এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • খেরোর খাতা

  • "অধর্মের যাঁতাকলে ধর্ম আজ অসহায়"

    Sadikul Haque Molla লেখকের গ্রাহক হোন
    ৩০ নভেম্বর ২০২৫ | ৬২ বার পঠিত
  • ধর্ম মানব সভ্যতার একটি চিরন্তন সঙ্গী। যুগ যুগ ধরে এটি মানুষের জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করে এসেছে। কিন্তু আজকের যুগে দাঁড়িয়ে আমাদের প্রশ্ন করতে হয় - আমরা কি ধর্মের প্রকৃত অর্থ উপলব্ধি করতে পেরেছি, নাকি ধর্মের নামে অধর্মকে আঁকড়ে ধরে ধর্মের পবিত্রতাকে কলুষিত করছি?

    ধর্ম একটি আধ্যাত্মিক এবং সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়। আমাদের এই বিশাল পৃথিবীতে আনুমানিক ১০,০০০-এর বেশি স্বতন্ত্র ধর্ম ও বিশ্বাস ব্যবস্থা প্রচলিত আছে। এই বৈচিত্র্যই প্রমাণ করে যে, ঐশ্বরিক অনুসন্ধান ও আধ্যাত্মিক অভীপ্সা প্রতিটি মানুষের মধ্যেই ভিন্ন ভিন্নভাবে প্রকাশ পায়।

    আমাদের মধ্যে কেউ কেউ ধর্মে বিশ্বাসী, আবার কেউ কেউ কোনো ধর্মই মানেন না - তারা নাস্তিক। এই দুটি অবস্থানই সমানভাবে সম্মানযোগ্য। কারণ মানুষের চিন্তা ও বিশ্বাসের স্বাধীনতা একটি মৌলিক মানবিক অধিকার।

    কোনো ব্যক্তি যদি জোর করে একজন নাস্তিক বা এক ধর্মের অনুসারীকে অন্য ধর্মে পরিবর্তন করতে চাপ দেয়, তাহলে সেই ব্যক্তি কখনোই মন থেকে ওই ব্যক্তিকে আস্তিক বা তার ধর্মে দীক্ষিত করতে পারেন না।

    ধর্ম যেহেতু হৃদয়ের বিশ্বাসের বিষয়, তাই মন থেকে গ্রহণ না করলে প্রকৃত ধর্ম হয় না। সুতরাং ধর্মের ব্যাপারে জোর-জবরদস্তি সম্পূর্ণ অর্থহীন এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের পরিপন্থী।

    একজন মানুষ সাধারণত যে ধর্মের পরিবারে জন্মগ্রহণ করে, প্রাথমিকভাবে সে সেই ধর্মীয় পরিবেশেই বড় হয়। এটি একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া। কিন্তু পরবর্তীতে যখন ব্যক্তির নিজস্ব চিন্তাশক্তি ও জ্ঞানের বিকাশ ঘটে, তখন সে তার নিজস্ব বোধবুদ্ধি অনুযায়ী যেকোনো ধর্ম বেছে নিতে পারে, এমনকি নাস্তিকও হতে পারে। এই পছন্দের স্বাধীনতাই মানুষকে প্রকৃত মানুষ করে তোলে।

    আব্রাহামিক ধর্ম বলতে আমরা প্রধানত তিনটি ধর্মকে বুঝি: ইহুদি, খ্রিস্টান ও ইসলাম। এই তিন ধর্মের পিতৃপুরুষ আব্রাহাম বা ইব্রাহিম। ইতিহাস বলে যে, তাঁর পিতা আজর ছিলেন একজন পৌত্তলিক, কিন্তু পুত্র হলেন একেশ্বরবাদী ধর্মের অন্যতম প্রধান বার্তাবাহক। এই ঘটনা থেকেই স্পষ্ট যে, ধর্মীয় বিশ্বাস পারিবারিক ঐতিহ্যের ঊর্ধ্বে ব্যক্তিগত উপলব্ধির বিষয়।

    একেশ্বরবাদ, বহুঈশ্বরবাদ, পৌত্তলিকতা, নিরাকার ঈশ্বরে বিশ্বাস - যার অন্তরে যেটার প্রতি আকর্ষণ থাকবে, সে সেই পথেই এগিয়ে যাবে। এখানে সাম্প্রদায়িকতার কোনো স্থান নেই।

    সাম্প্রদায়িকতা হলো "আমার ধর্মই শ্রেষ্ঠ, আমিই ঠিক, বাকিরা সবাই ভুল, বিধর্মী বা নাস্তিকদের শাস্তি দাও" - এই ধরনের সংকীর্ণ মানসিকতা। এটি ধর্মের প্রকৃত শিক্ষার সম্পূর্ণ বিপরীত।

    চিন্তা করুন, কেউ যদি ভয়ে বাহ্যিকভাবে কোনো ধর্ম পালন করে কিন্তু তার মন নাস্তিক থাকে, তাকে কি সত্যিকারের আস্তিক বা ধর্মভীরু বলা যায়? অবশ্যই না। এটি ধর্মের নামে প্রতারণা ছাড়া আর কিছুই নয়।

    প্রকৃতপক্ষে, প্রকৃত ধার্মিকরা কখনো সাম্প্রদায়িক হন না। তারা অন্যের ধর্মকে ছোট করেন না বা আঘাত করেন না। তারা তাদের নিজ হৃদয় থেকে ঈশ্বরের প্রার্থনা করেন এবং সর্বধর্মের মানুষের প্রতি শুভাকাঙ্ক্ষী থাকেন। এমনকি যারা অন্য ধর্মে বিশ্বাসী বা নাস্তিক, তাদের প্রতিও তাদের সহানুভূতি ও ভালোবাসা থাকে।

    প্রকৃত ধার্মিকরা কখনো ধর্ম নিয়ে বিবাদ বাঁধায় না। বরং তাঁরা ধর্মের প্রকৃত শিক্ষা - ভালোবাসা, ক্ষমা, উদারতা ও মানবিকতা - প্রচার করেন।

    ধর্ম এসেছে মানুষের জন্য, অন্য কোনো প্রাণীর জন্য নয়। আর মানুষের প্রাথমিক ও সর্বজনীন ধর্ম হলো মানবতা। যার হৃদয়ে মানবতা নেই, তার ভেতরে প্রকৃত ধর্মই নেই। কারণ সে ধর্ম পালনের মূল শর্তই লঙ্ঘন করেছে।

    ধর্ম নিয়ে বিদ্বেষ, সাম্প্রদায়িকতা, মানুষে মানুষে বিভেদ - এগুলো মানবতার পরিপন্থী। এগুলো ধর্মের নামে অধর্ম ছাড়া আর কিছুই নয়।

    পৃথিবীর বহু দেশে নাস্তিকতা রয়েছে। তারা কোনো ধর্মে বিশ্বাস করেন না। এটি সম্পূর্ণ তাদের নিজস্ব ব্যাপার এবং তাদের এই অধিকার সংরক্ষিত থাকা উচিত।

    অন্যদিকে, এমন কিছু দেশ আছে যেখানে ধর্ম পালন নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রিত। এটিও অন্যায়। আপনি নাস্তিক হতে পারেন, সেটি আপনার অধিকার। কিন্তু কেউ ধর্ম পালন করলে তাকে বাধা দেওয়ার কোনো নৈতিক অধিকার আপনার নেই। ধর্মীয় বিশ্বাস যেহেতু ব্যক্তিগত বিষয়, তাই এটি প্রত্যেকের একান্ত নিজস্ব মানবিক অধিকার।

    আব্রাহামিক প্রধান তিন ধর্মের বিশ্বাস অনুযায়ী, স্রষ্টা পৃথিবীতে মানুষ সৃষ্টির পূর্বে জিন জাতি সৃষ্টি করেন। কিন্তু তারা পৃথিবীতে এসে প্রকৃত ধর্ম পালন না করে অন্যায়, অনাচার, অত্যাচার, ঝগড়া-বিবাদে লিপ্ত হয়। ফলে স্রষ্টা ক্রুদ্ধ হন এবং তাদের বিনাশ করে মানব জাতিকে পৃথিবীতে পাঠান।

    এই কাহিনী থেকে স্পষ্ট হয় যে, ধর্মের মূল উদ্দেশ্য হলো শান্তি স্থাপন, মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বৃদ্ধি। ধর্ম কখনোই নিজেদের মধ্যে ঝগড়া-বিবাদ, দাঙ্গা-হাঙ্গামা, মারা-মারি, কাটা-কাটি করে ধ্বংসের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নয়।

    আমরা সভ্যতার এই চরম আধুনিক যুগে প্রবেশ করেও যদি ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ উপলব্ধি করতে না পারি, তাহলে আমাদের এই উন্নতি নিষ্ফল। প্রযুক্তিতে এগিয়ে গিয়েও মানবিকতায় পিছিয়ে থাকা মানবজাতির প্রকৃত উন্নতি নয়।

    অন্যের ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ কখনো ধার্মিকতার লক্ষণ হতে পারে না। এটি বরং অজ্ঞতা ও সংকীর্ণতার পরিচায়ক। যার হৃদয়ে মানবতা নেই, তার কোনো ধর্মীয় দাবিই গ্রহণযোগ্য নয়।

    প্রকৃত ধর্ম কোমল, শান্তিময় ও মানবতার শিক্ষা দেয়। যদি কেউ ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যা করে, তাহলে বুঝতে হবে সে ধার্মিক তো নয়ই, এমনকি একজন প্রকৃত মানুষ হওয়ার প্রাথমিক যোগ্যতাও তার নেই।

    আমরা মানুষ, মানবতার ঊর্ধ্বে কোনো ধর্ম হতে পারে না। আমাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে - আমরা ধর্মকে আঁকড়ে ধরব, নাকি অধর্মকে? আমরা কি শান্তি ও সম্প্রীতির পথে চলব, নাকি বিদ্বেষ ও সংঘর্ষের পথে?

    এই প্রশ্নের উত্তর প্রতিটি মানুষকেই নিজের বিবেক দিয়ে খুঁজে নিতে হবে। কারণ শেষ পর্যন্ত ধর্ম হোক বা না হোক, আমরা সবাই একই পৃথিবীর বাসিন্দা, একই মানবতার অধীনে। আর সামাজিক অবক্ষয় ও ধংসের হাত থেকে এই মানবজাতিকে রক্ষা করা আমদের নৈতিক দায়িত্ব ও কর্তব্য।
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঠিক অথবা ভুল প্রতিক্রিয়া দিন