চোরেরা প্রাচীনকাল থেকেই ভারতীয় সংস্কৃতিতে জায়গা করে নিয়েছে। কথাসরিৎসাগরে চুরির কথা আছে। এছাড়া তিন জন সংস্কৃত জানা চোরের কথা বলতে হলে প্রথম জন শর্বিলক, শূদ্রক রচিত ‘মৃচ্ছকটিক’-এর চোর। দ্বিতীয় চোর সজ্জলক। তাকে পাওয়া যাবে ভাসের খণ্ডিত নাটক ‘চারুদত্ত’তে। তৃতীয় চোরের নাম অপহারবর্মা। তাকে পাওয়া যাচ্ছে দণ্ডীর ‘দশকুমারচরিত’-এ। প্রাচীন ভারতে চৌর্যবিদ্যা একটি কলা হিসেবে স্বীকৃত হত। চুরি যেহেতু এক প্রকারের কলা বা আর্ট, সেজন্য চোরেরা গৃহস্থের বাড়িতে এমনভাবে সিঁদ কাটবে, যা দৃষ্টনন্দন-স্থাপত্য রূপে বিবেচিত হবে এবং নগরবাসীরা সকালে ঘুম থেকে উঠে সেই চৌর্যকর্ম দেখে চোরের নিন্দা করলেও তার শৈল্পিক গুণের প্রশংসা না করে পারবে না। পুরীপ্রিয়া কুণ্ডু তাঁর বই ‘চৌর্যসমীক্ষা’য় লিখেছেন, চৌর্যশাস্ত্র সংক্রান্ত দুটি পুঁথির অস্তিত্ব পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত ‘ষণ্মুখকল্প’, অপরটি পুনের ভাণ্ডারকর ওরিয়েন্টাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট-এ রক্ষিত ‘চৌরচর্য্যা’। যদিও এই লেখার বিষয় অতীতের চোর-ডাকাত নয়, বর্তমানের রাজনৈতিক ‘চোর’দের কথা। যারা টাকা নয়, পয়সা নয়, সরকার চুরি করে।
এ তো গেল ভূমিকা। মূল বিষয়ে আসা যাক। জিতলেন এক দলের টিকিটে। জেতার পর যাঁরা তাঁকে ভোট দিলেন, তাঁদের বেপাত্তা করে নেতাবাবু চলে গেল অন্য দলে। যে দল ছেড়ে গেলেন, সেই দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ উঠল টাকার বিনিময়ে জনপ্রতিনিধি কেনা-বেচা হয়েছে। কিন্তু কে শোনে কার কথা। গত সাড়ে পাঁচ বছরে কতজন এরকম দল বদলেছেন? অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্র্যাটিক রিফর্মস (এডিআর)–এর তথ্য বলছে, ২০১৬ সাল থেকে বিভিন্ন রাজ্যের বিধানসভা এবং দেশের সংসদের মোট ৪৪৩ জন সদস্য দল বদলেছেন। এঁদের মধ্যে ৪২ শতাংশই কংগ্রেসের। বিজেপি ক্ষমতায়, ফলে বিজেপি-র দলছুট জনপ্রতিনিধি মাত্র ৪.৪ শতাংশ। কোথায় যাচ্ছেন ওঁরা? দলত্যাগী বিধায়কদের মধ্যে প্রায় ৪৫ শতাংশরই গন্তব্য দেখা যাচ্ছে বিজেপি। এডিআর-এর রিপোর্ট জানাচ্ছে, গত পাঁচ বছরে কর্নাটক, মণিপুর, গোয়া, অরুণাচল প্রদেশ, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র-সহ বিভিন্ন রাজ্যের কংগ্রেস বিধায়কেরা দলে দলে বিজেপি-তে যোগ দিয়েছেন। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটকের পাশাপাশি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল পুদুচেরির সরকারের পতন হয়েছে বিধায়কদের দলবদলের ফলে। সেখানেও বিধায়কদের গন্তব্য ছিল বিজেপি। সম্প্রতি এই তালিকায় যুক্ত হয়েছে পশ্চিমবঙ্গের নামও। দলে দলে তৃণমূল কংগ্রেসের জনপ্রতিনিধিরা বিজেপির খাতায় নাম লিখিয়েছেন।
২০১৬ থেকে ধরলে, এই দলত্যাগীদের তালিকায় ৪০৫ জন বিধায়ক, ১২ জন লোকসভার সাংসদ এবং ১৭ জন রাজ্যসভা সাংসদ। ১২ জন লোকসভা সাংসদের মধ্যে অবশ্য বিজেপি-র ৫ জন। অন্যদিকে, রাজ্যসভার দলত্যাগীদের মধ্যে ৭ জন কংগ্রেসের।
আর এইখানেই একটা অদ্ভুত তথ্য বেরিয়ে এসেছে। সব রাজনৈতিক দলই বিভিন্ন সময়ে এই দল বদলের পিছনে শত শত কোটি টাকার লেনদেনের অভিযোগ করেছে। এডিআর-এর রিপোর্ট বলছে, এই সব দলত্যাগী সাংসদ-বিধায়কদের সম্পত্তি গড়ে ৩৯ শতাংশ বেড়েছে। এই বৃদ্ধি বলা যায় হঠাৎ করে, লাফিয়ে বৃদ্ধি। এই বৃদ্ধির উৎস কী, তা নিয়ে এখনও কোনও তদন্ত হয়নি, কোনও রাজনৈতিক দল এমন তদন্ত দাবিও করেনি। করলে হয়তো কিছু কিছু ক্ষেত্রে ভয়ঙ্কর সত্য প্রকাশিত হত। এবং এই যে জনপ্রতিনিধিরা এক দলের টিকিটে জয়ী হয়ে ভোটারদের অসম্মান করে দল ত্যাগ করলেন, তাতে কিন্তু তাঁদের কোনও রাজনৈতিক অসুবিধে হল না। গণতন্ত্রের মূল নীতির সঙ্গে আপস করার পরেও তাঁদের অনেকেই ফের পুনর্নির্বাচিত হয়ে ফিরে আসছেন অন্য দলের টিকিটে। ভোটারদের সচেতনতার অভাবই এর প্রধান কারণ।
দল বদল মূলত দু’রকমের হয়। এক, ভোটের আগে। দুই, সংখ্যার প্রয়োজন মেটাতে ভোটের ফল বেরোনোর পরে। এবারের পশ্চিমবঙ্গে ভোটের আগে যে পরিমাণ দল বদলের ‘হিড়িক’ দেখা গেল, এটা বোধহয় দেশের মধ্যে একটা রেকর্ড। এর প্রতিফলন দেখা গেল বিজেপির প্রার্থী তালিকায়। বিজেপির মোট প্রার্থীর এক তৃতীয়াংশের বেশি প্রার্থী হলেন তৃণমূল ফেরত। এরকম অতীতে কখনও দেখা যায়নি। একটা ঠাট্টা সোস্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। সেটা হল, বিজেপিতে প্রার্থী হতে গেলে আগে তৃণমূলে যাও আর তৃণমূলে প্রার্থী হতে হলে আগে সিরিয়াল কর। তাতে অবশ্য প্রমাণ হয়, তৃণমূলে প্রার্থী হওয়াটা তুলনায় কঠিন।
এখন নির্বাচন চুরি হয়। এই অভিযোগ করেছেন প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদাম্বরম। গত ৬-৭ বছরে একটা বিষয় পরিষ্কার। বিজেপি কোনও রাজ্যে নির্বাচনে যদি হেরেও যা্য়, তবু বিজেপি সেখানে সরকার গড়তে পারে। বিজেপি সম্পর্কে এখন বলা হয়, জিতলে আমরা সরকার গড়ব, আর হারলে, তোমরা বিরোধী আসনে বসবে। মধ্যপ্রদেশ, কর্নাটক, গোয়া সহ বেশ কিছু রাজ্যে হেরে গিয়েও সরকার গড়ে বিজেপি প্রমাণ করে দিয়েছে, ভোট বা নির্বাচন একটা ধাপ মাত্র, সরকার গড়ার জন্য ভোটে জিততেই হবে, তার কোনও মানে নেই।
এইসব কারণেই কি দল চালাতে টাকার প্রয়োজন ক্রমেই বেড়ে চলেছে? দেশের নাগরিকদের কাছে যাবতীয় তথ্য গোপন রেখে ‘অজানা-অচেনা’ সূত্র থেকে শত শত কোটি টাকা রোজগারের এক বিতর্কিত, সন্দেহজনক পথ আবিষ্কার করেছেন মোদি-অমিত শাহরা। সেটা হল নির্বাচনী বন্ডের মাধ্যমে টাকা নেওয়া। এই ভাবে গোপন সূত্র থেকে যে বিপুল পরিমাণ টাকা আসছে, শাসকদল বলে তার সিংহ ভাগ যাচ্ছে বিজেপির ফান্ডে। তাতেই স্পষ্ট, যারা এই টাকা দিচ্ছে, তাদের কোনও উদ্দেশ্য থাকতে পারে। কারা টাকা দিচ্ছেন, সেটা দেশের কোনও নাগরিকের জানার অধিকার নেই। কিন্তু সরকার, মানে শাসকদল জানতে পারবে ইচ্ছে করলেই। ফলে যারা টাকা দিচ্ছে তারা সরকারকে খুশি করতে চাইছে, এমন প্রশ্ন উঠতে পারে খুব স্বাভাবিক ভাবেই। প্রশ্ন উঠছে, কিন্তু জবাব দেওয়ার কেউ নেই। কেন এই গোপনীয়তা? তারও কোনও জবাব নেই। দেশ জুড়ে এই ভাবে টাকা তোলার নিন্দা হচ্ছে। বিজেপি নির্বিকার। পশ্চিমবঙ্গ ভোটের আগে ফের বন্ডে টাকা আসবে। এডিআর সুপ্রিম কোর্টে মামলা করে বলেছিল ভোটের আগে এই ভাবে অজানা সূত্র থেকে কোনও রাজনৈতিক দল টাকা পেলে তার অব্যবহারের সুযোগ আছে। অতীতে নির্বাচন কমিশন বলেছিল বন্ডে টাকা নেওয়া নির্বাচনী স্বচ্ছতার বিরোধী। এখন আবার নির্বাচন কমিশন বলছে, ভোটের আগে বন্ডে টাকা নেওয়া যেতে পারে। সুপ্রিম কোর্টও অবশেষে বলেছে, ভোটের আগে বন্ডে টাকা নেওয়া যাবে। এই প্রসঙ্গে একটাই কথা বলা যতে পারে।
আমাদের রাজ্যে দল বদল ব্যাপারটা মোটেই সেভাবে ছিল না। এর কৃতিত্ব মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পেইড বাই দ্য সেম কয়েন একেই বলে। এখন সেই অস্ত্রেই তৃণমূল বিজেপির কাছে নাস্তানাবুদ। একটা কথা অনেকেই বলছেন। সেটা হল, মমতা জিতবেন, কিন্তু ব্যবধান খুব বড় না-হলে ‘অপারেশন কমল’ মানে মধ্যপ্রদেশ-কর্নাটক মডেলে মোদি-শাহরা দল বদলের খেলায় সরকার দখল করে নেবে। ১৯৮৫ সালে রাজীব গান্ধী সংবিধান সংশোধন করে এই দল বদল রুখতে কিছু ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। পরে সেই আইনকে আরও একটু শক্ত-পোক্ত করেন অটলবিহারী বাজপেয়ীর সরকার। কিন্তু অটলজির উত্তরসূরীদের দাপটে এবং খেলায় ওই সংবিধান সংশোধন এক হাস্যকর জায়গায় পৌঁছেছে। কর্নাটক-মধ্যপ্রদেশে দেখা গেল এক অভিনব কৌশল। বিজেপির বিধায়ক কম। সরকারে কংগ্রেস, বা কংগ্রেস জোট। এবারে বিজেপিকে রক্ষা করতে একদল কংগ্রেস বিধায়ক পদত্যাগ করলেন বিধায়ক পদ থেকে। এমন সংখ্যক বিধায়ক পদত্যাগ করলেন যাতে কংগ্রেসের বিধায়ক সংখ্যা বিজেপির থেকে কমে যায়। এর পর ফ্লোর টেস্টে কংগ্রেসের পরাজয়। এবং চমকপ্রদ ঘটনা হল ওই কংগ্রেস ছেড়ে আসা বিধায়করা প্রায় সকলকেই উপনির্বাচনে বিজেপির টিকিটে জয়ী হয়ে ফিরে এলেন। কেউ কেউ মন্ত্রী-টন্ত্রিও হলেন। এই সব বিধায়কদেরই অনেকের সম্পত্তি বেড়েছে গড়ে ৩৯ শতাংশ, এডিআরের রিপোর্টে বলা হয়েছে। অতীতে এডিআরের একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, যে প্রার্থীদের নামে বহু ফৌজদারি মামলা রয়েছে, শতাংশের বিচারে ভারতীয় নাগরিকরা তাদের বেশি সংখ্যায় ভোটে জিতিয়ে আনেন, তুলনায় স্বচ্ছ ভাবমূর্তির প্রার্থীরা কম জেতেন।
নরেন্দ্র মোদির আমলে রাজ্যপালদের সহযোগিতায় যদি পরাজিত দল, দল-বদলের কৌশলে নির্বাচনে বিজয়ী হওয়া দলকে সরিয়ে ক্রমাগত ‘পরাজিত দল’ ক্ষমতায় আসেতে থাকে, তাহলে তো গোটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটাই হাস্যকর হয়ে উঠবে। আর গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে হাস্যকর করে তুললে তার সুযোগ নেয় স্বৈরতন্ত্রীরা। আমরা কি সেই দিকে এগোচ্ছি?
নির্বাচনে বিজয়ী দলের সরকারকে তাহলে কী ভাবে সুরক্ষা দেওয়া সম্ভব? প্রশ্নটা কঠিন। রাজনৈতিক দলগুলির সদিচ্ছা ছাড়া এটা সম্ভব নয়। এক সময় কংগ্রেস, রাজ্যপালদের সাহায্য নিয়ে নির্বাচিত সরকারকে সরিয়ে দিত। অসংখ্য এমন নজির আছে। যার বিরুদ্ধে আন্দোলনে নেমে রামকৃষ্ণ হেগড়ে, জ্যোতি বসু, এনটিআর, ফারুক আবদুল্লারা সারকারিয়া কমিশন বাসাতে বাধ্য করেছিল কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারকে। কর্নাটকের এস আর বোম্মাই মামলাতেও সুপ্রিম কোর্ট কড়া নির্দেশিকা জারি করেছিল সরকার ফেলার খেলা আটকাতে।
কর্নাটকের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সোমাপ্পা রায়েপ্পা বোমাই বনাম ভারত সরকারের সেই মামলার পর সুপ্রিম কোর্টের ৯ সদস্যের বেঞ্চ কয়েকটি শর্ত বেঁধে দেয়, কখন নির্বাচিত সরকার বাতিল করতে সংবিধানের ৩৫৬ ধারা ব্যবহার করা যাবে, আর কখন যাবে না। তার পর থেকে অপছন্দের সরকার ফেলাটা কমেছে। কিন্তু কেন্দ্র এবং রাজ্যে ভিন্ন দলের সরকার হলে, দু’পক্ষের বিরোধ অবশ্য কমেনি।
১৯৫৯-এর কেরলের নামবুদরিপাদের সরকার ফেলা আটকাতে সত্যজিৎ রায় থেকে শুরু করে বহু বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছিলেন। সেই সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক পরিবেশ অবশ্য আজ আর নেই।
অনেক রাজনীতিবিদ মনে করেন, নেহাত ভয়ঙ্কর কোনও ঘটনা না ঘটে গেলে, একটা নির্বাচিত সরকারকে পাঁচ বছর সরকার চালাতে দেওয়াটা নিশ্চিত করা উচিত সংবিধান সংশোধন করে। যদি কোনও সদস্য পদত্যাগ করেন? দল বদল করেন? সেক্ষত্রে তিনি পাঁচ বছরের জন্য ভোটে দাঁড়াতে পারবেন না, এই নিয়ম করা হোক। এটা একটা মত। এমন হলে দল বদল কমবে। আরেকটি মত হল, যদি কোনও বিধায়ক দল বদল করেন, পদত্যাগ করেন শাসকদল থেকে, সেক্ষত্রে বিনা নির্বাচনে সেখানে শাসকদল একজন মনোনীত সদস্য নিতে পারবেন। যাতে বিধায়কের পদত্যাগ, সরকারের সংখ্য গরিষ্ঠতায় কোনও প্রভাব না ফেলে। বিচ্ছিন্ন ভাবে কেউ কেউ এমন মত দিলেও, বাস্তব ছবিটা হল, রাজনৈতিক দলগুলি এই সমস্যাটা আলোচনাতেই আনছে না। বা আনতে চাই্ছে না। সেটা আরেকটা বড় সমস্যা।
অতএব .....???? """ আমরা সবাই চ্যাচ্চোড় আমাদের এই চোরের রাজত্বে নইলে মোরা চোরের সনে মিলবো কি শর্তে """"!!!তপন বাবু ঠিক বলে গিয়েছেন !! মনোজ মিত্র'র ""মহাবিদ্যা " স্মরণ করা যেতে পারে !!! '''হর হর চোর ঘর ঘর চোর """ !!