এসব কথা বিস্তারিতভাবে আমি আমার বই "আমেরিকা স্বপ্নপুরী না হত্যাপুরী?"তে লিখে রেখেছি। কিন্তু যেহেতু আমার সে বই এখনও পর্যন্ত এই দু বছরে সাড়ে পঁচাত্তর কপি বিক্কিরি হয়েছে, কারণ আমি সিপিএম নই বলে গণশক্তি সে বইয়ের রিভিউ প্রকাশ করতে রাজী হয়নি, তাই এই ফিরি ফোরামই আমার ফাইনাল ভরোসা।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র একসময়ে মধ্যবিত্তদের জন্যে, শ্রমিকদের জন্যে স্বর্গরাজ্য ছিল। লিবারাল ডেমোক্রেটিক প্রেসিডেন্ট রুজেভেল্ট অথবা কেনেডি-জনসনের সময়ে তো বটেই, গোঁড়া কেরেস্তান রিপাবলিকান আইজেনহাওয়ারের সময়েও আমেরিকায় প্রতি একশো জন খেটে খাওয়া পুরুষ ও নারীর মধ্যে চল্লিশ জন ছিল সংগঠিত শ্রমিক, অর্থাৎ লেবার ইউনিয়নের সদস্য।
"দ্য আমেরিকান ড্রীম" কথাটার উৎপত্তি সেই সময়েই। মধ্যবিত্ত মানুষের নিজেদের বাড়ি, নিজেদের গাড়ি, ঋণহীন জীবন, সপ্তাহে চল্লিশ ঘন্টা কাজ, আর বাকী সময়টা ফ্রী। সাপ্তাহান্তিক দুটো দিন ছুটি। সরকার তোমার স্বাস্থ্য ও স্কুল শিক্ষার খরচ বহন করবে, যদি তুমি ইউনিয়ন সদস্য হও।
হ্যাঁ, মার্কিনি পুঁজিবাদী মডেলেই সেসব সুখের দিন কাটিয়েছে আমজনতা। কমিউনিস্ট হতে হয়নি। ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যবধান নেমে এসেছিলো ন্যূনতম ১:৪০ রেশিওতে। অর্থাৎ, কোম্পানির মালিকের উপার্জন সাধারণ শ্রমিকের চল্লিশ গুণের বেশি নয়। আরো সহজ করে বললে, সাধারণ মার্কিনি ইউনিয়ন শ্রমিক যদি রোজগার করে ঘন্টায় পাঁচ ডলার, তার সিইও রোজগার করবে ঘন্টায় ২০০ ডলার। তার বেশি নয়।
ইউনিয়ন শ্রমিককে -- সে ইলেক্ট্রিকাল ওয়ার্কার হোক, রাজমিস্ত্রি হোক, কর্নফিল্ডের চাষী হোক অথবা স্কুল টীচার -- কোনোভাবেই যখন তখন ছাঁটাই করে দেওয়া চলবে না। এমন কি, ছাঁটাই হয়ে গেলেও ইউনিয়ন ও সরকার তাকে বেকার ভাতা দিতে বাধ্য থাকবে।
তারপর এলো ১৯৮০। ব্রিটেনে মার্গারেট থ্যাচার, এবং এই আমেরিকায় রোনাল্ড রেগান। শ্রমিক ইউনিয়নকে ভেঙেচুরে গুঁড়িয়ে দেওয়া হলো। মার্কিন পুঁজিবাদ ও ব্রিটিশ পুঁজিবাদ ঘোষণা করলো, মানুষ মানুষের জন্যে। অর্থাৎ, ইউ আর অন ইওর ওন। নিজের বেওস্তা নিজে করো। আরো সহজ বাংলায়, তুমি ভোগে যাও।
আজ রেগান-থ্যাচারের পঁয়তাল্লিশ বছরের শুভলাভ অ্যানিভার্সারিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি একশো জন খেটে খাওয়া পুরুষ ও নারীর মধ্যে মাত্র ৯জন ইউনিয়ন মেম্বার। ভারতে আরো কম -- ৭জন।
*আমেরিকায় কোম্পানির সিইও অর্থাৎ মালিক সেই কোম্পানির সাধারণ শ্রমিকের উপার্জনের এক হাজার গুণ রোজগার করে। অর্থাৎ, আমার ছাত্রছাত্রীরা হিসেব কষে বের করেছিল -- ডিজনি বা আমাজন বা টেসলা বা ফোর্ডের একজন মালিক মাত্র এক ঘন্টায় যা রোজগার করে, একজন সাধারণ শ্রমিকের সেই পরিমাণ উপার্জন করতে লেগে যাবে চার থেকে ছয় মাস।*
ভারতে কতদিন লাগবে, তার অঙ্ক আবিষ্কার হয়নি এখনো।
তা, আমার ওই সাড়ে অষ্টাশি কপি বিক্কিরি হওয়া বইটাতে অন্য কিছু অঙ্ক আমি দিয়েছি। তার একটা হলো, সারা পৃথিবীর ভোগবাদী, ধনী দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে শোচনীয় অবস্থা কোন দেশের? অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা তো এক্ষুণি বললাম। এবারে যোগ করুন স্বাস্থ্য (কোভিডে সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মৃত্যু -- বারো লক্ষ মানুষ ভোগে গেছে এই আমেরিকায়), শিক্ষা (একশো জনের মধ্যে মাত্র চল্লিশ জন কলেজে যায় এই আমেরিকায়), সারা পৃথিবীর টোটাল বন্দী সংখ্যার এক চতুর্থাংশ এই আমেরিকায় -- কিন্তু তাকে বলা হচ্ছে ল্যান্ড অফ দ্য ফ্রী -- ভানু জহরের হাস্যকৌতুকের থেকেও মজা, টিন প্রেগনেন্সি, ড্রাগ ব্যবহার, পর্নোগ্রাফি, ওবেসিটি, জাঙ্ক ফুড, রাস্তাঘাটে মলে সিনেমা হলে স্কুলে বন্দুকবাজি, পুলিশি নির্যাতন ইত্যাদি ইত্যাদি ভালো ভালো জিনিস -- সবকিছুতেই আমেরিকা সারা পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে এগিয়ে।
মানে, পিছিয়ে।
ব্যাংকে আপনার টাকা রাখলে সুদ পাবেন ০.৫% .হ্যাঁ, ঠিক শুনেছেন, ০.৫%. কিন্তু আপনি সেই একই ব্যাংক থেকে গাড়ি বা বাড়ি কেনার জন্যে লোন চাইতে গেলে আপনাকে দিতে হবে ১২ থেকে ২০ পার্সেন্ট। এদেশে কেউ কোনো প্রশ্ন করেনা। যারা প্রশ্ন করতো, তাদের ভেঙে গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
তাদের নাম ছিল শ্রমিক ইউনিয়ন।
ভারতে ও বাংলাদেশে মোদীমোহম্মদমোহন মডেল এই আজকের আমেরিকার মডেলের অতি বাধ্য ছাত্র। অনুগত, প্রশ্নহীন শিষ্য।
ও হ্যাঁ, বলতে ভুলে গেছি, মে দিবসের ইতিহাস কিন্তু আসলে মার্কিনি ইতিহাস। শিকাগো বলে একটা ভীষণ শীতের জায়গায় এই দারুণ উষ্ণ ইতিহাসের শুরু -- পুলিশের বন্দুকের গুলিতে। গরম রক্ত ঝরেছিল মার্কিনি শ্রমিকদের সেই ঐতিহাসিক দিনে।
মার্কিনি মিডিয়া মানুষকে ভুলিয়ে দিয়েছে। যদি আমার ওই বইটা পড়তেন, মিডিয়ার দরকার হতোনা। বইটারও আরো গোটা পঞ্চাশ বিক্কিরি হতো।
যাক সে দীর্ঘশ্বাসের কথা।
____________
মে দিবস, ২০২৫
নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র