সিঁড়ি ধুচ্ছিল মানোয়ারা। পাথর বসানো সিঁড়ি। ছোট ছোট হাত দিয়ে ঘষে ঘষে তুলছিল আগের দিনের পায়ে পায়ে আসা ধুলো। গোল গোল আঙ্গুলে সাবান তুলে নিয়ে লাগাচ্ছিল নাছোড়বান্দা দাগের গায়ে। ন্যাকড়া দিয়ে ঘষছিল। মগে করে জল ঢালছিল। একদম ঝাঁ চকচকে হওয়া চাই। নাহলে দাদাজান রাগ করে। গজর গজর করতে থাকে সারাদিন ধরে। আর সেই চিৎকারে দাদিজানের মেজাজ বিগড়ায়। ঝাঁঝ এসে পড়ে মানোয়ারার উপরে। রুক্ষ চুলের বিনুনি ধরে টানও পড়ে। রুটির সঙ্গে ভাজি দিতেও ভুলে যায় সেই দিনগুলোতে। তাই মানোয়ারা মন দিয়ে কাজ করে। মাঝে মাঝে একটু উঠে দাঁড়িয়ে, দূরে গিয়ে কোমরে হাত দিয়ে দেখে, দাগ কি আর দেখা যায়? আর একটু দীর্ঘশ্বাস ফেলে। এত লোক যে কেন আসে এ বাড়িতে!
লোক আসা যেন আরও বেড়েছে। এই কদিন ধরে। শুরুটা মইন চাচা মারা যাওয়ার পর থেকেই। দফায় দফায় লোক আসে - শুধু কথা, আর কথা, আর কথা। কত শলা পরামর্শ। মাঝে মাঝে তাদের গলা নেমে যায়। গুজুর গুজুর, ফিস ফাস। কীসব নাকি অসুখ হচ্ছে। আগে শুধু শহরে হচ্ছিল, এখন গ্রামে গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। শয়ে শয়ে লোক মরছে। দাওয়াই নেই। হাসপাতালে গেলেও কিছু চিকিৎসা হচ্ছে না। ডাক্তাররা হাত তুলে দিচ্ছে। তাদেরও কিছু করার নেই। লোকজন দম নিতে না পেরে খাবি খেতে খেতে মরে যাচ্ছে। মইন চাচাও তো সেভাবেই মরল। বুখার হয়েছিল। মানোয়ারাও গিয়েছিল দাদিজানের সঙ্গে। চাচিকে ঘিরে বসে ছিল সব মেয়েরা। গুনগুনিয়ে কাঁদছিল সবাই। বাইরের দাওয়ায় ছেলেরা সব আলাপ করছিল। মানোয়ারা দেখেছে, চাচা কেমন শ্বাস নেওয়ার জন্য আকুলি বিকুলি করছিল। মুখটা বেঁকে বেঁকে যাচ্ছিল। সপ্তাহ না পেরোতেই চাচীও বেহস্তে চলে গেল। দাদিজান বলল, আল্লা মেহেরবান। তারপরই সবার কপালে ভাঁজ পড়ল। গলায় চিন্তার দানা।
বাড়িতে লোক এলে মানোয়ারার কাজ বাড়ে। দাদিজান উনুন থেকে কড়া নামায়। চায়ের ডেকচি চাপায়। দুধ, মশল্লা, চা পাতা। খানিক জলও। নাহলে এত চা হবে কি করে! দুধটা প্রথমে কেমন শান্ত থাকে, তারপর একটা একটা করে বুড়বুড়ি জাগে। এই একটা, ওইখানে আরেকটা, ওই যে ওইখানে আরেকটা... ভারি ভাল লাগে দেখতে। কিন্তু সে দেখার সময় পেলে তো! রান্নাঘরে চুলার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেই ফরমায়েস উড়ে আসে, এটা কর, ওটা কর – আর সবকিছুর শেষেই জোড়ে, “দের মত করনা! জলদি লৌট আনা!” মানোয়ারাও জানে, জলদি ফিরতে হবে। চা নামলেই বৈঠকখানায় পৌঁছান চাই। মেহমানদের ঠান্ডা চা দিলে দাদাজান রেগে যাবে। তাই ছুটে যায় মানোয়ারা, ফেরেও ছুটতে ছুটতে। স্টিলের কানা ওঠা বগি থালায় গ্লাসে গ্লাসে চা ঢেলে দেয় দাদিজান। মানোয়ারা ওড়না জড়িয়ে নেয় সারা গায়ে। সব চুল যেন ঢাকা থাকে। পুরোহাতা কামিজের হাতা আরও টেনেটুনে নামিয়ে নেয়। তারপর ধীর পায়ে দুহাতে স্টিলের থালা ধরে এগিয়ে যায় বৈঠকখানার দিকে। একটুও যেন চা চলকে না পড়ে। প্রচণ্ড মনোযোগে ছোট্ট জিভটা বেরিয়ে আসে।
চা দিয়ে বেরোতেই মাথায় গাঁট্টা একটা। মুখ তুলে দেখে রমিজভাইয়া। মাথায় হাত বুলিয়ে মনে মনে গালি দেয় মানোয়ারা। মুখে কিছু বলার সাহস নেই। শুধু চোখ নামিয়ে বলে, জি।
“সেদিন সাহেবুলরা যে মুর্দাটার থেকে জেবর পেল , সেটা তুই প্রথমে দেখেছিলি? ”
ভারী গলার সরাসরি প্রশ্নে আরও ভয় পায় শরীরটা। রমিজের রাগ বাড়ির সবাই জানে। থালা বাটি ছুঁড়ে মারা তো আছেই, সেবার ছোটুকে তুলে কুয়োয় ফেলে দিতে গিয়েছিল। শেষমুহূর্তে দাদাজান আটকায়। কেঁদে কেঁদে নীল হয়ে গিয়েছিল ছোটু। কুঁকড়ে দেওয়ালের দিকে সরে যেতে যেতে মাথা নাড়ে মানোয়ারা। হ্যাঁ, দেখেছিল। সেই তো ছুটতে ছুটতে এসে বাড়িতে খবরটা দিয়েছিল। নদীর বাঁকের মুখে আটকে ছিল শরীরটা। শাড়িটা তখনও গায়ে জড়ানো। পাটা অনেকটা ফাঁক হয়ে আটকে গিয়েছিল রাইমুনিয়া ঝোপের মধ্যে। শুধু মাথাটা আধা ডোবা জলে। কালো চুলগুলো ভাসছিল জলে। মানোয়ারা পাটা টেনে একজায়গায় করতে চেষ্টা করছিল। যতই মুর্দা হোক, মেয়েমানুষ তো! এমন বেহায়ার মত পড়ে থাকলে লাজ লাগে না! কিন্তু অত গায়ের জোর কি আর ওর আছে। নড়াতেই পারল না। তারপরেই তো বাড়ির দিকে ছুটল। দাদাজানের বৈঠকখানায় তখন অনেকের জটলা। ওর মুখে শুনেই তো তারা সবাই গেল নদীর ধারে। মেলা বসে গেল প্রায়। সাহেবুলরা টেনে তুলল জল থেকে, আর তখনই তো ওটা দেখা গেল। মুর্দার নাকে ঝিকঝিকাচ্ছে বেশরটা। আর সেদিন দাদিজান খুব মেরেছিল। কেন সে বারণ করা সত্ত্বেও নদীর ধারে গিয়েছিল! বলেছিল, “মর, মর, মায়ের মত তুইও মর ।” দাদাজান রাগে গরগর করছিল। বলছিল, “বেশরম আওরত। রাস্তায় ল্যাংটা হয়ে নাচবে এরপর এই মেয়ে। যে মেয়ে নিজের ধর্ম ছাড়ে, তার রক্তে বেইমানি আছে। তার আওলাদও নিমকহারাম হবে।”
ভারী গলাটা আবার বলল, “দাদিজানকে বলে দিয়েছি। নদীর ধারে গেলে তোকে বকবে না আর। ভাল করে চোখ চেয়ে দেখবি। যদি আবার কিছু দেখিস, আমাকে এসে বলবি। নিজে এসে বলবি, বুঝেছিস। আর কেউ যেন না জানতে পারে। যদি অবাধ্য হয়েছিস তাহলে তোকে কোঠাবাড়িতে বেচে দিয়ে আসব।” ভয়ে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে মানোয়ারা। পাথরের মত। ঘাড় শক্ত করে তাকিয়ে থাকে মাটির দিকে। দেখে ছায়াটা উঠোন পেরিয়ে চলে গেল গোসলঘরের দিকে। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দ কানে আসার পর আবার নড়তে চড়তে পারল। বারান্দা ধরে এক ছুটে গিয়ে আম্মির ঘরে ঢুকে পড়ল।
এই সময়ের গল্প। হিংস্রতার গল্প, অসহায়তার গল্প। খুব খুব ভাল লাগল স্বাতী।
অদ্ভুত কষ্ট হল গল্পটা পড়ে।
খুব সাহসী গল্প। সমসাময়িকতার চিহ্ন সর্বাঙ্গে বহন করা গল্প।
এই গল্পটার ডিটেলের জন্যেই গল্পটা মনে থাকবে। চাক্ষুস করা যাচ্ছে।
লেখার উদ্দেশ্য মহান। গল্পের ভাল মন্দ বিচার অর্থহীন। সমালোচকের চশমা খুলে রেখে পড়েছি।
একটি সিরিজ করার অনুরোধ রইল।
সবাইকে অনেক ধন্যবাদ।
@ইন্দ্রাণী সমালোচনা পেলে খুশিই হতাম। নিজের লেখার কিছু ত্রুটি বোঝা গেলেও সব তো আর যায় না।