এই লেখাটির কথাগুলো আপনি যে পড়বেন সেই ব্যাপারটা হয়তো আপনার অদৃষ্টে আছে, অথবা আপনার স্বাধীন ইচ্ছায় পড়বেন না, কিন্তু সেই সিদ্ধান্তটিও যে স্বাধীন তার তো কোনো নিশ্চয়তা নেই। এসবই বলতেন অধ্যাপক ক – তাঁর চিন্তা ছিল মৌলিক, আমি ছিলাম তাঁর ছাত্র, পরে আমাকে পণ্ডিতমহল চিনেছিল অধ্যাপক ক-র কাজের ওপর গবেষণার জন্যই। এজন্য আমি তাঁর কাছে ঋণী ছিলাম।
রেবাকে আমি ঠিক ভালবাসতাম কিনা বুঝে উঠতে পারতাম না, ভালবাসার ব্যাপারটা ইচ্ছাস্বাতন্ত্র্যের ওপর তো নির্ভর করে না, নাকি করে – এই ব্যাপারে আমার দ্বন্দ্ব ছিল। রেবা আমার সহপাঠী ছিল। রেবা যখন বিয়ের জন্য চাপ দিল অধ্যাপক ক-র কাছে গিয়েছিলাম পরামর্শের জন্য। ওনাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন করতাম। স্যার বললেন, সমস্ত চাপের উর্ধে উঠে ব্যাপারটা ভাবতে।
ওনার হোমিওপ্যাথির সখ ছিল, দুটি কারুকাজ করা একইরকমের শাল কাঠের বাক্স ছিল তার, ছোট ছোট শিশিতে ভর্তি। ‘বিয়ে’ আর ‘বিয়ে নয়’ এরকম দুটি চিরকুট লিখে একটি বাক্সে রাখলেন, অপর বাক্সটিতেও ওরকম দুটি চিরকুট রাখলেন। আমাকে বললেন, চোখ বন্ধ করে ডালা খুলে প্রতিটি বাক্স থেকে একটা করে চিরকুট বের করে আনতে। দুটো চিরকুটেই দেখলাম লেখা ‘বিয়ে নয়’। স্যার হাসলেন, বললেন, “তুমি যে দুবারই ‘বিয়ে নয়’ পেলে তা কি পুনর্নিধারিত ছিল? তা তো হতেই পারে না, তুমি আর আমি জানি এটা নিতান্তই সম্ভাব্যতার একটা ফলাফল। অন্যদিকে তোমার স্বাধীন চিন্তা এখানে কোনো কাজেই লাগছে না। কাজেই অবাধ অভীপ্সা কি নিয়তিবাদ দুটোই আসলে বিভ্রম।”
এর কয়েকদিন বাদেই অধ্যাপক ক মারা গেলেন, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ। ক-র দর্শনচিন্তার ওপর আমার একটা বই বের হল, খুব দুঃখ হল যে উনি ছাপা অক্ষরে বইটি দেখে যেতে পারলেন না, বইটি ওনাকেই উৎসর্গ করেছিলাম। টেলিভিশনের টক শোতে আমন্ত্রণ পাচ্ছিলাম।
মাস ছয়েক বাদে রেবাকে বিয়ে করলাম। বিয়ের কিছুদিন পরে টেলিভিশনে অধ্যাপক ক-র ওপর আর এক শো’তে ডাক পেলাম। এবার রেবা নিজেকে ধরে রাখতে পারল না, আমাকে বলল অধ্যাপক ক তাকে নিপীড়ন করেছে, যৌন নিপীড়ন। জিজ্ঞেস করলাম এতদিন কেন বলনি, রেবা উত্তর দিল, “কী মনে হয় তোমার, কেন বলিনি?” টক শোতে গেলাম না, আমার বুদ্ধিজীবী জীবনের একমাত্র অবলম্বন ছিল ক-র দর্শন নিয়ে গবেষণা, সেটি আর না করার সিদ্ধান্ত নিলাম।
এর এক সপ্তাহ পরে ক-র বাড়ি গিয়েছিলাম। ওনার স্ত্রী, যিনি আমাকে নিকট আত্মীয় ও আপনজনের মতো দেখতেন, তাঁকে বললাম হোমিওপ্যাথির বাক্সদুটো দেখব। উনি বাক্স নিয়ে এলে পরে ডালা খুলে দেখলাম এখনো প্রতিটি বাক্সে দুটো করে চিরকুট রয়ে গেছে। চারটে চিরকুটেই লেখা ‘বিয়ে নয়’। ক-র দর্শন নিয়ে যে গবেষণা বন্ধ করেছি তা নিয়ে আর ক্ষোভ হল না, ভাবলাম ক আসলে ভাল দার্শনিক ছিলেনই না। উনি বলতেন স্বাধীন চিন্তা ও অদৃষ্টবাদ দুটিই বিভ্রম, কিন্তু সেটা যে বিভ্রম নয় তা প্রমাণ করতেই হয়তো আমি রেবাকে বিয়ে করেছিলাম। আমার স্বাধীন চিন্তাকে প্রতিষ্ঠা করতে যে আমি যে এটা করব সেটা ওনার বোঝা উচিত ছিল। ক নিজের দর্শনে বিশ্বাস না করে নিম্নমানের এক পদ্ধতিতে আমাকে প্রভাবিত করতে চেয়েছিলেন, যৌন-নিপীড়করা বোধহয় তাদের বৌদ্ধিক দর্শন জীবনে আরোপ করতে পারে না। ফিরে এসে রেবাকে কথাটা বলতে ও বলল, “তাহলে ক সবকটা চিরকুটে ‘বিয়ে’ লিখলে তুমি আমাকে বিয়ে করতে না – শুধুমাত্র তোমার স্বাধীন ইচ্ছার তত্ত্বকে প্রতিষ্ঠা করতে?”
আমি চুপ করে রইলাম। এর উত্তর আমার জানা ছিল না, রেবাও এই নিয়ে আমাকে আর আমাকে প্রশ্ন করে নি। এই কাহিনির শেষ এখানেই। এবার বলুন, পাঠক আপনি কি আপনার অবাধ অভীপ্সায় এই লেখাটি পড়লেন, নাকি লেখাটিকে পড়ার অদৃষ্ট নির্ধারিত ছিল?
আমার অবাধ অভীপ্সায় এই অসাধারণ লেখাটি পড়লাম। ক' জাতীয় জীব দ্বারা নিজের একটি ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা মনে পড়ে গেলো! ভুলে থাকি অথবা চাপা পড়া অতীতের দুঃসহ কোন মুহুর্ত!
Nemesis er akta byapar thake...kintu Sahrukh Khan er dialogue tao kintu sotti...
"Jokhon apni Kono kichuke pobitro Mone Chan, puro kainat sei iccha puron korar jonnyo uthe pore lage"
অদৃষ্ট না অভীপ্সা জানি না, কিন্তু একটা খুব অন্যরকম লেখা পড়া হল। একটা বহুস্তরীয় লেখা, যার স্বল্প গন্ডিতে হাজার কথা বলা হয়েছে।