এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  বিবিধ

  • "রাতের তারা আমায় কি তুই বলতে পারিস? কোথায় আছে, কেমন আছে মা"

    কিংবদন্তি লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | বিবিধ | ১৬ মার্চ ২০২০ | ৩৭৫৫ বার পঠিত
  • আজকে যখন এই লেখা শুরু করছি তখন, ঠিক এই সময়েও ২০১২ সালে আম্মা আমার সাথে ছিল। ঠিক এখন যে বিছানাতে বসে লিখছি, যে দিকে শিয়র এখন আমার, সেদিন এই বিছানাতেই এই দিকেই শিয়র দিয়ে আম্মা শুয়ে ছিল। ডান পাশে আমি আর বা পাশে বড়পা শুয়ে ছিলাম। ময়মেনসিংহ মেডিকেল কলেজ থেকে সে দিন সন্ধ্যায় আম্মাকে নিয়ে চলে আসছিলাম। সুস্থ করে আনতে পারিনি। কিন্তু উনি জেদ করে বাড়ি চলে আসছিলেন। আমরাও বেশ কিছুদিন হাসপাতাল জীবন কাটিয়ে ক্লান্ত ছিলাম। নিয়ে চলে আসছিলাম। যেহেতু সুস্থ করে আনতে পারিনি, তাই মাইক্রবাস থেকে একটা ব্যাটারি চালিত অটোতে নিয়ে আম্মাকে বাসার সামনে নিয়ে আসছিলাম। সেখান থেকে আমি কোলে করে আজকে যেখানে বসে লিখছি সেই বিছানায়। রাতের খাবারও আমিই খাইয়েছিলাম। পাখির মত করে খাওয়ানো, আম্মা হা করেন হা, আম্মা মুখ খুলত একটু, আমি খাবার দিয়ে দিতাম। ওষুধ খাইয়ে আমি একটু শেরপুর নিউমার্কেট থেকে ঘুরে আসছিলাম, বন্ধুদের সাথে দেখা করে, আম্মা একটু ভাল আছে সবাইকে এই খবর দিয়ে, আমি ফিরে আসছি এই নিদর্শন রেখে বাড়ি ফিরে আম্মার পাশে শুয়ে পরেছিলাম সেদিন। আমাদের দুই ভাই বোনের মাঝ থেকে কখন জানি আম্মা চলে গেল! সকালে বড়পা আম্মাকে ডাকছে, আম্মা সাড়া দিচ্ছে না। বড়পার ডাক শুনে আমার ঘুম ভাঙে। আমি একটা ডাক দিয়ে গায়ে হাত দিয়েই বুঝে গেলাম জোর করে বাড়ি ফেরার মাহাত্ম্য। ফাঁকি দিয়ে চলে গেছেন তিনি।

    ময়মেনসিংহ মেডিকেল কলেজে আম্মার চিকিৎসা চলছে দুই সপ্তাহের বেশি সময়। শামিম ভাই দিনের বেলায় ডাক্তারের সাথে দৌড়ঝাঁপ করত। রাতে থাকতাম আমি। আর বড়পা সর্বক্ষন! রাতে আম্মার বিছানায় বড়পা থাকত। আমি কী করি? আমি ঘুরতাম পুরো হাসপাতাল। এই করিডোর থেকে ওই করিডোর, হাঁটতে হাঁটতে মেডিকেল কলেজে চলে যেতাম। আবার ইউ ট্রান, এবার বাইরের চায়ের দোকান। দোকানে মশার কামড় দিয়ে চা খেয়ে, মারফতি আলাপ শুনে আবার হাঁটতে হাঁটতে আম্মার বিছানার পাশে জানালায় এসে দাঁড়াতাম। আম্মা সম্ভবত ঘুমানোর পর্যায় ছিল না। আমি দাঁড়াতেই চোখ খুলে দেখত আমাকে। আমি বলতাম, ঘুমান নাই কেন? ঘুমান। আম্মা বলত, তুই কোথাও গিয়ে চোখ বন্ধ করে থাক কিছুক্ষণ, আমার সাথে খুকি আছে, তোর চিন্তা করতে হব না। আমি চিন্তা করতাম না। আবার হাঁটা শুরু করতাম। হাসপাতালে বসার যে জায়গা গুলো থাকে তাতে গিয়ে বসতাম। মশাদের সাথে আলাপ হত, যখন আলাপ আর সহ্য করতে পারতাম না তখন আবার হাঁটা। এবার হাঁটতে হাঁটতে রত্না খালা আমাকে নার্সদের ক্যান্টিন চিনিয়ে দিয়ে গেছিল, সেখানে যেতাম। নার্সদের ক্যান্টিন বলেই কিনা, এখানে খুব কড়া চা পাওয়া যেত। চা খেতাম, দুই একজন নার্স তাদের কাজের ফাঁকে চা খেতে আসছে বা নিতে আসছে তাদের দেখতাম, তাদের কথা শুনতাম। বসে থাকতাম, আবার চা খেতাম। ওই ক্যান্টিনের চা সম্ভবত আমার মগজে বাসা বেঁধে আছে আজো। দারুণ চা খাওয়ার কোন স্মৃতি মনে করতে চাইলেই আমার মনে পরে নার্সদের এই ক্যান্টিনের চায়ের কথা। দুই তিন কাপ খেয়ে আবার হাঁটা। আবার আম্মার বিছানার পাশের জানলা, আবার আম্মার কণ্ঠস্বর, তুই ঘুমা কোথাও গিয়া! আমি হাসতাম! আমি বলতাম, আপনের কিছু লাগব? পানি বা অন্য কিছু। আম্মা ধমক দিত, খুকি তো সাথেই আছে, লাগলে ও বলব তোকে। তুই ঘুমা কোথাও! আম্মাকে বলতাম না, বলতে পারতাম না যে, এই জায়গায় আর যাই হোক ঘুমানো সম্ভব না আমার।

    সকাল হত, আম্মার জন্য, বড়পার জন্য পানি চা বিস্কুট এনে দিতাম। শামিম ভাই এসে দায়িত্ব বুঝে নিত। আমি মুনার বাসায় গিয়ে ঘুম। দুপুরের খাবার খেয়ে আর নিয়ে ফিরতাম হাসপাতালে। শুরু হত আমার হাঁটাহাঁটি কর্মকাণ্ড! এই কয়দিনের এই রুটিনে আমাদেরকে অসম্ভব ক্লান্ত করে দিয়েছিল। আমরা তিন ভাই বোনের অবস্থা কাহিল। বাড়িতে ফিরে ঘুরে ফিরে সেই আমাকে আর বড়পাকেই পাশে শুয়ার দায়িত্ব দেওয়া হল! এই কয়দিনের ক্লান্তি এবার তার দাবী আদায় করল। মরণ ঘুম ঘুমালাম আমরা দুই ভাই বোন। আম্মা চলে গেল আমাদের রেখে।
    আজকে যখন আট বছর পূরণ হচ্ছে আম্মার চলে যাওয়ার তখনও মনে আফসোস লাগে সাথে থেকেও কেন শেষটুক পেলাম না। আম্মা কী আমাকে ডাক দিয়েছিল? কয়েকবার তো হাত আমার শরীরে এসেছিল, আমি ঘুমের ঘোরেই হাত নিয়ে কম্বলের নিচে ঢুকিয়ে দিয়েছিলাম। তখন কী আম্মা কিছু বলতে চেয়েছিল? জানি না, জানা হবে না আর! শুধু জানি আমি পাশে থেকে এক বিন্দু বুঝতে পারিনি। শক্ত করে মুঠি দিয়ে ধরে আছি, আমি ভাবছি ধরেই আছি, মুঠি খুলেই দেখি হাত ফাঁকা, কোন ফাঁক গলিয়ে চলে গেছে সব, হারিয়েছি মনি মুক্ত!

    এখন মাঝে মাঝেই মাকে স্বপ্ন দেখি। স্বপ্নেও আমি ভুলতে পারি না যে আম্মা আমাদের সাথে নাই। যতবার দেখি ততবার আমি আম্মাকে জরিয়ে ধরে কাঁদতে থাকি, কাঁদতে কাঁদতে ঘুম ভাঙে আমার। জরিয়ে ধরার সুখটুকুই শুধু থাকে তখন। স্বপ্নে আম্মা আমাকে হাসতে হাসতে বলে পাগল, তুই কান্দস কেন? আমি ভাল আছি তো! কোন কোনদিন হাসতে হাসতে বলে তোদের ছাড়া ভাল লাগে না, থাকমু না এখানে! আমি কাঁদতে কাঁদতে বলি, আসেন, বাড়ি আসেন, আপনাকে ছাড়া কিছু ভাল লাগে না! আম্মা হাসে আমার কথা শুনে। আমার ঘুম ভাঙে অব্যক্ত এক কষ্ট নিয়ে। আমি স্তব্দ হয়ে যাই, আমার দুনিয়া উলট পালট হয়ে যায় ঘুম ভেঙেই! ছোট ছেলে বলেই কিনা কে জানে, আমি আম্মাকে ছাড়া কিছুই বুঝতাম না। ঢাকা থেকে বা বাড়ির বাইরে কোথাও গেলে ফিরে গিয়েই আম্মাকে জরিয়ে ধরতাম। এই স্পর্শ সুখ, গায়ের গন্ধের প্রতি টান আমি এখনো খুঁজে বেড়াই। স্বপ্নের মাঝে ক্ষণিকের ওই মুহূর্ত আমাকে তৃপ্তির বদলে আরও অস্থির করে দেয়, আমি পারি না স্বাভাবিক হতে।

    আট বছরে পারিনি, কত বছরে পারব জানা নেই। কেউ জানে কী?
    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১৬ মার্চ ২০২০ | ৩৭৫৫ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • একলহমা | ১৬ মার্চ ২০২০ ০৬:২১91482
  • কোনদিন পারে কি কেউ?
  • একলহমা | ১৬ মার্চ ২০২০ ০৬:২১91483
  • কোনদিন পারে কি কেউ?
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লাজুক না হয়ে প্রতিক্রিয়া দিন