১.
“আপনি এতক্ষণ যা বললেন, তার সহজ ব্যাখ্যা আছে! পুরোপুরি না মিললেও কাছাকাছি যায় একটা খুবই কমন মেন্টাল ডিসঅর্ডার …”
আমি এক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকি ডাক্তারটির দিকে। ইতোমধ্যে গোটা বিশেক রোগী দেখে ফেলেছেন। আর তাদের সাথে কথা বলতে বলতে তার কণ্ঠে একটা অন্য রকম টান তৈরী হয়েছে। মনে হচ্ছিল, আগের রোগীদের সাথে চালানো শব্দগুলোই তিনি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বললেন না শুধু, তাদের জন্য লেখা ঔষুধগুলো দিয়ে আমার প্রেসক্রিপশানটাও ভরতে লাগলেন!
ব্যাপারটা খুবই দুঃখজনক আর কিঞ্চিৎ অপমানকর ছিল! এই ডাক্তারটির কোন ধারণাই নেই যে এই মুহূর্তে আমার মাথার মধ্যে কী ঘটে চলেছে! যে জটিল আর বীভৎস পরিস্থিতিকে প্রতিনিয়ত ফেইস করছি আমি, আমি নিশ্চিত, ওয়েটিং রুমে অপেক্ষমান একজন রোগীর সাথেও তার বিন্দুমাত্র কোন মিল নেই। এমনকি যদি মেডিক্যাল হিস্ট্রির কথাও বলা হয়, মানে, ঐ যে দূরে গাদা গাদা বই দেখা যাচ্ছে ডাক্তারের পেছনের বুকশেলফ আলো করে রাখা, সেখানেও আমার সমস্যাটার কথা লেখা থাকতে পারে না! এত বিচিত্র, বিদঘুটে একটা বিষয় আর কারো জীবনে ঘটেছে, তা কী করে হতে পারে!
আমি সিট থেকে উঠে দাঁড়াই, আর মানিব্যাগটা বার করে গুনে গুনে কয়েকখানা কড়কড়ে নোট মেলে ধরি শূন্যে। ডাক্তার সাহেব যিনি কোন ম্যানেজার রাখেননি আলাদা করে ফিস্ সংগ্রহের জন্য মূর্তির মত বসেই রইলেন। উপায়ন্তর না দেখে যখন টেবিলের উপরই ছুঁড়ে ফেলে আসতে যাচ্ছিলাম নোটগুলো, পেছন থেকে ভেসে এল মাখন-মোলায়েম একটা কণ্ঠস্বর, ‘আপনার প্রেসক্রিপশানটা …’
‘ডিপ্রেশানের ঔষুধগুলো আপনার এখানে আসার আগে থেকেই খাচ্ছি; খুব কমন ঔষুধ তো, সবখানেই পাওয়া যায়। কিন্তু বলতে কি… কোন কাজ হয়নি আমার… উল্টো পায়খানাটা খুব শক্ত হয়ে গেছে। তাই বলছিলাম কি, প্রেসক্রিপশাটা প্রিন্ট করে অযথা কাগজ নষ্ট ….‘- বলে একটুখানি থামি আমি। আর সেই বিরতিতে অনেকটা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসেন তিনি আমার দিকে, আর হতটা নিজের করতলে পুরে নিয়ে বলতে থাকেন, “না, না, এভাবে যাবেন না, প্লিজ। …আচ্ছা, ঠিকাছে, আবার গোড়া থেকে শুরু করুন। আপনার সমস্যাগুলি আরেকবার ঝালাই করে নেয়া যাক !”
সত্যি বলতে কী, ডাক্তারের কাছে যাওয়ার চিন্তা মাথাতেই ছিল না আমার। আমি তখন পাগল পাগল হয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম; দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগ আমার চোখমুখে শক্তিশালী ছাপ রেখে যাচ্ছিল! মাত্র কদিনেই আমার ওজন কমে গিয়েছিল অর্ধেক! একদিন গুলিস্তান গোল চত্বর পার হচ্ছি; হঠাৎ একটি বন্ধুর মুখোমুখি পড়ে যাই। কাছে-ধারেই ওর অফিস ছিল। সেই দুপুরে মাথার উপর গনগনে সূর্যকে রেখে সে আমার সামনে ব্যরিকেড হয়ে দাঁড়িয়েছিল। কিছুটা থতমত খেয়ে দ্রুতই সামলে উঠে বলি, ‘এখান থেকে বরাবর গেলে নবাবপুর রাস্তার একটা লেজ পাওয়া যাবে, তার মাথায় একটা সাঙ্ঘাতিক সুন্দর পুকুর আছে, জানোস? আইজই খবর পাইলাম। যাবি দোস আমার …” ব্যস্ত শহরের এই মাঝদুপুরে আমার মুখে পুকুর শুনেই কিনা, কথাটা শেষ করার আগেই বন্ধুটি আমায় টানতে শুরু করে, আর ঠিক কয়েক গজ সামনে কেশর উঁচু করে রাখা একটি রেস্টুরেন্টে নিয়ে তোলে। খাওয়া-দাওয়ার পাঠ চুকে যাওয়ার পর সে আমায় উপরে বর্ণিত ডাক্তারটির সাথে একটিবার দেখা করার জন্য কিরা করায়।
আমার চোখে-মুখে হয়ত অস্বাভাবিক আর অদ্ভুত কিছু একটা লক্ষ্য করে থাকবে বন্ধুটি। কিন্তু আমার মনের মধ্যে ঢুকেছিল সে? সেখানে তো অনেক অনেক দিন ধরেই রচিত হচ্ছিল তারা – ক্ষণে ক্ষণে একটা ঝাঁকুনি দিয়ে ছেড়ে যাচ্ছিল লম্বা লম্বা সব সুতো! প্রথম যে ঘটনাটা আমার স্মৃতিতে একটা সরু সুতোর মতই ঝুলে রয়েছে, তা নানুকে ঘিরে। আমি তখন ক্লাস টু বা থ্রিতে পড়ি। ঈদ চলে এসেছিল নাকের ডগায়, গন্ধ শুঁকতে পারা যাচ্ছিল খুব স্পষ্ট করে। পাড়ার বন্ধুরা দেখাচ্ছিল তাদের নতুন জামাকাপড়। বাড়িতে বাড়িতে চলছিল সেমাই, মিষ্টান্ন, পায়েস, পোলাওয়ের আয়োজন। চাঁদ রাতকে বরণ করে নিতে সাজ সাজ রব সর্বত্র।
অথচ আমাদের বাসায় ঈদ নিয়ে ছিঁটেফোঁটা আলোচনাও নেই, কারণ নানু পড়ে আছেন হাসপাতালে! আমি ছিলাম নানুর সব থেকে আদরের নাতি; সপ্তাহখানেক আগে যখন দেখতে গিয়েছিলাম, আমার হাতটা নিজের মুঠোয় পুরে কত কিছুই না জানতে চাইলেন। নানুকে ভালবাসতাম খুবই; তবু নানু হাসপাতালে থাকলে ঈদ হবে না কেন তা মাথায় এল না আমার। এমন তো নয় যে, নানুর যায় যায় অবস্থা! ঐ তো আমরা কেবিনে থাকতেই ডাক্তার এসেছিল নানুকে দেখতে, রিপোর্টে একটা নজর বুলিয়ে হেসে উঠেছিলেন, ‘বাহ! প্রায় সবগুলো সাইডই তো ইম্প্রুভ করছে! আর কটা দিন, মা… এরপরই বাসায় যেয়ে নাতির সাথে কুস্তাকুস্তি করতে পারবেন!’
ডাক্তারের কথায় সেদিন খিলখিল করে হেসে উঠলেও ঈদের পুরো সকালটা আমার কাটলো বালিশে মুখ গুঁজে। কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলাম না একটা ঈদ এমনি এমনি কেটে যাবে! একটা হাহাকার সম্পূর্ণ গ্রাস করে নিয়েছিল আমায়, আর বালিশটা ভিজে উঠেছিল চিক্ চিক্ জলে! বেলা কিছুটা গড়াতে একটি কোমল হাতের স্পর্শ অনুভূত হল পিঠের উপর, আর মাথাটা তুলতেই মায়ের প্রশ্রয়মাখানো হাসি হাসি মুখটা চোখে পড়ল, “চল, তোর নানুকে দেখি আসি। প্রতি ঈদে তো নানুর হাতে পায়েস খাস, আজ তুই না হয় নানুকে খাইয়ে দিবি।“
অনেকদিন আগের কথা হলেও স্পষ্ট মনে পড়ছে - মায়ের কথাটা শুনে শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলাম তার দিকে কিছুক্ষণ; তারপর মুখখানা আবার ফিরিয়ে নিয়েছিলাম দেয়ালের দিকে। আসলে কি ঘোরাফেরা করছিল আমার মনের কোণে, তা সবিস্তারে বলতে পারব না। তবে মায়ের উপর যে ক্ষোভ তৈরী হয়েছিল, তা যে নানুর পানে তীব্র গতিতে ধাবমান হচ্ছিল, বুঝতে পারছিলাম। অসুখটা যেহেতু সেরেই যাচ্ছে, তাহলে ঈদটা আসার আগেই নানু বাসায় চলে আসতে পারতো না! না, হাসপাতাল থেকে সব রোগ তাড়িয়ে তারপর বাসায় ফিরতে হবে বুড়িকে! নিজের লাভটাই দেখছে ষোলআনা, আর এদিকে আমাদের যে সবকিছু বুড়িগঙ্গার জলে বিসর্জন দিতে হচ্ছে, সেদিকে একটুও খেয়াল নেই!
মনে আছে, ক্ষোভের পারদ যখন ফুটছিল, তার গনগনে আভায় আমার চোখের জল শুকিয়ে আমসত্ত্ব হয়ে গিয়েছিল! পরে সে আমসত্ত থেকেই অনেক কষ্টেও আর এক ফোঁটা জল বেরুল না, যখন ওই দিন বিকেলেই নানুর লাশ এসে পৌঁছুলো বাড়িতে। শুধু আমার জন্যই ইচ্ছে করেছিলেন মা; যখন অনেক বলে-কয়েও রাজী করাতে পারলেন না আমায়, হাসপাতাল যাওয়াটাই ক্যানসেল করে দিয়েছিলেন। অথচ ওইদিন দুপুরেই খবর আসে, নানুর কন্ডিশান হঠাৎ করেই খুব খারাপ দিকে টার্ন করেছে; কিডনি, হার্ট, লাং- সব নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে আস্তে আস্তে! মা’কে কোন মতে বুঝিয়ে- শুনিয়ে রেখে বাবা একাই চলে গিয়েছিলেন হাসপাতালে, আর বিকেলের মধ্যেই নানুকে নিয়ে ফিরে এসেছিলেন!
আমার বুকটা ফেটে চৌচির হচ্ছিল! তবে দুনিয়ার সবচেয়ে কাছের মানুষটি চলে যাচ্ছেন বলে নয়, বরং একটা অপরাধবোধ ক্রমশ পিষে ধরছিল আমায়, আর ভেতরের আর্তনাদকে চাপা দিচ্ছিল! আমার কেবলই মনে হচ্ছিল, আহা, আমি যদি যেতাম হাসপাতালে, তাহলে হয়ত নানুটা মরে যেত না! তবে এ শুধুই বালক মনের কাঁচা আবেগের বিস্ফোরণ ছিল; কোন যৌক্তিক ভিত্তি ছিল না একে সত্যি ভেবে নিয়ে পড়ে থাকার। আর থাকিওনি আমি; মৃত্যুর গ্রহণকালটা পেরিয়ে যেতেই ভুলে গিয়েছিলাম সমস্ত কিছু, আগাপাছতলা শুদ্ধ।
২.
“আপনি কি অশরীরি কোন কিছুতে বিশ্বাস করেন?” ডাক্তারের প্রশ্নে ফিরে এলাম শৈশব থেকে। আবারো তাকালাম তার দিকে – লোকটি কী চাইছে বুঝতে পারছি না। হাত ধরে নিয়ে এসে বসালেন, অথচ মনে হচ্ছে ভূত-প্রেতে বিশ্বাসের উপর দিয়ে চালিয়ে দিতে চাইছেন ব্যাপারটা! হ্যাঁ, ছোটবেলায় তো সবার মত আমিও ভূতে বেজায় ভয় পেতাম। কিন্তু বড় হতে হতে সে ভয় কেটে গিয়েছে অনেকটাই, একেবারে হাওয়া হয়ে না গেলেও। আর… এখন… এই বড়বেলাতে…যে ঘটনাগুলো ঘটছিল আমার জীবনে, তার সাথে ভয়ের সম্পর্ক থাকলেও ভূতের কোন সম্পর্ক আছে বলে একদমই বিশ্বাস করিনি আমি।
আমি তখন ফাইনাল ইয়ারে। একদিন কলেজে যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছিলাম। চুলটা আঁচড়ে ঠিক লাইনমত এনেছি, ঢেউ তোলাটা তখনো বাকী ছিল, এমন সময় মা এসে দাঁড়ালেন দরজার কোণে, “ তোর খালুর শরীরটা না কি ভাল না! ফেরার সময় একটু দেখে আসিস।“ আমি চিরুনিটা হাতে ধরা অবস্থাতেই জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আবার কী হইল! খালুজান না কিছুদিন আগেই হাসপাতাল থেকে সুস্থ হইয়া ফিরলেন!’ কথাটা মিথ্যে নয়; মাস তিনেকও হবে না, যমে-মানুষে টানাটানি হয়েছিল খালুকে নিয়ে। খালুর পোস্রাব নালী সরু হয়ে গিয়েছিল, রক্ত পড়ছিল সেখান দিয়ে। খুব জটিল একটা অপারেশানের দরকার পড়েছিল, আর খুব দ্রুতই তা সমাধা করতে হত।
সাকসেসের সম্ভাবনা ছিল ফিফটি ফিফটি। আর যে কজন প্রফেসার সার্জন ছিল হাসপাতালটিতে, সবারই কোন না কোন শিডিউল ছিল। সুতরাং, একজন সহকারী সার্জনের উপর যখন দায়িত্বটা ন্যস্ত হল, কান্নার দেয়াল ভেঙে পড়ে হুলুস্থল বেঁধে গেল আমাদের পরিবারে! আমার একটাই খালা, সেই অর্থে, খালুও একজনই; আর তার পুঁচকে দুটো ছেলে-মেয়ে। মনে আছে, অপারেশানের রাতে কেউ একফোঁটা ঘুমায়নি। পরের দিন ডাক্তার গার্জেনদের কেবিনের বাইরে ডেকে যখন বলছিলেন, ‘সব কিছুই তাঁর মর্জি! না হলে, অপারেশানের সময় একটা গুরুত্বপূর্ণ গ্লান্ড খুঁজে পাচ্ছিলাম না! আশা প্রায় ছেড়েই ….”, কেবিনের অভ্যন্তরে খালু তখন টিভিতে প্রদর্শিত অ্যাশেজ ট্রফির শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচটা নিয়ে পুরো তেতে উঠেছেন!
আজ শৈশবের সেই অভিশপ্ত ঈদের দিনটা যেন ফিরে এল, আর রাগটা মায়ের উপর থেকে ধীরে ধীরে খালুর পাড়ে গিয়ে চড়তে শুরু করল! কী পেয়েছে লোকটা! কদিন আগেই বাড়িসুদ্ধ মানুষের ঘুম হারাম করে এখন আবার নেমেছেন মাঠে! একটুও জিরোতে দেবেন না নাকি কাউকে! সারাটা জীবন অনিয়ম করে বেরিয়েছেন, নিজের স্বাস্থ্যের দিকে খেয়াল করেননি, সংসারের কথা ভাবেননি, এখন তার মাসুল গুণতে হচ্ছে আমার খালা ও ছোট ছোট ভাইবোনগুলোকে! বিরক্তিতে চোখ-মুখ কতটা কুঁচকে গিয়েছিল জানি না, কিন্তু সেই অবস্থাতেই ফোন দিলাম খালামনিকে, আর ওপার থেকে ভেসে এল সুমিষ্ট গলা, ‘আরে তেমন কিছু না….কে কইল তোরে…. ও বুঝছি, কাইল শরীরটা একটু খারাপ করছিল, বুজিরে জানাইছিলাম কতায় কতায় …”
আমার চোখ-মুখ এতটা শক্ত হয়ে যায় যে তা শরীর বেয়ে রাস্তার কংক্রিট অবধি পৌঁছে যায়, আর চলার গতিকে রুদ্ধ করে দিতে থাকে। ঘর থেকে বেরুনোর আগে মায়ের ঘরে একবার উঁকি দিয়েছিলাম অবশ্য - এই এক সমস্য আমার মাকে নিয়ে; তিনি যেন সবার গার্জেন, কারো কিছু কাশি-টাসি আসলেও তাকে নেমে পড়তে হবে সুরক্ষায়, আর ব্যবহার করবেন আমাকে! আমার যেন আর কোন কাজ টাজ নেই, কলেজ, লেখাপড়া, এক্সাম সব কিছু শিকেয় উঠলেই বা কী!
ক্যাম্পাসে ঢোকার সাথে সাথে অবশ্য ব্যাপারটা ভুলে যাই আমি। ওখানে আবার সেদিন একটা প্রীতি ক্রিকেট ম্যাচ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। মনে আছে, খুব দুর্দান্ত একটা শো হয়েছিল। আমাদের দল জেতার দ্বারপ্রান্তে ছিল; খেলা শেষে কিভাবে সেলিব্রেইট করব তা নিয়ে প্ল্যান করতে শুরু করে দিয়েছি - হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল, আর ওপারের কথাগুলি পুরো না শুনেই একটা বন্ধুর বাইক ধার করে আমি ছুটতে শুরু করি ওসমানি হাসপাতালের দিকে। কিন্তু মাঝপথে আবার ফোন আসে- ওপ্রান্ত থেকে বাবার থমথমে গলাটা শুনতে পাওয়া যায়, আমায় বাসায় চলে আসতে বলছেন! আসলে এবার একটুও টাইম নেননি খালু, বা বলা ভাল, কারো সময় নষ্ট করেননি বেচারা! কে জানে, হয়ত দিনের বেলায় আমার করা অভিযোগটা শুনতে পেয়েছিলেন তিনি!
খালুর ঘটনাটা কয়েকটা দিন আমায় ভীষণ দুর্যোগের মধ্যে রেখেছিল, রাতে চোখের পাতা অনেক চেষ্টাতেও এক করতে পারিনি; কখনো ঘরের সিলিং, কখনো ঘর থেকে বাইরে গিয়ে পৃথিবীর সিলিংটার দিকে তাকিয়ে থেকেছি আনমনে! যতই বাঁধা দিতে চাইছিলাম, কুরে কুরে বড় হচ্ছিল আর স্থায়ী বাসা বাঁধছিল ভাবনাটা মনের মধ্যে। যদি সেদিন মায়ের অনুরোধে সাড়া দিয়ে খালুকে দেখতে যেতাম, তাহলে হয়ত মৃত্যুটা এড়ানো যেত! আমার মধ্যে মনে হয় ….একটা অশুভ শক্তি আছে, যা আমায় সঠিক কাজটা করতে বাঁধা দেয়, আর বিভিন্ন অঘটনের সূত্রপাত করে!
৩.
‘আপনি এমন করে ভাবছেন কেন? আর এতটা পার্সোনালিই বা নিচ্ছেন কেন? আমাদের সবার জীবনেই এমন দুর্ঘটনা ঘটে। আমরা যেমনটা চাই, ভাবি বা প্লান করি, তার বিপরীতই ঘটে প্রায়।“ ডাক্তার গমগমে কণ্ঠে বলে যাচ্ছিল কথাগুলি। কিন্তু তার লেকচার শোনার মত মনের অবস্থা ছিল না আমার। কারণ যে ঘটনাগুলি বলা হল, তা তো ছিল কেবল সূচনা। এরপর থেকে যে বীভৎস আর নারকীয় জীবন আমায় ফেইস করতে হচ্ছে, তার ভাগ নেয়ার তো আর কেউ নেই! একাই বহন করতে হচ্ছে আমায়!
সেবার অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার শিডিউল চলে এসেছিল একটু আগেভাগেই, আর আস্তে আস্তে চেনা পৃথিবীতে ফিরে এসেছিলাম আমি। হাতে সময় একদম ছিল না, অথচ সিলেবাসের বেশিরভাগই জমে ছিল। ফেল করলে কাউকে মুখ দেখাতে পারব না- আমাদের পরিবারে এই রেকর্ডটি এখন পর্যন্ত নেই কারো। লজ্জা থেকে মুক্তির তাড়নায় দিন রাত বইতে মুখ গুঁজে থাকলাম। অন্য সময় হলে কী হত জানি না, কিন্তু দুঃসহ সময়ের ঠিক পরের সেই একনিষ্ঠ ধ্যান আমায় পরীক্ষাগুলো পার করিয়ে নিল না শুধু, ফাটাফাটি একটি রেজাল্ট এনে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিল, এমনকি চাকরির বাজারেও সুড়সুড় করে ঢুকিয়ে দিল।
‘তার মানে, আপনার কাছে যে ঘটনাগুলি অদ্ভুত বলে মনে হয়, তা হঠাৎ করেই ঘটে, আর তারপর দীর্ঘদিন ধরে সেরকম কিছু আর ঘটে না। কিন্তু আপনার মনের এক গোপন ঘরে তা লুকিয়ে থাকে। আর সেই ঘরের দুয়ারটা হাট করে খোলা থাকে …আমার মনে হয়, অবচেতন মনে তারা বংশ বিস্তার করে, কার্ল জুং বলে একজন বিশিষ্ট সাইকিয়াট্রিস্ট ছিলেন …’ ডাক্তার যখন আমায় থামিয়ে দিয়ে এক নাগাড়ে বলে যাচ্ছিলেন, মাথাটা প্রবল বেগে চক্কর দিতে শুরু করেছিল আমার! হতাশা মিশ্রিত ক্ষোভটা পুনরায় সতেজ হতে শুরু করেছিল - সমস্যার পুরো চিত্র ধারণ করার ক্ষমতা এই লোকগুলির ধাতে নেই, এরা পারে শুধু পুঁথিগত বিদ্যার রস দিয়ে হালকার উপর ঝাপসা মাখন লাগাতে!
মাথাব্যথাটা নিয়ন্ত্রণে আনতে চেম্বারের দক্ষিন কোণে অবস্থিত জানালাটার দিকে পা বাড়াই আমি। বাইরে মানুষ আর যানের তীব্র স্রোত, রং-বেরংয়ের। একটা শক্তিশালী বাতাস সবার গা ছুঁয়ে বিপুল বেগে সামনে এগিয়ে যাচ্ছিল; কিন্তু সবার উপর তার আবেগ সমান হচ্ছিল না, কারো শুধু চুলের ডগা স্পর্শ করছিল, কারো গায়ের জামাটা উড়িয়ে নিচ্ছিল, আবার কারো শুধু অনুভূতিতেই বিচরণ করছিল, এই যেমন আমি। উপভোগ করতে শুরু করে দিয়েছিলাম; হঠাৎ কিছু একটা চোখে পড়তেই শিউরে উঠি আমি, আর কাঁপতে কাঁপতে ডাক্তারের টেবিলে ফিরে আসি। ডাক্তার সাহেব তখন গভীর মনযোগের সাথে কিছু একটা আঁকিবুকি করছিলেন তার ক্ষুদে নোটবুকটাতে। দেহখানা সামান্য ঝুঁকতেই চোখে পড়ল তিনটে মানুষের মুখ; নোটবুক পাতাটার তিন কোণে অবস্থান নিয়েছে তারা। একটির নীচে লেখা আছে আমার নাম, দ্বিতীয়টিতে মা, আর তৃতীয়টিতে ‘মৃত ব্যক্তি’। আমার উপস্থিতি টের পেয়েও ডাক্তার মাথা তুললেন না; বরং কিছুক্ষণ গভীর চিন্তায় মগ্ন থেকে ঐ অবস্থাতেই জিজ্ঞেস করলেন, “আচ্ছা, ছোটবেলায় এরকম কিছু কি ঘটেছিল, যা আপনাকে ভীষণ ভয় পাইয়ে দিয়েছিল?”
হ্যাঁ, আমার এরকম একটা ঘটনা আছে, এবং এখন পর্যন্ত আমি ছাড়া পৃথিবীর আর কারোরই তা জানা নেই। তবে এই অবিশ্বাসী ও অর্বাচীন ডাক্তারটিকে সে কথা জানানোর বিন্দুমাত্র ইচ্ছে নেই আমার। শৈশবের দিনগুলিতে বার্ষিক পরীক্ষার পরপরই নানুবাড়ি যাওয়া ছিল আমাদের জন্য রুটিন ওয়ার্কের মত। নানুবাড়ির পেছনে একটা জংগলের মত ছিল - সেখানে আমরা কাজিনরা সবাই দল বেঁধে আউটিং করতাম, বিভিন্ন রকম এডভেঞ্চারে মেতে উঠতাম। এমনি এক আউটিংয়ে দলের লোকজন একটু বেশীই ছিল, আর জংগলটাও খুব ভরতি হয়ে ছিল গাছে-লতায়-পাতায় যাদের বাঁধন টুটে সামনে এগোনো কিছুটা চ্যালেঞ্জিং ছিল! কিছুটা এগুনোর পর হঠাৎ একটা অদ্ভুত দেখতে অচেনা বুনো ফুল আমার চোখে আটকে দেয়; এতটাই বিভোর হয়ে যাই যে খেয়ালই করিনি কখন দলছুট হয়ে গিয়েছি। অবশ্য একটা কর্কশ স্বরে আমার হুঁশ ফিরে আসে, আর ঘাড় ঘোরাতেই একটা অতিকায় কাক চোখে পড়ে - সরাসরি তাকিয়ে আছে আমারই দিকে! কী কুচকুচে তার রং, আর কী ভীম-ভীষণ তার চেহারা!
নিরাপদ দূরত্বেই মাটির উপর দাঁড়িয়েছিল সে। প্রথমে কিছুটা ভয় পেয়ে গেলেও পরে একটা ঢিল ছুড়ে তাড়াতে চেষ্টা করি তাকে। কিন্তু কাকটি দু’পা পিছিয়ে ফের দাঁড়িয়ে পড়ে। এরপর কোথা থেকে আরো কতগুলো কাক মুহূর্তের মধ্যে এসে হাজির হল সেখানে। নতুন কাকগুলি যেন সবাই প্রথম কাকটইর কার্বন কপি, একই আকার, একই আকৃতি! ওদের কেউ দাঁড়াল প্রথম কাকটির আশেপাশে, কেউ কেউ অবস্থান নিল কাছেই হাঁ করে দাঁড়িয়ে থাকা গাছের ডালগুলিতে! মাত্রই কয়েকটা মুহূর্ত, কোথাও কোন আওয়াজ নেই, বিশ্বচরাচর যেন থেমে গিয়েছিল। আর তারপরই সবাই একযোগে এক স্বরে ডাকতে শুরু করল আমার দিকে সরাসরি তাকিয়ে! আমার মেরুদন্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতে লাগল! বুঝতে পারলাম না কেন এমন হচ্ছে! আমি তো ওদের কোন বাসা ভেঙে দেইনি, অথবা, ওদের কাউকে আক্রমণ করিনি। বা ওদের কোন শবদেহও কাছে ধারে দেখতে পাইনি! তাহলে!!! হাত পা অবশ হয়ে গিয়েছিল আমার, থরথর করে কাঁপছিল সারা দেহ! অজ্ঞানই হয়ে যেতাম হয়ত; হঠাৎ দেখতে পেলাম দলটা ফিরে আসছে। ওদের শোরগোলের শব্দ শুনেই কিনা, মুহূর্তের মধ্যেই অনেকটা ভোজবাজির মত উধাও হল কাকগুলো! আমার দলের লোকদের কারো কারো চোখ পড়ল আমার দিকে; কিন্তু সেখানে কোন বিষ্ময় ছিল না! ওদের কেউ কোন কিছু জিজ্ঞাসাও করল না আমায়!
দলের মধ্যে থাকলে সবারই একটা দাদাগিরির টেনডেনসি থাকে। আমার মধ্যেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। আমি জানতাম ঘটনাটা জানালে কেউ তো বিশ্বাস করবেই না, উল্টো আমার পৌরুষ নিয়ে প্রশ্ন উঠবে; আর দাদাগিরিটাও হুমকির মুখে পড়বে। তাই পুরো চেপে যাই বিষয়টা আমি সেদিন। এবং এখন পর্যন্ত চেপেই যাচ্ছি। তবে ঐ ঘটনাটা কিন্তু থেমে থাকেনি মোটেও; বরং সেই যে শুরু হল, তারপর থেকে আমার জীবনের একটা স্থায়ী অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়াল এই কাক অধ্যায়! কোথাও আমায় একা পেলেই হল - প্রথমে একটা কাক আসবে, তারপর তাকে অনুসরণ করবে আরো কতগুলি। আর তাদের এই অনুসরণ চলতে থাকে পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকি না কেন! প্রথম প্রথম খুব ভয় পেলেও এখন অনেকটাই গা সওয়া হয়ে গেছে! অনেক ভেবে আমার মস্তিষ্ক এই বের করেছে যে, কাকগুলো হয়ত আমার মাঝে কিছু একটা দেখে থাকবে! ওদের ইন্দ্রিয় তো আর আমাদের মত নয়। হয়ত এমন কিছু পেয়েছে আমার মধ্যে, যা ওদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। মাঝে মাঝে তো, কাকেদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ হওয়াটা উপভোগের উপলক্ষ তৈরী করে আমার জন্য!
ছোট থেকেই কথাটা সবার মত আমিও জানি – ডাক্তার ও উকিলের কাছে কিছু লুকোতে নেই, সব কিছু খুলে বলতে হয় তা সে যতই অপ্রিয় হোক। কিন্তু এখন পর্যন্ত ডাক্তারটির যে ভাবগতিক দেখতে পাচ্ছি, কাকের গল্পটা আমার ব্যাপারে মানসিক রোগীর নিশ্চিত রায়ে পৌঁছে দেবে তাকে। অথচ আমি কী করে তা হতে পারি! আমি তো সব কিছু বুঝতে পারছি, কী কী হচ্ছে সব কিছুর পুংখানুপুংখ বর্ণনা দিতে পারছি। শুধু কেন হচ্ছে, সেটুকুই জানা নেই আমার! এই যে মাস ছয়েক আগে আমার মামার ঘটনাটা! মামার বাসা থেকে মা আমায় ফোন দিয়ে বলল, অফিস থেকে ফেরার সময় তোর মামাকে একটু দেখে যাস! প্রচন্ড ক্লান্ত ছিলাম বলে নয়, মায়ের এই অনুরোধটাই আমার বিরক্তি উৎপাদন করেছিল, একটা প্রচ্ছন্ন জোর ছিল সেখানে!
গেল বছর মামার স্ট্রোক হয়েছিল; হার্টে রিং পরিয়ে ব্লকের একটা আপাত সমাধান করা হয়েছিল। এরপর তো মামা দিব্যি ভাল আছেন, খাচ্ছেন, ঘুরছেন, কাজ করছেন। মামার বাসা থেকে গত সপ্তাহেও ঘুরে এলাম; একটা পাঞ্চাবি নিয়ে গিয়েছিলাম। মামার আদরের যেমন কোন তুলনা নেই, তার রাগেরও তেমনি। দেখা হলেই মামার লম্বা লম্বা কথার দাপট শুরু হয়ে যেত; নেমে আসতো উপদেশের প্লাবন অনেকটা শাসানির সুরে! মামাকে আমি ভালবাসতাম বেশী, না কি ভয় করতাম - তা জানা নেই; কিন্তু সেদিন একটুও ইচ্ছে করেনি তাকে দেখতে যেতে। শুধু মামাত ভাইকে একটা ফোন দিয়েছিলাম; আর যখন সে জানাল যে, জাস্ট একটু বুকে ব্যথা উঠছিল, এখন সব ঠিকঠাক, তখন মায়ের প্রতি তৈরী হওয়া রাগটা মামার দিকে ঘুরে গিয়েছিল যথারীতি। কই এখন সামান্য বুকব্যথা হলেই আত্মীয় স্বজনকে ডাকাডাকি কেন! নিজেকে তো সব সময় মনে করে এসেছেন বাদশা আলমগীর!
বিরক্তিটা এতদূর পৌঁছেছিল যে বাসায় না যেয়ে একটা সিনেমা হলে ঢুকি পড়ি আমি। হাফ বিরতিতে বাইরে এসে একটা সিগারেট ধরিয়ে দুটো সুখটান দিয়েছি, ঠিক এই সময় ক্রিং ক্রিং - বাবার ফোন, "তোমার মামার অবস্থা খুবই সঙ্গীন। বাথরুম ভেঙে বের করা হইছে। চেতন নাই। দেরি না করে বারডেমে চলে আস।“ বলা বাহুল্য, মামাকে আমি পাইনি যেয়ে। আর এ ঘটনাটার পরেও আমার মনে হতে থাকে, যদি আমি মায়ের ডাকে সাড়া দিয়ে যেতাম মামাকে দেখতে, তাহলে এই শকিং সময়টা হয়ত এড়াতে পারতাম! বলতে কী, এ ঘটনাটার পর পুরোপুরি ভেঙে পড়ি আমি। যে মামা দেখা হলেই চুমোয় ভরিয়ে দিত, আর নিজের জন্য ব্যয় করত টাকা গুঁজে দিত পকেটে, এই এতটা বয়সেও - তাকে হারানোর জন্য যতটা কষ্ট আমার হল, তার থেকে অনেক বেশি তাতিয়ে বেড়াল একটা অপরাধবোধ!
অন্য ঘটনাগুলোর মত এই অপরাধবোধটাও এক সময় স্তিমিত হয়ে এল। কিন্তু ভয়ঙ্কর কুটিল এক সময় যেন অপেক্ষা করছিল আমার জন্য দুবাহু বাড়িয়ে! এরপর এরকম ঘন ঘন হতে লাগল, হয়ত আমার সচেতনতার কারনেই বিষয়টা আমার নজরে এল - আগেও হয়ত হয়েছে, কিন্তু খেয়ালের বাইরেই থেকে গিয়েছে! বিষয়টা হল, আমি যদি কাউকে নিয়ে খুব আবেগাক্রান্ত হই, একটা প্রবল অভিমান যদি ঝরে পড়ে, কোন যুক্তিবলেই ঐ ব্যক্তিটিকে যদি কোন ওয়াকওভার না দেয়া যায়, তাহলে কিছু একটা ঘটবে! আর সেটা হবে ভয়ংকর! এরকম হতে লাগল আমার কোন আত্মীয়কে নিয়ে, বন্ধুকে নিয়ে, সহকর্মীকে নিয়ে! একটা সময় আমি ভাবনাটার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করলাম, কিন্তু ভাবনার বায়ু আরো প্রবল হল তাতে এবং আমায় তছনছ করে উড়িয়ে নিয়ে চলল নরকরাজ্যে!
যখনই নতুন কোন ভাবনা ঘিরে ধরত আমায়, ভীষণ অস্থির হয়ে পড়তাম; মাঝে মাঝে অতলে হারিয়ে যেতাম, মাথাটা শূন্য হয়ে ঝুলে পড়ত; মনে হত, আমি বুঝি আর আমার মাঝে নেই! আমি কে, কেন এসেছি, কি কাজ! নিজেকে একটা অচেনা প্রাণী মনে হত আমার! সেই সময়টা একটা অবর্ণনীয় আতংক সারাটা ক্ষণ তাড়া করে ফিরত আমায়! তাহলে কি সত্যি সত্যি আমার মধ্যে অন্য মানুষের কোন মৃত্যু সংকেত বর্তমান! আমি তাহলে এই সৃষ্টিজগতের একজন মৃত্যুদূত! আবিষ্কারটা আমার স্বাভাবিক জীবনকে ধ্বংসের দোরগড়ায় নিয়ে এল, হরণ করল জীবনের সব স্বাভাবিক সুখ আর আনন্দ!
৪.
‘না, না, ব্যাপারটা এত ডিরেক্ট নয়, আপনি যেরকম ভাবছেন। আপনি কারো প্রতি অসন্তুষ্ট হচ্ছেন, আর আজরাইল ছুটে আসছে - এত সরাসরি নয় কিন্ত ঘটনাটা, আপনার কথাকেই যদি বিশ্বাস করি।“ ডাক্তারের কথাগুলি সান্ত্বনার পরিবর্তে আমার মধ্যে নতুন করে জ্বালা ধরিয়ে দিল! আমি নিশ্চিত, এতক্ষণ পর্যন্ত সে আমার একটা কথাও বিশ্বাস করেনি।
“আসলে কয়েকটা শর্ত মানতে হবে আপনার কথিত মৃত্যুগুলোকে নিয়মে দাঁড় করাতে হলে, যেমনঃ আপনার মা’কে অনুরোধ জানাতে হবে, তারপর আপনাকে সেই অনুরোধ প্রত্যাখান করতে হবে, সাম্প্রতিক অসুখের রেকর্ড থাকলেও সেই সময় সাবজেক্টের শারীরিক কন্ডিশান বেটার থাকতে হবে, আর সর্বোপরি, আপনার মধ্যে ভালবাসা ও ঘৃণার একটি দ্বন্দ্ব তৈরী হতে হবে।“ ডাক্তার বলে চলে আমার ক্রোধ বা অভক্তির প্রতি কোনরূপ ভ্রূক্ষেপ না করে।
‘আমার মাকে আপনি অযথাই টেনে আনছেন এসবের মাঝে, ডাক্তার সাহেব। মায়ের বিন্দুমাত্র ভূমিকা নেই ঘটনাগুলোতে। আমার অনুরোধ প্রত্যাখানের মধ্যেই আসলে লুকিয়ে আছে রহস্যটা। আমি যদি দেখতে যেতাম, তাহলে হয়ত তাদের প্রাণটা হারাতে হত না। মানে, আমি যদি কারো প্রতি সদয় থাকি, তাহলে সে বেঁচে যায়। কিন্তু বিরূপভাবাপন্ন হলেই….যেমন, ধরুণ, এই কিছুক্ষণ আগেই আমার মাথায় এসেছে একটি নাম…জানালার ধারে দাঁড়িয়েছিলাম যখন, হাইহিল পড়া এক মহিলাকে দেখে একজনকে মনে পড়ে যায় আমার… এক নিকটাত্মীয়, আমার মামি…ছোটবেলায় যে আমায় মুখে তুলে কত যে খাইয়েছে… তার প্রতি প্রবল একটা নিরাসক্তি অনুভব করছি আমি এখন … তাকে কোনদিনই… ধরতে পারিনি …আমি। তার স্নেহ… যেন সবটাই অভিনয়।“
‘আচ্ছা, তার কোন অসুখ-টসুখ হয়েছিল সম্প্রতি?’ ডাক্তার উস্কোখুস্ক কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করেন আমায়।
‘বড় কোন অসুখ না, সিস্ট-টিস্ট কি জানি হইছিল মাসখানেক আগে, ছোটখাট একটা সার্জারি করতে হইছিল। নিজের স্বাস্থ্যের দিকে কমই খেয়াল ছিল মহিলার, সারাক্ষণ কোথায় কার সাথে কাকে লাগিয়ে দেয়া যায়, সেই তালে থাকেন। সব শুভকাজে একটা বাঁধা দেয়া চাই-ই! না হলে পেটের ভাত হজম হয় না!’ বিরক্তিতে কপালের শিরাগুলি ভীষণ রকম মোচড়াতে থাকে আমার।
“আচ্ছা, আজ তাকে নিয়ে আপনার মায়ের সাথে কোন কথা হয়েছে?” ডাক্তার জানতে চান।
“আবার মা! বললাম না, ব্যাপারটা ঘটে আমার মাথায়, আর কারো কন্ট্রিবিউশান নেই এখানে! আমার মধ্যে যাকে নিয়ে দোটানা তৈরী হয়, একটা অস্থিরতা পেয়ে বসে…” আমি মাথাটা চেপে ধরি দু হাত দিয়ে; হঠাৎ করেই ভেতরের রগগুলো এতটা তড়পাতে শুরু করেছিল যে কথা বলতে কষ্ট হচ্ছিল আমার!
“ঠিক আছে, ঠিক আছে। শান্ত হোন দয়া করে। আচ্ছা, একটা কাজ করতে পারবেন? কাউকে ফোন করে একটু জানবেন যে, আপনার মামির এখন কি অবস্থা?’ ডাক্তারের কণ্ঠ থেকে এক ঝাঁক অচেনা ঔৎসুক্য ঝরে পড়ে।
‘আমি ফোন করতে পারব না, আপনি করুন।।.. মাথার সব তার ছিঁড়ে যাচ্ছে আমার!... এই নিন আমার ফোন… কল লিস্টে মামিদের বাসার নাম্বার পেয়ে যাবেন।“
ডাক্তার প্রথমে কিছুটা দোনামনা করলেও পরে নাম্বারটা খুঁজে বের করে চেপে দিলেন। কিছুক্ষণ রিং হতেই ওপার থেকে ভেসে আসে শব্দেরা। দুইপ্রান্তে কথা বিনিময়ের পর ডাক্তার যখন টেবিলের উপর রাখেন ফোনটা , তখন তার মুখ পুরো ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে, রক্তকনিকারা প্রবল বেগে ছুটে বেড়াচ্ছে মুখের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্তে।
আমি প্রশ্নাতুর চোখে তাকালে ডাক্তার বললেন, ‘বলতে পারছি না কার সাথে কথা হল, কিন্তু কী কর্কশ সেই স্বর! জানাল, আপনার মামি নাকি সত্যি মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলেন। অবশ্য এখন ডেঞ্জার মুক্ত।“
‘তাহলে তো মিলে যাচ্ছে….” আমার মেরুদণ্ড দিয়ে শীতল স্রোত বয়ে যেতে থাকে!
“না, কিচ্ছু মিলেনি, আরো খতিয়ে দেখতে হবে আমাদের। আচ্ছা, একটা কাজ করবেন? খুব ভাল হয় তাহলে। যাবেন না কি মামীকে দেখতে?” ডাক্তারের চোখে হঠাৎই খেলে যায় বিদ্যুতের একটা চমক!
‘না, না, আমি যাব না! আর গেলেও কাজ হবে না। কোন কিছু বদলাবে না। তার নিয়তি লেখা হয়ে গেছে!“
‘যেতে তো আপনাকে হবেই, সঙ্গে আরো একটা কাজ করতে হবে, মামিকে যেনতেন উপায়ে অসুস্থ করে দিতে হবে। তাড়াতাড়ি করুন, হাতে সময় কিন্তু একদমই নেই। আর একটা কথা, পথে কোন কিছুতেই যেন ঘাবড়াবেন না… যা কিছু সামনে আসবে, উপেক্ষা করে এগিয়ে যাবেন। মনে রাখবেন, আপনার মামির জীবনটা এখন আপনারই হাতে!‘
৫.
ডাক্তারের কথায় কি যেন একটা ছিল! আমি দৌঁড়ুতে শুরু করি। জ্যাম এড়াতে একটা বাইপাস রোড ধরি, যা দিনের বেলাতেও নিরিবিলি থাকে, আর তখন তো ছিল রাত। দিন দুয়েক আগেই কৃষ্ণপক্ষ শুরু হয়েছিল। তার সঙ্গে তাল মেলাতেই কিনা, স্ট্রিট লাইটগুলোও যেন কৃষ্ণপক্ষ পালন করছিল। না হলে, এতগুলো লাইট একযোগে অকেজো হয়ে পড়ে, কে কবে শুনেছে! রাস্তায় মানুষজন নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে একটা দুটো গাড়ির শো শো শব্দ, এছাড়া কিছু রিকশাসাইকেলের টুংটাং!
আমি একটা বাইক নিয়ে রওনা দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুদূর এগোতেই আচমকা ব্রেক কষতে হল! নেহায়েত একটা কাক পথের মাজখানটিতে দাঁড়িয়েছিল, আর আমার মনে হয়েছিল কোন কালো বোরখা পড়া নারীমূর্তি বুঝি! এই ঘোর বিপদের মধ্যেও হাসি পেল আমার; নিজের নির্বুদ্ধিতাকে বকতে বকতে যখন স্টার্ট দিতে গেলাম বাইকটা, তখন আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে কা কা করে উঠল সেই কাকটা! এর পরপরই আরেকটা কাক আমার ঠিক মাথার উপর দিয়ে উড়ে গেল এবং চক্রাকারে ঘুরতে শুরু করল। তারপর শুরু হয়ে গেল সমাবেশ, কোথাও থেকে পঙ্গপালের মত উড়ে এল তারা শয়ে শয়ে, হাজার হাজারে! আমার সারা শরীর ভয়ে থরথর করে কাঁপতে লাগল! চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসতে লাগল! আমার সব অঙ্গপ্রত্যংগ যেন নিমিষেই বিকল হয়ে গেল, সব অনুভূতি উবে গেল, একটা কুচ-কালো অন্ধকার ডানায় আমি যেন কোন যমপুরীতে ভেসে চললাম!
আওয়াজটা ফোনের ছিল না, আমি নিশ্চিত। আমার মুঠোফোনে ইনকামিং মেসেজের জন্য আলাদা একটা টোন সেট করে নিয়েছিলাম আমি। মনে পড়ে, অপশানগুলোর মধ্যে সব থেকে অদ্ভুত টোনটিই আমি বেছে নিয়েছিলাম। আর সেই টোনই যমপুরি থেকে সেই বাইপাসের থেমে যাওয়া বাইকে এনে ফেলেছিল আমায়, প্রায় নিশ্চিত আমি। ডাক্তারের ক্ষুদে বার্তাটা সেই কৃষ্ণপক্ষে জ্বলজ্বল করছিল, “ ফোন ধরছেন না কেন? কই আপনি? পৌঁছাননি এখনো? দেরী করছেন কেন?” মুহূর্তের মধ্যেই আমার মনে পড়ে গিয়েছিল ডাক্তার সাহেবের কথাটা - আপনার মামির জীবন সংকটাপন্ন। জীবনের সব শক্তি জড়ো করে বাইক স্টার্ট দিয়েছিলাম আমি, এরপর চলতে শুরু করেছিলাম কাকের আদিগন্ত বাহিনীকে চূর্ণবিচুর্ণ করে!
কিভাবে যে পৌঁছেছিলাম মামির বাসায় মনে নেই। কিন্তু এত রাতে আমায় এ রূপে দেখে মামি ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছিল, আর তার রোগা শরীরটা তার ধকল সইতে না পেরে ফিট হয়ে গিয়েছিল! মনে পড়ছে, অচেতন মামিকে আমিই নিয়ে গিয়েছিলাম হাসপাতালে।
৬.
সপ্তাহখানেক পরে ডাক্তার সাহেবের চেম্বারে আবার ঢুকেছিলাম আমি। ইদানিং কেন জানি মনে হচ্ছে, আমার আর কোন অসুখ টসুখ নেই। সামনে হবে কিনা তা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েই গেছে। ডাক্তার জানালেন, সামনেও আর হবে না। আমি অবাক চোখে তাকালে হাসতে হাসতে বললেন, ‘আরে ভাই, আমি কিছু করিনি। সব কিছু তো আপনিই করলেন। আমি শুধু সমীকরণটা খুঁজে বেড়াচ্ছিলাম; যখন ধরে ফেললাম, তখনই তো সমাধান সূত্রটাও হাতে এসে গেল। মামির জীবনে যে আপনার জীবনটাও পোরা ছিল।“
ডাক্তারের চেম্বার থেকে বেরুতে বেরুতে আবার মেসেজ টোনটা ডেকে উঠল। আর মুহূর্তের মধ্যে চিন্তাটা খেলে গেল আমার মাথায় বিদ্যুত স্ফুলিঙ্গের মত - আচ্ছা, মেসেজ অপশানটা তো অনেক দিন ধরেই বন্ধ করে রেখেছিলাম। সেইদিন ওই কাকের রাজ্যে ওটা হঠাৎ করে খুলে গেল কী করে! তাহলে কি ডাক্তারের হাতে যখন আমার ফোনটা ছিল তখন তিনিই! কিন্তু তা কী করে হয়! আমি তো তার সামনেই ছিলাম আগাগোড়া! তাহলে! আমি আর কিছু ভাবতে পারছিলাম না! মাথাটা আবার শূন্য হতে শুরু করেছিল! সেখানে অগণিত কাকের স্বর! একযোগে, অবিরাম স্রোতের মত!
……………………………………………………………………………..
(সমাপ্ত)
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।