কর্মস্থল বাঁকুড়ায়, ভোট হুগলীতে। আমি প্রথমে ঠিক করেছিলাম ভোট দিতে যাব না। বাঁকুড়া থেকে সিঙ্গুরে গিয়ে ভোট দিয়ে সেই দিনেই ফেরা পোষাবে না। পরে মতবদল হল। সিদ্ধান্ত নিলাম যাব। কারণ কয়েকটা বিশেষ কারণে আমাকে একবার বাড়ি ফিরতেই হবে। তাই ভোটের দিনেই ফিরি, রথ দেখা কলা বেচা একসাথে হবে।
সেদিন সকাল সাড়ে ছ-টায় বের হলাম। এখান থেকে দুর্গাপুর স্টেশন ৩০কিমি প্রায়। রাস্তায় পুরো শান্ত পরিবেশই পেলাম। দিকে দিকে নানা দলের দলীয় পতাকা উড়ছে। ট্রেনে চলেছি, সেদিন ট্রেনটাও অনেকটা ফাঁকা, তাই জানালার ধারে বসে, মাঠ-ঘাট দেখতে দেখতে। কোথাও ভোট হচ্ছে, ভোটের লাইন দেখা যাচ্ছে... দূর থেকে অন্তত কোনো গন্ডগোল চোখে পড়ল না।
ট্রেন থেকে নেমে প্রথমে গেলাম পোলবা ব্লকের সুগন্ধ্যা অঞ্চলে। ওখানে আমার শ্বশুরবাড়ি। এবারও রাস্তায় কয়েকটা ভোটগ্রহণ কেন্দ্র পড়ল। ঝামেলা-টামেলা নেই, ভোট চলছে। অনন্তপুরে শাঁখ, আম প্রতীকের ব্যানার টাঙিয়ে নির্দলরাও বসে আছে চোখে পড়ল। ওখান থেকে বাইক নিয়ে নিজের গ্রামে।
আমাদের ভোটগ্রহণ কেন্দ্রে দেখলাম দুটো বুথ হয়েছে। পরিবেশ শান্ত। পিকনিকের আমেজ। যেরকম হয়। ভোট চলছে। চারটে লাইন হয়েছে। দুটো পুরুষদের আর দুটো মহিলাদের। এছাড়া কিছু চেয়ার, বেঞ্চ পাতা আছে। কয়েকজন বয়স্ক ও অসুস্থ মানুষ তাতে বসে। মহিলাদের লাইন তাড়াতাড়ি এগোচ্ছে – পুরুষদের সময় লাগছে। লাইন ভেঙে নানা দলের প্রার্থী কর্মীরা বয়স্ক-অসুস্থদের এগিয়ে দিচ্ছে, সবাই হাসিমুখে মেনেও নিচ্ছে।
পঞ্চায়েত ভোট, তাই প্রার্থীদেরও দেখা গেল। বিজেপি, সিপিএম, তৃণমূলের প্রার্থীরা কখনও নিজেদের মধ্যে গল্প করছে, কখনও লাইন সামলাচ্ছে, জল এগিয়ে দিচ্ছে। এমনিতেই সবাই সবাইয়ের চেনা, তাই গল্প-টল্প চলছে। আমার সঙ্গেও কথা বলতে এল সবাই। কখন ফিরেছি? থাকব কিনা? গ্রামে যেরকম হয়, সেরকমই পুরো উৎসবের মেজাজ।
লাইনে প্রায় দেড়-দু-ঘণ্টা দাঁড়াতে হল। অসুবিধে কিছু হয়নি। অনেকের সঙ্গেই অনেকদিন পর দেখা, নানা কুশল বিনিময় হল। সব দলের লোকজনই কথা বলল, কোনও ঝগড়া অশান্তি নেই। তারপর আমারও ভোট দেওয়া হল। সে আর কী বলব, যেরকম করে ভোট দেওয়া হয়। বুথের ভিতরে তিনজন পোলিং এজেন্টকে আড্ডা দিতে দেখলাম। হ্যাঁ, একজন বন্দুকধারী পুলিশকেও দেখেছিলাম।
টেনশন শুরু হল, ভোট দিয়ে ফিরে, টিভিতে খবর দেখে। মনে হচ্ছে ভয়ঙ্কর দাঙ্গা লেগে গেছে। চারদিকে ধুন্ধুমার কান্ড হচ্ছে। ফিরব কী করে? কিন্তু ফিরতে হবেই। তাই বিকেলে একটু সময় নিয়ে বের হলাম। সেই একই রাস্তা। পরিবেশ আগের মতই শান্ত। কিন্তু টেনশন যায় না। দুর্গাপুর স্টেশনে নেমে তাই কর্মসূত্রে পরিচিত দু-একজনকে ফোন করে বাঁকুড়ার পরিস্থিতি জানতে চাইলাম। ওরা নিশ্চিন্তে ফিরতে বলল। এদিকটায় কোনও সমস্যা হচ্ছে না জানাল। ফেরার পথে আমারও কোথাও কোনো অশান্তি গন্ডগোল চোখে পড়ল না। সকালের মতই শান্ত পরিবেশ। শুধু একটা জয়গায় তখনও ভোট চলছে, ভোটারদের লাইন দেখলাম। কর্মস্থলে ফিরলাম রাত ন- দশে। টিভিতে খবরে দেখলাম চারদিকে কত অশান্তি। যতবারই দেখি, মনে হল, আমার মত ভোট দেওয়ার অভিজ্ঞতা ভাঙড় কিংবা ডোমকলের লোকজনের কেন হয় না?