শুক্রবার ২০ তারিখে যখন বোম্বে পুণে নাগপুর নাসিক শাট ডাউনের খবর এলো আমরা তখন অফিসে, গাদা গাদা ডেস্কটপে দমাদ্দম আইডেস্ক আর সিট্রিক্স ইন্সটল করানো হচ্ছে, আরএসএ টোকেন ইস্যু করা হচ্ছে প্রতিটা ডেস্কটপপিছু। এরপরে ডেস্কটপ যার নামে সে দেখে নিচ্ছে সমস্ত অ্যাপ্লিকেশান ঠিকঠাক কাজ করছে কিনা, আগামি দুই সপ্তাহ বাড়ি থেকে ওই ডেস্কটপের সাহায্যে অফিসের কাজ করতে হবে, কাজে কোথাও কোন বিঘ্ন ঘটা চলবে না। শাট ডাউন যে হতে চলেছে তা জানতামই। পিম্পড়ি চিঞ্চওয়াড় অঞ্চলে পজিটিভ কেসের সংখ্যা লাফিয়ে বাড়ছে। মোটামুটি ১৬ তারিখ থেকেই আমরা অনেকে বাড়ি থেকে কাজ করা শুরু করেছি, তবে যে সব কর্মীকে ল্যাপটপ দেওয়া হয় নি এবং যাদের সরাসরি প্রোডাকশান ডেটা কিংবা বিলিং অ্যাপ্লিকেশান নিয়ে কাজ করতে হয় তাদের অফিসে আসতেই হচ্ছে। এদিকে মুখ্যমন্ত্রী ও পুণের কালেক্টরেট নরমে গরমে সমস্ত প্রাইভেট কোম্পানিকে কর্মীদের যতটা সম্ভব বাড়ি থেকে কাজ করাতে বলছেন। SEZ অঞ্চলের কিছু অদ্ভুত নিয়মকানুনের গেরোয় আটকে কোম্পানি চাইলেও অনেককেই বাড়ি থেকে কাজ করানো যাচ্ছে না। অতএব একদিকে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ক্লায়েন্টের সাথে আরেকদিকে শহর কর্তৃপক্ষের বিভিন্ন প্রতিনিধির সাথে দফায় দফায় চলছে মিটিং। এরই মধ্যে আবার রাজ ঠাকরের মহারাষ্ট্র নির্মাণ সেনার এক মহিলা কর্মী বিভিন্ন আইটি কোম্পানিতে ঢুকে লোকজনকে মিষ্টি করে ধমকাচ্ছে এই মুহূর্তে কোম্পানি বন্ধ না করলে খুব খারাপ হবে। সেসব স্টিং ভিডিও নিয়েও কিছু উত্তাল আলোচনা জায়গায় জায়গায়।
এদিকে সরকারি অফিসসমূহ ও সরকারি পরিবহন প্রথমে ১৬ তারিখ থেকে ৬০ ভাগ পরে ধাপে ধাপে কমিয়ে শুক্রবারে ২৫ ভাগ চালু। শাট ডাউন করলে অত্যাবশ্যক সহায়তার কর্মীরা আসতে সমস্যায় পড়বেন বলে অফিসের ভেতরে আলাদা করে যথেষ্ট জায়গাসহ থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দুপুরে শাট ডাউনের ঘোষণা হওয়ামাত্রই বিভিন্ন পেয়িং গেস্ট ও মেস তার বাসিন্দাদের ঘর ছেড়ে দিতে নোটিশ দেয়। এই মালিকরা ঠিক কেন ছাড়তে বলেছেন তা খুব পরিস্কার নয়, তাঁরা পরিস্কার করে কোন কারণও দেখান নি অধিকাংশ ক্ষেত্রে। ফলে শহরের বাইরে থেকে আসা বিপুল সংখ্যক ছাত্রছাত্রী, অফিসকর্মী ও অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকরা হঠাৎ করেই বিপদে পড়ে যান। দিশেহারা হয়ে সকলেই জিনিষপত্র নিয়ে দৌড়ান পুণে সেন্ট্রাল স্টেশান কিংবা স্বরগেটের বাস টার্মিনাসের দিকে। ফলত সোস্যাল ডিসট্যান্সিঙের গুষ্ঠির তুষ্টি করে পুণে স্টেশানের বাইরে ও ভেতরে থই থই জনসমুদ্র, ট্রেন স্টেশানে ঢোকামাত্র আনরিজার্ভড তো বটেই রিজার্ভড কামরাতেও লোকে যেভাবে পারছে মেরে ঠেলে গুঁতিয়ে এমনকি কামড়ে জায়গা বের করে ঢুকে যাচ্ছে। এই সব লোকের একটা বড় অংশের গন্তব্য বাংলা, আসাম, বিহার এবং উত্তরপ্রদেশ। সন্ধ্যের পর রেল কর্তৃপক্ষ আরো কয়েকটি পাটনা ও হাওড়াগামী স্পেশ্যাল ট্রেনের ঘোষণা করলেন। যাঁরা পড়ে রইলেন পরেরদিনের ট্রেনে যাবার জন্য তাঁরা বেশিরভাগ প্ল্যাটফর্মে বা বাইরের চত্বরে শুয়েবসে রইলেন, ফিরে যাবার তো আর জায়গা নেই, হোটেলে ওঠাও এঁদের ক্ষমতার বাইরে। পরেরদিন আমাদের হাউসিং বা অফিসের লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় সেসব ছবি দেখে দাঁত কিড়মিড় করে বলবেন 'এদের মিলিটারি দিয়ে বাটাম লাগানো উচিৎ। নিজেরাও মরবে আমাদেরও মারবে'।
আলোকচিত্রঃ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস থেকে নেওয়া পুণে সেন্ট্রাল স্টেশান
আবার সকলেই যে বাধ্য হয়ে চলে যাচ্ছেন তাও নয়। প্রবল আতঙ্কেও অনেকে শহর ছাড়ছেন। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের রিপোর্ট থেকে জানতে পারছি পুণে শহরে সুরক্ষাকর্মী সরবরাহের জন্য কমবেশী ৯০০ সংস্থা আছে, সুরক্ষাকর্মীর সংখ্যা ৫০,০০০ এর মত। এঁদের অনেকেই আসেন মারাঠাওয়াড়া, লাতুর, বিহার আর ছত্তিশগড়ের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। পুণেতে সংক্রমণের সংখ্যা বাড়ার খবরে ভয়ের চোটে এঁদের অনেকের বাড়ি থেকে বারবার ফোন আসছে ফেরত যেতে বলে। এঁরা যাচ্ছেনও। ওই খবর অনুযায়ীই কিছু সংস্থা অতিরিক্ত বেতন কবুল করেও কর্মী ধরে রাখতে পারছে না। বলাবাহুল্য সুরক্ষাকর্মীদের নিজেদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত বিশেষ নেই। যাঁদের অনবরত লোকের ব্যাগ, ল্যাপটপ, আইডি কার্ড হাতে নিয়ে দেখতে হয়, খাতায় লিখে সই করিয়ে নিতে হয় আগন্তুকের, তাঁদের বরাদ্দ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই স্বচ্ছভারত অভিযানের বেঁচে যাওয়া কিছু ফিনফিনে পাতলা মাস্ক, আর কোথাও কোথাও একটি শেষ হতে বসা হ্যান্ড স্যানিটাইজারের বোতল। অতএব ভয় দ্রুত গ্রাস করছে তাঁদের।
আমাদের অফিসের যাদের বাড়িওলা উচ্ছেদের নোটিশ ধরায়নি তারা যে যার ডেস্কটপ কোলে করে বাড়ি গেল। আর যারা ফোনেই শুক্রবার রাতে কিম্বা শনির সকালে বাড়িছাড়ার নোটিশ পেয়েছে তারা আবার সেখান থেকে জিনিসপত্র নিয়ে এসে গেস্ট হাউসে বা অফিসেরই কোনও এক ওডিসির কোণায় উঠল। এবং ...এবং কর্তৃপক্ষ থেকে শুরু করে সদ্যযোগ দেওয়া কুচো কর্মী পর্যন্ত সব্বাই দৌড়ালো দোকান বাজারে খাবার দাবার জিনিসপাতি কিনতে। তা সেসব মোটামুটি পাওয়া গেল দুধ ছাড়া। দুধ আবার পরেরদিন সকালে পাওয়া যাবে। শনিবার সকাল থেকে মোটামুটি খাবারদাবার, মুদীখানা আর অষুধের দোকান ছাড়া বাকী সব বন্ধ। তবে শনিবারও বেশ কিছু হোটেল রেস্টুরেন্ট খোলা ছিল। সেখানে বসে খাবার অনুমতি না থাকলেও প্যাক করিয়ে আনা অথবা স্থানবিশেষে বাড়িতে ডেলিভারিও করানো যাচ্ছিল। অতঃপর রবিবারের জনতার কার্ফিউ এবং বিকেল পাঁচটার বাদ্যিবাজনা। এখানে জনতা অবশ্য রাস্তায় বেরোয় টেরোয় নি, যে যার ব্যালকনি, জানলা থেকে যা পেরেছে বাজিয়েছে। কিন্তু সোমবার সকাল থেকে বেশ কিছু লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে, টোলপ্লাজাগুলোতে লম্বা লাইন। অতএব এবারে সম্পূর্ণ লক ডাউন ও ১৪৪ ধারা জারি হয় মুম্বাই, পুণে, নাগপুর ইত্যাদিতে। অর্থাৎ ব্যক্তিগত মালিকানার গাড়ি অত্যন্ত জরুরী পরিষেবা (ডাক্তার, ব্যাঙ্ককর্মী ইত্যাদি আপন আপন পরিচয়পত্রসহ) ছাড়া রাস্তায় বেরোতে পারবে না, ১০ জন একসাথে জড়ো হওয়া চলবে না ইত্যাদি। কিন্তু এতেও গাড়ির ঢল তখন কমানো যায় নি। কাজেই এরপর জারি হয় কার্ফুর আদেশ। মঙ্গলবার সকাল থেকেই রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যায় গাড়ি। বিভিন্ন হাউসিঙে পুলিশ এসে নির্দেশিকা জারি করে যায়। যাবতীয় সাফাইকর্মী, খবরের কাগজের হকারের ঢোকা নিষিদ্ধ হয়। অবশ্য সরকারি ও প্রাইভেট যাবতীয় যানবাহন বন্ধ থাকায় অধিকাংশ কর্মী বা হকার আসতেই পারেন নি।
অতঃপর এলো ২৪ মার্চ রাত আটটা। প্রধানমন্ত্রী হাতজোড় ইত্যাদি নানাবিধ অভিনয় করে গোটা ভারতে ২১ দিনের জন্য সম্পূর্ণ লক ডাউন ঘোষণা করলেন। বলা বাহুল্য কীভাবে কী হবে তার কোন রূপরেখা তিনি বলেন নি। কিছু নির্দেশাবলী এদিক ওদিক ঘুরে বেড়ায় যে অত্যাবশ্যকীয় পণ্য ও পরিষেবা চালু থাকবে। কিন্তু কীভাবে, তার উত্তর যে যেভাবে ভেবে নিয়েছেন সেটাই চুড়ান্ত। গতকাল পর্যন্ত আমাজন প্যান্ট্রি, বিগ বাস্কেট, গ্রোফার্স বা ফ্রেশ ট্যুহোমের ডেলিভারি সার্ভিস দিব্যি বজায় ছিল। রবিবারে চলে নি অবশ্য, কিন্তু সোম ও মংগলবারে চলেছে। মজা শুরু হল আজ সকাল থেকেই। বিভিন্ন জায়গায় এদের গাড়ি আটকে, কর্মীদের হেনস্থা করে ফেরত পাঠায় পুলিশ। কোথাও কোথাও এমনকি জলের ট্যাঙ্কারও নাকি আটকানো হয়েছে। প্রতিবেশী ফিসফিস করে বলেন আরে ট্যাঙ্কার লবি গড়কড়ির, ও ঠিক ছাড়া পেয়ে যাবে, একটু দেরী হবে হয়ত। তা গড়কড়ির জন্যই হোক বা জল আটকালে আজই মারদাঙ্গা শুরু হতে পারে বলেই হোক জলের গাড়ি আসে বেলা এগারোটার পরে। আমাজন, ফ্রেশট্যুহোম ইত্যাদিরা নিজ নিজ সাইটে ও ক্রেতাদের মেসেজ করে জানায় তারা কর্তৃপক্ষের সাথে আলোচনা করে সমাধানে আসার চেষ্টা করছেন। হয়ত দুই একদিনের মধ্যে ঠিক হয়েও যাবে। কিন্তু ইতিমধ্যেই খবর পেলাম সবজি চালানের ব্যবস্থা না করতে পেরে কৃষক সেটা হয় খেতের মধ্যে পুঁতে দিচ্ছেন নয়ত মাঠেই ছড়িয়ে দিচ্ছেন যাতে অন্তত পচে সার হয়। অতএব সাপ্লাই লাইন বন্ধ হতে চলেছে। আজকের বাংলা কাগজেই খবর ছিল আলুচাষীরা অনেকেই আলু হিমঘরে তুলে উঠতে পারেন নি, মাঠেই রয়েছে এখনও। সেগুলোরও গতি খানিকটা ওই মাঠের সার হওয়াই হবে হয়ত। এরকম চললে আশঙ্কা হয় অচিরেই রাস্তায় ঘাটে দাঙ্গা লেগে যাবে খাদ্যের জন্য।
গরম আসছে এইসময় সরবত ও মস্তানির দোকানগুলোতে কিছু ঠিকা লোক নিয়োগ করে ঠান্ডা পানীয়ের চাহিদা সামাল দিতে। এবার তাদের নিয়োগ করার ক্ষমতা আদৌ কারো থাকবে কিনা, চাহিদা থাকবে কিনা তাও বলা খুব মুশকিল। ফলত বেশ কিছু লোক অনাহার ও দুর্ভিক্ষের মুখোমুখী হবে। আমাদের অঞ্চলের ছোটখাট রেস্টুরেন্টগুলো যেহেতু একেবারে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, এরাও বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে, এদের সেটা সামলানোর মত মূলধনের জোরও নেই। এই পরিবারগুলোর কী হবে জানি না, ভাবতে পারছি না। এদের জন্য প্রধানমন্ত্রী কিছু ভেবেছেন বা কোন পরিকল্পনা করেছেন বলে জানা যায় নি। বরং কেরল রাজ্যসরকার রাজ্যের মানুষের সাহায্যে কুড়ি হাজার কোটি বরাদ্দ করার ঘোষণা করায় কেন্দ্রীয় সরকার সেই ঘোষণা নাকচ করাতে চেয়ে সুপ্রীম কোর্টে মামলা করেছে বলে খবরে দেখেছি। অর্থাৎ কেন্দ্রীয় সরকার নিজেরাও কোনরূপ অর্থ বরাদ্দ করবেন না, কোনও রাজ্য সরকার করলেও সেটি নাকচ করানোর চেষ্টা করবেন। এসব দেখলে শুধু বা বা নয় বলতে হয় তওবা তওবা। চীনের উহানে লক ডাউনের সময় প্রতিটি পরিবারে দৈনন্দিন খাবার মুদীখানার সামগ্রী সরকারি কর্তৃপক্ষের তরফে পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। করোনা ছাড়া অন্যান্য অসুখ বিসুখের জন্য ভিডিও ও অডিও কলের মাধ্যমে রোগ নির্ণয় ও ওষুধ পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখানে অতি ঘন জনবসতি অঞ্চলে সেরকম কিছু পরিকল্পনা নিয়ে লক ডাউন করলে এবং তাতে সমস্ত ছোট উদ্যোগকে সামিল করলে কারোরই ত্ত অসুবিধে হত না। কিন্তু সেসব তো সময় নিয়ে মাথা খাটিয়ে পরিকল্পনার ব্যপার, দেশবাসীর প্রতি দরদ ও সহমর্মিতার ব্যপার। সেসব বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর কাছে আশা করা নিতান্ত বাতুলতা।
সর্বশেষ খবরে দেখছি আজ সকাল থেকে ডেলিভারি করতে গিয়ে ১৫০০০ লিটার দুধ আর ১০,০০০ কেজি সবজি ফেলে দিতে হয়েছে পুলিশি লাঠি চালনা ও অত্যাচার ও বাধায়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী কাল রাতে বলেছেন দেশে এই ২১ দিন কিচ্ছু চলবে না, কী কী চলতেই হবে তার কোন স্পষ্ট নির্দেশিকা না তিনি না তাঁর দপ্তর দিয়েছে, কাজেই পুলিশ বুঝে নিয়েছে সব গাড়িকেই থামাতে হবে। অতএব ‘অত্যাবশ্যকীয় পণ্য’ নামক ইতি গজটি উহ্যই থেকে গেছে। ২০২০র বসন্ত শুধু অচেনা ভাইরাসে বিষাক্তই নয়, চরম অব্যবস্থা ও সাধারণ মানুষের প্রতি চরম অবহেলা ও নির্মমতায় নির্দয় নিষ্ঠুরও।