এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • বুলবুলভাজা  আলোচনা  শিক্ষা

  • এস এস সি বিপর্যয়- নিয়োগ-দুর্নীতির আবহমানতা

    অর্ণব পাল
    আলোচনা | শিক্ষা | ১১ এপ্রিল ২০২৫ | ১১২০ বার পঠিত | রেটিং ৪.৬ (৫ জন)
  • ছবি: রমিত


    “ইন্টারভিউটা জাস্ট একটা লোক দেখানো ব্যাপার।
    কী বললেন? লোক ঠকানো?
    না! না! (অল্প হাসি) তাও বলতে পারেন।
    ভাগ্যবান লোক আপনি! মামা আছে!
    মামা না কাকা।
    ওই হল! মামা মানেই কাকা!”

    বাঙালি মধ্যবিত্ত সত্যজিৎ, মৃণাল নিয়ে যতটা মাতামাতি করে তার সিকিভাগও তাঁদের জন অরণ্য, প্রতিদ্বন্দ্বী, কলকাতা ৭১, ভুবন সোম এর মত সিনেমা গুলো আজকাল দেখে কি না সন্দেহ! ইদানীং ৩ রা এপ্রিল সুপ্রিম কোর্টের রায়ে ২৫,৭৫২ জন স্কুল শিক্ষক-শিক্ষিকার চাকরি যাওয়ার পর চারিদিকে প্রবল শোরগোল পড়েছে। সবাই দাবি করছেন আমরাই আসল “যোগ্য”। স্বাভাবিক, কে আর হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে, থুড়ি টাকা দিয়ে চাকরি পেয়েছি বলতে ভালোবাসবে!

    শিক্ষিত বাঙালি যুবক যুবতীদের শিক্ষকতার চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘদিনের ভরসার জায়গা স্কুল সার্ভিস কমিশন নামক সংস্থাটির। এখন প্রশ্ন হল কোন মামা, কাকারা এসে এই সংস্থাটির পরীক্ষা নেওয়ার ব্যবস্থাটিকে এবং নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে যুগপৎ লোক দেখানো ও লোক ঠকানোতে পরিণত করলেন?

    দেশের সর্বোচ্চ আদালত ২০১৬ সালে স্কুল সার্ভিস কমিশনের হওয়া নিয়োগ প্রক্রিয়াটিকে ব্যাপক দুর্নীতির দায়ে বাতিল করেছেন বটে, কিন্তু এ দুর্নীতির সূত্রপাত তৃণমূল কংগ্রেস ক্ষমতায় আসার পর ২০১২ সালে নেওয়া স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া থেকে। তৃণমূল জমানায় স্কুল সার্ভিস কমিশনের প্রথম চেয়ারম্যান হন অধ্যাপক চিত্তরঞ্জন মণ্ডল, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের দীর্ঘদিনের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক এই মানুষটি ঘোষিত বাম বিরোধী হলেও তাঁর পড়ানো ও পাণ্ডিত্য নিয়ে কোন প্রশ্ন ওঠার কোন অবকাশ ছিল না। সেই সময় NCTE (National Council of Teachers Education) এর নতুন নিয়মানুসারে ঠিক হয়, পরীক্ষা হবে দুটি ধাপে, কিন্তু এক দিনেই। প্রথমে ৯০ নম্বরের Teachers Eligibility Test বা সংক্ষেপে টেট এবং তারপর ২ নম্বর করে ৩০ টি প্রশ্ন, অর্থাৎ মোট ৬০ নম্বরের বিষয়ের উপর পরীক্ষা। টেট এর প্রশ্নপত্র এমসিকিউ ধাঁচে হবে, তবে বিষয়ের পরীক্ষায় প্রশ্নপত্রেই জায়গা থাকবে, তাতেই লিখতে হবে। টেটে ৬০% মানে ৫৪ নম্বর পেলে তবে বিষয়ের খাতা দেখা হবে, এরপর বিষয়ে ন্যূনতম ৪০% মানে ২৪ নম্বর পেলে ইন্টারভিউতে ডাক মিলবে।

    চিত্তরঞ্জনবাবু একটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, যেটা পশ্চিমবঙ্গের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষাগুলির স্বচ্ছতার ক্ষেত্রে পথপ্রদর্শক হতে পারত, যদিও দুর্ভাগ্যক্রমে তা হয় নি। তিনি টেট এর ওএমআর শিটের কার্বন কপি পরীক্ষার্থীদের দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন। পরীক্ষা হল, সম্ভবত ২০১২ এর শেষ দিকে ফলও প্রকাশ পেল। স্কুল সার্ভিস কমিশনের দেওয়া ওএমআর শিটের কার্বন কপির সৌজন্যেই বহু পরীক্ষার্থী আবিষ্কার করল তাদের টেট এ অকৃতকার্য ঘোষণা করা হয়েছে, কিন্তু কমিশন তাদের ওয়েবসাইটে যে উত্তর প্রদর্শিত করেছে সে অনুযায়ী তাদের অনেকেরই কৃতকার্য হওয়ার কথা! নাছোড়বান্দা কিছু পরীক্ষার্থী দৌড়ঝাঁপ শুরু করলেন, এবং বেশ অনেকদিন কেটে যাওয়ার পর কমিশন তাদের চিঠি দিয়ে স্বীকার করল যে তারা কৃতকার্য। ওদিকে আবার ততদিনে বিষয়ের খাতা দেখা শেষ। যাদেরকে কমিশন চিঠি দিয়ে স্বীকার করেছে যে তারা টেট পাশ, তারা কমিশনের কাছে আবেদন করলেন তাদের বিষয়ের খাতাটি দেখা হোক। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে স্কুল সার্ভিস কমিশন রা-টিও কারলো না। নাছোড় জনাকয়েক প্রার্থী তথ্যের অধিকার আইনে বিষয়ের প্রাপ্ত নম্বর জানতে চাইল, কমিশন চুপ, প্রার্থীরা রাজ্য তথ্য কমিশনে নালিশ ঠুকলেন, তাদের ধমক খেয়ে তড়িঘড়ি স্কুল সার্ভিস কমিশন বিষয়ের খাতার ফটোকপি দিল, এবং অনেকেই দেখা গেল তাতেও উতরে গিয়েছে। ততদিনে এইসব নিয়ে ডামাডোল শুরু হয়েছে, অনেকেই নিয়মিত স্কুল সার্ভিস কমিশনের সল্ট লেকের অফিসটির সামনে ধরনা, বিক্ষোভ শুরু করে দিয়েছে। কমিশন কাকে ইন্টারভিউতে ডাকছে, কীসের ভিত্তিতে ডাকছে, সব তখন যুক্তি তর্ক গল্পের নীলকন্ঠ বাগচির মত গুলিয়ে গিয়েছে। ইতিমধ্যে চিত্তরঞ্জনবাবু বিদায় নিয়েছেন বা বলা ভাল সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাঁকে। তাঁর জায়গায় এসেছেন সুবীরেশ ভট্টাচার্য, একাধারে ডায়মন্ড হারবারের ফকিরচাঁদ কলেজের অধ্যক্ষ, স্কুল সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যান এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটের দোর্দন্ডপ্রতাপ সদস্য। কমিশনের অফিসে কোন প্রার্থী দেখা করতে গেলে তিনি দেখা করতেন না, সবসময় “ব্যস্ত” থাকতেন, অথবা অফিসেই থাকতেন না। এই সুবীরেশ ভট্টাচার্যই ২০১৬ সালের এসএসসির শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষার দায়িত্বে ছিলেন এবং উনার তদারকিতেই নিয়োগ প্রক্রিয়া চলেছিল। এখন তিনি সিবিআই-এর হাতে গ্রেফতার হয়ে জেলে। অমিতেশ বিশ্বাস, একজন WBCS অফিসার, সে সময় কমিশনে সহ সচিব ছিলেন। তিনি একা চেষ্টা করেছিলেন বেনিয়ম আটকাতে, সুবীরেশবাবু কমিশনের অফিসে কর্মীদের নির্দেশ দিয়ে অমিতেশ বিশ্বাসের ঘরে তালা লাগিয়ে দেন, পরে অমিতেশ বাবুকে কম্পালসারি ওয়েটিং এ পাঠিয়ে দেওয়া হয়, অধুনা তিনি সম্ভবত বিকাশ ভবনে কোন গুরুত্বহীন পদে রয়েছেন।

    আসল ঘটনা অর্থাৎ ২০১৬ সালে পরীক্ষায় বসা ২৫,৭৫২ জন বা প্রায় ২৬০০০ শিক্ষক শিক্ষিকার চাকরি বাতিলের কথায় সরাসরি না ঢুকে কেন ২০১২ সালের এসএসসির পরীক্ষার সময় থেকে শুরু করলাম? আসলে পার্থ চট্টোপাধ্যায় এবং তার সঙ্গীসাথীরা সেই সময় থেকেই স্কুল সার্ভিস কমিশনকে শিক্ষা দুর্নীতির হাত পাকাবার আসরে পরিণত করে ফেলেছিলেন। চিত্তরঞ্জন মণ্ডল এবিপি আনন্দের সুমন দে কে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলছেন ব্রাত্য বসু শিক্ষামন্ত্রী থাকাকালীনই পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে পদত্যাগ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করছিলেন। ব্রাত্য বসু তাঁকে কোন চাপ দেন নি, একথাও চিত্তরঞ্জনবাবু বলেছিলেন সেই সাক্ষাৎকারে। তৃণমূলের অন্যতম মুখপাত্র কুণাল ঘোষও সুমন দে কে ২০২৪ এ দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন পার্থ চট্টোপাধ্যায় এসব করছেন দল জানত। বাতাসে কান পাতলে, নেতাদের সাথে জনান্তিকে কথা বললে সবাই বলবে তারা জানতেন। সম্ভবত সবাই সব কিছু জানতেন বলেই কেউই কোনও কিছু জানতেন না। শুধু ২০১২ র নিয়োগ প্রক্রিয়া যা ২০১৩-১৪ তে গিয়ে শেষ হয়, সেই প্রক্রিয়ার ইন্টারভিউতে ডাক না পাওয়া অনেক “যোগ্য” প্রার্থীর দীর্ঘশ্বাস বাতাসে মিলিয়ে গিয়েছে। স্কুল সার্ভিস কমিশন কে চেপে ধরলে তারা সম্ভবত সঠিক বলতে পারবে না বিভিন্ন বিষয়ে সর্বনিম্ন কত নম্বর পাওয়া প্রার্থীকে ইন্টারভিউতে ডাকা হয়েছিল। এ বিষয়ে তাদের একটাই মন্ত্র, উত্তরে থেকো মৌন।

    এবার আসি ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের শিক্ষক ও অশিক্ষক কর্মী নিয়োগের পরীক্ষা প্রসঙ্গে, যে পরীক্ষার নিয়োগ দুর্নীতিতে জড়িত থাকার অভিযোগে পার্থ চট্টোপাধ্যায় ২০২২ সাল থেকে এখনো জেলে। সুবীরেশ ভট্টাচার্য কমিশনের চেয়রাম্যান থাকাকালীন ২০১৬ সালে মোট চারটি নিয়োগ পরীক্ষা হয়। গ্রুপ ডি, ও গ্রুপ সি এর অশিক্ষক কর্মী নিয়োগ। ৯-১০ম শ্রেণীর ও ১১-১২শ শ্রেণীর শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা। শিক্ষক নিয়োগের পরীক্ষায় ৫৫ নম্বরের বিষয়ের উপর এমসিকিউ পরীক্ষা, যেখানে ১ নম্বরের ৫৫ টি প্রশ্ন ছিল, ৩৫ নম্বর শিক্ষাগত যোগ্যতার উপর ও ১০ নম্বর ইন্টারভিউতে ছিল।

    এই পরীক্ষায় ওএমআর শিট এর স্ক্যান করে মূল্যায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় নয়ডা স্থিত Nysa Communications নামে এক বেসরকারি সংস্থাকে, কোনরকম ওপেন টেন্ডার না ডেকেই। এই সংস্থা আবার স্কুল সার্ভিস কমিশনকে না জানিয়ে Data Scantech নামে একটি সংস্থাকে নিয়োগ করে।

    কিন্তু সমস্যার সুত্রপাত হয় ২০১৬ সালেই। টাইটানিক জাহাজ যেমন বন্দর ছেড়ে যাত্রা শুরুর মুহূর্তেই প্রায় এস এস নিউইয়র্ক নামে এক জাহাজের সাথে সংঘর্ষ বাধিয়ে বসছিল প্রায়, তেমনি ২০১৬ সালের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির কয়েকটি শর্তকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতে যান বৈশাখী ভট্টাচার্য। সেইটিই ২০১৬ সালের নিয়োগ প্রক্রিয়া সংক্রান্ত প্রথম মামলা। সুপ্রিম কোর্টের চাকরি বাতিলের রায়ে বৈশাখী ভট্টাচার্য বনাম রাজ্য সরকারের মামলাটিই প্রথম উল্লেখিত আছে, পরে ধাপে ধাপে সময়ের সাথে সাথে আরো মামলা হয়।

    সবথেকে রহস্যে ঘেরা ব্যাপার হল, ২০১৬ সালে নেওয়া পরীক্ষার ভিত্তিতে শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু হল ২০১৯ সাল নাগাদ। কোভিডের সময় লক ডাউন যখন অনেকটাই শিথিল, কিন্তু স্কুল কলেজ, অফিস, আদালতের কাজ পুরোপুরি ছন্দ ফিরে পায় নি তখনো, তখন অনেক পরীক্ষার্থীকে মোবাইলে এসএমএস পাঠিয়ে চটজলদি ইন্টারভিউ নিয়ে নিয়োগ দিয়ে দেওয়া হয়। যদিও এসব কথা চাপা থাকে না, যার ফলে ২০২১ সাল নাগাদ এসএসসির নিয়োগ প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করে একের পর এক মামলা হতে শুরু করে কলকাতা হাইকোর্টে।

    এরপরের ঘটনাপ্রবাহ মোটামুটি সকলের জানা, সে নিয়ে খুব বিশদে গেলে রাজশেখর বসুর মহাভারত হয়ে যাবে, বা তাতেও কুলোবে কিনা সন্দেহ! কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি রঞ্জিত কুমার বাগের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি তৈরি করে, সেই বাগ কমিটির রিপোর্ট পুকুর চুরি নয়, সাগর চুরির কথা তুলে ধরে তাদের রিপোর্টে।

    সিবিআই তদন্তভার নেয়, ২০২২ সালে বাগ কমিটির রিপোর্টে নাম থাকা এসএসসির দুই প্রাক্তন চেয়ারম্যান সুবীরেশ ভট্টাচাার্য, সৌমিত্র সরকার, সচিব অশোক কুমার সাহা, উপদেষ্টা শান্তি প্রসাদ সিনহা ও মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ এর সভাপতি কল্যাণময় গাঙ্গুলি গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হন পার্থ চট্টোপাধ্যায়। সিবিআই Nysa এর কর্মী পঙ্কজ বনসালের ঘর থেকে ৩ টি হার্ড ডিস্ক উদ্ধার করে যাতে ২০১৬ সালের পরীক্ষার ওএমআর এর স্ক্যানড কপিগুলি ছিল, যাকে এখন চালু কথায় মিরর ইমেজ বলে হচ্ছে।

    সিবিআই তাদের আদালতে জমা করা রিপোর্টে জানায় ওএমআর শিট ও এসএসসির দেওয়া প্রাপ্ত নম্বরে গরমিল রয়েছে এরকম সংখ্যা
    ১) নবম-দশম শ্রেণীর জন্য ৯৫২ জন শিক্ষক শিক্ষিকার ক্ষেত্রে
    ২) একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর জন্য ৯০৭ জন শিক্ষক-শিক্ষকার ক্ষেত্রে
    ৩) গ্রুপ সির ৩৪৮১ জন অশিক্ষক কর্মীর ক্ষেত্রে
    ৪) গ্রুপ ডির ২৮২৩ জন অশিক্ষক কর্মীর ক্ষেত্রে

    এছাড়াও চাকরি না পাওয়া প্রার্থীরা, যারা নিজেদের যোগ্য বলে এখনো দাবি করছেন তারা আদালতে বলেন এসএসসি শিক্ষক অশিক্ষক পদে মোট শুন্যপদের তুলনায় ২৩৫৫ টি অতিরিক্ত নিয়োগ করেছে, যেটায় পরে মন্ত্রীসভা শিলমোহর দেয়। হালে সুপ্রিম কোর্ট জানিয়েছে মন্ত্রীসভার সিদ্ধান্ত নিয়ে তদন্ত করা যাবে না, কিন্তু ওই সুপার নিউমারারি পদে নিযুক্তদের ব্যাপারে সিবিআই তদন্ত যেমন চলছে তেমন চলবে।

    এরপর ২২ শে এপ্রিল ২০২৪ এ বিচারপতি দেবাংশু বসাক ও শব্বর রশিদির ডিভিসন বেঞ্চ ২৫৭৫২ জন শিক্ষক শিক্ষিকার নিয়োগ বাতিল করেন মূলত চারটি অভিযোগকে মান্যতা দিয়ে।
    ১) মেধা তালিকার র‍্যাঙ্কে অদল বদল
    ২) মেধা তালিকার বাইরে থাকা প্রার্থীদের নিয়োগ দেওয়া
    ৩) এসএসসির সুপারিশ না করা প্রার্থীদের মধ্যশিক্ষা পর্ষৎ এর তরফে নিয়োগপত্র দেওয়া
    ৪) ওএমআর শিটে জালিয়াতি।

    সিবিআই তথ্যপ্রমাণ সহ আদালতকে জানায়
    ১) মেধা তালিকার বাইরে ১৪৯৮ জনকে শিক্ষক শিক্ষকার নিয়োগ হয়েছে
    ২) ৯২৬ জন শিক্ষক-শিক্ষিকাকে মেধা তালিকায় রদ বদল ঘটিয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে
    ৩) ৪০৯১ জন শিক্ষক-শিক্ষিকার ওএমআর শিটের প্রাপ্ত নম্বর আর এসএসসির জমা দেওয়া প্রাপ্ত নম্বরে গরমিল
    ৪) ২৩৯ জনের অন্যান্য ধরণের গরমিল।

    এই সংখ্যাটা সব মিলিয়ে ৬৭৫৪ তাহলে বাকিদের চাকরি যাচ্ছে কেন? সিবিআই এর রিপোর্টের ভিত্তিতে এবং চাকরি না পাওয়া কিন্তু নিজেদের যোগ্য দাবি করা প্রার্থীদের বক্তব্য থেকে আদালতের মনে হয়েছে গোটা নিয়োগ প্রক্রিয়াটাই শুরু থেকেই এতটা দুর্নীতিতে ভরা যে এর বাইরেও কেউ অসদুপায় অবলম্বন করেছেন কিনা বোঝা যাচ্ছে না।

    স্বাভাবিক ভাবেই রাজ্য সরকার ও চাকরিহারারা এই রায় কে চ্যালেঞ্জ করে সুপ্রিম কোর্টে যায় এবং গত ৩ রা এপ্রিল সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি সঞ্জীব খান্নার নেতৃত্বাধীন ডিভিশন বেঞ্চ কলকাতা হাই কোর্টের রায়কেই বহাল রাখেন। যাদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া গেল না, তাদেরকে শাস্তি দেওয়া চলে কিনা সে নিয়ে বিতর্ক চলতেই পারে। তবে এর পাশাপাশি মাথায় রাখতে হবে, ২৫৭৫২ জনের মধ্যে ৬৭৫৪ জনের বিরুদ্ধে সিবিআই প্রমাণ দাখিল করেছে মানে পাটিগণিতের হিসেবে বাকিরা সবাই যোগ্য এমনটিও বলা সম্ভব নয়, কারণ বাকি মামলাকারীরাও দাবি করছেন তারা যোগ্য। একই সঙ্গে টিভি, খবরের, কাগজ, রাস্তাঘাট সব জায়গায় দাবি উঠছে, এমনকি প্রাক্তন বিচারপতি অধুনা বিজেপি সাংসদ অভিজিৎ গাঙ্গুলিও দাবি করেছে এসএসসি মিরর ইমেজ প্রকাশ করুক। তাতেই নাকি দুধ আর জল আলাদা হবে। এখন সবাই যেটা জানে না, সেটা হল Nysa এর কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া হার্ড ডিস্কের মিরর ইমেজের উপর ভিত্তি করে সিবিআই যাদের অযোগ্য বলেছে তারা ওই মিরর ইমেজের বিশ্বাসযোগ্যতাকেই চ্যালেঞ্জ করে মামলা করেছে। সেই মিরর ইমেজের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য সেগুলি আপাতত হায়দ্রাবাদে কেন্দ্রীয় ফরেন্সিক ল্যাবে পরীক্ষাধীন অবস্থায় আছে। একটু রাজনৈতিক বুদ্ধি থাকা মানুষ মাত্রেই বুঝতে পারবেন যে সেগুলি সম্ভবত পরীক্ষাধীনই থেকে যাবে, যাতে সমস্যা ও জট বজায় থাকে।

    ২০১৬ সালের এসএসসি নিয়োগ নিয়ে সরকারের ব্যর্থতা আজ এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যেখানে শ্রডিঞ্জারের বিড়ালটির বাক্সের মধ্যে থাকাকালীন যুগপৎ জীবীত ও মৃতের মত বলতে হয় প্রতিটি প্রার্থী যুগপৎ যোগ্য ও অযোগ্য। এর সহজ সমাধানের রাস্তা বোধহয় তেম কিছু নেই, যাদের চাকরি গেল, তাদের দিশেহারা, মরিয়া অবস্থাটির প্রতিও যেমন সহানুভূতি জানাতে হয়, তেমন এত বছর ধরে যারা নিজেদের বঞ্চিত, যোগ্য প্রার্থী বলে দাবি করছেন তাদের কথাটিও ফেলে দেবার মত নয়। যেটা হল, ইতিমধ্যেই প্রায় অন্তর্জলি যাত্রায় যেতে বসা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটির জন্য কীর্তনীয়া বায়না দিয়ে সঙ্কীর্তন গাওয়ানোর পরিস্থিতি এসে পড়ল। তবে অভিভাবক, ছাত্র –ছাত্রীদের এ নিয়ে কতটা কী এসে যায় সে নিয়েও সন্দেহ আছে, তাদের কে তাদের প্রিয় স্যার ও দিদিমণিদের জন্য কিন্তু সেভাবে মাঠে ময়দানে দেখা যাচ্ছে না! এর কারণ কী? শিক্ষক শিক্ষিকারা কি নিজেদের দিকে একবার আয়না ধরবেন? বিশেষত কোভিডের পর তাঁরা কি বোঝেননি যে প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার গুরুত্ব অপ্রাসঙ্গিক করে দেওয়ার ছকে তাঁরা নিজেরাই নিজেদের জ্ঞানত বা অজান্তে শামিল হয়েছে? দিনের শেষে তাঁদের চাকরি যাওয়ার বিরুদ্ধে আন্দোলন শুধু তাঁদেরই আন্দোলন থেকে যাবে হয়ত। আর সাধারণ মানুষের সমর্থন ব্যতীত কোন দাবি, আন্দোলন সফলতার মুখ দেখে না।

    কেন্দ্রীভূত নিয়োগ ব্যবস্থার ভবিতব্য এটাই। সরকারি চাকরির বাজার মূল্য আকাশছোঁয়া, সুতরাং নিয়োগ ব্যবস্থা চোখের আড়ালে থাকলে দূর্নীতি হবেই। স্কুল সার্ভিস কমিশন, কলেজ সার্ভিস কমিশন এগুলো তুলে দিয়ে স্কুল পরিচালন সমিতি, কলেজ পরিচালন সমিতির হাতে নিয়োগ ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়া যেতে পারে। স্থানীয় দুর্নীতি চোখে পড়ে সহজে, তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে লড়া সহজ। আর দুর্নীতি বলতে আমি মূলত আর্থিক লেনদেনের কথা বলছি। Preference ব্যাপারটা যুগে যুগে ছিল, ওটা আটকানো যাবে না।

    স্থানীয় দুর্নীতি রোখার নাম করে আমরা পিঠের ভাগ নিয়ে বিড়ালের মত ঝগড়ায় যখন ব্যস্ত, তখন সেই পিঠের ন্যায্য ভাগ করার নামে কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা নামক বাঁদরটি সমস্ত পিঠেই নিজের পেটে চালান দিচ্ছে, এটা বুঝতে না পারলে কিছু হবে না। এ নিয়ে ভাবার সময় বোধহয় এসে গিয়েছে।

    “অপরের মুখ ম্লান ক’রে দেওয়া ছাড়া প্রিয় সাধ
    নেই।
    কেবলি আসন থেকে বড়ো, নবতর
    সিংহাসনে যাওয়া ছাড়া গতি নেই কোনো।
    মানুষের দুঃখ কষ্ট মিথ্যা নিষ্ফলতা বেড়ে যায়।“

    এ থেকে বেরিয়ে আসতে গেলে পশ্চিমবঙ্গে সবার আগে দলীয় মেরুকরণের বাইরের নাগরিক পরিসরটিকে ফেরানো সবার আগে জরুরি, নইলে লেখা শুরু করেছিলাম মৃণাল সেনের কলকাতা ৭১ এর যে কথাগুলি দিয়ে—সেই মামা কাকারাই লোক দেখানো বা প্রকারান্তরে লোক ঠকানোর কাজটি চালিয়ে যাবেন দিব্যি, কারন আমরাই সেই ভাগ্নে বা ভাইপো যারা আগে থেকে সবকিছু ঠিক করে রাখা ইন্টারভিউ দিয়ে চাকরি পেতে চেয়েছিলাম, শুধু গোলমাল টুকু হয়ে গেল বলে! নইলে কে আর প্রতিবাদ করতে নামে!


    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক।
  • আলোচনা | ১১ এপ্রিল ২০২৫ | ১১২০ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • সৌমেন রায় | 2409:40e1:100d:4f6a:8000::***:*** | ১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৬:৫৬542305
  • বেশ সুন্দরভাবে পুরো ব্যাপারটা তুলে ধরেছেন। তবে এসএসসি পরিবর্তে পরিচালন সমিতির হাতে দায়িত্ব তুলে দেওয়ার  যে প্রস্তাব দিয়েছেন সেটা সমর্থন করতে পারছি না। এই ব্যবস্থা কি সংশোধন করা অসম্ভব মনে করছেন ? প্রথম দিকের পরীক্ষাগুলোতে আমার মত অনেক সাধারণ পরিবারের ছেলে যাদের না ছিল খুঁ টির জোর, না ছিল অর্থের জোর শুধুমাত্র মেধার জোরে চাকরি করছে।
  • PRABIRJIT SARKAR | ১২ এপ্রিল ২০২৫ ১৭:২৩542306
  • সৌমেন বাবুর সঙ্গে এক মত। আগেকার সিস্টেমে কোন বিজ্ঞাপন না দিয়ে কোন মামা ভাগ্নে কে বলত 'কাল থেকে এস' চাকরি হয়ে যেত। আদালতে যাওয়ার সিন ছিল না। সরকার যদি চোরদের নিয়ে চোরদের জন্য হয় এরকম স্ক্যাম হতে পারে। তবে কোর্ট এখনো আছে। তাই এই ন্যায় বিচার হল। চোরদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিলে হয়তো পরের বার এরকম হবে না।
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। ঝপাঝপ প্রতিক্রিয়া দিন