সম্ভাবনাহীনতার সাথে মানিয়ে নেওয়া তুলনামূলক অনেক সহজ, সম্ভাবনা জাগিয়ে তলিয়ে যাওয়ার থেকে। চোখের সামনে সম্ভাবনার অপমৃত্যু দেখার কষ্ট কেবল ভুক্তভোগীরাই জানবেন। আর ঠিক এই কারণেই বিরহী নিয়ে কিছু লিখতে বসা। এমনিতে সিনেমা/সিরিয়াল এর রিভিয়্যু লিখি না – প্রথমত লেখার মত সাবজেক্ট খুঁজে পাই না। বেশির ভাগ সিনেমা বা সিরিয়াল যা নিয়ে হইচই হয়, সেগুলোতে বিশেষ ইন্টারেস্ট নেই ব্যক্তিগতভাবে।
কিন্তু চেনাশোনা বা একদম অচেনা লোকজনের মুখে ‘বিরহী’ নিয়ে মারকাটারি প্রতিক্রিয়া পড়ে মনে হল এটা দেখতেই হয়। এবং তার থেকেও বড় কথা শুনলাম – এই প্রথম নাকি এক বাঙলা সিরিয়াল হচ্ছে যেখানে ‘গ্রাম’ প্রস্ফুটিত হচ্ছে নিখুঁতভাবে। বলাই বাহুল্য, আমি এই সিরিজের নির্মাতাদের এমন দাবী শুনিনি – ইনফ্যাক্ট তাঁদের এমন কোন দাবী সম্বন্ধেই আমি নিজে ওয়াকিবহাল নই, যেখানে তাঁরা নিজেদের এই সিরিজকে যুগান্তকারী বা পথ প্রদর্শনকারী বলেছেন। তাই মনে হয়, যা কিছু অত্যুচ্ছাস এবং দাবীদাওয়া – সবই আমাদের মত দর্শকবৃন্দের। ঠিক এইখানটাতেই হালকা সমস্যা থেকে যায়।
কেউ যদি বলেন, তাঁর এই সিরিজ ভালো লেগেছে বা লাগেনি – তা নিয়ে বিশেষ তর্ক হতে পারে না। কারণ ওই যে, কথায় বলে, ‘পছন্দ নিজের নিজের’। কিন্তু কেউ যদি কোনো কিছুতে স্ট্যাম্প মারতে চান বিশেষ দাবী নিয়ে – তাহলে মনে হয় একটা দায়বদ্ধতা থেকে যায় ব্যাপারটা একটু খুলে বুঝিয়ে বলার, যে ভাই, আমি এই এই জন্য এই জিনিসকে তুলনাহীন মনে করছি। এখানে আবার কিন্তু তর্ক করার জন্য চতুরভাবে ‘রিলেটিভ’ এবং ‘অ্যাবসলিউট’ মিশিয়ে দিলে হবে না! যে সমস্ত প্রচণ্ড ফালতু টাইপের বাংলা সিরিজ বা সিরিয়াল আমাদের খাওয়ানো, গেলানো বা সামনে পরিবেশন করা হয় – তার থেকে বিরহী অনেক আলাদা, একঝাঁক তাজা হাওয়া এনে দিচ্ছে – এই নিয়ে কোনো দ্বিমত নেই। তাই এই লেখায় সেই বাংলা সিরিজের ‘রিলেটিভ’ তুলনা থাকবে না; আমার ইন্টারেস্ট – এই সিরিয়ালে সত্যিই কি ‘গ্রাম’ ফুটে উঠেছে অথেন্টিক ভাবে – সেই নিয়ে একটু তলিয়ে দেখা।
তাই আরো গভীরে ঢোকার আগে কিছু ডিসক্লেমার – যদি কেউ মনে করেন, ভাই, কেউ তো দাবী করেননি যে ‘বিরহী’ বাংলার গ্রাম অথেন্টিকভাবে ফুটিয়ে তুলছে, তুমি নিজেই ছায়াযুদ্ধে মেতেছ – তাঁদের উদ্দেশ্যে বলা, এই লেখাটা সিম্পলি এড়িয়ে যান। বিরহী আপনাকে প্রভূত আনন্দ দিয়েছে, এই নিয়ে আমার কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।
আমার লেখালেখি যাঁরা পড়েন, তাঁদের অনেকেই জানেন, যে গ্রাম নিয়ে স্পর্শকাতরতা একটু বেশিই। বাংলা সাহিত্যে, সিনেমায়, সিরিয়ালে গ্রামভিত্তিক যে ভাঁড়ামো প্রদর্শন করা হয় এবং যে ভাবে গ্রাম-কে রিপ্রেজেন্ট করা হয়, সেই নিয়ে আমার অনেক খেদ। নিজের সীমিত সামর্থ্যে ভনিতাহীন গ্রামের গল্প লেখার চেষ্টা করে চলেছি। বিরহী-র প্রথম ফিডব্যাক পড়ে তাই নড়েচড়ে বসা।
আর একটা ব্যাপার – এই সিরিজের পরিচালক, লেখক, কলাকুশলীরা কতটা প্রতিভা দেখিয়েছেন অন্য ক্ষেত্রে, সেটাও এই লেখার বিচার্য নয়। এই লেখায় কেবলই বিরহী-তে যা দেখানো হয়েছে, যেমন দেখানো হয়েছে – তাই নিয়ে আলোচনা।
মফস্বল এবং গ্রাম – এই দুইয়ের স্পষ্ট সীমারেখা ক্রমশ মুছে আসছে। কার উন্নতি বা অবনতি হচ্ছে বা কে কাকে ঘিরে ফেলতে চাইছে – সেই সব জটিল ব্যাপারে ঢোকা এই লেখার বিষয়বস্তু নয়। বিরহী দেখে আমার যেটা মনে হল, মফস্বলের ব্যাপারস্যাপার তুলনামূলক ভালো ভাবে ফুটে উঠেছে – গ্রামের ব্যাপারস্যাপারের থেকে। গল্পের শুরু হচ্ছে কৃষ্ণ নামক ছেলেটার প্রেমিকার সাথে বিচ্ছেদের ঘটনা দিয়ে। নির্মীয়মাণ ফ্ল্যাটবাড়ি বা ইমারতের এক কোণে প্রেমিকার ঘোষণা, যে অন্যজনের বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, এবং আর সিদ্ধান্ত ফিরে দেখার উপায় নেই, চলে যাবার আগে সাহসী চুম্বন – এই সবই বিশ্বাসযোগ্য লাগে, এ গল্প আমরা অনেক শুনেছি এবং দেখেওছি। কেউ বললেন, নতুন গড়ে ওঠা ইমারত এবং পুরানো ভেঙে ফেলা বাড়ির মাঝে দাঁড়িয়ে এমন ছেড়ে যাওয়া নাকি সিম্বলিক কিছু ইঙ্গিত করছে! ভাবলাম, হবেও বা! কিন্তু আরো কয়েকটা পর্ব দেখার পর সিদ্ধান্তে এলাম, যে এর মধ্যে সিম্বলিক কিছু নেই – কৃষ্ণ এবং তার প্রেমিকা একটু নির্জনে কথা বলার জন্য সেটিং খুঁজছিল।
এরপরে কৃষ্ণ যখন তার বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে বা এমনি কথা বলছে, সেই ভাষ্যও খুব কনভিন্সিং – কেমন অবলীলায় তথাকথিত বাংলা স্ল্যাঙ ব্যবহার হচ্ছে, ঠিক এমনটা করেই তো আমরাও কথা বলেছি বা বলি! এ তো আমাদের নিজেদেরই গল্প – নড়েচড়ে বসি! তারপর চাকরির ট্রান্সফার নিয়ে টাকা-পয়সা খাবার ব্যাপারটা গল্পে দেখা দিয়ে যায় – ওদিকে দেখি প্রাইভেট মাস্টার-দের সাথে কেমন ব্যবহার করা হয়। এ সবই জীবনের বড় কাছাকাছি, বাস্তবেরও – ব্যাকগ্রাউন্ডে প্যানপ্যানে চেনা মেলোড্রামাটিক মিউজিক বা হিন্দি গান বাজে না। বরং শুরু হয় কীর্তন – সাত্যকির গলায়। এ জিনিস আগে দেখিনি, শুনিনি বাংলা সিরিজ বা সিরিয়ালে গানের এমন প্রয়োগও – প্রত্যাশা বাড়তে থাকে।
কিন্তু তাল একটু একটু করে কাটতে থাকে প্রথম পর্বেই – আমার তো মনে হল শহর/শহরতলি থেকে যখনই পরিচালক গ্রামের ভিতরের গল্পে ঢুকেছেন তখন থেকেই। প্রথম পর্বেই দেখতে পাই – কৃষ্ণকে সাইকেল কাঁধে করে পার হতে হয় একটা জলা, সেই বিরহী গ্রামে পৌঁছবার জন্য। কলকাতা থেকে ঘন্টাতিনেকের দূরত্বে এখনো এমন গ্রাম থাকতেই পারে – যেখানে যেতে হলে জলা পেরোতে হয়, কিন্তু সেই পেরোবার জন্য কোনো বাঁশের সেতু নেই, বা নিদেনপক্ষে একটা নৌকা – এটা মনে হয় খুব একটা বিশ্বাসযোগ্য নয় এখন। সে যতই শর্টকার্ট রাস্তার গল্প শোনানো হোক না কেন! আজ থেকে তিরিশ বছর আগে সাইকেল কাঁধে নিয়ে এমন জলা পেরনো কষ্টকল্পনা না হলেও (আমি নিজে সাইকেল কাঁধে নিয়ে বর্ষাকালে গ্রামের রাস্তা পেরিয়ে স্কুল গেছি) – এখন তেমন অবস্থা খুব একটা নেই। তার থেকেও বড় কথা, যখন জলা পেরুচ্ছে সাইকেল নিয়ে, তখনই ব্যাকগ্রাউন্ডে দিব্য পাকা রাস্তায় হইহই করে বাইক যাচ্ছে। আর একটা ব্যাপার মনে হল – পরিচালক এত ডিটেলস-এ সাইকেল নিয়ে জল পেরনো দেখালেন, তাহলে ভিজে জাঙিয়াটা নিয়ে কৃষ্ণ কি করল প্রথম দিন – সেটার ব্যাপারে আমার ধন্দ থেকেই গেল!
এবার গ্রামের যা কিছু দেখানো হয়েছে, সব কিছুই যে অবাস্তব তেমন নয় – মোবাইল নিয়ে চায়ের দোকানে খেলা, বাচ্চাদের স্কুলে না আসা – এগুলো এখন গ্রামের দিকে বাস্তব। কিন্তু পরিচালক সেই ব্যাপারটার উর্দ্ধে উঠতে পারলেন না (বা চাইলেন না), যা তাঁর আগেও কেউ করতে চাননি – তা হল গ্রামের লোকদের নিয়ে অহেতুক ভাঁড়ামি। গদাই-য়ের সেক্সের ওষুধ বিক্রির ঘটনা বা তারপরে বোম বলাই-য়ের বাড়ি গিয়ে সেই ভাঁড়ামো বারে বারে চোখে লাগতে লাগল। এই ভাবে ইংরাজি বলা দেখাতে হবে? যে পরিচালক সাত্যকীর কীর্তন শোনাচ্ছেন একদিকে, সেই তিনিই আবার দেখাচ্ছেন বোম বলাইয়ের বউ দু’খানি বোমা নিজের বুকের কাছে ধরে আছেন মাষ্টারকে দেখাতে গিয়ে! এতটা স্থূলতা ঠিক মেলাতে পারি না –
আর না মেলাতে পেরে ইউটিউবে বিরহী-র নীচে কমেন্টগুলো পড়ছিলাম কিছু কিছু। তাতে যা মনে হল, এই সিরিজ নিয়ে শুধু শহরের লোকেরাই উচ্ছ্বসিত এমন নয় – অনেক গ্রামের দিকের (সংখ্যায় কম হলেও কিছু কমেন্টে এমনটাই মনে হল) লোকও দারুণ, দারুণ বলে নিজেদের ভাব প্রকাশ করেছেন। এবার আমি নিজে কনফিউজড হয়ে যাই – আবার খানিক ভাবার পরে তেমন অবাকও হই না অন্তত! অথেন্টিসিটি নিয়ে কেউ মাথা ঘামাচ্ছে না – ভাঁড়ামোর আড়ালে স্থূল রসিকতা পরিবেশিত হচ্ছে, আমরা হাসছি, সেইগুলো গ্রামের টিপিক্যাল ব্যাপার বলে মান্যতা পেয়ে যাচ্ছে! যেভাবে বলাই আর ট্যাঁপার বোমার লড়াই হচ্ছে, তেমনভাবে ক্লাস সিক্সের ছেলেরাও মারপিট করে না আর! আমার মনে হচ্ছে না পরিচালক এগুলো জানেন না – কারণ তিনি গ্রামীণ স্ল্যাং, যেমন বাঁড়া, বোকাচোদা, ল্যাওড়া, বাল – এগুলো প্রায় অভ্রান্তভাবে ডায়লগে ঢুকিয়েছেন, আর অন্য দিকে দেখিয়ে যাচ্ছেন ভাঁড়ামো! এমন দ্বিচারিতা কেন গ্রামের গল্প পরিস্ফুটন করতে গিয়ে?
গল্পের গরু গাছে উঠছে, যখন দেখা যাচ্ছে লোকাল মস্তান ট্যাঁপা বাসের ফ্রন্ট সিটে বসে কোমরে গোঁজা পিস্তল বের করে কৃষ্ণকে ভয় দেখাচ্ছে। পিস্তল বের করাটা অবাস্তব নয় – অবাস্তব এই ব্যাপারটা, যে সমস্ত গ্রামের নির্জন রাস্তায়, মানে যে রাস্তায় কৃষ্ণ প্রায় একাকী সাইকেল চালিয়ে যায়, তার মাঝে কোথাও ওকে না ধরে, বাসে উঠে কৃষ্ণকে ভয় দেখাতে আসে!
তৃতীয় পর্বে কৃষ্ণের সাথে দেখা হয় রাধার – গল্পে এবার ঢুকবে প্রেম। বাসে কৃষ্ণের পাশে বসে যে ভদ্রলোক যান, তেমন লোক আছে প্রচুর ডেলি প্যাসেঞ্জারি করেন – আমরা সবাই দেখেছি। কিন্তু এখানেও পরিচালক কোথায় থামতে হবে জানেন না! অনেকটা সৃজিতের সিনেমার ডায়লগের মত – রাধার প্রায় পিছনের সিটে বসে এমন জোর করে চাপানো ডায়লগ! ইন্টারেস্ট হারাতে থাকি – তবুও দেখতে থাকি এই ভেবে, যে হয়তো আবার ফিরে আসবে ট্র্যাকে।
কিন্তু চতুর্থ পর্বের শুরুতেই সেলিম নামক লোকের সাথে রুবিনার দাম্পত্য ঝগড়ার নামে যা দেখানো হল – তারপর আর এই সিরিজটাকে যাই বলা হোক, গ্রামের ট্রু-রিপ্রেজেন্টেশন বা অন্য কিছুর পথপ্রদর্শক বলে মেনে নিতে আমার অন্তত প্রবল আপত্তি। এই ঝগড়ার সময়েই দেখলাম পরিচালক প্রথম অপ্রয়োজনীয় গালাগাল ঢুকিয়ে ব্যাপারটাকে পরিপূর্ণ ভাঁড়ামিতে পর্যবসিত করলেন। যিনি রুবিনার চরিত্রে অভিনয় করলেন, তাঁর ডায়লেক্টের কথা আর বললাম না – প্লাক করা ভুরু, ম্যানিকিওর করা নখ নিয়ে ঝাঁটাপেটা চলছে – এতে আর কোনো অসুবিধা না হলেও, চরিত্র এবং কাহিনী বিশ্বাসযোগ্যতা হারায় – এই আর কী।
যাই হোক, এখনো পর্যন্ত চতুর্থ পর্ব পর্যন্ত দেখেছি। যেভাবে উৎসাহ নিয়ে দেখতে শুরু করেছিলাম, তার দশভাগও আর অবশিষ্ট নেই আমার মধ্যে। প্রথম পর্ব দেখার পর ভেবেছিলাম, দ্বিতীয় পর্ব না দেখলে কিছু একটা মিস করব – বাংলা ওয়েব সিরিজ বা সিরিয়ালের জগতে নতুন কিছু দেখা থেকে। কিন্তু সেই কথাটি আর জোর গলায় বলতে পারছি না চতুর্থ পর্ব দেখার পর – আর বাকি না দেখলেও মনে হয় না নতুন কিছু দেখা বাকি থেকে যাবে।
লেখার শুরুতে যেটা বলেছিলাম – ‘বিরহী’-র সম্ভাবনা ছিল প্রচুর, একেবারে অদেখা কিছু দেখাবার, নতুন কিছু গল্প শোনাবার – কিন্তু চতুর্থ পর্বেই দেখলাম সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু হল। অপ্রাপ্তি তো রইলোই, দুঃখও রয়ে গেল এত সুন্দর এক সম্ভাবনার এমন পরিণতি দেখে।