নতুন কৃষি আইন নিয়ে ভারতে রাজনৈতিক সক্রিয়তা এখন তুঙ্গে। দু এক মাস আগেও যা ছিল রাজনৈতিক দলগুলির মৃদু আপত্তি তা ইতিমধ্যেই এক স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক আন্দোলনে পর্যবসিত। কৃষকরা তাঁদের লড়াই লড়ছেন, কৃষি আইনের সমস্যাগুলি তাঁরা বোঝেন তাঁদের দৈনন্দিন জীবন থেকে। কিন্তু অ-কৃষি পেশায় নিযুক্ত নাগরিক সমাজের সদস্য হিসেবে আমাদের একটা দায় থেকে যায় নৈর্ব্যক্তিক তথ্যের আঙ্গিকে বিষয়টি ভাল করে বুঝে নেওয়ার।
কৃষি আইন নিয়ে মূল আপত্তির জায়গা তিনটি – মান্ডি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থা তুলে দেওয়া এবং চুক্তিচাষে উৎসাহ দান। প্রতিটি বিষয় নিয়ে আলাদাভাবে আলোচনার আগে দেখে নেওয়া দরকার ভারতে কৃষি আদৌ লাভজনক কিনা।
ভারতে কৃষি কি আদৌ লাভজনক?
সাধারণ ভাবে কৃষি নিয়ে দুরকম ধারণা রয়েছে পরিষেবা ক্ষেত্রের সাথে যুক্তদের মধ্যে – একাংশ মনে করেন কৃষকরা হতদরিদ্র আর কিছু মানুষের ধারণা কৃষি একটি অতি-লাভজনক পেশা। সমাজকে বোঝার জন্য ব্যক্তি অভিজ্ঞতা যে মূল্যহীন তা নয়, কিন্তু ব্যক্তি অভিজ্ঞতার পরিসরটি ব্যক্তির সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে নির্ধারিত হয়, তাই সেই অভিজ্ঞতায় নির্বাচন-পক্ষপাতের সমস্যা (Selection bias problem) থাকে। ভারতীয় কৃষির লাভজনকতার বিষয়টি তথ্যের আলোকে দেখার চেষ্টা করা যাক।
আরও পড়ুন, কৃষক আন্দোলনের দাবির নেপথ্যে
কৃষিতে লাভের প্রসঙ্গে আসার আগে কয়েকটি বিষয় একটু ভালভাবে বোঝা দরকার। কৃষিতে লাভ হিসেবের বিষয়টি ঠিক বড় ব্যবসায় লাভের হিসেবের মত নয় যেখানে লাভের অঙ্ক আয় থেকে বিভিন্ন উপকরণের ব্যয় (যার মধ্যে মজুরিও আছে) বাদ দিয়ে পাওয়া যায়। তার বড় কারণ কৃষক এমন অনেক উপকরণ ব্যবহার করেন যা তিনি বাজার থেকে কেনেননি। কৃষিতে লাভ হিসেব করার যে কয়েকটি স্বীকৃত পদ্ধতি আছে তা আসলে কৃষির ব্যয় নির্ধারণের বিভিন্ন পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। কৃষির ব্যয়ের তিনটি প্রচলিত পদ্ধতি আছে যা সাধারণত গবেষকরা ব্যবহার করে থাকেন (যদিও Commission for Agricultural Costs and Prices (CACP) মোট আটটি ব্যয় নির্ধারণের পদ্ধতি উল্লেখ করেছে)।
A2: যে ব্যয় কৃষক অন্য কাউকে টাকা দেওয়ার মাধ্যমে নির্বাহ করছেন
A2 + FL: A2 এবং পারিবারিক শ্রম বাবদ আরোপিত ব্যয় (imputed cost)
C2: A2 + FL + কৃষকের মালিকানাধীন পুঁজি থেকে প্রাপ্ত সুদ + মালিকানাধীন জমির খাজনার মূল্যমান + ভাড়ায় নেওয়া জমির খাজনা।
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যাবে কৃষির ব্যয় হিসেবের পদ্ধতির অনেকটাই আরোপিত ব্যয়নির্ভর। ব্যয় ও লাভের হিসেব পেতে তাই এমন গবেষণাপত্রের দ্বারস্থ হতে হয়, যেখানে এই ব্যয় এস্টিমেট করা হয়েছে। ব্যয় হিসেবের এই সমস্যার কারণে সব গবেষকই দু’রকম লাভের অঙ্ক প্রকাশ করেন – একটা A2 ধরে, অন্যটা C2 ধরে। এরকমই একটি গবেষণাপত্রের (Tripathi, 2012) তথ্য ব্যবহার করে নিচে আমরা ধান ও গমের ক্ষেত্রে প্রতি হেক্টর জমিতে লাভের অঙ্ক প্রকাশ করলাম। প্রথমে A2 ব্যবহার করে তারপর C2।
চিত্র ১ – ধান ও গমচাষে A2 ভিত্তিতে গণনাকৃত প্রতি হেক্টর জমিতে মুনাফা (স্থির মূল্যমানে)। Source: (Tripathi, 2012)
চিত্র ২ – ধান ও গমচাষে C2 ভিত্তিতে গণনাকৃত প্রতি হেক্টর জমিতে মুনাফা (স্থির মূল্যমানে). Source: (Tripathi, 2012)
উপরের দুটি রেখাচিত্র থেকে দুটি বিষয় সামনে আসে। প্রথমত, উদারীকরণের আগে অবধি ধান আর গম চাষের মুনাফা মোটামুটি কাছাকাছি ছিল। ফারাকটা বাড়তে শুরু করে উদারীকরণের পর থেকে। যদিও কেন এমনটা হয়েছিল সেই কারণ অনুসন্ধানের পরিসর এটা নয়। দ্বিতীয়ত, উদারীকরণের আগে অবধি কৃষির মুনাফা সামান্য হারে হলেও বাড়ছিল। কিন্তু ১৯৯৩-এর পর মুনাফা ক্রমশ কমতে থাকে। ধানের ক্ষেত্রে এমনকী লোকসানের মুখও দেখতে হয়। পরিস্থিতির পরিবর্তন শুরু হয় ২০০৩-০৪ এর পর – তখন ধান গম উভয় চাষেই লাভের হার বাড়তে থাকে। ২০০৯-১০ নাগাদ ধান ও গম চাষের লাভের অঙ্ক কাছাকাছি আসতে থাকে। উক্ত গবেষণাটি ২০০৯-১০ আর্থিক বর্ষ অবধি করা হয়েছিল। তার পরের পরিস্থিতি নিয়ে এরকম কোন গবেষণা আমার চোখে পড়ে নি।
আরও পড়ুন, সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলন ও কৃষিসমাজের বিভিন্ন বর্গের অবস্থান- একটি উপক্রমণিকা
উপরের আলোচনা থেকে যে জিনিসটা বেরিয়ে আসে, তা হল খাদ্যশস্যের ক্ষেত্রে অন্তত মুনাফার হার বাড়লেও সে বৃদ্ধির হার অধিকাংশ বছরেই যৎসামান্য। একমাত্র ২০০৩-২০০৮ এই সময়কালে কৃষি মুনাফার একটা বড়সড় বৃদ্ধি ঘটে। তার কারণ অবশ্য খুব পরিষ্কার নয়। পরের অংশে যাওয়ার আগে আমরা একবার ধান ও গমে বিনিয়োগে রিটার্নের হার দেখে নেব। এই হার গণনা করা হয়েছে C2 ভিত্তিক মুনাফা ও C2-র অনুপাত গণনা করার মাধ্যমে। এখানেও খুব স্পষ্ট যে গমের ক্ষেত্রে মুনাফার হার (গড়ে ২৭%), ধানের থেকে অনেকটাই বেশি (গড়ে ১২%)।
চিত্র ৩ – ধান ও গম চাষে মুনাফার হার। Source: (Tripathi, 2012)
এই আলোচনাটি শেষ করার আগে ১৯৮৩-৮৪ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত কৃষকদের আয় এবং কৃষি শ্রমিকদের আয়ের একটি হিসেবে চোখ রাখব। এই হিসেবটি পাওয়া গেছে Chand et al., (2015) এর গবেষণা পত্র থেকে।
সারণি ১- কৃষক (cultivator) এবং কৃষি শ্রমিক (agricultural laborer) পিছু কৃষি আয়। Source: Chand et al., (2015)
এবার কৃষি বিলের মূল বিষয়ে আসা যাক। কৃষি বিলের তিনটি অধ্যায় নিয়ে সব চেয়ে বেশি বিতর্ক হচ্ছে – মান্ডি এবং ন্যূনতম সহায়ক মূল্য ব্যবস্থার অবসান এবং চুক্তি চাষ। আমরা এই বিষয়গুলি একে একে আলোচনা করব।
মান্ডি ব্যবস্থা
মান্ডি কথাটার আক্ষরিক মানে বাজার। এক্ষেত্রে মান্ডি বলতে যা বোঝায় তা হল বিভিন্ন রাজ্যে Agricultural Produce Market Comitte (APMC) নিয়ন্ত্রিত বাজার যা ২০১৬ তে e-nam এর মাধ্যমে এই বিপণন ব্যবস্থাটি অনলাইন করা হয়। কতটা ফসল মান্ডিতে কেনাবেচা হচ্ছে, তা কিন্তু রাজ্য ও ফসল ভেদে বিভিন্ন। এ বিষয়ে ২০১৩ সালে ন্যাশনাল স্যামপল সার্ভে অর্গানাইজেশন (NSSO) প্রকাশিত Some Aspects of Farming in India তে চোখ রাখলে ব্যাপারটি আরো পরিষ্কার হবে। এই রিপোর্ট NSS 70th রাউন্ডের ভিত্তিতে নির্মিত। নিচের চিত্রে বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে কত শতাংশ পরিবার কোথায় তাদের উৎপাদন বিক্রি করছেন তার একটা হিসেব আছে।
চিত্র ৪ কৃষক পরিবারগুলি কোথায় তাঁদের উৎপাদন বিক্রি করেন তার শতকরা হিসেব। Source: Some Aspects of Farming in India, 2013
উপরের চিত্র থেকে একথা পরিষ্কার যে (অন্তত ২০১৩ তে) সবাই যে মান্ডিতে ফসল বিক্রি করতেন এমন নয়। বিশেষত ধানের ক্ষেত্রে ৭১% পরিবার তাঁদের ফসল স্থানীয় ফসল ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করেন। গম ও তূলোর ক্ষেত্রে মান্ডিতে ফসল বিক্রয়কারী পরিবারের শতাংশ বেশি হলেও খুব বেশি নয় – গমের ক্ষেত্রে ৩৪% আর তূলোর ক্ষেত্রে ২৫%। এ তো গেল পরিবারের সংখ্যার হিসেব। যদি উৎপাদনের পরিমানের দিক থেকে হিসেব করি তাহলে কোথায় ফসল বিক্রি হবে তা রাজ্য, ফসল এবং কৃষকের জমির পরিমাপের ওপর নির্ভর করে। ওই একই রিপোর্ট থেকে পাওয়া যায় যে পশ্চিমবঙ্গে, ২০১৩ সালে, মোট উৎপাদিত ধানের ৬৭% বিক্রি হয়েছিল স্থানীয় ফসল ব্যবসায়ীদের কাছে আর ২২% মান্ডিতে। কিন্তু যদি আমি পশ্চিমবঙ্গের ক্ষুদ্র কৃষকদের দেখি, যাঁদের জমির পরিমাণ ০.৫ হেক্টরের কম, তাঁদের মোট উৎপাদনের ৮১% বিক্রি হয়েছিল স্থানীয় ফসল ব্যবসায়ীদের কাছে আর ৮% মান্ডিতে। গমের ক্ষেত্রে কিন্তু সাধারণ ভাবে মান্ডির গুরুত্ব বেশি –পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে মোট গম উৎপাদনের ৪৭% বিক্রি হয়েছে মান্ডিতে আর ৪৩% বিক্রি হয়েছে সরকারি এজেন্সি আর সমবায়ের মাধ্যমে। সেখানে স্থানীয় ফসল ব্যবসায়ীদের ভাগ মাত্র ৯%।
আরও পড়ুন, বেণীর সঙ্গে মাথা
উপরের আলোচনার প্রতিপাদ্য হল এই যে, কৃষি-আইনের মান্ডি বহির্ভূত বিক্রয়নীতির প্রভাব রাজ্য ও ফসল ভেদে আলাদা হবে এবং তার বিশদ বিশ্লেষণ এখনই করা মুশকিল। কিন্তু মান্ডি ব্যবস্থার প্রভাব যে কৃষি বিপণনের ওপর পড়বে এটা বোঝাই যায়। কৃষি বিপণন নিয়ে একটা জরুরি আলোচনা তাই করে নেওয়া দরকার। একথা মোটামুটি সবাই জানেন যে, কৃষক যে দামে তাঁর ফসল বিক্রি করেন এবং যে দামে তা পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় তার মধ্যে অনেকটা ফারাক থাকে এবং এই ফারাকটা মূলত মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের পকেটে ঢোকে। কেন কৃষকরা মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীদের কম দামে ফসল বিক্রি করেন, তার উত্তরটা একটু জটিল। আগে এরকম একটা ধারণা ছিল যে প্রকৃত চাষিরা দাম পান না, কারণ তাঁরা বাজার-দাম জানতে পারেন না। কিন্তু এই ধারণা যে সত্যি নয় তা ইতিমধ্যেই দেখিয়েছেন একাধিক গবেষক (Fafchamps & Minten, 2012; Mitra et al., 2018)। এর মধ্যে প্রথম গবেষণাপত্রটি মহারাষ্ট্রের কৃষক নিয়ে করা আর দ্বিতীয়টি পশ্চিমবঙ্গের আলু চাষিদের নিয়ে। দুটি ক্ষেত্রেই কৃষকদের মোবাইল ফোন দেওয়া হয় যার মাধ্যমে তাঁদের কৃষিপণ্যের দাম জানানোর ব্যবস্থা করা হয়। দেখা যায় যে, পশ্চিমবঙ্গ বা মহারাষ্ট্র কোথাওই দামের তথ্য জানার কোন প্রভাব কৃষকদের প্রাপ্ত দামের ওপর পড়ে না। আমাদের এরকমও ধারণা থাকে যে ফড়ে বা দালালরা কৃষকদের ঋণের জালে ফেলে সস্তায় জিনিস কিনে নেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে (মহারাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই প্রশ্নটি করা হয় নি) দেখা গেছে এই ধারণাটিও ঠিক না। ফড়েরা টাকা ধার দেন ঠিকই। কিন্তু তাঁরা তার শর্ত হিসেবে কম দামে জিনিস কেনেন না; কৃষকরা বেশি দামে পণ্য বিক্রয় করে তাঁদের টাকা ফেরত দিলে তাঁরা আপত্তি করে না। কৃষকরা যে সরাসরি পাইকারি বাজারে উৎপাদন বিক্রি করতে পারেন না, তার বিভিন্ন কারণ আছে। তার মধ্যে একটা হল ছোট কৃষকরা যে পরিমাণ আলু বিক্রি করেন অত কম পরিমাণ আলু পাইকারি ব্যবসায়ী কিনতে চান না, কারণ আলু বাছাইয়ের একটা স্থির ব্যয় থাকে। ফড়েরা অনেক কৃষকের থেকে আলু কেনেন বলে তাঁরা একসঙ্গে অনেকটা আলু বাজারে বিক্রয় করতে পারেন। এই আলোচনার অবতারণা করার একটা কারণ হল আমাদের অনেকেরই ধারণা আছে ফড়েরা ফিল্মের অমরীশ পুরী জাতীয় ভিলেন, যাঁরা বলপূর্বক কৃষকদের দিয়ে যা খুশি করিয়ে নিতে পারেন। বাস্তবত, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীর সাথে কৃষকের সম্পর্কটি অনেক জটিল এবং তা ফসল ও রাজ্য ভেদে বিভিন্ন। পরে আবার এই আলোচনায় ফেরা যাবে। আপাতত ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আলোচনায় আসা যাক।
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য
ন্যূনতম সহায়ক মূল্য (যাকে আমি সংক্ষেপে সহায়ক মূল্য বলে উল্লেখ করব) নিয়ে আলোচনার আগে একটা বিষয় বুঝে নেওয়া দরকার। ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের সঙ্গে ন্যূনতম মজুরির একটা পার্থক্য আছে। কোন ব্যবসার মালিক তাঁর কর্মচারীকে ন্যূনতম মজুরির থেকে কম মজুরি দিতে পারেন না, তা বেআইনি, অর্থাৎ কেউ তেমন মজুরি দিলে তাঁর বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ন্যূনতম সহায়ক মূল্য কিন্তু সেরকম নয়, অর্থাৎ কৃষক এবং ফসল বিক্রেতা চাইলে ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের থেকে কম দামে কেনা-বেচা করতে পারেন, তা আইনের চোখে অপরাধ নয়। সেই কারণে এটি ন্যূনতম সহায়ক মূল্য, ন্যূনতম মূল্য নয়। তাহলে এই সহায়ক মূল্যের গুরুত্ব কী? নিয়ম হল বাজারে যদি দাম সহায়ক মূল্যের থেকে কম হয় তাহলে সরকার ফসল সহায়ক মূল্যে কিনে নেবে। সরকার যদি সব চাষির থেকে সহায়ক মূল্যে ফসল কেনেন, তাহলে কেউ আর শস্য ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রয় করবেন না। তাই তাঁরাও খোলা বাজারে বেশি দাম দিতে বাধ্য হবেন। অর্থাৎ সহায়ক মূল্য কৃষককে ভাল দাম দেওয়াতে পারবে কিনা তা অনেকাংশেই নির্ভর করে সরকার নিয়মিত শস্য কিনছে কিনা তার ওপর। কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সরকার নিয়ম করে সহায়ক মূল্যে ফসল কেনেন না। তাই কৃষকও সহায়ক মূল্যের থেকে কম দামে ফসল বিক্রি করেন। এক্ষেত্রেও রাজ্য এবং ফসল ভেদে পরিস্থিতি বেশ আলাদা। নিচের চিত্রে বাজার দামের সাথে সহায়ক মুল্যের পার্থক্য সহায়ক মূল্যের শতাংশে প্রকাশ করা হল বিভিন্ন রাজ্যের জন্য ধান ও গমের ক্ষেত্রে। (এটি গণনা করার জন্য যে ফর্মূলা ব্যবহার করেছি তা হল [বাজার দাম-সহায়ক মূল্য]×১০০/সহায়ক মুল্য)।
চিত্র ৫ গমের বাজার দাম ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের পার্থক্য (ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অনুপাতে). Source: Tripathi, 2012
চিত্র ৬ ধানের বাজার দাম ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের পার্থক্য (ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের অনুপাতে). Source: Tripathi, 2012
এই চিত্রটি সহজে বোঝার উপায় হল যে যেখানে যেখানে বার গুলি ০-এর নিচে সেখানেই চাষিরা সহায়ক মূল্যের থেকে কম দাম পেয়েছেন। ধানের ক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গে ২০০৪-০৫ এবং ২০০৯-১০ এ এবং ওড়িশায় একই সময় এমনটা হয়েছে। গমের ক্ষেত্রেও এই দুই বছরেই বিহার এবং উত্তর প্রদেশে চাষিরা সহায়ক মূল্যের থেকে কম দাম পেয়েছেন বাজার থেকে। গত দশ বছরে সহায়ক মূল্য এবং বাজার দামের সম্পর্ক কী হয়েছে তা নিয়ে আর কোন গবেষণা চোখে পড়েনি। তবে আমার বিশ্বাস উদার অর্থনীতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব সরকারই শস্য ক্রয়ে তেমন মন দিচ্ছে না। তাই সহায়ক মূল্য বিষয়টি খাতায় কলমে থাকলেও তত সহায়ক হচ্ছে না। এছাড়াও যেটা লক্ষ্যণীয় সেটা হল বাজার দাম সহায়ক মূল্যের থেকে কতটা বেশি সেটা কিন্তু একই ফসলের জন্য বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন। এটার একটা সম্ভাব্য ব্যাখ্যা হল যেসব রাজ্যে ফুড কর্পোরেশন অফ ইন্ডিয়া এবং বিভিন্ন রাজ্য সরকারি সংস্থা শস্য কেনায় যত সক্রিয় সেখানে চাষিদের বাজার দামের থেকে বেশি দাম পাওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি।
চুক্তি চাষ
কৃষি বিল নিয়ে তৃতীয় (এবং আমার মতে সবথেকে বড়) আপত্তির জায়গাটা হল চুক্তি চাষ। নতুন কৃষি বিল অনেকাংশেই এই চুক্তি চাষের জায়গাটা সুগম করেছে এমনভাবে যাতে লাভ বড় কোম্পানির। বাংলায় এরকম একটা ধারণা চালু আছে যে চুক্তি চাষ বিষয়তা নীলকর সাহেবদের দাদন দেওয়া জাতীয় একটি বিষয় অর্থাৎ কর্পোরেট কোম্পানিগুলি চাবুক মেরে অনিচ্ছুক কৃষকদের দিয়ে চুক্তি চাষ করায়। প্রথমেই বলে রাখা ভাল যে বিষয়টা ঠিক এরকম নয়। কৃষকরা চুক্তিতে যোগদান করেন স্বেচ্ছায়। সমস্যাটা হয় পরের দিকে। এই আলোচনাটায় ঢোকার আগে চুক্তি চাষ বিষয়টা কী সেটা একটু বুঝে দেখা দরকার। কৃষিতে চুক্তি চাষ বলতে যা বোঝায়, তা হল বর্তমানে নির্ধারিত দামে, কোন একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ভবিষ্যতের কোন একটি সময়ে জোগান দেওয়ার আগাম চুক্তি (Forward Contract). ব্যাপারটা কিন্তু এরকম নয় যে নতুন কৃষি বিল ভারতে চুক্তি চাষের প্রবর্তন করছে। চুক্তি চাষ ভারতে বহুদিন ধরেই প্রচলিত। যেহেতু পাঞ্জাব এখন কৃষি আইন বিরোধী আন্দোলনে উত্তাল, তাই চোখ রাখা যাক পাঞ্জাবের দিকেই।
পাঞ্জাবে চুক্তি চাষের সুত্রপাত ১৯৮০-র দশকের শেষের দিকে, যখন ১৯৮৮ সালে বহুজাতিক পেপসিকো পাঞ্জাবের চাষিদের সঙ্গে কৃষি পণ্য সরবরাহের জন্য আগাম চুক্তি করে। ওই দশক শেষের সময়ে সবুজ বিপ্লবের সূর্য অস্তমিত প্রায়, চাষিদের জমি থেকে আয় তখন আয় কমে গেছে অনেকটাই। শুধু পেপসিকো নয়, নয়ের দশকের প্রথমদিকে পাঞ্জাবে চুক্তি চাষে অগ্রণী ছিল হিন্দুস্তান লিভার লিমিটেড এবং একটি স্থানীয় কোম্পানি নিজ্জার অ্যাগ্রো ফুডস ওয়ার্কস। এই তিনটি কোম্পানির সঙ্গে পাঞ্জাবের কৃষকদের চুক্তি সম্পর্ক নিয়ে বিশদে আলোচনা করেছেন সুখপাল সিং তাঁর ২০০২ সালে প্রকাশিত একটি প্রবন্ধে (Singh, 2002)। তাঁর প্রবন্ধের আলোচনার সময়কাল ১৯৯০-এর দশকের শেষের দিক। অধ্যাপক সিং দেখিয়েছেন চুক্তি চাষে যাঁরা যেতেন তাঁরা বেশ বড় চাষি, তাঁদের জমির গড় আয়তন ৩৫.৭২ একর। এঁদের মধ্যে যাঁরা পেপসিকো বা হিন্দুস্থান লিভারের সঙ্গে চুক্তি করতেন তাঁদের জমি আরো বড়, তাঁদের জমির গড় আয়তন যথাক্রমে ৩৯.৬৩ একর এবং ৪৭.২৫ একর। নিজ্জার-এর সঙ্গে চুক্তিবদ্ধ কৃষকরা তুলনায় কম জমির মালিক, গড়ে ১৬.৮৭ একর। পেপসিকো এবং হিন্দুস্থান লিভারের সঙ্গে যাঁরা চুক্তিবদ্ধ হতেন তাঁরা গড়পরতা ১২-১৩ বছরের স্কুল শিক্ষা সম্পূর্ণ করেছেন অর্থাৎ মাধ্যমিক বা উচ্চ-মাধ্যমিক পাশ। নিজ্জারের সঙ্গে চুক্তিবদ্ধদের ক্ষেত্রে এই সংখ্যাটা একটু কম কিন্তু সেখানেও গড়ে একজন কৃষক ৭ বছর স্কুলে পড়েছেন অর্থাৎ ক্লাস ৭-৮ পাস, যদি ধরে নিই যে সবাই ক্লাস ওয়ান থেকেই স্কুলে যাচ্ছেন। সুতরাং এটা খুব সহজেই বোঝা যায় যে পাঞ্জাবে ১৯৯০-এর শেষ দিকে যারা চুক্তি চাষ করতেন তাঁরা গড়পরতা ভারতীয় কৃষকের থেকে অনেক ধনী এবং শিক্ষিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও চুক্তি চাষ করতে গিয়ে তাঁরা যে সমস্যায় পড়তেন সে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বোঝার দরকার। প্রথমেই বলে নেওয়া ভাল যে চুক্তি চাষ করতে এঁদের কেউ বাধ্য করেনি।
মূল সমস্যা দেখা দিয়েছে যখন চাষিরা নানারকম কারণে (রোগ/পোকা, বীজের সমস্যা, প্রাকৃতিক বিপর্যয়) ইত্যাদি কারণে তাদের চুক্তিকৃত ফসল সরবরাহ করতে পারে নি। যে চুক্তি করা হত তাতে অনেক বেশি রক্ষিত হত কোম্পানির স্বার্থ। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের কারণে ফসলের ক্ষতি হলেও কৃষক তাঁর চুক্তি সম্পাদন থেকে ছাড় পেতেন না। প্রত্যেক চুক্তিতে কৃষক তাঁর পূর্ব স্বীকৃত ফসল জোগান দিতে না পারলে শাস্তির সামনে পড়তেন, কিন্তু কোম্পানি তাদের চুক্তিবদ্ধ পরিমাণ না কিনলে তার জন্য চুক্তিতে কোন শাস্তির সংস্থান ছিল না। এই সমস্যা বহুগুণ বেড়ে যাবে নতুন কৃষি আইনে। কারণ এই আইনের সংস্থান অনুযায়ী চুক্তি নিয়ে কোন বিরোধ দেখা দিলে কৃষক আদালতে যেতে পারবেন না, আমলারাই তার বিচার করবেন। অধ্যাপক সিং দেখাচ্ছেন পাঞ্জাবের শিক্ষিত, অবস্থাপন্ন চাষিরাই বড় কোম্পানির বিরুদ্ধে সুবিধা করে উঠতে পারছিল না বিশেষত যেখানে প্রাকৃতিক কারণে শস্যের ক্ষতি হচ্ছিল। তাই তাঁদের অনেকের মধ্যেই সেই সময়েই চুক্তি চাষ তথা বহুজাতিক কোম্পানির বিরুদ্ধে একটা ক্ষোভ জন্মাচ্ছিল। এতদসত্বেও পাঞ্জাবে সেই সময় অনেক কৃষকই কিন্তু ভবিষ্যতেও আবার চুক্তি চাষে উৎসাহ দেখায়, কিন্তু সেটা সবাই নয়। স্থানীয় কোম্পানি নিজ্জারের ক্ষেত্রে ৮০% কৃষকই চুক্তিতে ফিরতে চেয়েছিল। বহুজাতিক হিন্দুস্থান লিভার বা পেপসির ক্ষেত্রে কিন্তু এই সংখ্যাটা তত আশাপ্রদ নয় – হিন্দুস্থান লিভারের ক্ষেত্রে ৩৮% এবং পেপসির ক্ষেত্রে প্রায় ৩০% কৃষক নতুন করে চুক্তি চাষে আগ্রহী ছিলেন না। পাঞ্জাবের যে কৃষকদের চুক্তি চাষ নিয়ে সমস্যা উঠে এসেছে গবেষণাপত্রটিতে তারা সবাই কিন্তু অবস্থাপন্ন কৃষক। সেখানে এখন ভারতের কৃষক সমাজ, যারা বেশির ভাগই ছোট জোতের মালিক, তাঁরা যদি নতুন কৃষি আইনে চুক্তি চাষের সিঁদুরে মেঘ দেখেন, তবে সেই আশঙ্কাকে খুব অমূলক বলা যায় না।
অতঃ কিম…
তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়াল? নতুন কৃষি আইনের মূল সমস্যা লুকিয়ে আছে কর্পোরেট চুক্তি চাষের মধ্যেই। পুরনো অভিজ্ঞতা থেকে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক কারণে শস্য হানি হলে পুরো দায় বর্তায় কৃষকের ওপর। অন্যদিকে কোম্পানি যদি প্রতিশ্রুতি মত ফসল না তোলে তাহলে কৃষক খুব কিছু করেও উঠতে পারে না। এর ওপরে আবার নতুন আইনে কোর্টে যাওয়ার উপায়ও রাখা হয় নি। চুক্তি চাষ নিয়ে আতঙ্কিত হওয়ার তাই যথেষ্ট কারণ আছে। পাঞ্জাব ভারতের সেই সব রাজ্যগুলোর মধ্যে অন্যতম যাদের কৃষকরা চুক্তি চাষ করছেন অনেক দিন ধরেই। তাই চুক্তি চাষের বিপদ সম্পর্কে অন্য রাজ্যের কৃষকদের থেকে তাঁদের ধারণা অনেক পরিষ্কার। বাকি যে দুটি বিতর্কিত ধারা – মান্ডি ও ন্যূনতম সহায়ক মূল্য সম্পর্কে – তা আসলে চুক্তি চাষের ভিত শক্ত করার জন্যই। চুক্তি চাষে অরাজি কৃষক অন্য যে দু’জায়গায় ফসল বেচতে পারতেন – সরকার এবং মান্ডি – নতুন আইনের এই দুটি ধারা এই দুটি প্রতিষ্ঠানকেই দুর্বল করে দেবে।
এরকম একটা কথা বলার চেষ্টা চলছে যে কৃষিতে বড় পুঁজি ঢুকলে ফড়েদের থেকে টাকা চাষিদের ঘরে ঢুকবে। এই কথার বিশেষ কোন ভিত্তি নেই। ধরা যাক, এখন কৃষিতে ১০০ টাকার একটা উদ্বৃত্ত তৈরি হয়। সেটার ১০ টাকা প্রায় কৃষক আর বাকিটা ফড়েরা। এই ভাগ ঠিক হয় দরকষাকষির ক্ষমতা দিয়ে। বহুজাতিক বা জাতীয় পুঁজি ঢুকলে কৃষকের দরকষাকষির ক্ষমতা কেন বাড়বে এটা আমার বুদ্ধির অগম্য। যে কৃষক স্থানীয় রামা-শ্যামার পকেট থেকে ১০ টাকার বেশি বের করতে পারেন না, তিনি কোন মন্ত্রবলে আম্বানির পকেট থেকে ৪০ টাকা তুলে নেবেন, তা বোঝা যায় না। কিন্তু যদি কৃষকরা আগের মতই ১০ টাকা পান, তাহলে কি আমরা এটা বলতে পারি এই আইন অন্তত খারাপ কিছু করছে না? তাও পারি না। সে কারণ অবশ্য উপরের আলোচনা থেকে একটু আলাদা। প্রথম কারণ, দালাল শুনলে আমরা যতই নাক সিঁটকোই না কেন, মধ্যবর্তী ব্যবসায়ীরা স্থানীয়, এবং তাঁরা ব্যবসার লাভের একটা অংশ স্থানীয় বাজারে বা স্থানীয় গণ-দ্রব্যের পেছনে খরচ করেন। জাতীয় বা বহুজাতিক সংস্থার হাতে এই উদ্বৃত্ত গেলে তার বেশিটাই যাবে সমাজের ওপর তলায় যাঁদের ব্যবহার্য দ্রব্য বা সেবাও কিন্তু সমাজের ওপর তলার লোকেরাই জোগান দেন। একটা সহজ উদাহরণ দিয়ে ব্যপারটা বোঝানো যেতে পারে। গ্রামের শস্য ব্যবসায়ী বড়লোক হলেও তিনি কিন্তু চুল কাটেন স্থানীয় নাপিতের কাছে। তাই ফসল ব্যবসার উদবৃত্ত তিনি পেলে তার কিছুটা স্থানীয় নাপিতের পকেটেও আসবে। অন্যদিকে জাতীয় বা বহুজাতিক কোন কোম্পানির সিইও-রা চুল কাটেন খুব দামি কোন স্যালোঁতে, তাই সেই টাকাও তাঁরর মত বড়লোক কারো পকেটেই ঢোকে। সুতরাং, কৃষি-বিলের ফলে কৃষকের অবস্থা এক থাকলেও শস্য ব্যবসার উদ্বৃত্ত যদি স্থানীয় ব্যবসায়ীর পরিবর্তে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পুঁজির পকেটে ঢোকে তাতে আর্থিক অসাম্য আরো বাড়বে যেটা মোটেই কাম্য নয়।
দ্বিতীয়ত সমস্যাটি দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য সংক্রান্ত। স্থানীয় পুঁজির বদলে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পুঁজির হাতে টাকা গেলে দেশের রাজনৈতিক ভারসাম্য বদলে যাবে। স্থানীয় পুঁজি আঞ্চলিক দলের অর্থের জোগানদার, যেখানে জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পুঁজি অর্থ যোগায় জাতীয় দলগুলিকে। কৃষিতে স্থানীয় পুঁজির আধিপত্য শেষ হলে লাভ বিজেপির মত জাতীয় দলের, ক্ষতি আঞ্চলিক দলগুলির। এতে অনেক ক্ষেত্রেই স্থানীয় স্বার্থ বিঘ্নিত হতে পারে। কৃষি আইন এবং তাকে ঘিরে টানাপোড়েনের বিষয়টি তাই শুধুমাত্র কৃষকদের আয় বৃদ্ধি বা হ্রাসের প্রশ্নে দেখলে হবে না, একই সঙ্গে এর রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক তাৎপর্যও কিন্তু সুদূরপ্রসারী।
চমৎকার লেখা, তথ্যসমৃদ্ধ, ভাল বিশ্লেষণ।
আমি শুধু দু'একটি কথা যুক্ত করতে চাই। ভুল হলে শুধরে দেবেন।
১ এই সরকার কিঞ্চিৎ আটঘাট বেঁধে খেলতে নেমেছে। যেমন, কন্ট্রাক্ট ফার্মিং বা চুক্তি চাষের আইনে ভারতীয় কন্ট্র্যাক্ট অ্যাক্টের 'ফোর্স মেজর' ( force maejrure ) শর্ত জুড়ে দিয়েছে। যার ফলে চাষি যদি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের (পড়ুন খরা, বন্যা, পঙ্গপালের আক্রমণ, কোন মহামারী ইত্যাদি) ফলে, মানে যে ফ্যাক্টরগুলোর জন্যে ও দায়ী নয় বা ওর নিয়ন্ত্রণের বাইরে, চুক্তি চাষের শর্ত পূরণ করতে না পারে তাহলে অন্য পক্ষ ওর উপরে কোন পেনাল্টি ধার্য করতে পারবেনা।
২ সামান্য অবস্থায় সালিশি ব্যবস্থায় বা কৃষির জন্যে তৈরি বিশেষ আদালতে ( যা গঠন করবে বলে সরকার আন্দোলনকারীদের লিখিত প্রতিশ্রুতি দিয়েছে) যদি চাষি শর্তভঙ্গের জন্যে দোষী সাব্যস্ত হয় তাহলে তাকে শুধু চুক্তির পয়সা ফেরৎ দিতে হবে। কোন অতিরিক্ত পেনাল্টি নয়। অথচ অন্য পার্টি (অ-কৃষক) দোষী সাব্যস্ত হলে তাকে চুক্তির টাকার ১৫০% মানে ৫০% পেনাল্টি জুড়ে চাষীকে ফেরৎ দিতে হবে।
৩ অন্য পক্ষ চাষির জমিকে বন্ধক রাখতে পারবেনা বা তাতে কোন স্থায়ী নির্মাণ করতে পারবেনা। যদি কাজের তাগিদে কোন নির্মাণ করে তাহলে চুক্তির সময়সীমা সমাপ্ত হলে (১ থেকে ৫ বছর) তাকে নিজের খরচে ভেঙে দিতে হবে, নইলে তা চাষির সম্পত্তি হয়ে যাবে।
৪ চুক্তি চাষে দাম নির্ধারণে দু'রকম মডেল রাখা হয়েছে।
এক, ফিক্সড প্রি-ডিটারমিন্ড প্রাইস। তাতে ফসল আসলে বাজারে দাম পড়ে গেলেও চাষির ক্ষতি নেই বরং লাভ। কারণ, অন্যপক্ষ আগের দামে কিনতে বাধ্য।কিন্তু বাজারে দাম চড়ে গেলে, একই কারণে, চাষির ক্ষতি।
দুই, দামে একটা অংশ ফিক্সড ,যা বাজারের বাস্তবিক দর নিরপেক্ষ, অন্য অংশটি ভ্যারিয়েবল। ওই অংশটির নির্ধারণ দু'পক্ষ মিলে করবে বাজার দর দেখে। এখন চাষির থিওরিতে স্বাধীনতা আছে দুটোর কোন একটা মোড বেছে নেওয়ার।
৫ পরিশেষে এই আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে বাংলার কৃষি ঠিক খাপে খাপ নয়। দেখতে হবে পাঞ্জাব -হরিয়ানার কৃষির ইকোসিস্টেমকে। কেননা, গোটা দেশে যে ৭% কৃষক মণ্ডিতে ধান গম বিক্রয় করে বা এমএসপির সুরক্ষা কবচের লাভ পায় তার ৮০%ই পাঞ্জাব-হরিয়ানা-পশ্চিম উত্তর প্রদেশের। তার মধ্যে ওদের ৯০% কৃষকই মন্ডিতে যায়। দেশের মোট ৭০০০ মন্ডীর ৪০০০ই ওই এলাকাতে।
৬ ওরা এমন মরিয়া হয়ে সবকিছু বাজি রেখে কেন লড়ছে? কারণ এটা দুটো ইকোসস্টেমের লড়াই। নতুন তিনটে আইন ওদের ইকোসিস্টেমকে ভেঙে দিচ্ছে, ওদের নিরাপত্তা সুখচ্যান ছিনিয়ে নিচ্ছে।
তাই কন্ট্র্যাক্ট ফার্মিং নয়, মন্ডির বাইরে খোলা বাজার বা অপ্রত্যক্ষরূপে এমএসপি তুলে দেওয়ার চক্রান্ত হল আসল ক্ষোভের কারণ। সরকার যদি এমএসপিকে বেঞ্চমার্ক করা এবং তার উল্লঙ্ঘন দন্ডনীয় অপরাধ করে আইন বানায় তো আন্দোলন থেমে যাবে।
লেখাটির জন্য অনির্বান মুখোপাধ্যায় মহাশয় কে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই।
এই প্রসংগে আগ্রহী পাঠক দের জন্য আরেকটি তথ্য সূত্র।
গতকাল ২৬১২২০২০ তারিখে, নতুন কৃষি আইন এবং ঘটমান কৃষক আন্দোলন প্রসংগে বিজু কৃষ্ণান (সারা ভারত কৃষক সভা) , দীনেশ অ্যাব্রল (নেশন ফর ফার্মার্স) , পি সাইনাথ (পিপলস আরকাই ফর রুরাল ইন্ডিয়া) , অধ্যাপক রতন খাসনবিশ এর বক্ত্ব্য, একটি ওয়েবিনার এ।