করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরে কেটে গেছে প্রায় সাত-আট মাস। ক্রমশ বোঝা যাচ্ছে করোনা চিকিৎসা বিজ্ঞানের পরিধি অতিক্রম করে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আলোচনার মধ্যে ঢুকে আসছে। করোনার তাৎক্ষণিক প্রভাবে কর্মচ্যূতির নানান কাহিনি প্রতিদিন উঠে আসছে সংবাদপত্র ও গবেষণা পত্রের পাতায়। লকডাউনের সময় পরিযায়ী শ্রমিকদের অসীম দুর্দশার কথাও ইতিমধ্যে বহু আলোচিত। কিন্তু এটাও ঠিক যে করোনার যে যে অর্থনৈতিক প্রভাবগুলি নিয়ে সাধারণত আলোচনা হয় সেগুলি স্বল্পমেয়াদী। ইতিমধ্যে সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর থেকে আমরা জেনেছি পরিযায়ী শ্রমিকদের অনেকেই তাদের পুরনো কাজের জায়গায় ফিরতে শুরু করেছে, Centre for Monitoring for Indian Economy’র প্রতিবেদন অনুযায়ী বেকারি হার অল্প হলেও কমতে শুরু করেছে, যদিও তা হয়ত মূলত গ্রামীণ প্রকল্পের মাধ্যমেই। যে হারে বেকারত্ব কমছে তা যথেষ্ট কিনা তা নিশ্চয়ই বিতর্ক থাকতে পারে। তাছাড়া স্বল্পমেয়াদে কর্মহীনতার সমস্যাও অবজ্ঞা করার নয়। কিন্তু করোনা আজ নয় কাল যখন মিটে যাবে তখন এই সমস্যাগুলির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব অর্থনীতিতে নাও থাকতে পারে। আমি এই প্রবন্ধে একটি সম্ভাব্য দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব নিয়ে আলোচনা করতে চাই। উন্নয়নের প্রক্রিয়া সাম্প্রতিককালে যে নীতি অবলম্বন করে এগোয়, করোনা একভাবে সেটাকে নিয়েই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে। করোনার টিকা বেরিয়ে যাওয়ার পরে বা পরিযায়ী শ্রমিকরা কাজে ফিরে যাওয়ার পরেও যে প্রশ্নগুলি থেকেই যাবে। আমার উদ্দেশ্য সেই অনালোচিত, দীর্ঘমেয়াদী প্রশ্নকেই আরেকটু উস্কে দেওয়া।
উন্নয়নের ভূগোল
উন্নয়নেরও একটা ভূগোল আছে। করোনা সংক্রমণেরও। এই দুই ভূগোলে কোন সম্পর্ক আছে কিনা বা করোনা সংক্রমণ, উন্নয়নের ভূগোলকে কোনভাবে প্রশ্নের মুখে ফেলে দেয় কিনা সেটা দেখাটাই আমার উদ্দেশ্য। তাই করোনার ধানে পৌঁছনর আগে, ভূগোলের শিবের গীত একটু গেয়ে নেওয়া প্রয়োজন। উন্নয়নের ভূগোলের বিষয়টা অভিজ্ঞতা থেকে কথাটা আমরা জানতাম অনেকদিন ধরেই, কিন্তু তার একটা সুগঠিত তত্ত্ব আসতে লেগে গেল ১৯৮০-৯০ এর দশক, আর সেটা এল অর্থনীতিবিদ পল ক্রুগম্যানের (Paul Krugman) হাত ধরে, যার জন্য তিনি নোবেল পাবেন ২০০৮ এ। অর্থনীতির ভুগোলের মূল কথা হল উন্নয়ন প্রক্রিয়া একটি আঞ্চলিক বৈষম্য তৈরি করে এবং সেই বৈষম্য যে শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক তাই নয়, সেটা আন্তর্দেশীয়ও বটে। এর মানে হল, উন্নয়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে চললে কোন একটি দেশের মধ্যেও একজায়গায় সব কলকারখানা, উন্নয়ন জড়ো হবে আর অন্যদিকে থাকবে অন্ধকার (আক্ষরিক অর্থেই, ছবিতে বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার হবে)। এই অবধি পড়েই হয়ত আপনার চোখে কলকাতার আলো আর পুরুলিয়ার অন্ধকার ভেসে উঠছে, কিন্তু মনে রাখা দরকার উন্নয়নের এই কাঠামো বিশ্বজনীন। পৃথিবীর ধনীতম দেশও এই নীতির বাইরে নয়। এই কাঠামোটি বোঝার সবচেয়ে ভালো উপায় হল উপগ্রহ থেকে নেওয়া রাতের আলোর ছবির দিকে চোখ রাখা, যা নাসা নিয়মিত ভাবে প্রকাশ করে চলে এবং এই রাতের আলোর (Nightlights) তথ্য কোন স্থানের উন্নয়নের মাপকাঠি হিসেবে অর্থনীতির গবেষণায় বহুল ব্যবহৃত। নিচের ছবিতে আমেরিকার রাতের আলোর চেহারাটা দেখে নেওয়া যাক। ছবি দেখলেই বুঝবেন যে আমেরিকার উপকূলবর্তী এলাকায় যত আলো আর মাঝখানটা অন্ধকার। আসলে আমেরিকার প্রায় সব শিল্প এবং পরিষেবা ক্ষেত্র দুই উপকূলে, মধ্যিখানটা মূলত কৃষিপ্রধান এবং জনবিরল। রাতের ছবির এই আলো দেখে উন্নয়নের একটা সহজ পরিমাপ পাওয়া সম্ভব।
চিত্র ১-আমেরিকার রাত্রিকালীন আলোর উপগ্রহ থেকে তোলা ছবি। সুত্র- নাসা ওয়েবসাইট।
একই রকম ভাবে ভারত, অন্য দেশ, এমনকি ভারতের কোন গ্রাম বা শহরেরও রাত্রিকালীন আলোর ছবি পাওয়া সম্ভব। এখানে ভারত ও তার আশেপাশের অঞ্চলের ছবি দিলাম। (এই ধরণের একটা ছবি দেওয়ালির আগে খুব ঘোরে যদিও সেটা একেবারেই ভুয়ো। আমরা হাউই ছুঁড়ে যতই আনন্দ পাই না কেন, উপগ্রহ থেকে সেই আলো দেখা যায় না। এটা যে ভূয়ো সেটা নাসা জানিয়েছিল ২০১২ তে যা বিস্তারিত জানতে লিঙ্ক দেখতে পারেন। তবু বোরিং সত্যি কে-ই বা কবে জানতে চায়!)
চিত্র ২- দক্ষিণ ও পশ্চিম এশিয়ার রাত্রিকালীন আলোর উপগ্রহ চিত্র। (সূত্র- নাসা)
এবার আসল আলোচনায় ফিরি। এই ছবি গুলো থেকে যে জিনিসটা পরিষ্কার সেটা হল উন্নত, উন্নয়নশীল যে রকম দেশই, উন্নয়ন মোটের ওপর আঞ্চলিক বৈষম্যের কাঠামো অনুসরণ করে এগোয়। কিন্তু কেন এরকম হয়? আমি খুব সংক্ষেপে বিষয়টা আলোচনা করছি। এমনিতে কোথাও কোন প্রাকৃতিক (মুম্বইতে স্বাভাবিক সমুদ্রবন্দর) বা ঐতিহাসিক (কলকাতা ভারতের পুরনো ব্রিটিশ রাজধানী) সুবিধে থাকলে এটা হতেই পারে। ক্রুগম্যান দেখালেন দুটো অঞ্চলের অন্য কোন পার্থক্য না থাকলেও একজায়গায় শুধুমাত্র বেশি ব্যবসা আছে বলেই নতুন ব্যবসা সেখানে ভিড় জমাতে পারে। আমি একটা উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা স্পষ্ট করছি। ধরুন, আপনি একজন ডাক্তার। এবার আপনি একটা নার্সিংহোম খুলতে চান এবং তার জন্য আপনার সম্ভাব্য দুটো জায়গা হল কলকাতা আর পুরুলিয়া। এবার আপনি কোথায় নার্সিংহোম খুলবেন? কলকাতায় নার্সিংহোম খোলার সুবিধে দুটো। এক, এখানে বেশিরভাগ বড়লোক থাকে তাই বাজারের আকার বড়। দুই, কলকাতা যেহেতু অন্য ব্যবসারও কেন্দ্রস্থল তাই অন্য ভোগ্যবস্তুর দাম কম। আপনি হয়ত ভাবছেন পুরুলিয়ার বাজারে সস্তায় সবজি পাবেন (এবং হয়ত পাবেনও) কিন্তু অন্য যেকোন জিনিস – সসেজ থেকে স্মার্টফোন সবকিছুর দামই পুরুলিয়াতে অনেক বেশি হবে এবং এমন অনেক কিছু থাকবে (যেমন পার্ক স্ট্রিট এর রেস্তোরাঁর খাবার, বাচ্চার জন্য ভালো ইংরাজি মিডিয়াম স্কুল ইত্যাদি) যা পেতে গেলে আপনাকে কলকাতায় আসতেই হবে। সেই কারণে, পুরুলিয়াতে নার্সিংহোম খুললে, আপনার কর্মীদের ধরে রাখার জন্য কলকাতার তুলনায় মাইনে অনেক বেশি দিতে হবে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে হয়ত পুরুলিয়াতে থাকা কর্মীদের খরচ কম হতে পারে, যেমন বাড়িভাড়া। কিন্তু বেশিরভাগ জিনিসের জন্যই কলকাতায় থাকা একজনের তুলনায়, পুরুলিয়াতে থাকা কর্মীর খরচ অনেক বেশি হবে। তার মানে ডাক্তারবাবু যদি কলকাতায় নার্সিংহোম খোলেন বড় বাজার এবং কর্মীদের কম মাইনে – এই দুদিক থেকে তাঁর সুবিধে। কিন্তু পুরুলিয়াতে সুবিধে হল সেখানে আর কোন নার্সিংহোম না থাকার কারণে তাঁর সামনে প্রতিযোগিতা কম – তিনিই সেখানে একচ্ছত্র অধিপতি। এখন এই দুই ধরণের সুবিধের মধ্যে যেটি বেশি হবে সেটিই নির্ধারণ করে দেবে যে নার্সিংহোম কেন্দ্রে (অর্থাৎ কলকাতায়) হবে না পরিধিতে (অর্থাৎ পুরুলিয়াতে)। ক্রুগম্যান দেখালেন যে যোগাযোগ ব্যবস্থার যত উন্নতি হতে থাকে, তত পরিধিতে থাকা ব্যবসায়ীর স্থানীয় বাজারে আধিপত্য কমতে থাকে, কারণ তখন সহজেই কেন্দ্র থেকে ব্যবসায়ীরা এসে পরিধিতে জিনিস বিক্রি করে চলে যায়। নার্সিংহোম এর ক্ষেত্রে হয়ত বিক্রেতারা যাবেন না, কিন্তু ক্রেতারা সহজেই কলকাতায় এসে চিকিৎসা পরিষেবা কিনে নিয়ে যাবেন। ফলাফল কিন্তু একই – পরিধিতে ব্যবসা খোলার সুবিধে কমবে। ক্রুগম্যান এর তত্ত্ব তাই বলছে যত যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে, কেন্দ্রে উন্নয়ন কেন্দ্রীভূত হবে। যদিও পরবর্তী গবেষণায় ক্রুগম্যান দেখাচ্ছেন যদি যোগাযোগ ব্যবস্থার আরও অনেক উন্নতি হয় এবং পরিধিতে শ্রম সস্তা হয় তাহলে ব্যবসা আবার পরিধিতেও ফিরতে পারে (উদাহরণ, চিন ও পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক উত্থান)। কেন্দ্র ও পরিধির সম্পর্ক ঠিক কি হবে সেটার নানারকম তাত্ত্বিক সম্ভাবনা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যেকোন অন্তর্দেশীয় ও আন্তর্জাতিক দুদিকেই এই কেন্দ্র-পরিধি কাঠামো রয়ে গেছে।
পড়ুন: লকডাউনে ব্যতিক্রমী হকারটাউনে
করোনা ও কেন্দ্র-পরিধির কাঠামো
উন্নয়নের ভূগোল মোটের ওপর এই কেন্দ্র-পরিধির কাঠামো মেনেই চলে। আর এখানেই করোনার সংক্রমণ একটা নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া গত অনেক বছর ধরেই যে নীতি ধরে এগিয়েছে সেটা হল সংযোগের নীতি। এই সংযোগটা কখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রূপে এসেছে, কখনো কেন্দ্র-পরিধির রূপে। এই নীতির মূল কথা হল একেকটা অঞ্চল একেক ধরণের উৎপাদন করবে আর তারপর তারা প্রয়োজন মত বিনিময় করে নেবে। এই নীতি আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রযোজ্য। এর একদিকে আমেরিকা প্রযুক্তির ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করবে আর চিন উৎপাদন করবে এটা যেমন রয়েছে, তেমনি কারখানা থাকবে মহারাষ্ট্র, গুজরাট বা কর্নাটকে আর শ্রমিক যাবে বিহার বা উত্তর প্রদেশ থেকে, এটাও রয়েছে। এই নীতির মূল কথা হল বিশেষীকরণ এবং বিনিময়। এমনিতে এই নীতিতে অর্থনীতির সংগঠন খুবই কার্যকরী এবং সে কারণেই ঐতিহাসিক ভাবেই একটি সফল। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক হল এক জায়গায় সংকট সৃষ্টি হলে, তা খুব দ্রুত অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু প্রতিটা অঞ্চলই অন্য অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল, তাই কারও পক্ষে চট করে পাঁচিল তুলে দেওয়া মুশকিলের। এই সমস্যাটা প্রথম বোঝা গেছিল ২০০১ এর এশিয়ান আর্থিক সঙ্কটের সময় যখন খুব দ্রুত সঙ্কট এশিয়া থেকে প্রায় সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেক্ষেত্রেও তখন Contagion শব্দটা ব্যবহৃত হত, যা আজ অতিমারীর ক্ষেত্রেও ব্যবহার হচ্ছে। কিন্তু সেটা ছিল আর্থিক সঙ্কট, যার সমাধানও আর্থিক। এশিয়ার অনেক মানুষ সেই সঙ্কটে পথে বসলেও, এত মানুষের মৃত্যু হয়নি পৃথিবী জুড়ে। শেষ এরকম মহামারী হয়েছিল ১৯১৮’র স্প্যানিশ ফ্লুতে। কিন্তু তখনও রোগ ছড়িয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সৈনিক আর যুদ্ধবন্দিদের মাধ্যমে। বিশ্বায়নের সংযোগ ধরে নেমে আসা এরকম বিশ্বজনীন স্বাস্থ্য সঙ্কট এই প্রথম। কিন্তু সংযোগের সূত্র ধরে রোগ ছড়ানোর বিষয়টি যে শুধু আন্তর্জাতিক এরকম নয়। এই সুত্র অন্তর্দেশীয় সংযোগের ক্ষেত্রেও একই ভাবে প্রযোজ্য।
খাপ বললে কিছু বছর আগে কলম বা তলোয়ারের অনুষঙ্গ আসত। এখন অবশ্য ফেসবুক, কিংবা হরিয়ানা। খুব জোর যোগেন্দ্র যাদব কী বলেছিলেন বা রায়া সরকার! সিরিয়াস৯-র পরের সংখ্যা খাপ নিয়ে। লিখছেন তাতিন বিশ্বাস, বল্লরী সেন, প্রতীক, শাশ্বতী দত্তরায়, অভিজ্ঞান সরকার। খাপ এড়াবেন না।
বিষয়টি খুব গভীর ভাবে, অর্থনৈতিক আলোচনায় ব্যবহৃত রাশিবিজ্ঞানের রীতিনীতি মেনে দেখানোর উপায় এখানে নেই। আমি শুধু বিষয়টির একটু আভাস দিচ্ছি, অনেকটা সিনেমার ট্রেলারের মত। আমার বক্তব্য হল, যেসব রাজ্যে এই কেন্দ্রে-পরিধির কাঠামো বেশি শক্তিশালী, অর্থাৎ আঞ্চলিক বৈষম্য বেশি সেসব রাজ্যে করোনা ছড়াবার সম্ভাবনা বেশি। এখন কোন রাজ্যে আঞ্চলিক বৈষম্য বেশি সেটা বোঝার উপায় কি? আমরা পূর্বে আলোচিত রাত্রিকালীন আলোর সম্যক বিচ্যুতি (Standard Deviation) ব্যবহার করে তার একটা ধারণা পেতে পারি। অন্য পরিমাপও ব্যবহার করা যেতে পারে, যদিও সব পরিমাপের নিজস্ব কিছু সুবিধে-অসুবিধে আছে। যাঁরা রাশিবিজ্ঞানের সাথে পরিচিত নন, তাঁদের জন্য সম্যক বিচ্যুতির ধারণাটি একটু সংক্ষেপে বলছি। ধরা যাক, পশ্চিমবঙ্গের সব জেলার (কোচবিহার, দার্জিলিং, কলকাতা,পুরুলিয়া ইত্যাদি) জন্য রাত্রিকালীন আলোর একটি পরিমাপ আমি নিয়েছি। এর থেকে আমি একটি রাজ্যের গড় রাত্রিকালীন আলোর পরিমাপ পেলাম। এবার মাপছি প্রতি জেলার রাত্রিকালীন আলোর মানটি, রাজ্যের গড়ের থেকে কতটা আলাদা। এই পার্থক্য (বা বিচ্যুতি) বিভিন্ন জেলার জন্য বিভিন্ন রকম হবে। হয়ত কলকাতা রাজ্য-গড়ের একটু বেশি কাছে, পুরুলিয়া গড় থেকে একটু দূরে এরকম। এবার আমরা এই পার্থক্যগুলির একটি গড় নিলে সেটা রাজ্যের জেলাগুলি একে অপরের থেকে রাত্রিকালীন আলোর বিচারে কতটা ছড়িয়ে আছে তার একটা ধারণা পাওয়া যাবে – এই পরিমাপটিকেই সম্যক বিচ্যুতি বলে। (একটু বেশি সহজ করে বলার প্রয়াসে আমি কয়েকটা জটিল বিষয় বাদ দিলাম, আগ্রহী পাঠক একটু wiki করে দেখে নিতে পারেন।) মোদ্দা ব্যাপার হল, যে রাজ্যে সম্যক বিচ্যুতি বেশি, সেখানে জেলাগুলির রাত্রিকালীন আলোর মান ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, অর্থাৎ, সেখানে আঞ্চলিক বৈষম্য বেশি যা কেন্দ্র-পরিধি কাঠামোর একটি সূচক। আমাদের ধারণা সেইসব জায়গায় করোনা সংক্রমণ আটকানো তত কঠিন। নিচের রেখাচিত্রে বিভিন্ন রাজ্যের রাত্রিকালীন আলোর সম্যক বিচ্যুতির মান দিলাম।
চিত্র ৩- ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে রাত্রিকালীন আলোর সম্যক বিচ্যুতি (Standard deviation)
Source: Chakraborty, T and Mukherjee, A, Economic structure and contagion: A study on Covid 19 outbreak in India, 2020, Working Paper
এবার দেখুন যেসব রাজ্যে সংক্রমণ খুব বেশি যেমন, মহারাষ্ট্র, তামিলনাডু বা গুজরাটে সম্যক বিচ্যুতির মানও বেশ ওপরের দিকে। অন্যদিকে, কেরালা, যেখানে করোনা সংক্রমণকে সাফল্যের সাথে আটকে দেওয়া গেছে সেখানে এই সম্যক বিচ্যুতির মান বেশ কম। কেরালার মতই সম্যক বিচ্যুতি রয়েছে মধ্যপ্রদেশে এবং মধ্যপ্রদেশের করোনা সংক্রমণ নিয়ে খুব একটা আলোচনা চোখে পড়ে না। কিন্তু ২২ আগস্টের হিসেবে কেরালায় যেখানে প্রতি ১০ লাখে সংক্রমণ ১৬০৪, মধ্যপ্রদেশে তা মাত্র ৬৩০ (সূত্র- https://www.covid19india.org/)। অর্থাৎ, কম আলোচিত হলেও মধ্যপ্রদেশও সংক্রমণ প্রতিরোধে যথেষ্ট সফল। আমরা একবার দেখে নিই অগাস্টের ১০ তারিখ অবধি ভারতের করোনা সংক্রমণের পরিস্থিতি। নিচের রেখাচিত্রে জনসংখ্যার অনুপাতে সংক্রমণের চিত্রটি দিলাম। এখানে মোট আক্রান্তের সংখ্যাকে জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করা হয়েছে।
চিত্র ৪- মাথাপিছু সংক্রমণের হার, ১০ অগাস্ট, ২০২০ অবধি
(Source: Chakraborty, T and Mukherjee, A, Economic structure and contagion: A study on Covid 19 outbreak in India, 2020, Working Paper)
উপরের আলোচনা থেকে যে সিদ্ধান্ত আমরা করতে চাইছি, তা নিয়ে নানারকম সঙ্গত আপত্তি উঠতেই পারে। যেমন, সাধারণ ভাবে কেন্দ্র-পরিধির কাঠামো যে সব রাজ্যে আছে তারা শিল্পোন্নত। এবার এই ধরণের রাজ্যে জনঘনত্ব বেশি এবং তারা আরো অনেক রকম পরিকাঠামোগত বিষয়েই অন্যরকম। এই সব পার্থক্যও করোনা সংক্রমণে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা নিতে পারে। তাহলে কি করেই বা বোঝা গেল যে কেন্দ্র-পরিধি কাঠামোই সংক্রমণ বৃদ্ধির জন্য দায়ী? এটা খুবই সঙ্গত প্রশ্ন, কিন্তু এই পরিসরে তার উত্তর দেওয়া সম্ভব নয়। কারণ সেই উত্তর যে ধরণের পর্যালোচনা দাবী করে (অর্থাৎ multivariate regression) তা এখানে করা যাবে না। আপাতত, আমি শুধু একটা ভাবনা উসকে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। কিন্তু সেটা কোন ভাববিলাসী ভাবনা নয়, তার পেছনে কিছু প্রাথমিক যুক্তি অন্তত আছে। সেই যুক্তি আঞ্চলিক বৈষম্যভিত্তিক কেন্দ্র-পরিধি মডেলকেই প্রশ্নের মুখে ফেলছে যাকে আমরা করোনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব বলে চিহ্নিত করতে পারি। অথচ স্থানীয় সম্পদভিত্তিক উন্নয়নের অন্য মডেল যে আমাদের সামনে ছিল না তা কিন্তু নয়। গান্ধীর গ্রাম-স্বরাজের ধারণা বা রবীন্দ্রনাথের গ্রামোন্নয়নের মডেল কিন্তু কেন্দ্র-পরিধি কাঠামোর বিপ্রতীপ অবস্থান নেয়। কিন্তু সেই সব আলোচনা এতদিন অবিহেলিতই ছিল। করোনা হয়ত সেইসব গুরুত্বপূর্ণ বিতর্ককেই আবার সামনে নিয়ে এল।
রাতের আলোর বিস্তার ও বিচ্যুতি দিয়ে বোঝানোর পদ্ধতিটি আকর্ষণীয়।
তবে multivariate regression ছাড়াও সহজ কথায় কার্যকারণ না বোঝালে centre-periphery model এর সংগে করোনার সম্পর্ক পরিষ্কার হচ্ছে না। এই correlation টা spurious মনে হতে পারে।
আন্চলিক বৈষম্য তো rural-urban migration এরও গোড়ার কথা, যা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও সত্য। সেই অতি পুরাতন প্রশ্ন, why are we so rich and they do poor?
এই regression এ explanatory variable গুলি কী?
উৎপাদন, আয় ইত্যাদি ছাড়াও জনঘনত্ব, আদানপ্রদানের খোলামেলা ভাব (openness to trade) ইত্যাদি? যদি তাই হয়, তবে গবেষণালব্ধ ফলটা সহজেই বোঝা যায়। তাতে আলোর চমক থাকলেও ভাবনায় নতুন দিশা আছে কি?
সম্যক বিচ্যুতি আসলে একটি ভ্যারিয়েন্সের পরিমাপ, কে কতটা কেন্দ্র থেকে কাছে বা দূরে। আলোর ভ্যারিয়েনস দিয়ে কতজন মানুষ তাঁদের উপস্থিতি, কাজকর্ম বোঝার চেষ্টা হচ্ছে। তার সঙ্গে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণের নিয়ন্ত্রণের কোরিলেশন থাকতে পারে। তাহলে আরো একটি তৃতীয় ভ্যারিয়েবল এর কনফাউণ্ডার। সেটা হয়ত কোন মানুষ ঘরের ভেতরে আবদ্ধ এবং আলো সেখান থেকে আসছে।
আরো একটা ব্যাপার। করোনাভাইরাস একটি Poisson process । একে সরাসরি লিনিয়ার মডেল দিয়ে ব্যাখ্যা করা যাবে না।
করোনা কিভাবে ছড়ায়, তার মেক্যানিজম (ভাইরাস, ড্রপলেট ইত্যাদি) তো আমাদের জানা, তাই সরাসরি তাই সরাসরি সংক্রমণ ছড়ানোর ম্যাপ, এবং হিসেব করা যায়। যে হিসেবের মূলে একটা কার্য-কারণ সম্পর্ক (কজেশান) আছে এবং সেটা ধরে হিসেব করা যায়। এর কোন আলাদা প্রক্সি (রাতের আলো) - যা সরাসরি সম্পর্কযুক্ত নয় তার দরকার নেই। কারণ আলাদা প্রক্সির সঙ্গে কোরিলেশান দেখানো যায় কিন্তু কজেশান দেখানো যায় না। তাই কোরিলেশান-টা স্পুরিয়াস কিনা সেটা যাচাই করা সম্ভব নয়।আর জনঘনত্ব বা মেট্রোপলিটান এরিয়ার উপস্থিতি দিয়ে অনেক সহজেই বোঝা যায় অনেক মানুষের একজায়গায় আসার সম্ভাবনা কোথায় বেশি - বদ্ধ ঘরে থাকার সম্ভাবনা (অফিস, রেস্তোরাঁ ইত্যাদি) কোথায় বেশি। সেগুলো সরাসরি হিসেবের মধ্যে আনা অনেক সহজ এবং রিজনেবল। রাতের আলোকে ধরে করোনা ছড়াবার ম্যাপ বোঝা বেশ ফার-ফেচড বলেই মনে হল।
আমার মনে হয় মূল কথাটি আমার বোঝাতে একটু ভুল হয়েছে। এখানে দুটি প্রশ্ন এসেছে। আমি তার একটা উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করছি।
১। রাত্রিকালীন আলো দিয়ে কী অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মাপা যায়?
রাত্রিকালীন আলো দিয়ে অর্থনৈতিক কর্মকান্ড মাপাটা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে এখন বহুল প্রচলিত। আমি তাই খেয়াল রাখি নি যে যাঁরা সেই সব গবেষণার সাথে তত পরিচিত নন তাঁরা এটা নাও মানতে পারেন। রাত্রিকালীন আলোকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের মাপকাঠি ধরে প্রচুর গবেষণা হচ্ছে। উপগ্রহের চিত্রে যে আলো ধরা পরে সেটা কিন্তু বাড়ির, বন্ধ ঘরের আলো নয়। মূলত বড়, বড় কারখানার আলো। আমি দুটি লিঙ্ক দিচ্ছি, পড়ে দেখতে পারেন।
দ্বিতীয়টি বিমুদ্রাকরণ এবং অর্থনৈতিক ফলাফল নিয়ে গীতা গোপিনাথ ও অন্যদের গবেষণা। তার একটি সার সংক্ষেপ আপনারা দেখে থাকবেন (https://theprint.in/economy/demonetisation-hit-growth-by-2-points-says-paper-by-gita-gopinath-3-other-experts/165547/)। কিন্তু এই যে এনারা বিমুদ্রাকরণের পরে অর্থনৈতিক কার্যকলাপের পরিমাপ করলেন সেটা কী ভাবে? তাতে সার্ভে ডেটা যেমন আছে তেমনই আছে রাত্রিকালীন আলোর তথ্য। সেটা মূল পেপার বা তার abstract পড়লেই বুঝতে পারবেন। সেটারও লিঙ্ক দিলামঃ https://scholar.harvard.edu/files/gopinath/files/crgmn_demonetization.pdf
আশা করি আপনারা মানবেন যে রাত্রিকালীন আলো দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নতি মাপার পদ্ধতিটি এখন অর্থনীতিবিদদের মহলে একটি স্বীকৃত উপায়। আমি শুধুমাত্র সেটাই ব্যবহার করেছি।
২। রাত্রিকালীন আলোর সাথে করোনা সংক্রমণের যোগাযোগ কী?
রাত্রিকালীন আলোর সাথে করোনা সংক্রমণের কোন সরাসরি সংযোগ নেই। রাত্রিকালীন আলো শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির একটি প্রক্সি। করোনার সম্পর্ক এই অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির ভৌগোলিক বিভাজনের সাথে। আমি এটা একজায়গায় লিখেছি
"আমাদের উন্নয়ন প্রক্রিয়া গত অনেক বছর ধরেই যে নীতি ধরে এগিয়েছে সেটা হল সংযোগের নীতি। এই সংযোগটা কখনো আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের রূপে এসেছে, কখনো কেন্দ্র-পরিধির রূপে। এই নীতির মূল কথা হল একেকটা অঞ্চল একেক ধরণের উৎপাদন করবে আর তারপর তারা প্রয়োজন মত বিনিময় করে নেবে। এই নীতি আন্তর্জাতিক এবং আভ্যন্তরীন বাণিজ্যের ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রযোজ্য। এর একদিকে আমেরিকা প্রযুক্তির ব্লু-প্রিন্ট তৈরি করবে আর চিন উৎপাদন করবে এটা যেমন রয়েছে, তেমনি কারখানা থাকবে মহারাষ্ট্র, গুজরাট বা কর্নাটকে আর শ্রমিক যাবে বিহার বা উত্তর প্রদেশ থেকে, এটাও রয়েছে। এই নীতির মূল কথা হল বিশেষীকরণ এবং বিনিময়। এমনিতে এই নীতিতে অর্থনীতির সংগঠন খুবই কার্যকরী এবং সে কারণেই ঐতিহাসিক ভাবেই একটি সফল। কিন্তু এর সবচেয়ে বড় সমস্যার দিক হল এক জায়গায় সংকট সৃষ্টি হলে, তা খুব দ্রুত অন্য জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। যেহেতু প্রতিটা অঞ্চলই অন্য অঞ্চলের ওপর নির্ভরশীল, তাই কারও পক্ষে চট করে পাঁচিল তুলে দেওয়া মুশকিলের। "
মূল সুত্রটি এইখানে আছে যেখানে বলা হচ্ছে উন্নয়ন প্রক্রিয়া এই যোগাযোগের দাঁড়িয়ে আছে এবং এই যোগাযোগ বিভিন্ন অঞ্চলের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির উপর নির্ভর করে যা আমরা মাপছি রাত্রিকালীন আলো দিয়ে। করোনা কিভাবে ছড়াবে সেটাও বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে কি ধরণের যোগাযোগ তার ওপর নির্ভরশীল। যে গ্রাম স্বয়ংসম্পূর্ণ সেখানে শহর থেকে রোগ আসার সম্ভাবনা কম -- ব্যপারটা সরলীকরণ করে বললে অনেকটা এইরকম। এখানেই করোনা এবং অর্থনৈতিক ভূগোলের সম্পর্ক। আমি হয়ত ঠিকভাবে বোঝাতে পারিনি, সেটা আমার ব্যর্থতা। কিন্তু এটা ঠিক spurious correlation এর ব্যপার নয়। এর পেছনে একটি তাত্ত্বিক বক্তব্য আছে।
এর বাইরে আর যা প্রশ্ন আছে সেগুলি বেশ টেকনিক্যাল। তার উত্তর আমি এখানে দিতে অক্ষম। কিন্তু উত্তর আছে। আমাদের গবেষণা পত্রটি সম্পূর্ণ হলে এবং কোথাও Discussion Paper হিসেবে অন্তত রাখলে আমি তার লিঙ্ক দিয়ে এখানে দেব না হয়। তখন বাকি প্রশ্নের উত্তর আশা করি পেয়ে যাবেন। সেখানে যদি কিছু জিনিষ ঠিক বলে মনে না হয় তখন নাহয় সেই আলোচনা করা যাবে।