আজ সন্ধ্যায় আমার পচাত্তর ছুঁইছুঁই বাবা বললেন, ''আমি তোমাদের তিন ভাইবোনকে ঈদের জামা কিনে দিতে চাই। আগামী বছর আর ঈদ পাবো কিনা জানি না।'' আব্বা অবসরের পনের বছর পূর্ণ করার পর সরকার থেকে একটি মাসিক সন্মানি পেতে শুরু করেছেন। সেই টাকা থেকেই তিনি তার সন্তানদের ঈদ উপহার দেয়ার কথা ভাবছেন জীবন সায়াহ্নে দাঁড়িয়ে।
আব্বার কথাটা শুনে হৃদয়ের গভীরে ভীষন মোচড় অনুভব করলাম .......... স্মৃতির সিড়ি দিয়ে নামতে নামতে চলে গেলাম সেই শৈশবের কোন এক ঈদে, আব্বা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন, মামারা ইতোমধ্যে ঈদের শার্ট, প্যান্ট কিনে দিয়েছেন, খালা কিনে দিয়েছেন জুতো, কিন্তু এরপরও আমি কাঁদো কাঁদো, আমার যে অন্য সবার মত দুই সেট জামা চাই, সকাল ও বিকালে বদলে পরার জন্য, আমার বাবার হাতে টাকা নেই, বোনাসের টাকা দোকানের ধার শোধেই ব্যয় হয়েছে, আমাদের ভাইবোনদের মুখের দিকে তাকিয়ে আর বসে থাকতে পারলেন না, আমার সেজ ফুপা থাকেন চট্রগ্রামে, তার কাছে থেকে কিছু টাকা নিয়ে এলেন ঈদের দুদিন আগে, মনে পড়ে, আমায় নিয়ে গিয়েছিলেন গুলিস্তানের একটি সদ্য নির্মিত মার্কেটে, দোকানে ঢুকেই ছোটদের জন্য টানানো একটি কমপ্লিট স্যুটের দিকে আঙ্গুল তাক করে ফেললাম, সেই হাত আর নামাতে পারলেন না তিনি, অবশেষে বাজেটকে তছনস করে সেই স্যুট বগলদাবা করে মহানন্দে বাসায় ফিরলাম।
সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে সার্ভিস বেনিফিট আব্বাকে আগেই তুলে ফেলতে হয়েছিল, তাই যখন অবসরে যান, তখন নিজের অবসর-উপার্জন বলতে তেমন কিছু ছিল না। আমরা ভাইবোনেরা সবাই মিলে বাবাকে ঈদের পাজামা-পাঞ্জাবি কিনে দিয়েছি সবসময়। ...আজ এত বছর পর নিজের উপার্জন হাতে পেয়ে আব্বা তার সন্তানদের আবার ঈদের জামা কিনে দিতে চাইছেন, আব্বা কি সেই সময়ে ফিরে যেতে চাইছেন? মিস করেন সেই সময়টুকু? নিজে উদোম থেকেও সন্তানকে ঈদের দিনে সুন্দর পোশাক পরানোর আনন্দটুকু পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা?
আমি বললাম, ' কোন দরকার নেই, আব্বা। উমরাহ হজ্বে যাওয়ার জন্য টাকাগুলো জমানো হচ্ছে, সেইভাবেই থাকুক।' বাবার উত্তর, '' চারদিকের যে অবস্থা, আগামী বছর পর্যন্ত নাও বেঁচে থাকতে পারি, বাবা ! উমরাহ হয়তো করা হবে না, আমার ইচ্ছা, তোমাদের ভাইবোনদের এই শেষ সময়ে কিছু একটা উপহার দেই।'' ...শৈশবে বাবার কাছ থেকে ঈদের পোশাক পেলে খুশীতে মন নেচে উঠতো, কিন্তু আজ বাবার কথাটা শোনার পর থেকেই ভিতর হতে গুমড়ে গুমড়ে উঠছে কান্না ...... চোখ ভিজে উঠছে বারবার কোন এক অজানা বেদনায়...... মানুষের জীবন এত বৈপরিত্যে ভরা কেন? কেন এত অদ্ভুত বিষাদমাখা?
পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।