পঞ্চায়েত ভোট আর সন্ত্রাস এখন সমার্থক হয়ে গেছে। প্রত্যেক পাঁচ বছর অন্তর গ্রামবাংলার এই ভোটে লাগামছাড়া হিংসা, খুনোখুনি, সন্ত্রাস। এই শতাব্দীতে পাঁচটি নির্বাচন হয়েছে, সেগুলিতে মৃত্যুর সংখ্যা যথাক্রমেঃ ২০০৩-এ ৮০, ২০০৮-এ ৪৫, ২০১৩তে ৩১, ২০১৮তে ৭৫ এবং এবারে এখনো অবধি সংখ্যা ৫০ ছাড়িয়ে গেছে। লক্ষণীয় ২০০৮ এবং ২০১৩ সালে মৃত্যু অপেক্ষাকৃত কম। দুবারই রাজ্যের নির্বাচন কমিশনার ছিলেন মীরা পাণ্ডে, অত্যন্ত মেরুদণ্ডসম্পন্ন সরকারি আমলা যিনি রাজনৈতিক নেতাদের ধমক চমকের কাছে মাথা নোয়াতেন না। ২০০৮-এ বামফ্রন্ট সরকার এক দফায় নির্বাচন করতে চেয়েছিল, পান্ডে এর বিরোধিতা করে তিন দফা ভোট করার প্রস্তাব দেন। তাঁর অনমনীয় মনোভাবের কারণে বাম সরকার তা মেনে নিতে বাধ্য হয়। তৃণমূল সরকারের সঙ্গে তাঁর ধারাবাহিক সংঘাত সর্বজনবিদিত। সরকার ২০১৩র পঞ্চায়েত নির্বাচন ছয় মাস এগিয়ে নিয়ে আসতে চেয়েছিল, কিন্তু পান্ডের বিরোধিতার কারণে তারা নির্ধারিত সময়ে ভোট করতে বাধ্য হন। একই ভাবে সরকারের তীব্র বিরোধিতা সত্ত্বেও কেন্দ্রীয় বাহিনী এনে কয়েক দফায় ভোট করা হয়। ভোটের সময় কেন্দ্রীয় বাহিনী মোতায়েন করার জন্য তিনি সমস্ত হুমকি উপেক্ষা করে হাই কোর্ট, সুপ্রিম কোর্ট অবধি গেছেন। এর জন্য তাঁকে প্রবল ভাবে হেনস্থা করা হয়েছে, নানা কটু কথা বলা হয়েছে, কিন্তু কোনকিছুই তাঁকে তাঁর সিদ্ধান্ত থেকে টলাতে পারেনি। আমরা দেখেছি ঐ বছর নির্বাচনে ৩১ জন মারা গেছিলেন যা তুলনামূলক ভাবে কম।
উপরোক্ত কথাগুলো বলা এই কারণে যে যতটা সম্ভব সুষ্ঠু ভাবে ভোট করা যায় যদি একজন শক্ত, বজ্রকঠিন ব্যক্তি, যিনি নিয়ম জানেন, সংবিধান জানেন, তিনি যদি পুরো প্রক্রিয়ার দায়িত্বে থাকেন। সরকার, তা সে যত শক্তিশালিই হোক, তাদের খেয়াল খুশি মতো সেই ব্যক্তিকে পরিচালিত করতে পারে না। আমাদের রাজ্যে ব্যাপারটা এরকম দাঁড়িয়ে গেছে যে নির্বাচন, বিশেষ করে পঞ্চায়েত নির্বাচন হলেই খুনোখুনি হবে, বহু লোক মারা যাবে। এটা যেন ভবিতব্য, এর অন্যথা যেন হতে পারে না! শাসক দল, বিরোধী দলগুলি কি সত্যিই চায় যে ভোট শান্তিপূর্ণ, সন্ত্রাসমুক্ত হোক? এটা করতে গেলে প্রথমেই একজন দৃঢ়, নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশনার প্রয়োজন যিনি সরকারের তাঁবেদারি করবেন না। গত মার্চ মাসে দেশের শীর্ষ আদালত নির্বাচন কমিশনার নিয়োগ সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ রায় দেয়। এখন কেন্দ্রীয় মন্ত্রীসভা নাম পছন্দ করে তা রাষ্ট্রপতির কাছে সুপারিশ করে থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায় তাঁরা শাসক দলের প্রতি অনুরক্ত। শীর্ষ আদালত বলছে দেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধী দল নেতা এবং প্রধান বিচারপতি, এঁদের তিনজনের একটি কমিটি হবে। তাঁরা রাষ্ট্রপতির কাছে নাম সুপারিশ করবে। এই পদ্ধতি অনুসরণ করলে নির্বাচন পরিচালনা একজন নিরপেক্ষ ব্যক্তির দায়িত্বে সমর্পণ করা সম্ভব। এমন একজন মুখ্য নির্বাচন কমিশনার আমরা নিশ্চয়ই চাই না- যিনি বলবেন আমার দায়িত্ব খালি ব্যবস্থা করা, কোথায় বুথ দখল হচ্ছে বা বোমাবাজি হচ্ছে সেটা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। বলাই বাহুল্য সুপ্রিম কোর্টের ঐ রায় বস্তাবন্দি হয়ে পড়ে আছে। শাসক দল তো বটেই, বিরোধী দলগুলিও সেটা কার্যকরী করার ব্যাপারে কোনও উচ্চবাচ্য করছে না।
ভোট সন্ত্রাসমুক্ত করতে হলে আরও তিনটি পদক্ষেপ আবশ্যক। প্রতিটা ভোটে কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতি প্রয়োজন। এটা দুঃখজনক যে রাজ্যের পুলিশ এতোটাই শাসকের বশংবদ যে মানুষ তাঁদের ওপর ভরসা করতে পারে না। অনেকে বলবেন আধা-সামরিক বাহিনীই তো শিতলকুচি হত্যাকাণ্ডের জন্য দায়ী। সেটা ঠিক। আবার এটাও ঠিক কেন্দ্রীয় বাহিনীর উপস্থিতির কারণে বিধানসভা নির্বাচনে রক্তপাত কম হয়েছে। কেন্দ্রীয় বাহিনী আনলেই শুধু হবে না তাঁদের সঠিক ভাবে মোতায়েন করতে হবে। এমনটা না হয় যে ভোট হয়ে গেলো কিন্তু স্পর্শকাতর বুথের তালিকা তাঁদের কাছে পোঁছালই না, এবারে যেটা হয়েছে।
দ্বিতীয়ত পশ্চিম বাংলায় প্রতিটা ভোট অন্তত তিন দফায় হওয়া আবশ্যক। বিশেষ করে পঞ্চায়েত ভোট কারণ গ্রামাঞ্চলে খুনোখুনি এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা আশ্চর্যজনক যে শাসক দল অধিক দফা ভোট চায় না, এক দফা ভোট করার ওপর জোর দেয়! এটা কি এই কারণে যে এক দফা হলে বাহিনীর অপ্রতুলতার কারণে বুথে নিরাপত্তা কম থাকে এবং ভোট লুঠ, রিগিং, ছাপ্পা করতে সুবিধা হয়? এই কারণেই কি শাসক অধিক দফা ভোটের বিরোধিতা করে? তৃতীয়ত আজ যখন প্রযুক্তির এতো উন্নতি হয়ে গেছে তখন কেন অন্তত মনোনয়ন অনলাইনে করা যাবে না। এবার তো মনোনয়ন পর্বের সময়েই পনেরো জন মারা গেছেন। ঢাক ঢোল পিটিয়ে, লোক দেখিয়ে, মানুষকে নিজেদের পেশির জোর প্রদর্শন করে, ভোটের আগেই সবাইকে সন্ত্রস্ত করে মনোনয়ন দাখিল করতে যেতেই হবে? অনেকে বলবেন সব নির্বাচনেই এটা করা উচিত। হলে তো ভালোই কিন্তু বাংলার পঞ্চায়েত নির্বাচনে এটা করা জরুরী, কারণ এই ভোটে যে পর্যায়ে খুনোখুনি হয় তা অভুতপূর্ব। এটা করলে অনেক প্রাণ বেঁচে যাবে। অদ্ভুত হচ্ছে শাসক দল তো বটেই, বিরোধী দলগুলিও অনলাইন মনোনয়নের জন্য কোনও জোরালো দাবি তোলে না। তারাও নিজের এলাকায় ক্ষমতা প্রদর্শন করতে চায়, বিরোধী শক্তি, ভোটারদের সন্ত্রস্ত করতে চায়।
আসল ব্যাপার হচ্ছে সদিচ্ছার অভাব। দূর্ভাগ্যজনক হলেও সন্দেহই হয় আদপে কি কেউ সত্যিই চায় যে শান্তিপূর্ণ ভোট হোক?
বিচারপতি বলেছেন পঞ্চায়েত মধুভাণ্ড, তাই এতো খুনোখুনি। কথাটা শুনতে কটু লাগলেও এতে একটা ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সত্য নিহিত আছে। গত দোসরা জুন বালেশ্বরের বাহানাগা রেল স্টেশনের কাছে যে মর্মান্তিক দুর্ঘটনা আছে সেটার সাথে বাংলার পঞ্চায়েত ভোটের কী মিল আছে? ঐ দুর্ঘটনায় অন্তত সত্তর জন মারা গেছেন যাঁরা কাজের খোঁজে অন্য রাজ্যে যাচ্ছিলেন। প্রতি দিনই বহু মানুষ ভিন রাজ্যে পাড়ি দেন। এছাড়া তাঁদের উপায় নেই। গ্রামে কোনও কাজ নেই। বাংলার গ্রামাঞ্চলে অর্থনৈতিক অবস্থা যে কী ভয়াবহ এটা তার একটা ছোটো নিদর্শন। কেন্দ্রীয় সংস্থা এনএসএসও (ন্যাশনাল স্যাম্পেল সার্ভে অর্গানাইজেশন) সাম্প্রতিক সমীক্ষা অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গে কৃষি অত্যন্ত অলাভজনক হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ৬৭৬২ টাকা। দেশের কৃষক পরিবারের গড় মাসিক আয় ১০২১৮ টাকা। এই সমীক্ষা ২০১৮ ও ২০১৯ সালের প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে করা হয়েছে। কৃষক পরিবার বলতে বোঝায় যাঁরা বছরে অন্তত ৪০০০ টাকা মূল্যের ফসল উৎপাদন করে এবং যে পরিবারের অন্তত একজন কৃষিকাজে যুক্ত। আরও তাৎপর্যপূর্ণ এই মাসিক আয়ের মাত্র ২২.৮%, অর্থাৎ ১৫৪৭ টাকা আসে চাষ থেকে; দিনমজুরি, এনরেগায় কাজ, বেসরকারি চাকরি, ছোটো দোকান, লোকের বাড়ি বিবিধ কাজ ইত্যাদি থেকে আসে ৫৫%, অর্থাৎ ৩৭২১ টাকা। অন্যান্য পেশা থেকে আয় আরও প্রায় ১৪%। এর অর্থ পশ্চিমবাংলার অধিকাংশ কৃষক আংশিক চাষি। এঁদের মূল উপার্জন হয় অকৃষি কাজ থেকে বা বলা চলে ‘অড জবস’ থেকে। এর মধ্যে আবার একশো দিনের কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। সুতরাং গ্রামীণ গরিবদের দুর্দশা সহজেই অনুমান করা যায়।
অকৃষি কাজের উৎস হচ্ছে পঞ্চায়েত এবং রাজনৈতিক দাদারা। প্রতিটি পঞ্চায়েতে বছরে দুই থেকে পাঁচ কোটি সরকারি গ্রান্ট আসে। এছাড়া আবাস যোজনা, জল জীবন মিশন এবং নানা সরকারি প্রকল্পের টাকা সরাসরি পঞ্চায়েতে আসে। শুধুমাত্র আইনি পথেই এতো টাকা আসে, গরু পাচার, বেআইনি নিয়োগ ইত্যাদি মারফত আয় কিন্তু ধরা হচ্ছে না। এই বিপুল ‘মধুভাণ্ড’ দাদারা নিয়ন্ত্রণ করে। যাঁরা তাদের সঙ্গে থাকে তাঁরা কাজ পান, অন্যরা পান না। এই কাজ পাওয়ার জন্য সীমাহীন খুনোখুনি, যারা মারছে এবং যাদের মারা হচ্ছে প্রায় সবাই নিম্নবিত্ত, মূলত নিম্নবর্ণ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ। হিংসার এই মারণযজ্ঞে জড়িয়ে না পড়ে তাঁদের উপায় নেই। এটা তাঁদের রুটি রুজির প্রশ্ন। সদিচ্ছা থাকলে নির্বাচনকে শান্তিপূর্ণ করা যেতে পারে কিন্তু অর্থনীতির এই ভয়ঙ্কর দুষ্ট চক্রের থেকে গ্রামবাংলা কী করে মুক্তি পাবে তার কোনও দিশা আপাতত নেই।