাংলাভাষী মুসলমানদের মধ্যে প্রভাবশালী। হালে দলের অবস্থা পড়তির দিকে। মুসলমান ভোট যাতে কংগ্রেসের সাথে ভাগ না হয়ে যায় তাই এ আই ইউ ডি এফ ঠিক করেছিল আগের বারে জেতা তিনটি আসনেই লড়বে (বরপেটা, ধুবড়ি, করিমগঞ্জ)। কংগ্রেসের কি লাভ হবে?
তিন, ২০১৪ সাল থেকে আদালতের তত্ত্বাবধানে আসামে এন আর সি’র কাজ চলছে। প্রত্যেক আসামবাসীকে প্রমাণ করতে হবে সে বা তার বাপ-ঠাকুদ্দা ১৯৭১, ২৫ মার্চের আগে রাজ্যে এসেছেন। প্রায় ৫০ বছর আগের দলিল দস্তাবেজ জোগাড় করা চাট্টিখানি কথা নয়। মধ্যবিত্তরাই হিমশিম খাই, নিরক্ষর, গরিব মানুষদের কথা ভাবুন। মহিলারা পড়েছেন বেশি ফাঁপড়ে; বিবাহিতাদের পদবী, ঠিকানা বদলে যায়, ফলে বংশবৃক্ষ প্রমাণ করা বেশি কঠিন। এন আর সি প্রক্রিয়া “আদি নিবাসী” ও বহিরাগতের মধ্যে ফারাকও করছে। কেননা বহিরাগতদের জন্য দলিল দস্তাবেজ যাচাই প্রক্রিয়া বেশি কড়া (পশ্চিমবঙ্গে এন আর সি হলে ঘটিদের ছাড় দেওয়া হবে কিনা অমিত “উইপোকা” শাহবাবু জানেন) [২]। এন আর সি সম্পন্ন করার জন্য বিজেপি কম বাহাদুরি করে নি। রাজ্যে যে বিরাট সংখ্যক বহিরাগত জনগণ আছে তারা কি বিজেপিকে ভোটে শায়েস্তা করবে?
চার, উজনী আসাম মানে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার পূর্ব দিক। এই অঞ্চল অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের দূর্গ ছিল, আলফার জন্ম এখানে। ২০১৪ সালের ভোটে বিজেপি সব হিসেব উল্টিয়ে দিয়ে উজনীতে আশাতীত ফল করে। তেজপুর, লক্ষীমপুর, ডিব্রুগড়, যোরহাট – কলিয়াবর বাদে উজনীর সবক’টা আসন জেতে। উজনী আসাম দখল করে বিজেপি আসাম দখল করেছে বলা যায়। এবছর জাতীয়তাবাদীরা নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে উজনী আসাম কাঁপিয়েছেন। নভেম্বর মাসে যে পাঁচজন বাঙালি শ্রমজীবীকে হত্যা করা হল, সম্ভবত নাগরিকত্ব বিলের প্রতিবাদে, তা এই উজনীতেই। বিজেপি উজনী আসামে ধরে রাখতে পারবে?
সর্বভারতীয় প্রশ্নগুলো – যেমন নোটবাতিল, জি এস টি, পুলওয়ামা, বেকারসমস্যা – আমরা বাদ দিলুম। ২০১৯ সালের ভোটের ফলের সারসংক্ষেপ ১ নং তালিকায় দেওয়া আছে।
২০১৯ ভোটের ফলাফল
| ২০১৪ | ২০১৯ | |||
| ভোট শতাংশ | আসন | ভোট শতাংশ | আসন | |
| বিজেপি | ৩৬.৮৬ | ৭ | ৩৬.০৫ | ৯ |
| কংগ্রেস | ২৯.৯ | ৩ | ৩৫.৪৪ | ৩ |
| এ আই ইউ ডি এফ | ১৪.৯৮ | ৩ | ৭.৮ | ১ |
| অগপ | ৩.৮৭ | ০ | ৮.২৩ | ০ |
| বিপিএফ | ২.২১ | ০ | ২.৪৮ | ০ |
| নির্দল (সরণিয়া) | ৩.২৪ | ১ | ২.৭ | ১ |
তালিকা ১ – ২০১৪ ও ২০১৯ সালে বড় দলগুলোর ভোট শতাংশ ও আসন সংখ্যা। নবকুমার সরণিয়া নির্দল প্রার্থী হিসেবে কোকরাঝার কেন্দ্র থেকে পরপর দু’বার জিতেছেন। সূত্রঃ নির্বাচন কমিশন ওয়েবসাইট
বিজেপির আসন সংখ্যা সাত থেকে নয় হয়েছে। ওদের ভোটের অনুপাত কিন্তু সামান্য কমেছে। ৩৬% ভোট থেকে ৬৪% আসন পেয়েছে। দুই, কংগ্রেসের আসন সংখ্যা একই রয়েছে, তিন। ভোট অনুপাত বেড়েছে, প্রায় বিজেপির সমান ভোট, তাও বিজেপির তিন ভাগের এক ভাগ আসন পাওয়ার একটা কারণ কংগ্রেস জোট বানাতে পারে নি। তিন, এ আই ইউ ডি এফের ক্ষতি সবচেয়ে বেশি। আসন তিন থেকে একে নেমেছে, শুধু বদরুদ্দিন আজমল ধুবড়ি থেকে জিতেছেন। প্রায় সাত শতাংশ ভোট হারিয়েছে। চার, বিজেপির জোটসঙ্গী অগপ ও বিপিএফ কোনও আসনে জেতেনি।
অগপকে যে তিনটি আসন ছাড়া হয়েছিল সেগুলো বিজেপি বা অগপ কারো পক্ষে জেতা সহজ ছিল না (ধুবড়ি, বরপেটা, কলিয়াবর)। ২০১৪ সালে যখন জোট ছিল না বিজেপি এর একটাও জেতেনি। অগপ চার নম্বরে ছিল বা আরও নিচে। এবছর জোটের দৌলতে বিজেপি অগপকে ভোট ট্রান্সফার করেছে, তা সত্বেও অগপ জিততে পারে নি। ট্রান্সফারের ফলে বিজেপির ভোট শতাংশ কমে গেছে। অগপ বিজেপিকে অন্য আসনে ভোট ট্রান্সফার করেছে কিন্তু তার পরিমান সামান্য ছিল। এই হল বিজেপির ভোট কমার কারণ।
আসনওয়ারি ভোট
বিশ্লেষণের খাতিরে আসামের ১৪ খানা আসনকে তিন ভাগে ভাগ করতে পারি। (১) শিলচর, করিমগঞ্জ। দুটো আসনই বরাক উপত্যকায়, বাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চল। গতবার যথাক্রমে কংগ্রেস, এ আই ইউ ডি এফ জিতেছিল। এবার বিজেপি দুটোই ছিনিয়ে নিয়েছে। শিলচর আসনে বিজেপির ভোট চমকপ্রদ ১৫% বেড়েছে, কংগ্রেসের বেড়েছে মাত্র ২%। এ আই ইউ ডি এফ না লড়ার ফলে ওদের ভোট কংগ্রেসে গেছে অনুমান করা যায়, তা সত্বেও কংগ্রেস সুবিধে করতে না পারার কারণ সম্ভবত কংগ্রেসের হিন্দু ভোট বিজেপিতে গেছে। করিমগঞ্জ এ আই ইউ ডি এফের মজবুত জায়গা। কংগ্রেস সেখানে প্রার্থী দিয়ে এ আই ইউ ডি এফের যাত্রা ভঙ্গ করেছে, বিজেপি কম মার্জিনে বেরিয়ে গেছে। কংগ্রেস আর এ আই ইউ ডি এফের ভোট যোগ করলে বিজেপি হেরে যায়।
(২) তেজপুর, লক্ষীমপুর, ডিব্রুগড়, যোরহাট, স্বায়ত্বশাসিত জেলা। মোটামুটি উজনী আসামে অবস্থিত আসনগুলো। জনজাতি ও অসমীয়াভাষী লোকেদের সংখ্যাগরিষ্ঠতা, মুসলমান জনসংখ্যা কম। বিজেপি সবক’টা আসন জিতেছে। তিনটি আসনে ভোটের শতাংশ ৬০% ছাড়িয়ে গেছে। সরাসরি লড়াই হয়েছে কংগ্রেসের সাথে। কয়েকটায় কংগ্রেসের ভোট অনুপাত বেড়েছে, কিন্তু বিজেপিকে টেক্কা দিতে পারে নি। বিজেপির সবচেয়ে ভাল অবস্থা বোধহয় এই ২নং ভাগেই।
(৩) কলিয়াবর, নগাঁও, গুয়াহাটি, বরপেটা, মঙ্গলদৈ, কোকরাঝার, ধুবড়ি। আসনগুলো মধ্য ও নামনী (পশ্চিম) আসামে, জনসংখ্যা মিশ্রপ্রকৃতির। মুসলমান, কোচ রাজবংশী, বোড়ো, রাভা, তিওয়া ইত্যাদি জনগোষ্ঠীর বাসস্থান। এখানেই বিজেপির জোটসঙ্গীরা লড়েছে ও হেরেছে। বিজেপি নিজে নগাঁওয়ে হেরেছে কংগ্রেসের কাছে। কংগ্রেস এ আই ইউ ডি এফের থেকে বরপেটা ছিনিয়ে নিয়েছে। সব মিলিয়ে কংগ্রেস দুটো আসনে এ আই ইউ ডি এফের আসন হারানোর কারণ হয়েছে, করিমগঞ্জ ও বরপেটা। এই ভাগে কংগ্রেস পেয়েছে ৩, বিজেপি ২, এ আই ইউ ডি এফ ১, নির্দল ১টি আসন।
যে চারটে প্রশ্ন দিয়ে শুরু করেছিলাম তাতে ফেরা যাক। এক, নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিলের বিরোধ বিজেপির ক্ষতি করতে পারে নি। বিজেপির সাথে কংগ্রেসের সরাসরি লড়াই যে আসনগুলোয় তার ফলাফল দেখে এরকম অনুমান করা যায়। বিলবিরোধী ভোট কংগ্রেসের ঝুলিতে এসেছে বটে, কিন্তু পরিমান বেশি ছিল না। বিজেপির ক্ষতি না হওয়ার একটা কারণ সম্ভবত এন আর সি দেখিয়ে অসমীয়া জাতীয়তাবাদীদের সন্তুষ্ট করা গেছে। হিন্দুত্বের দাওয়াই তো আছেই।
দুই, এ আই ইউ ডি এফের না লড়ার ফলে কংগ্রেসের খানিক লাভ হয়েছে, তবে তেমন কিছু হয় নি। নগাঁওয়ে কংগ্রেসের জেতার কারণ বদরুদ্দিনের পার্টি দাঁড়ায় নি। অথচ, করিমগঞ্জে লড়ে কংগ্রেস উলটে এ আই ইউ ডি এফের ক্ষতি করে দিয়েছে। কংগ্রেসের হিংসুটেপনার কারণ ওরা ভয় পেয়েছে মুসলমান পার্টি এ আই ইউ ডি এফের সাথে বোঝাপড়া করলে হিন্দু ভোট হারাবে। অথচ হিন্দু ভোট এমনিতেই বিজেপির দিকে গেছে।
তিন, এন আর সি’র জন্য বিজেপির ক্ষতি হয় নি। অনুমান করা যায় হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালির মধ্যে ধর্মের ভিত্তিতে ভোট ভাগ হয়েছে। হিন্দু বাঙালির সামনে নাগরিকত্ব বিলের ললিপপ ঝুলিয়ে এন আর সি’র হয়রানিগুলোকে ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে।
চার, উজনী আসামে বিজেপির বিজয় অব্যাহত। কোনও আসনেই বিজেপির ভোট অনুপাত কমে নি। ২০১৮ সালে আসামে পঞ্চায়েত ভোট হয়, তাতেও বিজেপি উজনীতে ভাল ফল করে। বিশ তিরিশ বছর আগে অবধি অসমীয়া জাতীয়তাবাদ আসামের রাজনীতিতে গভীর প্রভাব ফেলত। সেই পর্যায় শেষ। উজনী আসামের ফল যেন তাতে শিলমোহর লাগাল।
শেষ কথা
কী করে ৭০% হিন্দু একটি পার্টিকে ভোট দিল? সংক্ষেপে, বিজেপি তিনটি হাতিয়ার ব্যবহার করেছে। এক, এন আর সি দিয়ে স্থানীয় মানুষদের বাংলাদেশী অনুপ্রবেশ নিয়ে উৎকণ্ঠাকে ঠান্ডা করেছে। স্থানীয় জাতীয়তাবাদী ভোট বহুদিন থেকে বিজেপির দিকে ঝুঁকছিল। সেই প্রবণতা আরও মজবুত হল। দুই, নাগরিকত্ব বিলকে কাজে লাগিয়ে বহিরাগতদের ধর্মের ভিত্তিতে টুকরো করেছে। এন আর সি’র আতঙ্কে জেরবার বহিরাগত হিন্দু বাঙালি, হিন্দু নেপালি নিজের নাগরিকত্ব বাঁচাতে বিজেপির পাশে দাঁড়িয়েছে। সাম্প্রদায়িক মেরুকরণে হাওয়া লেগেছে। তিন, বিজেপি স্থানীয় জাতীয়তাবাদী দল, জনজাতিভিত্তিক দলগুলোর সাথে ফলপ্রসূ জোট বানিয়েছে। ওদের বহিরাগত নিয়ে আশঙ্কাকে মুসলমান নিয়ে আশঙ্কায় পরিণত করা সহজ ছিল না। লেকিন, মোদী হ্যায় তো মুমকিন হ্যায়।
অন্যদিকে কংগ্রেস বহু সুযোগ হারিয়েছে। বড় দলগুলোর মধ্যে একমাত্র কংগ্রেস নাগরিকত্ব বিলের বিরুদ্ধে। তা সত্বেও বিলবিরোধী বিক্ষোভের ফসল কংগ্রেস ঘরে তুলতে পারে নি। এন আর সি’র একুশে আইনে ব্যতিব্যস্ত মানুষকে আশ্বস্ত করতে পারে নি, তাদের হকের লড়াই লড়তে পারে নি। বরং এন আর সি’র বাহাদুরি নেওয়ার চেষ্টা করেছে। হিন্দুদের চটানোর ভয়ে এ আই ইউ ডি এফের ক্ষতি করে বিজেপিকে জিতিয়েছে।
স্থানীয় জাতীয়তাবাদীদের দুর্বলতর হয়ে যাওয়া এই ভোটের একটি জরুরি বার্তা। আসামের রাজনীতির ইতিহাসজ্ঞ অমলেন্দু গুহ বৃহৎ ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও ক্ষুদ্র আঞ্চলিক জাতীয়তাবাদের টানাপোড়েন নিয়ে তত্ত্ব দিয়েছিলেন। বর্তমান আসামের রাজনৈতিক রূপরেখা বিপজ্জনক সঙ্কেত দিচ্ছে। ক্ষুদ্র জাতীয়তাবাদ যখন বৃহৎ জাতীয়তাবাদের হাতের পুতুল হয়ে যায় সে আর স্থানীয় মধ্যবিত্ত, উচ্চমধ্যবিত্তের আশা-আকাঙ্খাকে ধারণ করতে পারে না। তারা কি সামনের দিনে অন্য কোনো রূপে বেরিয়ে আসবে?
সূত্রঃ
[১]https://scroll.in/article/863831/interview-everyone-will-be-the-same-level-of-citizen-says-the-state-coordinator-in-assam
[২]https://www.thequint.com/news/politics/narendra-modi-hindutva-lok-sabha-election-results-2019-csds-survey-muslims-sikhs?fbclid=IwAR2M9W1c1cWc_SXjLj3Q7U5DavlMLo7K6_mwpaoAm2KwJT9nMnxC7EwenyI