এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  ধারাবাহিক  উপন্যাস  শনিবারবেলা

  • নকশিকাঁথা (৯)

    বিশ্বদীপ চক্রবর্তী
    ধারাবাহিক | উপন্যাস | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮০২ বার পঠিত
  • নকশিকাঁথা – উপন্যাসের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট এবং বাঙালি অভিবাসী জীবনের না জানা সময়

    ১৮৯০ এর দশক। তখন আমেরিকা এক সন্ধিক্ষণে। কালো মানুষেরা সদ্যই স্বাধীন। কিন্তু আমেরিকার দক্ষিণের রাজ্যগুলোতে বিভিন্নভাবে তাদেরকে আবার অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। অন্যদিকে শিল্প বিপ্লবের শেষ পর্যায়ে এসে মধ্যবিত্ত সাদা মানুষের আমেরিকা নিজেদের জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য পেরিয়ে ধর্ম এবং সংস্কৃতির খোঁজ শুরু করেছে। বিবেকানন্দের আমেরিকা বিজয়, হিন্দু ধর্মের জন্য আমেরিকার কৌতূহল এবং পৃষ্ঠপোষকতার খবর আমাদের জানা আছে। কিন্তু এই আগ্রহ শুধু ধর্মের ক্ষেত্রে নয়। পণ্য এবং বিনোদনের জগতেও ছিল। তারই হাত ধরে এমনকি বিবেকানন্দ আসার আগেও আমেরিকায় এসে গেছিল চুঁচুড়া, তারকেশ্বর, চন্দনপুর, বাবনানের কিছু লোক তাদের চিকনের কাজের পসরা নিয়ে। হাজির হয়েছিল উত্তর আমেরিকার সমুদ্রতটে। ছড়িয়ে পড়েছিল আমেরিকার বিভিন্ন শহরে, সংসার পেতেছিল কালোদের সমাজের অংশ হয়ে। শুধু চিকনদারেরা নয়। শতাব্দীর শেষের দিকে বৃটিশ জাহাজ থেকে পালিয়ে নিউ ইয়র্কে নেবে যাচ্ছিল সিলেট, চট্টগ্রাম থেকে আসা মাঝি-মাল্লারাও। মধ্য আমেরিকার শিল্পাঞ্চলে কাজের অভাব ছিল না কোন।

    বড় অদ্ভুত এই সময়। একদিকে দ্রুত শিল্পের বিকাশ ঘটছে, দেশ বিদেশ থেকে মানুষ এসে জড়ো হচ্ছে আমেরিকায়। আবার পাশাপাশি কালোদের উপর নিপীড়ন বাড়ছে, এশিয়া থেকে আসা অভিবাসীদের জন্য কঠিন হয়ে উঠছে সব নিয়মকানুন। বাবনানের চিকনদার আলেফ আলি আর পাঁচকড়ি মণ্ডল, সিলেটের গোবিন্দ সারেং কি আক্রাম, বেদান্ত সোসাইটি গড়ে তুলতে আসা অভেদানন্দ - এমনি আরও অনেকের জীবন জড়িয়ে যাবে অনেক রঙের মানুষের দেশ আমেরিকার এক উথালপাথাল সময়ে, বুনবে নানা রঙের নকশিকাঁথা।



    ১৮৯৭ সালের ১৫ই জুনের রাত। স্বচ্ছ, টলটলে আকাশে তারারা সাঁতার কাটছিল, নিচে টিমটিমে বাতি-স্তম্ভ জ্বালিয়ে জাগছিল এলিস আইল্যান্ড। স্ট্যাচু অব লিবার্টি সেই আধো-আঁধার গায়ে মেখে দাঁড়িয়ে ছিল স্ব-মহিমায়। আর ছিল রাতের অতন্দ্র-প্রহরী উইলিয়ামস গেনস। এল শেপের বিল্ডিংটা ঘিরে গুনে গুনে পঁয়ত্রিশ মিনিটে একটা চক্কর মারে বিল। আজ রাতে এড গোটি তার জুড়িদার। যখন বিল জিরোবে, সে হণ্টন মারবে। পুরনো বার্জ অফিস আর হাসপাতালের চত্বর পাহারার ডিউটিতে আছে জো কেলি আর স্যাম ক্রিস্টেনসন। দু’টো নাগাদ ওরা চারজনে একসঙ্গে বসে কফি খাবে কিচেনের বারান্দায়। একটু গুলতানি করবে। তবে গিয়ে চোখের ঘুম আরও ঘণ্টা তিনেকের জন্য জিরোন দেবে। এটা তাদের রোজকার রুটিন।

    হাতের বাতি দোলাতে দোলাতে পুব-মাথা থেকে শুরু করে বিল্ডিঙের পশ্চিম-মুখো চলেছিল বিল। বারোটার ঘণ্টা শুরু হতে হতেই ও সেই আওয়াজের সঙ্গে সঙ্গে হপস্কচ খেলার ভঙ্গিতে প্রতিটা ঢং শব্দের সঙ্গে কল্পিত ছক লাফাতে লাফাতে পার করল। কেউ দেখলে ভাবত এই মোটা মুচওয়ালা মুশকো জোয়ানটা করছে কী? আর ওর আট বছরের মিয়নো বউ সিমোন দেখলে কী বলত? কে কী বলল বা ভাবল তাতে বিলের ঠ্যাঙা। রাতের অন্ধকার যেমন কিছু ভয় জুটিয়ে আনে, তেমনি অনেক ভান-ভণিতাও ছেড়ে চলে যায়। এই যেমন, রাত একটার ঘণ্টা বাজার সময়, সে যদি পুব দিকে থাকে তাহলে ক্যাপ্টেন বার্কের গ্রে হাউন্ড জ্যাকের মত গলা উপরে তুলে একটা গম্ভীর ডাক ছাড়ে। দিনে দিনে গলাটা জ্যাকের মত সুরে খেলছে। ভাবলেই গর্বে বিলের বুক ভুঁড়ি ছাড়িয়ে সামনে এগিয়ে যায়। এমনি-ধারা নানান খেলা দিয়ে নিজেকে জাগিয়ে রাখে বিল গেন্স।

    বারোটার ঘণ্টা বন্ধ হতেই চারপাশে কেমন থমথমে ভাব। কী একটা নেই নেই ভাব। আরও নিস্তব্ধ। লাফালাফিতে বেল্ট থেকে প্যান্টালুনটা ঝুলে ভুঁড়ির নিচে চলে গিয়েছিল। টেনে তুলে লাঠি ঠকঠক করতে করতে এবার সাধারণ পদক্ষেপে হাঁটা শুরু করল। কোন তলা থেকেই সেরকম আওয়াজ উঠছে না। যদিও অনেক লোক এই চত্বরে আছে এখন, গত ক’দিন জাহাজে লোক এসেছে অনেক। তত্ত্বতালাশ, যত রকমের রোগের যাচাই করা শেষ হলে, একে একে সবাইকে বাইরে যাওয়ার ছাড়পত্র দেওয়া হবে। ইদানীং লোক আসা এত বেড়ে যাচ্ছে! তেমনি বেড়েছে নিয়ম কানুন। দিনেরটা দিনে সাঙ্গ হয় না আর। যারা সঙ্গে সঙ্গে ঢুকতে পারে না, তাদের থাকার বন্দোবস্ত করতে হয় এখানেই।

    আগে ক’টা আর লোক আসত? বার্জ অফিসেই তাদের কাগজপত্র দেখে, ডাক্তারি পরীক্ষা-নিরীক্ষা সেরে ছেড়ে দেওয়া হত। সে’সব দিনও দেখেছে বিল। তারপর এলিস আইল্যান্ডের এই পেল্লায় তিনতলা বাড়িটা উঠল। নতুন আসা কমিশনার সেনার সাহেবের এই বিল্ডিংটা পছন্দ নয়, কথায় কথায় বলে কি – যে, দেশলাই বাক্সের মত কতগুলো কাঠামো খাড়া করে দিয়েছে! সারা পৃথিবীর লোক আসছে এই বন্দরে - তাদের স্বপ্নের দেশে, সেই দেশের একটা ইজ্জত নেই?

    বিল সে’সব বোঝে না। আগে কী অবস্থা ছিল সেটা শুধু জানে। বার্জ অফিসে ভিড় সামলাতে সামলাতে নাভিশ্বাস উঠে যেত। গত পাঁচ বছর অন্তত সেটার একটা সুরাহা হয়েছে। যদিও যে হারে লোক আসা বাড়ছে – শুধু সংখ্যায় বাড়ছে তা তো নয়, কোন কোন দেশ থেকেই না এসে পৌঁছচ্ছে যত হাভাতের দল! বেঁটে, লম্বা, সাদা, হলুদ, বাদামি - হরেক কিসিমের। সারাদিন এত রকমের ভাষায় কিচির মিচির চলে, দিনের ডিউটি থাকলে কেমন মাথা-পাগল লাগে বিলের। রাতে একটু শান্তি।

    বিল্ডিঙের তিনতলায় একলা মহিলাদের জিরোবার জায়গা, অনেক আগেই নিঝুম হয়ে গিয়েছিল সব। একলা পুরুষরা নিচের তলায়। টুপটাপ করে সেসব ঘরের বাতিও নিভে গেল। তাতে সোয়াস্তি নেই। কড়া পাহারা দিতে হয়। রাতে কেউ নিচ থেকে উপরে যাওয়ার চেষ্টা করছে কিনা, তার তদারকি। এখানে এসে দাঁড়িয়ে চারধারে আলো দুলিয়ে দেখে নিল একবার। নিজের ছায়াটা একবার এমাথা আর একবার ওমাথা জুড়ে ভূতুড়ে নাচ নেচে নিল। কারোর টিকি দেখা গেল না। এমনিতেই মাঝের দোতলায় অফিস করেছে রোমিওদের রুখতে। তবে রাত্রে আর ক’জনই বা থাকে অফিসে? সেইজন্য দোতলার বেশিটা আগে থেকেই অন্ধকার। ক্লান্ত বোধ করলে বিল সেখানে একবার একটু গড়িয়ে নিতে যায়। শান্তিতে চোখ বোজার কি উপায় আছে? কখন যে বার্ক মহোদয় উদয় হবেন! তাকে লাঠি ঠকঠকাতে না দেখলেই শুরু হবে গাঁক গাঁক। সে ব্যাটা প্রহরীদের সুপারিন্টেনডেন্ট। কেদ্দানি দেখাতে হবে না!

    এল শেপের অন্য উইং গোটাটাই পরিবার-ওয়ালা লোকেদের জন্য বরাদ্দ। সব ক’টি ঘরেই সার দিয়ে বেঞ্চ কিংবা লোহার খাট পাতা। সে তুমি শুধু ট্যাঁপাটেঁপি হও, কি সাত বাচ্চার পল্টনের সর্দার। ওদিকে এমনিতে মারমার কাটকাট নেই, তবে বাচ্চাদের চ্যাঁ-ভ্যাঁতে কান ঝালাপালা। এই তো বারোটা বেজে ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে যাচ্ছে, তবু বাচ্চাগুলোর ছিঁচকাঁদুনেপনা বন্ধ হয়েছে কি? জ্বালাতন!

    অথচ আজ একবার চোখটা না বুজলেই নয়। দুপুর বেলা শোওয়ার সময় বনি এসে হাজির। যেই দেখেছে বিলের বউ সিমোন বেরিয়েছে, অমনি উঁকিঝুঁকি। নেহাত অনেক ছলাকলা জানে সে মেয়ে, একেবারে রসের ভিয়েন একখানা। ভেবেই বিলের গোঁফ ছ্যাঁদা করে হাসি ঝিলিক মারল। সে সোমত্ত মেয়ের বুড়ো বরে শরীর জুড়ায় না। তাগড়া জোয়ান বিল তার পিরিতের নাগর। লাল-চুলো বনিকে বিলেরও কোন না-পছন্দ নয়। উফ! মেয়ে নয়তো, গনগনে আগুন। কেমন রস-টসটসে ঠোট, আঙুর ফলের মত টলটলে চোখ - আর সবচেয়ে বড় কথা, টান টান শরীরে লাল বাতাবি লেবুর মত ঢলো ঢলো বুকজোড়া। শরীর ছুঁলেই যা একটা ঝটকা লাগে। বোঝা যায় ওই বুড়ো হাবড়াটা এমন টসটসে যৌবনবতীকে কোন রসেই মজাতে পারেনি। সিমোন বাড়ির বাইরে কালেভদ্রে বেরোয়। বিলের উপর তার কড়া নজর। তবে বিল আর বনিও কি কম ঝানু! বনির এক মাসি আছে ফর্টি সেকেন্ড স্ট্রিটে, বিল কাজে যাওয়ার নাম করে ওখানে এসে ভিড়ে যায় বনির সঙ্গে। ওসব ঝামেলা না করে আজ কিনা বাড়িতেই ভোজের আয়োজন! এমন সংযোগ কালে ভদ্রে হয়। অতএব দু’হাতের বেড়ে বনিকে নিয়ে মাথার ঘুম ছুটে গিয়েছিল বিলের।

    এইসব হুল্লোড়ে দুপুর কাটিয়ে শেষ বেলায় সবে চোখ বুজবে, সারা দুপুর অনেক ভোঁস ভোঁস করে ঘুমিয়েছো - বলে ধাক্কা দিয়ে তুলে সিমোন পাঠাল কাঠ চিরতে। ফলে ঘুমের ঘরে আজ নেহাতই ফাঁকি, মাথাটা কি সাধে ঝিমঝিম করছে! জুড়িয়ে আসা চোখে ধাঁধা দেখছে মাঝেমধ্যেই। এই কারণে যখন দোতলায় বড়বাবু ইকলারের অফিসের জানালাটা লালচে হতে দেখেছিল, প্রথমে পাত্তা দেয়নি। শুরুতে মনে হল, কেউ বুঝি লম্ফ জ্বেলেছে। কিন্তু আরও দু’কদম এগিয়ে মনে হল - আরে, ইকলারের তো কখনো রাতের ডিউটি হবার কথা না, তাহলে কি ওর ঘরে চোর ঢুকল? চোখ কচলে, মাথা ঘুরিয়ে, আবার যখন তাকাল তখন সেই লম্ফের আলো চেহারায় সকালের সূর্যের মত একথালা, আর তার চারপাশে আলোর ফুলঝুরি।
    চোখের ঘুম এক নিমেষে কেটে গেল বিল গেন্সের। চেঁচিয়ে উঠল আগুন! আগুন! পড়ি কি মরি করে দৌড়ে গিয়ে বড় ঘণ্টাটা বাজিয়ে দিল। স্তব্ধ রাতে পাগলা ঘণ্টি কাঁপিয়ে তুলল চরাচর। এতক্ষণ চ্যাঁচামেচি করে যেসব বাচ্চারা মায়ের কোলে নেতিয়ে পড়েছিল তাদের জনা কয়েক আবার তারস্বরে চিৎকার জুড়ে দিল। তিনতলায় একটা ঘরের জানালা পটাং করে খুলে গেল। সোফি রাফ মাথা বাড়াল, সে হচ্ছে মহিলা মেট্রন। ঘুম জড়ানো গলায় চেঁচাল, হোয়াটস আপ গার্ডস?

    নিচের তলায় দুটো ঘরে আলো জ্বালাল কেউ। হাসপাতালেও আছে জনা চল্লিশেক বিদেশি আগন্তুক। সেখানেও হল্লা শুরু হল। কেউই ঠিকঠাক জানে না কি হয়েছে, কিন্তু ঘণ্টার শব্দে ঘুম ভেঙে আলোড়ন উঠল এক নিমেষে।

    এতক্ষণে ইকলারের ঘরটা দাউ দাউ করে জ্বলছিল, ছড়িয়েছে পাশের ঘর দু’টোতেও। বুটের ভারী শব্দে তুলে এসে পড়ল জো, এড আর স্যাম। এসে গেল ক্যাপ্টেন বার্কও। সে দোতলায় ঘুমচ্ছিল, কিন্তু তার কুকুর জ্যাক ঘুম ভাঙিয়ে নিয়ে এসেছে বিপদের গন্ধ পেয়েই।

    বার্কের মাথা বেশ পরিষ্কার। এসেই হাঁক পাড়ল - স্যাম, দৌড়ে যাও। সবার আগে বাইরের লোহার গেটের তালা খুলে বেরোনোর রাস্তা খালি কর।

    নিজের নিজের ঘর থেকে অনেক লোক ইতিমধ্যে বেরিয়ে এসেছে। যা হাতের কাছে পেয়েছে, বগলদাবা করে দৌড়চ্ছে।

    Feuer! তারস্বরে চেঁচাতে চেঁচাতে আল্ডেগার স্নাইডার জীবনে প্রথমবার শরীরে কোট না চাপিয়ে নিজের ঘরের দরজার বাইরে পা দিয়েছে। পরনে ডোরাকাটা পাজামা আর জলপাই রঙের শার্ট। পাজামা টানতে টানতে দুই হাতে দুই ঢাউস সুটকেস নিয়ে বিস্রস্ত অবস্থায় সে দরজার বাইরে থেকে হাঁক পাড়ছিল। অ্যাডেলা! বালড্রিখ! ফিউওর! ফিউওর! এডা! এহোকাম, কম স্নেল হস! সে যে হাতের বাক্স প্যাঁটরা নাবিয়ে আবার ঢুকে বউ বাচ্চাকে বগলদাবা করে উদ্ধার করে আনবে সেটা সাহসে কুলোচ্ছে না।

    হের আল্ডেগার, আমি যাচ্ছি। জোহান বলে যুবকটি ছেলেদের একতলার আবাস থেকে বেরিয়ে এসেছিল। জাহাজে আসার সময় সে অ্যাডেলা আর বাল্ড্রিখের সঙ্গে অনেকটা সময় কাটিয়েছিল। কিশোরী এডাকে তার ভারী পছন্দ। ধূমায়মান অন্ধকারে ঝড়ের বেগে ঢুকে গেল আল্ডেগারের ঘরে।

    Feugo! Feugo! ঠিক পাশের ঘরটা থেকে হোসে, লুই আর জেভিয়ার আট থেকে বার-চোদ্দ বছরের ছেলে তিনটি প্রায় চ্যাংদোলা করে তাদের বাবা ফারনান্দো মোলারেসকে বের করে আনল। তাদের ভাবভঙ্গিতে আমোদের লক্ষণ যথেষ্ট। নিজেদের দিক থেকে অনেক চেষ্টা করেছে পাদ্রেকে ঘুম থেকে তোলার। কিন্তু আমেরিকা পৌঁছানোর আনন্দে ফারনান্দো গত রাতে একটু বেশি পরিমাণে সাংগ্রিয়া টেনেছিল, এখন হুঁশ ফেরানো মুশকিল। একদিকে তিন ছেলে বাবাকে টেনে আনছিল, অন্যধারে তার বউ মিলা টেনে আনছিল বাক্স প্যাঁটরা। তবে বাচ্চাদের মতো রঙ্গতামাশায় মজেনি। ফারনান্দোর দিকে তাকিয়ে যেভাবে হিজো দে পুতা! বলে ভেংচে উঠল, বোঝাই যায় মেজাজ টঙে। এখানে আর কেউ তার ভাষা বুঝতে পারল কি না থোড়াই তোয়াক্কা করে মিলা।
    Feu!
    Ogien!
    Fuoco!
    কাজ চালিয়ে নেওয়ার মত ইংরাজি অনেকেই জানে। কিন্তু আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে এইসব ক্ষেতের চাষি, খনি শ্রমিক, দর্জি, ছুতোর মিস্ত্রি - অর্জিত ভাষা জ্ঞান ভুলে মাতৃভাষায় চেঁচামেচি জুড়ে দিল।

    মুশকিল হল, এরা সবাই নতুন দেশে এসেছে। আগুন লাগা দেখে ভয়ে কী করবে, কোন দিকে যাবে বুঝতেও পারছে না। সেকথা যে ভাষায় জিজ্ঞেস করছে গার্ডদের অনেকেই তা বুঝবে না। কিংবা প্রহরীদের মধ্যে দেশোয়ালি ভাই থাকলেও, এতসব কচকচির মধ্যে সেসব বোঝা নেহাতই দুষ্কর। দিনের বেলায় নানান ভাষায় পারঙ্গম একদল লোক থাকে, তারা ভাষার রকমফের বুঝে ইংরাজিতে তরজমা করে। এখন এই রাতে তারা আর কোথায়? হুড়হুড় করে লোক বেরিয়ে আসছে। এর মধ্যে ঠাণ্ডা-মাথার বার্ক এডকে বলল লোক গুনতে, না হলে জানবে কী করে সব লোক বেরিয়েছে কিনা?

    আগুন এতক্ষণে সব তলাতেই ছড়িয়ে পড়েছে। বার্ক তড়াক করে একটা কাঠের টুলের উপর দাঁড়িয়ে পরিত্রাহি চেঁচাতে থাকল, এক্সিট! এক্সিট! বুদ্ধি করে তার ডান হাত দিয়ে যেদিকে লোহার গেট খোলা হয়েছে সেদিকে দেখাচ্ছিল। যেই একজন সেটা বুঝে তার লোটা কম্বল টানতে টানতে সেদিকে দৌড়েছে, অন্য লোকগুলো জান মাল হাতে নিয়ে তার পিছনে ছুট।
    বার্ক লোকটার বুদ্ধি আছে। তিন তলার আগুনে পোড়া কাঠ ভেঙ্গে ভেঙ্গে পড়ছিল। জায়গাটা জতুগৃহের চেহারা নিচ্ছে দ্রুত। তাঁর এই উপস্থিত বুদ্ধির গুণে এইভাবে বেশির ভাগ লোক বেরিয়ে না গেলে আজ অনেক প্রাণ যেতে পারত।

    সোফি রাফ নেমে এসেছিল এতক্ষণে। তার বপুটি কিছু কম নয়। কিন্তু দেখা গেল দরকারে বলের মত গড়িয়ে যেতেও তার দ্বিধা নেই। একবারও না থেমে সে বার্ককে তার পিছনে লোক পাঠাতে বলে দৌড়াচ্ছিল হাসপাতালের ফ্যামিলি ওয়ার্ডের দিকে। হাসপাতালের ডাক্তার আর নার্সরা বেরিয়ে এসেছিল। সিস্টার জুলিয়া আর প্যাট ছুটলো মেট্রনের সঙ্গে।
    আগুন ছড়িয়ে পড়ছে দ্রুত। কাঠের বাড়ি, দেখতে দেখতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে। ইঞ্জিনহাউসের বেকন সাহেব আর তার অ্যাসিস্ট্যান্ট কেলি হোস পাইপ নিয়ে জল ঢালতে কসুর করেনি। ফায়ার ব্রিগেডকে খবর দেওয়া হয়েছে, যতক্ষণে তারা নৌকা বেয়ে ম্যানহাটন থেকে এসে পৌঁছাবে, এই বিল্ডিঙের আর কিছু থাকবে না।

    সত্যিই কিছু রইল না। ভাগ্য ভাল, যে কেউ মরে নি। আগুনে ঝলসে গেছে অনেকে, তাদেরকে হাসপাতালে ডাক্তার জোসেফ হোয়াইট আর তাঁর নার্সের দল যতটা হল সামলাল। বাকি যারা পোড়েনি, তাদের জিনিস পুড়ে বেশি কিছু আর বাকি নেই। ওইটুকু সম্বল করেই তো এসেছিল নতুন দেশে। সব হারানোর কান্নাটা ছড়িয়ে যাচ্ছিল। এর মধ্যে রোল উঠল মরিসকে দেখা যাচ্ছে না।
    কে মরিস?
    মরিস কেম্প!
    ওই যে লোকটা নেবেই তক্ষুনি তক্ষুনি বাইরে যেতে না পেরে হল্লা জুড়েছিল।
    একা ছিল তো লোকটা, স্কটল্যান্ডের।
    গেল কই? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না!

    সঙ্গে সঙ্গে বার্ক জ্যাককে নিয়ে দৌড়েছিল এক তলার দিকে। জ্যাক না থাকলে মরিসকে আজ বাঁচান যেত না। সে এমন মরণ ঘুম ঘুমচ্ছিল, যে এত চেঁচামেচিতেও ঘুম ভাঙেনি।
    ফারনান্দোর মতো, কিন্তু ওকে চ্যাংদোলা করে বের করে আনার কেউ ছিল না। যখন ঘুম ভাঙল তখন দম বন্ধ হয়ে যায় যায়। জ্যাক প্রায় মুখে করেই টানতে টানতে বের করে আনল মরিসকে। অন্তত আগুনে একটা লোকও মারা যায়নি দেখে বড় সাহেব সেনার নিশ্চিন্ত হতে পেরেছিলেন সেদিন।

    আগুন লেগেছে, খুব ভাল হয়েছে। সারা রাত চেঁচিয়ে তার গলা ঘ্যাঁসঘ্যাঁসে। সবার মতো তার জামা কাপড়েও উড়ে আসা পোড়া কাঠের ছাই, টাই ঝুলে পড়েছে, স্যুটের দশা তথৈবচ। তবু তার গলায় যেন তৃপ্তির সুর। যবে থেকে কমিশনার হয়ে এসেছেন, এই বিল্ডিং নিয়ে সেনেটারদের সঙ্গে কম তদ্বির তো করেননি। সদ্য তৈরি হয়েছে এই অফিস, নতুন করে টাকা ঢালতে সরকার রাজি ছিল না। এবার আর তাদের উপায় রইল না।

    ডেইলি ব্রুকলিন, নিউ ইয়র্ক ওয়ার্ল্ড এমনি সব কাগজের রিপোর্টাররা ততক্ষণে এসে উপস্থিত। তাদেরকে বুক বাজিয়ে এটা না বলে পারেন? রোজ হাজারে হাজারে লোক আসছে, তাদের জন্য এমন কাঠের বাক্স বানিয়ে রাখলে এমনটাই তো হবে। কতবার বলেছি, কে শোনে কার কথা! এই যে দেখেছেন এতগুলো লোক ওখানে, এরা সারারাত কি লড়াইটাই লড়ল, সবকটা লোকের প্রাণ বেঁচেছে শুধু এদের জন্যেই। কিন্তু ফেডারাল গভর্নমেন্ট যদি তাড়াতাড়ি কোন ব্যবস্থা না নেয়, তাহলে সামনে মহা দুর্দিন। রোজ এত লোক আসছে আমরা সামলাতে পারবো কতদিন বলতে পারি না।

    সেনার দুঁদে লোক। জানে খবরের কাগজের হেড লাইন না হলে সেনেটারদের টনক নড়ে না।
    কমিশনার, এখন কী হবে তাহলে? অনেক জাহাজ তো বন্দরে ভেড়ার জন্য এসে পড়েছে।
    সত্যিই তাই। সাতটা জাহাজ ঢুকবে ঢুকবে করছিল। এস এস সেন্ট লুই ছিল তার মধ্যে একটা।
    কিছু করার নেই। পুরনো বার্জ অফিসেই কিছু কাজ সারতে হবে, বাকি সব কটা জাহাজ বিভিন্ন পিয়ারে পাঠিয়ে দেবো। আমাদের লোক জাহাজে উঠে উঠে সব কাজ কর্ম সারবে।

    সেটা ঠিক নতুন একটা অফিস তো দিনে দিনে খাড়া করা যাবে না। যদিও সেনেট থেকে তিন মাসের মধ্যে টাকা পাস হয়ে গেল। কিন্তু ডিজাইন মনস্থ করতে পুরো এক বছর। এবার শক্ত পোক্ত কিছু না করলে সেনার হতেই দেবে না। শেষ অবধি নতুন অফিস হতে লেগে গিয়েছিল তিন তিনটে বছর।

    কিন্তু সে’সব পরের কথা। আগুন লাগার দুই মাস বাদে স্বামী অভেদানন্দ যখন এসে পৌঁছালেন, গরম চলে গিয়ে তখন হেমন্ত আসি আসি করছে। ১৮৯৭ সালের ২২ অগাস্ট। ইমিগ্রেশান অফিস তখন পুরনো বার্জ অফিসেই পুরো দস্তুর বহাল। ভিড় সামলাতে ইমিগ্রেশান ডিপার্টমেন্ট বেহাল। জাহাজঘাটায় নেবে সে কী লম্বা লাইন!
    নেহাত ক্লান্ত শ্রান্ত অভেদানন্দ যখন সব হ্যাপা চুকিয়ে বেরোলেন, তাঁকে অভ্যর্থনার জন্য অপেক্ষায় ছিল জোজো, দিদি বেটি, ফ্রান্সিস বেকেট, মিস্টার হোমার। ওদের দেখে অভেদানন্দের ধড়ে প্রাণ এল যেন। গত দুই মাস সমুদ্রযাত্রা তাঁর শরীরকে একেবারে নিংড়ে নিয়েছিল।

    তাঁর যদি দুই মাস, আলেফের জন্য চার মাস। একবার ফিরে, ফের সাদাম্পটান থেকে জাহাজে চেপে এসেছে। আলেফদের বেরোতে আর একটু দেরি হল, সবচেয়ে সস্তার প্যাসেঞ্জার তো। এবার যে তাদের ঢুকতে দিয়েছে সেটাই বড় কথা। বুদ্ধিটা মুসা মণ্ডলের। ওরা আর বারোজনের দল বেঁধে আসে নি। মুসা মণ্ডল বাকি দলবল নিয়ে সাদাম্পটন থেকে পাড়ি দিয়েছে সাউথ আফ্রিকায়। এবার শুধু এসেছে মোকসাদ আলি, আলেফ, বসির আর ফায়জল। মুসার কথাই ঠিক। বারোজনের জায়গায় যখন চারজন সেই একই মাল নিয়ে এসে পৌঁছাল, মজদুর বলে আর ভাগিয়ে দিল না তাদের। এবার আর কার্ডে লিখে দিল না ‘public charge।’ মাল ছাড়িয়ে একেবারে জেটি পার করে নিউ ইয়র্কের ঘাটে ফেরি লাগার পর মোকসাদ আলির মুখে হাসি ফুটল দুই মাস বাদে। গরমের আসল সময়টা চলে গেছে, কিন্তু এখনো হাওয়ায় কাঁপন ধরেনি। বোর্ডওয়াকে কিছু বেচা কেনা তো হবেই।

    বসির, আলেফ, ফায়জল সবাই এই দেশে প্রথম বার। বিকেলের মিয়নো আলোকে হার মানিয়ে ধীরে ধীরে ঝকমকিয়ে উঠছিল ম্যানহাটন। ঢলঢলে পাতলুন আর সস্তার কোট গায়ে দাদপুর আর বাবনানের তিন গ্রাম্য যুবক হাঁ করে দেখছিল চকমিলানো এই শহর। পথের ধারের বড় বড় গোল ইলেকট্রিকের আলোয় ওদের মুখে দিগ্বিজয়ের হাসি, পোশাকের মলিনতা ছাপিয়ে ঝকমকিয়ে উঠল গঙ্গার ঘাটে এনে ফেলা এক ঝাঁক রুপোলি ইলিশের মত।


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • ধারাবাহিক | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ | ১৮০২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৫:২৬497959
  • চমৎকার এগোচ্ছে।
  • Prativa Sarker | ১১ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১৭:৩৫497963
  • এ-ই উপন্যাসটি বিশেষ মনোযোগের দাবী রাখে। শুধু গুরুচন্ডা৯ র লেখাগুলির প্রেক্ষিতে নয়, সমসাময়িক বাংলা সাহিত্যেও। 
     
    পাঠকের নজরে আসুক!
  • সিএস | 49.37.***.*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০১:৩৪497980
  • এ লেখা আমার ভালো লাগে না।

    সেই চিরাচরিত বাংলা উপন্যাসের কিছু চরিত্র, তারা কী ভাবল আর কী করল আর তাদের কী হলো তারই বর্ণনা শুধু।

    আগের একটা পরিচ্ছেদে লেখা হয়েছিল এক নর্তকীর স্কার্টের ঘুর্ণির মধ্যে এক চরিত্রের ঢুকে যাওয়ার কথা।

    ঐ দৃশ্যটি হতে পারত এই উপন্যাসের কেন্দ্রীয় মোটিফ অথবা ঐ সময়ের একটি ইমেজ।

    কিন্তু এখনো পাইনি সেসব।

    যে সময়ের কথা লেখা হচ্ছে, শিল্প বিপ্লবের শেষের দিকটা, আমেরিকান ড্রিমের প্রথম দিকটা, ধনতন্ত্রের এক বিশেষ পর্যায়, নিউ ইয়র্ক শহরের হীরকদ্যুতিময় হয়ে ওঠার সময়টা, সেই সময় ধরার মত ভাষা বা লেখায় রিস্ক নেওয়া - যা ধরা আছে ২০ - ৩০ দশকে ডস পাসোর উপন্যাসে বা সিনক্লেয়ার লিউসের ব্যাবিট উপন্যাসে অথবা অনেক পরে E L Doctorow র Ragtime উপন্যাসে - সে ব্যাপার এই লেখায় এখনো পাইনি।

    বোধ করি ঐ সময় নিয়ে উপন্যাস লেখা কোন অ - আমেরিকানের পক্ষে সম্ভবই নয়। নিতান্তই 'বাঙালী' একটি লেখা হবে যার ইঙ্গিত হয়ত আছে উপন্যাসটির নামের মধ্যে, কিন্তু আমি হয়ত আশা করছিলাম বিষয়ের সাথে সঙ্গতি রেখে ক্ষুরধার আধুনিক এক লিখন, কিন্তু পাচ্ছি হয়ত নিতান্তই এক গল্প বলা !
     
     
  • বিশ্বদীপ | 103.234.***.*** | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৯:২৩497987
  • মতামতের জন্য ধন্যবাদ। 
    ভাষার সীমাবদ্ধতা লেখকের নিজস্ব, সেখানে অন্য কারো ঝকঝকে ভাষা অনুকরণের সম্ভাবনা কম।  
    বিষয়ের ব্যাপারে বলতে পারি। এই উপন্যাসের বিষয়বস্তু আমেরিকার ঝকমকে হয়ে ওঠা নয়। এই উপন্যাস অনেকটাই বাঙ্গালীর। ওই সময়ে একদল বাঙ্গালী যাদের বেশির ভাগই অশিক্ষিত,দরিদ্র এবং নিজের দেশে নিরন্ন কিভাবে অন্য এক দেশে গিয়ে সেই দেশের নির্যাতিত নিগ্রো সমাজের সঙ্গে এক হয়ে লড়াই করেছে সেটা হয়তো এই উপন্যাস থেকে জানা যাবে। আমেরিকার ওই সময়ে উত্থানের ইতিহাস আমেরিকান হাতেই ভাল মানাবে। কিন্তু ইতিহাসে হারিয়ে যাওয়া এই বাঙ্গালিদের জীবনযুদ্ধ কোন বাঙ্গালিকেই লিখতে হত। 
  • | ১২ সেপ্টেম্বর ২০২১ ১০:৫৩497999
  • হুঁ আমারও পড়ে এটা ছিটকে পড়া ছড়িয়ে যাওয়া প্রান্তবাসী বাঙালিদের কথা বলেই মনে হচ্ছিল।  লেখকও কনফার্ম করেছেন দেখছি। 
    আর আমার মতে ভাল গল্প বলতে পারাও একটা বিরাট গুণ। অধিকাংশ মানুষ গল্প শুনতে ভালবাসে। কাজেই সেইদিক থেকে আমার কাছে এটা চমৎকার লাগছে। 
  • সিএস | 49.37.***.*** | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০১:২৪498037
  • বিশ্বদীপবাবু লিখেছেন যে এই উপন্যাস থেকে বাঙালীদের লড়াইয়ের ইতিহাস, সে দেশে গিয়ে যে লড়াই করতে হয়েছিল, সেসব জানা যাবে। ধরে নিচ্ছি ইতিহাস অথবা 'জানা যাবে' এই শব্দগুলো সচেতনভাবেই ব্যবহার করেছেন এবং এখানেই আমার আপত্তির জায়গা, উপন্যাস যেরকম পড়তে চাই, সেসব নিয়ে।

    মনে হয়, ইতিহাস জানানোর জন্য বা অতীত জানানোর জন্য সম্পূর্ণ ইতিহাস বই যদি বা না লেখা যায়, অন্তত ফীচার লিখেও হয়ত সে উদ্দেশ্য ভালভাবে সফল করা যায়। এরকম লেখা হয়েও থাকে,  খবরের কাগজে বা পত্রিকায় যেখানে অতীতের ঘটনাকে তুলে আনা হয়েছে অথবা অভেদানন্দের কাজের কথা জানার জন্য নিশ্চয় জীবনীগ্রন্থ বা অন্য কাগজপত্র রয়েছে, সেগুলো ব্যবহার করে উপন্যাসের পরিবর্তে অন্য লেখা লেখা যায়। বরং উপন্যাস লিখতে গেলে, সেই লেখার যা দাবী  অর্থাত প্লট, চরিত্র বা সাইকোলজি, সেসব মেটাতে গেলে ইতিহাস বা অতীতে ঠিক কী ঘটেছিল সেসব পুরো জানানো যাবে না, উপন্যাসের আবর্তে জড়িয়ে পড়তে হবে। উদ্দেশ্যের সাধুতা বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য নেই অথবা বাঙালীর কথা বাঙালীকেই লিখতে হবে সে ব্যাপারেও (যদিও ইতিহাস লেখার ক্ষেত্রে সে যুক্তি খাটে না) কিন্তু অতীতের কথা গল্পচ্ছলে বলে যাওয়া, উপন্যাসের মাধ্যমে, লেখার এই ধরণ  নিয়ে আমার দ্বিমত রয়েছে, যদিও 'অতীতাশ্রয়ী' উপন্যাসের সংখ্যা কম পড়েনি, বাংলা ভাষায়। 

    উপন্যাসকে মূলতঃ বর্তমানের শিল্প বলে মনে করি, বর্তমানের সাথে এনগেজ  করার জন্যই একজন লেখক উপন্যাসের দিকে যেতে পারে কিন্তু সেই বর্তমানের মধ্যে যদি ইতিহাস মিশে থাকে অথবা লেখক তার বর্তমানে ইতিহাস দ্বারা উত্যক্ত অথবা প্রভাবিত হন তাহলে বর্তমান থেকে শুরু করে উপন্যাস তার মধ্যে ইতিহাসকে মিশিয়ে নিতে পারে, উপন্যাসের শিল্পকে আমি এইভাবেই দেখি, শুধুই ইতিহাসের গল্প বলার জন্য নয় অথবা ক্ষেত্র সমীক্ষার ফল জানানোর জন্য নয় কিংবা গরীব মানুষরা অথবা কোন গোষ্ঠী কত কষ্টে আছে সেসব  জানানোর জন্য নয় কিন্ত সবকিছুকেই নিজের মধ্যে নিয়ে উপন্যাস  অন্য এক তৃতীয় বস্তু হয়ে উঠতে পারে। অনেকটা এই কারণেই আমি নিউ ইয়র্ক শহরের ও সেই সময়ের কথা উল্লেখ করেছিলাম কারণ আমি মনে করি না যে বাঙালী 'লস্কর' - দের ইতিহাস অথবা নিগ্রোদের ইতিহাস অথবা নিউ ইয়র্কের জাহাজ ঘাটায় ভিড় জমানো অভিবাসীদের জীবন নিউ ইয়র্কের উন্নতি অথবা ধনতন্ত্রের প্রসারের থেকে বিযুক্ত। নিউ ইয়র্ক ও আমেরিকা এইসব লোকগুলিকে নিজের জন্য ব্যবহার করেছে আবার এই লোকগুলিও ঐ শহরটি অথবা দেশটিকে তৈরী করেছে। আমার মতে বাঙালীদের কথা লিখতে গেলেও শহরটি ও দেশটি এসে পড়তে বাধ্য, তাদের যাবতীয় আবর্ত, ঘূর্ণি, ফাটল ও ম্যাজিক সমেত। বাঙালী চরিত্র ও নিগ্রো চরিত্রদের সাথে শহরটিকেও উপন্যাসের চরিত্র হয়ে উঠতে হবে, আমি এই উপন্যাসের থীমটিকে সেভাবেই দেখি। আর উপন্যাসের ভাষাকে ঝকঝকে, কারুকার্যময় হতে হবে সেরকম কোন দাবী নেই কিন্তু এমন একটি ভাষা দরকার যা কিছু চরিত্র আর তাদের গল্প তৈরী করেই শান্তি পাবে না বরং ঐ সময় ও স্থানের জটিলতাকে ধারণ করতে পারবে।

    তুলনা করলে বলা যায়, নিউ ইয়র্কে অভিবাসীদের আগমন আর বিভিন্ন মানুষের লড়াইয়ের সাথে যুক্ত হয়ে গেছিল নতুন দেশে টিকে থাকা এবং তাদের  উচ্চাকাঙ্খার পূরণ, তাদের নিয়ে লিখতে গেলে আশা করছিলাম লেখক উপন্যাসের নির্মিতি নিয়ে উচ্চাকাঙ্খী হবেন, নিছক গল্প তৈরী করে বাঙালীর 'ইতিহাস' লেখায় সীমাবদ্ধ থাকবেন না, উপরন্ত  যখন   উপন্যাস না লিখে ইতিহাস লিখতে গেলেও শহর ও দেশটির ঐ বিশেষ সময়ের কথাও অবধারিতভাবে এসে যেত । 
     
     
  • বিশ্বদীপ | 2402:3a80:a91:fc07:0:25:fa75:***:*** | ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ ০৬:২৯498041
  • সিএস, এত সুন্দর করে আপনার মতামত জানিয়েছেন, খুব ভাল লাগল। তবে কিনা, আমি সেটাই লিখবো যেটা লিখতে চাই। আর পাঠক সেটাই পড়বেন, যেটা তার ভাল লাগে। 
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। পড়তে পড়তে প্রতিক্রিয়া দিন