দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর থেকেই আমেরিকা গণতন্ত্রের ঠিকাদারি নিয়ে নিয়েছে। ষাট সত্তর দশকে তাদের এই ফোপর দালালির পরিণামে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের মুখে ঝামা ঘষে দিয়ে বিভিন্ন দেশে নানা কিসিমের বাম শাসন কায়েম করেছে। পরবর্তিকালে বামপন্থী মতাদর্শের শক্তিক্ষয়ের পাশাপাশি ইসলামিক মৌলবাদের উত্থান ঘটেছে। ২০১১ সালে নিউ ইয়র্কে ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের ওপর জঙ্গিদের দুঃসাহসিক আক্রমণ মার্কিনিদের বিশ্বজুড়ে মাতব্বরি করার সুবর্ণ সুযোগ এনে দেয়। এই ব্যাপারে অতি বিশ্বস্ত লেজুড় ইংল্যান্ড ও ন্যাটো গোষ্ঠীকে তারা যোগ্য দোসর হিসাবে পেয়ে যায়। দেশে দেশে তাদের বাহিনী সন্ত্রাসবাদ দমন ও গণতন্ত্র রক্ষার পবিত্র কর্মে ব্রতী হয়। প্রতিটি দেশকে তারা ধ্বংসস্তুপে পরিণত করে, লক্ষাধিক মানুষ হত্যা করে, বহু লক্ষকে স্থানান্তরিত ও উদ্বাস্তু করে, পুতুল সরকারের মাধ্যমে ছদ্ম ভেজাল গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করে, তারপর পুরো দেশটাকে চূড়ান্ত নৈরাজ্য, ভ্রাতৃঘাতী জাতিবাদী হানাহানিতে নিমজ্জিত করে পলায়ন করে। ইরাক, লিবিয়া, সিরিয়া, ইয়েমেন, আমেরিকার এই গা-জোয়ারি নীতির এক একটি উজ্জ্বল মাইলস্টোন। প্রথম তিনটি দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ইসলামিক স্টেট ও অন্যান্য জঙ্গি গোষ্ঠীর কুক্ষিগত। অন্তরঙ্গ সুহৃদ, মৌলবাদের পিতৃভূমি সৌদি আরবের মাধ্যমে ইরান-সমর্থিত হুথি জঙ্গিদের বিরুদ্ধে প্রক্সি যুদ্ধ চালিয়ে ইয়েমেন ছারখার। যুদ্ধ ও দুর্ভিক্ষর প্রকোপে দেশটা বিধ্বস্ত, নিঃশেষিত। আর আফগানিস্তান! পেটোয়া মিডিয়ায় তো আমরা খালি আমেরিকা কতো ডলার ঢেলেছে আর তার কী রকম অপচয় হয়েছে সেটার বয়ান শুনতে পাই। বিশ বছরের যুদ্ধে ২৩১২ জন মার্কিন মেরিন মারা গেছেন। অপর দিকে আফগানিস্তান এবং সীমান্ত লাগোয়া পাকিস্তানে ২৪০০০০ জনের মৃত্যু হয়েছে যা ১১ই সেপ্টেম্বর ২০০১ এর আক্রমণে মৃত্যুসংখ্যার থেকে আশি গুণ বেশি। ৩৫ লক্ষ মানুষ দেশের অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হয়েছেন, ২৫ লক্ষ উদ্বাস্তু হয়েছেন। পিছিয়ে পড়া দেশটাকে মধ্যযুগীয় অপশাসন থেকে যাদের উদ্ধার করার কথা ছিল সেই আমেরিকার উপস্থিতিতেই এই বিভীষিকা ঘটে গেছে। এসব কিছুই কিন্তু কোনও দিন খবরে আসেনি। আমরা খালি যুক্তরাষ্ট্রের অভিবাকত্বে ‘সুশাসন’এর কথাই শুনে গেছি, গদগদ স্বরে গণতন্ত্রর ডানা মেলার গল্প শুনেছি, নারী-স্বাধীনতার কাহিনিতে মুগ্ধ হয়েছি। কিন্তু প্রকৃত ছবিটা কী? দুই দশক ধরে কী উন্নতি করলো দেশটা?
আমেরিকার সুশাসন
দাবি করা হয় বিশ বছরের মার্কিনি শাসনে মহিলাদের প্রভূত উন্নতি হয়েছে। উন্নতি মূলত দুটি ক্ষেত্রে- মেয়েরা স্কুলে যাচ্ছেন, বিভিন্ন পেশায় নিযুক্ত হয়েছেন। সেটা কিছুটা ঠিক, কিন্তু তা একেবারেই একটা সম্পন্ন বৃত্তের মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামাঞ্চলে, প্রত্যন্ত পাহাড় পর্বত এলাকায় মেয়েরা যে তিমিরে ছিলেন সেই তিমিরেই আছেন। কিছু শহরের বাইরে তথাকথিত সুশাসন আফগান সমাজে বিন্দুমাত্রও দাঁত ফোটাতে পারেনি। দাবি করা হয় সাহেবরা আসার আগে স্কুলে ছাত্রীদের সংখ্যা ছিল শূন্য, যেটা ডাহা মিথ্যা। ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ এর ২০০১ এর সমীক্ষায় বলছে নারী শিক্ষা তখন ছিল ৫.৬%, স্কুলে মেয়েদের সংখ্যা শতাংশের হিসাবে ৮%। প্রসঙ্গত ছেলেদের ছিল ২২%। সাম্প্রতিক সমীক্ষায় বলছে দেশে নিরক্ষরতার হার ৮৭%। নারী শিক্ষা সুকৌশলে বয়সভিত্তিক দেখানো হয় যার ফলে প্রকৃত চিত্রটা বোঝা দুষ্কর। ধারণা করা যায় সেটা মোটামুটি ১৬%। এটা যদি উন্নতি হয় তাহলে ব্রিটিশ আমলে ভারতেও যথেষ্ট উন্নতি হয়েছিল। ৭০-৮০% মেয়েদের বলপূর্বক নাবালিকা থাকাকালীনই বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়, ৯০% গার্হস্থ্য হিংসার শিকার, যার ফলে আত্মহত্যার হার ৮০%। সদ্য অপসারিত রাষ্ট্রপতি আশরফ গনিকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো কেন দুই-তৃতীয়াংশ মেয়ে এখনো স্কুলে যায় না। খোদ রাষ্ট্রপতি বলেন, পশ্চিমের সাহায্যকারী সংস্থার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে প্রকৃত অবস্থার কোনও মিলই নেই। অধিকাংশ বয়ঃসন্ধি[প্রাপ্ত মেয়েদের স্কুলে কোনও শৌচালয় নেই। তিন কিলোমিটারের মধ্যে কটা মেয়েদের স্কুল আছে? তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন। অভিযোগ করেন, আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞ সংস্থাগুলি পুরুষ-কেন্দ্রিক, চকচকে সব পুস্তিকা বার করে যাতে সারবস্তু কিছু নেই। বেশির ভাগ পরিবার মেয়েদের স্কুলে পাঠাতে চান না। মহিলা শিক্ষক মাত্র ২০%, বাবা মায়েরা চান না তাঁদের মেয়ে কোনও পুরুষ শিক্ষকের কাছে লেখাপড়া করুক। বাড়ি থেকে স্কুলের দূরত্ব একটা বিরাট বাধা। পথ দুর্গম, বিপদসংকুল; তালিবান তো আছেই, নানা বয়সের পুরুষ ওঁত পেতে থাকে। স্কুলবাড়ি নেই, শৌচালয় নেই, কোনও নিরাপত্তা নেই। এছাড়া তৃতীয় বিশ্বের আর সব দেশের মতো গরিবি তো আছেই; শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য স্কুলে পাঠানোর চেয়ে মেয়েদের কাজে লাগানো অনেক বেশি জরুরি। অবস্থা ভয়াবহ; বলা হচ্ছে আফগানিস্তান নারীর জন্য বিশ্বে নিকৃষ্টতম দেশ। প্রবল দারিদ্র ও নিষ্ঠুর, অমানবিক পুরুষতন্ত্রের চাপে আফগান নারীরা অসহায়, মুমুর্ষু। সংবাদপত্রে, টিভিতে এই অবদমিত, নিষ্পেতিত বিপুল নারী সমাজের খোঁজ পাওয়া যায় না। সেখানে লেখা হয় গত দুই দশকে মেয়েরা স্বাধীন, সক্রিয় জীবনের পর আবার অবরুদ্ধ। প্রশ্ন কোন মেয়েরা? মাত্র এক-চতুর্থাংশ আফগান শহরে থাকেন। তাঁদের কিয়দংশের অবস্থা সম্পর্কেই শুধুমাত্র অবহিত আমরা। কী দুঃসহ অবস্থায় বাকিরা জীবন অতিবাহিত করছেন তা অতি দুঃস্বপ্নেও আমরা ঠাওর করতে পারবো না। সমাজে গভীর, পরম্পরাগত ক্ষত, প্রকট ধর্মান্ধতা, নারী-বিদ্বেষ। বাইরে থেকে কোনও র্যাম্বো এসে M-6, M-16 বা ড্রোন দিয়ে এই সমস্যার নাগাল পাবে না।
বছর ছয়েক আগের একটি সমীক্ষায় জানা যাচ্ছে আফগানিস্তান এশিয়ার সবচেয়ে অনুন্নত দেশ। HDI ২০০১ এ ছিল ১৮৯টা দেশের মধ্যে ১৬২, এতোই সুশাসন হয়েছে যে তা ২০২০তে ১৬৯এ নেমে গেছে। আমেরিকা তো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে এসেছিলো! অথচ দেশের ৩.৮ কোটি মানুষের মধ্যে নথিবদ্ধ ভোটার মাত্র ৯৭ লক্ষ। ২০১৯র নির্বাচনে ভোট পড়েছে ২০%র কম। তালিবানি আক্রমণে প্রচারপর্ব বারবার রক্তাক্ত হয়েছে, অন্তত দুটি সুইসাইড বম্বিংয়ে প্রায় ষাট জন মারা গেছেন। এসবই হয়েছে যখন মার্কিন সৈন্য নাকের ডগায় বসে আছে।
আমেরিকা-তালিবান অন্তরঙ্গতা
২০১১ সালেই আমেরিকা বুঝে যায় ঠেকনা দিয়ে যে আফগান সরকারটাকে তারা খাড়া করতে চাইছে সেটা অপদার্থ। তাদের কোনও জনভিত্তি নেই, সাধারণ মানুষ মনে করে তারা মার্কিনিদের পদলেহী কুকুর, তাদের সেনা একটা ভাড়াটে বাহিনী। সন্ত্রাসের শিরোমণি ওসামা বিন লাদেন কিছু দিন আগেই মেরিনদের অপারেশনে নিহত। দেশে যুদ্ধের বিরুদ্ধে মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে। অর্থনীতির ওপর চাপও ক্রমবর্ধমান। এই অবস্থায় বারাক ওবামা তালিবানের সঙ্গে প্রাথমিক কথাবার্তা শুরু করার ইঙ্গিত দিলেন। নয় বাই এগারোর দশ বছর পূর্তিতে ওবামা ঘোষণা করলেন যে ২০১৪র মধ্যে সব সৈন্য সরিয়ে নেওয়া হবে। এক বছর বাদেই তালিবান কাতারে অফিস খোলার অনুমতি পেয়ে গেল। এই সময় থেকে ২০২০র ফেব্রুয়ারি অবধি অন্তত নয় রাউন্ড আলোচনা হয়েছে। খামখেয়ালি ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৭ সালে তালিবদের সঙ্গে সমস্ত রাজনৈতিক আলোচনা নিষিদ্ধ করে দেন। কিন্তু ততদিনে পরিস্থিতি আমেরিকার নিয়ন্ত্রণের বাইরে; দেশের প্রায় ৬০% তালিবানদের দখলে। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের কারণে তাঁরা প্রত্যাঘাত করলঃ খোদ কাবুলে ১১৫ জনকে নৃশংস ভাবে হত্যা করল। আমেরিকা আবার সুড়সুড় করে আলোচনায় ফিরে এল। তারা চুক্তি করার জন্য এতোটাই মরিয়া ছিল যে রাষ্ট্রপুঞ্জের জঙ্গি তালিকায় অন্যতম প্রধান ব্যক্তি, তালিবান প্রধান মোল্লা আবদুল গনি বরাদরকে পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত করে তারা আলোচনায় অংশগ্রহণ করার জন্য অনুমতি দিল। তালিবান আলোচনায় গনি সরকারের অংশগ্রহণের বিরোধিতা করল, বলল তারা পুতুল সরকার। আলোচনা গতি পেল। ২০২০র ফেব্রুয়ারিতে দোহাতে চুক্তি হল। তালিবানরা আল কায়দার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করতে সম্মত হল। তারা অঙ্গীকার করলো যে আফগানিস্তানের মাটিকে ভবিষ্যতে আর কখনো আমেরিকার বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। নভেম্বরে আসন্ন নির্বাচনের কথা স্মরণ করে ট্রাম্প সাহেব তড়িঘড়ি সৈন্য কমানোর সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলেন। প্রেসিডেন্ট গনির বিরোধিতা উপেক্ষা করে ৫০০০ তালিবকে মুক্তি দেওয়া হল। আমেরিকা তালিবানের ওপর থেকে সমস্ত নিষেধাজ্ঞা তুলে নিতে সম্মত হল।
আশ্চর্যজনক ব্যাপার হচ্ছে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যে আফগান সরকারকে তারা দীর্ঘ কুড়ি বছর অর্থ, সামরিক সাহায্য দিয়ে স্বাবলম্বী করে তোলার চেষ্টা করেছিলো তাদেরই তারা আলোচনায় ব্রাত্য করে দিল। লড়াইটা যাদের বিরুদ্ধে ছিল সেই তালিবানরাই হয়ে গেলো আমেরিকানদের মিত্র। আলোচনার শুরু থেকেই জঙ্গিদের চাপের কাছে আমেরিকা নতি স্বীকার করলো। এরপরে স্বাভাবিক ভাবেই দেশের মানুষের কাছে গনি সরকারের আর কোনও গ্রহণযোগ্যতাই রইলো না। একই রকম ভাবে আশ্চর্যজনক হচ্ছে যে কোনও যুদ্ধবিরতি ঘোষণা হল না; কোনও স্থায়ী জাতীয় সরকার গঠন করে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হল না। আমেরিকার আচরণটা হয়ে দাঁড়াল, আমরা চললুম, এবার তোমরা তোমাদের ব্যাপার বুঝে নাও। এই আচরণ অনেকের কাছে রহস্যজনক বলে মনে হয়েছে। দেশের জনমত কী এতোটাই প্রবল ভাবে বিরুদ্ধে ছিল? কোষাগারে কি এতোটাই টান পড়ছিল? ঘটনা হচ্ছে এর আগে দুবার সৈন্য অপসারণ ঘোষণা করে আমেরিকা পিছিয়ে গেছে। তারা বুঝে গেছিল যে গনি সরকার কোনও কাজের নয়, দেশটা যদি তালিবানদের হাতে যায় তো যাক। তারা উপলব্ধি করলো যে সংকট তারা নিজেরা সৃষ্টি করেছে সেটার থেকে পলায়ন করা ছাড়া তাদের উদ্ধার পাবার আর কোনও উপায় নেই।
তালিবান ও অন্যান্য দেশ
আমেরিকার প্রস্থানে চিন, রাশিয়া, ইরান, পাকিস্থান উচ্ছ্বসিত। তালিবান চিনকে কথা দিয়েছে যে উইঘুর এবং তাঁদের সমর্থনকারী ‘ইস্ট টার্কিস্থান ইসলামিক মুভমেন্ট’ কে তারা কখনই সমর্থন করবে না এবং কোনও সন্ত্রাসবাদী গোষ্ঠীকে তাদের দেশে ঘাঁটি গাড়তে দেবে না। চিন নিজেদের স্বার্থ সম্পর্কে সর্বদা সজাগ। তারা তাদের স্বপ্নের প্রজেক্ট ‘বেল্ট রোড ইনিশিয়েটিভ’ কে আফগানিস্তানে সম্প্রসারিত করতে চায়। রাশিয়া পুরানো শত্রু আমেরিকার অপদস্থতায় খুশি। মুজাহিদিন তৈরি করে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ানকে কী ভাবে অপদস্থ করা হয়েছিলো তা তাদের স্মরণে আছে। শিয়া-প্রধান ইরানের সঙ্গে সুন্নি-প্রধান তালিবানদের সখ্যতা আঞ্চলিক রাজনীতিতে একটা নতুন দিক উন্মোচিত করেছে। আমেরিকার হেনস্থায় ইরান যে খুশি হবে তা বলাই বাহুল্য, কারণ তাদের প্ররোচনায় ইরান দীর্ঘ দিন ধরে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে কোণঠাসা হয়ে আছে। আর পাকিস্তান তো তালিবানদের নিরাপদ আশ্রয়, যখনই তারা চাপে পড়ে তখনই তারা সীমানা পেরিয়ে সেই দেশে ঢুকে পড়ে। ইংল্যান্ড বলেই দিয়েছে তারা নতুন জমানার সাথে কাজ করতে রাজি। সাতকাণ্ড রামায়ণ পড়ে আজ এসে বাইডেন সাহেব বলছেন তালিবানদের আচরণ, দৃষ্টিভঙ্গি, মতাদর্শের আদৌ কোনও পরিবর্তন হবে কী না সন্দেহ আছে! এই সহজ কথাটা এতদিন কেন তাঁর বোধগম্য হয়নি এটাও একটা রহস্য! তবুও তিনি বলছেন যদি লক্ষণীয় পরিবর্তন হয় তবে স্বীকৃতি দিতে তারা দ্বিধা করবে না।
তালিবান ও ভারত
এই পুরো ঘটনায় ভারত নিছক এক পার্শ্বচরিত্র হিসাবেই থেকেছে। ভারত চাইলেও দোহায় সাম্প্রতিক কোনও গুরুত্বপূর্ণ আলোচনায় তাকে স্থান দেওয়া হয়নি, মামুলি কিছু সভায় উপস্থিত থেকেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে। মুশকিল হচ্ছে ভারতের বৈদেশিক নীতি এখন পুরোপুরি মার্কিন-ঘেঁষা, যার ফলে সাবেকি বন্ধু রাশিয়ার সাথেও তার দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কোনও সন্দেহ নেই তালিবানের উত্থান সমগ্র উপমহাদেশে ইসলামিক মৌলবাদকে অনুপ্রাণিত করবে। আর কে না জানে একটা মৌলবাদ আরেকটাকে পুষ্ট করে। সমগ্র মুসলিম সমাজকে তালিবানি আয়নায় দেখা শুরু হয়ে গেছে। প্রমাণ করার চেষ্টা হচ্ছে যে তাঁরা একই রকম ভাবে হিংস্র, বর্বর ও নারীবিদ্বেষি। যোগী সরকার দেওবন্দে সন্ত্রাসবাদ দমন সেল (ATS) এর একটা অফিস খুলে ফেলেছে, কারণ তালিবানিরা না কি দেওবন্দি ইসলামিক মতাদর্শের অনুগামী! আসামে জঙ্গিদের সমর্থনে সোশ্যাল মিডিয়ায় পোস্ট করার জন্য কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই সংকটের মধ্যেও ভারত সরকার আফগান শরণার্থীদের ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করছে। মুসলিমদের শুধু ই-ভিসা দেওয়া হচ্ছে, ছয় মাসের মেয়াদ ফুরিয়ে গেলে ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। তাই নতুন সরকারের সঙ্গে ভারতের আদৌ কোনও কার্যকর সম্পর্ক গড়ে উঠবে কিনা তা বলা দুষ্কর।
সাম্প্রতিক পরিস্থিতি
আফগানরা স্বাধীনচেতা জাতি। ব্রিটিশরাও তাঁদের পুরোপুরি পদানত করতে পারেনি। তারা ব্রিটিশদের রক্ষাধীন ছিল, প্রটেক্টোরেট। গত চার দশকে মহাপরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়ান এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কেউই তাঁদের কব্জা করতে পারেনি। দেশটা জ্ঞাতি ও উপজাতি রেষারেষি ও দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ। দেশের বিভিন্ন পকেটে, দুর্গম অঞ্চলে যুদ্ধবাজ সামন্তসর্দারদের সার্বিক আধিপত্য, যেখানে ধর্মের চেয়েও নিজের ক্ল্যান বা উপজাতির প্রতি আনুগত্যই ছিল প্রধান। আশির দশক থেকে সোভিয়েত ইউনিয়ানকে আটকানোর জন্য উগ্র ধর্মান্ধ সৌদি জঙ্গিদের মাধ্যমে আমেরিকানরা প্রথম এখানে ধর্মীয় মৌলবাদ রফতানি করে। আজকের তালিবানি উত্থান সেই নীতিরই বিষফল। এটা নিশ্চিত যে তালিবানিরা পালটাবে না। প্রতিদিন মধ্যযুগীয় বর্বরতার নতুন সব নমুনা প্রকাশ্যে আসছে। কিছু অসমসাহসী মহিলা এবং সামান্য কিছু জায়গায় সর্দারদের মিলিশিয়া প্রতিরোধ করার চেষ্টা করছে। এটা চলবে, কারণ আফগানিস্তান এমন একটা দেশ যেখানে যুদ্ধ চিরন্তন। একটাই রাস্তা, আফগানদের তাঁদের নিজেদের মতো থাকতে দেওয়া হোক। হয়তো তাতে আফগানিস্তান আগামী দিনে সৌদি আরবের মতো একটা ‘সভ্য’, ‘আধুনিক’ (যেখানে নারীদের গাড়ি চালানোর অনুমতি পাওয়ার জন্য কয়েক দশক ধরে অপেক্ষা করতে হয়) মৌলবাদী দেশ হয়ে উঠতে পারবে। ইতিহাস বারবার শিক্ষা দিচ্ছে যে বহিরাগত শক্তি সেখানে হস্তক্ষেপ করার চেষ্টা করলে শুধুমাত্র হিতে বিপরীতই হবে।