নৈর্ব্যক্তিক সালতামামির হাল-হকিকত ঠিক মনে নেই। থাকার মধ্যে ওই তো ক’টা স্থিরচিত্র আবছামতো। ঝেড়ে মুছে বলছি তাকে – একটু বলো, এক দু-কথা। আজকে না হয় সেই জুতোতে সেই জামাতে আর আঁটি না। খুব একটা যে খবর নিয়েছি – সেটাও তো নয়, কাজেই সে তার ছবি ছাবার মধ্যে কিছু লুকিয়ে ফেলছে অন্ধকারে। এর মধ্যেও তার কয়েকটা পাতামাত্র ফেরত দিল। তাও শুধু এক মাঝের পাতা। আগে পিছের অনেকটা তার পোকায় কাটা, তাও তো অনেক। কথা ছিল যেমন যেমন ছবি দেবে ঠিক তেমনই লিখতে হবে। আগে পরের হিসেব কষলে খেলা বন্ধ।
তাই তবে হোক, এক এক পাতায় ঠিক যেটুকু আলো পড়ল, ঠিক ততটাই, দ্বীপের মতো একলা থাকুক নিজস্বতায় মুখরিত। কাজ হচ্ছে চুপিসাড়ে সেই ছবিটাই তুলতে চাওয়া জলছবিতে পয়সা ঘষে। সস্তা কাগজ মাথায় রেখে তবুও তো যথাসম্ভব চাপ দিয়েছি যদি তাতে স্পষ্ট দেখায়। কাছের থেকে দূরের থেকে দেখতে দেখতে ছবির সঙ্গে কেটে যাচ্ছে কয়েকটা দিন। বেলা ক্রমে ছোট হচ্ছে, বাড়তে থাকছে রাস্তা জুড়ে হলদে পাতা – মোহর যেন রোদ্দুরে সে - হাসল এমন। অল্প হাওয়ায় উড়ে যাচ্ছে। ছোটগুলো ঘুরে যাচ্ছে হাওয়ার সঙ্গে – বড় পাতা পাশে পাশে হাঁটতে যাচ্ছে।
আবার একদিন সকাল থেকে রঙের গন্ধ সব কিছুতে। আগে সাতদিন ধুলোতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। দেয়ালগুলো চেঁচাচ্ছিল - বাচ্ছাগুলো দোলের শেষে স্নানের সময় যেমন চেঁচায় ছোবড়া ঘষে ঘষে মায়ের ধৈর্য্য যখন প্রান্ত সীমায়। তাও রং ছোপ থেকেই গেছে প্রায় সবারই হাতে মুখে পায়ের গোছে। বিশেষত আঙুলগুলোর মধ্যিখানে। ডাল মাখা ভাত কালক্রমে অন্যরকম রঙের লাগল। নখের কোণের রং উঠতেও হপ্তাখানেক। কিন্তু মুখের রং তুলতে বিকেল বেলা আরেক প্রস্থ ঘষাঘষি, কাল সকালে স্কুলে যাওয়ার আগেই যেন সাফ হয় সব। হেই মা কালি।
কীসের থেকে কীসে যাচ্ছে, কথা হচ্ছে সেই সকালে কাজ চালাচ্ছে রঙের মিস্ত্রি। আনাচ কানাচ লণ্ডভন্ড হলেই তবে সামনে আসে দুঃসম্পর্কের আত্মীয়রা। অভিমানে খাটের পিছন দেওয়াল ঘেঁসে লুকিয়ে যাওয়া ওই চিঠিটার কথা তো প্রায় ভুলেই গেছি। অরিজিতের, ক্লাস এইটের সময় লেখা। টিভিতে সেই ঘটকবাবুর সিনেমা কটা দেখাচ্ছিল। সেই নিয়ে সব কিশোর বালক ইচ্ছেমতো, ভালোই লিখত। ছেলেমানুষি নানা রঙের।
রং তুলতে গিয়েই দেখা সেই দেওয়ালের ইতিহাসের রঙিন পাতা। একবার সেই হালকা সবুজ, তারও আগে গোলাপি রং, আমরা তখন খুবই ছোট, সন্ধে হলেই আধঘন্টা তবলা পেটাও মায়ের হুকুম, সঙ্গে ভাইটা সামনে নিয়ে হারমোনিয়াম "ঠুমকি চলত"…।
স্বপ্নদেরও পূর্বজন্মে হাত-পা ছিল। দিন দুপুরের যে তমিস্রা আয়না ধরলে ছোবল মারত, সন্ধে নাগাদ চোখ বুজলেই নৌকা চোখে ভাসতে তুমি ইচ্ছেমতো। আসতে যখন - বালিশ বুকে সামনে শুধু ইনল্যান্ডের নীল সমুদ্র তার মধ্যে জাহাজ চলছে। এবড়োখেবড়ো হাতের লেখা, কখনও ফের যত্ন করে চুল আঁচড়ানো স্কুলের জামায় অক্ষরেরা - যখন যেমন আবহাওয়া। "যখন-তখন" কথার কথা, তখন খুব কাজও থাকত। সাত সকালে রেডি হয়ে সাইট যাওয়া। দুপুর বেলা টিফিন আসত হোটেল থেকেই। বাড়ি, থুড়ি হোটেল ফিরতে আটটা ন'টা। ফেরার পথে কিংবা রাতে একলা হেঁটে এস টি ডি বুথ, ঘাটশিলাতে। লাইন পেলেই আলো জ্বলত, নয়ত আবার এবড়োখেবড়ো ঢেউয়ের মাথায় ডিঙি নৌকার ছটফটানি। আমরা জানি, সেও সব নয়, স্বপ্ন যেমন ওলট পালট, কালক্রমের ধার ধারে না। কবে যেন কথা ছিল ক'জন বন্ধু আসতে পারে। দিন দুয়েকের মতো মাত্র একটু আধটু ঘোরা ফেরা, আসল ধান্দা সারারাত্রি মদ্যপানে বেদম হয়ে ফুর্তি করা। আগেভাগেই বলা ছিল হোটেলটিতে, আমার মতো জনা কয়েক এসে আমার নামটি বললে - ঘর দিও হে।
তেমনই এক শ্রাবণসন্ধ্যা, অ্যাসিড প্ল্যান্টে এদিক ওদিক সমস্যারা ছুটিয়ে মারে। হাতের কাছে কাউকে পাওয়া দায় হয়ে যায়। ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি ভীষণ। নতুন প্ল্যান্টও বৃষ্টি দেখে ছন্নছাড়া। কারোর কোনও চাপের তাপের ঠিকঠিকানা কেউ রাখে না। এক বছরের অভিজ্ঞতার ইঞ্জিনিয়ার ভেজা জামায় ছুটে বেড়ায় পাগলা হয়ে। কোথাকার এক অ্যাসিড লিকে জিন্সে ফুটো, ভিজে মোজা পকেট ভরে হোটেল ফিরতে অবাক কান্ড। আজকেই সেই হতভাগার দলবল সব হাজির হল। কোনও মতে স্নানটি সেরেই গ্লাসটি টেনে মিশে যাওয়া স্কুলের ক্লাসে। সারাদিন ও সারারাত্রি ঠিক এভাবেই ছুটিয়ে বেড়ায় ছন্নছাড়া। মায়ার বশে তারও হাতে দিনের শেষে প্রিয়সঙ্গ মজ্জায়িত সুধাপাত্র। কয়লাখনির মধ্যে বুঝি এমন ভাবে হীরকখন্ড ঝলসে ওঠে। ইনল্যান্ডের সমুদ্দুরে তাও লিখিত এক টুকরো ডাঙার খবর।
মনে পড়ে?
এবার তবে ফুলের দোকান, বড়বাজার। পরেশনাথ দেখতে দু'ভাই দাদুর সঙ্গে দুপুর দুপুর পৌঁছে গেছি। দোকান বলতে সামনে কিছু ফুলের তোড়া, গোড়ের মালা, মোতির মালা -পুজোয় লাগে, মাটির বড় সরায় রাখা জলের মধ্যে গোলাপগুচ্ছ - খুচরো এসব বিক্রিবাটা। আসল ব্যবসা অর্ডার মাফিক, সেই অনুযায়ী ভেতর ঘরে লাইন দিয়ে ফুল গাঁথছে মানুষজনে। সামনে পাহাড় রজনীগন্ধা। তার বৃন্ত ভাঙার কত রকমফেরও শিখেছিলাম। কাজের শেষে সবুজ বৃন্ত গর্ভকেশর সহ বাতিল। বাকি ফুলটি মালায় গাঁথা সারা সন্ধে ম ম করে, আলোর মধ্যে। ছবিগুলোও বেঁচে থাকবে অনেক বছর, বৃন্তবিহীন। মদন দা আর বিজয় দা'রা রেডি করছে জিনিসপত্র - একটু খেয়েই বেড়িয়ে যাবে - কোথায় যেন খাট সাজানো, বিয়ের গাড়ি, ফেস্টুন, গেট। “বরমালাটা কেমন যেন চেয়েছিল রে?” - মিলিয়ে নিচ্ছে। সেইসব নয়, আমাদের তো ধান্দা ছিল অন্যরকম। ভিতরঘরেই এক টেবিলে কালো শক্ত টেলিফোনের রিসিভারে কেমন গন্ধ। জর্দা পানের সঙ্গে মিশেল ব্যাকেলাইট ঠান্ডা ঠান্ডা। কানের মধ্যে কেমন একটা জাহাজ শব্দ - ডায়াল টোনের। এক একটা ঘর ইচ্ছে মতো ডায়াল করলে শব্দ থামে। টেলিফোন টা প্রশ্ন করে কার নম্বর? কার নম্বর… তখনই খোঁজ ক্যালেন্ডারে যদি একটা আস্ত কারও ফোন নম্বর থাকে কোথাও… অন্য যে কেউ, অন্য কোথাও… যদি থাকে। সেও একটা ভিড়ের মধ্যে সমুদ্দুরে একলা হয়ে খুঁজতে চাওয়া অন্যটিকে।
পরেশনাথের মিছিল মানেই ঝ্যঁকোর ঝোঁকড় ব্যান্ড বাজছে। মাঝে মধ্যে মঞ্চ জুড়ে দেবদেবীরা সঙ্গে তাদের সাঙ্গোপাঙ্গ। উল্টোদিকের পায়রাখোপের জানলা খুলে দেখছিল কেউ। ফুটপাথে কেউ দাঁড়িয়ে গেছে। তারই পাশে অন্য লোকটি হেঁটে যাচ্ছে টপকে এসব। অন্য কোথাও যাওয়ার আছে। বাস ট্রাম সব বন্ধ বলে হাঁটতে হচ্ছে। পাশের দোকান মস্ত চুলোয় দুধ ঝাল দেয়। চ্যাপটা কড়াই অল্প আঁচে কেউ একজন সর তুলছে। রাবড়ি হবে। সেখান থেকেই মাটির ভাঁড়ে লস্যি খেয়ে গোঁফ গজালেই, দেদার মজা। মোটা সরটা সবার শেষে মুখের মধ্যে অন্য আরও গন্ধ সমেত জমা থাকত অন্য কোনও খাতার পাতায়।
পুজো বলতে শিরশিরানিই, সারাজীবন। ছোটবেলায় পাড়ার মাঠে বাঁশ পড়লেই পুজো শুরু। বাঁশ বাঁধতেই কুঁচো কাঁচা পাড়ার যত বানর সেনা চৌপর দিন উঠছে নামছে। প্রথম প্রথম বাঁশে চড়তেও শিরশিরানি, পরের দিকে গা সওয়া সব। ত্রিপল ঢাকা পড়লে আবার অন্য খেলা - লুকোচুরি। এর পিছনে তার আড়ালে কত জায়গা রাতারাতি। তারপর এক মাঝরাত্রে ঠাকুর এলে আর পায় কে। স্নান খাওয়া ঘুম কয়েক ঘন্টা ছাড়া বাকি সব সময়টা বাইরে কাটে।
নতুন জামায় শিরশিরানি। প্যান্ডেলে এক অনুষ্ঠানে বারো লাইনের এক কবিতার শেষ দু'লাইন ভুলে গিয়ে নেমে আসলে সারাজীবন শিরশিরানি। যদিও কেউ খোঁজ রাখে নি। সামনে যারা বসেছিল, কয়েকজন তো হাততালিও - কী লজ্জা সে। তখন থেকে এ পর্যন্ত মঞ্চ বলতে শিরিশিরানি।
স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে একলা ঠাকুর দেখতে যাওয়ার প্রথম দিনে শিরশিরানি। সপ্তমীতে সন্ধে সাতটা স্কুলের গেটে - আসবে তো কেউ? অনুমতি পাওয়ার কষ্ট, নষ্ট হবে? তখন কারও ফোন ছিল না। কথা সবই ছুটি পড়ার দিনে হওয়া। ভোলে নি তো? যদি তাদের বাড়ি থেকে আসতে না দেয়?
ক্রমে দেখা, সবাই ভাবে, সবাই আসে, কয়েক মিনিট আগে পরে। তারপরে তো রাস্তা শুধু রাস্তা চেনায়। পুজোর ভিড়ে কত মানুষ, সেও প্রথমই।
কয়েক বছর পরের পুজোয় সাইকেলে এক ভোরবেলাতেই বেরিয়ে গেছি। অর্ধচেনা আবাসন এক। সেখানকার ওই একটি মানুষ চিনি তখন। সে যদিও জানত না তা, সেই সুবাদে অর্ধচেনা। আবাসনের ছোট পুজো, ইতস্তত শূন্য চেয়ার চক্রাকারে শিশির মেখে আড্ডা মারে। এক কোণে এক টেবিল ফ্যানের সামনে রাখা ঢাকের পাশেই কাঁথায় মোড়া ঢাকি কাঁসি ঘুমিয়ে কাদা। আলো ফুটেছে, গান ছিল কি? হবে হয়ত। মূর্তি ছিল একচালাতেই। আশে পাশে কিছু জানলার একটা বোধ সেই মানুষের। কিছুক্ষণই অনন্তময় শিরশিরানি শরীর জুড়ে। কোনও একটা জানলা ধারে একমনে এক শিউলি গাছটি বিমুর্ত এক আলপনা দেয় ঘাসের ওপর। কেউ না যেন দেখে আমায়, যদি বা কেউ শুধোয় কিছু? গলা শুকনো, বলব না হয় তেষ্টা পেয়েছে। মিথ্যে হবে? শিরশিরানি।
আরও কয়েক বছর পরে একটা ঘরে ডুমের আলো, হলদে আলো। সেই প্রথমই একলা শোনা গানের কথায় শিরশিরানি। গানের সুরে গায়কীর এক মায়ার টানে শিরশিরানি। কিছু পরে প্যান্ডেলে এক জনপ্রিয় হিন্দি গানের কথার সঙ্গে অনুরণণ - বেদম ঝটকা। সংজ্ঞা হারায় - শিরশিরানি।
এই এখনও আবহাওয়া যেমন করে হালকা হ'ল হঠাৎ করে, ভোরের দিকে পাতলা গোছের চাদর লাগে। অনেক দূরের থেকে আসা ভেসে আসা গানের লাইন, ঢাকের শব্দ, ভিড়ের গন্ধ সেন্ট জিলিপি সঙ্গে মিশেল এগরোল চাউ শিরশিরানি নৌকা করে আসতে থাকে সুদূর থেকে। একে একে পা রাখছেন এক এক বয়স, এক এক মানুষ। কী আনন্দ।
পুজোর শেষে স্কুল খুলে যায় পরীক্ষাতেই। সেও নামল সবার শেষে। তাকে বললাম - হাড়কাঁপুনি।
স্বাদের কথা না বললে অসম্পূর্ণ পাপের ঘড়া। যা নিষিদ্ধ - মন্ত্রসিদ্ধ জড়িয়ে থাকে অবকাশের আয়েস ছুঁয়ে। অকথ্য ঝাল লঙ্কা নুনে মেখে নেওয়া কালো তেঁতুল অল্প তেলে লম্ফ জ্বালে জিভের গোড়ায়। শিখায় ধোঁয়ায় টাকরা সমেত মুখগহ্বর জ্বালিয়ে দিয়ে অন্তঃপুরে নির্বাণ লাভ। একলা ছিল স্বাদের খোঁজে নৌকা বাওয়া ভন্যি দুপুর গ্রীষ্মছুটি। সামনে কাউকে পেলে তাকে দিতামও ভাগ, তার হয়ত সিদ্ধলাভে ফাঁক ছিল তাই পালিয়ে বাঁচে। আর চায় না।
খিদের আবার নিজস্ব স্বাদ। খিদের মুখে খাবার চেয়ে মুখঝামটায় শরীর কেমন শক্ত হয়ে খিদে কোথায় হজম করে। খানিক পরে মাথার ভেতর হালকা লাগা ফিরে এলেই কড়া শাসন। সামনে খোলা অক্ষরেরা ঝাপসা হয়ে কাঁপতে থাকা জলছবিতে। শক্ত কাঠের পাটার মতো পিঠটা যেন পেট ছুঁয়েছে। অন্য কিছু তখন তো আর মাথাতে নেই। চটি গলাই, বেরিয়ে পড়ি কাছে পিঠেই, এ রাস্তারা ও রাস্তারা, অশ্বত্থ গাছে নিচে বাসা কয়েকটি ঘর বাস্তুহারা, তিজেল হাঁড়ির মধ্যে ফোটে ভাতের দানা। যার যা আছে সবটুকু ওই সকাল সকাল বাজী রাখল সারাদিনের। এবার যে যার জুয়োর ঠেকে - গ্যারেজে বা ভিক্ষে করে সন্ধেবেলা ফেরৎ আনবে যা জিতেছে। সেটাই পুঁজি পরের দিনের।
বাড়ি ফিরি, ততক্ষণে কিছু একটা তৈরি হয়েছে। রাগ অভিমান বাক-বিতন্ডা ঢেকে ঢুকে অনেকটা খাই। সারাদিনের পড়াশোনায় খিদেকে আর বইয়ের পাতায় না দেখতে হয়। আর তো ক'দিন - পরীক্ষাটা হয়ে গেলে তার রেজাল্ট এলেই চারপাশটা বদলে যাবে। আর কখনও কাউকে যেন খাবার চেয়ে অন্য কিছু পেতে না হয় - দেখতে হবে।
কথায় কথায় অনেকবারই একলা একলা হাঁটার মতো ছন্দ আসে। একলা হাঁটা অনেকটা সেই সুতোর গুলি - সোজা পথে খানিক গেলেই জট ছেড়ে যায়, তখন খিদে উলোঝুলো, খুব দূরে নয়, কাছেপিঠের আড়াল থেকে শুধুই দেখে, অস্বস্তি টা ঝেড়ে ফেলতে প্রাণপণে তাই পা চালাচ্ছি বইয়ের ছাতায় ঢুকতে হবে। অঙ্ক খাতার মধ্যে যদি গিয়ে সেঁধোই শিকল দেব। তারপর ঘুম। কাল সকালে দরজা খুললে দেখা যাবে।
টাকাপয়সার অভাবটিও খিদের বাচ্ছা, মাটির কাছে থাকা মানুষ অনায়াসে শিকার করে কামড়ে ধরে। তখন যেন চোরাবালি কিম্বা ব্যাধি সংক্রামকটি - চেনা জানা বন্ধু স্বজন দেখে তবে দূরে থেকেও। আসেও কিছু কাছের যারা, তাদের ঠেলায় কাদায় পড়া গাড়ির চাকা ওঠে খানিক। চলেও পথে কষ্টেসৃষ্টে।
হাতে কিছু টাকা আসবে মাস পেরোলে - এই মর্মে বাচ্চা দুটির বাড়ি গিয়ে পড়াই তাদের সন্ধেবেলা। চা-বিস্কুট উপরি ছিল। হোমটাস্কটি করিয়ে দিয়ে আমার ছুটি। প্রথম মাসের দিনগুলো আর শেষ হয় না। মাস পেরোলেই যেন পুজো এমন একটা ইচ্ছে নিয়ে কাটাচ্ছি দিন হাড়-হাভাতে। তিনশো টাকা মাসকাবারি। মাইনে পেয়ে রোল চাউমিন ইচ্ছে মতো একটা দিনের নবাবিতেই থমকে গেছি। জমাই তবে, হাড়হাভাতের টাকা জমলে তারই পাশে বড় বড় স্বপ্ন জমে।
শেষ অবধি কবে যেন দিন চারেকের বাজার করতে ফুরিয়েছিল। এমন করে, যাতে তাকে মনে রাখতে কষ্ট না হয়। শেষ অবধি অপূর্ণ সেই স্বপ্নগুলোই সত্যি হয়ে থাকছে মনে। কী আশ্চর্য।
আলোর মধ্যে ফেরা আর ফিরতে চাওয়ার মধ্যে একটা ফারাক থাকে। পৌঁছে গেলে অন্ধকারটি যায় হারিয়ে এক্কেবারে। ফিরতে চাওয়ায় দূরের থেকে দেখা আলোর খুঁটিনাটির খানিক জেনেও অন্ধকারে হাঁটতে তেমন সমস্যা নেই। বরং আলোর স্বপ্ন এসে আলোতর কিছু একটার নেশা ধরায়। হাঁটতে হাঁটতে প্রায় সবারই ঘুম এসে যায়, কয়েকজনার চলার পথেই রাত কেটে যায়। আলো আসে, সময়মতোই। কারো কারো হাঁটতে বড় ক্লান্ত লাগে, রাগ করে কেউ। কেউ বা শুধুই কাঁদতে থাকে, চেঁচায় এত, সেইজন্যই এড়িয়ে চলে বাদবাকিরা। ছন্দ চলে নিজের লয়ে, সময় হলে আলো জ্বলে অন্ধকারে, সময় এলে দিনমানেও আঁধার নামে।
শেষ অবধি আর শেষ হয় না। চেনা রাস্তায় ফিরে এলেও অন্যরকম প্রতিবারই, লেখা যেমন পাথরকুঁচি দিনে রাত্রে, ঋতুভেদে, মর্জিমাফিক সোনা বানায়, হোঁচট খাওয়ায়, ছুড়ে মারে অন্য কাউকে। একই রাস্তায় পাশাপাশি নাপিতটি আর বন্ধু মুচি একই দৃশ্যে খুঁজে নেবে জুতোর খুঁত ও খোঁচা দাড়ি – তারই পাশে থেকেও তুমি চিনবে ওকে অন্য নামে।
ডেকে নিও, তারও হয়ত তোমার সঙ্গে দেখা হলেই বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি নামে…।
প্রথম প্যারাটা এভাবেও সাজানো যেতঃ
নৈর্ব্যক্তিক সালতামামির হাল-হকিকত
ঠিক মনে নেই -
থাকার মধ্যে ওই তো ক’টা স্থিরচিত্র
আবছামতো,
ঝেড়ে মুছে বলছি তাকে –
একটু বলো, এক দু-কথা।
আজকে না হয় সেই জুতোতে সেই জামাতে আর আঁটি না
খুব একটা যে খবর নিয়েছি –
সেটাও তো নয়,
কাজেই সে তার ছবি ছাবার মধ্যে কিছু
লুকিয়ে ফেলছে অন্ধকারে।
এর মধ্যেও তার
কয়েকটা পাতামাত্র ফেরত দিল
তাও শুধু এক মাঝের পাতা
আগে পিছের অনেকটা তার পোকায় কাটা,
তাও তো অনেক।
কথা ছিল
যেমন যেমন ছবি দেবে
ঠিক তেমনই লিখতে হবে,
আগে পরের হিসেব কষলে
খেলা বন্ধ।
যেমন এখানটাঃ
এই এখনও
আবহাওয়া যেমন করে হালকা হ'ল হঠাৎ করে,
ভোরের দিকে পাতলা গোছের চাদর লাগে।
অনেক দূরের থেকে আসা
ভেসে আসা
গানের লাইন
ঢাকের শব্দ,
ভিড়ের গন্ধ
সেন্ট জিলিপি সঙ্গে মিশেল এগরোল চাউ
শিরশিরানি
নৌকা করে আসতে থাকে সুদূর থেকে।
একে একে পা রাখছেন এক এক বয়স,
এক এক মানুষ।
কী আনন্দ।
শেষ ক'টা লাইনও এভাবেঃ
শেষ অবধি আর শেষ হয় না
চেনা রাস্তায় ফিরে এলেও
অন্যরকম প্রতিবারই।
লেখা যেমন পাথরকুঁচি
দিনে রাত্রে, ঋতুভেদে,
মর্জিমাফিক সোনা বানায়,
হোঁচট খাওয়ায়,
ছুড়ে মারে অন্য কাউকে।
একই রাস্তায় পাশাপাশি নাপিতটি আর বন্ধু মুচি
একই দৃশ্যে খুঁজে নেবে
জুতোর খুঁত ও খোঁচা দাড়ি –
তারই পাশে থেকেও তুমি
চিনবে ওকে অন্য নামে।
ডেকে নিও,
তারও হয়ত তোমার সঙ্গে দেখা হলেই বৃষ্টি নামে,
বৃষ্টি নামে…।
আমার আবার এই কবিতার মতো লাইন না সাজানোতেই ভালো লেগেছে। ছন্দটা বুঝে বুঝে পড়তে।
লেখাটা ফিরিয়ে আনলো - সেই শিরশিরানি !
আলাদা করে জর্দা, কালো ভারি টেলিফোন আর রজনীগন্ধার স্তূপের কথা বলতেই হয় আমাকে। ঘ্রাণ, শব্দ, ছবি মাথায় ঢুকে গিয়েছিল প্রথম যেদিন পড়ি। তারপর কত খুঁজেছি। পাই নি। পরে ভেবেছি, এরকম লেখা সত্যিই ছিল?
মূল লেখায় এই অংশ টি ফিরে পেয়ে খুব আনন্দ হয়েছে।
ভালো লেগেছে। কেন, বলতে পারছি না।
সি এস,
হ্যাঁ, লেখাটা অমনও হতে পারত, কিন্তু টানা গদ্যের জামাতে রাখলে পড়তে পড়তে ছন্দ খুঁজে পেলে একটা মজা লাগে, সেটা খুঁজে নেওয়ার জন্যই এমন রাখলাম।
বি,
একদম ষণ্ডচক্ষু ঃ)
প্রতিভা দি,
থ্যাঙ্ক্যু....
ছোটাই,
তোমার মনে আছে সে লেখার কথা? বছর দশেক হ'ল সে অসমাপ্ত হয়েই রয়েছে।
কুশান,
"কেন" জানতে পারলে ভালোলাগা যদি পালায়, এইই ভালো...
একটার পর একটা পড়ে গেছি। ভালো লাগায় কমতি পড়েনি। আর শেষে এসে ভালো লাগার ঘট উপচে গেল।
সঙ্গের ছবি ভালো মিশ খেয়েছে।
পড়ে ফেললাম। ফরিদার এই লেখাটা কিরম ত্যাঁদোড় টাইপের, নানারকমভাবে পড়া যাচ্ছে।
একলহমা,
থ্যাঙ্ক্যু...
দ,
"ত্যাঁদোড়" শব্দটা আজ অবধি কোনও লেখার বিশেষণ হিসেবে দেখিনি। অভূতপূর্ব সম্ভাষণে খুবই মজা পেয়েছি, তা বলাই বাহুল্য ঃ)
একদিন কথা বলে জেনে নেব খ'ন.... সিরিয়াসলি।
এর আগে সি এস যেভাবে বলেছিল এটা সেই রকম ছন্দে লেখারই চেষ্টা ছিল প্রাথমিক ভাবে। তবে তা অন্য ছন্দে কোনও পাঠকের কাছে প্রতিফলিত হ'লে সেটা তাঁরই নিজস্ব। সেটাই স্বাভাবিক।
হা হা কোনও নেগেটিভ অর্থে ব্যবহার করি নি। বহু আগে একবার শৌভর কবিতা সম্পর্কে আরেক গুরুভাই ব্যবহার করেছিল। প্রায় সিমিলার অবস্থা দেখে আমিও করলাম। :-)
ফরিদ তো শক্তি চাটুজ্যের কবিতা পছন্দ করে। আমি যখন সাজাচ্ছিলাম তখন ওনার কিছু বড় কবিতা আছে, সেগুলোর কথা মনে হচ্ছিল। জানা নেই ফরিদার সেরকম কিছু মনে হয়েছিল কিনা। যেমন এই লাইনদুটো, শক্তির কবিতাতেও থাকতে পারত।
"আগেভাগেই বলা ছিল হোটেলটিতে, আমার মতো জনা কয়েক এসে আমার নামটি বললে - ঘর দিও হে।"
"চটি গলাই, বেরিয়ে পড়ি কাছে পিঠেই, এ রাস্তারা ও রাস্তারা, অশ্বত্থ গাছে নিচে বাসা কয়েকটি ঘর বাস্তুহারা, তিজেল হাঁড়ির মধ্যে ফোটে ভাতের দানা।"
দ,
সে আমি জানি। আমি মজাই পেয়েছি। ইন ফ্যাক্ট জল খাচ্ছিলাম, কমেন্ট দেখে বিষম খেয়ে একশা।
সি এস,
শক্তি চটোপাধ্যায়ের বেশ কিছু কবিতার স্বকণ্ঠে আবৃত্তি প্রায় টানা পাঁচ বছর অফিস যাতায়াতের দৈনিক দু'ঘন্টা ধরে শুনেছি। মন্ত্রোচ্চারণের মতো গেঁথে গেছে হয়ত।
তারাপদ রায় একবার এক কবিতায় জীবনানন্দ কে পাশের ঘরে বসতে বলে "আমায় লিখতে দিন" বলেছিলেন।
সেই সাহস আমি করি না, .. বরং "ছবি আঁকি ছিঁড়ে ফেলি" তে বিশ্বাস রাখি ঃ)