ঘটনার আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে শীতলকুচিকে বানিয়ে তোলা হল শত্রুর মুখ। হাততালির শব্দ শোনা যাচ্ছে। হিন্দুত্ববাদীদের সভায়, উল্লাসে ফেটে পড়ছে জনতা।
২০১৯-এর লোকসভা ভোটের সময় হিন্দুত্ববাদীদের হাতে একটা পুলওয়ামা ছিল। একটা সার্জিক্যাল স্ট্রাইক ছিল। আসলে একটা পাকা-পোক্ত শত্রুর মুখ ছিল। যার নাম পাকিস্তান। ইতিহাসে এটা বার বার দেখা গিয়েছে, যাদের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের ভাগ বেশ খানিকটা কম, বা প্রায় শূন্যের কাছাকাছি, তাদের নির্বাচন জেতার জন্য, মানুষের ‘মন’ জয়ের জন্য, নিজরদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য, ক্রমাগত শত্রুর দরকার হয়ে পড়ে।
পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা ভোটে হিন্দুত্ববাদীরা শত্রু হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করেছিল প্রথমে অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়কে। তাতে খুব একটা সুবিধা না হওয়ায় শুভেন্দু অধিকারীকে দিয়ে মমতার নামের পাশে একটা বেগম শব্দ বসিয়ে ‘বেগমমমতা’ হয়ে উঠেছিল তাদের অন্যতম শত্রু-মুখ। যার সঙ্গে মাঝে মাঝেই হালকা করে পাকিস্তান, বাংলাদেশকেও জুড়ে দেওয়া হচ্ছিল।
বিজেপি নির্বাচনে হারলে পাকিস্তানে বাজি ফাটানো হবে, এই কথা আমরা বিভিন্ন রাজ্য বিধানসভা ভোটের প্রচারে বিজেপির প্রথম সারির নেতাদের বার বার বলতে শুনি। তারা ছাড়া বাকিরা সবাই পাকিস্তান আর চিনের এজেন্ট, এই প্রচার হিন্দুত্ববাহিনী নিরলস ভাবে করে চলেছে বহু দিন ধরে। তাদের এই প্রচারকে প্রতিহত করার ক্ষমতা যে ক’জন বিরোধী নেতা-নেত্রী কিছুটা হলেও রাখেন, সেই তালিকায় অবশ্যই প্রথম সারিতে মমতার নাম আছে। আঞ্চলিক দল হিসেবে বিভিন্ন রাজনৈতিক সমীকরণে এবং তাঁর নিজের বেশ কিছু ভুল সিদ্ধান্তের জন্য, মমতার অনেক রকম ‘অসুবিধা’ এবং পিছুটানের কথা আমরা জানি। সেই দোষ থেকে অবশ্য কোনও রাজনৈতিক দলই মুক্ত নয়। আর্থিক দুর্নীতির অভিযোগ বামপন্থীদের বাদ দিলে দেশের সব রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধেই আছে। পিএম কেয়ার্স ফান্ডে কোন কোন কর্পোরেট কত কোটি টাকা দিয়েছে সেই তালিকা প্রকাশ করতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর এত ভয় কেন? ইলেক্টোরাল বন্ডের মাধ্যমে বিজেপি কোন কোন ব্যবসায়ীর থেকে কত টাকা পেয়েছে , বিদেশ থেকে কোনও টাকা এসেছে কি না, তার উত্তর দিতে নরেন্দ্র মোদীদের এত অসুবিধা কেন? এর জবাব না দিয়ে ক্রমাগত আদালতের রায়ের পিছনে লুকোতে হচ্ছে বিজেপিকে। প্রশ্ন উঠেছে, যে ব্যবসায়ীরা টাকা দিচ্ছেন তার বিনিময়ে তারা কোনও সুবিধা পেয়েছেন কি না? এই সব প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বিজেপি ক্রমাগত আদালতের রায়কে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। সন্দেহ নেই, আর্থিক লেনদেনের অস্বচ্ছতার প্রশ্নে দেশের এক নম্বর দল এখন বিজেপি। তিনশোর বেশি আসন নিয়ে ক্ষমতায় থাকার সুবাদে এবং বিরোধীরা টুকরো টুকরো এবং দুর্বল হওয়ায়, তারা একটা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে। তারা জবাব এড়িয়ে যেতে পারছে। তবুও মানতে হবে, গত ৬-৭ বছরে বিজেপির বিরুদ্ধে যত কঠোর সমালোচনা বিরোধী অবস্থানে থাকা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীরা করেছেন, এবং বিজেপিও যাকে সব থেকে বেশি আক্রমণ করেছে এই সময়ে, এই নিয়ে কোনও তালিকা তৈরি হলে মমতার নামই শীর্ষে থাকবে। মমতাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে মরিয়া চেষ্টার সেটাও একটা কারণ।
হিন্দুত্ববাদীরা পশ্চিমবঙ্গে চতুর্থদফা ভোটের পর তাদের শত্রুর মুখ বদলে দিলেন। এখন তাদের শত্রু-মুখ হল শীতলকুচি। নন্দীগ্রামেও শুভেন্দু আধিকারীকে, সংখ্যালঘু ভোটারদের উদ্দেশ্য করে ‘পাকিস্তান’ শব্দ ব্যবহার করতে দেখা গিয়েছিল, তাঁর মুখে শোনা গিয়েছিল মমতাবেগম শব্দ। বিষাক্ত বক্তৃতায় তিনি দিলীপ ঘোষকে সম্ভবত ছাড়িয়ে গিয়েছেন। শুভেন্দুকে ফের শোনা গেল বলছেন, তিলক কেটে, তুলসীপাতা মুখে দিয়ে বুথে যান। আপাত ভাবে খুবই নির্দোষ কথা। কিন্তু তাঁর অন্য সব বিষ-বক্তৃতার সঙ্গে এটা মিলিয়ে দেখুন, তিনি আসলে দুই ধর্মের মানুষকে আলাদা করে চিহ্নিত করে দিতে চাইছেন। দেখা গেল তিনি বলছেন, শীতলকুচির নিহতেরা ‘দুধেল গাই’।
নন্দীগ্রামে হেরে গেলে শুভেন্দুর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ প্রশ্নের মুখে পড়ে যাবে, সম্ভবত সেই ভয় থেকেই প্রকাশ তাঁর এই মরিয়া ভাব এবং এত নিম্ন মানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি। রাহুল সিনহাকে দেখা গেল আক্ষেপ করছেন শীতলকুচিতে কেন মৃতের সংখ্যা এত কম তাই নিয়ে। ইঙ্গিত খুব স্পষ্ট, সংখ্যালঘু মানুষের আরও মৃত্যু কামনা। সায়ন্তন বসুকে দেখা গেল বলছেন, একজনকে মারলে চার জনকে মারব।
নিরস্ত্র জনতার উপর গুলি চালানো এবং হত্যার পর দেশের সর্ব বৃহৎ রাজনৈতিক দলের নেতাদের এই সব মন্তব্য, প্রধানমন্ত্রীর তা নিয়ে নীরব থাকা, একটাই কথা বলে। সেটা হল, ঘৃণা এখন ভারতে শাসকের রাজনীতির সব থেকে জরুরি উপাদান। এর সঙ্গে মিলিয়ে নিন আরও কয়েকটি তথ্য। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন আন্দোলনকারীদের পোশাক দেখে চিনতে। মোদী মন্ত্রিসভার এক সদস্যকে শাহিনবাগকে উদ্দেশ্য করে জনতাকে দিয়ে বলাতে দেখা গিয়েছিল, ‘গোলি মারো সালোকো’। মোদী মন্ত্রিসভারই আরেক মন্ত্রীকে দেখা গিয়েছিল আখলাখ খুনে গ্রেফতার হওয়া এক অভিযুক্তের স্বাভাবিক মৃত্যুর পর, সেই শবযাত্রায় উপস্থিত থাকতে, যেখানে হত্যায় অভিযুক্তের ওই মৃতদেহ জাতীয় পতাকায় ঢেকে দেওয়া হয়েছিল। সেই কেন্দ্রীয় মন্ত্রীর টুইটে তাকে বলা হয়েছিল ‘শহিদ’। এই সব কিছু একই সুতোয় বাঁধা। আর এই মুহূর্তে তারা সবাই সক্রিয় শীতলকুচিতে।
শুভেন্দু অধিকারী-সহ বিজেপি নেতারা যে এই সব বলছেন তার প্রতিক্রিয়া কী হচ্ছে? এমন তো নয় যে নেতারা এই সব কথা বলছেন , আর মানুষ চুপ করে আছে। নেতাদের এই সব কথায় হাততালিতে ফেটে পড়ছে চারপাশ। ময়দান।
গোরিলা, শিম্পাঞ্জি, ওরাংওটাংরাও হাততালি দেয়, বুক চাপড়ায় আনন্দ হলে, বা দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য। মানুষের হাততালির আদিম যোগসূত্র হয়তো সেটাই। শীতলকুচিতে কেন্দ্রীয় বাহিনীর গুলিতে চার যুবকের মৃত্যুতে এই যে নেতা-সহ হাজার হাজার হিন্দুত্ববাদের সমর্থক জনতার হাততালি, এই উল্লাস আমাদের কোন পথ দেখাচ্ছে? মনে হচ্ছে, বাংলা যেন তার সব বৈশিষ্ট্য খুইয়ে ফেলছে। মৃত্যু হচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের। জন্ম নিচ্ছে পশ্চিমবংগাল। গোবলয়ের ঢেউয়ে ভাসছে বাংলার পট, বাঁকুড়ার ঘোড়া, ভাটিয়ালি গান, লালনের সুর।
ইসি মানে শুধু ইলেকশন কমিশন নয়, এক্সট্রিম কম্প্রোমাইজও।
হনুমানরাজ নিপাত যাক