ধুন্দুলের লতা বা আকন্দের চারা যদিবা দেখেছি, তাও মনে হয় যেন বিগত জন্মের স্মৃতি, কাউরি গ্রাম-ফেরতা কোন গুনিনের সঙ্গেই কোনদিন কোন লেনাদেনা গড়ে ওঠেনি। না ভয়ের, না ভালবাসার। অবশ্য সে দেখলে শ্যাখের বিবি হালিমার ঘরকন্নাই বা কোন সুতোয় চেনা! তবু একুশ বছরের দিদির বিয়ের দায় মাথায় চাপানো চৌদ্দর ছোটভাই এর শিশু শ্রমের গল্পটা চেনা চেনা লাগে যে! আর তারই মাঝে লেখক কেমন বুনে দেন শবেবরাতের মোমের আলো আর দোলের চাঁদের পৃথগন্ন হওয়ার কিসসা।
“বন্ধ হয়ে গেল বড় বাঁশের মাথায় ডালা ঝুলিয়ে সবাই মিলে দরজায় দরজায় ছড়া কেটে ঘোরা,” দিলিদিলি মহাম্মদ, আখেরাতের মহাম্মদ/ যে দিবে জোড়া পিঠা/ তার হবে জোড়া বিটা/ যে দিবে ছিঁড়া পিঠি/ তার হবে কানা বিটি।”
এইভাবেই না কত চতুরতার সঙ্গে গেরস্তের থেকে পিঠে সংগ্রহ করত বাচ্চাবুড়োরা! কানা বিটি হবার ভয়ে তাদের ডালা ভরে উঠত নিখুঁত পুরুষ্টু স্বাদু পিঠেয়। কী যে দিনকাল এল, এ সবই এখন বন্ধ হবার মুখে।”
-গুনিন
এই দরদী অক্ষরস্বাক্ষর চিনে নিতে ভুল হয় না। প্রতিভা সরকারের প্রথম বই, ফরিশতা ও মেয়েরা (গুরুচন্ডালি) প্রকাশ পায় ২০২০ সালে, তারও আগে থেকে লেখকের সঙ্গে পরিচয়। আত্মজা, দেবদাসী, জল প্রতিটি গল্পপাঠই যেন নতুন, নতুন যন্ত্রণার অভিমুখ খুলে দেয়। সেই থেকে ছায়াবৎ তাঁর কলমকে অনুসরণের শুরু। ফরিশতা ও মেয়েরা (গুরুচন্ডালি) থেকে শুরু করে সদাবাহার (সৃষ্টিসুখ), শ্মশানবন্ধু ও অন্যান্য গল্প (বার্ণিক) হয়ে গুণিন ও বেলেহাঁস (গুরুচন্ডালি) অবধি এই যাত্রা চলেছে, চলছে।
***
শেষতম গল্প-সংগ্রহটি পড়ে উঠলাম সদ্য। গুণিন ও বেলেহাঁস। যে বইএর শুরু গুণিন গল্পটি দিয়ে। আর যাত্রার আপাত সমাপ্তি বেলেহাঁস গল্পে। ছোটগল্প পাঠক চিনে নেয় নিজের মতন করে। কোন গল্প কার কেন ভাল লাগে, কোন চেতন-অবচেতন অভিজ্ঞতার সঙ্গে মিলে গিয়ে মনে ঝংকার তোলে সে কথা বলা দুষ্কর। তাই গল্প নিয়ে যে কোন আলোচনাই নিতান্ত ব্যক্তিগত। ভাল লাগা-মন্দ লাগাও। তবু এইটুকুই বললে হয়ত আরও বেশ কিছু জনের সঙ্গে মতের মিল হবে, যে প্রতিভা সরকার একজন সমাজ-সচেতন লেখকের নাম। তার কাহিনীর বাহন বেশিরভাগ সময় এক কাব্যধর্মী মোলায়েম ভাষা, অথচ তার কাহিনীর বিন্যাস সাধারণত এমনই যেন গল্পটা এক বস্কিং রিঙের চৌহদ্দি। মুষ্টিযোদ্ধা সেখানে রিং জুড়ে উড়ে বেড়ান। তাঁর কাটান-চাপানের পায়ের ছন্দে মোহিত হন দর্শক। কেয়াবাত বোল ওঠে। তাঁর ফাঁকে পূর্ণ-গোচরে অথচ প্রত্যক্ষ চেতনার অগোচরে হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়,। এক আকস্মিক মুহূর্তে সামনের চোয়ালে আছড়ে পড়ে। যেন ভেলভেটে মোড়া নিখুঁত ছোবল। চুরচুর হয়ে যায় সামনের সব প্রতিরোধ। ভূমিশয্যা ছাড়া আর কোন গতি থাকে না তার। পাঠকের।
ভাষা, কাহিনী-বিন্যাসের সঙ্গে যোগ দেয় আঞ্চলিক বাক-কৌশল, স্থানীয় লৌকিক-প্রতীকের অমোঘ ব্যবহার। কাল পরিধির নির্মাণের পাশাপাশি তারা গড়ে তোলে গল্পের নিজস্ব আবহ। সব মিলিয়ে তাঁর হাতের সব লেখাই একটি প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে যায়, যে স্তরে পৌঁছানই অনেক লেখকের কাছে শ্লাঘার বিষয়। আর কোন কোন গল্প তারই মধ্যে পাঠককে ছুড়ে দেয় এক উচ্চ শিখরে। সেই বিন্দুতে গদ্য, ফর্ম, কনটেন্ট ইত্যাদির কচকচি বৃথা হয়ে যায়। লেখক ও প্রকাশককে ধন্যবাদ এই রকমই বেশ কয়েকটি গল্প এই সংকলনে স্থান পেয়েছে। সংকলনের শুরুর গল্প গুনিনের কথা দিয়ে এই লেখার শুরু করেছি। এই পর্দা-তোলা গল্পটি ছাড়াও উত্তরাধিকার, কণ্ঠস্বর ইত্যাদি গল্পগুলি এই পাঠকের ব্যক্তিগত মতে সেই চুড়া ছুঁয়েছে। গল্পগুলির পা চারপাশের সমাজ-সংসারে শক্ত করে গাঁথা, বিষয়-নির্বাচনে আর জোরালো উপস্থাপনায় অপ্রতিরোধ্য। কোথাও প্রতিভা নির্বিবাদী বিশ্বাস থেকে দ্বন্দ্বের দোলাচলময়তায় দিকে যাত্রার কথা বলেন, কোথাও কৃপণ শব্দের পরিসরে গড়ে তোলেন এক পিতৃতান্ত্রিক পৌরুষ-ক্ষমতার পরম্পরাগত প্রশ্নহীন প্রবাহের কাহিনী।
আরও আছে। ধরা যাক শেয়াল-মারা গল্পটির কথা। এই গল্পে তাঁর কলমে ভেসে ওঠে আমাদের অ্যানথ্রপসেন্ট্রিক দুনিয়ার নিয়মনীতি অগ্রাহ্য করে গড়ে ওঠা এক মানুষী মায়ের সঙ্গে এক না-মানুষী আসন্নপ্রসবার সংবেদী বন্ডিং এর কাহিনী। এতোই সেই টানের জোর যে তার দরুন নিজের কৌমের সোল্লাস হননেচ্ছার বিপরীতেও যেতে কন্যা দ্বিধাহীন। কেন জানি না শেয়াল-মারা পড়তে পড়তে মনে পড়ে "ফরিশতা ও মেয়েরা" বইয়ের নাপাক গল্পের গৃহবধূ রাবিনাকে। সেও আরেক মানুষ আর না-মানুষের গভীর ভালবাসার গল্প। কিন্তু মুসলিম ধর্মমতে প্রাণীটি যে নাপাক। তাহলে? তাহলে কি হল জানার জন্য মূল গল্পই আছে, তবু রাবিনার মত আমরাও তো ভরসা করতে চাই যে কোন মানবধর্মই কোন প্রাণীকে নাপাক বলতে পারে না, বলে নি।
প্রকৃতপক্ষে ফরিশতা ও মেয়েরা বইয়ের গল্পগুলি যেখানে থেমেছে, গুনিন ও বেলেহাঁস বইয়ের গল্পগুলো যেন ঠিক সেইখান থেকেই শুরু। বইগুলির গল্প পড়ার সময় স্পষ্ট অনুভব করা যায় কলমের ডগায় নেচে বেড়ানো শব্দগুলোর থেকে ফেরেশতার আশীর্বাদ ঝরে পড়ছে। আশ্চর্য গদ্য, অসামান্য বিষয়-নির্বাচন, তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের ক্ষমতার পাশাপাশি লেখিকার মায়া টলটলে দেখার চোখ – সব মিলিয়ে এক একটা অসাধারণ কাহিনীর বুনোট। প্রতিভা গল্প-ই বলেন। একেকটি নিটোল গল্প। তবু বলার জাদুতে অনেক গল্পই যেন বুলস-আই তে গিয়ে লাগে।
ফরিশতা বইতে প্রতিভা লিখেছিলেন তেভাগুর কথা। অবিশ্বস্ত প্রেমিক গোপাল আর নবকলেবরের জগন্নাথ এক হয়ে যায় বাপ-মরা পতিতাবৃত্তির দরজায় পা রাখা অনিচ্ছুক মেয়েটির কাছে। কী অনায়াস মুনশিয়ানার সঙ্গে স্থানীয় নবকলেবর সংক্রান্ত বিশ্বাসটির কথা ব্যবহার হয়েছিল এই গল্পে। বর্তমান সংকলনেও ঠিক তেমনই দক্ষতায় জঙ্গলের বিষ গাছের কাহিনীর পাশে পাশে উত্তরাধিকার গল্পটি বিস্তার পায়। এক অসামান্য গল্প! আসলে প্রতিভার লেখনীতে গল্প গঠনের অভিনবত্ব, ভাষা-সৌকর্য বা বুনটের দক্ষতা এইসব তো আছেই, সবার উপরে আছে পাঠকের মনে ঢেউ তোলার ক্ষমতা। এইখানটাতেই লেখিকা বাজী জিতেছেন। আর এই পরিচয় তাঁর সব গল্পে গল্পে বিছিয়ে, এই সংকলন ছাড়িয়ে অন্য সংকলনে।
প্রতিভার লেখা বৈচিত্র্য-বিলাসী। ফরিশতা ও মেয়েতেও দেখা যে তাঁর গল্পরা শুধুই বাংলার চেনা পরিসরে আটকে থাকেনি, সারা ভারত জুড়ে তারা শিকড় বিস্তার করেছে। গুনিন ও বেলেহাঁসেও সে সীমানা-উল্লঙ্ঘনের স্পষ্ট ছাপ। চরিত্রগুলিও বিচিত্র। গ্রামীণ আকালু গুনিন থেকে নাগরিক গৃহবধূ ঈশা – সকলেরই বিচারণ প্রেক্ষিত আলাদা। তবু তাতেও চরিত্রগুলির জীবন্ত হয়ে উঠতে অসুবিধা হয় না। ভালবাসা শব্দটিও প্রচলিত পরিসরের বাইরে গিয়ে কতই না শেডে ধরা পড়ে। ভ্যালেন্টাইন্স ডে’র ( অথবা বসন্তপঞ্চমীর ) ক্ষুদ্র পরিসরে ধরা না পড়া বাস্তব জীবনের অচেনা, প্রায় আবাঙমনসাগোচর ভালবাসারা গভীর থেকে আচমকা ভেসে উঠে শান্ত জলতলে ছোট্ট ঘাই মেরে যায়।
‘গুনিন ও বেলেহাঁস’ বইতে প্রতিভা সরকারের চেনা ধাঁচের সামান্য বাইরের কয়েকটি গল্পও আছে। যেমন সত্যি মিথ্যে বা বেড়াল-কুকুরের মা একটা আবছা অথচ কৌতূহল-জাগানো, অন্যতর উন্মোচনের ঈশারা দেয়।
মোটের উপর, এই গল্পগুলো পড়া একটা অভিজ্ঞতা। সাহিত্য মূল্যের দিক দিয়ে তো বটেই, আমাদের খাড়া-বড়ি-থোর নিত্য জীবনের বাইরেও সমান্তরাল বয়ে যাওয়া একটা অন্যতর জীবনের সন্ধান পাওয়ার জন্যেও বটে।
গুনিন ও বেলেহাঁস
লেখকঃ প্রতিভা সরকার
প্রকাশকঃ গুরুচণ্ডা৯
মূল্য – ১১০ টাকা