পোশাকের রকম-সকম বা দামের দিক থেকে দেখলে অবশ্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে মহাত্মা গান্থীর কোনও মিল নেই, বরং ফারাক-ই আকাশ-পাতাল, তবু নরেন্দ্র মোদি যে কখনও কখনও গান্ধীকে অনুকরণের চেষ্টা করেন, তা তাঁর আচার আচরণ, চরকা কাটার ভঙ্গীমা এবং কখনও কখনও ভাষা ব্যবহারের মধ্যে দিয়েও প্রকাশ পায়। লকডাউনের শুরুর দিকে মানুষের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে নরেন্দ্র মোদি প্রায় গান্ধীর ভাষায় ‘ত্যাগ’ এবং ‘তপস্যা’র কথা বলেছেন। তার পর এই নিয়ে একটি নিবন্ধ লিখেছিলেন গান্ধীর পৌত্র রাজমোহন গান্ধী। রাজমোহনের মূল বক্তব্য হল, গান্ধী তো নিজের ভুল কাজের দায়িত্ব নিতেন। ভুল স্বীকার করতেন। গান্ধীর কাছে অহিংসা কোনও কৌশল ছিল না। অহিংসা তাঁর নীতি এবং ধর্ম ছিল। ১৯২২ সালে গান্ধীর ডাকে পথে নামা আন্দোলনকারীরা যখন গোরক্ষপুরের চৌরিচৌরায় থানার ভিতরে ঢুকে ইংরেজসেবক ২২ জন পুলিশকে খুন করেছিল, গান্ধী আন্দোলন তুলে নিয়ে তাঁর পত্রিকা ‘নবজীবন’-এ লিখলেন, গোরক্ষপুরের চৌরিচৌরার ওই ঘটনার জন্য আমিই সব থেকে বেশি দায়ী।
চলতি বছরের ২৪ মার্চ রাতে নরেন্দ্র মোদি ৪ ঘণ্টার নোটিসে লকডাউন ঘোষণা করে লক্ষ লক্ষ পরিযায়ী শ্রমিককে অবর্ণনীয় দুর্দশার মধ্যে ফেলে দিলেন। সংবাদ মাধ্যমের তথ্য অনুযায়ী বাড়ি ফেরার পথা প্রায় দু’শো জনের মৃত্যু হল রাস্তায়, রেললাইনে ট্রেনে কাটা পড়ে, পথ দুর্ঘটনায়, পথে অসুস্থ হয়ে বিনা চিকিৎসায়। খাবার, পানীয় জলের অভাবে তারা ধুকতে ধুকতে পায়ে হেঁটে, সাইকেলে, ভ্যানে চেপে রওনা দিয়েছিলেন বাড়ির পথে। তার পরও বহুবার নানান বাহারি পোশাকে নরেন্দ্র মোদি সরকারি ক্যামেরার সামনে এসেছেন। একবারও কিন্তু স্বীকার করলেন না যে তাঁরই ভুলে লক্ষ লক্ষ মানুষ অনন্ত দুর্ভোগের মধ্যে পড়েছেন। গান্ধী কি শুধু বসার কায়দায় আর বক্তৃতা দিয়ে হওয়া যায়!
আজ থেকে চার বছর আগের কথা। আচমকা নোট বাতিল করে গোটা দেশকে তিনি বিপাকে ফেলেছিলেন। বলেছিলেন সব কালো টাকা বেরিয়ে পড়বে। দেখা গেল তা হল না। সব টাকাই ব্যাঙ্কে ফেরত এল। বলেছিলেন, কাশ্মীরে সন্ত্রাসবাদ কমবে। যার কোনও লক্ষণই নেই। ওই সময় টাকার জন্য ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড়িবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়েছে। কখনও তো নরেন্দ্র মোদি বলেননি যে তিনি মানুষের এই দুর্ভোগের দায় নিচ্ছেন! লাইনে দাঁড়িয়ে বয়স্ক মানুষদের মৃত্যুর দায় তিনি নিচ্ছেন, কেউ কখনও শোনেনি তঁর মুখে এমন কথা।
১৯৪৬ সাল। কলকাতায় ভয়ঙ্কর গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ঘটে গেছে। তার পর নোয়াখালিতে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা। গান্ধী পৌঁছলেন নোয়াখালিতে। তিনি ঠিক করলেন খালি পায়ে হেঁটে মানুষের কাছে যাবেন। প্রথম প্রথম তাঁর যাও্য়ার পথে ভাঙা কাচ আর মল ফেলে রাখা হত। কিন্তু তাঁকে থামানো যায়নি। তিনি পায়ে হেঁটে মানুষের মনে আস্থা ফেরানোর চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। অভিযোগ ছিল নোয়াখালির এসপি, ই এস এম আবদুল্লা দঙ্গায় উসকানি দিয়েছেন। তাকে দেখে গান্ধী বলেছিলেন, ওহ্, তুমিই তা হলে সেই আবদুল্লা! তোমার কথা আমাকে অনেকে বলেছে। নোয়াখালিতে আক্রান্ত মানুষদের রক্ষা তো তুমি করই-নি, বরং অনেক ক্ষেত্রে আক্রমণকারীদের উৎসাহ দিয়েছ। আবদুল্লা গান্ধীর সামনে কোনও জবাব না দিয়ে কিঞ্চিত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে। গান্ধী আবদুল্লার কাঁধে হাত রেখে বললেন, তুমি আমার সঙ্গে এসো। যে পুলিশ সুপারের বিরুদ্ধে হিন্দুদের পুঞ্জিভূত অভিযোগ, গান্ধী তাকে নিয়েই এলেন প্রার্থনাসভায়। শ্রোতাদের মধ্যে গুঞ্জন শুরু হয়ে গেল। গান্ধী আবদুল্লাকে নিজের পাশে বসালেন। পরে প্রতিদিন গান্ধী প্রতিটি আক্রান্ত গ্রামে গ্রামে ঘুরেছেন। বেশ কিছু দিন ছিলেন নোয়াখালিতে। আর আবদুল্লা ততদিনে একজন বিশ্বস্ত গান্ধী ভক্ত। পরে আবদুল্লা বদলি হয়ে যান মুর্শিদাবাদে। দেশভাগের সময় গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জানতে চাইলেন, তিনি কি ভারতে থেকে যাবেন না পাকিস্তানে চলে যাবেন। গান্ধী আবদুল্লাকে বললেন, না, তুমি পাকিস্তানে যাও। নতুন রাষ্ট্র, পাকিস্তানের তোমার মতো অফিসারের দরকার আছে। গান্ধীহত্যার পর গান্ধীস্মৃতি রক্ষায় একটি তহবিল তৈরি হয়েছিল। সেই তহবিলে প্রথম যে হাজার টাকার মানিঅর্ডারটি এসে পৌঁছেছিল, সেটা ঢাকা থেকে আসা, এস এম আবদুল্লার। এই হলেন মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। আর সেখানে নরেন্দ্র মোদি বক্তৃতায় বলেন, আন্দোলনকাদরীদের পোশাক দেখে বোঝা যায় (লুঙি বোঝাতে এই মন্তব্য) তারা কোন ধর্মের মানুষ! গুজরাটের পুলিশ অফিসার অভিযোগ করেছেন, মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দাঙ্গা প্রতিরোধে দায়িত্ব পালনে ঘাটতি ছিল। অবসরপ্রাপ্ত লেফ্টেন্যান্ট জেনারেল জমিরুদ্দিন শাহ তাঁর সরকারি মুসলমান বইয়ে লিখেছেন, (সিট এবং নানাবতী কমিশনের ক্লিনচিটের পরেও) ‘গুজরাটে যখন দাঙ্গা শুরু হয়, আমি তখন যোধপুরে। সেনা প্রধান পদ্মনাভনের ফোন পেলাম। অবাক হলাম। সেনা প্রধান সরাসরি কখনও ডিভিসন কমান্ডারকে (তখন জমিরউদ্দিন ওই পদে ছিলেন) ফোন করেন না। পাঞ্জাবে একসঙ্গে কাজ করার সূত্রে তিনি আমাকে চিনতেন, ডাকতেন ডাক নাম ধরে, ‘জুম’ বলে। সেনাপ্রধান ফোনে বললেন, জুম, তোমার ট্রুপস নিয়ে এখনি গুজরাট চলে যাও, দাঙ্গা ঠেকাও’। ২০০২-এর ২৮ ফেব্রুয়ারি আর ১ মার্চের মাঝের রাতের মধ্যে যোধপুর থেকে আমেদাবাদে পৌঁছে গিয়েছিল তিন হাজার সেনা। জমিরউদ্দিন লিখেছেন, ‘আমাকে বলা হয়েছিল আমেদাবাদ পৌঁছলে ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় গাড়ি, গাইড, ম্যাপ সব দেওয়া হবে রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে’। আমেদাবাদে নেমে তিনি দেখতে পান, গাড়ি নেই। দায়িত্ব পালনে দেরি হয়ে যাচ্ছে দেখে জমিরউদ্দিন সেই রাতেই গান্ধীনগরে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাড়িতে দেখা করতে যান। যাওয়ার পথে দেখতে পান পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে আর বাড়ি-ঘরে আগুন লাগাচ্ছে দুষ্কৃতীরা।জমিরুদ্দিনের কথায়, ‘রাত দু’টোয় মুখ্যমন্ত্রীর বাড়িতে পৌঁছে বিস্মিত হয়ে দেখি প্রতিরক্ষামন্ত্রী জর্জ ফার্নানডেজ সেখানে উপস্থিত। দু’জনে তখন ডিনারে বসছেন’। আইন-শৃঙ্খলা স্বাভাবিক অবস্থায় ফেরাতে ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য গাড়ি, ট্রাক, ম্যাজিস্ট্রেটের সহযোগিতা, মানচিত্র সহ সেনার যা যা প্রয়োজন সেসব দ্রুত পাওয়ার জন্য মুখ্যমন্ত্রীকে তিনি বললেন। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে নির্দিষ্ট আশ্বাস পেয়ে তিনি এয়ারপোর্টে ফিরে আসেন। কিন্তু পরের দিন ১ মার্চ সারাদিন অপেক্ষা করেও গাড়ি পেল না সেনা। গাড়ি এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা পাওয়া গেল ঠিক ২৪ ঘণ্টা পরে, ২ মার্চ। অর্থাৎ একদিন বিনা বাধায় দাঙ্গা চলেছিল। বলা হয় এক হাজারের বেশি মানুষ খুন হয়েছিল গুজরাট গণহত্যায়। যদি ২৪ ঘণ্টা আগে সেনাকে ঘটনাস্থলে যাওয়ার জন্য গুজরাট সরকার গাড়ি দিত, তাহলে হয়তো মৃতের সংখ্যা অনেকটাই কম হত, লিখেছেন জমিরুদ্দিন (নানাবতী কমিশনে তাঁর সাক্ষ্য নেওয়া হয়নি)।
নোয়াখালি থেকে কিছুদিনের মধ্যেই গান্ধী ছুটে এলেন বিহারে। বিহারে তখন নোয়াখালির বদলা নিতে দাঙ্গা শুরু হয়েছে সেখানে। বিহারে তখন কংগ্রসের সরকার। সেই সময় একদিন স্থানীয় কংগ্রেস নেতাদের ডেকে গান্ধী বলেছিলেন, যারা বলেন বিহারের দাঙ্গা নোয়াখালির বদলা, তাদের আমি বলি এমন ভাবে ভাবা মানে গুন্ডামির প্রতিযোগিতায় নামা। তিনি কংগ্রেস সদস্যদের উদ্দেশে বললেন, চোখের সামনে আপনারা দেখলেন নিরীহ মানুষকে খুন করা হচ্ছে, বাধা দিতে গিয়ে আপনাদের মৃত্যু হল না কেন! হয় করব না হয় মরব, এই ভাবনা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়লেন না কেন!
এই হলেন গান্ধী। নরেন্দ্র মোদি কি তাঁর মুখ্যমন্ত্রিত্ব-কালে ঘটা গুজরাট গণহত্যার পর তাঁর দলের কর্মীদের সামনে দাঁড়িয়ে এই কথা বলতে পেরেছিলেন? পারেননি। শুধু তাই নয়, জে কুরুভাচিরা তাঁর ‘পলিটাইজেশন অফ হিন্দু রিলিজিয়ন ইন পোস্ট মডার্ন ইন্ডিয়া’ বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রকাশ্যে অটলবিহারী বাজপেয়ী প্রধানমন্ত্রী থাকাকালীন নরেন্দ্র মোদিকে হালকা করে হলেও বলেছিলেন রাজধর্ম পালন করতে, কিন্তু সেই তিনিই একদম উল্টো কথা বলেছিলেন ২০০২-এর ১৭ ডিসেম্বরে বিজেপির সংসদীয় দলের বৈঠকে। বাজপেয়ী বলেছিলেন, ‘আমাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে আমরা কি দেশের অন্যান্য জায়গাতেও গুজরাট ফর্মুলা ব্যবহার করব? আমি তাদের বলি, ওরা কি ফের গোধরা করবে’। গান্ধী যাকে বলেছেন গুন্ডামির প্রতিযোগিতা, এতো সেই ভাষা!
গান্ধী শুধু বক্তৃতা দিয়ে হওয়া যায় না।
গত ১৫ ই আগস্ট আমরা পেরিয়ে এলাম ৭৪তম স্বাধীনতা দিবস। স্বাধীনতা দিবসে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বললেন, 'প্রত্যেক ভারতীয়ের স্বপ্ন স্বনির্ভর ভারত গড়ে তোলা। এই স্বপ্নকে এবার আমরা বাস্তবে পরিণত করব।' তিনি বলেন, 'এই করোনা অতিমারির সময়ে ১৩০ কোটি ভারতীয় আত্মনির্ভর ভারত গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেছেন। আমি আত্মবিশ্বাসী যে ভারত তার স্বপ্নকে অনুভব করতে পেরেছে। আমরা একবার যখন একটা কিছু করব বলে ঠিক করি, তখন তা পূরণ না করা পর্যন্ত আমরা থামি না। আমার সহ-নাগরিকদের ক্ষমতা, আত্মবিশ্বাস এবং দক্ষতার ওপর আমার পূর্ণ আস্থা আছে।'
অতীতে প্রধানমন্ত্রীর অচ্ছেদিন, মেক ইন ইন্ডিয়া, স্মার্ট সিটি, বছরে ২ কোটি চাকরি এমন বহু প্রতিশ্রুতির কথা আমরা জানি। সে প্রসঙ্গ এখন নাহয় থাক। এবারের ১৫ অগস্টের ভাষণ ছিল প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নরেন্দ্র মোদির সপ্তম বক্তৃতা। আমরা বরং, প্রথম বার প্রধানমন্ত্রী হয়ে নরেন্দ্র মোদি তাঁর প্রথম স্বাধীনতাদিবস-বক্তৃতায় কী বলেছিলেন, সেটা এক ঝলক দেখে নিই।
ভোটে জয়ী হয়ে, ২০১৪ সালের ১৫ অগস্ট লালকেল্লা থেকে ভাষণে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, ‘আমার প্রিয় ভাই-বোনেরা, নানা কারণে দীর্ঘ বছের ধরে আমাদের দেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনার পরিবেশ রয়েছে। ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতার পরেও জাত-পাতের বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ থেকে আমরা মুক্তি পাইনি। কিন্তু সময় এসেছে এখন প্রশ্ন করার, এই জিনিস আর কত দিন চলবে? এর থেকে কার উপকার হয়? অনেক হয়েছে। অনেক প্রাণ ভেসে গেছে। প্রিয় দেশবাসী, পিছনে ফিরে একবার তাকিয়ে দেখুন, এর থেকে কারও ভালো হয়নি। শুধু আমাদের প্রিয় জন্মভূমির মুখে কালির ছোপ লেগেছে। এত দিন এসব বন্ধ করার জন্য আমরা কিছুই করিনি। তাই আজ এই স্বাধীনতা দিবসে আমি দেশবাসীর কাছে করজোড়ে আবেদন করছি, জাত-পাতের বিষ, সাম্প্রদায়িকতার বিষ, আঞ্চলিকতার বিদ্বেষ, সামাজিক, অর্থনৈতিক বিভাজন, যা আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে প্রধান বাধা, আসুন আজ আমরা অন্তর থেকে বলে উঠি, আগামী ১০ বছরের জন্য আমরা এসব ভুলে যাই, এই ভাবেই আমরা একসাথে এগিয়ে যেতে চাই এক নতুন সমাজ গড়ার দিকে। তখন আপনারা দেখবেন, শান্তি, সদিচ্ছা, ঐক্যের কী প্রচণ্ড শক্তি। চলুন আমরা আজ থেকেই এই পরীক্ষা শুরু করি, শপথ নিই। প্রিয় দেশবাসী, আমার কথায় আস্থা রাখুন। আমি কথা দিচ্ছি, এতদিন যে পাপ হয়েছে, সব ভুলে গিয়ে, মুছে ফেলে এগিয়ে চলুন, সদিচ্ছা আর ঐক্যের শক্তিতে আমরা দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাব। আমি বিশ্বাস করি আমরা পারব’।
তার পর কী হল? এক বছর না পেরোতেই শুরু হল দেশের বিভিন্ন জায়গায় মব লিঞ্চিং করে সংখ্যালঘুদের খুন করা। এই সব খুনের ঘটনায় বার বার বিজেপি সমর্থক হিন্দুত্ববাদীদের নাম উঠে এসেছে। ২০১৫র ২৮ সেপ্টেমবরে উত্তরপ্রদেশে বাড়ি থেকে বের করে দল বেঁধে পিটিয়ে খুন করল মহম্মদ আখলাককে। যারা মারল তারা নাকি গোরক্ষক বাহিনী। আখলাকের দোষ ওর বাড়িতে নাকি গরুর মাংস রাখা আছে ফ্রিজে। যদিও তা প্রমাণ করা যায়নি। প্রধানমন্ত্রী, যিনি ১০ বছরের জন্য সবাইকে হিংসা থেকে দূরে থাকতে বললেন ২০১৪-র ১৫ অগস্ট। তাঁর সমর্থকদের এই কাজে তিনি কিন্তু নীরব থাকলেন। এই ঘটনার প্রায় এক বছর পরে আখলাক খুনে গ্রেফতার হওয়া ১৮ জনের মধ্যে রবি শিসোদিয়া নামে এক অভিযুক্ত জেলের ভিতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। হাসপাতালে ভরতি করার পর তিনি মারা যান। ওঁর বাড়ির লোক-জনেরা অবশ্য দাবি করেন যে জেলে অত্যাচার করা হয়েছে বলেই রবি অসুস্থ হন। সেই সময়ে নরেন্দ্র মোদির মন্ত্রিসভার সদস্য বিজেপি মন্ত্রী মহেশ শর্মা সেখানে যান, হত্যায় অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির মরদেহে ফুল দিয়ে প্রণাম করেন। এই সংক্রান্ত ছবি দিয়ে একটি টুইটও করেন বিজেপির ওই কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। মহেশ শর্মাকে আখলাক খুনে নিন্দা করে কোনও মন্তব্য করতে দেখা যায়নি। কিন্তু খুনে অভিযুক্তের পাশে তাঁকে দেখা গেল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তা নিয়েও নীরব থাকলেন। খুনে অভিযুক্ত ওই রবি শিসোদিয়ার মরদেহ জাতীয় পতাকায় ঢেকে তাকে সম্মান জানানো হল। শহিদ বলা হল তাকে। সেই খবর সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হল। নরেন্দ্র মোদি তা নিয়েও কোনও মন্তব্য করলেন না। গোরক্ষক নামের ওই ‘লিঞ্চিং-বাহিনী’ সাহস পেয়ে গেল। এর পর টানা কয়েক বছর ধরে দেশের বিভিন্ন রাজ্যে একের পর এক ঘটতে থাকল পিটিয়ে সংখ্যালঘু হত্যার ঘটনা। প্রধানমন্ত্রী যে আবেদন ২০১৪ সালের ১৫ অগস্ট করেছিলেন, সেই আবেদন আরও একবার করলে হয়তো কিছু মৃত্যু ঠেকানো যেত। কিন্তু তা তিনি করেননি। প্রধানমন্ত্রীর ছবি দিয়ে নানা সাফল্যের কথা লিখে সারা দেশের প্রায় সব সংবাদপত্রে, টেলিভিশনে নিয়মিত বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর ওই আবেদন বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচারিত হলেও হিন্দুত্ববাদীদের সমর্থক ওই বাহিনীকে মনে করিয়ে দেওয়া হত সেই কথাগুলো। তেমন উদ্যোগও দেখা যায়নি বিন্দুমাত্র।
দিল্লি বিধানসভা ভোটের প্রচারে দেখা গেল বিজেপির শীর্ষ নেতা-মন্ত্রীদের কেউ কেউ শাহিনবাগের আন্দোলনকারীদের উদ্দেশে জনতাকে দিয়ে বলাচ্ছেন গোলি মারো শালোকো, কেউ বলছেন, ইভিএমে এমন ভাবে ভোট দিতে, যাতে শক লাগে শাহিনবাগে। এক বিজেপি সাংসদ বললেন, ভোটে বিজেপিকে জিতিয়ে দিল্লিকে শাহিনবাগ মুক্ত না করলে এরা আপনার আমার মা-বোনকে ধর্ষণ করবে। যিনি এ কথা বললেন, দেখা গেল দেখা গেল তার পরে পরেই সংসদে রাষ্ট্রপতি ভাষণের উপর আলোচনা তাঁকে দিয়েই শুরু করাচ্ছেন নতেন্দ্র মোদি। নির্বাচনী বক্তৃতায় এই ধরনের কথা বলার জন্য বিজেপির একাধিক নেতাকে নির্বাচন কমিশন শাস্তিও দেয়। কাউকে ৪৮ ঘণ্টা কাউকে ৭২ ঘণ্টা নির্বাচনী প্রচার থাকে সরে দাঁড়াতে হয় নির্বাচন কমিশনের নির্দেশ। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সেই সময়েও তাঁর সহকর্মীদের মনে করিয়ে দেননি তাঁর ২০১৪ সালের বক্তৃতার কথা।
এর পর দিল্লিতে দাঙ্গা হল। দিল্লি সরকারের সংখ্যালঘু কমিশনের তথ্যানুসন্ধান রিপোর্টে বলা হল, ফেব্রুয়ারি মাসে দিল্লির দাঙ্গায় সংখ্যালঘুদের উপর পরিকল্পিত আক্রমণে পুলিশ কার্যত আক্রমণকারী দুষ্কৃতীদের সঙ্গীর ভূমিকা পালন করেছিল। সেই রিপোর্টে আরও বলা হল, গত ২৩ ফেব্রুয়ারি, বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ উত্তর-পূর্ব দিল্লির মৌজপুর এলাকায়, জনৈক বিজেপি নেতার প্ররোচনামূলক বক্তব্যের পরেই পুরো এলাকা জুড়ে একটি নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর হামলা ছড়িয়ে পড়ে। কমিটির মতে শুরুতে সংখ্যালঘু মানুষ নিজেদের পরিবার, সম্পত্তি রক্ষার্থে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করে, কিন্তু আক্রমণকারী জনতা ক্রমশ বিপুল আকার ধারণ করায় তারা কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
এই ঘটনাতেও কিন্তু প্রধানমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শনে যাননি। আক্রান্ত সব-হারা মানুষের কাঁধে হাত রেখে তিনি তাঁর ২০১৪ সালের আবেদনের কথা দেশবাসীকে মনে করিয়ে দেননি। সংখ্যালঘু কমিশনের রিপোর্টে এত গুরুত্পূর্ণ অভিযোগ ওঠা সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী একবারও বলেননি, ওই সব অভিযোগের তদন্ত হবে। হ্যাঁ, নজির কিন্তু আছে। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একটু ইতিহাস ঘাঁটলেই জানতে পারবেন, আমাদের দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরু দাঙ্গা বিধ্বস্ত এলাকায় গিয়ে মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন, এমন একাধিক ঘটনার নজির রয়েছে।
গান্ধী হওয়া অত সহজ নয়।
জরুরী লেখা।
নোয়াখালি পিলগ্রিমেজ একটা অসম্ভব ব্যাপার। সভ্যতার ইতিহাসে এক আধবার ওরকম কিছু হয়ে যায়!
ডুবে গিয়েছিল, তুললাম।
বা! করোনার সময় গান্ধী থাকলে কি করতেন এনিয়ে ল্যান্সেটে একটা ভালো লেখা বেরিয়েছে।
লিংক দেবেন?
আত্মজীবনীতে প্লেগ নিয়ে অনেক লেখা আছে। ওনার সঙ্গে যে নার্স রুগিদের সেবা করছিলেন তিনি প্লেগে মারা গেছিলেন।
অসাধারণ লেখা
হুঁ
উপনিবেশ তার কাজে প্রচণ্ড সফল। সে যখন দেখে তার একদা শাসিত দেশের মানুষরা নরেনকে কাটতে ব্যাপকভাবে মোহনকে আঁকড়ে ধরছে এবং নিবিষ্টচিত্তে এই কাটাকুটি খেলায় মগ্ন, তখন সে এসব দেখে-টেখে আড়ালে মুচকি মুচকি হাসে।
এই খেলা সে শুরু করেছিল রামমোহন গোষ্ঠীকে পোগোতিসিল আর রাধাকান্ত গোষ্ঠীকে পোতিক্কিয়াসিল 'বানিয়ে'। পাবলিকে সেই বানানোটা খুব পচুন্দো করে। তাই পাবলিক একইভাবে পোগোতিসিল বিদ্যাসাগর বনাম পোতিক্কিয়াসিল রাধাকান্তর কাটাকুটি খেলায় নিবিষ্টচিত্তে মগ্ন হয়।
কেবল জানতেও পারে না কী কৌশলে মাত্র ২৬ বছরের ব্যবধানে 'পরম মান্য' মনুকে কলমের এক খোঁচায় নাকচ করে দিয়ে, পরাশরকে কলিযুগ-এর গুরুঠাকুর 'বানিয়ে' ফেলা হয়।
দুঃখ হয়, যখন দেখতে পাই ওয়াজেদ আলি শাহকে গদিচ্যুত করার বিষয়ে উদাসীন থেকে 'সঞ্জীবকুমার' আর 'সৈয়দ জাফরি'-রা বনাম নামক কাটাকুটি খেলায় নিবিষ্টচিত্তে মগ্ন হয়ে পোবোন্দো রচনা করেন এই ২০২০তেও।
হায় লাঠি উপনিবেশ তোমার দিন গিয়াছে যায় নাই
"করোনার সময় গান্ধী থাকলে কি করতেন এনিয়ে ল্যান্সেটে একটা ভালো লেখা বেরিয়েছে"
ডাঃ অভয় বাংগ এর লেখা। এখন ওঁর বক্তৃতা চলছে, আইসিএমআর এর গান্ধীজয়ন্তী উদযাপন অনুষ্ঠানে। গান্ধী এবং স্বাস্থ্য নিয়ে। সেটাই বিষয় হলেও, শুধু স্বাস্থ্য নিয়ে বলছেন না। এই কোভিড সময়ে গান্ধী থাকলে সার্বিকভাবেকী করতেন, সেই নিয়েই বলছেন।
বললেন, সবার আগে কোভিড নিয়ে ভয়, প্যানিক তাড়াতেন। ডেথ রেট অনেক কম, বয়স্ক, কোমর্ডিটি ছাড়া তেমন দুশ্চিন্তা করতে বারণ করতেন।
নিজেই অসুস্থের সেবার জন্য এগিয়ে যেতেন।দেশের প্রান্ত থেকে প্রান্তে। বিবিধ ব্যবস্থা নিতেন, নিজের হাতে।
'ন্যাচারাল পাওয়ার অব হিলিং ' এ জোর দিতেন। এই অগস্টের সেরোসারভেলেন্স দেখিয়ে দিয়েছে কতটা ছড়িয়েছে, যারা অসুস্থই হন নি বা নিজেরাই সুস্থ হয়ে উঠেছেন। কীভাবে বেশিরভাগ মানুষ সেটা
ভেন্টিলেটরের থেকে বেশি ভাল ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থা করতেন। ভাল হাইজিন, স্যানিটেশনের উপর বেশি জোর দিতেন, প্রচুর দামি হাস্পাতাল কেন্দ্রিক মডেল থেকে বেরিয়ে।
সেই স্বাস্থ্য মডেলকে প্রোজেক্ট করতেন, যা গ্রাম কেন্দ্রিক, খুব লো কস্ট, শুধু কোভিড না, অন্য রোগের জন্যেও, যা এখন কোভিডের কারণে অবহেলিত।
'আরোগ্য স্বরাজ' আনতেন।
মাইগ্রান্ট শ্রমিকদের এরকম দুরবস্থা হতে দিতেন না। গান্ধী নিজে গিয়ে গিয়ে এঁদের সবার সেবাশুশ্রূষা যত্ন আত্তি করতেন। খাবার, জল, ওষুধ দেওয়া ছাড়াও আশা দিতেন।
হয়তো মাইগ্রান্টদের সংগে নিজেই হাঁটতেন দিনের পর দিন। হয়তো এটাই হত ঐতিহাসিক দ্বিতীয় ডান্ডি মার্চ।
সব ধর্ম বর্ণের মধ্যে এরকম বিভেদ ঘটাতে দিতেন না। এই তবলিগি ইস্যুতে সাম্প্রদায়িক বিষ ছড়াতে দিতেন না।
তথাকথিত অচ্ছুত, ট্রাইবাল, মুস্লিম, ক্রিশ্চান সবার মধ্যে যেতেন, অবিশ্বাস দূর করার চেষ্টা করতেন।
পথে পথে ঘুরতেন।
প্রতিবেশীদের মধ্যেও এই কোভিডের কারণে যে অবিশ্বাস, অসহযোগিতার পরিবেশ তৈরি হল, হতে দিতেন না।
কোভিড কন্ট্রোল নিয়ে যা যা ভুল হত, স্বীকার করতেন। সবার সামনে। চৌরিচৌরার মতন।
বলতেন, কোভিড নিয়েই থাকতে হবে, বেশিরভাগই আসিম্পটোমেটিক, এটা আগে বলা হয়নি, সেই ভুল স্বীকার করতেন।
লোকাল ইকনমি, লোকাল কন্সাম্পশন, লোকাল সম্পর্কে জোর দিতেন। ওয়াশিংটন, বেজিং, দিল্লির আওতার বাইরে। লোকালাইজড লাভিং কেয়ারিং ইকনমি। গ্রামীণ স্বরাজ।
কন্সাম্পশন কমাতে বলতেন। নিড আর গ্রিডের মধ্যে পার্থক্য করতে বলতেন। ওয়ার্ল্ড নিড পূরণের জন্য যথেষ্ট, গ্রিডের জন্য নয়, এই মেসেজ আবার দিতেন।
গ্লোবাল ওয়ার্মিংং ও এর সংগেই জড়িত, বোঝাতেন।
এই প্যানডেমিকের মত পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার পিছনে এই গ্রিডের ভূমিকা বোঝাতেন।
স্বরাজ ইজ নট রুল অফ দ্য সেল্ফ বাট রুল অন দ্য সেল্ফ।
এইসব।
বেশ ইন্টারেস্টিংলি, গান্ধী নিয়ে বিশাল সেলিব্রেশন চলল এক দু' বছর ধরে। প্রচুর পাব্লিকেশন, অনুষ্ঠান।