কয়েকদিন আগে আমাদের শহরের বাটা দোকানের ঘটনা লিখেছিলাম। তখন ওই মহিলার পরিচয় সনাক্ত করতে পারি নাই। যারা উপস্থিত ছিল তারা তাকে চিনে নাই, বিএনপির ওই নেতাকেও চিনে নাই। কিন্তু যিনি এমন আগুন গরম মেজাজ নিয়ে শহরে ঘুরাঘুরি করছেন তিনি আর কত নিজেকে লুকিয়ে রাখতে পারবেন? পরিচয় বের হয়েই গেল। এবং আশ্চর্য কাণ্ড হচ্ছে এই মহিলাকে আমি চিনি। আমার বন্ধুর বড় ভাইয়ের স্ত্রী! এই বিয়েও খাইছি আমি, বরযাত্রী গিয়েছিলাম। উনার এহেন পরিণতি দেখে একটু আশ্চর্য হইলাম। তার বাচ্চা যে স্কুলে পরে সেখানেও তিনি রীতিমত তাণ্ডব চালিয়েছেন!
নরসিংদীর পলাশ উপজেলার প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের কারখানায় আগুন লেগেছে। পুড়ে শেষ সব। হুট করেই এমন ভয়ানক আগুন কেন লাগল প্রাণের ফ্যাক্টরিতে? দুইদিন আগে দেখছিলাম প্রাণের মালিক কাদিয়ানী এমন একটা প্রচার! সত্য মিথ্যা জানি না, এইদিক থেকে কিছু হয় নাই তো? আমি জানি না, অনুমান করছি শুধু।
গাজি টায়ারের ঘটনায় সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে প্রায় দুইশজন মানুষ মারা গেল, এইটা নিয়ে কোথাও কোন উচ্চবাচ্য নেই! প্রথম আলো একটা নিউজ করল ছাত্রলীগ আর যুবলীগের দুই পক্ষ এই অগ্নিকাণ্ড, মানুষ পুড়ে মারার ঘটনা ঘটিয়েছে। একটু পরে এই খবর আর পাওয়া গেল না তাদের ওয়েবসাইটে! আমি অনেক খুঁজলাম, কিন্তু পেলাম না। এইটা কেমন কথা না? এত বড় অভিযোগ অথচ লিখেই খবর নাই হয়ে গেল?
প্রথম আলোর একটু বেহুশ অবস্থা চলছে তা বুঝি। মানে কী রেখে কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। সরকার প্রায় তাদের ঘরনারই। এরা প্রত্যেকেই প্রথম আলোয় কলাম লিখে। প্রথম আলো যে নিজেকেই সরকার ভাবছে না তার কোন নিশ্চয়তা আছে? নাই। ১/১১ সরকারের সময়ও প্রথম আলো এই ভূমিকায় ছিল। তখনও তারা নিজেদেরকেই সরকার মনে করত। কেউ কেউ বলছে ফখরুদ্দিনের নানান বক্তব্যের ড্রাফট প্রথম আলো থেকে যেত! এগুলা প্রমাণ করা মুশকিল, কাজেই জোর দিয়ে বলা একটু বিপদেই।
তো প্রথম আলো এবারও বেহুশ হয়ে আছে। সরকার পতনের পরে তারা নিউজ করল শেখ হাসিনার সাথে একই হেলিকপ্টারে সালমান এফ রহমানও দেশ ছেড়েছেন! কয়দিন পরে সদরঘাট থেকে ধরা পড়ল দরবেশ বাবা! প্রথম আলো ওই সংবাদ যদিও বিদেশি কোন এক সংবাদ মাধ্যমের বরাতে ছেপেছিল। কিন্তু ছেপেছিল তারাই এবং ভুল স্বীকারও করী নাই। প্রথম আলো পারছে না এই সরকার আমাদের আন্দোলনের ফসল বলতে, পারলে তাও বলত আমার ধারণা।
কৃতিত্ব সবাই নিতে চায়। তাত্ত্বিক সবাই হতে চায়। যারা এই ষোল বছরের মধ্যে অন্তত পনেরো বিশ বার সরকার ফালায় দেওয়ার ঘোষণা দিছিল। যারা কিছু হলেও বলত এই যে এবার আর রক্ষা নাই, আওয়ামীলীগ সরকার শেষ! সর্বশেষ গত অক্টোবরেও যারা ধাক্কা দিয়ে সরকার ফেলে দিছিল তারাও কৃতিত্ব নিতে চায়! এখন বলে কী বলছিলাম, এবার পড়ে যাব! আরে ভাই, তুই তো পড়ে যাব প্রতিবারই বলস, এ আর নতুন কী!
আমি আমার কথা জানি। আমার মাথা পরিষ্কার ছিল। আওয়ামীলীগ প্রচুর ভুল করেছে। এই আন্দোলন অনেক আগেই নস্যাৎ করা যেত। যখন আন্দোলন তুঙ্গে তখন আমাকে বারবার অনেকেই বলছে এই যে গেল সরকার। আমি বলছিলাম আওয়ামীলীগ বা সরকার জনগণের কাছে জনপ্রিয় না, তার জনপ্রিয় হওয়ার কোন ইচ্ছাও নাই। তাই সে টিকে থাকার জন্য আরও লাশ ফেলবে। তবুও টিকে থাকতে চাইবে। কারণ তার সেফ এক্সিট নাই। বলছিলাম আর্মি যে পর্যন্ত সরকারের সাথে আছে সেই পর্যন্ত সরকারের পতন হবে না। এখন বুঝি যে আর্মি সরকারের সাথে কখনওই ছিল না। তো আমি বুঝতেছিলাম কিসের পরে কি হচ্ছে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, দেশিও ষড়যন্ত্র এগুলা মাথায় থাকার পরেও মনে হয়েছে এইটার দায় আসলে শেখ হাসিনারই। হয় তিনি কারও উপরে অন্ধ বিশ্বাস করে ধরা খেয়েছেন না হলে নিজেরই সব ভুল। যিনি এমন একটা অবস্থান থেকে নেমেছেন যা এক কথায় অবিশ্বাস্য।
যাই হোক, এই কৃতিত্ববাদীদের কে কৃতিত্ব না দিয়ে উপায় আছে? এক দশের মধ্যে যে কোন সংখ্যা বিজয়ী, তারা এক থেকে দশ পর্যন্ত সব গুলা সংখ্যাই বলছে, একটা মিলে গেছে, এখন এর জন্য কৃতিত্ব চায়!
তবে কৃতিত্ব নেওয়ার দাবিদার শুধু এরা না। ইউনুস সাহেবও আছেন এই লাইনে। একটা খবর ছড়িয়ে পড়ছে সব জায়গায়। ঢাকা এয়ারপোর্টের চেহারা বদলে গেছে। এখন ওয়াইফাই সুবিধা পাচ্ছে, ল্যান্ড ফোন আছে যাতে ফ্রি প্রবাসীরা কথা বলতে পারবে ইত্যাদি। এখন কে বুঝায় এদেরকে যে এইটা আগেও ছিল। আমি নিজে রোমানিয়া থেকে আসার সময় এই ফ্রি ফোন দিয়ে কথা বলছি আমার ভাইয়ের সাথে! কিন্তু কেউ একজন কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে, কী বলার আছে?
আরেকটা তো আরও বড় আয়োজন করে কৃতিত্ব নিচ্ছে এই সরকার। পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয় থেকে ১৮৩৫ কোটি টাকা বাঁচিয়েছে এই সরকার। এদিকে পাঁচ জুলাই দেশের সব পত্রিকায় এই খবর প্রকাশ হয়েছে! মানে এই টাকা বাঁচানোর ব্যাপারটা আওয়ামীলীগ সরকার আমলেই হয়েছে। মহান উপদেষ্টারা কী মনে করে কে জানে এখন এইটার কৃতিত্ব নিতে চাচ্ছে। ( ঢাকা পোস্টের লিংক দিচ্ছি নিচে, তারা এক সাথে দুইটা সংবাদই রেখে দিছে! বুঝা যায় এইটা তাদেরকে প্রকাশ করতে বলছে, তাই তারা করছে এখন দুইটা খবরই এক সাথে।)
উপদেষ্টা বলেছেন, "সেতু উপদেষ্টা বলেন, ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণ করে পদ্মা সেতু প্রকল্পের মূল সেতুতে ৫৩০ কোটি টাকা, নদী শাসনে ৮০ কেটি টাকা, সংযোগ সড়ক ও সার্ভিস এড়িয়ায় ১৭৮ কোটি টাকা, ভূমি অধিগ্রহণ ১০৩ কোটি টাকা ও অন্যান্য সব ব্যয় মিলিয়ে ১ হাজার ৪৯১ কোটি টাকা সাশ্রয় করা হয়েছে।তিনি আরও বলেন, বিদ্যুৎ খাতে বিভিন্ন অনিয়মের ফলে যে অতিরিক্ত ব্যয় হয়েছে, তা নিরসনে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। শুধু সংখ্যাগত উন্নয়ন হলেই হবে না, গুণগত উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা নির্দেশ দিয়েছেন।"
পুরাই খাইছে আমারে অবস্থা না?
সারা দেশে শিক্ষকদের অপমান অপদস্থের একটা মিছিল শুরু হইছে। কোথাও যদি না হয় তাহলে উশখুশ শুরু হয়ে যাচ্ছে, এখানে কেন কিছু হচ্ছে না? বয়স্ক শিক্ষকদের রীতিমত অপমান করে জোর করে পদত্যাগ করানো হচ্ছে। এই ব্যাপারে আমাদের আইন উপদেষ্টা বলেছেন এগুলা হওয়া ঠিক না, কিন্তু শিক্ষকরা এতদিন দলের প্রতি অন্ধ সমর্থন দিয়েছে তাই এগুলা হচ্ছে। আইন উপদেষ্টার মতোই কথা না? একটা ভিডিও দেখছি যেখানে এক শিক্ষক পদত্যাগ পত্রে জোর করে সাক্ষর দেওয়ার পরে তিনি দুম করে কাঁপতে কাঁপতে পরে গেলেন।ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল সম্ভবত। গতকাল শুনলাম তিনি মারা গেছেন! এগুলার কোন মূল্য নাই। একদল মানুষ এখন যাই হচ্ছে, যে অনিয়মই হচ্ছে তাকেই চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। প্রিন্স মাহমুদ, যিনি বাংলাদেশের খ্যাতনামা সুরকার। তিনি পুরো আন্দোলন জুড়েই অন্ধ সমর্থন দিয়ে গেছেন ছাত্রদের। এবং তিনি এখন পর্যন্ত ওই ঘোর থেকে বের হতে পারেন নাই। তিনি আরেকজনের একটা স্ট্যাটাস শেয়ার করছেন। যা তার নিজেরও বক্তব্য। সেখানে লেখা শিক্ষক যদি দলদাসে পরিণত না হয় তাহলে বখাটে ছাত্রও সেই শিক্ষকের সামনে মাথা নত করতে বাধ্য। দলদাস শিক্ষক ইতর ছাত্র থেকেও অধম। এই যে মবের প্রতি উৎসাহ দেওয়া, তারা জানে কী হচ্ছে পুরো দেশে? তাদের উৎসাহ পেয়ে সামনে আরও কী কী হতে পারে? কালকে দেখলাম আরেকজন লিখেছে যারা এগুলা নিয়ে মায়া দেখাচ্ছে তারা জুলাই মাসে কই ছিল? একটা শ্রেণিই না কি জুলাইয়ে চুপ থেকে এখন এইসবের জন্য মায়া কান্না করছে! ফ্যালাসির কোন মাত্রা কোন ধারণা আছে কোন?
শিক্ষকদের নিয়ে যে ফুটবল খেলা চলছে সেই প্রেক্ষিতে চিন্তা করলাম এমন পরিস্থিতিতে যদি আমাদের জিকে স্কুলের প্রধান শিক্ষক জলিল স্যার পড়তেন তাহলে কী করতেন? বেশ কয়েকবার চোখের সামনে ভিডিওর মত করে চালানোর চেষ্টা করলাম দৃশ্যটা, বেশি দূর যেতে পারি নাই একবারও! প্রথমত আমার মনে হয় প্রধান শিক্ষকের যে অফিস রুম সেখান পর্যন্ত যাওয়ার আগেই অর্ধেক আন্দোলনকারীর সাহস উবে যেত! ত্রিশ চল্লিশ জন মিলে আসত, স্যারের রুমের সামনে পর্যন্ত আসতে আসতে তা দশ বারোজনে নেমে আসত। এরপরে ঠেলা ধাক্কা মেরে দুই পাঁচজন স্যারের রুমে ঢুকত। বিশাল অফিস রুমের মাপে আজদাহা একটা টেবিলের পিছনে স্যার যখন বসে ডাক দিত, কী চাস তোরা? কী হইছে? তখন সালাম দিয়া এই কয়জনও চলে আসত, বলত না,স্যার এমনেই আসছিলাম, বলেই দৌড়!
এর চেয়ে ভিন্ন কিছু আর কল্পনা করতে পারছি না আমি। জলিল স্যারকে আমরা টাইগার ডাকতাম। আমরা নাম দেই নাই, আমাদের পূর্বপুরুষেরা এই নাম দিয়ে গেছে। আমরা শুধু বহন করে চলছি সেই নাম। সাদা পাঞ্জাবি আর সাদা পায়জামা পরে, ক্লিন সেভ, ব্যাক ব্রাশ করা কাঁচাপাকা চুল, পায়ে কালো এক জোড়া বাটা জুতা পরে আসতেন স্কুলে। স্কুলে স্যার ঢুকা শেষ, সমস্ত স্কুলে খবর পৌঁছে যেত টাইগার চলে আসছে! সব তমতমা! অ্যাসেম্বলি ক্লাস করানোর জন্য আমাকে ডাকত। আমি একটু মুখচোরা মানুষ। ফিজিক্যাল টিচার মোফাজ্জল স্যার ডাক দিতেন, সাদেক, সামনে আয়! এই আরামে দাঁড়াও, সোজা হউ আর পতাকাকে সালাম দেও, সোনার বাংলা গান গাও বলা কঠিন কিছু না। মুশকিল হচ্ছে টাইগার! জলিল স্যার এসে যখন পিছনে দাঁড়াত আমার সব সাহস কই যে উড়ে যেত! সারা স্কুলের সামনে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকতে হত।
আব্বা বিমান বাহিনীতে চাকরি করত এইটা উনি জানতেন, আমাকে ডাক দিতেন বিমান বাহিনীর পুলা, এদিকে আয়! আমি ওইখানেই শেষ। একদিন ক্লাসে কি জানি জিজ্ঞাস করল, পারি নাই। বলল তুই একটা সুন্দরবনের গাধা! এমন উপমা আমৃত্যু মনে না রাখা ছাড়া আর কোন উপায় আছে?
স্যার ছিলেন বাংলায় এম,এ। কিন্তু বাংলা পড়াতেন কমই। উনি ক্লাস নিতেন না মূলত। কেউ না আসলে, তিনি সেদিন ক্লাসে আসতেন। পড়ানর চেয়ে নানা বিষয়ে আলাপই বেশি করতেন। কিন্তু ওই যে! আমরা তো সেই স্বাদ নিতে পারতাম না। পুরো ক্লাস খিচ মেরে পার করে দিতাম। তবু কিছু তো পেয়েছিলাম। একজন জিজ্ঞাস করেছিল স্যার হিন্দুরা ওদের ধর্মকে সনাতন বলে কেন? আমাদের ধর্ম কী কম পুরাতন? স্যার চমৎকার করে বুঝিয়ে দিলেন কেন ওইটা সনাতন ধর্ম আর আমাদেরটা না। তিনি বুঝালেন ইসলামের আগমনের ইতিহস, সনাতন ধর্মের ইতিহাস। সব মিলিয়ে বললেন তোরা যদি আদম থেকে হিসাব করস তাইলে বলবি আমাদের ধর্মও সনাতন। কিন্তু আদম থেকে হিসাব করলে তো হিন্দু ধর্মও সনাতন। ওরা বলছে মনু থেকে শুরু। এই জন্য যেটা প্রচলিত সেটাই তোর মাথায় রাখতে হবে। বর্তমান যে ধর্ম এইটা তো আর বেশিদিন আগের না, তাইলে? এতদিন পরে ঠিক মনে নাই, তবে স্যার আমাদেরকে দারুণ করে বুঝিয়েছিল এইটা মনে আছে।
শেরপুর শহরে জিকে স্কুলের বিশেষ সুনাম ছিল জেলার সেরা সেরা বদের হাড্ডি এখানে পড়ত বলে! এই একেকটা মাস্টার পিস, যাদের নাম এখন বললে যারা চিনে তারা স্যারের প্রতি সম্মানের মাত্রা বাড়িয়ে দিবে, তাই নাম বলছি না। এদেরকে জলিল স্যার টাইট দিয়ে রাখত। আহ! স্যারের সামনে তর্ক করার চেষ্টা করল জনৈক ছাত্র, স্যার জাস্ট কিক মেরে ওকে ফেলে দিল স্কুলের করিডর থেকে! কেন? ও টিফিন পিরিয়ডে স্কুল পালিয়ে স্কুলের পুকুরেই আবার গোসল করতে আসছে, ধরা পরে আবার স্যারকে কী জানি বুঝানোর চেষ্টাও করছে! এমন যার সাহস তাকে স্যার যথারীতিতে আপ্যায়ন করলেন!
জিকে স্কুলের লম্বা করিডর ধরে স্যার যখন রাউন্ডে বের হতেন তখন যে যে ক্লাসের সামনে দিয়ে যেতেন ওই ওই ক্লাসে নীরবতা নেমে আসত হুট করেই। আর এটাই ছিল সাইন, বাকি ক্লাস গুলো বুঝে যেত টাইগার ইজ কামিং! যে বাথরুমে যাবে বলে হাত তুলেছিল সে চুপ করে বসে গেল, যে নতুন কোন দুষ্টামির ফন্দি বের করছিল সে ভাবল এখন না, একটু পরে দেখা যাবে! অন্য স্যারেরা এক জিনিস টাইগার ভিন্ন জিনিস। জুতা মসমস করে ভারি শরীর নিয়ে দীপ্ত পায়ে হেঁটে যেতেন আব্দুল জলিল, ওরফে টাইগার!
আমাদের আগের কয়েক ব্যাচ খুব খারাপ রেজাল্ট করেছিল এসএসসিতে। আমাদের স্কুল ছিল আধা সরকারি। স্যারেদের বেতন বন্ধ হয়ে গেছে ফলাফল খারাপের জন্য। এমন ভয়াবহ খারাপ অবস্থা স্কুলের। এই সময় আমাদের উপরে গুরু দায়িত্ব আসল যেভাবেই হোক রেজাল্ট ভালো করতেই হবে। আমরা জলিল স্যারকে এই একটা আনন্দ দিতে পারছিলাম। ভুল বললাম, আরেকটা আনন্দ স্যারকে দিয়েছিলাম আমরা। তখন নির্মান স্কুল ক্রিকেট টুর্নামেন্ট হত। আমরা ফাইনালে উঠলাম, জিতলামও আমরাই। বলে রাখি, আমরা যতদিন স্কুল ক্রিকেট খেলছি ততদিন, একটা বছরও আর কেউ জিতে নাই। আমরা প্রতিবার চ্যাম্পিয়ন। তাও স্যার এই জয়ে কেন বেশি খুশি হলেন? আমরা জিতে যখন স্কুলে গেছি ট্রফি নিয়ে, খেলার জন্য স্কুল ফাঁকা, স্যার একাই অফিস রুমে কী জানি করছিলেন। আমরা হইহই করে ঢুকে গেলাম। স্যার খুশিতে প্রায় কেঁদে দেন! স্যার বলল শোন, এইটা বিশেষ জয়। দিশা স্কুল ফাইনালে উঠছে, কার্ড ছাপাইছে, শহরের নানা মানুষকে কার্ড দিছে, সেই কার্ডে জিকে স্কুলের নাম লেখে নাই! কার সাথে ফাইনাল খেলবে তার নাম লেখার এই সৌজন্যতাটুকুও দেখায় নাই! এখন ওরা দেখুক কার সাথে খেলা পড়ছিল! এত বছর পরে এখনও স্যারের চকচকে মুখ, চোখ সব মনে পড়ছে আমার!
কিচ্ছু না, ব্যক্তিত্ব! ধরে ধরে সমানে মারত আমাদের তা না, ব্যক্তিত্বই বাধ্য করত আমাদেরকে উনাকে সম্মান দিতে। গলার গম্ভীর আওয়াজ, জ্ঞান, বাচন ভঙ্গি সব মিলিয়ে জলিল স্যার কিংবদন্তি ছিলেন। স্যারের মৃত্যুর পরে স্কুলে একটা আলোচনা সভার আয়োজন করেছিল। তখন আমি স্কুল থেকে বের হয়ে গেছি তবুও আমি কৌতূহলী হয়ে গিয়েছিলাম। সারা দেশ থেকে কত বিজ্ঞ শিক্ষকেরা আসছিল এই আলোচনা সভায়। তখন মনে হইছিল লোকটাকে সম্ভবত আমরা ধারণ করতে পারি নাই। নিতে পারি নাই উনার কাছ থেকে সবটুকু।
গুনির কদর এখন পাপের পর্যায় চলে গেছে যেন। কোনমতেই এই পাপ করা যাবে না। এক পাপ দিয়ে আরেক পাপের হিসাব মিলিয়ে দিচ্ছে। ওরা আমিনুলকে জেল খাটাইছে, এখন সাকিবকে জেল খাটানো হবে! আইন উপদেষ্টা বলছেন তখন কই ছিলেন আপনার? তখন কই ছিলেন এক মহা অস্ত্র, সবাই দেখি যেখানে সেখানে এই অস্ত্র তাক করে বসে আছে! ভালো বিপদ না?
বন্যার ত্রাণের খবরের মধ্যে একটা কুৎসিত খবর দেখলাম। এক স্বেচ্ছাসেবক লিখেছে তার অভিজ্ঞতা। ঢাকা থেকে কোন একটা প্রতিষ্ঠান ত্রাণ নিয়ে গেছে ফেনির ওইদিকে কোথাও। ওইখানে যারা কাজ করছে তাদেরকে ত্রাণের খাবার দাবাড় বুঝিয়ে দিয়েছে। কাঁচা সব কিছু নিয়ে গেছে। ওইখানে রান্না করে দেওয়া হবে। যারা কাজ করছে তারা দেখে অনেক কিছু আনছে, ৮০ কেজি গরুর মাংস আনছে কিন্তু কোন মুরগি নাই! ওরা বলছে এখানে অনেক হিন্দু পরিবারও তো আছে, তারা কী খাবে? কয় কেজি আর মুরগি লাগবে? ওরা ২৫০০ টাকা চাইছিল মুরগির জন্য। ওরাই কোন জায়গা থেকে আনিয়ে রান্না করবে। কিন্তু এরা দিবে না। ওরা হিন্দুদেরকে ত্রাণ দিবে না! পরে যারা সেখানে ছিল তারা নিজেদের টাকায় মুরগির ব্যবস্থা করেছিল। এইটা দেখে গা ঘিনঘিন করল আমার। আমাদের বিন্দুমাত্র ধারণা আছে কতখানি নিচে নামছি আমরা? অবিশ্বাস্য!
অনেক আগে একটা গুজব শুনেছিলাম। বিএনপির জমাত এগুলা প্রচার করত। কী? বঙ্গবন্ধুর এক হিন্দু পরিবারের ছেলে। বিয়ে না করেই বাচ্চা হইছে, সেই বাচ্চাকে বঙ্গবন্ধুর পিতার কাছে গছিয়ে দেওয়া হয়েছে। এই বাচ্চাই হচ্ছে বঙ্গবন্ধু। হাস্যকর কথাবার্তা। কিন্তু এখন মানুষ এই সব খাচ্ছে। যা দিচ্ছে তাই খাচ্ছে। বর্তমান প্রজন্ম যে আমার খুব অপছন্দ তার বড় কারণ এইটা। এই প্রজন্ম এগুলাকে মজা হিসেবে নিয়ে বিশ্বাস করে বসছে। এই প্রজন্মই শিক্ষকদের গায়ে হাত তুলছে, হার্ট অ্যাটাক হয়ে মারা যাচ্ছে এদের হাতেই।
বঙ্গবন্ধুর এই কথাটা এখানে বললাম অন্য কারণে। এইটা মিথ্যা তাতে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু অভিযোগটা কী? তার জন্ম হিন্দু পরিবারে! এমন বিচ্ছিরি কাণ্ড আর আছে দেশে? হিন্দু পরিবারে জন্ম! যারা ছি ছি করছে তাদের দুই থেকে তিন প্রজন্ম ধরে টান দিলে সব নিম্নবর্ণের হিন্দু গোষ্ঠী বের হয়ে আসবে তার হিসাব নাই। অথচ কী নিয়ে মেতে আছে এরা!
https://www.dhakapost.com/national/290800
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।