এই সাইটটি বার পঠিত
ভাটিয়ালি | টইপত্তর | বুলবুলভাজা | হরিদাস পাল | খেরোর খাতা | বই
  • হরিদাস পাল  আলোচনা  অর্থনীতি

  • বাংলাদেশের যাদুকর

    মোহাম্মদ কাজী মামুন লেখকের গ্রাহক হোন
    আলোচনা | অর্থনীতি | ১০ মে ২০২৪ | ৪৫২ বার পঠিত | রেটিং ৫ (২ জন)
  • ২০২১ সাল, মে মাস। করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের ধাক্কায় উথালপাতাল সারা দেশ। লকডাউন মাত্রই শিথিল হয়েছে। একটি প্রায় বিরান মার্কেটের সামনে দাঁড়িয়ে একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কিছু কর্মী। মার্কেটটি একটি নামকরা স্কুলের পাশে গড়ে উঠেছে। স্কুলের বাচ্চাদের প্রয়োজন পূরণের পাশাপাশি অভিভাবকদের প্রয়োজন পূরণেও চোখ ছিল মার্কেট নির্মাতাদের। অভিভাবকরা যখন বাচ্চাদের ক্লাস শেষ হওয়ার অপেক্ষায় থাকবে, তখন যেন তাদের মাঠের গরম ও ভীড়ে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে না হয়, বরং মার্কেটের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বিপণী বিতানগুলিতে ইচ্ছেমত ঢুঁ মারতে পারে, সেদিকে ছিল তাদের অসাধারণ দূরদৃষ্টি! বলতে কী, ছাত্র-কেন্দ্রিক দোকানের থেকে অভিভাবক-কেন্দ্রিক দোকানের সংখ্যাই ছিল বেশী। আর কথিত ঐ কর্মীরা এমনি একটি দোকানে এসেছিল দল বেঁধে, এক নারী ঋণখেলাপির খোঁজে।

    সেই  নারী ঋণখেলাপি একটি টেইলার্স শপ খুলে বসেছিল মার্কেটটিতে। প্রথম দিকে সে মাত্র একজন সহকারীকে নিয়ে অভিভাবকদের কিনে আনা সিট কাপড়গুলিকে সায়া, ব্লাউজ, সলোয়ার, কামিজে রূপ দিত। পরে তার নিপুণ হাতের কাজের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে স্কুলের বাচ্চাদের মায়েরা হামলে পড়তে লাগল। অর্ডারের চাপে হিমশিম খেতে থাকা সেই নারী উদ্যোক্তা লোকবল বাড়াল। কিন্তু মানুষের হাতে কুলোচ্ছিল না, তাই যন্ত্রের আবশ্যকতা দেখা দিল। এবং এটা সেই সময়, যখন সে প্রথমবারের মত একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সুসজ্জিত অফিসে প্রবেশ করল। সেখানকার লোন অফিসার তার ব্যবসা পরিদর্শন করে এতটাই খুশী হলেন যে, মাত্রই এক সপ্তাহে তার জন্য ঋণ মঞ্জুরীপত্র বের করেন আনলেন হেড অফিস থেকে। নতুন সব মেশিনে ঝক্‌ঝক্‌ তক্‌তক্‌ করতে লাগল সেই নারী উদ্যোক্তার দোকানটি। কিন্তু সে মাত্রই মাসখানেকের জন্য। কারণ তারপরেই দেশজুড়ে জারি হল লকডাউন, এমন একটি জিনিস যা আগে কখনোই দেখেনি দেশটির কেউ।
     
    দেশের সব স্কুল কলেজ বন্ধ হয়ে গেল সবার আগে, তারপর একে একে অন্য সব অফিস আদালত। আবার এক সময় লক ডাউন শিথিল হতে থাকলে অফিস আদালত চালু হলেও স্কুল-কলেজ কিন্তু খুলল না। ইউনেস্কোর একটি হিসেবে প্রায় ৫৪৩ দিন একটানা বন্ধ ছিল বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ, যা একটি রেকর্ড বিশ্বের জন্যই। এদিকে যতদিন স্কুল বন্ধ থাকল, ততদিন স্কুলকেন্দ্রিক সেই নারী উদ্যোক্তার ব্যবসাও বন্ধ থাকল। কিন্তু বন্ধ থাকল না তার ঋণের দায় ও সুদ আরোপের হিসেবটা। হ্যাঁ, সরকার থেকে ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বাড়ানো হয়েছিল, এবং বারংবার এই সুযোগ দেয়া হয়েছে। কিন্তু ঋন তো মওকুফ হয়নি, আর তাই পরিশোধের বর্ধিত সময় পার হয়ে গেলেও সেই নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্ভব হয়নি ঋণ পরিশোধে এগিয়ে আসার। হ্যাঁ, সরকার থেকে প্রায় ২০ হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়েছিল ক্ষুদ্র ও মধ্যম (এসএমই)  উদ্যোক্তাদের জন্য করোনার ক্ষতি পুষিয়ে নিতে। কিন্তু আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো বৃহৎ শিল্পপতিদের জন্য প্রাথমিক বরাদ্দ ৩০ হাজার কোটি টাকার করোনা প্রণোদণার কোটা দ্রুতই পূরণ করে ফেলতে পারলেও এসএমই সেক্টরের কোটা পূরণে বিপুল সমস্যার সন্মুখীন হল। মজার ব্যাপার হল, প্রাথমিক বিতরন-সাফল্যে উৎসাহিত হয়ে বৃহৎ শিল্প ও সেবা খাতের ঋণ-লক্ষ্যমাত্রা ধাপে ধাপে তিরিশ হাজার কোটি টাকা থেকে এক লক্ষ তিন হাজার কোটি টাকায় উপনীত হয়, কিন্তু প্রথম দেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থতার কারণে পরে আর এ খাতের ঋণ বিতরন করা যায়নি খুব বেশী; মাত্র ৪৬ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা ঋণ বিতরন হয়েছে গত অক্টোবর পর্যন্ত। ওদিকে এসএমই  খাতের ঋণ-লক্ষ্যমাত্রা বেড়ে  ২০ হাজার কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার কোটিতে উন্নীত হয়, এবং গত অক্টোবার পর্যন্ত বিতরন হয়েছে ৩১ হাজার ৮৫৩ কোটি টাকা।

    তার মানে,  আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রথমে উদ্বিগ্ন থাকলেও ধীরে ধীরে ক্ষুদ্র ও মাঝারী খাতে নজর দিয়েছিল। যেমন, এই নারী উদ্যোক্তাকে এক পর্যায়ে প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল করোনা প্রণোদনা প্যাকেজের অধীনে ঋণ নেয়ার জন্য। কিন্তু সেই নারী উদ্যোক্তার পক্ষে সম্পত্তির দলিল জমা রাখা প্রায় অসাধ্য ছিল।  সে ভাড়া বাসায় থেকে ভাড়া দোকানে ব্যবসা করত। নিজ গ্রামের যৎসামান্য ও উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত  কাগজপত্রবিহীন সামান্য যে গ্রামীন কৃষিজমি তার ছিল, তা জামানত হিসেবে প্রস্তাব করার সাহস তার ছিল না।  ফলে আরো লাখো লাখো ক্ষুদ্র ও মধ্যম উদ্যোক্তার মত আমাদের এই নারী উদ্যোক্তাও থেকে গেল করোনা প্রণোদনাবিহীন, যাদের হয়ত সব থেকে বেশী প্রয়োজন ছিল এই প্রণোদনার পিল। আর তারই অমোঘ পরিণতি হল আমাদের আলোচিত উদ্যোক্তার দোকানে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের তাগাদা বাহিনীর ধর্ণা, লকডাউনের এই দ্বিতীয় গ্রহণকালে, এই ঘোর খরার মার্কেটে।  

    আমাদের এই নারী উদ্যোক্তা যে শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কাছেই দেনাদার ছিল, তা নয়। ঋণের টাকা দিয়ে তো সে মেশিন কিনল। কিন্তু বড় বড়  অর্ডারকে পূরণ করার জন্য যে সে গাদা গাদা কাপড় এনেছিল হোলসেল কাপড় সাপ্লাইয়ারদের কাছ থেকে, তাদের দেনা পরিশোধেও ছিল উপুর্যুপুরি আর ধারালো চাপ। আর্থিক প্রতিষ্ঠানের আইন-সমর্থিত চাপ সামলাতে পারলেও ঐ নারী উদ্যোক্তা সরবারহকারীদের আইন-অসমর্থিত চাপ সামলাতে ব্যর্থ হয়েছিল, যার অবশ্যম্ভাবী ফল নতুন ক্রয় করা সেলাই মেশিনগুলোর অধিকাংশ নামমাত্র মূল্যে বিক্রি করে দেয়া কাপড়ের স্টকের সাথে সাথে। এভাবে করোনার করাল গ্রাস সেই সাপ্লাইয়ারদের অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিলেও আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি ঋণের কোন টাকাই উদ্ধার করতে পারল না। ফলশ্রুতিতে তারা আইনি পদক্ষেপ শুরু করলে,  আমাদের আলোচ্য নারী উদ্যোক্তা মান-সন্মান বাঁচাতে মহাজনদের দ্বারস্থ হল, যারা প্রচলিত সুদের প্রায় চার-পাঁচ গুণ হারে ঋণ দিয়ে থাকে, আর ঋণ আদায়ে তাদের থাকে আলাদা গুন্ডা বাহিনী। ফলে করোনা অস্বাভাবিক মুনাফা এনে দিল টাকার এই আদিম কারবারীদেরও!

    ‘’উধাও হল কালো ধোঁয়া
    ফুটল শহর আলোয় ধোয়া
    করোনার করাল ছোঁয়া
    অসভ্যতা সব টুটে যাওয়া’’

    করোনার মর্ত্যধামে আগমনের শুরুতে নিবন্ধকার লিখিত লাইনগুলিতে নিছকই বালখিল্য আকাঙ্ক্ষা প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, না হলে অসভ্যতা পৃথিবী থেকে তো টুটে যাওয়ার নয়!  প্রায় ১.২ ট্রিলিয়ন টাকার করোনা প্যাকেজ যা কিনা জিডিপির ৪.৪%, তাতে কিন্তু উপকারভোগীর সংখ্যা ছিল মাত্রই  ৫.৮০ লাখ। করোনায় ক্ষুদ্র ও মধ্যম খাতের ব্যবসায়ীরা পথে বসেছে, আর একটি শ্রেণী আখের গুছিয়েছে, যেভাবে চিরকাল যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ বা দুর্বিপাকের সুযোগ নিয়ে আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়েছে একটি বাহিনী। যেখানে একজন ক্ষুদে ব্যবসায়ী সর্বস্ব হারিয়ে রাতে ইজি বাইক ও দিনে দারোয়ানের চাকরি নিয়ে কোনমতে পেট চালাচ্ছে, সেখানে প্রণোদনার টাকা নিয়ে অনেকে জমি ও সম্পত্তি করেছে দেশে-বিদেশে। এগুলো শুধু কথার কথা নয়, এগুলোর জন্য নথিবদ্ধ প্রমাণ রয়েছে, আর সেগুলো এসেছে খোদ সরকারী দপ্তরের তদন্ত থেকেই। এমনি একটি তদন্তে বের হয়ে এসেছে, একটি প্রতিষ্ঠান প্রায় তের কোটি পঞ্চাশ লাখ টাকা প্রণোদনার ঋণ গ্রহণ করে তাদের চলতি হিসেবে (ব্যাংক একাউন্ট) রেখে দেয়, পরে তা উঠিয়ে অন্য ব্যাংকে জমা করে রাখে। তাদের শিল্প প্রতিষ্ঠানের উন্নতিতে তারা এই অর্থ ব্যবহার করেছে এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি।
    বর্তমানে  দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা খুবই ভঙ্গুর ও অস্থিতিশীল অবস্থায় আছে। মুডি সহ অন্যান্য রেটিং এজেন্সি দেশে সার্বভৌম রেটিং চালু হওয়ার পর প্রথমবারের মত অবনমন করেছে একে। মুডি এ বছর আমাদের দেশের দীর্ঘমেয়াদী ঋণপরিশোধ রেটিং বিএ৩ থেকে নামিয়ে বি১ করেছে, আর স্বল্পমেয়াদী ঋণ পরিশোধ সামর্থ্যকে নামিয়ে ‘নট প্রাইম’ করেছে। রিজার্ভ ঠেকেছে তলানিতে। আন্তর্জাতিক মানদন্ড অনুযায়ী রিজার্ভ এখন প্রায় ২০ বিলিয়ন ডলার, ২০২১ সালের আগস্টে যা ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। কিন্তু এসবের দায়ভার দেয়া হচ্ছে সব ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধকে। আশ্চর্য হল, করোনার দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হলেও কেউ কথা বলছে না শব্দটি নিয়ে আর। আসলে করোনা মোকাবেলায় সফল হয়েছি আমরা, সারা বিশ্বে আমরা উদাহরণ সৃষ্টি করেছি, এসব তথ্যের জন্য এখন আর করোনাকে দোষ দেয়া যাচ্ছে না! করোনায় টিকা সরবারহে সাফল্য দেখিয়েছে বাংলাদেশ এবং প্রাণহানি কম ঘটেছে, সন্দেহ নেই। কিন্তু অর্থনীতির টিকায় কতটুকু সফল হয়েছে, তা নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে বিভ্রান্তির বেড়াজাল।

    স্টিভেন ই ল্যান্ডসবার্গ তার ‘দ্য আর্মচেয়ার ইকোনোমিস্ট’ গ্রন্থে ‘হাউ স্ট্যাটিকস লাই’ প্রবন্ধে বলেন,  ‘’There are always plenty of people around to observe a crowd. There is nobody around to observe a vacuum.’’  করোনায় বাংলাদেশ খুব ভাল পারফর্মেন্স করেছে তার প্রমাণ হিসেবে হাজির করা হচ্ছে জিডিপির হারকে। হ্যাঁ, করোনা পরবর্তী সময়ে আমাদের জিডিপি বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ প্রজেকশানকে হার মানিয়েছে। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছিল ৫.৪৭%। অথচ আইএমএফ-এর ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক আউটলুক ভবিষ্যৎবাণী করেছিল প্রবৃদ্ধি হবে ৩.৮%।

    আমাদের জিডিপি ক্যালকুলেশান নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই গুঞ্জন রয়েছে, তাকে গোণায় না ধরেও বলা যায়, বৈশ্বিক স্ট্যান্ডার্ডে অনুপাতটা বেশি ছিল বাংলাদেশের জন্য। কিন্তু তার পেছনের নেপথ্য কারণগুলো কী ছিল? যেকোন পর্যবেক্ষক তার নিরপেক্ষ চোখখানা মেললেই দেখতে পাবেন, আগের বছরে যা ধরা হয়নি হিসেবে, সেসব নাম্বারের তেলেসেমাতি ছাড়াও আছে লকডাউন পরবর্তী ভোগব্যয়ের হঠাৎ কিন্তু সাময়িক উল্লম্ফনের ঘটনা। উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে, রপ্তানিতে ২০২০-২১ এ অর্জিত ৩৮.৭৫ বিলিয়ন ডলার প্রায় ১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি নির্দেশ করছে। তবে তা ২০১৮-২০১৯ এর রপ্তানিমূল্য ৪০.৫০ বিলিয়ন ডলারকে ছাড়িয়ে যেতে পারেনি। উপরন্তু, ২০১৯-২০২০ এর থেমে যাওয়া রপ্তানিগুলো এই সময় যুক্ত হয়েছিল। এছাড়া এক্সপোর্ট প্রমোশান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, ফেব্রিকস ও ইয়ার্নের  উচ্চ খরচের কারণে গার্মেন্টসের মূল্য বিদেশী ক্রেতারা কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছিল।  এদিকে আমদানী প্রায় ১৭% বাড়লেও তা মূলত আগের অর্থবছরের জের টানার ফল; মূলধনী যন্ত্রপাতির আমদানি বরং ৩.২৮% হ্রাস পেয়ে ৩.২৪ বিলিয়ন  ডলারে দাঁড়িয়েছিল।
     
    একটি বিখ্যাত শিল্প গ্রুপের  ব্যবস্থাপনা পরিচালক  বলেন যে, কভিডের মধ্যেব্যবসায় সফলতার পেছনে একাধিক বিষয়কাজ করেছে, একক কোনো কারণ নেই।
    প্রথমত,  কভিডের কারণে কয়েকমাস ব্যবসা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এ সময়অনেক ছোট ছোট ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেছে।যারা টিকে ছিল, তারা মনোযোগ দিয়েছে ব্যয় নিয়ন্ত্রণে এতে সার্বিকভাবে দক্ষতাঅনেক বেড়েছে। রফতানিমুখী অনেকউৎপাদনকারী নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ায় রফতানিপ্রবৃদ্ধিতেও কিছুটা সুবিধা হয়েছে।   
    বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০২২ অনুযায়ী, দারিদ্র্য হার ২০১৬ এর ২৪.৩ শতাংশ থেকে নেমে ১৮.৭ শতাংশে এসে দাঁড়িয়েছে। তার মানে, দারিদ্র্য মোকাবেলায় আমাদের অগ্রযাত্রা অব্যাহত রয়েছে। এদিকে গিনি কোএফিশিয়েন্ট (অর্থনৈতিক অসাম্য পরিমাপের সূচক)  কিন্তু চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়, করোনায় আমাদের অর্থনীতি কতটা বেগ হারিয়েছে, অসুখ ঢুকেছে কত গভীরে! কোন দেশের অর্থনৈতিক অসাম্য উচ্চমাত্রায় আছে বলে ধরা হয়, যদি তার গিনি কোএফিশিয়েন্ট সূচক ০.৫০ মানকে স্পর্শ করে। ২০১০ সালে আমাদের গিনি কোএফিশিয়েন্ট ছিল ০.৪৫৮, ২০১৬ সনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ০.৪৮২ তে, আর ২০২২ এ তা আরো উঁচুতে উঠে অবস্থান করছে ০.৪৯৯ মানে। তার মানে, উচ্চ মাত্রার ধন-বৈষম্যের ক্লাবে ঢোকা আমাদের জন্য এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমাদের পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এ বছর এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের জন্য এই অসাম্যই এখন বড় বাঁধা। তার মতে, দরিদ্র জনসংখ্যার আয় বেড়েছে, কিন্তু ধনী লোকের আয় আরও বেড়েছে, যা আয় বৈষম্যকে প্রকট করে তুলছে। আর এ কারণেই হয়ত আয়ের সমতার রাষ্ট্রীয় স্বপ্ন ফিকে হতে শুরু করেছে।  

    করোনায় আমাদের অর্থনীতির তলা কতটা ফুটো হয়েছে, তা বুঝতে হলে তাকাতে হবে ব্যাংক কুঋণের হিসেবের দিকেও, যা দিন দিন শুধু বাড়ছেই, সরকারী প্রণোদনার সাথে পাল্লা দিয়ে। সেপ্টেম্বর ২০২২ এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশ ৯.৪% খারাপ ঋণ নিয়ে দক্ষিন এশিয়ায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে, শুধু দেউলিয়া ঘোষিত শ্রীলংকা রয়েছে আমাদের উপরে ১০.৯% ঋণ নিয়ে।
    মনু সংহিতায় একটি শ্লোক আছে,  “ যঃ অর্থ সূচি, সঃ শুচিঃ”, মানে অর্থের বিশুদ্ধাতেই শুচিতা নিশ্চিত হয়। আজ প্রশ্ন উঠছে, করোনার টাকাগুলো তাহলে গেল কই? কেন ফেরত আসছে না জনগনের কষ্টার্জিত টাকা? অনেক টাকা বিদেশ থেকে এলেও সেও তো বাংলাদেশের মানুষকেই পরিশোধ করতে হবে। তো সেই টাকাগুলো কই? একটি হিসেবে দেখা গেছে, অফশোর ব্যাংকগুলিতে (দেশের বাইরে বিনিয়োগের নিরাপদ স্বর্গ) বাংলাদেশীদের টাকা বেড়ে গিয়েছে। এছাড়া আরো একটি তথ্যে দেখা গেছে, সিঙ্গাপুরে বাংলাদেশীরা শীর্ষে রয়েছে নির্মাণ খাতের বিনিয়োগে।

    বাংলাদেশের বৈদিশিক মুদ্রার মজুদ এখন বিপদজনক ঝুলে আছে, যেকোন সময় তলা ক্ষয় হয়ে যেতে পারে বলে অনেকে আশংকা করছেন। বাংলাদেশ কি তবে শ্রীলংকা হতে যাচ্ছে? উত্তর হচ্ছে, না হয়ত। চার্লস ডিকেন্সের উক্তি এখানে স্মরণ করা যেতে পারেঃ ‘’There are dark shadows in the earth, but its lights are stronger in the contrast.’’

    সমাধান হয়ত করে দেবে অভিশাপ রুপে পরিগণিত বাংলাদেশের সেই পচা-কালো-রোগা জনগনই যারা মধ্যপ্রাচ্যের মরুভূমিগুলোতে নামমাত্র মূল্যে শ্রম বেচে, আর তাদের মা-বোনেরা নামমাত্র মূল্যে শ্রম বেচে আধুনিক বাংলাদেশের নীলকর সদৃশ  গার্মেন্টস কারখানাগুলোতে। তাদের সৃষ্ট প্রবাসী আয় ও রপ্তানি আয় খাতে অনুকূল বাতাস বইতে শুরু করেছে বলে সাম্প্রতিক খবরে প্রকাশ। বাংলাদেশটা এ যাত্রা আবারো বেঁচে যাবে হয়ত এদের হাত ধরেই। আগের বার গুলোতেও বাঁচিয়েছে এরাই, মধ্যস্বত্বভোগী লুটেরা বাহিনীর তৈরী করা শত মরনফাঁদ সত্বেও।
    সত্যি বলতে কী, প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাতের শ্রমিকেরাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত যাদুকর। আমাদের আলোচ্য নারী উদ্যোক্তা এই যাদুকরদের একই পরিবারভূক্ত। এরাই হচ্ছে সেই বাংলাদেশ মিরাক্যল, যা পশ্চিমা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ক্লাসগুলোতে ইদানিং আলোচিত হয়। এদের হাতেই রয়েছে বাংলাদেশের আগামী দিনের জীয়নকাঠি। কিন্তু যাদু দেখানোর জন্য খুব সামান্য হলেও কিছুটা স্থানের প্রয়োজন পড়ে; আমাদের যাদুকরদের জন্য সাময়িক স্বার্থত্যাগ করে সেইটুকু স্থান কি আমরা ছেড়ে দিতে পারি না?  
     
    (সমাপ্ত)
     

    পুনঃপ্রকাশ সম্পর্কিত নীতিঃ এই লেখাটি ছাপা, ডিজিটাল, দৃশ্য, শ্রাব্য, বা অন্য যেকোনো মাধ্যমে আংশিক বা সম্পূর্ণ ভাবে প্রতিলিপিকরণ বা অন্যত্র প্রকাশের জন্য গুরুচণ্ডা৯র অনুমতি বাধ্যতামূলক। লেখক চাইলে অন্যত্র প্রকাশ করতে পারেন, সেক্ষেত্রে গুরুচণ্ডা৯র উল্লেখ প্রত্যাশিত।
  • আলোচনা | ১০ মে ২০২৪ | ৪৫২ বার পঠিত
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | 2404:1c40:b7:1586:1:0:5178:***:*** | ১০ মে ২০২৪ ১৮:১৩531567
  • রমিত চট্রোপাধ্যায় 
    ধন্যবাদ দাদা।
     
    হীরেনদা 
    অনেক ধন্যবাদ। 
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী | ১০ মে ২০২৪ ১৯:৩৪531570
  • প্রবাসী আয় ও রপ্তানি খাতের শ্রমিকেরাই হচ্ছে বাংলাদেশের প্রকৃত যাদুকর। - একদম।
     
    ভালো লেখা, জরুরী লেখা।
  • | ১০ মে ২০২৪ ২০:৩৩531575
  • খুব ভালো লেখা। প্রয়োজনীয়।
  • মোহাম্মদ কাজী মামুন | 2404:1c40:bc:bdac:1:0:569e:***:*** | ১১ মে ২০২৪ ১২:২১531604
  • অমিতাভ চক্রবর্ত্তী 
    অসংখ্য ধন্যবাদ দাদা।
    ////
    দ দি
    অনেক ধন্যবাদ।  
  • মতামত দিন
  • বিষয়বস্তু*:
  • কি, কেন, ইত্যাদি
  • বাজার অর্থনীতির ধরাবাঁধা খাদ্য-খাদক সম্পর্কের বাইরে বেরিয়ে এসে এমন এক আস্তানা বানাব আমরা, যেখানে ক্রমশ: মুছে যাবে লেখক ও পাঠকের বিস্তীর্ণ ব্যবধান। পাঠকই লেখক হবে, মিডিয়ার জগতে থাকবেনা কোন ব্যকরণশিক্ষক, ক্লাসরুমে থাকবেনা মিডিয়ার মাস্টারমশাইয়ের জন্য কোন বিশেষ প্ল্যাটফর্ম। এসব আদৌ হবে কিনা, গুরুচণ্ডালি টিকবে কিনা, সে পরের কথা, কিন্তু দু পা ফেলে দেখতে দোষ কী? ... আরও ...
  • আমাদের কথা
  • আপনি কি কম্পিউটার স্যাভি? সারাদিন মেশিনের সামনে বসে থেকে আপনার ঘাড়ে পিঠে কি স্পন্ডেলাইটিস আর চোখে পুরু অ্যান্টিগ্লেয়ার হাইপাওয়ার চশমা? এন্টার মেরে মেরে ডান হাতের কড়ি আঙুলে কি কড়া পড়ে গেছে? আপনি কি অন্তর্জালের গোলকধাঁধায় পথ হারাইয়াছেন? সাইট থেকে সাইটান্তরে বাঁদরলাফ দিয়ে দিয়ে আপনি কি ক্লান্ত? বিরাট অঙ্কের টেলিফোন বিল কি জীবন থেকে সব সুখ কেড়ে নিচ্ছে? আপনার দুশ্‌চিন্তার দিন শেষ হল। ... আরও ...
  • বুলবুলভাজা
  • এ হল ক্ষমতাহীনের মিডিয়া। গাঁয়ে মানেনা আপনি মোড়ল যখন নিজের ঢাক নিজে পেটায়, তখন তাকেই বলে হরিদাস পালের বুলবুলভাজা। পড়তে থাকুন রোজরোজ। দু-পয়সা দিতে পারেন আপনিও, কারণ ক্ষমতাহীন মানেই অক্ষম নয়। বুলবুলভাজায় বাছাই করা সম্পাদিত লেখা প্রকাশিত হয়। এখানে লেখা দিতে হলে লেখাটি ইমেইল করুন, বা, গুরুচন্ডা৯ ব্লগ (হরিদাস পাল) বা অন্য কোথাও লেখা থাকলে সেই ওয়েব ঠিকানা পাঠান (ইমেইল ঠিকানা পাতার নীচে আছে), অনুমোদিত এবং সম্পাদিত হলে লেখা এখানে প্রকাশিত হবে। ... আরও ...
  • হরিদাস পালেরা
  • এটি একটি খোলা পাতা, যাকে আমরা ব্লগ বলে থাকি। গুরুচন্ডালির সম্পাদকমন্ডলীর হস্তক্ষেপ ছাড়াই, স্বীকৃত ব্যবহারকারীরা এখানে নিজের লেখা লিখতে পারেন। সেটি গুরুচন্ডালি সাইটে দেখা যাবে। খুলে ফেলুন আপনার নিজের বাংলা ব্লগ, হয়ে উঠুন একমেবাদ্বিতীয়ম হরিদাস পাল, এ সুযোগ পাবেন না আর, দেখে যান নিজের চোখে...... আরও ...
  • টইপত্তর
  • নতুন কোনো বই পড়ছেন? সদ্য দেখা কোনো সিনেমা নিয়ে আলোচনার জায়গা খুঁজছেন? নতুন কোনো অ্যালবাম কানে লেগে আছে এখনও? সবাইকে জানান। এখনই। ভালো লাগলে হাত খুলে প্রশংসা করুন। খারাপ লাগলে চুটিয়ে গাল দিন। জ্ঞানের কথা বলার হলে গুরুগম্ভীর প্রবন্ধ ফাঁদুন। হাসুন কাঁদুন তক্কো করুন। স্রেফ এই কারণেই এই সাইটে আছে আমাদের বিভাগ টইপত্তর। ... আরও ...
  • ভাটিয়া৯
  • যে যা খুশি লিখবেন৷ লিখবেন এবং পোস্ট করবেন৷ তৎক্ষণাৎ তা উঠে যাবে এই পাতায়৷ এখানে এডিটিং এর রক্তচক্ষু নেই, সেন্সরশিপের ঝামেলা নেই৷ এখানে কোনো ভান নেই, সাজিয়ে গুছিয়ে লেখা তৈরি করার কোনো ঝকমারি নেই৷ সাজানো বাগান নয়, আসুন তৈরি করি ফুল ফল ও বুনো আগাছায় ভরে থাকা এক নিজস্ব চারণভূমি৷ আসুন, গড়ে তুলি এক আড়ালহীন কমিউনিটি ... আরও ...
গুরুচণ্ডা৯-র সম্পাদিত বিভাগের যে কোনো লেখা অথবা লেখার অংশবিশেষ অন্যত্র প্রকাশ করার আগে গুরুচণ্ডা৯-র লিখিত অনুমতি নেওয়া আবশ্যক। অসম্পাদিত বিভাগের লেখা প্রকাশের সময় গুরুতে প্রকাশের উল্লেখ আমরা পারস্পরিক সৌজন্যের প্রকাশ হিসেবে অনুরোধ করি। যোগাযোগ করুন, লেখা পাঠান এই ঠিকানায় : guruchandali@gmail.com ।


মে ১৩, ২০১৪ থেকে সাইটটি বার পঠিত
পড়েই ক্ষান্ত দেবেন না। লুকিয়ে না থেকে মতামত দিন