
২০১৪ সালের নির্বাচনের ভারতীয় জনতা পার্টির ইস্তেহারে লেখা আছে, ‘অত্যাচারিত হিন্দুদের জন্য ভারতবর্ষ স্বাভাবিক আশ্রয়স্থল থাকবে। আশ্রয়ের জন্য তাঁরা এদেশে আসতে চাইলে স্বাগত’ (India shall remain a natural home for persecuted Hindus and they shall be welcome to seek refuge here)।[১] ঘোষণাটা ভোটের বাজারের মামুলি বুকনিবাজী নয়। এর সাথে হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শের যোগ আছে। ভারতবর্ষ হিন্দুদের পিতৃভূমি, পুণ্যভূমি। সাভারকার সাহেব ‘হিন্দুত্বঃ কে হিন্দু?’ পুস্তিকাতে লিখেছেন ভারতীয় মুসলমান বা খ্রীষ্টানের সাথে হিন্দুর এখানেই তফাত। হিন্দুদের পিতৃভূমি ও পুণ্যভূমি ভারতে; ওদের পুণ্যভূমি আরবে, জেরুজালেমে। অর্থাৎ ভারতবর্ষের মাটির ওপর হিন্দুদের অধিকার বাকিদের তুলনায় এক কাঠি বেশি। এই দেশ বিশ্বের হিন্দুদের আশ্রয়স্থল।
এই প্রসঙ্গে ‘তাহলে ধর্মনিরপেক্ষতার কী হল?’ কোশ্চেনটা জরুরি, কিন্তু আপাতত তা মুলতুবি থাক। আগে এই নীতির ফলাফল কী হতে পারে দেখা যাক। আসামের দিক থেকে দেখলে ‘ভারত হিন্দু আশ্রয়স্থল’ নীতির বিশেষ তাৎপর্য আছে। ২০১৪-এর নির্বাচনের সময়ে মোদিজি অর্ণব গোস্বামীকে সাক্ষাৎকার দেন।[২] অর্ণব জিজ্ঞেস করেন বাংলাদেশে দেড় কোটি হিন্দু আছে। আপনারা দেড় কোটি লোককে ভারতে (পড়ুন আসামে) চলে আসার আমন্ত্রণ দিচ্ছেন না তো? মোদিজি স্বভাবসিদ্ধ প্রাজ্ঞতায় জানান হিন্দু কোনও ধর্মই নয়, জীবনশৈলী। সাংবাদিকদের বাংলাদেশে গিয়ে হিন্দুদের ওপর গবেষণা করা উচিত। ফিজি নিয়ে বলছেন না কেন? ইত্যাদি। হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়ার নীতি মোদি সরকার বলবৎ করবে এ নিয়ে সন্দেহ থাকে না।
লোকে বলে মোদিজি কথা রাখেন না। ১৫ লক্ষ টাকা ব্যাঙ্কে ঢোকার কথা ছিল, বছরে এক কোটি রোজগার তৈরি হওয়ার কথা ছিল। সব ফক্কা। কথাটা পুরো সত্যি নয়। হিন্দুদের আশ্রয় দেওয়ার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করা হচ্ছে। ২০১৬ সালে কেন্দ্র সরকার লোকসভায় ‘নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল ২০১৬’ আনে।[৩] বিল বলছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও আফগানিস্তানের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকেরা এদেশে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া আশ্রয় নিতে পারেন। ৭ বছর এদেশে বাস করলে তাঁরা স্বাভাবিকতার (naturalisation) মারফৎ নাগরিক হওয়ার আবেদন জানাতে পারবেন (অন্যদের জন্য ১২ বছর)। কারা এই ভাগ্যবান সংখ্যালঘু? হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, খ্রীষ্টান, পার্সি।
আসামে বিলের বিরুদ্ধে সভাসমিতি, মিছিল, পিটিশন শুরু হয়ে যায়। আসাম চুক্তি মতে ১৯৭১-এর ২৪ মার্চের পরে আসা বিদেশিদের নাগরিক হিসেবে স্বীকার করা হবে না। হিন্দু হোক বা মুসলমান, সোজা ধরে বহিষ্কার করে দেওয়া হবে। ছ’ বছরের দীর্ঘ আসাম আন্দোলনের ফল, বহু শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া আসাম চুক্তি, তাকে খারিজ করবে ভাজপার নাগরিকত্ব বিল! – অসমিয়া জাতীয়তাবাদী অংশ থেকে প্রশ্নটা উঠছে যদিও, রাজনীতির পরিহাস হল, আসাম আন্দোলনের নেতারা বর্তমান রাজ্য সরকারে ভাজপার ছোট সরিক। জাতীয়তাবাদী দল অগপ নাগরিকত্ব বিলকে ‘জাতিধ্বংসী বিধেয়ক’ বলে লাফঝাঁপ দিচ্ছে, সরকার থেকে বেরিয়ে যাওয়ার হুমকি দিচ্ছে, কিন্তু বেরিয়ে আসছে না।
অন্যদিকে ভাজপা গেরিলা কৌশলে খেলছে। কখনও ঘাপটি মারছে, কখনও সামনে আত্মপ্রকাশ করছে। সপ্তাহ কয়েক আগে যৌথ সংসদীয় সমিতি (জে পি সি) বিল সম্পর্কে অঞ্চলের মানুষদের মতামত নেওয়ার জন্য গুয়াহাটি আর শিলচরে শুনানির আয়োজন করে। তার উত্তাপ গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে। গুয়াহাটি শিলচর দুই শহরেই জে পি সি’র শুনানির সামনে গণসমাবেশ, ভাষণ, মানবশৃঙ্খল ইত্যাদি হয় -- যথাক্রমে বিলের বিরুদ্ধে ও পক্ষে। গুয়াহাটিতে হাওয়া বেগতিক বুঝে ভাজপা নেতারা জে পি সি’র কাছে নিজেদের বক্তব্য জানাতেই গেলেন না। শিলচরে অবশ্য বিলের পক্ষে বলে এসেছেন ওনারা। কংগ্রেসের বিড়ম্বনা আরও করুণ। গুয়াহাটিতে ব্রহ্মপুত্র উপত্যকার কংগ্রেসি নেতারা বিলের বিরোধিতা করছেন। শিলচরে বরাক কংগ্রেসের নেতারা বিলের সমর্থন করছেন। আন্তঃউপত্যকা রেষারেষি আসাম প্রদেশে নতুন বস্তু নয়, সেই বৃটিশ আমল থেকে চলে আসছে। রাজনৈতিক দলের ভেতরে উপত্যকাভেদে ভাগ এতো বেশি আগে দেখা যায় নি সম্ভবত।
ভাজপার দিক থেকে দেখলে বিলের অন্তত দুটো উপকারিতা আছে। প্রথমত, মতাদর্শগত লাভ। নাগরিকত্ব বিল ভারত হিন্দুদের ধাতৃভূমি পুণ্যভূমি মৌলবাদী ধারণাকে আইনি জামা পরিয়ে দিচ্ছে। দুই, এন আর সি।[৪] এন আর সি’তে আসামের বাসিন্দাদের নাম তোলার প্রক্রিয়া এখনো শেষ হয় নি। এন আর সি’র শেষ তালিকা বেরোনোর কথা ৩০ জুন তারিখে। বেরোলে বোঝা যাবে ক’জন আসামবাসী জায়েজ, আর কারা বাংলাদেশি। যদি দেখা যায় হিন্দু আসামবাসীদের বড় অংশের নাম লিস্টে নেই, ভাজপা নাগরিকত্ব বিলের মুলো ঝুলিয়ে বলবে আমরা হিন্দুদের পরিত্রাতা, বিল পাস করিয়ে হিন্দুদের বাংলাদেশে বহিষ্কার হওয়া থেকে রক্ষা করব। খিলঞ্জিয়া (স্থানীয়) সম্প্রদায়ের বিল বিরোধিতাকে ঠান্ডা করতে বলা হবে এতো হিন্দু বেরিয়ে গেলে আসাম মুসলমান শাসনে চলে যাবে যে। বিল সমর্থন করুন। ইতিমধ্যে এরকম বয়ান শোনাও যাচ্ছে। ১৯৩০, ৪০-এর দশকে আসামে মুসলিম লিগের সরকার চলেছিল। সে অভিজ্ঞতা বড় মধুর নয়। ফলে সাম্প্রদায়িক উস্কানি লোকে খেতে পারে।
আর যদি কম সংখ্যক হিন্দু আসামবাসীর নাম এন আর সি তালিকার বাইরে থাকে, তাহলে বিল বিরোধিদের ধার কমে যাবে। কেননা কম লোককেই জায়গা দিতে হচ্ছে। সংক্ষেপে বলতে গেলে, ভাজপার কাছে নাগরিকত্ব বিল হিন্দু ভোটকে সংহত করার হাতিয়ার।
আসামের রাজনীতির মারপ্যাঁচের বাইরে গিয়ে বিল সম্পর্কে দু একটা কথা বলে শেষ করা যাক। বলা বাহুল্য, বিলের মূল সুর ধর্মনিরপেক্ষতার বিরুদ্ধে যাচ্ছে। ফলে ভারতের সংবিধানের ১৪ তম অনুচ্ছেদকে (আইনের সামনে সবার সমান অধিকার) লঙ্ঘণ করছে। বিল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে, শুধু পাকিস্তান, বাংলাদেশ, আফগানিস্তানের মত মুসলমানপ্রধান দেশের সংখ্যালঘুদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা কেন? শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমারেও সংখ্যালঘুদের ওপর অত্যাচার হয়, এদের মধ্যে মুসলমানরা আছেন। মিয়ানমারের সংখ্যালঘুদের নাগরিকত্ব দিলে মুসলমানেরা ভারতের নাগরিক হয়ে যাবে এই ভয়? আবার পাকিস্তানে শিয়া, আহমাদিয়া বা হাজারাদের ওপর অত্যাচার চলে আসছে বহুদিন। তাঁদের জন্য নাগরিকত্বের ব্যবস্থা নেই তাঁরা মুসলমান বলে? প্রশ্ন এরকমও উঠতে পারে, ধর্মকেই সংখ্যালঘুতার ভিত্তি কেন ধরা হচ্ছে? রাজনৈতিক কারণে বা সমকামিতার জন্যও তো অত্যাচার হয়। সেই সংখ্যালঘুরা কি জায়েজ সংখ্যালঘু নয়?
আশ্চর্যজনকভাবে নাগরিকত্ব বিল বলছে আশ্রয় পাওয়ার জন্য সংখ্যালঘুদের অত্যাচারিত হওয়ার প্রমাণ দাখিল করতে হবে না। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের হলেই চলবে। ধরা যাক একজন হিন্দু বহাল তবিয়তে বাংলাদেশে আছেন, অত্যাচারিত হচ্ছেন না। তিনি কাগজপত্র ছাড়া ভারতে আশ্রয় চাইতে পারেন কেননা তিনি হিন্দু। অথচ যখন বিলের সপক্ষে যুক্তি দেওয়া হচ্ছে বলা হচ্ছে সংখ্যালঘুরা অত্যাচারিত তাই আশ্রয়![৫] সন্দেহ জাগে আসলে অত্যাচারিত-টারিত যুক্তিগুলো নিছক শাক বই আর কিছু নয়। মাছ হচ্ছে ভারতে হিন্দুরাষ্ট্র আসছে।
দেশ সব অত্যাচারিত মানুষের আশ্রয়স্থল হোক -- ন্যূনতম আদর্শ এরকম হতে পারে। নাগরিকত্ব (সংশোধনী) বিল অত্যাচারিত সংখ্যালঘুর প্রশ্নকে আলোচনার কেন্দ্রে এনে একটা কাজের কাজ করেছে। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, আনা হল সংখ্যালঘুর গায়ে সাম্প্রদায়িক রং চড়িয়ে।
h | unkwn.***.*** | ২৫ মে ২০১৮ ০২:০৫83808
Prativa Sarker | unkwn.***.*** | ২৫ মে ২০১৮ ০২:৩৭83809
S | unkwn.***.*** | ২৫ মে ২০১৮ ০৮:৫০83810
hht | unkwn.***.*** | ২৬ মে ২০১৮ ০২:০২83814
ddt | unkwn.***.*** | ২৬ মে ২০১৮ ০৬:৩২83811
ddt | unkwn.***.*** | ২৬ মে ২০১৮ ০৬:৩৭83812
সুশান্ত কর | unkwn.***.*** | ২৬ মে ২০১৮ ০৭:২১83813