আব্বা ২১ অক্টোবর ২০২০ তারিখে চলে গেলেন। মহা প্রস্থান। আমরা এখন শুধু স্মৃতি ধরে নিয়ে বেঁচে থাকব। প্রায় চার বছর ধরে বিছানায় শুয়ে রয়েছিলেন। আমি অতন্দ্র প্রহরীর মত পাহারা দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। আমার পাহারা শেষ। আমি এখন মহা ছুটি পেয়ে গেলাম। কিন্তু আমি জানি আমাকে ঘড়ির কাটা মনে করাবে, আমাকে জ্বালাবে আমার কর্তব্যহীন সময়। ঠিক সকাল আটটায় চা, বিস্কিট। সাড়ে নয়টা থেকে দশটার ভিতরে সকালের নাস্তা, দুপুর বারোটায় আবার হালকা নাস্তা। দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে দুপুরের খাবার। বিকাল পাঁচটায় আবার চা, বিস্কিট। সন্ধ্যায় হালকা নাস্তা, রাত আটটায় রাতের খাবার। এই রুটিন এখন আমাকে প্রতিনিয়ত খোঁচাচ্ছে। সময় হলেই আমি এক অস্থিরতায় পরে যাচ্ছি।
২০১৭ সালের জানুয়ারির ২০ তারিখ আব্বা স্টোক করেন। দৌড়াদৌড়ি করে ময়মনসিংহে নিয়ে গেলাম। ডাক্তার নিশ্চিত করলেন যে আমাদের অনুমান সঠিক, আব্বার একটা স্টোক হয়েছে। বাম পাস অবশ হয়ে গেছে। একমাত্র উপায় ফিজিওথেরাপি। বাড়িতে আনা হল, শুরু হল চিকিৎসা। চিকিৎসা মানে থেরাপি দেওয়া। উন্নতি হচ্ছিল খুব সুন্দর করে। কিন্তু হয়েও হল না। ধুম করেই উল্টা মারা শুরু করল আব্বার শরীর। বয়স বড় বাধা হয়ে দাঁড়াল। বাম পাশে শক্তি আর ফিরে পেলেন না।
আমি ঢাকায় পোশাক রপ্তানির একটা বায়ং হাউজে চাকরি করতাম। আমার কাজ ছিল ইউকের বায়ারদের সাথে কথা বলে, অর্ডারটার খুঁটিনাটি জেনে নিয়ে পোশাক প্রস্তুত করে শিপে তুলে দেওয়া। পদের পোশাকি নাম মারচেন্ডাইজার। লোভনীয় চাকরি ছিল নিঃসন্দেহে। কিন্তু আমি চিন্তা করলাম ভিন্ন কিছু। আমি এক ঝটকায় সব ছেড়ে দিলাম। সোজা আব্বার পাশে। শুরু হল আমার সংগ্রাম। আমার মনে হয়েছে আমি লোক রেখে আমার মন মত সেবা আমার বাবাকে দিতে পারব না। আমার মনে হয়েছে এখন আমার বাবা উনার পাশে উনার কাছের একজনকে খুঁজবে। এখানে বলে রাখা ভাল যে আমার মা মারা গেছেন ২০১২ সালে। এবং তখন থেকেই আমি বুঝতেছিলাম যে আমাদের এই বিশাল ভাই বোনের পরিবারে আমি আর আমার বাবা এখন বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। দুইজনই ব্যাচেলর। সবাই যার যার সংসারের নানান সমস্যায় জর্জরিত। তাদের চিন্তার, তাদের কাজের সেন্টার অফ গ্রেভেটি পরিবর্তন হয়ে গেছে। তাদের বৃত্তের কেন্দ্র এখন আমার বাবা না। সন্তান, স্বামী তারপরে হয়ত শ্বশুরবাড়ি তারপরে আব্বা। কাজেই চাইলেও তারা পারবে না পুরোপুরি সময় দিতে। কাজেই এ কাজ যে আমার তা আমি পরিষ্কার বুঝতে পারেছিলাম।
কিন্তু একজন বয়স্ক মানুষের সেবা কীভাবে করে তা সম্পর্কে আমার বিন্দু মাত্র ধারনা ছিল না। ভয় পেতাম, রেগে উঠতাম, উনাকে কষ্ট দিতাম, আমি লেজেগোবরে মেখে যেতাম। ধীরে ধীরে আমি একটা আয়ত্তে নিয়ে আসলাম। এই ধীরে ধীরে যে আসলে কেমন তা এখন ভাবলে গা শিউরে উঠে আমার। আমি হচ্ছি বাড়ির ছোট ছেলে। আদর ছিল আমার অধিকার। কোনদিন রোগীর সেবা জাতীয় কোন কাজ আমি করে নাই। সেই আমি সব শিখে গেলাম। মাংস পেশিতে ইনজেকশন দেওয়া থেকে শুরু করে সাপজিটর দেওয়া, আব্বাকে বিছানা থেকে উঠিয়ে বাথরুমে নিয়ে গিয়ে বাথরুম করানো, তাঁকে পরিষ্কার করে আব্বার বিছানায় নিয়ে আসা, সব করতে থাকলাম। সবাই ভয় দেখাত শুয়ে থাকলে পিঠে ঘা হয়ে যেতে পারে, আমি তাই কষ্ট হলেই তাঁকে তুলে টেনে নিয়ে যেতাম ডাইনিং টেবিলে। ধরে বসে খাওয়াতাম। তারপর আবার বিছানায়।
কিন্তু দিন আবার বদলে গেল। আব্বার শরীর আরও খারাপ করল। উনি আর আমার শরীরে ভর দিয়ে টেবিলে আসতে পারেন না। বিছানায় খাওয়া শুরু হল। বিছানার পাশে একটা টেবিল বানিয়ে নিয়ে আসলাম। টয়লেট করার জন্য পোর্টেবল চেয়ার আনা হল। এখন সব বিছানার পাশেই। শুয়া থেকে তুলে বিছানায় বসেই খাওয়া। ঘরে হুইল চেয়ার আসল। মাঝে মধ্যে তাতে করে বাইরের দুনিয়া দেখা। এদিকে আমারও উন্নতি হচ্ছে কাজে কামে। আমি এই সময়টাতে সব শিখে গেছি। আমার ঘিন্না পিত্তি চলে গেছে। কিন্তু তখন অনেক বাকি ছিল যা পরে বুঝেছি। আমার নতুন দক্ষতার মাঝে যোগ হল নাপিতের কাজ। আমি সব যন্ত্রপাতি কিনে নিলাম। প্রতি মাসে একবার করে আব্বার চুল কেটে দিতাম, দাড়ি ছেঁটে দিতাম, গোঁফ কেটে দিতাম। আমার দক্ষতায় আমি নিজেই মুগ্ধ।
সময় চলে গেছে। এদিকে যে কারণেই হোক আমি আর আব্বা বাড়িতে একা হয়ে গেলাম। আমার দক্ষতার পালকে নতুন পালক যোগ হল। আমি রান্না করা শুরু করলাম। দুপুরের ভাত তরকারির জন্য সাহায্য পেতাম কিন্তু সকালের আর রাতের খাবার আমাকেই ব্যবস্থা করতে হত। নুডলস, মেকারনি আব্বার খুব পছন্দ ছিল। আমারা দুইজন দিনের পর দিন পার করে দিতে থাকলাম এই সব খেয়ে। আস্তে আস্তে আমার একটা রুটিন তৈরি হয়ে গেল। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে আটটার মধ্যে আব্বাকে এক কাপ চা দিতে হবে। তারপর সাড়ে নয়টা থেকে দশটার মধ্যে সকালের নাস্তা। সকালের নাস্তার পরে আবার এক কাপ চা। এরপর বারোটায় হালকা কিছু। দুইটা থেকে আড়াইটার মধ্যে দুপুরের খাবার। পাঁচটার দিকে আবার এক কাপ চা। সন্ধ্যায় হালকা খাবার, সাড়ে আটটার মধ্যে রাতের খাবার। চা বানানোর দক্ষতা রীতিমত ঈর্ষণীয় পর্যায়ে চলে গেল। ইউটিউব দেখে দেখে আর অতীতে আমার মেসের জীবনের অভিজ্ঞতা দিয়ে চলতে থাকল আমার আর আব্বার জীবন। এই সময়টায় আমি একটা পা ঘরের বাইরে ফেলতে পারিনি। আক্ষরিক অর্থেই রুমের বাইরেরও যেতে পারিনি। উঠানে প্রথম দিকে কয়েকবার যাওয়ার পরে দেখি আব্বা ডাক দিলে আমি কিছুই শুনি না। কাজেই ডাক শোনার দূরত্ব হচ্ছে আমার সীমানা।
বই সিনেমা ইন্টারনেট এই সব ছিল আমার অক্সিজেন। বেঁচে থাকলাম আমি। পরিস্থিতি পরিবর্তন হল। বাড়িতে আবার মানুষজন ফিরল। আমি একটু স্বস্তি পেলাম। আমার দৌড়ের সীমানা একটু বৃদ্ধি পেল। যতদূর থেকে একটা ফোন কল পেলে দ্রুত চলে আসা যায় তত দূর ছিল আমার সীমানা। বাথরুম চেপেছে, একটা ফোন, আমি সাইকেল, রিকসা যেভাবে হোক উড়াল দিয়ে বাসায়। সর্বোচ্চ পাঁচ থেকে সাত মিনিট। কিন্তু কোন কোনদিন আব্বা আমাকে এই সময়টুকুও দিত না। এমন পরিস্থিতি সামাল দেওয়া আমি শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিপূরণ ভাবে শিখে উঠতে পারিনি। যা হত তা হচ্ছে আমার প্রচুর চিৎকার চেঁচামেচি আর হচ্ছে আমি নিজেও মেখে লেপটে একসা! পরবর্তীতে একটু উন্নতি হয়েছিল। কিন্তু পরিপূরণ ভাবে এই জিনিস সামাল দেওয়া আমি শিখিনি।
বাসায় লোকজন ফিরলেও কেন জানি আমার রুটিন পরিবর্তন হল না। আমি আগের মতই সকালে উঠে চা বানাই। আব্বাকে চা খাওয়াই। উনারা যদি রুটি বানিয়ে দেন তাহলে রুটি আমি ভাজি, সাথে ডিম ভেজে আব্বাকে খেতে দেই। দুপুরের খাবার শুধু তৈরি পেতাম। সেই খাবার আব্বাকে গুছিয়ে দিলে আব্বা নিজে নিজেই খেয়ে নিতে পারত। অন্য সব আগের মতই চলোতে লাগল। আমি কে কী করল বা কেন করল না তার হিসাব নেওয়া ছেড়ে দিয়েছিলাম প্রথম থেকেই। কাজেই সেই প্রসঙ্গ টানব না এখানে। আমাকেই তখনো নুডলস বানাতে হত, ম্যাকারনি তৈরি করতে হত।
আমার প্রতিনিয়ত চিন্তা হত আর কী করা যায়! কী করলে মানুষটা একটু আরাম পাবে। আমি গাড়ি ধোয়ার পাইপ কিনে আনলাম। বাথরুম থেকে সহজেই আব্বাকে বিছানার পাশে বাথরুম শেষে পরিষ্কার করাতে পারলাম। আবারও, নিজের আবিষ্কারে আমি নিজেই মুগ্ধ। বাথরুম কঠিন হয়ে বিপদে গেলল আমাকে। আমি শুরু করলাম ইসুবগুল খাওয়ানো। এইটা আবার দৈনিক খাওয়ানো যাবে না। দিতে হবে দুই একদিন পরে পরে। দৈনিক দেওয়া যাবে না, শিখলাম কই? ঠেকে শিখলাম। দৈনিক দিয়ে একদিন মাখামাখি করলাম তারপর শিখে গেলাম। নখ কাটার জন্য বিশেষ রকমের নেইল কাটার কিনে আনলাম। আব্বার বাম হাতের নখ সব নষ্ট হয়ে বড় হয়ে গেছিল। সম্ভবত রক্ত চলাচল হত কম বলে এমন হয়েছিল। এই নেইল কাটারে সেই নখও কাটা যায়। শুয়ে শুয়ে যেন উনি ফ্যান লাইট চালু করতে বা বন্ধ করতে পারেন তাই হাতের কাছে সুইচের ব্যবস্থা করে দিলাম। মোবাইল দেওয়া হল কাছে। যখন যাকে ইচ্ছা ফোন করে যেন কথা বলতে পারেন। হাতের কাছে সব এনে দিলাম। রাজ্যের জিনিস উনার মাথার কাছে জমা হল। কোনটা কখন লাগবে আমি নিজেও জানতাম না।
এই সবের মাঝে যা হল তা হচ্ছে আমার আর আব্বার মাঝে অদ্ভুত একটা সম্পর্ক তৈরি হল। বন্ধু? বা তারচেয়েও বেশি কিছু হয়ত। উনার রাতের ঘুম ঠিকঠাক হচ্ছে এই ব্যাপারটা নিশ্চিত করার জন্য আমি রাত জেগে থাকতাম। আড়াইটার পরে ঘুমাতে যেতাম। রাজ্যের গল্প শুরু হত এই সময়ে। আমি শুধু শুনে যেতাম। আব্বা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানে বন্দী ছিল। আমার আগ্রহের জায়গা ছিল সেই সব গল্প। আব্বা সেই গল্প বলতে বলতে চলে যেত আরেক গল্পে। কবে কোথায় কোন জাহাজে উঠে এক বাঙালি ভদ্রলোক আব্বাকে বাঙালি জেনে পুরো জাহাজ ঘুড়িয়ে দেখিয়েছে, পরে রাতের খাবার খাওয়ানোর পর ফিরতে দিয়েছিল সেই গল্প শুনি। আমি শুনি আমার আমার দাদার গল্প। তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ করেছেন। এরপরে আসানসোল কয়লা খনিতে চাকরি করেছেন। সেখানকার ব্রিটিশ অফিসার তাঁকে বলেছেন যে তিনিই প্রথম মুসলিম কেউ যে এই কয়লা খনিতে প্রথম কাজ করছে। এমন নানান গল্প আমি শুনে যাই।
এই যে সম্পর্ক তৈরি হল তা শেষ দিন পর্যন্ত বহাল রইল। ছোট বড় যে কোন কারণে ডাক পড়ত আমার। উনাকে ঘিরে উনার আরও অন্য সন্তানেরা বসে আছে। কিন্তু তিনি খুঁজছেন আমাকে। উনারাও কিছু বুঝত না। কিছু বুঝতে হলে তারাও খুঁজত আমাকে। আমি আছি সব জবাব দেওয়ার জন্য। এদিকে আমার অবস্থা কিন্তু অনেকটা অন্তিম মুহূর্তে পৌঁছে গেছে। আমি তখন চিন্তাও করতে পারি নাই যে আমি এক সময় ঝাঁ চকচকে অফিসে টকটক করে টাইপ করতাম ইংরেজিতে মেইল। দুইটা তিনটা পোশাক কারখানার মালিক বসে থাকত কখন আমি বলব মাল কাটুন বা মাল লাইনে দিন আজকে। প্রডাকশন শুরু হবে আজকে। আমি এগুলা সব খেয়ে ফেললাম। ঢাকা শহরকে একটা সময় আমার বাড়ির উঠান মনে হত। আমি ঢাকায় থাকলে যেন সহজে নিশ্বাস নিতে পারতাম। সিনেপ্লেক্সে সিনেমা দেখা, শাহবাগে আড্ডা মারা কিংবা বই মেলায় রাত পর্যন্ত ঘুরাঘুরি ছিল আমার জীবন। সেই আমি অতি কষ্টে সকালে ঢাকা যেতাম বই মেলার সময়। মেলা ঘুরে বই কিনে আবার রাতের বাসে বাড়িতে। বাড়ি ফিরে দেখতাম আব্বা সজাগ। আমার জন্য অপেক্ষা করছে। আমি ফিরেছি, এবার ঘুমাবে। আমার রুটিন আবার চালু হয়ে যেত।
আমি চলতাম কীভাবে? আমার বাবার তো অর্থ সম্পদ ছিল না তখন আর। আমরা হচ্ছি সেই বংশের লোক যারা আমাদেরও ছিল এক সময় বলে থাকে তারা। কাজেই আমার চলার উপায় ছিল না। আমি ঢাকা থেকে ফেরার সময় যা সাথে করে নয়ে এসেছিলাম তা কিছুদিনের মধ্যেই ফুড়ুত! আমার অবলম্বন ছিল আব্বার পেনশনের টাকা। আব্বা পেত সাত হাজার টাকা। আমি সেই টাকায় চলতাম। ভাই বোনেরা যা দিত তা এমন কিছু না যে তা উল্লেখ করব। আমি এই সাত হাজারে আব্বার চা নাস্তা, আমার ইন্টারনেট সব মেনেজ করে ফেলতাম। খুব যে কষ্ট করেছি তা না। বলা চলে স্বপ্নের মত দিন যাচ্ছিল আমার।
সমস্যা একটাই, আমি কোথাও নেই। কোন ঘুরাঘুরির মাঝে নাই। বিয়ের অনুষ্ঠানে নাই। কোথাও নাই। অসামাজিক প্রাণী হয়ে রইলাম। যারা জানত তারা মেনেও নিল। কেউ না বুঝেই রাগ করত। আমি এই সব পাত্তা দেওয়ার কথা চিন্তাও করি নাই কোনদিন। যা সাধ্য না, সেই অসাধ্য সাধনের চেষ্টায় মেতে রইলাম আমি। মানুষ বেহেশতের কথা শুনায়, পাপ পুণ্যের গল্প বলে আমি শুধু আমার কাজ করে যাই। কিন্তু সব কিছুর মত এইসবেরও শেষ আছে। আর তা যে এই বছরেই, এই সময়েই এসে হাজির হবে তা কে জানত! গত এক মাস থেকে আব্বার শরীর খারাপ হওয়া শুরু হল। জ্বর আসল, সুস্থ হল। ধুম করে প্রস্রাব বন্ধ হয়ে গেল। প্রস্রাব হয় না হয় না করে ৩২ ঘণ্টা হয়ে গেল। আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরে এমন অবস্থা। শেষে ক্যাথেটার দেওয়া হল। আমার দক্ষতার আরেক নমুনা প্রকাশ পেল এবার। এতদিন সব কিছু করলেও আব্বা আমার সামনে কাপড় সরাতে ইতস্ততা বোধ করত। এবার আর কিছু রইল না।ক্যাথেটারে প্রস্রাব আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমি ক্যাথেটার খুলে দিলাম নিজ হাতে। খাওয়াও পানি, সরবত। প্রস্রাব হল কিন্তু এরপর উনি আর প্রস্রাবের উপরে নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেলেন না। কনডম ক্যাথেটার নামে এক জিনিস পরানোর চেষ্টা করলাম। পরালাম কিন্তু কাজ করল না। শুরু হল আরেক অধ্যায়। ডায়পার দেওয়া শুরু করলাম। দৈনিক সকাল রাতে করে ডায়পার পরালাম আমি। পরাও, পরিষ্কার কর আবার পরাও। চলল নতুন রুটিন। এরমাঝেই আসল ডায়বেটিক্স সমস্যা, সমানে নেমে যেতে থাকল। সামাল দিতে দিতে শরীরে পানি আসল। ওষুধ দেই, কাজ হওয়ার আগেই পায়ের দিকে চামড়া উঠে গেল। ওষুধ দেই, ভাল হতে থাকল। আরেক সমস্যা হাজির হল, আগে বাম পায়ে শক্তি না পেলেও তাতে কোন ব্যথা ছিল না। এখন ধরলেই ব্যথা পাওয়া শুরু করলেন। এই সমস্যার মাঝেই কোমরে ফোঁড়া উঠল বড় একটা। আমি চোখেমুখে অন্ধকার দেখতে থাকলাম। বাথরুম করতে থাকলেন বিছানায়। আমি আগের চেয়ে আরও নাস্তানাবুদ হতে থাকলাম। বিপদ কমল না, বেড়েই চলল। এবার আমি প্রথম আমার বোনদের বললাম যে আমি একা আর সামাল দিতে পারছি না, আব্বার শরীর অত্যাধিক দুর্বল। আমি তখন গুনাক্ষরেও ভাবিনি যে আব্বা আর আগের মত হবে না। এই অসুস্থতাই যে শেষ তা আমার চিন্তার বাইরে। ডায়পার, ফোঁড়া সব মিলিয়ে নাজেহাল অবস্থা।
ওহ, আরেকটা কথা বলিনি। বমি সামাল দিতেও শিখে গেলাম আমি। বমি করছে কেউ এই দৃশ্য দেখলে তা থেকে দুইশ হাত দূরে থাকতাম আমি। সেই আমি দুই হাত পেতে বমি ধরেছি। খাওয়াচ্ছি, দিলেন বমি করে। একদম হড়হড় করে বমি। হাতের কাছে কোন কাপড় থাকলে তা দিয়ে দুই হাতে বমি ধরার চেষ্টা করেছি। তিনি বমি করে দাড়ি বুক ভাসিয়ে চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতেন। কর এবার সব পরিষ্কার। আব্বার যখন শরীর খুব খারাপ তখন মানুষজন প্রায়ই আসে দেখতে। একজন আমাকে এইভাবে বমি ধরতে দেখে খুব বুদ্ধি করে আমাকে বললেন, এক জোরা রাবারের গ্লাবস কিনে আনতে। যাতে আমি গ্লাবস পরে বমি পরিষ্কার করতে পারি। আমি বললাম এই খালি হাতেই এই কয় বছর ধরে বমি, পায়খানা প্রস্রাব সব পরিষ্কার করলাম, এখন গ্লাবস কিনব! গ্লাবসের প্রয়োজন আমার নাই। বমিটা আব্বাকে খুব দুর্বল করে দিয়েছিল।
এত সমস্যার মাঝে চরম আঘাত হানল হচ্ছে আব্বার রক্ত চাপ। হুট করেই চাপ কমে গেল। কমে গেল মানে নাই। প্রথম মাপলাম ৬৩/৫৪ পেলাম। আর পারিনি রক্ত চাপ বাড়াতে। সকালে আব্বা আমার হাতে মধু খেয়ে চলে গেলেন। ডায়বেটিক কম পেয়ে মুখে মধু দিয়েছিলাম। তিনি খেলেন। চার চামচ মধু খাওয়ার পরে আর আমার ডাকে সাড়া দিলেন না। আমার ছুটি হল এক অসম সংগ্রামের। ৭৮ বছর বয়সে আব্বা চলে গেলেন।
আমি এই তিন বছর দশ মাস সময়ে আমার হিসাবে এমন কোন আহামরি কাজ করিনি। সন্তান হিসেবে আমার কাছে মনে হয়েছে এইটা করা ছাড়া আর আর ভিন্ন কোন উপায় নেই। মানুষ এর মাঝে অসাধারণত্ব খুঁজে পাচ্ছে কেন আমি জানি না। আমার কাছে বরং মনে হয় আমি নিতান্তই অপদার্থ ছেলে আব্বার। যদি আমি প্রচুর টাকা কামাই করতে পারতাম তাহলে হয়ত আরও ভাল ভাবে রাখতে পারতাম উনাকে। ঢাকা শহর কতদিন দেখেন নাই, আমি পারতাম তাঁকে আবার ঢাকা শহরটাকে দেখাতে। কত আফসোস নিয়েই না তিনি চলে গেলেন। শেষের কিছুদিন ঘরের বাইরে যাওয়ার জন্য খুব আহাজারি করেছেন। নিয়ে যাও একটু আমাকে, কতদিন বাইরের কিছু দেখি না। অথচ উনি তখন পাঁচ মিনিট বসে থাকতে পারেন না। আমি পারলাম না কেন উনাকে যে ভাবেই হোক একটু ঘুড়িয়ে আনতে? আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি কতবার, কতবার মেজাজ হারিয়েছি তার কোন হদিস নাই। শেষের দিকে কি আমি বেশি ক্লান্ত হয়ে গেছিলাম? আমি কি আমার অজান্তেই হাল ছেড়ে দিয়েছিলাম? আমি জানি না। আমি যোগ্য হলে এমন কিছুই হত না।
সব কিছুর শেষ আছে। আমি আমার দায়িত্ব দোষ গুণ মিলিয়ে পালনের চেষ্টা করেছি। আমার দায়িত্ব শেষ হয়েছে। ভুল গুলাকে মেনে নিয়েই আমি অন্তত পিছন ফিরে অতৃপ্তি নিয়ে মরব না। আমি অন্তত বলতে পারব আমার সাধ্যের মধ্যে যতটুকু সম্ভব আমি তার প্রতি বিন্দু দিয়ে চেষ্টা করেছি বাবাকে ভাল রাখতে। আরেকটা কাজ আমি করেছি। আমি একটা উদাহরণ সৃষ্টি করে দিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছি। এখনকার দিনে কেউ এমন করে না এমন কথা শুনতে শুনতে কান ঝালাপালা আমার। এখন অন্তত কেউ বলতে পারবে না এই কথা। অন্তত একটা উদাহরণ দিতে পারবে এখন। আমার সামনে তেমন উদাহরণ ছিল না। আমি নিজের মত করে চেষ্টা করে গেছি শুধু। এখন দেখা যাক ভবিষ্যৎ আমার জন্য কী নিয়ে অপেক্ষা করছে!
ভালো থাকবেন। শ্রদ্ধা জানবেন।
টুপী খুললাম সাদেক।
ভালো থাকুন,শান্তি পান-- এই আমার একান্ত কামনা।
ধন্যবাদ। অসংখ্য ধন্যবাদ আপনাদেরকে।
অসাধারণ। আমার ২ বছর বয়স থেকেই বাবা অসুস্থ, পারকিনসনস ডিজিজ। জীবনের শেষ দিকে, প্রায় 3 বছর শয্যাশায়ী ছিলেন।
সেবার ভার নিজের কাঁধে নিয়েছিলেন আমার মা, আর কিছুটা দাদা। আমি বিদেশ থেকে কিছু ওষুধ, স্পেশাল ম্যাট্রেস - এসব পাঠানো ছাড়া আর কিছুই করে উঠতে পারি নি।
এই কিছু না করার দুঃখ এখনও জ্বালায়। সাদেকের ভূমিকা নিতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করতাম।