বঙ্গ রাজনীতির ভোট রঙ্গে বাম-কং জোটে আব্বাস সিদ্দিকির আগমন অথবা 'অনুপ্রবেশ' নিয়ে চর্চা যখন তুঙ্গে, তখন স্বাভাবিকভাবেই অন্য এক ‘সংখ্যালঘু’ নেতার প্রসঙ্গ এসে পড়ে। যদিও তাঁর উত্থানের পরিপ্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। দেড় দশক আগে গড়পড়তা বাঙালি হিন্দুর মাওলানা সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সম্পর্কে কোনো ধারণাই ছিল না। ২০০৭ সালে নন্দীগ্রামে ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, সেটিই সিদ্দিকুল্লা চৌধুরীকে ভদ্রলোক বাঙালি হিন্দু তথা ভারতবর্ষের কাছে পরিচিত করে। আমার সঙ্গে তাঁর প্রথম যোগাযোগ হয় জমিয়তের একটি সভায়। তদানীন্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের একটি উক্তির তীব্র বিরোধিতা করে জনাব চৌধুরী তখন খবরের কাগজের প্রথম পাতায়। নিছক কৌতূহলে বীরভূমের পাঁড়ুইতে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের জনসভায় গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি চারিদিকে পুলিশ আর সভা জুড়ে কেবলই পুরুষ। মঞ্চেও তাই। সেখানে উপস্থিত পরিচিত এক বামপন্থী আমাকে মঞ্চে বক্তব্য রাখতে বলেন। মঞ্চের উপর যাঁরা বসে ছিলেন তাঁদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ছিল ছুঁৎমার্গ আক্রান্ত – নারীদের প্রকাশ্য সভায় আসতে দিতে তাঁদের যুগ যুগ লালিত আপত্তি। কিন্তু সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে বলেন যে উনি অবশ্যই বলবেন। সেই থেকে যোগাযোগ।
নন্দীগ্রামে বামেদের বিরুদ্ধে সম্পূর্ণ অবামোচিত ক্রিয়াকলাপ অর্থাৎ কর্পোরেট পুঁজির জন্য জমি অধিগ্রহণের অভিযোগে জর্জরিত বামফ্রন্টের উচ্চবর্ণীয় হিন্দু নেতৃত্ব তার আসল চেহারা তখন দেখিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বলেই ফেলেন যে খারিজী মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরি হচ্ছে। মুসলমান মানেই দেশদ্রোহী এবং জঙ্গি। টুপি-দাড়ি-সন্ত্রাসবাদী – সরল সমীকরণের বিরুদ্ধে সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী এবং জমিয়তের তীব্র প্রতিবাদ বাঙালি মুসলমানের পরিচিতির সংকটকে সকলের সামনে তুলে আনে। যাঁদের অবস্থান ছিল শুধুই প্রান্তে, যাঁদের একমাত্র পরিচিতি ছিল ভোট ব্যাংক তাঁদের অবস্থা ও অবস্থান নিয়ে সাচার কমিটি ২০০৬ সালে অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। উল্লেখ থাকা দরকার যে, অন্যান্য অনেক রাজ্য সরকারের মতোই তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারও সাচার কমিটিকে তথ্য দেওয়ার ব্যাপারে অসহযোগিতা করে। তা সত্ত্বেও সীমিত তথ্যের ভিত্তিতেই এ রাজ্যের মুসলমানদের যে ছবিটা উঠে আসে তা তাঁদের আর্থ-সামাজিক বঞ্চনাকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে তুলে ধরে। সমাজে, বিশেষত, মুসলমানদের মধ্যে এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। সাচার রিপোর্টকে বাংলাভাষী জনসাধারণের কাছে পৌঁছে দেবার ব্যাপারে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন বিশিষ্ট বামপন্থী সংগঠক সন্তোষ রাণা। তিনি বাংলা ভাষায় এই রিপোর্টের একটি অসামান্য সংক্ষিপ্তসার লিখে দেন, যা পুস্তিকা আকারে প্রকাশিত হয়। পুস্তিকাটি বিশেষত সাচার রিপোর্ট এবং সাধারণভাবে মুসলমানদের বঞ্চনার বিভিন্ন যোগগুলো নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও তর্ক-বিতর্ক সংগঠিত করার জন্য খুবই কাজে লাগে। জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ছিল এই গণ-আলোচনার অন্যতম সংগঠক।
জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ভারতে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের লক্ষ্যে, সেই ১৯১৯ সালে। জাতীয়তাবাদী এবং বরাবর দেশভাগের বিরুদ্ধে থাকা এই গুরুত্বপূর্ণ সংগঠনের কথা দুর্ভাগ্যজনকভাবে বাঙালির ইতিহাসে উল্লেখিত না হওয়ায় বেশিরভাগ বাঙালি তাঁদের অবদানের কথা জানেন না। যদিও পশ্চিমবঙ্গে জমিয়তের লক্ষাধিক সদস্য এবং কয়েকশ মাদ্রাসা আছে। বহু হিন্দু বাঙালি জমিয়াতের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামিকে গুলিয়ে ফেলেন। ধরে নেন এটি বাংলাদেশে অবস্থিত কোনো সংগঠনের শাখা। বিড়ম্বনার কথা এই যে, বাঙালি মধ্যবিত্ত সমাজে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে রামকৃষ্ণ মিশন সেক্যুলার বুদ্ধিজীবীদের কাছে সমাজ সংস্কারক ও শিক্ষা প্রসারের মর্যাদা পেয়ে থাকেন, কিন্তু, সেই সমাজে একই রকম কাজে যুক্ত থাকা জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ সাম্প্রদায়িক হিসাবে চিহ্নিত হয়ে যায়। আমাদের দুর্ভাগ্য ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে জমিয়তের ভূমিকা নিয়ে পাঠ্যপুস্তকে একটি লাইনও খরচ করা হয়নি।
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী কয়েক দশক ধরে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের পশ্চিমবঙ্গ শাখার সাধারণ সম্পাদক। জমিয়তের কাজের সঙ্গে সঙ্গে নির্বাচনী রাজনীতির কর্মকাণ্ডেও তিনি আছেন। জাতীয় কংগ্রেসের তরফে কাটোয়া লোকসভায় তিনি একাধিকবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। তবু কেবলমাত্র একজন ধর্মীয় নেতা হিসাবেই তাঁর পরিচয় সীমাবদ্ধ ছিল, ভোটের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন প্রায় বিস্মৃত। প্রথমে ভাঙড়ে জমির আন্দোলন, এবং তার পরে নন্দীগ্রাম আন্দোলনই তাঁকে সর্বসাধারণের কাছে পরিচিত করে। তাঁকে স্রেফ মুসলমান দাড়ি টুপি ওয়ালা মৌলবাদী হিসাবে দাগিয়ে দেওয়ার যে চেষ্টা শাসক গোষ্ঠী করে তাতে হিতে বিপরীত হয়। নন্দীগ্রাম আন্দোলন ধর্মীয় আন্দোলন ছিল না। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে একদা জমিয়তের যে ঐতিহাসিক ভূমিকা ছিল প্রায় সেই আদলেই তার পুনরাবৃত্তি ঘটল নন্দীগ্রামে। সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী ও সন্তোষ রাণার মতো বামপন্থীদের নেতৃত্বে গঠিত ভূমি উচ্ছেদ প্রতিরোধ কমিটির মধ্যে বিভিন্ন দলের বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন জাতের মানুষ ছিলেন। এছাড়া ইতিমধ্যেই তৈরী হয়ে গিয়েছিল গণ উন্নয়ন ও জন অধিকার সংগ্রাম সমিতি যার মধ্যে ছিল বহু ধরনের অধিকারের লড়াইয়ে যুক্ত সংগঠন।
ভূমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে ঘোষিত বামপন্থী দলের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলনে নামলেন একজন ধর্মীয় নেতা অবশ্যই সমাজের কাছে অন্যরকম বার্তা গেল। বাংলায় রাজনৈতিক ক্ষমতার লড়াই যখনই বিধানসভায় পৌঁচেছে তখনই সেখানে আসীন হয়েছেন উচ্চবর্ণীয় হিন্দুরা। সিদ্ধার্থ রায়, জ্যোতি বসু, বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য থেকে মমতা ব্যানার্জি কোথাও এর ব্যতিক্রম হয়নি। ধর্মীয় সংখ্যালঘুরা সব দলেই থেকেছেন শুধুমাত্র প্রতিনিধি হিসাবে, নির্ণায়ক ভূমিকায় তাঁদের কখনোই বিশেষ গুরুত্ব পেতে দেখা যায়নি। এ কথা দলিত বা জনজাতি গোষ্ঠীগুলোর ব্যাপারেও একই রকম।
ক্ষমতাসীন শাসক যখন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দকে সাম্প্রদায়িক প্রতিপন্ন করার উদ্যোগ নিল তখন স্পষ্ট ভাষায় সিদ্দিকুল্লা তার প্রতিবাদ করলেন। এই প্রথম মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের অবস্থান তৈরি করতে পারল। এর ফলে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে মুসলমানেরা সিদ্দিকুল্লার দলে ভিড় করলেন। বামফ্রন্টের একটি অংশ যারা ক্ষমতার বাইরে ছিলেন তাঁরা জমিয়তের সঙ্গে বিভিন্ন আন্দোলনে যুক্ত হলেন। ১৪ মার্চ ২০০৭, নন্দীগ্রাম গণহত্যার বিরুদ্ধে ধর্মতলার প্রতিবাদ সমাবেশে মাথায় কালো কাপড় বেঁধে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী প্রতিবাদে শামিল ছিলেন মহাশ্বেতা দেবী। সেজ আইনের বিরুদ্ধে, কেমিক্যাল হাব তৈরির বিরুদ্ধে, ভূমি উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সিদ্দিকুল্লাই তখন সবার আগে। গণ-উন্নয়ন ও জন-অধিকার সংগ্রাম সমিতির ঘোষণাপত্রে চোখ রাখলে সেটিকে একটি বামপন্থী দলের রচনা বলেই মনে হবে। সেখানে বিশ্বায়ন, উদারীকরণ, সিপিএমের দক্ষিণপন্থী অবস্থানের তীব্র সমালোচনা আছে। ২০০৫ সালে ভাঙড়ে রাজ্য সরকারের সালেম গোষ্ঠীর জন্য জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে এই সমিতি তৈরি হয়েছিল। নকশালপন্থীরা, দলিত আন্দোলনে যুক্তরা, মানবাধিকার সংগঠন এবং বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এখানে যুক্ত ছিলেন। ২০০৭ সালে সিদ্দিকুল্লাহ এবং সন্তোষ রাণাদের উদ্যোগে ডাকা সর্বভারতীয় সেজ-বিরোধী কনভেনশনে মেধা পাটেকর, জি.এন.সাইবাবা, দীপঙ্কর ভট্টাচার্য, অরুন্ধতী রায় প্রমুখ অনেকেই ছিলেন। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী এবং জমিয়তের সাথে বাংলার বহু সেক্যুলার গণসংগঠনের এই যোগাযোগ ছিল অভূতপূর্ব। সভাস্থলে মাওলানাদের পাশে দেখা গেল বহু বাঙালি হিন্দু বুদ্ধিজীবীকে।
পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুদের শিক্ষা স্বাস্থ্য কর্মসংস্থান প্রকৃতি বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রান্তিক অবস্থানে থাকতে হয়েছে তা নিয়ে সাচার কমিটির রিপোর্টে বিস্তারিত বলা হয়েছিল। এই নিয়ে রাজ্য সরকারের তরফে চাপান উতোর চলতে থাকে, কেননা দেখা গেল কংগ্রেস জমানার থেকেও খারাপ অবস্থা হয়েছে বামফ্রন্ট আমলে, কিন্তু এই দিকে দৃষ্টিপাত করা হয়নি। সাম্প্রদায়িক আক্রমণ থেকে তাঁরা রক্ষা পেয়ে এসেছেন,ঠিকই, কিন্তু শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মনিয়োজন – কোনোদিক দিয়েই মুসলমানদের সক্ষমতা গড়ে তোলার ব্যবস্থা হয়নি। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে সাচার কমিটির রিপোর্ট ও রঙ্গনাথ মিশ্র কমিশনের সুপারিশ কার্যকরী করার জন্য বিশাল আন্দোলন হয়েছিল। এর আগে মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক বঞ্চনার কথাটি এত জোরে কেউ বলেননি, অন্তত সংখ্যালঘুদের মধ্য থেকে এমন রাজনৈতিকভাবে দাবি ওঠে নি। এই সমস্ত মিলে বামফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যায়। সিদ্দিকুল্লাহ ইসলাম ধর্মে বিশ্বাসী বিভিন্ন গোষ্ঠীগুলিকেও একত্রিত করতে পেরেছিলেন। কিন্তু নন্দীগ্রাম আন্দোলন জটিল থেকে জটিলতর হতে থাকলে এবং প্রতিরোধ সংঘর্ষে পরিণত হলে আন্দোলনের লাগাম তৃণমূলের হাতে চলে যেতে থাকে। যাদের মাদ্রাসায় জঙ্গি তৈরি হয় বলে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য দাবি করেছিলেন, সিপিএম-তৃণমূলের অস্ত্রের লড়াই শুরু হয়ে যাওয়ায় তাঁরা সরে আসেন। গোটা পশ্চিমবঙ্গের খারিজী মাদ্রাসাগুলির কোনোটাতে কখনো অস্ত্রের কারবার চলে না এ কথাটা জোর দিয়ে বলতে এখনও অনেকের দ্বিধা আছে – সন্তোষ রাণার মতো বামপন্থীরা ছিলেন ব্যতিক্রম। তিন দশকেরও বেশি বামপন্থী শাসন এই ভ্রান্তি নিয়ে ভাবেনি। এমনকি, মুসলমানদের আর্থ-সামাজিক অবস্থা নিয়ে একেবারে গণ-উদ্যোগে, এবং বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি মেনে সমীক্ষা করে তুলে আনা “লিভিং ওয়ার্ল্ড অব দ্য মুসলিমস অব ওয়েস্ট বেঙ্গল” – এর মতো প্রামাণ্য রিপোর্ট, শঙ্খ ঘোষ ও অমর্ত্য সেনের হাত দিয়ে প্রকাশিত হবার পরও এ নিয়ে দপ্তরী বামপন্থীরা মাথা ঘামাতে আগ্রহী হননি। দশ বছর ক্ষমতার বাইরে থেকে এবার হয়তো তাঁরা অন্যরকম ভাবছেন।
২০০৬ সালে পিপলস ডেমোক্রেটিক কনফারেন্স অফ ইন্ডিয়া (পিডিসিআই) নামের রাজনৈতিক দল তৈরি হয়। এর সভাপতি হন সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী, সঙ্গে ছিলেন সরদার আমজাদ আলি, পশুপতি মাহাতো, অশোক নস্কর, সুভাষ মণ্ডল প্রমুখ। মুসলমান, দলিত, জনজাতি এই সমস্ত গোষ্ঠীর মিলিত ক্ষমতায়নের ভাবনা ছিল এখানে। নন্দীগ্রাম আন্দোলনের পরবর্তী পর্যায়ে পি.ডি.সি.আই দ্রুত জনসমর্থন লাভ করে। ইতিমধ্যে বাংলা জুড়ে রেশন আন্দোলন ঘটে গেছে। প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা বলে, বহু জায়গাতেই কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দলের উদ্যোগ ছাড়াই মানুষ এই আন্দোলন করেছেন। পরে সেখানে দল পৌঁছেছে। এর প্রতিফলন ঘটে ২০০৮ এর পঞ্চায়েত নির্বাচনে। বাম জমানার পতন সূচিত হয়। পঞ্চায়েত স্তরে একদিকে বাম, অন্যদিকে সবাই, কোথাও কোথাও বামের শরিকেরাও সিপিএমের বিরুদ্ধে। এই পুরো সময়ে জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের ভূমিকা অসামান্য। প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসা শিক্ষক যেভাবে দলিত ও আদিবাসীদের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের ঐক্য সাধন করেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শব্দগুলি ফিকে হয়ে যায়। বীরভূম জেলায় একটি পঞ্চায়েতে পিডিসিআই-র সমস্ত প্রার্থী জয়যুক্ত হন –প্রধান নির্বাচিত হন একজন আদিবাসী, দুই সদস্য তফশিলি জাতির পাশাপাশি ব্রাহ্মণ প্রার্থীও ছিলেন। সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়, কিন্তু সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে শেষ পর্যন্ত লাভ হয় তৃণমূলের।
সে ইতিহাস সবাই জানেন। ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পিডিসিআই লড়ে অসমের প্রধান বিরোধী দল অল ইন্ডিয়া ইউনাইটেড ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এআইইউডিএফ)-এর সমর্থনে। এই দলটির মূলেও জমিয়ত। উত্তরকালে পিডিসিআই এআইইউডিএফ-এর সঙ্গে মিশে যায়। সিদ্দিকুল্লাহ বাংলার দায়িত্বে থাকেন। ২০১১ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনে সিদ্দিকুল্লাহ এআইইউডিএফ-এর প্রার্থী হিসেবেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। বামফ্রন্টের পাশাপাশি তৃণমূলের বিরোধিতাও ছিল। তৃণমূল সংখ্যালঘু, দলিত ও জনজাতি গোষ্ঠীর বিপুল ভোট পেয়ে ক্ষমতায় আসে। পরবর্তী পাঁচ বছরে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য যে ঘটনায় সিদ্দিকুল্লাহ আবার সামনে আসেন সেটি খাগড়াগড় কাণ্ড যেখানে একটি বিস্ফোরণের ঘটনায় খাগড়াগড় মাদ্রাসাকে অভিযুক্ত করা হয়। কোনো কোনো বাঙালি বুদ্ধিজীবী খাগড়াগড়ের প্রকৃত স্বরূপ উদ্ঘাটন করে লেখালেখি করলেও, মুসলমান মানেই জঙ্গি - এই গল্পের গরু আবার গাছে ওঠে। সে সময় আবার সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী এবং জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ পথে নামেন। বর্ধমান কার্জন গেট থেকে শুরু করে যে কোনো জনসভাতেই তখন বিপুল জনসমাগম। সম্ভবত এই সময়েই তৃণমূলের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক তৈরি হয়। ২০১৬ সালে মঙ্গলকোট থেকে তৃণমূলের প্রার্থী হয়ে জিতে মন্ত্রী হয়েছেন সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরী। কিন্তু বৃহত্তর মুসলমান সমাজে তাঁর জনপ্রিয়তা অনেকটাই নষ্ট হয়েছে। বাংলার পট পরিবর্তনে তাঁর যে ভূমিকা, যা তাঁকে এক বিশিষ্টতা এনে দেয়, সে সত্যটিকে তিনি নিজেই – যে পরিস্থিতির মধ্যেই হোক না কেন – অনেকখানি গুলিয়ে দিলেন। তিনি যে বাস্তবকে তুলে ধরেন, তাকে পুঁজি করে তৃণমূল ক্ষমতাসীন হল, আর সিদ্দিকুল্লা দলের এককোণে দাঁড়িয়ে থেকে সেই দলের এক ক্ষুদ্র প্রতিনিধি হয়ে রইলেন – যেমনটি বহু কাল ধরে ডান বাম সব দলেই সংখ্যলঘুদের হয়ে এসেছে।
সিদ্দিকুল্লাহ চৌধুরীর সঙ্গে যাঁরা এসেছিলেন তাঁদের অনেকে তাঁর সঙ্গে গেছেন, কিন্তু অনেকেই রয়ে গেছেন। আজ যে সাম্প্রদায়িকতা দেশের সংবিধানকেও বিপন্ন করে তুলছে, যে বিদ্বেষের বিষ বাঙালীর ঐতিহ্যকে ধূলায় মেশালো, সিদ্দিকুল্লাহ সেখানে বিরাট ভূমিকা নিতে পারতেন। কিন্তু ক্ষমতার অলিন্দের ছোটবড় স্বার্থের সঙ্গে পাল্লা দিতে গিয়ে বৃহত্তর ক্ষেত্রে তিনি প্রায় অপ্রাসঙ্গিক হয়ে গেছেন। মুসলমান নেতৃত্বে আপামর বাঙালি আসবে না, এই উপলব্ধিই হয়ত তাঁকে নিজের দল ছাড়তে প্ররোচিত করে। অথবা, দীর্ঘ লড়াইর ক্লান্তি তাঁর সংগ্রামী সত্তাকে গ্রাস করে।
তা বলে লড়াই থেমে থাকবে না। নাগরিকের মর্যাদা ও সমানাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য পশ্চিমবাংলার মুসলমান যে সামাজিক ন্যায়ের দাবিটাকে উর্ধ্বে তুলে ধরতে পেরেছেন তার মূলে অনেকটা অবদান রেখেছেন চৌধুরী সাহেব। মুসলমানরা যে কোনো সংকীর্ণ গোষ্ঠী-কেন্দ্রিক রাজনীতির ফাঁদে পা না দিয়ে একদিকে নিজেদের মতো করে শিক্ষা-স্বাস্থ্য-কর্মনিয়োজনের মতো বিষয়গুলিকে সামাজিক উদ্যোগের আওতায় নিয়ে এসেছেন, আবার অন্যদিকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে চলেছেন রাজনৈতিক-সামাজিক ন্যায্যতার জন্য – সে ব্যাপারেও সিদ্দিকুল্লার ভূমিকা অস্বীকার যাবে না। আবার ঠিক একই কারণে, তিনি যখন এই বৃহত্তর ক্ষেত্রটা ছেড়ে দিয়ে শাসকদলের ক্ষুদ্র প্রকোষ্ঠে জায়গা করে নিলেন – তখন মুসলমান জনসাধারণ সেই স্থানটাকে শূন্য পড়ে থাকতে দেবেন না। নিজেদের তাগিদে এবং উদ্যোগে তাঁরা নিজেদের নেতা তুলে আনবেন – যে নেতা হবেন একই সঙ্গে মুসলমানের প্রতিনিধি, আবার সারা বাংলার নেতা। সিদ্দিকুল্লার রাজনৈতিক কণ্ঠক্ষেপ ও নীরবতা, তাঁর বিশিষ্ট হয়ে ওঠা ও সাধারণে পরিবর্তিত হয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়া থেকে মুসলমানরা শিখেছেন, শিখছেন। তাই বোধ হয় একক কোনো নেতৃত্ব নয়, তাঁদের মধ্যে থেকে উঠে আসছে সামূহিক নেতৃত্বের একটা সংকেত। আব্বাস সিদ্দিকী নিজেকে কতখানি এই প্রক্রিয়ার ফল হিসেবে দেখতে পারেন তার ওপর নির্ভর করবে তিনি কতখানি ‘রাজনৈতিক’ থাকবেন।
দারুণ লেখা।
একটা কথা। ওনার সম্বন্ধে কিছুই জানতাম না।
কিন্তু তসলিমাকে কোলকাতা থেকে তাড়ানোর ব্যাপারে সিদ্দিকুল্লা সাহেবের ভূমিকা নিয়ে লেখিকা কিছু বলবেন?
এই ধরণের সমৃদ্ধ মাটিস্পর্শ অনুভুতি তাঁর পক্ষেই লেখা সম্ভব যিনি অন্তত নিজের রঙিন চশমার রঙে না-রাঙিয়ে কিংবা নিজেদের সংস্কারের ফিনাইলে না-চুবিয়ে তথাকথিত অসংস্কৃত-অশিক্ষিত মুসলমানদের হৃদয় দিয়ে অনুভব করেন। এরকম মূল্যায়ন প্রতিবেশী সমাজের অগ্রণীদের কলমে কোনওদিন চোখে পড়েনি। লেখিকা এবং গুরুচণ্ডা৯ উভয়ের প্রতি ভালোবাসা অবিরাম।
এই লেখাটা সত্যি খুবই ভাল। কোনো বিষয়ে প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা থাকা আর না থাকার তফাৎ যে দেখার দৃষ্টিভঙ্গিকে কতটা আলাদা করে দেয়, এই লেখাটা পড়লে বোঝা যায়। আমার নিজেরই এই বিষয়টা নিয়ে অন্যরকম ধারণা ছিল। আমি প্রভাবিত হলাম। এটাই লেখাটার স্ট্রেংথ।
বেশ কিছু বিষয়ে একেবারেই সম্পূর্ণ দ্বিমত হলেও অপ এড রাইটার মনীষা বন্দ্যোপাধ্যায় সবসময়ে ই অনন্য। আমার সমসাময়িক বা অনুজপ্রতিম দের মধ্যে শান্তিনিকেতনের যাঁরা নিজ নিজ ক্ষেত্রে বিশিষ্ট তাঁদের মধ্যে অহনা , মনীষা , আর বিদিশা তাঁদের সম্পূর্ণ ভিন্ন সেনসিবিলিটি নিয়েই লেখা, জীবনচর্যা , কাজের জগত সবেতেই খুবই উজ্জ্বল। ভাই কিছু কেউ মনে করবেন না কেউ আমাদের ওদিককার লোক ভালো কিছু করলে একটু বেশি ভালো লাগে। :---)))) নো এনারসি ডেমোর দিন একটা টেম্পোর উপর দাঁড়িয়ে মনীষার বক্তৃতা মনে রাখার মত ছিল, ঐ নিউ মার্কেটে র ওখানটায়।
এক্স টেম্পোর বক্তৃতা?
সিদ্দিকুল্লাহ-র লেখা আজ বেরিয়েছে বর্তমানে-- https://bartamanpatrika.com/home?cid=13&id=285674
তথ্য ভিত্তিক এই প্রতিবেদন লেখা ও প্রকাশ করার জন্য ধন্যবাদ আপনাকে।কমঃ সন্তোষ রানা সম্পর্কে আমার অনেক কিছুই জানা আছে।
এমনকি উনার সাথে আমার ব্যক্তিগত পরিচয়
ছিল।তবে সিদ্দিকুল্লা চৌধুরী সম্পর্কে কিছু জানতাম, কিন্তু এতটা জানতাম না। অজানা তথ্য জানতে সাহায্য করার জন্য লেখককে আবার ও ধন্যবাদ ।
একদিকে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বলব, আবার ধর্মীয় গোষ্ঠীর প্রতিনিধিত্ব চাইব, এটা স্রেফ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছু নয়। আন্দোলন হবে সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধে, অশিক্ষার বিরুদ্ধে। ধর্মীয় পরিচিতি নিয়ে নয়। সিদিকুল্লা, সিদ্দিকী এদের গুরুত্ব দিলে অন্য সাম্প্রদায়িক দল এর সুযোগ পুরোমাত্রায় নিতে থাকবে।
"প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে মাদ্রাসা শিক্ষক যেভাবে দলিত ও আদিবাসীদের সঙ্গে সংখ্যালঘুদের ঐক্য সাধন করেন, তা সত্যিই বিস্ময়কর। সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী শব্দগুলি ফিকে হয়ে যায়। "
সিদ্দিকুল্লাহ সাম্প্রদায়িক নন, জেহাদি নন মানলাম। কিন্তু মাদ্রাসা শিক্ষার নামে তিনি যে আসমানী শিক্ষার অবিজ্ঞানের চাষাবাদ করেন, সেখানে দিনের পর দিন নিজ ধর্মের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠায় পৌত্তলিক ধর্মগুলোর প্রতি প্রচণ্ড হিংসা, বিদ্বেষ ও বিষোদগার প্রচার করা হয়। নাস্তিক, কাফের, ইহুদি, নাসারাদের কতল করার শিক্ষা দেওয়া হয়।
তাই দিনের শেষে সিদ্দিকুল্লাহ কোং কুপমুণ্ডুকতায় পূর্ণ আধ্যাত্মিক নেতাই থাকেন, মানবিক মোড়কে মওলানা ভাসানী হয়ে ওঠেন না।
এ যেন মল পরিস্কার করতে মূত্রের ব্যবহার!
ভোটবাক্সে ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারে মখনের প্রলেপ বা নিখাদ সরলীকরণ আখেরে আত্মঘাতী হওয়ার সম্ভবনা বাড়ায়।
ভুলভাল বকে থাকলে সুধীজন শুধরে দেবেন। ধন্যবাদ
পুনশ্চঃ বর্তমানের লেখাটি পড়লাম, সায়নী- দেবলীনার পরে দিদি সংখ্যালঘু ভোট নিশ্চিতে আরেকজন দাঁড়ি-টুপির কাস্টিউম পরা অভিনেতাকে নিয়োগ করেছেন মনে হলো।
সামাজিক পরিষেবার প্রতিশ্রুতিগুলোর ভেতর সিদ্দিকুল্লাহর শ্মশান চুল্লী ও কবরস্থানের দেয়াল তোলার প্রতিশ্রুতিটিও লক্ষনীয়, নিছকই মোল্লার দৌড়। :))
"TMC MLA Siddiqullah Chowdhury describes SC verdict on instant triple talaq as ‘unconstitutional’"
"taslima nasreen@taslimanasreen. Aug 30, 2017
W.Bengal's Idris Ali & Siddiqullah Chowdhury r bigoted misogynists. They'r against democracy & human rights. But Didi has made them ministers!"
"during the trials of the Razakars — .....Chowdhury held meetings in support of the Razakars, and hailed them as “religious leaders”. After the country’s courts pronounced the Razakars guilty and awarded punishment, Chowdhury also labelled it a “conspiracy” on the part of the government.
"It is said that Franklin Delano Roosevelt defended the US tendency to support dictators by remarking, “He may be a son of a bitch, but he's our son of a bitch.”
(কোন তথ্যে ভুল থাকলে অগ্রিম ক্ষমা চেয়ে নিলাম)
এই খোপে আরেক ভাইজান আব্বাসের কিঞ্চিৎ কাহিনীও থাক :))
রামকৃষ্ণ মিশনের সাথে জামাতের তুলনা। বাঃ বাঃ। উত্তম ।